প্রেম_পায়রা ?️?️ পর্ব-১৪,১৫

0
1235

প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-১৪,১৫
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
চতুর্দশ_পর্ব

“আমি শুভ্রতা কে ভালোবাসি!”
কথাটা বারংবার মিশরাতের মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। এটা শোনার পর আর কোনো কিছু ব্যাখ্যা করে বলে দিতে হয় নি তাকে। সবকিছুর হিসেব ই তার মিলে যাচ্ছে।
রুমটায় পিনপতন নীরবতা। কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। মিনিট পাঁচেক পর নীরবতা ভেঙে মিশরাত নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠলো,

– ” তাহলে অযথা এই ডিলটার‌ কি প্রয়োজন ছিলো?
আপনি তো চাইলেই শুভ্রতাকে বিয়ে করে নিতে পারতেন!”

পিছনে ফিরে তাকাল স্নিগ্ধ। চোখে মুখে কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার ব্যর্থতা!
এতক্ষণ ধরে মিশরাতের সাথে রুড ব্যবহার করলেও এখন আর সেটা হয়ে উঠছে না। পুরোনো অতীত আবারো তার সামনে ফিরে এসেছে যেটা থেকে সে এতদিন পালিয়ে পালিয়ে থাকছিলো। কিন্তু কথায় আছে না, সত্য বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারে না। ঠিক তেমনটাই তার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রয়ারের দিকে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধ। ড্রয়ার থেকে কালো রঙের ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মিশরাতের মুখোমুখি বসলো সে। ডায়েরিটা মিশরাতের দিকে এগিয়ে দিতেই মাথা তুলে তাকালো মিশরাত‌। স্নিগ্ধর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে স্নিগ্ধ চোখের ইশারায় ডায়েরিটা খুলতে বলল।
– ” এতেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া রয়েছে। আশা করি এটা পড়লেই সবটা তোমার বোঝা হয়ে যাবে!”
মিশরাতের হাতে ডায়েরিটা ধরিয়ে দিয়ে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।

এদিকে মিশরাত একপলক স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে চেয়ে ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টানো শুরু করলো।

০৬ই ডিসেম্বর, ২০১৮.

লন্ডন শহর‌। বিশাল এক সাম্রাজ্যের এক বিশাল শহর লন্ডন। লন্ডনকে ঘিরে রয়েছে হাজারো ঐতিহাসিক সব ঘটনা।
মূলত দু বছরের একটা কোর্স কমপ্লিট করার জন্যই লন্ডনে আসা। তবে দু বছর একা একা একটা অচেনা শহরে কাটানো মোটেও ছোট ব্যাপার নয়। লন্ডন ভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজে পিএইচডি কমপ্লিট করতে দু বছর সেখানেই পরিবার ছেড়ে কাটাতে হয় আমাকে। তবে এ দু বছরেই যে আমার জীবনটা সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে যাবে তা কখনো কল্পনাও করিনি।
সিটি অফ লন্ডনের বিখ্যাত কয়েকটা জায়গার মধ্যে লন্ডন আই হলো অন্যতম। টেমস নদীর অন্যপাশে অবস্থিত গোলাকার রাইড ই লন্ডন আই নামে পরিচিত। যেখান থেকে পুরো লন্ডন কে ঘুরে দেখা সম্ভব।
আর ঠিক এই দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে মেমোরিয়াল দিন ছিল।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭.
লন্ডন আই তে এসেছিলাম ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে ঘোরাঘুরি করার জন্য। ভার্সিটির পিএইচডি ফার্স্ট ইয়ার সবে মাত্র শুরু হয়েছে। টেমস নদী পেরিয়ে লন্ডন আইতে পৌঁছাতে ছোট ছোট বৃত্তাকার ক্যাপসুলের মতো সিটে বসে ৩৬০° কোণে লন্ডন শহর ঘুরে দেখা যায়। আর এখানেই সর্বপ্রথম দেখা হয়েছিল আমার তার সাথে।
কালো শাড়ি পরনে এক বাঙালী নারী। চোখ গুলো টানা টানা, ঘন পাপড়ি যুক্ত চোখে রয়েছে অসংখ্য মায়া। আর সেটার মায়াতেই পড়ে গিয়েছিলাম আমি।
লাভ এট ফার্স্ট সাইট বাক্যটায় ছোট কাল থেকেই বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল আমার। কেননা ছোট বেলায় স্কুল কলেজে থাকতে মেয়ে পটাতে গিয়ে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তাই তখন থেকেই এসব প্রেম ট্রেম বাদ দিয়ে দেই ”

পড়ার মাঝেও ফিক করে হেসে উঠলো মিশরাত‌। কিছুক্ষণ হাসি থামিয়ে আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলো সে।

” এই মায়াটাই আমার জীবনটাকে কিভাবে বদলে দিল কখন টেরই পেলাম না। ভীড়ের মাঝ থেকে এগিয়ে গিয়ে ক্যাপসুলে প্রবেশ করি আমরা। সেখানে ঐ মেয়েটাও থাকে। সরি মেয়েটা বলছি কেন? সে তো আমার মায়াবতী! আমার শুভ্রতা!!
রাইড চলা শুরু করলে গ্লাসের বাইরে থেকে লন্ডনের পুরো শহর এক এক করে দৃশ্যমান হতে থাকে। কিন্তু আমার দৃষ্টি তখনও আমার মায়াবতীর দিকে বিদ্ধ‌। হঠাৎ পকেটে থাকা ফোনটা বের করে আনমনে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম তার‌। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো ওখানেই। তবে এতে কিছুটা উপকার ও হয়েছে। লাস্টের ছবি তোলার সময়ে মেয়েটা পেছন ঘুরে তাকায়। আমাকে এমনভাবে ধরা খেতে হবে তা মোটেও কল্পনা করি নি। মেয়েটা তেড়ে আস আমার দিকে।
– ” হেই! হোয়াট ইজ ইওর প্রবলেম!
হোয়াই আর ইউ ক্লিক মাই পিকচার উইদাউট টেক মাই পারমিশন‌।”

থতমত খেয়ে গেলাম আমি। আমার ফ্রেন্ড রাও পাশে ইতিমধ্যে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। তাই আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
– ” একচুয়ালি! আই ওয়াজ টেক পিকচার এরাউন্ড দ্যা সিনারি! আই ডিড নট নোটিস্ড ইউ।”

মেয়েটি যে আমার কথায় বিশ্বাস করেনি সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটা রুক্ষ স্বরে বলে উঠে,
– ” আমি জানি আপনাদের মতো ছেলেদেরকে। রিডিকিউলাস!!”
বলেই গটগট করে সামনে হাঁটা শুরু করে দেয় মেয়েটি। আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এটাই আমার তার সাথে প্রথম দেখা।
এরপর কয়েকদিন অনেক খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু খুঁজে পাইনি। মিনিমাম তিন চার দিন পর হঠাৎ আবারো তার সাথে কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে যায় আমার।
লন্ডনের আইকন যে স্থির ব্রীজ যা মোটামুটি কম বেশি সব ছবিতেই দেখানো হয়। লন্ডন ব্রীজের উপর ফ্রেন্ড সার্কেলের দু একজন গিয়েছিলাম ফটোগ্রাফী করতে। স্টুডেন্ট থাকতে ফটোগ্রাফীর প্রতি অদ্ভুত একটা নেশা ছিল। সুন্দর সুন্দর দৃশ্যগুলো ক্যামেরা বন্দি করতে ভীষণ ভালো লাগতো।
তো সেদিন ও নিয়মমাফিক ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম সেদিন। হঠাৎ লন্ডন ব্রীজের একপ্রান্তে ক্যামেরাতে ছবি বন্দি করতে গিয়ে ছবি বন্দি হয়ে গেল আমার মায়াবতীর। সাদা শাড়ির মাঝে কালোর কারুকাজ। লম্বা চুলগুলো একপাশে এনে বিনুনি করা। যেন একদম শুভ্র অপ্সরী‌। পাশ থেকে আনানের ডাকে ধ্যান ফিরে আসে আমার। ও হ্যাঁ আমিতো বলতেই ভুলে গিয়েছি। আনান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
– ” কিরে এভাবে হ্যাবলার মতো ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছিস। ছবি তোলা বাদ দিয়ে!”

– ” কই‌ কিছু না তো! এখান থেকে সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। চল সামনের দিকটায় যাই।”

এটুকু বলে সামনের দিকে দৃষ্টি যেতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার। সেকি মেয়েটা কোথায় চলে গেল? এখানেই তো ছিল। সেদিন তার দেখা পেয়েও একরাশ হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছিলাম!”

হাই দিয়ে উঠে মিশরাত‌। ঘড়িতে কাটা জানান দিচ্ছে রাত বারোটা বেজে গিয়েছে। হালকা ঘুম ঘুম ভাব এসে জড়ো হচ্ছে তার চোখে। কিন্তু এখন তো ঘুমোলে চলবে না। তাকে জানতে তো শুভ্রতা আসলে কে!
তাই অলসতা কাটিয়ে আবারো পরবর্তী থেকে পড়া শুরু করলো সে!

” এর মাঝ থেকে কেটে গিয়েছে আরো একমাস। ভার্সিটিতে অলরেডি এক্সাম ও শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এ একমাসে মেয়েটাকে কম খুঁজি নি। কিন্তু মেয়েটা যে হাওয়ার মতো অদৃশ্য হলো যে আর তাকে খুঁজে পেলাম না।
কিন্তু নিয়তি নামে একটা জিনিস আছে না? যেটাকে আমরা চাইলেও কন্ট্রোল করতে পারি না। ঠিক তেমনি আবারো নিয়তি আমাদের এক সাথে মুখোমুখি করলো।
ঘুরেফিরে আবারো আমাদের দেখা হলো একই ভার্সিটিতে। এতে যে কি পরিমান খুশি হয়েছিলাম সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। এরপর থেকে মায়াবতীর সাথে রোজ রোজ দেখা হতো। টুকটাক কথাও হতো তার সাথে। এর মাঝে জেনে গেলাম আমার মায়াবতীর একটা মিষ্টি নামও রয়েছে। শুভ্রতা! লাইব্রেরীতে প্রায় সময় দেখা হলে একসাথে বসে কফি খাওয়া বা টুকটাক আড্ডা জমানো হতো‌।
মাস পাঁচেক পর একদিন একগাদা সাহস নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবার সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে তাকে জানিয়েছিলাম আমার মনের সব কথা।
মনে মনে অবশ্য একরাশ ভয় হচ্ছিল যে আবারো ছোটবেলার মতো রিজেক্টেড হতে না হয়।
কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে শুভ্রতা ও আমার ভালোবাসাকে একসেপ্ট করেছিল।
এখান থেকেই সূচনা ঘটেছিল আমার আর শুভ্রতার নতুন প্রেমের। তবে কথায় আছে না যেখানে তুমি সবচেয়ে বেশি সুখ খুঁজে পাবে সেখানে দুঃখ রাও এসে জড়ো হবে।
তেমনি আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল‌। ফাটল ধরেছিল আমাদের ভালোবাসায়‌। শুনেছি যাকে মন থেকে ভালোবাসা হয় তারা নাকি কখনো ছেড়ে চলে যায় না।
তাহলে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল কিভাবে?
একবছর রিলেশন ভালো থাকলেও এরপর শুভ্রতার বিহেভিয়ারে ব্যাপক একটা পরিবর্তন চলে আসে। হুটহাট মেজাজ বিগড়ে যাওয়া, কথায় কথায় ব্রেকআপ করার হুমকি দেয়া আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবাতে শুরু করে। তাই এর মূল কারণ জানার চেষ্টা করি। কিন্তু সেই সত্যি জানতে গিয়ে আমার পায়ের তলা দিয়ে জমিন সরে গিয়েছিল‌।
নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে নিজের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখতে পেয়ে মাথা কাজ করছিলো না আমার। ভরা রেস্টুরেন্টের মাঝে গিয়ে শুভ্রতাকে একটা ঠাঁটিয়ে চড় মেরে বসি!
– ” স্নিগ্ধ বিশ্বাস করো, আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি।
আর আনানের‌ সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যেও না!”

শুভ্রতার বারণ করা সত্ত্বেও বেরিয়ে আসি রেস্টুরেন্ট থেকে। শুনেছি ছেলেরা খুব সহজে কান্না করেনা। তবে সেদিন আমার চোখে জল জমেছিল। পেছনে যে শুভ্রতা আমাকে ডাকছে তা আমার কানে পৌঁছালেও পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কেনই বা করবো!
কিন্তু হঠাৎ কারো গগন কাঁপানো চিৎকার কানে পৌঁছাতেই রুহ কেঁপে উঠলো আমার। পেছনে ফিরে তাকাতেই মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসলো,
– ” শু‌,শুভ্, শুভ্রতা!!”

মিশরাতেরও গলা শুকিয়ে আসলো। এর পর থেকে ডায়েরির পাতা গুলো ছেঁড়া। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলেও আর কিছু লিখা নেই। কিন্তু এর পর কি হয়েছিল? আর শুভ্রতাই বা কোথায়!

– “তোমার জন্য কষ্ট হয় মিশরাত‌। বাট কি করবো বলো? আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে তুমি থার্ড পার্সন। তাই তোমাকে তো সরতেই হবে! স্নিগ্ধ কে আমি তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিবো।

আর স্নিগ্ধ তোমার কাছ থেকেও আমার অনেক হিসেব নিকেশ বাকি! তোমাকে তো এত সহজেই ছেড়ে দিতে পারিনা!”
বলেই বাঁকা হেসে উঠলো অরিন!……………

চলবে ?

#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#পঞ্চদশ_পর্ব

রাত আড়াইটার বেশি বাজে। চারপাশের মানুষজনের কোলাহল থেমে গিয়েছে অনেকটা সময় আগেই। কিন্তু এখনো স্নিগ্ধের ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। এদিকে মিশরাত বসে বসে স্নিগ্ধের ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

– ” এতো রাতে লোকটা আমাকে এভাবে ডায়েরিটা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল?
আড়াইটা বেজে গিয়েছে অথচ তার আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। কি করি এখন! কোথায় আছে সেটাও তো জানি না।”
দরজার পানে চেয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় ঘুমে চোখ দুটো আপনাআপনি বুজে আসে মিশরাতের‌।

এদিকে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। দৃষ্টি তার আকাশের পানে। চাঁদের আলোয় চোখের কোণে জমে থাকা পানিটুকু চিকচিক করছে।
– ” আমি তো কখনোই চাইনি আমাদের গল্পটা এমন হোক!
আমি তো চেয়েছিলাম আর বাকি পাঁচটা সম্পর্কের মতো আমরা দুজন ও একসাথে থাকবো! কিন্তু ঐ একটা জিনিস, বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করি না আমি।
তবুও আমি চেয়েছিলাম আবারো সবকিছু নতুন ভাবে শুরু হবে। কিন্তু দেখো নিয়তি সেটা হতে দিল না! কেড়ে নিল তোমাকে আমার কাছ থেকে!
কোথায় তুমি মায়াবতী!”
মনে মনে প্রলাপ বকে স্নিগ্ধ।
রাত প্রায় তিনটার দিকে রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করে স্নিগ্ধ। রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথে মিশরাতের দিকে চোখ পড়ে তার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে, সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মিশরাত‌। স্নিগ্ধর দেয়া ডায়েরীটা এখনো হাতে গুটিয়ে নিয়ে রেখেছে। ডায়েরির ছেঁড়া পাতাটা দৃশ্যমান। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে মিশরাতের হাত থেকে ডায়েরিটা সাবধানে নিয়ে আসলো স্নিগ্ধ। ডায়েরিটা পাশের টেবিলে রেখে কয়েক পলক মিশরাতের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে তাকে কোলে তুলে নিল সে। ঘুমের মধ্যে কারো স্পর্শ পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠলেও পরমুহূর্তেই আবারো ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় মিশরাত‌।
অতি সাবধানে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় এক পাশে মিশরাতকে শুইয়ে দেয় স্নিগ্ধ। একদম বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে মিশরাত‌।
মিশরাতের ঘুমন্ত চেহারায় কয়েক পলক তাকিয়ে আলতো হেসে অপর পাশে নিজেও শুয়ে পড়ে স্নিগ্ধ।

কারো উত্তপ্ত ভারী নিঃশ্বাস চেহারার উপর আছড়ে পড়তেই নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। পিটপিট করে চোখ খুলতেই খেয়াল করে কারো বুকের মধ্যে মাথা দিয়ে এতক্ষণ বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল সে। সেটা মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছাতেই ধড়ফড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে মিশরাত‌। অস্থিরতায় কপাল বেয়ে ঘাম পরছে। যতদূর মনে পড়ছে সে তো কাল রাতে সোফায় ঘুমাচ্ছিল তাহলে এখন এভাবে স্নিগ্ধের বুকের উপর কিভাবে কি সম্ভব!
এদিকে মিশরাতকে এভাবে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠতে দেখে স্নিগ্ধের ও চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। মিশরাতের ওমন ভয়ার্ত চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ।
– ” কি হয়েছে মিশরাত! এনিথিং রং?”

মিশরাত আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে উঠল,
– ” আমি এখানে কি করে? আমি তো কাল রাতে,,,”
পুরো বাক্য শেষ হওয়ার আগেই স্নিগ্ধ বলে উঠল,
– ” হ্যাঁ কাল রাতে তুমি সোফায় ঘুমোচ্ছিলে তাই তোমাকে খাটে এনে শুইয়ে দিয়েছি! আর কিছু?
এই ছোট্ট একটা বিষয়ের জন্য এভাবে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে দেয়া নট ফেয়ার মিশরাত!”

– ” কাল রাতের স্নিগ্ধ আর সকালের স্নিগ্ধর মাঝে বিশাল পার্থক্য। কাল রাতেই তো স্নিগ্ধর সাথে কথা বলা যাচ্ছিল না। আর এখন এমন বিহেভ করছে যেন সব কিছুই স্বাভাবিক!
লোকটা আসলেই এলিয়েন!”
বিড়বিড় করে উঠে মিশরাত। এদিকে স্নিগ্ধ বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধতে ব্যস্ত স্নিগ্ধ। তখনি রুমে মিশরাত প্রবেশ করতে করতে বলে উঠল,
– ” আপনি কিন্তু এখনো আমাকে সবটা বলেন নি স্নিগ্ধ।
যেটুকু জেনেছি তার বেশিরভাগই ধোঁয়াশা। ডায়েরির বাকি পাতাগুলো কোথায়? আর শুভ্রতাই বা কোথায়!!”
আড়চোখে একবার তাকাল স্নিগ্ধ। আয়নাতে মিশরাতের চেহারায় স্পষ্ট কৌতুহলের ছাপ ফুটে উঠেছে।

গলায় টাই বাঁধা শেষ হতেই পেছন ফিরে মিশরাতের দিকে হালকা ঝুঁকে বলে উঠল,
– ” সময় হলে সবটা জেনে যাবে!”

এমন গম্ভীর কণ্ঠ শুনে মিশরাতের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। এখনো সে সটান দাড়িয়ে রয়েছে। স্নিগ্ধ হালকা হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল বাহিরে।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিক। ঠান্ডা ও গরমের মাঝামাঝি সময়। ছাদে দাড়াতেই সূর্যের আলো আছড়ে পড়ে মিশরাতের মুখ বরাবর। কিন্তু তাপ তেমন বেশি নেই। ছাদের কর্ণার টায় দাঁড়িয়ে পায়রা দুটোকে দানা ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। গতমাসে স্নিগ্ধ কে একবার বলার পর ই দুটো সাদা রঙের পায়রা এনে দেয়া হয়েছে তাকে। বিকেল বেলার কিছুটা সময় এখন তাদের সাথেই কাটানো হয়। পায়রা দুটোও হয়েছে তার মনের মতোন। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যে নেমে যাবে। নিচ থেকে মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর ডাক কানে পৌঁছাতেই দানার কৌটা পাশে রেখে ছুট লাগায় নিচের দিকে।

– ” জী মা, ডাকছিলেন?”

মিশরাতের কন্ঠস্বর শুনে‌ মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী আলতো হেসে বলে উঠলেন,
– ” হ্যাঁ, মিশরাত! এসো ভিতরে এসো!”
মিশরাতও বাধ্য মেয়ের মতো মিসেস ইয়ামিনের সামনে গিয়ে বসে পড়লো।
– ” শুনেছি তোমার বড় ভাইয়ের বউ কি যেন নাম হ্যাঁ, মেহের! মেহের নাকি প্রেগন্যান্ট?”

মিশরাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই মিসেস ইয়ামিন বলে উঠলেন,
– ” আলহামদুলিল্লাহ! যাক ভালোই হয়েছে।
আমি কি ভাবছিলাম মিশরাত, তোমার বিয়ের পর আর ও বাড়িতে যাওয়া হয় নি! তোমার শ্বশুর ও এখন অনেকটাই সুস্থ। আমি চিন্তা করছিলাম স্নিগ্ধ আর তুমি একবার ও বাড়ি থেকে ঘুরে এসো কয়েকদিনের জন্য।
এতে তোমার আর স্নিগ্ধের বন্ডিং টাও আরো স্ট্রং হবে!
মেহেরের সাথেও‌ কয়েকদিন সময় কাটাতে পারবে তুমি!

এখন তোমার মতামত কি?”

মিশরাত মাথা নিচু করে বলল,
– ” মা আপনি যা বলবেন তাই হবে!
আর স্নিগ্ধ যদি রাজী থাকেন তাহলে!”

– ” ঠিক আছে! আমি স্নিগ্ধ কে বুঝিয়ে বলবো!
তুমি বরং গিয়ে রাত থেকে সবকিছু গোছানো শুরু করে দাও!”
মিশরাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি বুঝিয়ে উঠতে নিলেই মিসেস ইয়ামিন আবারো বলে উঠলেন,

– ” আর হ্যাঁ! আমারো কিন্তু খুব শীঘ্রই ছোট্ট একটা মেহমান চাই!”
প্রথম প্রথম কথাটার মানে না বুঝলেও পরমুহূর্তে সেটা বোধগম্য হতে লজ্জায় কান গরম হয়ে আসলো মিশরাতের। হঠাৎ করে এমনটা হওয়ার কারণ ঠিক বুঝলো না সে। তাই দ্রুত পায়ে কোনোমতে সেখান থেকে চলে আসলো মিশরাত‌।
মিটিং শিডিউল শেষ হতেই অফিসের এক গাদা ফাইল নিয়ে কেবিনের দরজায় কড়া নাড়ে অরিন।
– ” ইয়েস কাম ইন!”
অনুমতি পেয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই স্নিগ্ধ দিকে নজর পড়ে অরিনের।
চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে স্নিগ্ধ।
– ” স্নিগ্ধ স্যার?
এইযে আপনার ফাইল গুলো!”
স্নিগ্ধ চোখ খুলে বলে উঠলো,
– ” ঠিক আছে, এখানে টেবিলে রেখে দাও সেগুলো!”
অরিন ফাইলগুলো পাশে রেখে কেবিনের দরজার সামনে গিয়েও থেমে গেল। পেছন ফিরে বললো,
– ” স্নিগ্ধ স্যার?”

আবারও অরিনের গলা শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকালো স্নিগ্ধ।
– ” ইয়েস মিস অরিন! এনিথিং এল্স?”

– ” ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমরা কি একসাথে ডিনার অর কফিশপে বসতে পারি?”
হঠাৎ করে অরিনের মুখে এমন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো স্নিগ্ধ! হঠাৎ এমন আবদারের কারণ??

ইফতেখার চৌধুরীর শরীরের কন্ডিশন এখন পূর্বের তুলনায় ৮৫ ভাগই ভালো। এখন অনেকটাই স্পষ্ট কথা বলতে পারেন তিনি। মিসেস ইয়ামিন আর মিস্টার ইফতেখার চৌধুরীকে ডিনার করিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছে মিশরাত‌। রোজকার দিনের চেয়ে আজ অনেকটা সময় ই পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্নিগ্ধ এখনো বাসায় ফেরেনি। রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মিশরাত‌। দরজা খুলে দিতেই স্নিগ্ধের ক্লান্তিমাখা চেহারাটা দৃশ্যমান হয় মিশরাতের।
ভেতরে প্রবেশ করতেই মিশরাত বলে উঠে,
– ” আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি!”

স্নিগ্ধ সোজাসাপ্টা গলায় বলে দিল,
– ” আমি বাহির থেকে অরিনের সাথে ডিনার করে এসেছি!
অযথা খাবার নষ্ট করতে হবে না!
তুমি খেয়ে নাও!”

স্নিগ্ধর কথা শুনে অবাক না হয়ে পারলো না মিশরাত‌। কেননা তার জানামতে স্নিগ্ধ কখনো বাহিরে কোনো অফিস কলিগদের সাথে ডিনারে যায় না? তাহলে আজ হঠাৎ অরিনের সাথে?
ছোট করে আচ্ছা বলে টেবিল থেকে খাবারের প্লেট গুলো সরিয়ে রেখে দিলো। আর স্নিগ্ধ ও গটগট করে উপরে উঠে চলে আসে।

– ” সো স্যাড তাইনা, মিশরাত?
কিন্তু কিছু যে করার নেই! এভাবেই আস্তে আস্তে স্নিগ্ধ কে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনবো আমি!
তোমাদের মাঝে কোনোদিনই আমি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হতে দিবো না। আর না দিবো তোমাদের দুজনকে কাছে আসতে!
নেক্সট একটা ছোট্ট চাল, আর তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকা বাদবাকি সম্পর্কটুকুতেও আমি এমন ফাটল ধরাবো যে আর কখনোই তা জোড়া লাগানো যাবে না।”
বলেই দেয়ালে টাঙানো মিশরাতের ছবির উপর লাল রঙের কালি দিয়ে ক্রস চিহ্ন এঁকে দিল অরিন।

– ” আই এম ব্যাক, স্নিগ্ধ! বি রেডি!!”
ফোনের রিংটোন কানে পৌঁছাতেই পাশ ফিরে তাকায় অরিন‌। ফোনে আর অক্ষর জ্বলজ্বল করছে। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে যা কানে আসে তাঁতে মুখের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল অরিনের‌। সাথে তো রয়েছেই কিছুটা রহস্য!!

– ” হোয়াট!!
তুমি আমাকে না জানিয়েই মাকে হ্যাঁ বলে দিলে?
আচ্ছা তোমার কী কমনসেন্স বলতে কিছু নেই নাকি আদৌ!”
অনেকটাই গর্জে বলে উঠলো স্নিগ্ধ!………

চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here