প্রেম_এসেছে_গোপনে #পর্ব_০২ #অনন্যা_অসমি

0
369

#প্রেম_এসেছে_গোপনে
#পর্ব_০২
#অনন্যা_অসমি

চুলে চিড়ুনি করতে করতে আচমকা থেমে গেলো আরশিয়া। মানসপটে ভেসে উঠলো ওয়াসিমের সেই অগোছালো, ক্লান্তিমাখা মুখশ্রী। কেন যেন বারংবার তার সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে সে। ওয়াসিমের কথা আরশিয়া আগে কাস্মিনকালেও শোনেনি। অবশ্য যেখানে সে জায়রা, জুবাকেই এই প্রথম দেখেছে, সেখানে ওয়াসিম তো ধারণারই বাইরে।

” কি গো সুন্দরী, আয়নার দিকে তাকিয়ে কার কথা ভাবছো? আমার কথা বুঝি?”

আচমকিক কারো কণ্ঠস্বরে চিন্তার ইতি টানলো আরশিয়া। ঝটপট চুল বেঁধে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।

” ইশ, এভাবে তাকাবেন না দামী নূর কহিনূর আপু। এখানটা বড্ড লাগে।” বুকের বাম পাশটায় আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল ইনান।

” আন্টিকে তাহলে বলতে হবে ওনার ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য।”

” আরে এসব ডাক্তারে কিছু হবেনা, আমার এই বুকে ব্য’থা তো একমাত্র আপনিই সারিয়ে তুলতে পারবেন। এই বুকে ব্য’থার কারণ যে আপনিই দামী নূর কহিনূর আপু।”

আরশিয়া এবার বেশ বুঝতে পারছে ইনানের হাবভাব। আড়াআড়িভাবে বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে সরু চোখে সে তার দিকে তাকালো।

” এভাবে তাকাবেন না গো আপু, দেখা যাবে আপনার এই চাহনি সহ্য করতে না পেরে আমার হৃদয় ব্লাস্ট করে বসল। তখন কিন্তু আপনাকে পুলিশে নিয়ে যাবে। আপনাকে পুলিশে নিয়ে গেলে তখন দেখা যাবে সেই শোকে কেউ শোকাহিত হয়ে দেবদাস বনে গেল, নয়তো অগ্নিমূর্তি হয়ে মৃ’ত আমিকে আবারো মেরে ফেলল।”

ইনানের কথা শুনে আরশিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো।

” মানে? কি বলতে চাইছো তুমি ইনান?”

” আব.. ও কিছু না। এই নাও তোমার জন্য কোকাকোলা। স্পেশালি তোমার জন্য একদম নরমালটা আনা হয়েছে, তোমার তো আবার ঠান্ডায় সমস্যা। নাও নাও, চটজলদি খেয়ে নাও।”

” আমার জন্য আবার কেন আনতে গেলে?”

কিছু একটা বিড়বিড় করে ইনান বলল,

” আমরা সবাই খেলাম আর তুমি খাবেনা তা কি করে হয়? তুমি আমাদের অতিথি, অতিথিকে না দিয়ে আমরা কি করে খাই বলো? ফুফি, চাচী এনারা জানার আগেই নিয়ে এলাম, না হলে বকা শুনতে হতো।”

” কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমি খাইনি? তোমাকে তো তখন সেখানে দেখলাম না।”

আরশিয়ার কথার বিপরীতে ইনান একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,

” এটা মনের টান গো সুন্দরী। ও তোমার মতো নিরামিষ মানুষ বুঝবেনা। আমি গেলাম, তুমি খেয়ে এসো।”
.
.

” তুমি কি কিছু খুঁজছো?”

সেই ঘোরলাগা শীতল ওয়াসিমের কন্ঠ শুনে আরশিয়া স্থির হয়ে গেলো। ফাঁপা ঢোক গিলে পেছন ফিরে তাকালো।

” কি হলো? কিছু হারিয়ে গিয়েছে কি?”

” আমি আমার জুতো জোড়া খুঁজে পাচ্ছিনা। সেটাই খোঁজা চেষ্টা করছি।” হতাশামিশ্রিত কন্ঠে বলল আরশিয়া।

” কি ধরণের?”

” কালো রঙের, তাতে প্রজাপতি আঁকা আছে। আপনি কি দেখেছেন?”

” তুমি এখানে বস, আমি এখুনি খুঁজে নিয়ে আসছি।”

দ্রুততার সাথে ওয়াসিম আরশিয়ার জুতোর খোঁজে লেগে পড়লো। দু’মিনিটের মাথায় সে হাজির, হাতে থাকা জুতো জোড়া আরশিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” এটা নাকি দেখো তো।”

” জ্বি এটাই,আপনি কোথায় পেলেন?”

আরশিয়ার জুতো জেনে ওয়াসিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তবে তা আরশিয়া বোঝার আগে নিজের মধ্যে চেপে রাখলো।

” সেটা তোমার না জানলেও চলবে। নাও, জুতো জোড়া পড়ে নাও।” নিচু হয়ে আরশিয়ার পায়ের সামনে রাখলো জুতো জোড়া।

” ওয়াসিম ভাই তুমি কহিনূর আপুর পায়ের কাছে কি করছো?”

আচমকা জায়রার কন্ঠ শুনে ওয়াসিম, আরশিয়া উভয়েই ঘাবড়ে গেলো। জায়রার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ইনান, একদম সূক্ষ্মদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে দু’জনকে।

” কি হলো ওয়াসিম ভাই বললে না তো তুমি নিচে কি করছিলে?”

” আসলে আমি আমার জুতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না, উনি সেটাই খুঁজে এনে দিয়েছেন। দুঃখিত, আপনাকে কষ্ট দিলাম।”

” না কোন সমস্যা নেই। তোমার কোন সমস্যা হলে তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো।”

আরশিয়া সৌজন্যরক্ষাতে হালকা হেসে ভেতরে চলে গেলো।

” তোমার কোন সমস্যা হলে তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারো! কাহিনী কি ওয়াসিম ভাই, হুম হুম? কই আমাদের তো এতো সুন্দর করে কোনদিনও বলনি।” দুষ্টমি ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল জায়রা।

তার কথা শুনে ওয়াসিম বিরক্তি নিয়ে আড়চোখে তাকাল।

” কাহিনী কি মানে? কোন কাহিনী নেই। সে নতুন, কাউকেই চেনে না। তাই আত্নীয়তার খাতিরে বলেছি। এমনভাবে বলছিস যেন আমি তোদের কোন সাহায্যই করিনি।”

” তাই নাকি বড় ভাই?” পেছন থেকে ওয়াসিমের কাঁধে হাত রেখে বলল ইনান। চোখে-মুখে তার দুষ্টুমি ছেঁয়ে আছে। ওয়াসিম বিরক্তি নিয়ে কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে দ্রুত স্থানটা ত্যাগ করলো।
.
.

সবেমাত্র রাত নয়টা বাজে, শহরের মানুষের জন্য এটা মাত্র হলেও গ্রামে ন’টা মানেই অনেক রাত। চুপচাপ মুখ গোমড়া করে চেয়ারে বসে আছে আরশিয়া, মনে মনে সে একটু বিরক্তও বটে। গত তিনদিন ধরে তার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সব উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া, ঘুম না হওয়ার কারণে তার বেশ অস্তির অস্তির লাগছে। সুমনা আহমেদকে বলেও কোন লাভ হয়নি বরং তিনি উল্টো “অসামাজিক” বলে গালমন্দ করলেন। অগ্যত ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও আরশিয়াকে খাবার জন্য আসতে হলো।

” কহিনূর আপু চলো আজ তুমি আমাদের সাথে বসবে।”

” হুম আপু চলো, আমরা আজ সবাই আড্ডা দিতে দিতে খাবো। তোমার একদম খারাপ লাগবেনা।”

” না আপুরা তোমরা খাও, আমি মায়ের সাথেই বসবো।”

” আরে ধুর, বড়দের মাঝে বসে কি খাওয়া যায় নাকি? বড়দের সাথে বসলে তো একটু মজা করে কথাও বলা যায়না। সবসময় মেপে মেপে কথা বলতে হয়।” মুখ ভার করে বললো জায়রা। জুবা গিয়ে সুমনা আহমেদকে টেনে নিয়ে এলো।

” আন্টি আপনি একটু আপুকে বলুন না আমাদের সাথে বসতে। আপু কত বড় হয়েছে, এখনো আপনার সাথে সাথে লেগে থাকে। এরকম হলে কি চলে?”

সুমনা আহমেদ মুখে হাসি রেখে বললেন,

” আর বলো না মা, মেয়েটা একা কোথাও যেতে চাইনা। সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়। তোমরা যাও, ও আরহামকে নিয়ে আসছে।”

” তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু আপু। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”

দু’বোন সরে যেতেই সুমনা আহমেদ দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” এতো অহংকার কিসের তোমার? জীবনে এই প্রথমবার এখানে এসেছো, নিজের কথা না হোক অন্তত আমার সম্মানের কথা মাথায় রেখে হলেও এই সংকীর্ণ মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসো। দেখো তোমার থেকেও বয়সে ছোট মেয়েগুলি তোমার সাথে কি সুন্দর মিশে গিয়েছে। আর তুমি! এসেছো পর্যন্ত কারো সাথে দু’দন্ড মন খুলে কথা বলোনি। অবশ্য বলবে কেমন করে? এটা তো আমার মামারবাড়ি, এদের সাথে কথা বললে তো আবার তোমাদের জাত চলে যাবে। আমার কপালটাই খা’রা’প।”

মাথানিচু করে যথাসম্ভব চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছে আরশিয়া। জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সে, সমস্ত অস্বস্তিকে জোড় করে নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে জায়রার পাশের চেয়ারটায় বসলো আরশিয়া।

” আপু তুমি এসেছো! ইশ, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না আমি কতটা খুশি হয়েছি। অতঃপর এতোদিন পর আজ তুমি আমাদের সাথে যোগ দিলে।” একপাশ থেকে আরশিয়াকে হালকা করে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললে জায়রা। জায়রার বাচ্চামো আচরণ দেখে মুচকি হাসলো আরশিয়া। এ কয়েকদিনে সে বুঝতে পেরে গিয়েছে মেয়েটা অনেক সহজসরল আর মিশুক। তা না হলে কি নিজের থেকে বয়সে বড় কারো সাথে এতোটা সহজ কেউ হতে পারে?

” দেখি দেখি কহিনূরকে ছাড় তুই। মেয়েটাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে মে’রে ফেলবি নাকি? এমনিতেই শরীরে শুধু হাঁড়গোড় আছে,এভাবে চেপে ধরলে তো তাও ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।” তৃষাণের কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো। জায়রা মুখ ভেঙচি দিয়ে আরশিয়াকে ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here