প্রেম_পায়রা ?️?️
পর্ব-৮,৯
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
অষ্টম_পর্ব
নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্যে সাজেক ভ্যালির সাথে আর অন্য কোনো কিছুর তুলনা হয়না। তুলোর মতো স্বচ্ছ সাদা মেঘেদের দল ভেসে উড়ে বেড়ায় আকাশে। কখনো বা শরীরকে ছুঁয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যায় হুট হঠাৎ!
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আট ঘণ্টা লেগে যায়। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটা বেজে যায়। খাগড়াছড়ি নেমে রিসোর্টে পৌঁছাতেও বেশ খানিকটা সময় লেগে যেতে পারে। তাই আপাতত কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়া দরকার। গাড়ি থেকে লাগেজ গুলো নামিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো স্নিগ্ধ আর মিশরাত। সামনেই ক্যান্টিনের মতো একটা জায়গা। এখান থেকেই সাজেক যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যাবে। চান্দের গাড়ি নামটা শুনতে বেশ মজার হলেও খোলা জিপ হওয়ার কারণে এটাকে স্থানীয় ভাষায় চান্দের গাড়ি বলা হয়। ক্যান্টিনের সিটে বসে টেবিলে মাথা এলিয়ে দেয় মিশরাত। হঠাৎ করেই শরীরটা খারাপ লাগছে। বিপি ফল করলো নাকি?
ভাবতে ভাবতেই হাতে থাকা সাইড ব্যাগ থেকে হাতরে হাতরে একটা ঔষধের পাতা বের করলো সে।
ফোনের নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে যায় স্নিগ্ধর। এরকম পাহাড়ি অঞ্চলে নেটওয়ার্কের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বিড়বিড় করতে করতে মিশরাতের দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার।
– ” এটা কিসের ঔষধ খাচ্ছো তুমি?”
স্নিগ্ধর গলার আওয়াজ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় মিশরাত। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠে,
– “এটা? এমনি! হালকা বিপি ফল করেছে মেইবি! তাই আর কি!”
মিশরাতের কথা কানে পৌঁছাতেই স্নিগ্ধের মেজাজ চড়ে যায়।
– ” একটু খানি পুঁচকে মেয়ে! তোমার আবার বিপি ফল করবে কেন?
খাওয়া দাওয়ার কোনো নিয়ম নেই, সারারাত ধরে পেঁচার মতো জেগে থাকো আরো!
ঔষধ আগেই খেতে হবে না, আগে অল্প কিছু খাবার খেয়ে নাও!”
খাবারের কথা শুনে মুখ কুঁচকে ফেলে মিশরাত। তার কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ ই বোধ হয় খাওয়া। কিন্তু কিছু বলার তেমন সাহস পেলো না। সামনে স্নিগ্ধর রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয়ে চুপসে যায় সে। হালকা কিছু খেয়ে ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করে,
– ” এখন কি ভালো লাগছে? মাথা ঘোরানো কমেছে?”
মিশরাত না নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই স্নিগ্ধ বিনিময়ে একটা হাসি দেয়। মিনিট বিশেক পর গাড়ি আসাতেই উঠে পড়ে স্নিগ্ধ আর মিশরাত।
লাগেজ হাতে নিয়ে চান্দের গাড়ির লাস্টের দিকটায় পাশাপাশি বসে পড়ে মিশরাত আর স্নিগ্ধ। গাড়িতে মোট বারো জনের সিট থাকায় সেটা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়বে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আস্তে আস্তে সব যাত্রী পূর্ণ হলেই গাড়ি চলা শুরু করে দেয়।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। আশেপাশের পাহাড়ি রাস্তা গুলো এতক্ষণ দৃশ্যমান হলেও রাতের অন্ধকারে সেগুলো ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। তবে রাতের আকাশটাও বেশ সুন্দর। নীলচে আকাশের মাঝে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। খোলা আকাশের নিচে শো শো বহেমিয়ান ঠান্ডা হাওয়ায় কখন যে চোখটা লেগে এসেছে টেরই পায়নি মিশরাত। পাশাপাশি বসে থাকায় ঘুমের ঘোরে মাথাটা স্নিগ্ধর কাঁধে এলিয়ে দিতেই পাশ ফিরে তাকায় স্নিগ্ধ।
ঘুমন্ত মিশরাতের মুখটাতে চোখ আটকে যায় স্নিগ্ধ। ঘুমন্ত কোনো মানুষকেও বুঝি এতো সুন্দর লাগে? এ কদিন মিশরাতকে খেয়াল না করলেও আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখছে স্নিগ্ধ।
হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা কথা আছে না?
” যে নারীকে ঘুমন্ত অবস্থায় সুন্দর লাগে সে নারী আসলেই সুন্দর!”
ঠিক তেমনি মিশরাতের বেলায়ও স্নিগ্ধর একই ধারণা। বাতাসের বেগে চুল গুলো উড়তে উড়তে কয়েকটা কপালে আছড়ে পড়ে মিশরাতের। সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আবার পুনরায় পাশ ফিরে মুচকি হাসে স্নিগ্ধ।
দীর্ঘ সময় জার্নি করে স্নিগ্ধ আর মিশরাত এসে পৌঁছায় তাদের গন্তব্য সাজেক ভ্যালিতে। দূর হতে উঁচু উঁচু পাহাড় তার উপরে ভাসমান তুলোর মত মেঘ। সব কিছু মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর ভিউ। আশেপাশে অনেক রিসোর্ট আর কটেজ রয়েছে। বিশেষ করে আদিবাসীদের কটেজ, বাঁশ আর কাঠের নৈপুণ্যে তার দারুণ সংযোগ দেখতে পাওয়া যায় এই আদিবাসীদের কটেজে।
তবে আগে থেকেই রিসোর্ট বুকিং করায় সেখানে আর যাওয়া হলো না মিশরাত আর স্নিগ্ধের। ক্লান্ত শরীর নিয়ে রিসোর্ট রুংরাং এ প্রবেশ করে তারা। শুনেছে এখান থেকে নাকি সাজেকের ভিউ খুব সহজেই পাওয়া যায়। রুমের চাবি নিয়ে স্নিগ্ধ হাঁটা শুরু করে রুমের দিকে। আর মিশরাত ও গুটি গুটি পায়ে পিছু নেয় স্নিগ্ধর।
টানা দু’দিন যেহেতু অনেক ধকল গিয়েছে তাই রুমে এসে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে মিশরাত। স্নিগ্ধ একবার আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
– ” তোমার মতো অলস আর কেয়ারলেস মেয়ে আমি আজ পর্যন্ত দেখলাম না।
এত দূর থেকে জার্নি করে এসেছো কোথায় আগে ফ্রেশ হবে তা না এসেই ঠাস করে বসে ঝিমোচ্ছো?
যাও আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো!
ইডিয়ট!!”
স্নিগ্ধর এমন ধমক খেয়ে নড়েচড়ে বসে মিশরাত। মুখে একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। লাগেজ থেকে কালো রঙের একটা কুর্তি নিয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
প্রায় আধঘন্টা পর শাওয়ার নিয়ে বের হয় মিশরাত। স্নিগ্ধ একপলক মিশরাতের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গটগট করে তোয়ালে নিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। মাথার টাওয়াল নিয়ে ব্যালকনিতে এক কর্ণারে মেলে দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মিশরাত। ব্যালকনি থেকে বাইরের দৃশ্যটা বেশ ভালো লাগছে। আকাশের বুকে খন্ড খন্ড মেঘ হাওয়ার সাথে সাথে ভেসে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো সাজেক ট্যুর করার। যাক এ মিথ্যে বাহানা হলেও একবার তো আসা হলো এখানে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকানোতে ব্যস্ত মিশরাত। লম্বা, ঘন চুল হওয়ায় শুকাতে বেশ সময় লেগে যায়। খট করে দরজা খোলার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই আয়নাতে তাকায় মিশরাত।
খালি গায়ে শুধু ট্রাউজার পরনে ফর্সা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি মুক্তোর মতো জমে রয়েছে। গলায় তোয়ালে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে স্নিগ্ধ। হঠাৎ এমন ভাবে স্নিগ্ধ কে দেখে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠল মিশরাত।
চিৎকার শুনে ভড়কে যায় স্নিগ্ধ। মিশরাতকে এভাবে চিল্লাতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
– ” এই মেয়ে এই! তোমার সমস্যা কি! এভাবে ষাঁড়ের মত চিল্লাছো কেন? আমি ভূত না দানব?”
মিশরাত তখনও চোখ বন্ধ করে প্রত্যুত্তরে বলে,
– ” আপনি ভূত ও না দানবও না।
কিন্তু এভাবে খালি গায়ে ঘোরাঘুরি করার মানে কি? আপনার কি জামাকাপড় নেই নাকি?”
মিশরাতের কথা শুনে স্নিগ্ধ হাসবে, কাঁদবে নাকি রাগ করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়ে এমন উদ্ভট কথাবার্তা কিভাবে বলে সে বোঝে না। শেষমেষ তার কপালে এমন একটা মেয়েই জুটলো। ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে যায় স্নিগ্ধ। তারপর বিছানা থেকে টিশার্ট তুলে সেটা গায়ে জড়িয়ে নিল সে।
– ” ওতো চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে না।
এন্ড ওয়ান মোর থিং, আমার যা খুশি আমি তাই করবো, ইচ্ছে হলে সারাদিন এভাবে খালি গায়ে ঘুরবো। সেটা তোমার দেখতে হবে না! ডাফার একটা!!”
স্নিগ্ধর কথা শুনে চোখ খুলে তাকায় মিশরাত। স্নিগ্ধ রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
– ” হুহ ঢং কতো? এটিটিউড কতো? খালি গায়ে থাকেন না হলে জামা গায়ে থাকেন তাতে আমার কি!
মিস্টার এরোগ্যান্ট কোথাকার!!”
বিড়বিড় করে বলে উঠে মিশরাত।
আজকের দিনটা ক্লান্ত থাকায় আর কোথাও যাওয়া হলো না স্নিগ্ধ আর মিশরাতের। রাতের দিকে ডিনার শেষে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো মিশরাত। অনেক দিন মেহেরের সাথে কথা হয় নি। কথা শেষে পেছনে ফিরতেই হালকা ভয় পেয়ে যায় সে। স্নিগ্ধ হাত ভাঁজ করে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
– ” কাল সকালে রেডি থেকো! আমরা বের হবো! এই এক সপ্তাহ এখানে থেকে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। আমার অফিসে কাজ রয়েছে। এখন তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো।”
মিশরাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই স্নিগ্ধ রুমে এসে খাটে শুয়ে পড়ে। মিশরাত ও এক কোণে গুটিসুটি মেরে চুপ করে শুয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে তলিয়ে যায় ঘুম নামক বিশালতার রাজ্যে।
কালো শাড়ি পরিহিতা একটা আবছা ছায়ামূর্তি ক্রমশ স্নিগ্ধর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্নিগ্ধ হাত বাড়িয়েও যেন তার নাগাল পাচ্ছে না। বোধহয় কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনেহিচড়ে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যেতেই লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে স্নিগ্ধ। এসির ঠাণ্ডা বাতাসের মাঝেও দরদর করে ঘাম ঝরছে তার কপাল থেকে। নিঃশ্বাস ও জোরে জোরে আসা যাওয়া করছে।
অনেক দিন পর স্বপ্নটা পুনরায় চোখে ভাসতেই অস্থিরতা বেড়ে গেল স্নিগ্ধর। পাশ ফিরে তাকাতেই খেয়াল করে মিশরাত বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কপাল জুড়ে। বিড়াল ছানাদের মতো ঘুমোতে দেখে মুচকি হাসে স্নিগ্ধ।
সকালের আলোর ছায়া মুখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠে মিশরাত। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই খেয়াল করে ঘড়িতে সাতটা বেজে গিয়েছে। শুনেছে এখানের হ্যালিপ্যাড নাকি সূর্যোদয় দেখার জন্য বেস্ট। বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিল মিশরাত। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা, আর ট্রেকিং করে যেতে হবে বলে শাড়ি পড়াটাও রিস্ক। তাই লাগেজ থেকে একটা লেমন কালারের কুর্তি নিলো সে। স্নিগ্ধও হোয়াইট কালারের টিশার্টের উপর একটা জ্যাকেট আর ব্ল্যাক জিন্স পড়ে রেডি হয়ে নিলো।
সর্বপ্রথম সাজেক ঘোরার জন্য যেতে হবে দীঘিনালা। এখান থেকে কিছুদূর ট্রেকিং করলেই সামনেই পাওয়া যাবে হাজাছড়া ঝর্না। ইনফরমেশন মোতাবেক ট্রেকিং করতে করতে দুপুরের আগেই পৌঁছে যায় সেখানে স্নিগ্ধ আর মিশরাত। সবুজের সমারোহের মাঝে পাহাড়ি স্বচ্ছ পানির ঝর্ণা বিমোহিত করে মিশরাতকে। সেখানে যেয়ে বিভিন্ন ধরনের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আর মিশরাতের এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ আর লাফালাফি দেখে মুচকি হেসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে স্নিগ্ধ।
আর এদিকে কেউ দূর হতে স্নিগ্ধ আর মিশরাতের দিকে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ঠোঁটের কোণে থাকা হাসিটা রহস্যময়। যে হাসিতে লুকিয়ে আছে না জানা অজস্র হাঁসি।
– ” ওয়েলকাম মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ!!
উমম! এতো বছর পর আবারো দেখা। কিন্তু এবারের দেখাটা বোধহয় সারাজীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে আপনার! না জানি কোন আঁধার আপনার জীবনকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলে যা থেকে চাইলেও আলোর ছোঁয়া পাবেন না কখনো!!”
বলেই মাথার ক্যাপটা ঠিক করে নিলো কেউ। মাস্কের আড়ালে থাকা চোখ দুটোতে জমে রয়েছে ভয়ঙ্কর কোনো এক প্রণয়!!!
কি হবে তাহলে সামনে?…………
চলবে ?
#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#নবম_পর্ব
সাজেক ভ্যালির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে কংলাক পাহাড়। এই পাহাড়ের জন্যই বেশিরভাগ মানুষের এখানে আসা। কেননা কংলাক পাহাড়ে উঠলেই মেঘেদের ছুঁয়ে দেখা যায়। তবে এর জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
বেশ খানিকটা পথ ট্রেকিং করে হাঁপিয়ে উঠেছে মিশরাত। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে পাশে ঝুলন্ত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেয়ে নেয় সে। পানি খাওয়া শেষ হলে সামনে তাকাতেই খেয়াল করে স্নিগ্ধ অসহায় ফেস করে তাকিয়ে রয়েছে। বুঝতে বাকি রইল না সেও বেশ ক্লান্ত। তাই ব্যাগ হাতরে হাতরে আরেকটা পানির বোতল স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দিতেই স্নিগ্ধ বিনিময়ে একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিলো আর বোতলটা হাতে নিলো।
বেশ খানিকটা সময় পর ট্রেকিং করে স্নিগ্ধ আর মিশরাত পৌঁছে যায় সাজেকের প্রথম গ্রাম রুইলুই পাড়া। এখানে আদিবাসী লুসাইদের বসবাস। আদিবাসী হলেও ভ্রমণ কারীদের প্রতি বিশেষ সম্মান আর আপ্যায়ন করে থাকে তারা। গ্রামটা বেশ সুন্দর। সবুজ লম্বা লম্বা গাছের সারি চারপাশে আর দূর থেকে উঁচু উঁচু পাহাড় গুলো দৃশ্যমান।
লুসাই আদিবাসীদের একতলা বিশিষ্ট ঘরগুলো বাঁশ আর কাঠ দিয়ে সুন্দর করে গড়ে তোলা। স্নিগ্ধ আর মিশরাত ছাড়াও অনেকেই ট্রেকিং এ এসেছে। এখন এই ভর দুপুরে আর এক পা ও নড়া সম্ভব নয়। আর কংলাক পাহাড়ে পৌঁছাতে হলে আরো অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হবে। তাই আশেপাশে একটা আদিবাসীদের ঘর খুঁজে সেখানে পা বাড়ালো স্নিগ্ধ। আর মিশরাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধের কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে।
এদিকে রুসাই আদিবাসীদের মধ্যে একজনের বাসায় এসে দরজায় কড়া নাড়ে স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ পর একজন মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দেয়। রুসাইদের ভাষা সম্পর্কে অবগত না থাকায় কিছুটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিলো তার। কি দিয়ে শুরু করা উচিত তা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না। কিন্তু স্নিগ্ধ কে অবাক করে দিয়ে ঐ মধ্যবয়সী মহিলাটি বাংলা ভাষায় কথা বলা শুরু করে দিলো। বেশ খানিকটা অবাক হলেও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর সেখানে মিশরাত ও তার এক রাত থাকার ব্যবস্থা করে সে।
রাতের বেলা খাবারের সময় মহিলাটি স্নিগ্ধ আর মিশরাতের সামনে খাবার পরিবেশন করে। এখানকার জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে এক ধরনের শুঁটকি মাছ দিয়ে ঝাল ঝাল করে ভর্তা আর বাঁশের মাঝখানে ক্ষুদের চাল দিয়ে আগুনে রেখে রান্না করা। পাহাড়ি অঞ্চল গুলোতে প্রায় জায়গায় এভাবেই খাবার রান্না করা হয়। স্নিগ্ধ প্রথম ভাতের লোকমা মুখে পুরতেই ঝালে মুখ দিয়ে অনবরত শ্বাস নিতে শুরু করে। কেননা ঝাল জিনিসটা তার কাছে মোটেও সহ্য করার মতো নয়।
স্নিগ্ধকে এভাবে ঝালে ফোঁস ফোঁস করতে দেখে মিশরাত দ্রুত উঠে পানির গ্লাসটা স্নিগ্ধর সামনে ধরতেই ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেয়ে নিল সে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে গিয়েছে প্রায়। এখান থেকে আরো দু আড়াই ঘন্টার বেশি সময় লাগবে কংলাক পাহাড়ে পৌঁছাতে। আর সন্ধ্যার পর পাহাড়ি এলাকাতে না চলাই ভালো। এতে দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা কম থাকে।
রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করার জন্য একটা মাঝারি সাইজের খাট সুন্দর করে গুছিয়ে দেয় মধ্যবয়সী মহিলাটি। এটুকু বিছানায় দুজন শুতে গেলে তো লেগে লেগে শুতে হবে আর যেটা কোনোদিন ই সম্ভব না। দুজনেই একবার অসহায় চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে সেখানে গিয়ে বসে পড়লো। আজ রাতটা একটু কষ্ট করেই কাটাতে হবে।
পকেট থেকে ফোনটা বের করে অন করতেই বিরক্ত হয় স্নিগ্ধ। এখানে নেট নেই বললেই চলে। তাই একটু সামনে এগিয়ে জানালার পাশে ঘেঁষে দাঁড়ায় স্নিগ্ধ। রাতের স্বচ্ছ আকাশের পূর্ণ থালার মত চাঁদের ঝলকানি জানালা ভেদ করে ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে। এদিকে মিশরাত আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে স্নিগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,,
– ” আচ্ছা শুনুন স্নিগ্ধ, একটা কথা বলি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?”
স্নিগ্ধ ফোন স্ক্রল করতে করতে বলে উঠে,
– ” তোমাকে না করলেও তুমি শুনবে নাকি? এর চেয়ে বলেই ফেলো কি বলতে চাও!”
স্নিগ্ধর কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে নেয় মিশরাত। এই লোকটা কি কখনো কোনো কথার সোজা মিনিং বের করতে পারে না? সবসময় খোঁচা দিয়ে কথা বলে!
এজন্য বা পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে দৃঢ় কন্ঠে উঠে,
– ” না থাক কিছু না! এমনি বলছিলাম! সিরিয়াস কিছু না!”
ফোন থেকে মাথা তুলে তাকায় স্নিগ্ধ। মিশরাতকে ওমন করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে সামনে এগিয়ে যায় স্নিগ্ধ। তারপর সামনে দাঁড়িয়ে হাত ভাঁজ করে বলে উঠে,
– ” আচ্ছা ঠিক আছে, আর কিছু বলবো না! এবার বলো কি জানতে চাও আমার কাছ থেকে।”
একবার আড়চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলে উঠে,
– ” আর ইউ শিওর মিস্টার স্নিগ্ধ? আমি যা প্রশ্ন করবো তার সঠিক উত্তর কি আদৌ দিতে পারবেন?”
স্নিগ্ধ চোখ দুটো ছোট ছোট তাকিয়ে বলে,
– ” এনি ডাউট?”
মিশরাত একদৃষ্টে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
– ” শুভ্রতা কে?”
পিলে চমকে উঠে স্নিগ্ধ। নামটা শুনতেই শরীর ও কপাল তার অস্থিরতায় ঘর্মাক্ত হয়ে উঠছে। নিঃশ্বাস নিতেও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। চোখে মুখে ভয়ার্তের ছাপ। এটা দেখে মিশরাত ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ” কি হয়েছে স্নিগ্ধ? আপনি কিছু বলছেন না কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি!!”
স্নিগ্ধ পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে কন্ঠে যথেষ্ট গম্ভীরতা বজায় রেখে বলে উঠলো,
– ” তোমার সাহস হলো কি করে মিশরাত আমার ডায়েরিতে হাত দেয়ার?
তুমি কোন অধিকারে আমার পারমিশন ছাড়া আমার ডায়েরি পড়েছো? কারো পার্সোনাল জিনিস যে পারমিশন ছাড়া ধরতে হয় না এই বিষয়টা কি তার বোধগম্য নয়?”
বোকা বনে যায় মিশরাত। সে কি জিজ্ঞেস করলো আর স্নিগ্ধ কি জবাব দিচ্ছে? আর কিসের ডায়েরির কথা জিজ্ঞেস করছে তাকে! সে তো ডায়েরি এখনো অবধি ছুঁয়েও দেখে নি!
– ” আরে আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে! আমি তো আপনার ডায়েরি,,”
পুরোটা বাক্য শেষ না হতেই স্নিগ্ধ পুনরায় বলে উঠে,
– ” ব্যাস! অনেক হয়েছে! তুমি আমার অনুমতি ছাড়া আমার ডায়েরি পড়ে আবার আমাকেই এক্সপ্লেশন করছো!
তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হচ্ছি বারবার। ভুলে যেও না তুমি আমার স্ত্রী নও! ইটস জাস্ট এ ডিল!”
এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবটা শুনলেও মেজাজ চটে যায় এবার মিশরাতের। মানে কি? সে কিছু বলছে না বলে স্নিগ্ধ তাকে এতো কথা শুনিয়ে দেয়ার কি আছে! মুখে রাগের আভা স্পষ্ট!
– ” আরে আমাকে কিছু বলতে তো দিবেন নাকি!!
আমি আপনার কোনো পার্সোনাল ডায়েরি পড়া তো দূরে থাক ছুঁই ও নি। আমি শুভ্রতা নামটা জিজ্ঞেস করেছি কেননা কাল রাতে আপনি ঘুমের ঘোরে বারবার শুভ্রতা শুভ্রতা বলে চিল্লাছিলেন। তিলকে তাল বানানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না।
আর হ্যাঁ আমি জানি আমি আপনার স্ত্রী না আর আমাদের বিয়েটাও একটা ডিল! এটা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, যত্তসব!!”
কপোট রাগ দেখিয়ে বললো মিশরাত। আর স্নিগ্ধ এখনো থ মেরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ ধরে সে মিশরাতকে না জেনে কতকিছু বলে বসলো। না জানি মিশরাত কি ভাববে? এখন নিজের প্রতি নিজেরই রাগ লাগছে। কিন্তু মিশরাতকে কিছু বলবে তার পূর্বেই সে খেয়াল করে মিশরাত পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। একটা হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো স্নিগ্ধ। হয়তো বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে সে। কিন্তু শুভ্রতা? নামটা এতো বছর শুনতে পেয়ে মনের মধ্যে অজানা অস্থিরতা বিরাজ করছে!!
সকালে ঘুমের মাঝে পানির স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠে স্নিগ্ধ। মাথার চুল বেয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। সাত সকালে এমন কান্ডে রাগের মাত্রা উচ্চ হয়ে যায় স্নিগ্ধর। কিন্তু সামনে তাকাতেই সব রাগ উবে যায় তার। মিশরাত হাতে গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
– ” সকাল সকাল এটা কি ধরনের আচরণ মিশরাত?”
মিশরাত হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,
– ” এভাবে পড়ে পড়ে মহিষের মতো ঘুমালে পানি দিয়ে তো জাগাতেই হবে। উঠে পড়ুন। সকালের আলো ফুটে গিয়েছে অনেক আগেই। আমাদের যেতে হবে!!”
মিশরাতের কথা শুনে উঠে পড়ে স্নিগ্ধ। ফ্রেশ হয়ে ঐ লুসাই আদিবাসী মধ্যবয়সী মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারো ট্রেকিং এ বেরিয়ে পড়ে স্নিগ্ধ আর মিশরাত। দীর্ঘ তিন, সাড়ে তিন ঘন্টার টানা ট্রেকিং করে অবশেষে পৌঁছায় সাজেকের সর্বশেষ গ্রাম কংলাক পাড়া। আর এখানেই রয়েছে সেই সুউচ্চ পাহাড় কংলাক। উঁচু পাহাড়ের রাস্তা গুলো এঁকেবেঁকে যাওয়ায় খুব সাবধানে বাঁশের লাঠির ভর দিয়ে দিয়ে উপরে উঠে চলেছে স্নিগ্ধ আর মিশরাত। কংলাক পাহাড়ে তারা ছাড়াও অনেকেই এসেছে ট্রেকিং করে। সর্বোচ্চ উঁচুতে উঠতে পেরে মুখের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল মিশরাতের। এতক্ষণে জমে থাকা শরীরের সবটুকু ক্লান্তি মেঘেদের শীতল ছোঁয়া পেতেই উড়ে পালালো। চোখ বন্ধ করে সবকিছু উপলব্ধি করছে মিশরাত। আর পাশেই স্নিগ্ধ একদৃষ্টে মিশরাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। খোলা চুলগুলো বাতাসের সাথে খেলায় মেতে উঠেছে।
– ” মেয়েটা আসলেই অদ্ভুত! কখন কি থেকে কি হয়ে যায় তা বোঝা মুশকিল!
কাল রাতেই তো কত কিছু হয়ে গেলো। কিন্তু সকাল না হতেই সবকিছু আবার স্বাভাবিক! আর যাই হোক মেয়েটা মনের দিক দিয়ে অনেক ভালো!
কিন্তু এই আমার একটা ভুলের জন্য ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো??”
আনমনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো স্নিগ্ধ। দৃষ্টি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিশরাতের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই কানে কারো ফিসফিস আওয়াজ পেতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল।
শুধু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
– ” শ,শু,শুভ্, শুভ্রতা!”
দ্রুত গতিতে পাশ ফিরে তাকায় স্নিগ্ধ। না কেউ নেই! তাহলে এই আওয়াজ!
– “এটা তো শুভ্রতার গলার আওয়াজ! কিন্তু এখানে শুভ্রতা আসবে কি করে? কিন্তু এখনি তো আমি আওয়াজ টা খুব কাছে থেকে শুনেছি!”
অস্থির ভাবে আশপাশে খুঁজতে থাকে স্নিগ্ধ। এদিকে মিশরাত পেছন ঘুরে স্নিগ্ধকে দেখতে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে যায়।
– ” একটু আগেই তো স্নিগ্ধ এখানে ছিলেন! এখন আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেল! ধ্যাত!!
এই লোকটাকে নিয়ে আর পারিনা!”
কিছুদূর যেতেই স্নিগ্ধকে চোখে পড়ে মিশরাতের। দ্রুত পায়ে হেঁটে স্নিগ্ধর কাঁধে হাত রাখতেই স্নিগ্ধ পেছন ফিরে বলে উঠে ,
– ” শুভ্রতা!!”
চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকায় মিশরাত। চোখে মুখে কৌতুহলের ছাপ।
– ” শুভ্রতা? কে শুভ্রতা? আরে আমি মিশরাত। আপনি এভাবে কাকে খুঁজছেন?”
মিশরাতকে দেখে স্নিগ্ধ আমতা আমতা করে বলে উঠে,
– ” এমনি আমার হাতের ঘড়ি বোধহয় কোথাও পড়ে গিয়েছে? ওটাই খুঁজছিলাম!
আচ্ছা চলো ওদিকটায় যাওয়া যাক!”
মিশরাত একপলক তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠল,
– ” ঠিক আছে, চলুন!”
এদিকে খানিকটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে কেউ আনমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে চলেছে।
– ” ইশশ্ বেচারা স্নিগ্ধ চৌধুরী!
আপনাকে এভাবে দেখলে কষ্ট হয় আবার হাসিও আসে! আমি আপনার সামনে আপনার পাশে প্রতিটা মুহূর্ত থাকবো কিন্তু আপনি চাইলেও আমায় চিনতে পারবেন না!
গেম ইজ স্টার্ট মিস্টার আশফিন চৌধুরী স্নিগ্ধ! আর এই গেম এ উইন আমিই হবো!
সাথে করে আপনার লাইফটাও এমনভাবে ডেসট্রয় করবো চাইলেও সারাজীবনে সেই ক্ষতিপূরণ করতে পারবেন না আপনি!!
শীঘ্রই দেখা হবে! বি রেডি!”
বিড়বিড় করতে করতে চোখের চশমাটা ঠিক করে নিল কোনো অজানা আগন্তুক!!………..
চলবে ?