প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-১৬,১৭
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
ষোড়শ_পর্ব
– ” হোয়াট!
তুমি আমাকে না জানিয়েই মাকে হ্যাঁ বলে দিলে?
আচ্ছা তোমার কি কমনসেন্স বলতে কিছু নেই নাকি আদৌ!”
অনেকটা গর্জে বলে উঠে স্নিগ্ধ।
ভয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল মিশরাত। স্নিগ্ধর এরূপ আচরণ তার সম্পূর্ণ অজানা।
– ” আসলে মা চাইছিলেন তাই আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম!”
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো মিশরাত।
– ” মা বললো আর ওমনি তোমার হ্যাঁ বলতে হবে? আর কয়েকদিন বাদেই আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হবে। এখন এসব করার মানে কি?”
– ” স্নিগ্ধ!!!
এসব কেমন ব্যবহার? তুমি অকারণে মিশরাতের সাথে এতো চিল্লিয়ে কথা বলছো কোন সাহসে?”
পেছন থেকে মিসেস ইয়ামিন বলে উঠলেন। মায়ের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকালো মিশরাত আর স্নিগ্ধ দুজনেই। স্নিগ্ধর গলা শুকিয়ে আসছে। মা তাকে আবার সন্দেহ করে বসবে না তো?
– ” কি হলো? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
তুই মিশরাতের সাথে এভাবে চিল্লাছিস কেন?
আমি মিশরাতকে বলেছি যে তুই ওর সাথে তোর শ্বশুরবাড়ি যাবি। এতে এতো রুড বিহেভ করার কি আছে!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন । স্নিগ্ধ মাথা নিচু করে বললো,
– ” কিন্তু মা,,”
তার পূর্বেই মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর প্রত্যুত্তর,
– ” আর কোনো কথাই নয়। তুমি কাল সকালে মিশরাতের সাথে মিশরাতের বাড়ি যাবে এটাই ফাইনাল!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথার উপর উল্টো প্রত্যুত্তর করার সাহস হয়ে উঠলো না স্নিগ্ধর।
গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে মিশরাত। সকাল সকালই রওনা দিয়ে দিয়েছে তারা। স্নিগ্ধ ও কিছুক্ষণ পর সিটে বসে পড়লে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতে গাড়ি ছুটে চলে তার আপন গতিতে।
কলিং বেলের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই মিসেস ইবনাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। এতো সকালে কে আসবে আবার। দরজা খুলতেই অপর পাশ থেকে মিশরাত এসে মিসেস ইবনাতকে জড়িয়ে ধরে।
– ” মিশরাত, তুই?”
অনেকটা অবাক হয়ে বললেন মিসেস ইবনাত।
– ” কেন মা, নিজের বাড়িতে আসা বারণ নাকি?”
মুখ গোমড়া করে বললো মিশরাত।
– ” না, না! সেটা কখন বললাম আমি? আমি বলতে চাইছি যে তুই একা কেন? জামাই কোথায়?”
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন মিসেস ইবনাত।
– ” তোমাদের জামাই আসছে!
হঠাৎ করে উনার ফোন এসেছিল তাই হয়তো আসতে লেট হচ্ছে।”
মিসেস ইবনাত ছোট করে আচ্ছা বললেন। এর মাঝে স্নিগ্ধ এসে হাজির হয়।
– ” আসসালামুয়ালাইকুম মা! কেমন আছেন?”
– ” ওয়ালাইকুমুস সালাম! এইতো আলহামদুলিল্লাহ! তোমরা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো!”
মিসেস ইবনাতের কথায় স্নিগ্ধ আর মিশরাত দুজনেই বাসায় প্রবেশ করে। ভেতরে যেতেই মেহেরকে চোখে পড়তেই মিশরাত ছুট লাগায় মেহেরের দিকে।
– ” বউমনি…..!”
মেহেরও মিশরাতকে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর মিশরাত আর স্নিগ্ধ কে মিসেস ইবনাত উপরে রুমে পাঠিয়ে দিলেন।
অনেকদিন পর চেনা পরিচিত ঘরটায় প্রবেশ করার পর মনের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি মেলে গেল মিশরাতের। পুরো রুমটাই ঠিক আগের মতো আছে কিন্তু রুমের মানুষটারই এখানে আর নিয়ম করে থাকা হয় না।
মিশরাতের ভাবনার সুতো কাটে স্নিগ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে।
– ” বাহ্ তোমার রুমটা তো বেশ সুন্দর! আর পুরো রুম স্ক্যান করে যা মনে হচ্ছে তুমি একজন বিরাট বইপ্রেমী।
এম আই রাইট?”
মিশরাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়। তারপর লাগেজ থেকে তোয়ালে বের করে স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– ” আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন!
তারপর না হয় রেস্ট নিবেন!”
স্নিগ্ধ ও বিনিময়ে একটা হাসি দিয়ে তোয়ালে টা নিয়ে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে।
– ” ড্যাম ইট! এটা কিভাবে হলো!
নো নো মিশরাত আর স্নিগ্ধ একসাথে রয়েছে। তার মানে স্নিগ্ধ এ কদিন অফিসও জয়েন করবে না।
এ কদিনের মাঝে যাতে কোনো গড়মিল না হয়ে যায়। তোকে যা করার তাড়াতাড়ি ই করতে হবে অরিন!”
অফিসের কেবিনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ক্ষোভে বিড়বিড় করতে থাকে অরিন।
– ” ডোন্ট ওয়ারি, স্নিগ্ধ! এবারের চালে গুটি হিসেবে মিশরাতকেই আমি ইউজ করবো। আর সেই চালে পা দিয়ে তুমি নিজেই মিশরাতকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিবে!
আর এটাই হবে তোমার ধ্বংস হওয়ার প্রথম স্টেপ!!”
এদিকে ফ্রেশ হয়ে রুমে প্রবেশ করতেই স্নিগ্ধর চোখ পড়ে মিশরাতের উপর। গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়ি ফর্সা শরীরে ফুটে রয়েছে। আঁচলের অংশ টুকু কোমড়ে গুঁজে রুমের আনাচে কানাচে পরিষ্কার করার কাজে লেগে পড়েছে মিশরাত। যার ফলস্বরূপ ফর্সা কোমরের উন্মুক্ত অংশে থাকা কালো কুচকুচে রঙের তিল স্নিগ্ধর চোখে আটকে যায়। হাতে থাকা তোয়ালে পাশে রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিশরাতের দিকে।
বুকশেলফ থেকে বইগুলো সাজানো শেষ করে মিশরাত। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে তাকায় সে। স্নিগ্ধ কে এতোটা কাছাকাছি দেখে হার্টবিট ক্রমশ বাড়তে থাকে মিশরাতের।
স্নিগ্ধর উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মিশরাতের মুখে। স্নিগ্ধের ওমন গভীর ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার।
– ” কি হচ্ছে এসব? উনি এভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন কেন? কি করি এখন? হুটহাট এমন উদ্ভট মার্কা আচরণ করে কিভাবে লোকটা বুঝি না।”
মনে মনে বিড়বিড় করে দোয়া দুরূদ পড়া শুরু করে দেয় মিশরাত।
– ” মিশরাত, জলদি নিচে খেতে,,,”
পুরোটা বাক্য পূর্ণ হওয়ার আগেই মিশরাত আর স্নিগ্ধকে এভাবে দেখে চিল্লিয়ে অপর পাশে ফিরে তাকায় মেহের।
– ” সরি, সরি! আমি মনে হয় ভুল টাইমে এসে পড়েছি!
আপনারা একটু পর নিচে খেতে আসবেন। আমি যাই!”
বলেই গটগট করে হাঁটা শুরু করলো মেহের।
আর এদিকে মেহেরের চিৎকার শুনে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধ। এতক্ষণে যে কি বিরাট ভুল করতে যাচ্ছিলো তা মস্তিষ্কে বোধগম্য হতেই ছিটকে কয়েক পা পেছনে সরে আসে সে।
মিশরাত অসহায় দৃষ্টিতে একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার স্নিগ্ধর দিকে তাকাচ্ছে। মেহের তাদের একসাথে এভাবে দেখে কি ভাববে তা নিয়ে মাথাব্যথা উঠে যাচ্ছে মিশরাতের। স্নিগ্ধর দিকে চোখ পাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
– ” কাল রাতে তো আমাকেই কমনসেন্সের লেকচার দিচ্ছিলেন। আজ আপনার কমনসেন্স কি বাড়িতে লকারে রেখে এসেছিলেন?
বউমনি আমাদের দুজনকে দেখে কি ভাববে মনে মনে!”
এদিকে স্নিগ্ধ মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছে। আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিশরাত কটাক্ষের সুরে বলল,
– ” ওভাবে সটান দাঁড়িয়ে না থেকে নিচে চলুন! আমি একটু পর আসছি।
সবাই আমাদের জন্য ওয়েট করছে।”
বলেই মুখ বাঁকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল মিশরাত।
দুপুরের লাঞ্চের পর থেকে মিশরাত আর রুমে আসে নি। মেহেরের সাথে বসে গল্পের আসর মেলে বসেছে। আর স্নিগ্ধ এদিকে রুমে বসে বোরিং সময় কাটাচ্ছে।
– ” এজন্যই মাকে বলেছিলাম যে আমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই।
ধ্যাত!”
মনে মনে বিড়বিড় করে ফোন স্ক্রলে মনোযোগ দিলো স্নিগ্ধ।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে এসেছে। অনেকদিন পর বাড়ির মেয়ে বাড়িতে ফিরে আসায় বাড়ির পরিবেশ ই অন্য রকম। হলরুমে বসে বসে সবাই আড্ডা দিতে ব্যস্ত এসময় আজীজ সাহেব বলে উঠলেন,
– ” কি ব্যাপার, তোমরা সবাই এখানে আড্ডা দিচ্ছো কিন্তু স্নিগ্ধ? সে কোথায়?”
বাবার কথা শুনে মিশরাতের টনক নড়ে যে সে এ বাড়িতে একা আসেনি, তার সাথে আরো কেউ এসেছে।
– ” এইরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম স্নিগ্ধের কথা। নিশ্চয়ই রেগে বোম হয়ে রয়েছে। একবার কি উপরে গিয়ে দেখে আসবো?”
মনে মনে বিড়বিড় করে মিশরাত।
– ” মিশরাত, গিয়ে দেখে আসো স্নিগ্ধ উপরে কি করছে?”
আজীজ সাহেবের কথায় মিশরাত মাথা নাড়িয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
রুমের দরজা আস্তে করে খুলতেই আতকে উঠে মিশরাত। পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার।
– ” কি ব্যাপার, এভাবে পুরো রুম এভাবে অন্ধকার করে রেখেছে কেন? স্নিগ্ধ কি ঘরে নেই!”
ভাবতে ভাবতে লাইটের সুইচ অন করতে যাবে এমন সময় কারো হ্যাঁচকা টানে ভয় পেয়ে যায় মিশরাত।
বাইরের শো শো বাতাসে জানালার পর্দা সরতেই কিছুটা আলো রুমে এসে পড়ে আর তাতে স্নিগ্ধর রাগান্বিত চেহারা স্পষ্ট মিশরাতের চোখে পড়ে।
– ” এই মেয়ে এই! সমস্যা কি হ্যাঁ!
আমাকে এতো দূর এনে এখন নিজে সারা বাড়ি টই টই করে ঘুরছো, অথচ আমাকে এভাবে ঘরে থাকতে হচ্ছে!”
ভ্রু কুঁচকে ফেলে মিশরাত। মানে কি? কি সব হাবিজাবি বকছে স্নিগ্ধ?
– ” তো কি করবো? আপনাকে সারাদিন কোলে করে নিয়ে ঘুরবো নাকি?
আপনি কি বাচ্চা যে কোথাও যেতে ভয় পান? নিজে হেঁটে কি নিচ পর্যন্ত যাওয়া যেত না!!”
মিশরাতের প্রত্যুত্তরে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় স্নিগ্ধ। আর তাই তো! সে তো নিজেই যেতে পারতো! আর মিশরাতের অনুপস্থিতিই বা তাকে এতো ভাবাচ্ছে কেন?
রাতে ডিনারের পর্ব চুকিয়ে রুমে আসে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। মিশরাতের রুমের সাথে থাকা এডজাস্ট ব্যালকনি টা বড় হওয়ায় সেখানে বসার জন্য দুটো বেতের মোড়া আর একটা গোল টেবিল বসানো হয়েছে। স্নিগ্ধ ও গিয়ে সেখানে বসে পড়ে। মিশরাতও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলের বিনুনি পাকানো শেষ হলে একবার গিয়ে ব্যালকনিতে উঁকি দিয়ে আসে।
পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে স্নিগ্ধ। মিশরাত মোড়ায় বসতে বসতে বলে উঠে,
– ” ঘুমোতে যাবেন না? অনেকটা রাত হয়েছে তো!”
– ” আজ কেন জানি ঘুম আসছে না! তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়!”
– ” ঠিক আছে। না ঘুমালেন! তাহলে আমাকে গল্পের পরবর্তী অংশ টুকু বলুন!”
ভ্রু কুঁচকে তাকায় স্নিগ্ধ।
– ” গল্প? কিসের গল্প? কি বলতে চাইছো তুমি!”
চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠলো স্নিগ্ধ।
এবার মিশরাতও সোজা হয়ে বসে একদৃষ্টে স্নিগ্ধের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
– ” শুভ্রতা কোথায়?”………..
চলবে ?
#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#সপ্তদশ_পর্ব
– “শুভ্রতা কোথায় স্নিগ্ধ?
আর ডায়েরির ছেঁড়া পাতা গুলোতেই বা এমন কি ছিল যার কারণে আপনি সেগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো মিশরাত।
দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। স্নিগ্ধ ভালো করেই জানে মিশরাত সবটা না জেনে থামবে না। আর কতোই বা লুকোবে তার অতীতকে। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবতা কাটিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠল,
– ” শুভ্রতা ইজ ডেড!”
স্নিগ্ধর কথা কর্ণপাত হতেই মিশরাতের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অতিমাত্রায় শক খেলে যা হয় সাধারণত। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল,
– ” মানে!
কিন্তু কি করে! ঐদিন রাতেও তো সবকিছু ঠিকঠাক ছিল!”
মিশরাতের কথা শুনে স্নিগ্ধ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ফ্ল্যাশব্যাক,,
” সেদিন রাতে রাগে ক্ষোভে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার শুভ্রতার বারংবার ডাক কানে যাওয়া সত্বেও পেছন ফিরে তাকাই নি আমি। কেনই বা তাকাবো! যেখানে আমি তাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম, যেই বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার ছিল তারা দুজনেই আমাকে বাজে ভাবে ঠকিয়েছে।
দ্রুত পায়ে হাঁটার এক পর্যায়ে শুভ্রতার আত্ম চিৎকার কানে পৌঁছাতেই আমার পা আপনাআপনি থমকে গেল। পেছনে তাকাতেই আমার হিতাহিত জ্ঞান টুকু হারিয়ে গিয়েছিল। কেননা চোখের সামনেই নিজের ভালোবাসার মানুষটির রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা মোটেও কম কথা নয়। একটা বড় বাসের ধাক্কায় মুহূর্তেই পুরো শরীর রক্ত বর্ণ ধারণ করতে থাকে শুভ্রতার।
সেদিনের চেয়ে মর্মান্তিক কোনো স্মৃতি আমার জীবনে আদৌ আছে কি না আমি মনে করি না। সেদিন খুব কষ্টে নিজেকে সামলে শুভ্রতাকে নিয়ে হসপিটালে পৌছেছিলাম। এক্সিডেন্টের কারণে চেহারার এক পাশের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লাস্ট তিন ঘন্টা যাবৎ অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে একসময় ডক্টর বেরিয়ে আসে। আর এসে আমাকে যা বলে তাতে আমার পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যায়।
ডক্টর: “সো সরি মিস্টার স্নিগ্ধ!
উই ট্রাইড আওয়ার বেস্ট। বাট শি ইজ নো মোর!”
থমকে গিয়েছিলাম আমি। নিজের কানকে যেন ঐ মুহুর্তে বিশ্বাস করতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ঐযে নিয়তি!
সে আমাদের কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দেয়। সেদিন আনান ও হসপিটালে উপস্থিত ছিল। এরপর থেকে আনানের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখিনি। কয়েকমাস পরেই এক্সাম দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিডিতে ব্যাক করি। তবে বিডিতে ব্যাক করি সম্পূর্ণ নতুন রূপে।
একদম নতুন স্নিগ্ধ যাকে কেউ কখনো দেখেনি। অবশ্য মা এ ব্যাপারে আগে থেকেই জানতো আর এটা কোনোভাবে বাবার কানে পৌঁছাতেই বাবা আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আর যেটাতে অবাধ্য হওয়ার কারণেই বাবা হার্ট অ্যাটাক করে।”
মিশরাত এতক্ষণ একদৃষ্টে খুব মনোযোগ সহকারে স্নিগ্ধের বলা প্রতিটা কথা শুনছিল। কথাগুলো বলতে গিয়ে স্নিগ্ধের গলা বারবার কেঁপে উঠছিল। চোখের কোণে অশ্রু জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে।
মিশরাতও ঠিক কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। তার কিই বা বলা উচিত!
মিশরাতের টনক নড়ে স্নিগ্ধের আওয়াজ পেয়ে।
– ” তবে হ্যাঁ একটা কথা কি জানো, ভালোবাসার মানুষটি যতই ভুল করুক না কেন, তার প্রতি অভিমান, অভিযোগ জমুক না কেন দিনশেষে তার প্রতি কখনোই আমাদের মনে ঘৃণা জন্মাবে না।
আর যদি কখনো তোমার ভালোবাসার মানুষটির প্রতি ঘৃণা জন্মায় তাহলে বুঝে নিও আসলে তুমি ঐ মানুষটিকে কোনোদিন ভালোই বাসো নি।”
মিশরাত মলিন হেসে বলে উঠলো,
– ” এখনো খুব ভালোবাসেন শুভ্রতাকে, তাই না?”
মাথা তুলে তাকালো স্নিগ্ধ। মিশরাতের দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা গলায় বলে উঠলো,
– ” ভালোবাসি কি না জানি না তবে সে এখনো আমার হৃদয়ের একটা স্থানে গেঁথে রয়েছে যা আমি চাইলেও ভুলতে পারবো না।”
– ” আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে। আমি বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
বলেই উঠে চলে যেতে নিলে স্নিগ্ধর ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় মিশরাত।
– ” তুমি কাউকে ভালোবাসো না?”
পেছন ফিরে তাকায় সে। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠে,
– ” না কাউকে তেমন করে কোনোদিন ভালোবাসা হয়নি!”
বলেই গটগট করে রুমে চলে আসলো মিশরাত। আর স্নিগ্ধ বাইরের খোলা আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
পরদিন সকালে সূর্যের আলোর ঝলকানি মুখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই পাশে স্নিগ্ধের ঘুমন্ত চেহারা চোখে পড়ে তার। কপালের চুল গুলো এলোমেলো, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলোও হালকা অগোছালো তবে দেখতে অনেক কিউট লাগছে।
– ” কে বলবে এই মানুষটার ভেতরে এতো গুমোট কষ্ট লুকায়িত!”
স্নিগ্ধর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করলো মিশরাত।
– ” আচ্ছা ঠিক আছে! তুমি ওদের উপর নজর রাখো আর হ্যাঁ প্রতিটা ইনফরমেশন আমাকে টাইম টু টাইম সেন্ড করবে!”
বলেই খট করে কল কেটে দিলো অরিন।
– ” কি মনে করেছো স্নিগ্ধ? তুমি ওখানে থাকবে আর আমি এখানে থেকে কিছুই জানতে পারবো না?
উহু মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ, আমি তোমার আশেপাশে না থাকলেও সবকিছু একাকীই আমার জানা হয়ে যাবে!”
বলেই কিছুটা বাঁকা হাসলো অরিন।
বিকেলের দিকে স্নিগ্ধ, মিশরাত, মেহের, ইরফান, মিসেস ইবনাত আর আজীজ সাহেব সকলেই ঘুরতে বেরিয়েছেন একসাথে। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর গাড়ি এসে থামে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। সবাই বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে। কর্ণারের সাইডে গিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। আর পেছনের সারিতেই বাকি সবাই বসে। মেহেরের প্রেগন্যান্সির তিন মাস চলছে। ওয়েটার এসে সবার টেবিল থেকে অর্ডার নেয়া শেষ করে স্নিগ্ধ আর মিশরাতের টেবিলে এসে অর্ডার নিতে চাইলে স্নিগ্ধ বলে উঠে,
– ” শুধু এক কাপ ব্ল্যাক কফি!”
ব্ল্যাক কফির নাম শুনতেই নাক সিঁটকায় মিশরাত।
– ” এই তেতো লোকের পেটে কি আর মিষ্টি জিনিস হজম হবে!
নিরামিষ কোথাকার!”
মনে মনে কথাগুলো আওড়াতে থাকে সে।
গল্প গুজবের একসময় মিশরাত বলে উঠে,
– ” আচ্ছা আপনি এখানে বসুন!
আমি একটু আসছি!”
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শাড়ির আঁচল ভালোভাবে ঠিক করে নিচ্ছিলো মিশরাত। এমন সময় কোমড়ে কারো বাজে স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে সে। সচরাচর লেডিস ওয়াশরুমে তো পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাহলে কে হতে পারে? পেছনে তাকিয়ে যাকে দেখে তাতে যেন আরেক দফা অবাক হয় সে।
এদিকে স্নিগ্ধ মোবাইল স্ক্রল করলেও তার মাথায় একটা জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছে।
– ” কি ব্যাপার! মেয়েটা সে কখন বেরিয়েছে কিন্তু এখনো আসার কোনো নাম গন্ধ নেই!!”
– ” রবিন ভাই আপনি!!!”
অনেকটা বিস্মিত হয়ে বলে উঠে মিশরাত।
রবিন বিশ্রী ভাবে হেসে বলে উঠে,
– ” হ আমি! কেন তুই কারে আশা করছিলি? তোর নাগর, স্নিগ্ধরে?”
ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় মিশরাত। একটা মানুষ কতটা নিচে নামতে পারলে এমন ভাষায় কথা বলতে পারে!
– ” আপনার সাহস হয় কি করে আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলার! আর আপনি এখানে কি করছেন?”
রক্তচক্ষু নিয়ে বলে উঠে মিশরাত।
এদিকে রবিনের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে পূর্বের মতোই বিশ্রী হেসে এগোতে থাকে মিশরাতের দিকে।
– ” কি ব্যাপার ফারাহ্! তোরে তো রাগলে আরো মারাত্মক সুন্দরী লাগে এটা তো জানতাম কিন্তু এখন বিয়ার পর দেখি তোর সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাইড়া গেছে!”
এমন বাজে মন্তব্য পেয়ে রাগে মুখ হাত শক্ত হয়ে আসে মিশরাতের। কিন্তু এখন সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। স্নিগ্ধ আর বিশেষ করে মেহেরের সামনে কোনো ঝামেলা হলে এটার সাইড ইফেক্ট মেহেরের উপর পড়তে পারে। তাই যথাসম্ভব রাগটা কে কন্ট্রোল করে দরজা খুলে বের হতে নিলেই রবিন খপ করে মিশরাতের বাম হাত ধরে ফেলে।
নিয়ন্ত্রণে থাকা রাগটুকু আরো বেড়ে যায়। হাত মোচড়ামুচড়ি করার এক পর্যায়ে মিশরাত না পেরে ঠাস করে চড় বসাতে যাবে তখনি পেছন থেকে কারো কন্ঠস্বর পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় মিশরাত।
স্নিগ্ধ রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার ইতিমধ্যে।
এগিয়ে গিয়ে রবিনের দিকে তেড়ে যেতেই রবিন ভয়ে মিশরাতের হাত ছেড়ে দেয়। রবিনের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে,
– ” এই ভুল একবার করেছিস তো করেছিস! এর পর এটা করার চিন্তাও করিস না!
নাহলে ধরার জন্য ঐ হাত দুটোই তোর কাছে থাকবে না! মাইন্ড ইট!!”
বলেই মিশরাতের হাত মুঠোয় নিয়ে গটগট করে হাঁটা শুরু করলো স্নিগ্ধ। আর মিশরাত শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধের দিকে।
বাসায় ফেরার পথে স্নিগ্ধ একটা কথাও বলেনি মিশরাতকে। চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে এই মুহূর্তে ভীষণ ভাবে রেগে আছে। মিশরাতও তেমন একটা কথা বলেনি। রুমে শুধু গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করতে দেরি কিন্তু স্নিগ্ধের গর্জে উঠায় দেরি নেই।
– ” কোন সাহসে ঐ রাসকেল তোমার হাত ধরলো!!
আমি যদি আর একটু যেতে দেরি করে ফেলতাম তাহলে ভাবতে পারো কি থেকে কি হয়ে যেতে পারতো!!
ইডিয়ট কোথাকার!!”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠে স্নিগ্ধ।
আর এদিকে স্নিগ্ধের এমন গর্জে উঠায় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত। তাকে নিয়ে এতোটা পসেজিব হওয়ায় অনেকটা অবাক ও হয় সে।
– ” আমি তো ভাবতে পারিনি যে ঐ রবিন হঠাৎ করেই ওখানে চলে আসবে!! আমি তো জাস্ট,,,”
কম্পিত গলায় বলতে যাচ্ছিল মিশরাত কিন্তু পুরোটা বাক্য পূর্ণ করতে পারলো না কেননা তার পূর্বেই স্নিগ্ধ তার ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা মিশরাতের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।
– ” নো, নো! এটা হতে পারে না!
স্নিগ্ধ আর মিশরাত এতটা ক্লোজলি হতে পারে না! আমি হতে দিবো না সেটা!
কি মনে করেছিলে স্নিগ্ধ, এত সহজেই আমি সবকিছু ভুলে যাবো!!
নো! সেদিন শুধু মাত্র তোমার জন্য আমাকে ওভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে হতো না! আমার চেহারা পাল্টাতো না! আনান ও আমায় ছেড়ে চলে যেত না! সবকিছু হয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য! আর তোমাকে এত সহজেই তো আমি ছেড়ে দিবো না মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ!!”
বলেই হাতে থাকা শোপিজ সামনে থাকা আয়নাতে ছুড়ে মারলো অরিন। আর মুহুর্তে সেটা চুড়চুড় করে খন্ডে পরিণত হতে থাকে!
– ” আই এম ব্যাক স্নিগ্ধ! শুভ্রতা ইজ ব্যাক!!”…………….
চলবে ?