প্রেম_পায়রা ?️?️ পর্ব-১৮,১৯

0
1232

প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-১৮,১৯
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
অষ্টাদশ_পর্ব

মিশরাতের মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না একটু আগেই তার সাথে কি হয়ে গেল। আর তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরেই স্নিগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন একটু আগে কিছুই হয় নি।
মিশরাতকে এভাবে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ এগিয়ে গিয়ে মিশরাতের সামনে তুড়ি বাজাতেই ধ্যান ভাঙে মিশরাতের।
– ” কি ব্যাপার এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন! আ’ম টায়ার্ড! একটু ঘুমোতে চাই!”
বলেই মিশরাতেকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে মিশরাতের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো স্নিগ্ধ।
এদিকে মিশরাত পারছে না একটু পর হার্ট অ্যাটাক করতে। একের পর এক স্নিগ্ধের সব উদ্ভট আচরণ তাকে অনেক ভাবিয়ে তুলছে!

– ” এসব কি হচ্ছে আমার সাথে!!
আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো?
স্নিগ্ধ হঠাৎ এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন আমার সাথে?
পরশু রাতেই তো কত কিছু শুনিয়ে দিয়েছিল আমাকে! তাহলে আজকে হঠাৎ এমন পরিবর্তন!!!”
ভাবতে ভাবতেই মিশরাতের নজর যায় স্নিগ্ধর দিকে। গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা নিষ্পাপ চেহারা দেখে ভাবনা মিলিয়ে গেল মিশরাতের‌। তাই কয়েক পলক তাকিয়ে আস্তে আস্তে মিশরাতও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।

সকালে আলোক রশ্মি চোখের উপর পড়তে চোখ মুখ ঘুমের ঘোরেই কুঁচকে ফেলে স্নিগ্ধ। নড়েচড়ে আড়মোড়া দিয়ে উঠতেই মিশরাতের ঘুমন্ত চেহারা তার চোখে পড়ে। মিশরাত হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হয়ে ঘাড়ের নিচে পড়ে রয়েছে। আর ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়াউড়ি করছে। নিষ্পলক ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চুপচাপ উঠে গেল স্নিগ্ধ।

এদিকে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে আস্তে আস্তে নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। চোখ পিটপিট করে আশেপাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কে না দেখে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই খেয়াল করে মেহের দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

– ” কি ব্যাপার ননদিনী! ঘুম এখনো ভাঙেনি আপনার?
নাকি রাত জেগে জেগে গল্প করতে করতে ঘুমানোর টাইম পান নি!”

চোখে লেগে থাকা বাদবাকি ঘুম টুকুন উবে যায় মিশরাতের। ভ্রু কুঁচকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
– ” কিসের গল্প, বউমনি? আর কিসের কথা বলছো তুমি?”

মেহের হালকা হেসে বলে উঠলো,
– ” থাক আর না জানার ভান করতে হবে না তোকে!
আমাদের ফারাহর একমাত্র হাজবেন্ড তো ফারাহ্কে চোখে চোখে হারায়।”
বলেই মুখ টিপে হাসলো মেহের। আর এদিকে মিশরাত বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।
– ” বউমনি তুমি কিন্তু দিন দিন ভারী দুষ্ট হয়ে যাচ্ছো!
ভাইয়াকে যেয়ে কিন্তু সব বলে দেব।”
মুখ ফুলিয়ে বলে উঠে মিশরাত‌।

– ” হয়েছে বাবা মুখ ফুলিয়ে রাখতে হবে না। আমি তো মজা করছিলাম!
এই নাও তোমার ভাইয়া এগুলো তোমাদের দিয়েছে। আজ রাতে বাহিরে আমাদের দুই কাপলকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে পাঠানো হবে!”
বলেই একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল মেহের মিশরাতের হাতে।
মেহেরের কথা শুনে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল মিশরাতের‌। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার? তাও আবার স্নিগ্ধ আর মিশরাত একসাথে? স্নিগ্ধ শুনতে পেলে তো নিশ্চয়ই চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিবে। আফটার অল সে এই বিয়েটা মানে না। এর মাঝে মেহের চলে যায়। আর মিশরাত ভাবতে ভাবতে প্যাকেট টা নিয়ে রুমে চলে আসে।
স্নিগ্ধ ফ্রেশ হয়ে বেরোতে মিশরাতকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করে উঠে,

– ” কি ব্যাপার? এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন!
আর এই প্যাকেট কিসের?”
স্নিগ্ধর গলার কন্ঠস্বর কানে যেতে পাশ ফিরে তাকায় মিশরাত‌। আমতা আমতা করে বলে উঠে,
– ” আসলে,,আসলে বউমনি,,”

– ” কি হয়েছে? এভাবে আমতা আমতা করছো কেন? কি হয়েছে সরাসরি বলো!”
বলেই সোফার উপর সোজা হয়ে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। মিশরাত কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট টা স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দিল।
– ” আসলে ইরফান ভাইয়া আমাদের চারজনের জন্য ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের এরেঞ্জমেন্টস করেছেন। আর আমাদের দুজনের জন্য এটা পাঠিয়েছেন!”
আমতা আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।

এদিকে স্নিগ্ধ একদৃষ্টে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অতঃপর শান্ত গলায় যা বললো তাতে মিশরাতের বিস্ময়ের সীমানা রইলো না।

কালো রঙের জর্জেটের শাড়ি, হোয়াইট স্টোনের ইয়ারিং, হোয়াইট স্টোনের ব্রেসলেট, কোমর অবধি চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে দেয়া আর ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিকের ছোঁয়া। চুলগুলো ঠিক করতে করতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত‌। পেছনে ফিরে স্নিগ্ধ কে চোখে পড়তেই চোখ আটকে গেল তার। মিশরাতের সাথে মিলিয়ে পুরো ব্ল্যাক স্যুট পড়নে, চুলগুলো সুন্দর করে সেট করা! একদম ড্যাশিং লুক নিয়ে সামনে হাজির হয় স্নিগ্ধ।
এদিকে মিশরাতকে কালো রঙের শাড়িতে দেখে চোখ আটকে যায় স্নিগ্ধর। ফর্সা শরীরে কালোর আবরণ যেন একদম ফুটে উঠেছে।
নিচ থেকে ইরফানের গলার আওয়াজ পেয়ে দুজনের ধ্যান ভাঙে।
– ” চলো, যাওয়া যাক!”
স্নিগ্ধর কথায় মিশরাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। পাশ দিয়ে পার্স নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে দুজনেই‌।
ইরফান আর মেহের দুজনেই ম্যাচিং করে পার্পেল কালারের ড্রেস পড়েছে। স্নিগ্ধ আর মিশরাত সিঁড়ি দিয়ে নামতেই চারজন মিলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে ড্রাইভ করছে স্নিগ্ধ। আর পাশেই মিশরাত বসে আছে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আর পেছনের সিটে বসে আছে মেহের আর ইরফান। স্নিগ্ধ ড্রাইভিং করার ফাঁকে ফাঁকে বারবার আড়চোখে মিশরাতের দিকে তাকাচ্ছে।
প্রায় এক ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামে গন্তব্যে।

ছোট বড় ক্যান্ডেল, ফুল মিলিয়ে খুব সুন্দর করে টেবিল সাজানো হয়েছে। একটু পর ওয়েটার এসে দুজনের টেবিলে খাবার দিয়ে চলে যায়। এদিকে মিশরাত মুখ দিয়ে টু শব্দ ও বের করছে না। সে এ কদিনের মধ্যে স্নিগ্ধের বদলে যাওয়া আচরণ নিয়ে ভাবছে সে।
– ” স্নিগ্ধ আসলে চাইছেন টা কি? কদিন আগেও তো অন্য রকম ছিলেন! তাহলে দুদিন ধরে এতো কেয়ারিং, কোনো রাগারাগী ভাব নেই, হুটহাট উদ্ভট সব আবদার, আচরণ সবকিছুই কি নাটক মা বাবা সবাইকে দেখানোর জন্য নাকি সবকিছুর পেছনেও অন্য কোনো গল্প রয়েছে!”

মিশরাতকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে স্নিগ্ধ হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে।
হালকা চমকে উঠে মিশরাত।
– ” কি হয়েছে মিশরাত‌? আজ সকাল থেকেই দেখছি একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছো! এনিথিং রং?”
মিশরাত মাথা দু পাশে নাড়িয়ে না বোঝায়। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসতে যাবে তখনই মেহেরের গলার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত‌।

– ” আরে বউমনি, তুমি এখনো জেগে রয়েছো?
তোমাকে তো ডক্টর বলেছে ঠিক টাইম মতো ঘুমোতে! নাহলে তো শরীর খারাপ করবে!”

– ” একদিন দেরি করে ঘুমোলে আমার তেমন একটা ক্ষতি হবে না কিন্তু তোর সাথে আজ কথা না বললে হয়তো অন্য কিছু হয়ে যাবে!”

মেহের গম্ভীর কন্ঠে বলে মিশরাতের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। আর এদিকে মেহেরের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না মিশরাতের যে মেহের ঠিক কি বলতে চাইছে!
– ” হ্যাঁ বলো, বউমনি!
কি এমন কথা যে না বললে অন্য কিছু হবে!”

জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।

– ” তোর আর স্নিগ্ধের মাঝে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? নাকি কিছু লুকাচ্ছিস আমার কাছ থেকে?”

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। গলাটাও শুকিয়ে এসেছে মিশরাতের।
– ” হায় আল্লাহ! এখন কি হবে? বউমনি এসব কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? তাহলে কি বউমনি কোনোভাবে কিছু টের পেয়েছে?
না না এটা তো সম্ভব না?”
মনে মনে বিড়বিড় করে মিশরাত‌।
– ” কি হলো কোথায় হারিয়ে গেলি? আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করেছি!”

– ” আরে কি হবে আমার বউমনি? কিছুই হয় নি তো? আমার আর স্নিগ্ধের মাঝে সবকিছুই তো ঠিক আছে!”
আমতা করে বলে উঠলো মিশরাত‌।
মেহের একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিশরাতের হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,
– ” দেখ মিশরাত, আমি জানি তুই আমার থেকে কোনোকিছু লুকিয়ে রাখিস নি আজ পর্যন্ত। আর আমার বিশ্বাস তুই কিছু লুকাবিও না। তবে হ্যাঁ স্নিগ্ধের মতো ছেলে পাওয়া কম কথা নয়। এ কদিন আমি স্নিগ্ধকে খুব ভালো ভাবে খেয়াল করেছি। তোর প্রতি পসেজিবনেস, কেয়ারিং তোদের দুজনের মাঝে বন্ডিং সবকিছু সত্যিই মুখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আমি জানি তুই এখনো স্নিগ্ধকে ভালোবেসে উঠতে পারিস নি। কিন্তু স্নিগ্ধ ছেলে হিসেবে অসাধারণ। ছেলেটা সত্যিই তোকে ভালোবাসে। আমি জানি তুইও ঠিক একদিন স্নিগ্ধ কে ঠিক ভালোবাসবি! আর সেটা দেরিতে হলেও!!”
বলেই মেহের উঠে দাঁড়ালো। আর বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো।

আর মিশরাত‌ ঠায় বসে আছে এখনো। তার মাথায় মেহেরের বলে যাওয়া কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
– ” বউমনির কথাগুলো কি আদৌ সত্যি? আসলেই কি স্নিগ্ধ আমাকে ভালোবাসে? আর আমিও কি আসলেই কোনোদিন স্নিগ্ধ কে ভালোবাসতে পারবো!!!”……..

চলবে ?

#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব

পরদিন সকালে সূর্যের আলো ফোটার কিছুক্ষণ পরই মিশরাত‌ ঘুম থেকে উঠে লাগেজ গোছানো শুরু করে দেয়। কেননা আজ যে ও বাড়ি ফিরতে হবে। লাগেজ গোছানো শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে মিশরাত‌। মায়ের সাথে নাশতা বানানোর কাজে লেগে পড়ে সে।

সকাল ৮:৩০ মিনিট,,
ডাইনিং টেবিলে বসে রুটি চিবোচ্ছে স্নিগ্ধ। পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিশরাত সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। এ কদিন মেহেরের সাথে বেশ ভালোই সময় কেটেছে মিশরাতের‌।
গাড়ির সিটে বসতেই মাথা এলিয়ে দেয় মিশরাত‌। স্নিগ্ধ সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বলে উঠলো,
– ” বাড়িতে গিয়ে মা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে আমাদের ব্যাপারে তাহলে বলো যে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। আর তুমি তো জানোই যে মা ছোট খাটো বিষয় নিয়েও সন্দেহ করে তাই আমাদের সাবধানে থাকতে হবে!”

স্নিগ্ধর কথায় মিশরাত শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। বাইরের ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির জানালার গ্লাস ভেদ করে মিশরাতকে ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার।

প্রায় তিন ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামে চৌধুরী বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে লাগেজ গুলো এক সাইডে বের করে নেয় স্নিগ্ধ। মিশরাতও অন্য পাশ থেকে বের হয়ে যায়। কলিং বেলে চাপ দিতেই অপর পাশ থেকে মিনিট দুয়েক পর মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী দরজা খুলে দিলেন। মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীকে দেখা মাত্র মিশরাত সামনে এগিয়ে গেল।
মিসেস ইয়ামিন ও মিশরাতকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ আর মিশরাত দুজন একসাথে বাসায় প্রবেশ করে। ড্রয়িং রুমে সোফার উপর চোখ যেতেই স্নিগ্ধর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অস্ফুট স্বরে শুধু বলে উঠলো,
– ” ব,বা,বাবা!!”

মিস্টার ইফতেখার চৌধুরী সোফার উপর বসে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়েছিলেন সবেমাত্র কিন্তু পেছন থেকে হঠাৎ স্নিগ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি থেমে গেলেন।
স্নিগ্ধ একপ্রকার দৌড়ে ইফতেখার চৌধুরীর কাছে চলে গেল।

– ” বাবা তুমি? বাবা তুমি ঠিক হয়ে গিয়েছো?”

অতি উৎসুক হয়ে ইফতেখার চৌধুরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ। মিশরাতও গুটিগুটি পায়ে স্নিগ্ধর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইফতেখার চৌধুরী আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝান।
– ” হ্যাঁ বাবা, স্নিগ্ধ! দেখ আমি ঠিক হয়ে গিয়েছি! এইযে দেখ আমি এখন কথা বলতে পারছি!”
ইফতেখার চৌধুরীর কথা শুনে স্নিগ্ধ খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
– ” আ’ম সো মাচ হ্যাপি,বাবা! আমি সত্যি কল্পনাও করতে পারি নি আমি বাড়ি এসে এত বড় সারপ্রাইজ পাবো! কিন্তু মা তুমি তো একবারও আমাকে ফোন করে জানাও নি এ ব্যাপারে!!”

মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী এগিয়ে আসলেন।
– ” যদি তোকে বলেই দিতাম তাহলে সারপ্রাইজ থাকতো কিভাবে?
আর এ সবকিছুই হয়েছে তোর আর মিশরাতের জন্য। মিশরাতকে আমি যতই ধন্যবাদ দেই না কেন সেটা কম হয়ে যায়। মেয়েটার তোর বাবার প্রতি যত্ন, দায়িত্বে তোর বাবা আরো তারাতাড়ি রিকভার করেছে।”

মিসেস ইয়ামিনের কথার সাথে ইফতেখার চৌধুরীও তাল মিলিয়ে বলে উঠলেন,
– ” হ্যাঁ তোর মা ঠিকই বলেছে, আজ যদি তুই আর মিশরাত না থাকতি তাহলে আমার সুস্থ হওয়া বোধ হয় এবার হয়ে উঠতো না।”

দুজনের কথা শুনে মিশরাত হালকা হেসে বলে উঠলো,
– ” এসব কি বলছেন আপনারা? আপনারা আমার বাবা মায়ের মতো! আর বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে কর্তব্য থাকে সেটাই আমি পালন করেছি!”
মিশরাতের কথা শুনে স্নিগ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে মিশরাতের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো।

রাতের বেলা,,
ডিনার শেষ করে প্রায় রাত দশটার দিকে রুমে আসে স্নিগ্ধ। রুমে এসে খেয়াল করে মিশরাত ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বসে আনমনে চুলে বিনুনি পাকাচ্ছে। এদিকে রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত‌। স্নিগ্ধর দিকে চোখ যেতেই স্নিগ্ধ বিনিময়ে একটা হাসি দেয়।
– ” থ্যাঙ্ক ইউ মিশরাত‌।”
বিছানার উপর বসতে বসতে বলে উঠলো স্নিগ্ধ।

– ” থ্যাঙ্ক ইউ? কিন্তু সেটা কিসের জন্য?”
ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে মিশরাত‌।
– ” এইযে বাবা আজ পুরোপুরি সুস্থ! আমি তো কল্পনাও করিনি বাবা এতো তাড়াতাড়ি রিকভার করবে! বাট সেটা সম্ভব হয়েছে শুধু তোমার জন্য!
তার জন্য এই ছোট্ট একটা থ্যাঙ্ক ইউ।”
মিশরাত‌ নিঃশব্দে হাসে।

– ” হয়েছে হয়েছে এবার থামুন!
আমি জানি আমাদের বিয়েটা নরমাল না বাট এ কয়েক মাসে এ বাড়ির সবার সাথে একটা ভালো বন্ডিং হয়ে গিয়েছে আমার। সেটাকে ভুলি কি করে? আর ঐ যে বললাম আপনার বাবা মা আমার বাবা মায়ের মতোই!
সো থ্যাংকস ইজ নট এলাউড! মাইন্ড ইট!!”

সোজাসাপ্টা ভাবে বলে দিল মিশরাত‌। তবে প্রথম বাক্যটা বলার সময় কেন জানি গলাটা বারবার কেঁপে উঠছিল যেন এ কথাটা বলা অন্যায়।

– ” আচ্ছা বাদ দিন! আপনার কাছে আজ একটা আবদার চাইবো? পূরণ করবেন?”
রিকোয়েস্ট করে বললো মিশরাত‌।

– ” হ্যাঁ অবশ্যই কেন না?
ওয়েট আমি আসছি!”
বলেই পাশ থেকে উঠে গিয়ে একটা গিটার নিয়ে আসলো স্নিগ্ধ।

– ” আপনি গিটার ও বাজাতে পারেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মিশরাত‌।

– ” ইয়েস ম্যাম!
কলেজ লাইফে থাকতে শখের বশে গিটার বাজানো শিখেছিলাম। অনেকদিন বাজানো হয় না অবশ্য!”

বলেই মিশরাতের ঠিক সামনে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ পর ই গিটারের টুংটাং শব্দ কানে আসে মিশরাতের‌।

” তো কেয়া হুয়া জুদা হুয়ে
মাগার হ্যায় খুশি মিলে তো থে,,
তো কেয়া হুয়া মুড়ে রাস্তে
কুছ দূর সাঙ্ চালে তো থে

দুবারা মিলেগে কিসি মোর পে
যো বাকি হ্যায় বাত ও হোগি কাভি‌,,,

চালো আজ চালতে হ্যায় হাম,,,,,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,
জুদা হো রাহে হ্যায় যো হাম,,,,

ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,,

দুখাও ম্যায় দিল
জাতে জাতে তেরা
মেরা অ্যায়সা কোই ইরাদা নেহি
ছুপা লুগা ম্যায় হাসকে আসু মেরে
এ তেরি খুশি সে তো জাদা নেহি

জো বিছরে নেহি তো ফির ক্যায়া মাজা‌
জারুরি বি হ্যায় রেহনি থোরি কামি,,

নেহি হোগা কুছভি খাতাম,,,

ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,
জুদা হো রাহে হে কাদাম‌,,,,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,,,,,,,

সিতারো কি ভীড় কো গরছে‌
এক আখরি বার ফির দেখলো
এ যো দো আলাগ সি হ্যায় বেয়ঠে হুয়ে

এ তুম হো এ ম্যায় হু‌
ইয়েহি মানলো

এ দিন মে নেহি নাজার আয়েগে,,
মাগার কাল কো যাব রাত হোগি কাভি‌
যো‌ ইয়ে রশনি‌ হোগি কাম,,

ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,
জুদা হো রাহে হ্যায় কাদাম‌
ফির মুলাকাত হোগি কাভি‌,,,”

পুরোটা গান শেষ হতেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো স্নিগ্ধ। মিশরাতও এতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল স্নিগ্ধের দিকে‌। গানের প্রতিটা লাইন গাইতে গিয়ে গলাটা কিঞ্চিৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল স্নিগ্ধর‌।

– ” আপনি আমায় ভালোবাসেন স্নিগ্ধ?”
আনমনে তাকিয়েই বলে উঠলো মিশরাত‌।

স্নিগ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশরাতের দিকে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না তার। অতিমাত্রায় অবাক হলে যা হয়?
– ” কি বলছো এসব মিশরাত?”
ধ্যান ফিরে আসে মিশরাতের‌। মনে পড়ে সে তার অজান্তেই কত বড় কথা বলে ফেলেছে!
অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা দম নিয়ে বলে উঠে,
– ” আপনি কি আমায় ভালোবাসেন স্নিগ্ধ?”
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় স্নিগ্ধ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গিয়েছে।
– ” এসব কি ধরনের কথা, মিশরাত?
আমি তো তোমাকে সবকিছু আগে থেকেই বলে দিয়েছি!! তারপর ও তুমি এসব কথা বলছো কি করে??”

স্নিগ্ধর কথা শুনে মিশরাতও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর স্নিগ্ধর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ” হ্যাঁ আমি জানি সবটা!!
সবটা জেনেও আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি! আমাকে কি ভালোবাসা যায় না?”

আরেক দফা অবাক হয় স্নিগ্ধ। এসব কি বলছে মিশরাত!

– ” মিশরাত‌‌!!
আর ইউ লস্ট ইউর সেন্স? কি সব হাবিজাবি বকছো?
ওয়েট, ওয়েট!! কেউ কি তোমাকে কিছু বলেছে?”

মিশরাত মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।
– ” তাহলে?
তুমি হঠাৎ এমন সিরিয়াস হয়ে গেলে কিভাবে!
তুমি তো জানতে তাই না যে আমাদের বিয়েটা জাস্ট‌ একটা ডিল!”

– ” হ্যাঁ আমি জানি আমাদের বিয়ে একটা ডিল!
কিন্তু আমার মন? আমার মনকে কি করে কন্ট্রোল করবো আমি!
হ্যাঁ আমি আমি চাই আপনার ভালোবাসা! শুনেছেন?
আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ‌!!”
একপ্রকার চিল্লিয়ে বলে উঠে মিশরাত‌।
এদিকে মিশরাতের কথা শুনে রাগ উঠে যায় স্নিগ্ধর। রাগের কারনে পাশ থেকে ফুলদানি হাতে নিয়ে সেটা মেঝেতে সজোরে ছুড়ে মারে। ভয়ে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে মিশরাত‌। মিশরাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো মিশরাত‌।
স্নিগ্ধকে পিছু ডাকতে গিয়ে আহ্ শব্দ করে উঠলো মিশরাত‌। ভাঙা কাঁচের টুকরো গুলো পায়ের তালুতে গেঁথে গিয়েছে‌।

ভোর রাতে রুমে প্রবেশ করতেই আতকে উঠে স্নিগ্ধ। সারা রুম জুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের চিহ্ন। মেঝেতে হেলান দিয়ে ঘুমন্ত মিশরাতের দিকে চোখ পড়ে তার। রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে তাকাতেই চোখ যায় মিশরাতের পায়ের দিকে। রক্তের লম্বা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আশপাশ জুড়ে।

ঘুমের ঘোরে পায়ের মধ্যে শীতল স্পর্শ পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। তবে ঘুম পুরোপুরি ভেঙে যায় না। পায়ে মলম লাগিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় স্নিগ্ধ। তারপর নিজে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে আকাশপানে চেয়ে!

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে মিশরাত‌। পায়ের দিকে চোখ যেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে তার। ফ্রেশ হয়ে স্নিগ্ধর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও স্নিগ্ধ তাকে বরাবরের মতই এড়িয়ে চলেছে। এতে কিছুটা মন খারাপ হয় মিশরাতের‌।ভাবে সময়ের সাথে হয়তো সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সময় প্রবাহমান। দিন যেতে যেতে প্রায় দেড় মাস কেটে যায়। কিন্তু স্নিগ্ধর মাঝে কোনো পরিবর্তন আসে নি। সে পূর্বের তুলনায় মিশরাতের থেকে দূরে দূরে থাকে। হাজার চেষ্টার পরও স্নিগ্ধকে নরমাল করতে পারে নি সে।
ডার্ক ব্লু রঙের শাড়ি, পার্লের অর্নামেন্টস্, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। পুরো রুমটাকে সুন্দর করে ক্যান্ডেল আর ফুলের সংমিশ্রণে সাজিয়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধর জন্য অপেক্ষা করছে মিশরাত‌।
আজ স্নিগ্ধের কাছে নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে মিশরাত‌। বলে দিবে নাম না জানা সব অনুভূতির কথা। কাঙ্ক্ষিত সময়েই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। অতি উৎসুক হয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে সে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই বিস্ময়ের সীমা থাকে না তার। চোখকে যেন বিশ্বাস করা খুব কঠিন মনে হচ্ছে মিশরাতের। শুধু অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে,

– ” স,স্,স্ন,স্নিগ্ধ!!!”…………..

চলবে ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here