প্রেম_পায়রা ?️?️ পর্ব-১০,১১

0
1285

প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-১০,১১
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
দশম_পর্ব

পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে দুপুর পেরিয়ে বিকেল নেমে এসেছে। চারপাশে রোদের প্রখরতা নেমে গিয়ে চারপাশে স্বচ্ছ সাদা মেঘেদের দল ছোটাছুটি করছে। সাজেক ভ্যালির ট্রিপ টা বেশ ভালো লেগেছে মিশরাতের‌। এখন শুধু আর একটা জিনিস ই দেখার বাকি। সেটা হলো হ্যালিপ্যাড থেকে সরাসরি সূর্যোদয়। রাত নেমে যাওয়ার আগেই পূর্বের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মিশরাত‌ আর স্নিগ্ধ। রাতের অন্ধকার একবার নেমে গেলে আরো একটা রাত এখানে কাটাতে হবে। তাই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে তারা।
সন্ধ্যের আকাশে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। নীলচে আকাশের বিশালতার মাঝে এক ফালি চাঁদ দৃশ্যমান। গুটি গুটি পায়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে রিসোর্টে পৌঁছায় মিশরাত আর স্নিগ্ধ। কোনোমতে রুমের চাবিটা নিয়ে রুমের দরজা খুলতেই মিশরাত গিয়ে সোফার উপর ব্যাগটা রেখে বসে পড়ে।
মিনিট পাঁচেক পর উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় মিশরাত নাহলে সে জানে স্নিগ্ধ এসে দেখলেই বকবক শুরু করে দিবে। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই স্নিগ্ধর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় তার। স্নিগ্ধ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,

– ” তুমি কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। আমি ফ্রেশ হয়ে খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
মিশরাতও বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে আর পাশের টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকে। প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধ। খাটের উপর মিশরাতের দিকে একপলক তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে সে।

মিনিট বিশেক পর হাতে খাবারের ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে স্নিগ্ধ। খাটের দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। ফোন হাত থেকে পড়ে রয়েছে নিচে, এলোমেলো ভাবে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মিশরাত‌। মিশরাতকে এভাবে ঘুমোতে দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে স্নিগ্ধ।
– ” এ মেয়ে কোনোদিনই শোধরাবার নয়। এই অল্প সময়ের মধ্যেই না খেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। কেয়ারলেস একটা!!”
বিড়বিড় করে বলে উঠে স্নিগ্ধ। তারপর কিছু একটা ভেবে মিশরাতের পাশে গিয়ে আলতো স্বরে ডেকে উঠে,

– ” মিশরাত, এই মিশরাত! উঠো, অল্প করে কিছু খেয়ে নাও!”
কিন্তু বেশি কিছু লাভ হলো না। মিশরাত কিছুটা নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে গেল। স্নিগ্ধ কয়েক পলক তাকিয়ে মিশরাতের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় চলে গেল। সোফায় শরীর এলিয়ে দিতেই শরীরে জমে থাকা ক্লান্তিটুকু ঘুমে পরিনত হলো।

সকালের আলো ফোটার পূর্বেই যথাসময়ে এলার্ম বেজে উঠল। পরপর কয়েকবার বাজার পর চোখ মুখ কুঁচকে নড়েচড়ে উঠলো মিশরাত‌। হাতরে হাতরে এলার্ম বন্ধ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই স্নিগ্ধর ঘুমন্ত চেহারাটা চোখে পড়ে মিশরাতের‌। ভোরের আলো ভালো ভাবে না ফুটলেও আবছা আলোয় স্নিগ্ধর চেহারাটা স্পষ্ট। এতদিন ভালোভাবে স্নিগ্ধর দিকে না তাকালেও আজকে হঠাৎ কেন যেন তাকে খুব করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হলো মিশরাতের‌। কপালে ছোট ছোট চুলগুলো এলোমেলো ভাবে লেপ্টে রয়েছে। গালের খোঁচা খোঁচা হালকা চাপদাড়ি গুলো দেখে সেগুলো একবার ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হলো মিশরাতের‌। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসলো সে।

– ” কি হয়েছে তোর মিশরাত‌? কি সব হাবিজাবি ভাবছিস তুই!
না আসলেই তোর মাথাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে!
আরে তুই তো জানিস এই সম্পর্ক বাকিদের কাছে রিয়েল মনে হলেও তোর আর স্নিগ্ধের কাছে এটা জাস্ট একটা ডিল। তারপরও তুই বারবার উল্টোপাল্টা চিন্তা করিস কি করে!”
মনে মনে নিজেকেই বলতে থাকে মিশরাত‌। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা গুছিয়ে নেয় সে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই খেয়াল করে অলরেডি ৫:০০ টা বেজে গিয়েছে। এখান থেকে হ্যালিপ্যাডে যেতে মোটামুটি সময় লেগে যাবে। তাই দ্রুত ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হতেই খেয়াল করে স্নিগ্ধ ও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে স্নিগ্ধ বলে উঠে,
– ” তারাতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আমাদের হ্যালিপ্যাডে যেতে,,,”

পেছনে ফিরে পুরোটা বাক্য শেষ করতে পারলো না স্নিগ্ধ। কেননা তার আগেই চোখ আটকে গিয়েছে তার মিশরাতে।
জর্জেটের কালো শাড়ি পড়নে, লম্বা চুলগুলো কোমর অবধি ছড়ানো, ফর্সা শরীরে কালোর আবরণ যেন ফুটে উঠেছে।
এদিকে স্নিগ্ধর এমন ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে যায় মিশরাত‌। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে সে। মুহুর্তে আবার বাস্তবে ফিরে আসে স্নিগ্ধ।
মনে মনে নিজেকে হাজার টা গাল দিতে থাকে। মিশরাত কি ভাববে তাকে এখন। ভাবতে ভাবতেই মাথা নিচু করে কোনো কথা না আস্তে করে ওয়াশরুমে চলে যায় স্নিগ্ধ।

হ্যালিপ্যাড হলো সাজেক ভ্যালির এমন একটা জায়গা যেখান থেকে সরাসরি সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারা যায়। শাড়ির কুচি গুলো এক হাতে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছে স্নিগ্ধর পিছুপিছু মিশরাত‌। তারা ছাড়াও অনেকেই এসেছে সূর্যোদয়ের সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। হ্যালিপ্যাডে পৌঁছাতেই মিশরাত আলতো হাসে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি ভোরের সেই আলো ফুটতে। পাঁচ মিনিটের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সূর্যের আলো সরাসরি আছড়ে পড়ে মিশরাতের‌ মুখে। সূর্যের স্বর্ণালী রশ্মি মিশরাতের উপর পড়তেই স্নিগ্ধ একবার আড়চোখে তাকালো মিশরাতের দিকে। কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে ফোনটা বের করে মিশরাতের অজান্তেই তার কয়েকটা ছবি ঝটপট করে তুলে নিল স্নিগ্ধ। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মনে মনে ভাবলো,
– ” আমি মিশরাতের ছবি তুললাম কেন? ওর কাছ থেকে পারমিশন না নিয়ে ওর অজান্তেই ছবি তুলে নিলাম! এটা কি আদৌ ঠিক?
ভাবতে ভাবতেই ছবির ডিলিট বাটনে ক্লিক করতে গিয়েও কোনো এক অজানা কারণে থেমে গেল স্নিগ্ধ।

এদিকে মিশরাত কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে পিটপিট করে তাকাতেই পাশে স্নিগ্ধ কে না দেখে হালকা ঘাবড়ে গেল। এই লোকটা হুটহাট কোথায় হারিয়ে যায়? আবার তাকে এখানে একা ছেড়ে চলে যায় নি তো! ভাবতে ভাবতেই পেছন ফিরে স্নিগ্ধ কে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। সামনে দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ শাড়িতে পা বেঁধে গিয়ে পড়ে যেতে নিলেই ভয়ে চোখ মুখ কুঁচকে নেয় মিশরাত‌। এই বুঝি কোমর শেষ তার!
কিন্তু কিছুক্ষণ পর শরীরে কোনো ব্যাথা অনুভূত না হওয়ায় চোখ দুটো খুলে তাকায় মিশরাত‌। কোনো মেয়েলী হাত তার হাতকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে মিশরাত‌। পেছনে তাকাতেই তার চেহারা পূর্বের তুলনায় আরো কয়েক গুণ ভয়ার্ত হয়ে যায়। গাছের ভাঙা সরু অংশ সোজা হয়ে এখনো সেখানেই রয়েছে। যদি এই ভাঙা অংশের উপর কোনোভাবে পড়ে যেত তাহলে এখন সাজেক না হসপিটালে থাকতে হতো মিশরাতের‌। ভাবতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে তার।
কিন্তু যে তাকে এই অঘটনের শিকার হতে বাঁচিয়েছে তাকে তো অন্তত একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার।
সামনে তাকাতেই খেয়াল করে মিশরাতেরই সমবয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিন্স আর হুডি পরনে, মাথায় একটা ক্যাপ। ততক্ষণে স্নিগ্ধ ও চলে আসে সেখানে।

– ” দেখেশুনে চলতে পারো না? এখনি তো পড়ে গিয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটে যেত তাহলে?
কে বলেছিলো শাড়ি পরে আসতে?”
স্নিগ্ধর ধমক খেয়ে ভয়ে চুপসে যায় মিশরাত‌। কিছু বলবে তার আগেই পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি বলে উঠে,

– ” ইটস ইউর গুড লাক!
এন্ড মিস্টার, টাইম থাকতে‌ সাবধানে থাকবেন। নাহলে অচিরেই আপনার কাছ থেকে আপনার প্রিয় জিনিস গুলো কিভাবে হারিয়ে যাবে সেটা টেরও পাবেন না!
সো বি কেয়ারফুল!!”

কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর কানে আসতেই পাশ ফিরে তাকায় স্নিগ্ধ। মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই বিস্মিত হয়ে উঠে সে। অবাক হয়ে কম্পনরত কন্ঠে বলে উঠে,
– ” শুভ্রতা!!”
মিশরাত ও অবাক হয়। কে এই শুভ্রতা? এতদিন ধরে ইগনোর করলেও এবার ব্যাপারটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। স্নিগ্ধর এভাবে যাকে তাকে শুভ্রতা সম্বোধন করছে!

পাশে থাকা মেয়েটা স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বলে উঠে,
– ” এক্সকিউজ মি, মিস্টার!
আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আ’ম নট শুভ্রতা। আ’ম অরিন। অরিন সারাহ্।”

স্নিগ্ধ বেশ খানিকটা অবাক হয়। এ কি করে সম্ভব? এই মেয়েটার চোখ দুটো তো বলে দিচ্ছে যে এ শুভ্রতা। কিন্তু মেয়েটা নিজেকে অরিন বলে দাবী করছে কেন?……………

চলবে ?

#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#একাদশ_পর্ব

রিসোর্টে ফেরত আসার পর থেকেই স্নিগ্ধ মুখ দিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। এখনো যেন বড় কোনো শকের ভেতর রয়েছে। একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে।
মিশরাত আড়চোখে স্নিগ্ধ কে একবার দেখে নিল। হঠাৎ করে ঐ মেয়েটাকে দেখে এভাবে চুপ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা মোটেও তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ঘাপলা আছে! এই শুভ্রতা আসলে কে? যাকে ঘিরে এত রহস্য!
– ” স্নিগ্ধ কে কি একবার এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবো?
না থাক! ঐ দিন একটা ছোট বিষয় নিয়েই কত ঝাড়ি খেতে হয়েছিল আমায়। এখন যদি পুরো কাহিনী জিজ্ঞেস করি তাহলে নিশ্চিত আজকে কোনো বড় ঝড় বয়ে যাবে। এর চেয়ে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়।
পরে না হয় কোনো এক সময় জিজ্ঞেস করা যাবে।”
মনে মনে বিড়বিড় করে বললো মিশরাত‌। স্নিগ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও তার মাঝে কোনো পরিবর্তন এলো না। সে পূর্বের মতোই ধ্যানে মগ্ন।

ফ্ল্যাশব্যাক,,

– ” এক্সকিউজ মি, মিস্টার! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আ’ম নট শুভ্রতা। আ’ম অরিন। অরিন সারাহ্!”

বলেই মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে ফেলে অরিন। চেহারায় নজর পড়তেই থমকে যায় স্নিগ্ধ। এ কি দেখছে সে?
চোখ দুটো শুভ্রতার সাথে হুবহু মিললেও চেহারায় কোনো মিল নেই। এটা কিভাবে সম্ভব? একটা মানুষের চোখের মাঝে এতোটা মিল কি করে হতে পারে? মেয়েটাকে দেখে স্নিগ্ধর মাঝে অস্বস্তি বেড়েই চলেছে। কেন জানি মন বারবার বলে চলেছে এই অরিন মেয়েটাই শুভ্রতা। কিন্তু মনের সাথে মস্তিষ্ক সায় দিয়ে উঠছে না।

– ” এক্সকিউজ মি গাইজ! আমার যেতে হবে!
আর হ্যাঁ আপনি একটু বেশিই সাবধানে থাকবেন! গুড বাই!”
মিশরাতকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল অরিন। আর স্নিগ্ধ ও কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। সেটা দেখে মিশরাতও পিছু নেয়।

বর্তমানে,,
কারো তুড়ি বাজানোর শব্দ কানে যেতেই ভাবনার সুতো কেটে যায় স্নিগ্ধর। মাথা তুলে তাকাতেই খেয়াল করে মিশরাত চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

– ” কি ব্যাপার? এভাবে আনমনে কি ভেবে চলেছেন? ঘুমোতে যাবেন না নাকি?”

মিশরাতের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠে,
– ” কই কিছু না তো, তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো!
আমি আসছি!”
মিশরাত ছোট্ট করে আচ্ছা বলে চলে যায়।
বিছানায় দুজন দুপাশে ফিরে শুয়ে রয়েছে। কারো চোখে ঘুম নেই। পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে মিশরাত বলে ওঠে,
– ” আমি জানি আপনি এখন কাকে নিয়ে চিন্তা করছেন। আমি আপনাকে জোর করবনা যে আপনি আমাকে শুভ্রতার ব্যাপারে কিছু বলুন। কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে নিজ থেকে একাই সবটা বলবেন!”

নড়েচড়ে উঠলো স্নিগ্ধ। হ্যাঁ ঠিক এটারই তো আশংকা করেছিল সে। তার নিজের দোষের কারণে আজ তার অতীত আবারো তার সামনে চলে এসেছে। আর তার অতীত এমনভাবে তাকে আকড়ে ধরেছে যে চাইলেও তার থেকে ছুটে পালানোর কোনো পথ নেই। কিন্তু সেটা এখন সে প্রকাশ করলো না। তাই সবটা শুনেও না শোনার ভান করলো যাতে করে মিশরাত‌ ভাবে সে ঘুমিয়ে গিয়েছে। অপর পাশ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো মিশরাত‌। সে জানে স্নিগ্ধ তার কথা শুনেছে। তাই আস্তে করে চোখ দুটো বুজে নিলো আর ধীরে ধীরে ঘুমের অতলে হারিয়ে যেতে থাকলো।

পুরো সাতদিনের সাজেক ভ্যালি ট্রিপ শেষে আজ ঢাকায় ফিরে যেতে হবে মিশরাত আর স্নিগ্ধ কে। সকালে হালকা পাতলা কিছু খেয়ে প্যাকিং এর কাজে লেগে পড়লো মিশরাত‌। তার এই ট্রিপটা সবসময় মনে থাকবে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব হয় মিশরাতের কাছে। কিন্তু এটার সঠিক কারণ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।

রিসোর্ট থেকে লাগেজ হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়ে স্নিগ্ধ আর মিশরাত‌।
– ” আচ্ছা মা’কে কি বলেছেন ফোন করে যে আমরা আজ ঢাকায় ব্যাক করছি?”
হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে উঠে মিশরাত‌। স্নিগ্ধ পাশ ফিরে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,
– ” হ্যাঁ, আমি ফোন করে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি!”
এভাবে কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তার মাধ্যমে সামনে এগোতে থাকে তারা।
আচমকা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায় স্নিগ্ধ।

– ” আ’ম রিয়েলি সরি! আমি আসলে খেয়াল করি নি!”
কোনো মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পেয়ে সামনে তাকায় স্নিগ্ধ। সাথে মিশরাত ও।
অরিন অনুনয়ের চোখে বলে উঠলো কথাটি।
– ” আরে অরিন আপু!!
আপনি এখানে?”
অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মিশরাত‌। স্নিগ্ধ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে।

– ” হ্যাঁ আসলে আমি এই রিসোর্টেই করে উঠেছি।
তোমাদের হাতে লাগেজ? আবার ব্যাক করছো নাকি?”

অরিনের প্রশ্ন শুনে মিশরাত আলতো হেসে বলে,
– ” হ্যাঁ আপু!
আমরা আজ ঢাকায় ব্যাক করছি!”

– ” আচ্ছা ঠিক আছে!
হ‌্যাভ এ গুড জার্নি!
আর হ্যাঁ বি কেয়ারফুল!
কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না, তাইনা!”

বলেই একটা মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মিশরাতের পাশ ঘেঁষে চলে যায় অরিন। এদিকে মিশরাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এ মেয়ের কথাগুলো এমন জট পাকানো কেন? যেন কথার মাঝে হাজারটা অর্থ লুকানো। মনে মনে ভাবলেও বেশ একটা পাত্তা দেয় না মিশরাত‌।
শো শো বাতাস গাড়ির জানালা ভেদ করে মিশরাতের শরীরকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের তীর্যক রশ্মি ও তার মুখ বরাবর আছড়ে পড়ছে। হালকা তাপ আর হালকা ঠান্ডার সংমিশ্রণ বেশ ভালোই লাগছে তার।
গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিতেই কানে গানের সুর ভেসে আসলো।

” অ্যায় মেরে হামসাফার,,
ইক জারা ইন্তেজার,,,,

সুন সাদায়ে দে রেহি হ্যায়,
মান্জিল পেয়ার কি!

অ্যায় মেরে হামসাফার,,
ইক জারা ইন্তেজার,,

সুন সাদায়ে দে রেহি হ্যায় মান্জিল পেয়ার কি!!..

জিসকো দুয়ামো মে মানগা,,,
তু হে ওয়াহি রেহনুমা,,

তেরে বিনা মুশকিল হ্যায়
এক ভি কাদাম চালনা,,,(২)

বিন তেরে কাহা হ্যায় মান্জিল পেয়ার কি!!

অ্যায় মেরে হামসাফার,,
ইক জারা ইন্তেজার,,
সুন সাদায়ে দে রেহি হ্যায়
মান্জিল পেয়ার কি!..

( বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন)

কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসতেই সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ান মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী। এখন এই সময়ে কে আসবে? ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে গিয়ে দরজা খুলতেই অপর পাশ থেকে কেউ এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে।
– ” কেমন আছো মা? আই মিস ইউ‌।”

মিসেস ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে স্নিগ্ধ। আর মিশরাত পেছনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
– ” আরে স্নিগ্ধ তুই? এভাবে চলে আসলি অথচ আমাকে একবার ফোন করে জানালিও না!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথা শুনে অবাক হয় কিঞ্চিৎ মিশরাত‌। একটু আগেই না স্নিগ্ধ তাকে বলেছিল যে মিসেস ইয়ামিন তাদের ঢাকায় ফিরে আসার ব্যাপারে জানতো! তাহলে মিসেস ইয়ামিন কি বলছে এসব?
মিশরাতের ভাবনার মাঝেই মিসেস ইয়ামিন এসে মিশরাতকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী স্নিগ্ধ আর মিশরাতকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। রাতের বেলা ডিনার শেষ করে রুমে এসে বসতেই ফোন ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠে মিশরাতের‌।
ফোনে মেহের নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে মেহেরের কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
– ” কি ব্যাপার ননদিনী‌? বিয়ের পর দেখি আমাকে আর মনেই থাকে না আপনার!!
ব্যাপার কি?
আর হানিমুন কেমন কাটলো আপনার?”

মিশরাত জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে।
– ” বিয়েটাই দুজনের মাঝে কেউ মানে না। কিসের আবার হানিমুন? ”
বিড়বিড় করে বলে উঠে মিশরাত‌।
– ” কিরে ওভাবে কি বিড়বিড় করছিস? আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি!!”

– ” আহা বউমনি, তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয়!
আসলে কয়েকদিনের ট্রিপে গিয়ে ফোন করা হয়ে ওঠে নি। আর ওখানকার নেটওয়ার্ক ও তেমন খুব সুবিধার না!
তাই আর কি!!”

আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তার করতে করতে আধঘন্টা সময় কেটে যায়। ফোন কেটে দিয়ে সামনে তাকাতেই খেয়াল করে স্নিগ্ধ তার দিকে একদৃষ্টে সরু চোখে তাকিয়ে রয়েছে। হালকা ঘাবড়ে যায় সে? এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ কি?

– ” বিয়ে হয়েছে তার মানে এটা নয় যে পড়াশোনা বাদ দিয়ে এভাবে বাসায় বসে থাকবে!
আগামী সপ্তাহ থেকে তুমি রীতিমতো আবারো ক্লাস জয়েন করবে! আমি তোমার ভার্সিটির ভিপির সাথে কথা বলে নেব!”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মিশরাত‌। সাথে খুশিও লাগে। কেননা ‌আর মাত্র একটা ইয়ার আছে অনার্স কোর্স শেষ হতে।
খুশিতে একপ্রকার দাঁড়িয়ে যায় সে। স্নিগ্ধ কে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই স্নিগ্ধ বলে উঠে,

– ” হয়েছে আমাকে থ্যাঙ্কস দিতে হবে না। আর না এতো লাফালাফি করতে হবে। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো!

কাল সকাল থেকে আমি অফিস জয়েন করবো।”

স্নিগ্ধর কথা শুনে মুখে লেগে থাকা হাসিটুকু উবে যায় মিশরাতের‌। মুখ ফুলিয়ে খাটের উপর গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ে।
আর সেটা খেয়াল করতেই স্নিগ্ধ এক পলক মিশরাতের তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠলো!………..

চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here