প্রেম_পায়রা ?️?️
২২,২৩
লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
দ্বাবিংশ_পর্ব
হসপিটালের করিডোরের সামনে গম্ভীর হয়ে এক কোণে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। পাশেই মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী চেয়ারে বসে আছেন। তার মাঝে অস্থিরতা বিরাজমান। কিছুক্ষণ পর ই ভেতর থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসেন।
ডক্টর কে দেখামাত্র স্নিগ্ধ এগিয়ে যায় সেদিকে।
-” ডক্টর, বাবা কেমন আছেন? সিরিয়াস কোনো কিছু হয় নি তো?”
– ” নো মিস্টার স্নিগ্ধ, হি ইজ ফাইন। তবে অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পেয়েছেন। নেক্সট টাইম থেকে উনার একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে। কেননা কদিন আগেই হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে ভয়াবহ ধাপ থেকে ফিরে এসেছেন।
আর এবার যদি ফের তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন তাহলে আমাদের তাকে বাঁচানোর কোনো চান্স থাকবে না। সো বি কেয়ারফুল!
এক্সকিউজ মি!”
বলেই স্নিগ্ধর পাশ কাটিয়ে চলে আসলেন ডক্টর। আর স্নিগ্ধ এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ছোট্ট একটা ভুলের কারণে পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছে।
– ” এবার খুশি হয়েছিস তো!!
মেয়েটাকে বিনা অপরাধে বাসা থেকে বের করে দিলি তাও একটা মিথ্যে অপবাদের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু তুই? তুই কি করেছিস!
রাত বিরেতে মদ খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে, ছিঃ!
আর শুধু তোর জন্য আবারো তোর বাবার এই অবস্থা! এখন যতদিন না পর্যন্ত তুই মিশরাতকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে না পারবি আমার চোখের সামনে আসবি না তুই! চলে যা এখান থেকে!”
মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী স্নিগ্ধ কে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠলেন। মিসেস ইয়ামিন চৌধুরীর কথা কানে পৌছালেও মস্তিষ্ক জুড়ে মিশরাতের বলা কথাগুলোর বিচরণ।
– ” আপনার আমার প্রতি বিশ্বাস এতোই ঠুনকো যে, একটা ছবির উপর ভিত্তি করে আমায় এত বড় অপবাদ দিয়ে বসলেন?
একদিন আপনি সবটাই জানবেন কিন্তু আর চাইলেও আপনি আমাকে আর কাছে পাবেন না!!”
মিশরাতের বলে যাওয়া প্রতিটা কথা বারংবার স্নিগ্ধর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
– ” কি করে এতো বড় একটা ভুল করে ফেললাম আমি! মিশরাতের বলা কথাগুলো কী তবে সত্যি?
আর কাল রাতে কি হয়েছিল কিছুই তো মনে পড়ছে না আমার। কাল রাতে তো,,”
ফ্ল্যাশব্যাক,
– ” মে আই কাম ইন স্যার?”
কারো গলার আওয়াজ পেয়ে ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে তাকালো স্নিগ্ধ।
– ” ইয়েস কাম ইন!”
স্নিগ্ধর অনুমতি পেয়ে অরিন কেবিনে প্রবেশ করলো।
– ” স্যার এই যে একজন একটা পেনড্রাইভ দিয়ে গিয়েছে আপনার জন্য। ”
পেনড্রাইভের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকলো স্নিগ্ধ। হঠাৎ পেনড্রাইভ কেউ পাঠাবে কেন?
– ” ওকে গিভ মি!”
বলেই পেনড্রাইভ টা অরিনের কাছ থেকে নিয়ে সেটা পরখ করে নিয়ে ল্যাপটপে লাগিয়ে নিল। তারপর সেটা থেকে মেইন ফাইল ওপেন করতেই স্নিগ্ধর চেহারার রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করলো।
পেনড্রাইভের ফাইলে কয়েকটা ছবি ভেসে উঠছে। মিশরাত আর রবিনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি। লজ্জায় রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে স্নিগ্ধর। এক মিনিটের জন্য কেন জানি মনে হয়েছিল সবটা মিথ্যে।
– ” স্যার কি হয়েছে আপনাকে এত টেনশ্ড দেখাচ্ছে কেন? এনিথিং রং?”
স্নিগ্ধ মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। পরমুহূর্তেই অরিন পাশ থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে স্নিগ্ধর দিকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আচমকা হাত লেগে কিছুটা পানির গ্লাস থেকে পানি স্নিগ্ধর শার্টের উপর পড়ে যায়।
– ” সো সরি স্যার! আমি ইচ্ছে করে করি নি। ইটস এ এক্সিডেন্ট!
আরে এটা মিশরাত আপু না?”
ল্যাপটপের স্ক্রিনে দিকে তাকিয়ে বলে উঠল অরিন।
– ” স্যার ইনাদের তো আমি কিছুদিন আগেও একসাথে দেখেছি শপিং মলে!”
অরিনের কথা শুনে পাশ ফিরে সরু চোখে তাকায় স্নিগ্ধ। মাথার ভেতর হাজারো উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা!
– ” আর ইউ শিওর, মিস অরিন?
তুমি কি ঠিক এই ছেলেটাকেই মিশরাতের সাথে দেখেছিলে!”
– ” ইয়েস স্যার! আমি এদের দুজনকে একসাথে দেখেছি!”
এতক্ষণ জমে থাকা বাদবাকি রাগটুকুও জাগ্রত হয়ে উঠলো স্নিগ্ধর।
ল্যাপটপ টা পাশে ছুড়ে দিয়ে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো সে। অরিন কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল।
– ” স্যার , কুল ডাউন!
কি হয়েছে?”
বলেই তড়িঘড়ি করে পাশ থেকে বাইরে থেকে আরেকটা পানির গ্লাস নিয়ে আসলো সে। এদিকে স্নিগ্ধ রাগে ফুঁসছে।
স্নিগ্ধর সামনে পানির গ্লাস এনে ধরতেই স্নিগ্ধ সেটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খাওয়া শুরু করে দিলো। গ্লাসটা পাশে রাখতেই মিনিট পাঁচেক পর মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে থাকে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতেই এরপর থেকে কিছু স্পষ্ট মনে পড়ছে না তার!!”
বর্তমানে,,
– ” ওহ্ শিট! কাল রাতে তো আমি কোনো প্রকার ড্রাংক ই করি নি তাহলে মিশরাত সেসব কথা বললো কেন। যতদূর মনে পড়ছে কালকে ও গ্লাসে পানি খাওয়ার পর ই মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো। এর পরে কি হয়েছিল। আমার শার্টেই বা এই দাগগুলো আসলো কোত্থেকে?
ওয়ান মিনিট, ওয়ান মিনিট!!
আমি যদি ড্রাংক ই না করি তাহলে অরিনের সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করার কথা আসবে কোত্থেকে? আর অরিনই বা সেসব মিথ্যে বলবে কেন!
এখন তো এসব কিছুর উত্তর একজন ই দিতে পারবে!!”
বলেই গটগট করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো স্নিগ্ধ। আর মিসেস ইয়ামিন চৌধুরী স্নিগ্ধর যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে মিশরাত। চোখের দু পাশে কান্না করার জন্য দাগ পড়ে গিয়েছে। গাল আর নাকের ডগাও লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় মস্তিষ্কের ভেতরে স্নিগ্ধর বলা প্রতিটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে আর সেটাই বারংবার মনে সুচের মতো বিঁধছে।
– ” কি করে পারলেন এমনটা করতে স্নিগ্ধ? এই ছিল আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস?
কই আমি তো চেয়েছিলাম আপনাকে নতুন করে ভালোবাসতে। আপনার সাথে জীবনের বাকি অধ্যায় গুলো একসাথে পার করতে!
কিন্তু আপনি? কিভাবে বলতে পারলেন? হয়তো ঠিকই বলেছিলেন এক সময়। আমাদের বিয়েটা একটা ডিল ব্যাতীত অন্য কিছুই নয়!!”
মনে মনে বিড়বিড় করে বললো মিশরাত। তার ভাবনার মাঝেই গাড়ি এসে থামে একটা চেনা পরিচিত বাড়ির সামনে।
কলিং বেলের আওয়াজ পেতেই একজন দরজা খুলে দিল। মধ্যবয়সী একজন মহিলা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলেন। চোখে মুখে একরাশ খুশির ঝিলিক। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
– ” ফা,ফারাহ্!”
মিশরাতও এগিয়ে গিয়ে মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরলো।
– ” দিদা!!
কেমন আছো তুমি?”
আদুরে গলায় বলল মিশরাত।
– ” এতদিন পর এই বুড়ির কথা বুঝি তোর মনে পড়লো!”
অভিমানী গলায় মিশরাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন সিদ্দিকা বেগম।
– ” আহা কি বলছো এসব দিদা?
কে বলেছে আমার দিদা বুড়ি হয়ে গিয়েছে! আমার দিদা তো এখনো অনেক সুন্দরী। বাইরে বের হলে ছেলেদের লাইন পড়ে যাবে!”
– ” হয়েছে হয়েছে এবার থাম! বল তুই কেমন আছিস?”
– ” এইতো দিদা!
আশ্রমের বাচ্চা গুলো কোথায়? সেগুলোকে দেখছি না তো?”
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো মিশরাত।
সিদ্দিকা বেগম মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে উঠলেন,
– ” এইতো তোর রহিম চাচার সাথে বাচ্চাগুলো একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। ফেরত এসে তোকে দেখলে অনেক খুশি হবে!
আয় ভেতরে আয়।”
মিশরাত গুটি গুটি পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
এই অনাথ আশ্রম টা তার অনেক প্রিয় একটা জায়গা। মন খারাপেরা এসে ভীড় জমালেই মিশরাত এখানে চলে আসে। এখানকার ওনার সিদ্দিকা বেগমের সাথে রক্তের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও খুব ভালো একটা বন্ডিং রয়েছে। মাঝেমধ্যেই আসা হয় এখানে। কিন্তু গত পাঁচ মাসে ব্যস্ততার কারণে আর আসা হয়ে উঠেনি।
– ” আর তুই একা এসেছিস কেন? তোর জামাই কোথায়? সে আসেনি!”
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন সিদ্দিকা বেগম।
– ” না দিদা সে আসেনি, আমি একাই এসেছি!”
– ” সে কি কথা তুই একা আসছিস মানে?
তোদের দুজনের মাঝে আবার ঝগড়া হয় নি তো? রাগ করে চলে এসেছিস?”
সিদ্দিকা বেগমের কথায় হালকা ঘাবড়ে গেল মিশরাত।
– ” না না দিদা! তেমন কিছুই হয় নি! আসলে এমনি তোমার সাথে দেখা করতে মন চাইলো তাই চলে আসলাম। এখন কি এতেও কোনো বারণ আছে না কি?”
– ” না রে পাগলী! বারণ থাকবে কেন? আমার কাছে যখন খুশি তখন আসতে পারবি! এতে বারণের কি আছে?”
মিশরাত বিনিময়ে মুচকি হাসি দিল। ফ্রেশ হয়ে এসে জানালার কাছে এসে দাড়াতেই মৃদু দমকা হাওয়া এসে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল।
– ” আমি জানি না কোনদিন আপনি আমার নাগাল পাবেন কিনা স্নিগ্ধ!
আমি চাই না আবারো আপনার লাইফে ফিরে যেতে! তবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা এক বিন্দু পরিমাণ ও কমবে না। কিন্তু ভালোবাসা আর সেল্ফ রেসপেক্ট নিজ নিজ জায়গায়!
একটা ব্রেক করে আমি আরেকটা জোড়া দিতে পারবো না তাতে যদি আমার আপনার থেকে দূরে থাকতে হয় তাহলে সেটাই হোক!!”…………….
চলবে ?
#প্রেম_পায়রা ?️?️
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব
” আমি তোমারো বিরহে রহিবো বিলীন,,
তোমাতে করিব বাস!
দীর্ঘ দিবসো, দীর্ঘ রজনী,,
দীর্ঘ বরোসোমাস!!
যদি আর কারে ভালোবাসো,,,
যদি আরো ফিরে নাহি আসো,,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,,
আমি যত দুখো পাই গো,,,,
আমারো পরানো যাহা চায়,
তুমি তাই গো তুমি তাই গো,,,,,
আমারো পরানো যাহা চায়!!”
পাশের বড় কক্ষ থেকে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসতেই চোখ দুটো পিটপিট করে তাকালো মিশরাত। বিকেলের দিকে হালকা চোখটা লেগে এসেছিল। হাই দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। সুরকে অনুসরণ করে গুটিগুটি পায়ে এগোতেই খেয়াল করলো পাশের রুমে বাচ্চাগুলোকে রোজকার নিয়মমাফিক গানের ক্লাস করানো হচ্ছে। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিশরাত।
– ” কি ব্যাপার তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ফারাহ্?
ভেতরে চল, গিয়ে বাচ্চাদের সাথে জয়েন কর, ভালো লাগবে!”
সিদ্দিকা বেগমের কথা শুনে মিশরাত আলতো হেসে প্রত্যুত্তরে বলে উঠলো,
– ” থাক না দিদা।
আমি তো এমনি গানের সুর অনুসরণ করে এসেছিলাম।
আমি বরং গিয়ে আশ্রমের বাগানটার ওদিক দিয়ে হালকা হেঁটে আসি!”
সিদ্দিকা বেগমের অনুমতি নিয়ে বাগানের দিকটায় পা বাড়ালো মিশরাত।
অপরাজিতা গাছটা ফুলে ফুলে সমারোহ। ঝোপড়া ঝোপড়া হয়ে ফুটে রয়েছে। গাছটার শক্ত ডালটায় দুটো রশি বেঁধে দিয়ে একটা দোলনা বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার পর মিশরাত গিয়ে দোলনা টায় বসে পড়লো।
– ” ফারাহ্ আপি, ফারাহ্ আপি!”
চিল্লাতে চিল্লাতে একটা পাঁচ ছয় বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে আসলো মিশরাতের দিকে।
– ” কি হয়েছে রাই?”
– ” তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো!
ওখানে দিদা তোমাকে ডাকছে? আজকে তো তিথি আপুর জন্মদিন! তুমি আমাদের সাথে থাকবে না?”
– ” কেন থাকবো না রাই? অবশ্যই থাকবো! চলো গিয়ে সবকিছুর আয়োজন করি!”
বলেই রাইয়ের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত।
– ” হোয়াট! অরিন অফিস থেকে রিজাইন করেছে? মানে কি? কার পারমিশন নিয়ে তোমরা অরিনের রিজাইন লেটারে সাইন করেছো!!”
হুংকার দিয়ে উঠলো স্নিগ্ধ। তার অফিসের সব কর্মচারী ভয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
– ” কি হলো কেউ কথা বলছে না কেন?
আমার অনুপস্থিতিতে কে অরিনের রিজাইন লেটার সাইন করেছে কে?
টেল মি!!”
পুনরায় বলে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” স,স্,স্যার আমি!”
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল অফিসের ম্যানেজার জাকির সাহেব।
– ” জাকির সাহেব, আপনি!!”
অনেকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” ইয়েস স্যার, আমি। আসলে গতকাল রাতে ডিউটি শেষে অরিন ম্যাম আপনাকে না পেয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। জরুরী একটা কাজে তাকে এই জব থেকে রিজাইন নিতে হবে ইমিডিয়েটলি। আমি ব্যাপারটা আপনাকে জানানোর জন্য কয়েকবার কল ও করেছিলাম আপনাকে। বাট রেসপন্স পাই নি। তাই আপনাকে না জানিয়েই আমি সেটাতে সাইন করে দিয়েছি।”
নিচু হয়ে বলে উঠলেন জাকির সাহেব।
এখন প্রায় সবকিছুরই হিসাব মিলাতে পারছে স্নিগ্ধ।
– ” ড্যাম ইট!!
আচ্ছা ও কোথায় গিয়েছে সেটা কিছু বলে গিয়েছে?”
– ” নো স্যার!”
– ” আচ্ছা ঠিক আছে!!”
বলেই স্নিগ্ধ কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।আর জাকির সাহেব সহ বাকিরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
– ” ফারাহ্ আপু, ফারাহ্ আপু! আমাকে ঐ বেলুনটা দাও না, প্লিজ!”
কারো কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই পেছন ফিরে তাকালো মিশরাত।
– ” কি হয়েছে রাই?”
– ” আপু আমাকে ঐ বেগুনি রঙের বেলুন টা দাও না! তুমি তো কত্ত লম্বা! আমি তো একটুখানি পুঁচকে মেয়ে। আমার হাত কি ওতদূর যায় বলো?”
পাশ থেকে বেগুনি রঙের বেলুন টা রাইয়ের হাতে দিতে দিতে হালকা হেসে মিশরাত বলে উঠলো,
– ” হয়েছে, হয়েছে এই নাও! নিজেকে পুঁচকে মেয়ে দাবি করে। আবার সেই পুঁচকে মেয়েরই কত পাকা পাকা কথা!”
মিশরাতের কথা শুনে রাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মিশরাতও বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দিল।
আশ্রমের বাচ্চাগুলোর মধ্যে আজকে তিথির জন্মদিন। সে উপলক্ষে মাঝারি পরিসরেই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
অলিভ কালারের একটা লেহেঙ্গা, হাতে স্টোনের চুড়ি, কানে এক জোড়া ঝুমকা, আর কপালে মধ্যবিন্দুতে একটা ছোট টিপ। আনমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল মিশরাত। গ্যালারি থেকে ঘুমন্ত স্নিগ্ধর কয়েকটা ছবি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে সে। বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই ফোন থেকে সিম কার্ড খুলে নেয় সে।
-” আচ্ছা স্নিগ্ধ এখন কি করছে?
এখনো আমার উপর রাগ করে না না রাগ না ওটা ঘৃণা হবে!
আচ্ছা সেই তো বলেছিলেন যে ভালোবাসার মানুষটিকে নাকি চাইলেও কোনোদিন ঘৃণা করা যায় না! তাহলে? তাহলে কি স্নিগ্ধ আমাকে কোনদিন ভালোই বাসেনি?”
পেছন থেকে সিদ্দিকা বেগমের ডাক শুনে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে মিশরাত।
– ” কি হলো ফারাহ্! কোথায় হারিয়ে গেলি? এখানে আয়! এখানে এসে দাড়াঁ।”
সিদ্দিকা বেগম তাড়া দিতেই ফোনটা অফ করে উঠে দাঁড়ালো মিশরাত।
-” এই নাও তোমার তোমার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার টিকিট!
আগামী তিন দিন পর তোমার ফ্লাইট!
আর খবরদার স্নিগ্ধর কানে যাতে কোনোদিন না পৌঁছায় এসবের কথা!”
বলেই অরিন প্লেনের টিকিট ছুড়ে মারলো রবিনের সামনে!
-” আচ্ছা সুন্দরী ম্যাডাম, সেটা না নয় নাই জানলো! মাগার একটা জিনিস বুঝলাম না, ঐ ফারাহর জামাই স্নিগ্ধর সাথে আপনার কিসের শত্রুতা যে এত কিছু প্ল্যানিং করে দুজনরে আলাদা কইরা দিলেন!”
অরিনের দিকে সরু দৃষ্টে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো রবিন।
– ” দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস!”
অরিন সোজাসাপ্টা গলায় উত্তর দিল।
– ” কিছু তো গরমিল আছে! নাইলে এত সুন্দরী একটা মাইয়া হুদাই ঐ দুইজনের সংসার ভাইঙ্গা আবার ঐ ছেড়ারে ছাইড়া দিবো কেন?
সে যাই হোক, একদিক দিয়া আমারি ভালো হইছে! ঐ ফারাহর সব অহংকার ভাইঙ্গা চুইড়া গেছে!
খুব জোর গলায় বলছিলো না? হাহ্! সব শেষ হইয়া গেছে!!”
মনে মনে বিড়বিড় করে হেসে উঠলো রবিন।
————————-
– ” কিইইই!! মিশরাত তোমার বাড়িতে নেই মানে কি? এসব তুমি কি বলছো স্নিগ্ধ?”
অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বলে উঠলেন মিস্টার আজীজ সাহেব। আজীজ সাহেব সহ পরিবারের বাকি সদস্যদের মুখেও একি বিস্ময়তার ছাপ!
আজীজ সাহেবের প্রশ্নোত্তর পেয়ে স্নিগ্ধর কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো। মিশরাত এখানে নেই মানে কি? সে কোথায় যাবে তাহলে?
– ” কি বলছেন বাবা? মিশরাত এ বাড়িতে আসে নি!!”
আরেক দফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলো স্নিগ্ধ।
– ” মিশরাত এ বাড়িতে কি করবে? ওর তো তোমার বাড়িতে থাকার কথা তাই না স্নিগ্ধ?”
পেছন থেকে মিসেস ইবনাত বলে উঠলেন।
স্নিগ্ধ ঠিক কি উত্তর দিবে এই প্রশ্নের তা বুঝে উঠতে পারছে না! তার কিই বা বলা উচিত? এটা যে না মিশরাত তার বাড়িতে নেই। তাকে ছেড়ে কোনো অদূরে হারিয়ে গিয়েছে?
– ” কি হলো কিছু বলছো না কেন স্নিগ্ধ? মিশরাত কোথায়?
তোমাদের মাঝে কি কিছু হয়েছে??”
আজীজ সাহেবের কথা শুনে ধ্যান থেকে ফিরে আসলো স্নিগ্ধ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
চিল্লাচিল্লি করার আওয়াজ পেয়ে উপরের সিড়ি বেয়ে নেমে আসলো মেহের আর ইরফান। নিচে স্নিগ্ধকে এভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো মেহের।
মিনিট পাঁচেক পর স্নিগ্ধ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সবটা শুরু থেকে বলা শুরু করে আর সেটা কর্ণপাত হতেই আজীজ সাহেব সহ বাকি সবার চেহারাতেই বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
অনুষ্ঠান শেষ রহিম চাচার সাথে মিলে আশ্রমের কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে মিশরাত। গোছগাছ শেষ হলে লাইট অফ করে রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। রুমে যেতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠে সে।
– ” দিদা, তুমি এখানে? এত রাত পর্যন্ত জেগে আছো! ঘুমাও নি তুমি?”
রুমে প্রবেশ করতে করতে জিজ্ঞেস করে উঠলো মিশরাত।
– ” এমনি ঘুম আসছিলো না রে ফারাহ্। আয় আমার পাশে এসে বস দেখি!!”
মিশরাতও বাধ্য মেয়ের মতো গিয়ে সিদ্দিকা বেগমের পাশে বসে পড়লো।
– ” আমি জানি ফারাহ্! তুই এখানে এমনি এমনি আসিস নি। কিছু তো একটা হয়েছে। কেননা এখানে আসার পর থেকেই তোকে দেখছি কেমন জানি উদাসীন, মনমরা হয়ে বসে থাকিস এককোণে চুপচাপ!
কি হয়েছে? বল তো আমাকে! তোর আর স্নিগ্ধের মাঝে কি এমন হয়েছে যে কাউকে না জানিয়ে এখানে চলে এসেছিস!”
ভড়কে যায় মিশরাত। গলা শুকিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে।
– ” এখন কি করি? দিদা সবটাই বা জানলো কি করে!
এখন কি দিদাকে সবটা বলা ঠিক হবে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খায় মিশারাতের। কিছুক্ষণ পর আচমকাই সিদ্দিকা বেগমের পায়ের উপর মাথা রেখে মেঝেতে বসে পড়লো সে। আর মিসেস সিদ্দিকাও হালকা হেসে মিশরাতের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করলেন।
– ” তুমি এত বড় ভুল কি করে করতে পারলে স্নিগ্ধ?”
রাগে গজগজ হয়ে বলে উঠলো ইরফান। মেহের আর মিসেস ইবনাত তো এতটাই বিস্মিত হয়েছেন যে মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না, নীরব দর্শকের মতো সবটাই দেখে যাচ্ছেন।
স্নিগ্ধর মুখেও কোনো কথা নেই!
– ” আমার বোনটাকে তোমার সাথে বিয়ে দেয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল! ইউ রিডিকিউলাস!!”
বলেই স্নিগ্ধর দিকে তেড়ে যেতে নেয় ইরফান। ওমনি মিস্টার আজীজ সাহেব হাতের ইশারায় থেমে যেতে বলেন ইরফানকে।
– ” মিশরাত যেমন আমার মেয়ে তেমনি সে তোমার স্ত্রী, স্নিগ্ধ। আমি তোমার কাছ থেকে এটা এক্সপেক্ট করি নি।
যাক সেসব কথা, এখন তোমার স্ত্রীকে খোঁজার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার। তোমার নিজের ভুলের কারণেই যখন মিশরাত তোমার কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছে তবে তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব ও তোমার!
আশা করি এরপর তোমায় আর কিছু বলে দিতে হবে না!!”
শান্ত গলায় স্নিগ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন আজীজ সাহেব।
স্নিগ্ধও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করে।……….
চলবে ?