প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ২০,২১
২০
__________________________
দূর থেকে ইকোপার্কের গেইট দেখা যাচ্ছে। গাড়ি পার্ক করে নিজেদের ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে এসেছে প্রত্যেকে৷ অরু সকলকে পেছনে ফেলে আগে হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ টান অনুভব করলো ব্যাগে। তন্ময় পেছন থেকে তার ব্যাগ টেনে ধরেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। কিন্তু তন্ময় তাকে কেন ধরেছে বলেনি! সে তখন ড্রাইভার চাচার সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। আসমানের অবস্থা তেমন ভালো দেখাচ্ছেনা। ধীরে ধীরে পরিষ্কার আকাশে ছোট ছোট মেঘ জমতে শুরু করেছে। ড্রাইভার বলছে আজ না যাওয়াই ব্যাটার। কিন্তু অরুর জেদের বসে সকলকে যেতেই হবে। হাঁটা ধরলো সামনে। কিছুটা হেঁটে চলে এলো মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক গেইটের সামনে। ইটের তৈরি গেইট। গেইটের উপরে সাদায় কালো রঙে লেখা ‘ বন বিভাগ – মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক। ‘ ছোট করে ক্যাচি গেইট রয়েছে চারপাশের ইটের মধ্যখানে। গেইটের ভেতরে আকাশী রঙের টি-শার্টের সাথে কালো প্যান্ট পরে, চেয়ার পেতে দারোয়ান বসে। হাতে লাঠি। দশ টাকার টিকিট কাটে জনপ্রতি একজন করে মোট আটটি। নিজেদের টিকেট নিয়ে ঢুকে পড়ে। ঢুকতেই অরু দৌড় লাগায় সঙ্গে দীপ্ত। দুপাশে সবুজ গাছ। মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ আঁকাবাকা রাস্তা। পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। দেখা মিলছে নানান জাতের মূর্তির। রয়েছে বসার সিট। শাবিহা আঁড়চোখে দৌড়ে ছুটে চলা অরুর দিক তাকাল। তার ও ইচ্ছে করছে দৌড়াতে। কিন্তু নিজেকে আটকে রাখল। তার পাশেই অয়ন দাঁড়িয়ে। অয়নের কাঁধে একটা ব্যাগ সাথে তার হাতেও। হাতের ব্যাগটা শাবিহার। অয়ন আড়ালে তার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। যেমন এতটুকু ভারের ব্যাগ শাবিহা ক্যারি করতে পারবেনা।
–‘ আমার ব্যাগ আমাকেই দাও! ‘
–‘ আমি নিলে কি সমস্যা? ‘
–‘ সমস্যা নেই। ‘
–‘ তাহলে? ‘
–‘ উফ দিবে তুমি? ‘
–‘ শাবিহা আপু ব্যাগটা আমি নেই। কি হয়েছে! আমার এতটুকু ওজনের ব্যাগ নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ‘
শাবিহা ভীষণ রেগে গেল। লজ্জায় তার গাল দুটো লাল হয়ে উঠছে। এইযে হুট করে অয়ন তাকে আপু ডাকে, এটা কতটা লজ্জায় ফেলে ইদানীং তাকে, সেটা কী ছেলেটা জানে? আকাশ বিরক্ত সুরে
বলল,
–‘ অয়ন ব্যাগটা তোর জন্য ক্যারি করছে, এতে খারাপ কী? ছোট ভাই হিসেবে এতটুকু করতেই পারে। ‘
অয়ন মিষ্টি করে হাসলো। শাবিহা হনহনিয়ে অয়নকে পিছু ফেলে চলে গেল। ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের মতো থাকে না কেন তাহলে! ডিস্টার্ব কেন করে শাবিহাকে প্রতিনিয়ত। পেছনে অয়ন জিহ্বায় কামড় বসালো। মজা করতে গিয়ে, রাগিয়ে দিয়েছে। আকাশ না জেনে সেখানে কেরাসিন ঢেলে দিয়েছে। এখন অয়নকে বেশ কাঠখড় পোহাতে হবে তার মহারানীকে মানাতে।
গেইট থেকে ১০ – ১৫ মিনিট হাঁটতেই দেখা মিললো সেই আশ্চর্য সৌন্দর্যের নিদর্শন ‘মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত’। পাথারিয়া পাহাড়ের গাঁ বেয়েই মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের সৃষ্টি। গঙ্গামারায় প্রবাহিত হয়ে যাওয়া জলধারা প্রায় ১৬২ ফুট উচ্চতা থেকে মাধবছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এই জলপ্রপাত।
দৈর্ঘ্য প্রায় তিরাশি মিটার উচু পাথরের টিলার ওপর থেকে অবিরাম গতিতে ঝর্ণা আছড়ে পড়ছে নিচে। প্রায় ১৮০ ফুট উপর হতে অবিরাম গতিতে জলরাশি নিচে পতিত হওয়ার ফলে নিচে সৃষ্টি হয়েছে একটি কুন্ড। আর এই কুন্ডের প্রবাহমান বারিষার মতো স্রোতধারা শান্তির বারিধারার মতো মাধবছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শান্তির প্রতিক। অরুর চোখ জুড়িয়ে গেল এই সৌন্দর্যে। পাশেই প্রত্যেকে নিজেদের ব্যাগপত্র রেখেছে। অরু নিজেরটা ফেলে পাশে দাঁড়ানো তন্ময়কে প্রশ্ন করলো,
–‘ এটা কতটা উঁচু তন্ময় ভাইয়া? কতো উঁচু থেকে পানি পড়ছে? ‘
–‘ ১৬২ ফুট উঁচু থেকে। ‘
–‘ শুনেছি ঝর্নার আশেপাশে নাকি একটি কাব থাকে। যেখানে কাপড়চোপড় বদলায়! ‘
তন্ময় হাতের ইশারায় কৌতূহল অরুকে দেখাল। মনে হচ্ছে পাথরের তৈরি একটা গুহা। ভয়ংকর গুহা যার নাম কাব।
–‘ কি সুন্দর! সেখানে যাওয়া যাবে? আমি ঢুকে দেখতে চাই। ‘
–‘ বেশি করলে এক্ষুনি তোকে বের করে দিব। ‘
অরু মুখ ভেঙাল আড়ালে। পরপর আবার বলল,
–‘ তন্ময় ভাইয়া আপনি এখানে, এই ঝর্নায় দাঁড়িয়ে গোসল করেছেন? আমি শুনেছি এখানে গোসল করে। ‘
–‘ হু। ‘
–‘ আমিও ভিজতে চাই। ‘
–‘ ঝর্নায় যাবার রাস্তা বেশ দুর্গম এবং পিচ্ছিল। এখান থেকে দেখ। ‘
–‘ কি!! ‘
অরুর চোখজোড়া রসগোল্লার মতো বড়ো হয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় বেরিয়ে আসবে। এত কষ্ট করে জলপ্রপাতের সামনে এসে দূর থেকে দেখবে? এটা আদৌও সম্ভব? তন্ময়কে অগ্রাহ্য করে দ্রুত পায়ে যেতে নিয়েছিলো। তন্ময় ধমকে উঠলো,
–‘ এই তুই দাঁড়া! ওখানে যাবি না। ‘
–‘ কেন? আল্লাহ কেন! পানিতে না নামলে মজা কোথায়? ওই আকাশ ভাইয়া! ‘
আকাশ চোখজোড়া পিটপিট করলো। অরুর অসহায় চোখজোড়া লক্ষ্য করে বলল,
–‘ পাথর গুলো পিচ্ছিল। তুই যেই তুড়তুড়ি। পড়ে টড়ে যাবি। ‘
–‘ না না পড়ব না।ওইযে শাবিহা আপু যাচ্ছে! অয়ন ভাইয়া, দীপ্ত সবাই যাচ্ছে। আমিও যাবো। প্লিজ! ‘
–‘ কলি তো তন্ময়ের পাশে দাঁড়িয়ে। ও তো যাচ্ছেনা। তুই ও দাঁড়িয়ে থাক। ‘
অরু কলির দিক তাকাল। তন্ময়ের পাশেই দাঁড়িয়ে নতুন বউয়ের মতো। বিরক্ত অরুর চোখজোড়া জলে চিকচিক করছে। অসহায়, বেদনাময় মুখশ্রী দেখে তন্ময়ের শক্ত হৃদয় হয়তো কিছুটা নরম হলো। বলল,
–‘ সাবধানে যা। ‘
অরু মুহুর্তেই হেসে এগিয়ে গেল। ঠিকই বলেছে তন্ময়। ভীষন পিচ্ছিল। দুর্গম ও বটে।অতি সাবধানে একেকটি স্টেপ নিতে হচ্ছে। যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। অরু জুতো জোড়া খুলে ফেললো। তন্ময় চেঁচাবে তার পূর্বেই অরুর তড়িঘড়ি করে পানিতে পা ভিজিয়ে দিলো। ঠান্ডা পানি। সেখানে পা ভিজিয়ে রাখতেই মন ব্যাকুল হয়ে পড়লো।
অরুর থেকে বেশ কিছুটা দূরে শাবিহা। শাবিহার পেছনে অয়ন। সে ভয়ে আছে শাবিহা পড়ে যাবে। বা কিছু একটা হয়ে না যায়! শাবিহা চারপাশ ঘুরে একটা পাথরে বসলো। অয়ন পাশের পাথরে বসলো। দুজনের চাহনি ঝর্নায়৷ জলরাশি অবিরাম ধারায় নিচে পড়ছে। সৌন্দর্যের যেন কমতি নেই এখানে। যেখানে চোখ যায়, সৌন্দর্য! অয়ন হুট করে প্রশ্ন করলো,
–‘ তোমার পছন্দের প্লেস আছে? যেখানে তুমি এখনো যেতে পারোনি। তবে যেতে চাও। ‘
–‘ ছোট ভাইয়া, পাহাড়ি অঞ্চলে যাওয়া হয়নি। ‘
অয়ন কেশে উঠলো। ছোট ভাইয়া ডাকটা ভালোভাবে হজম হচ্ছে না। তবুও নিজেকে ঠিকঠাক রেখে বলল,
–‘ আমি গিয়েছি বেশ কয়েকবার। ‘
–‘ অনেক ঘুরেছ দেখছি! ছোট্ট ভাইয়া! ‘
–‘ অনেক ঘুরেছি তবে তোমার সঙ্গে ঘুরতে পারাটাই সবথেকে প্রিয়। ওসব তুচ্ছ! ‘
–‘ তুমি সেলিংয়ের কাজ কেন করছ না? এভাবে মিঠাই মেরে কাস্টমার জোগাতে পারবে। ‘
–‘ তুমি সেই কাস্টমার হলে আমি মিঠাই মারতে রাজি। ‘
–‘ ধুর! ‘
অয়ন হাসলো। শরীরের উপর অংশ নুয়ে হাতের মুঠোয় পানি নিল। এবং শাবিহার মুখে ছুঁড়ে মারল। আচমকা আক্রমণে শাবিহার চোখমুখ ভিজে গিয়েছে। এক ফোটা পানি ঠোঁটে পড়ে আছে। ঠিক মধ্যখানে। অয়ন সেখানেই বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো। ওই পানির ফোঁটার উপর তার বেশ হিংসা হচ্ছে। দৃষ্টি সরাতে পারছেনা যেন। শাবিহা বিষয়টি খেয়াল করেনি হয়তো। সে নিজেও পানি অয়নের গায়ে ছুড়ে মারল। অয়নের শার্ট অনেকাংশে ভিজে গেল। সে হেসে শাবিহার দিক আবারো পানি ছুড়ল। শাবিহাও ছুড়ল। দুজনের পানি ছোড়াছুড়ি একটি খেলায় পরিনতি হলো। হাসি ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে শাবিহা ভুলে বসলো তার সামনের ছেলেটি বয়সে তার থেকে ছোট। ভুলে বসলো প্রতিবেশী, পরিবার। এমুহুর্ত শুধু তার এবং অয়নের ।
_____________
দীপ্ত অন্যপাশে যাবে। চারপাশে বাচ্চাদের দেখার মতো সুন্দর সুন্দর স্থান আছে। সাথে আছে পুতুলে মুর্তি। বেশকিছু ভাস্কর্য রয়েছে বলা যায়। দীপ্ত সেগুলো দেখবে৷ আকাশ তাকে নিয়ে যাবে সেসময় তন্ময় বলল,
–‘ কলিকে সঙ্গে নে। ও জলপ্রপাত দেখতে তেমন ইন্ট্রেস্ট না। ‘
কলি দ্রুত মাথা দুলিয়ে বলল,
–‘ না সমস্যা নেই। আমি আপনার সাথে
থাকতে…. ‘
তন্ময় তাকে কথা শেষ করতে দেয়নি,
–‘ যাও আকাশের সাথে। ‘
আকাশ বলল,
–‘ চলো। খুব সুন্দর চারপাশ। জলপ্রপাত এতক্ষণ দেখার মতো কিছু না। ‘
কলি একদমই যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু কি করার? চোখমুখ অন্ধকার করে ওদের সাথে গেল। তন্ময় একাই দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি কিছুটা দূরের অরুতে। অরু পাথর পেরিয়ে কিছুটা নামছে তো আবার উঠে আসছে। দু’হাতে পানি তুলে দূরে ছুড়ে মারছে। নাহলে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখল তন্ময় এগিয়ে এসেছে। দুহাত দূরে হবে তার থেকে। অরু একগাল হেসে পানি ছুড়ে মারল তন্ময়ের দিক৷ তন্ময় হাত নিজের মুখের সামনে ধরে বলল,
–‘ অরু! ‘
অরু থামলো না। পুনরায় ঝুকে দু’হাতের সাহায্যে একগাদা পানি ছুড়ল। পরপর আরও কিছু। মুহুর্তেই তন্ময়ের উপরের অংশ ভিজে গিয়েছে। তাও তার চোখমুখে রাগের আভাস নেই। অরুর সাহস বেরে গেল। সে পাগলের মতো পানি ছুড়তে লাগলো। তন্ময় একপর্যায়ে পাথর টপকে এগিয়ে যাচ্ছে অরুর দিক৷ অরু হেসে সেখান থেকে যেতে নিয়েছে। কিছুটা গিয়েছেও! কিন্তু তন্ময় একদম কাছে চলে এসেছে দেখে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটতে নিয়ে পাথরে পা পিছলে পড়ে যায়। বে-কায়দায় পড়ে আর্তনাদ করছে। চোখের পানিতে গাল ভিজে উঠেছে। তন্ময় তখনই চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ছুটেছে। কিন্তু ধরতে সক্ষম হয়নি সময়মতো। দ্রুত পায়ে এসে অরুকে তুলতে চাইল। অরু উঠতেও পারছেনা। অতঃপর অরুর ঘাড়ে এবং হাটুর নিচে ধরে, পাজা’কোলে তুলে নিলো। যেখানে ব্যাগ গুলো রাখা সেখানে এনে বসালো। অরুর হাটু ছুঁলে গিয়েছে। হালকা রক্তের দাগ উঠেছে প্যান্টের উপর দিয়ে। পায়ের পাতা ছুঁলেছে সাথে হাড্ডি বেকেছে হয়তো। নড়াতেও পারছেনা। তন্ময় ধমকাতে গিয়েও ধমকাল না। রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে পায়ে ছুঁতে যেতেই অরু পা সরিয়ে ফেলল,
–‘ ব্যথা পাই। ‘
তন্ময় চোখ রাঙিয়ে পা’টা টেনে নিজের দিক আনল। দু একটা মোচড় দিবে পূর্বেই অরু চিৎকার করে উঠলো।
–‘ মরে যাবো। ধরবেন না একদম। ‘
অরুর হাত তন্ময়ের কাঁধ শক্ত করে চেপে। ব্যথা আর ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে। তাকে তন্ময় কিছুক্ষণ দেখে বলল,
–‘ চোখ খোল ত! ‘
অরু ভয়ে ভয়ে খুলল। তন্ময় বলল,
–‘ এখানে আরেকটি ঝর্না আছে জানিস? ‘
–‘ সত্যিই? কি নাম? ‘
–‘ পরিকুন্ড ঝর্না। সেটাও খুব সুন্দর। ‘
–‘ আমরা যেতে পারবো না সেখানে? ‘
–‘ হু পারবো। দশ মিনিট হেঁটে গেলেই সেটা দেখতে পারবো। ‘
–‘ সত্যি? ‘
অরু খুশিতে হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া তন্ময়কে একদমই খেয়াল করতে পারেনি। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে তার। স্বপ্নে বিভোর সে হঠাৎ পিনপিনে কষ্ট অনুভব করলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। পরপর তার পায়ে তন্ময় জুতো পড়িয়ে দিল। তারপর উঠে দাঁড়ালো। বলল,
–‘ দেখি উঠে দাঁড়া! ‘
অরু ভেজা নয়নে উঠে দাঁড়ালো। পা ঠিক হয়ে গিয়েছে। একটা মোচড় দেওয়ার জন্য কী ব্রিলিয়ান্ট অভিনয় না করলো। এতো সুন্দর অভিনয় তন্ময় কবে শিখেছে? অরু কি গাঁধি!
–‘ তারমানে সব মিথ্যে বলেছেন? ‘
–‘ না ঝর্না আরেকটি আছে পাশে। ‘
–‘ চলুন যাই সেখানে। প্রমিজ আর দৌড়াদৌড়ি করবো না। আপনার পাশেপাশে থাকব। ‘
তন্ময় শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যেমন ওয়ার্নিং দিচ্ছে এটাই শেষবার। অবশেষে রাজি হলো। অরুকে নিয়ে সেদিকটায় হাঁটা দিল। হাঁটতে অরুর একটু কষ্ট হচ্ছে বটে। পা থেকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। তন্ময় হঠাৎ তার বাম হাত অরুর সামনে এগিয়ে দিল। কিন্তু আজ হাত ধরতেও লজ্জাবোধ করছে অরু। পরপর বেশকিছু লজ্জাজনক সিচুয়েশনে পড়েছে সে। অবশেষে ধীরে তন্ময়ের হাতের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে লাগলো। চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেল সেই আকর্ষণীয় ঝর্নার সামনে। এই ঝর্না অন্যরকম সৌন্দর্যে ঘেরা। তবে এবার আর তন্ময় তাকে যেতে দেয়নি কাছে। দূর থেকেই দেখতে হচ্ছে।
অরু বলল,
–‘ আমাকে একটা ছবি তুলে দিবেন? ‘
–‘ না। ‘
–‘ না বলবেন না। এইযে এখানটায় দাঁড়াব। আপনি পুরো ঝর্না সহ আমাকে তুলবেন কেমন? ‘
চলবে ~~~~
প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল
২১.
সংসার জীবন অনেকটা একটি যুদ্ধের ময়দান। প্রথম যখন এই যুদ্ধের ময়দানে পা রাখেন, তখন শুধু যুদ্ধ করে যান একজনের জন্য। আপনার স্বামী! তারপর নিজের সন্তান! এখানে যুদ্ধের নামে চলে মায়ার খেলা। কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা উপলব্ধি করেও এই ময়দান ত্যাগ করতে পারবেন না৷ মায়ার জালে আটকানো এই মন আপনাকে ত্যাগ করতে দিবেনা। কারণ শতসহস্র যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যাবে একটুকরো সুখ উপলব্ধি করে। এইযে বছরের পর বছর যত্ন নিয়ে গড়া সংসার যখন ছেড়ে চলে এসেছেন, মনে হয়েছিল তিনি একটুকরো জীবন ফেলে এসেছেন। জীবনটুকু ফিরিয়ে পাওয়ার স্বপ্ন, একটি দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা নেহাতি। আজ তার সেই স্বপ্ন মুহুর্তেই কেমন বাস্তব রূপ ধারণ করতে বসেছে। চায়ের কাপ নিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দরজাটা খুলে ঢুকবেন শুধু। কিন্তু অদৃশ্য এক দ্বিধা নামের লজ্জা তাকে ঝেঁকে ধরেছে। স্বামীর সঙ্গে বছর-বছর ধরে কথা হয়নি। হয়নি দেখাসাক্ষাৎ। পাশে বসে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা থেকেও বহু দূরে রয়েছেন। পাশাপাশি বসে চায়ের কাপে ঠোঁট বুলিয়ে হাসিতে মাতোয়ারা হবার দিনগুলো মনে করতেই, চোখের কোণ ভিজে উঠে। তাই হয়তো সেই যুবতী মনের অনুভূতি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। দ্বিধাবোধ করতে থাকা তাকে অবাক করে দিয়ে ভেতর থেকে মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন,
-‘ এসেছ? ‘
চিরচেনা সেই ডাক। দ্বিধাবোধ ফেলে জবেদা বেগম রুমে ঢুকলেন। মোস্তফা সাহেব বইপত্র হাতাচ্ছিলেন। জবেদা বেগমকে দেখে এগিয়ে গেলেন। হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চেয়ারে বসলেন।
-‘ বসো। ‘
জবেদা বেগম জড়সড় হয়ে বসেছেন। বুড়ো বয়সী মন আজ যুবতীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। আঁড়চোখে স্বামীর পানে তাকালেন। চায়ে চুমুক বসিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিলেন মোস্তফা সাহেব। নরম সুরে শুধালেন,
-‘ রাগ কমেছে? ‘
জবেদা বেগমের মুখশ্রী মুহুর্তেই অন্ধকারে পরিনত হয়েছে। বিষন্নতা, কষ্ট, দুঃখ সবকিছু একত্রে ফুটে উঠছে মুখমণ্ডলে। চোখজোড়া জ্বালা করছে তার। মাথা নিচু করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন নিজেকে সামলাতে। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছেন। এই মুহুর্তের জন্য তিনি দুটো বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন। এই ভেবেছেন, স্বামী দ্বিধার দেয়াল টপকে চলে আসবেন তার মান ভাঙাতে। ঠিক যেমনটা করে এসেছেন দীর্ঘকাল ধরে। দিনের পর দিন যেতে লাগলো কিন্তু জবেদা বেগমের দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহরের সীমান্ত দেখা দিচ্ছিলোই না যেমন। নিজের গোছানো সংসার, ভালোবাসার স্বামী ফেলে আলাদাভাবে থাকার মতো কষ্ট পৃথিবীতে হয়তো দ্বিতীয়টি ছিলো না তার জন্য। রাগ তো তার কবেই ধুয়েমুছে চলে গিয়েছে। বুকে শুধু একরাশ অভিমান ছিলো। আজ সেই অভিমান স্বামীর একটি কথায় চলে গেল মুহুর্তেই। জবেদা বেগমের গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে নিচ্ছিল। তিনি মাথাটা ঘুরিয়ে মুছে নিলেন। মোস্তফা সাহেব হাতের চায়ের কাপ টি-টেবিলে রেখে জবেদা বেগমের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন৷ শুধালেন,
-‘ কাঁদছ? ‘
-‘ না তো! কাঁদবো কেন! ‘
-‘ আমি এইযে দেখছি। চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলছ! ‘
-‘ মোটেও না। শুধু চোখে পানি। এইযে, কই নাকে তো নেই। কাঁদলে আমার নাকের পানি বেরোয় না। মিথ্যা বলবেন না। ‘
-‘ তারমানে স্বীকার করছ যে তুমি কাঁদছ? ‘
জবেদা বেগম চুপ করে রইলেন। সেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাকে নিজের মুখে স্বীকার করিয়েই ফেললো। দেখেছে যেহেতু কাঁদছে তাহলে দেখতেই থাকুক। কেন প্রশ্ন করে বাচ্চাদের মতো! মোস্তফা সাহেব গম্ভীর স্বরে হাসলেন। হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে নিয়ে বললেন,
-‘ আমি তো তোমাকে হাজার রকম ভাবে কাঁদতে দেখেছি। ‘
-‘ আমি আপনাকে হাজার রকম ভাবে রাগতে
দেখেছি! ‘
-‘ তাই বুঝি? আমিতো রাগি না। শান্ত মানুষ! পানির মতো শান্ত। ‘
-‘ এভাবে আপনি মিথ্যে বলতে পারছেন? সেইবার সামান্য একটু ব্যাপার নিয়ে আপনি রেগে রুমের ড্রেসিংটেবিল ভেঙে ফেলেছিলেন, মনে নেই? ‘
-‘ ভুল বসত হয়েছিলো। ‘
-‘ আপনি এখন সম্পুর্ন মিথ্যে বলছেন! ‘
-‘ তাহলে সত্যি কিছু বলি? ‘
মোস্তফা সাহেবের ঠোঁটের ফাজলামো হাসিটুকু গায়েব হয়ে গিয়েছে। খুব নরম সুরে বললেন,
-‘ তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। ভালো থাকতে পারবো না। এই তিনটি বছর আমার জন্য হাজার বছরের সমান! আমি খুব লজ্জিত সেদিনের জন্য। আর কখনো এমন ভুল হবেনা। মাফ করে দিবে আমায়? ‘
জবেদা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। স্বামীর বুকে আলগোছে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলেন। তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে তাহলে। অপেক্ষাকৃত সেই মুহুর্ত আঁচলে ধরা দিয়েছে। মোস্তফা সাহেব আদুরে ভাবে জড়িয়ে রেখেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার আপ্রান চেষ্টা করছেন। তার নিজের চোখজোড়াও যে জ্বলছে। বুকের যন্ত্রণা লাঘব পেয়ে বসেছে তাকে। জবেদা বেগম ফুপিয়ে বললেন,
-‘ না। ‘
-‘ মাফ করবে না বলছ? কি করলে মাফ করবে? কান ধরবো? আচ্ছা ধরি তাহলে…
মোস্তফা সাহেব সত্যি হাত উঠিয়েছেন কান ধরতে। জবেদা বেগম দ্রুত তাকে আটকালেন।
-‘ কি করছেন! ‘
মোস্তফা সাহেব হাসলেন। জবেদা বেগম চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করলেন,
-‘ বাবা কি বলল? সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পেরেছেন? বাবা মেনেছে? ‘
-‘ মেনেছেন। তিনি বুঝেছেন আমাদের সিচুয়েশন। তবে তোমার ভাই বড়ো একটা গন্ডগোল পাকাবে মনে হচ্ছে। ‘
-‘ ভাইয়াকে বুঝালে সে নিশ্চয়ই বুঝবে। ‘
-‘ তুমি কি চাও? তন্ময়ের জন্য কলি…..
-‘ আমার ছেলে যাকে চায়, আমি তাকেই চাই। ‘
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা শেষ হতেই জবেদা বেগম মনের সব অভিমান মোস্তফা সাহেবের সামনে তুলে ধরছেন। মোস্তফা সাহেব মুচকি হেসে স্ত্রীর সকল অভিযোগ মাথা পেতে নিচ্ছেন। কয়েকবার বলেছেন, ‘ এমনটা আর কক্ষনো হবেনা। ‘
____________
অরু ভাঙা পা নিয়ে আবারো পাথরের চুড়ায় পড়েছে। এবার দু’পা অবস প্রায়। রাগের চুড়ান্তে পৌঁছে তন্ময় আকাশ ফাটিয়ে অরুকে ধমকেছে। তার রাগী উচ্চ স্বরের কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠেছে আশেপাশের অপরিচিত মানুষজন অবদি। ব্যথা এবং ধমক খেয়ে অরুর চোখেয় পাতায় অশ্রু। অশ্রুসিক্ত তাকে এবার শাবিহা নিজের সাথে নিয়ে হাঁটছে। ব্যথায় গুঙিয়ে সে শাবিহার সাথে ধীরে এবং খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হতে বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেল। বৃষ্টির দু’এক ফোঁটা পানি শরীর ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছে। আকাশ দীপ্তকে নিয়ে এসেছে মাত্রই,
-‘ চল বেরিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিও নামবে মনে হয়। ‘
তন্ময় মাথা দোলাল। নিজেদের ব্যাগগুলো কাঁধে নিয়ে সকলেই রওনা হয়েছে। ইকোপার্ক গেইটের সামনে আসতে না আসতেই তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। আচমকা বৃষ্টিতে উপস্থিত সকলেই খানিক ভিজে গেল। দ্রুত গাড়ির দিক ছুটেছে প্রত্যেকে। অরু ভাঙা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দুঃখে কষ্টে তার কান্না পাচ্ছে। অবশ্য ভুল তার নিজের! কিন্তু তারপরও তন্ময়ের উপর করা অভিমান যেমন ফ্রি। একটু কিছুতেই অভিমান করে বসে এই মন। এইযে শাবিহা তাকে ফেলে দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসেছে। কই শাবিহার উপর তো অভিমান হলোনা! ওইতো আকাশ, দীপ্ত রুবি এবং অয়ন ও চলে গিয়েছে তাকে ফেলে, কই তাদের উপর তো অভিমান হচ্ছে না। তাহলে কেন শুধু তন্ময়ের উপর তার সকল অভিমান! ভেজা নয়নে বৃষ্টির মধ্যে তাকাল সামনে দাঁড়ানো তন্ময়ের পানে। নিজে দাঁড়িয়ে ভিজছে তাকেও ভেজাচ্ছে। ধরে নিয়ে গেলে কী এমন হবে? এতো রাগ! অরু কী ইচ্ছে করে পড়েছিল? আচমকা ধাক্কায় পড়েছে।
এদিকে গাড়িতে বসা কলিকে বেশ চিন্তিত লাগছে। তাকে একপ্রকার টেনে গাড়িতে তুলেছে শাবিহা৷ কলি উঠতে চাচ্ছিল না। বারংবার প্রশ্ন করছিল,
-‘ তন্ময় ভাইয়া তো ওঠেনি এখনো। ‘
-‘ পরে উঠবে। ‘
কথাটা বলেই আগ্রহী চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো শাবিহা। একই অবস্থা গাড়িতে বসা প্রত্যেক সদস্যের। যেমন সামনে খুব আকর্ষণীয় ফিল্ম চলছে। আকর্ষনীয় বটেই! এইযে তন্ময় বৃষ্টির মধ্যে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তার পেছনে অরু দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দুজন ভিজে চুপচুপে ইতিমধ্যে। কেউ কোনো কথা বলছে না। তাদের দেখে মনে হচ্ছে ফিল্মের নায়ক-নায়িকা। নায়ক নায়িকার উপর চরম বিরক্ত। বিরক্ত হয়েই মুলত দাঁড়িয়ে। না এগিয়ে যাবে নায়িকাকে বাঁচাতে আর না সে যাবে না বাঁচিয়ে। একপর্যায়ে অরু খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেই হাঁটা ধরেছে গাড়ির দিক। লাগবে না তার সাহায্য। একাই যেতে পারবে। এই অরু ভাঙা পা নিয়ে মাধ্যমিক পরিক্ষা দিয়েছে। একশো এক ডিগ্রি জ্বর নিয়ে দিয়েছে এসএসসি পরিক্ষা। এখান থেকে এখানে যেতে তার বা’হাতের ব্যাপার। হুট করে নিজেকে হাওয়ায় ভাসতে অনুভব করলো। চিৎকার করে চেপে ধরলো তন্ময়ের শার্ট। তন্ময় রাগে কাঁপছে। আঁড়চোখে অরুকে চোখ রাঙাল। মনে হলো, অরুকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। একটুকরো গোস্তো ফেলবে না! হনহনিয়ে হাঁটা ধরেছে গাড়ির দিক। অরুকে বেশ নাজুক লাগছে। তন্ময়ের কোলে শুয়ে থাকা সে আশ্চর্যের শেষ সীমানায়। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো গতি নেই৷
গাড়ির সামনে এসে থেমেছে তন্ময়। ভেতরে অরুকে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলেছে। তারপর পাশে নিজেও উঠে বসলো। নিস্তব্ধতা চারপাশ জুড়ে। কারো কোনো কথা নেই। নিস্তব্ধতার মাঝে আকাশের হাসির শব্দ শোনা গেল৷ পরপর দীপ্তর এবং শাবিহার। তাদের হাসির কারণ বুঝল না কলি। সে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে আছে অরুর দিক। যে আপাতত কাঠকাঠ হয়ে বসে। এতসব মানুষ এখানে! কেউ অরুকে সাহায্য না করে চলে এলো কেন? তন্ময় বা সেভাবে দাঁড়িয়ে রইলো কেন? কলি কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে মনের কোণায় একটি অদ্ভুত যন্ত্রণা উপলব্ধি করলো।
অরুর ডান পাশে তন্ময় বাম পাশে রুবি এবং দীপ্ত। পেছনে অয়ন শাবিহা এবং কলি। সামনে ড্রাইভার এবং আকাশ। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। অরুর ঘোর কেটেছে বেশ সময় নিয়ে। সে আসলেই কল্পনা করেনি তন্ময় তাকে এভাবে সকলের সামনে কোলে তুলে নিবে৷ এরজন্যই এতটা চকমকেছে যে বোধগম্য হারিয়ে বসেছিল৷ শাবিহা ব্যাগ থেকে তাওয়াল বের করে দিল তন্ময়ের দিক৷ ভেজা কাপড়চোপড় পরেই বাকিটা রাস্তা যেতে হবে। তারা যে হোটেল নিবে এক রাত্রের জন্য তাও সম্ভব নয়৷ আগ থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়৷ কে জানত, এভাবে হুট করে ওয়েদার খারাপ হয়ে যাবে।
বাজারের সামনে গাড়ি থামানো হয়েছে। এখানে একটি পপিউলার হোটেল আছে। এখানে চাইনিজ এবং ইটালিয়ানো ডিসেস ছাড়াও নামি-দামি অনেক খাবারই পাওয়ার যায়। আকাশের বেশ চেনাজানা হোটেল। তিনজন পুরুষ মিলে বেরিয়েছে গাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য কিছু ভালো খাবার প্যাক করা সকলের জন্য। ঘন্টাখানেক সময় অপেক্ষা করে, খাবার নিয়ে বেরিয়ে এসেছে হোটেল থেকে। গাড়িতে উঠতেই আবারো চলছে গাড়ি। খিদে পেটে নিয়ে সকলে হামলে পড়েছে খেতে। যে যার মতো নিয়ে নিয়েছে নিজেদের পছন্দের ডিস। সবাই খেতে ব্যস্ত শুধু কলি বাদে। সে খাবেনা জানাচ্ছে বারবার। তন্ময়কে বিরক্ত লাগলো বটে,
-‘ কোনো সমস্যা? আমিতো তোমাকে হোটেল যাবার আগে প্রশ্ন করে গেলাম, কী খেতে চাও! বললে যেকোনো কিছু হলেই হবে। তাহলে এখন কী হয়েছে? ‘
-‘ খারাপ লাগছে আমার। ‘
-‘ বেশি খারাপ লাগছে? ‘
-‘ না এই একটু আরকি! ‘
শাবিহা বলল,
-‘ শুয়ে থাক। ভালো লাগবে। ‘
অরু আঁড়চোখে খাবারের দিক তাকাল। জিভ ভিজে উঠছে তার। বলল,
-‘ আপু আপনি সত্যি কি খাবেন না? ‘
-‘ খাব না৷ ‘
-‘ তাহলে আমি খাই! ‘
বলেই অরু নিজের খাবার শেষ করে কলির খাবার খেতে লাগলো। খাওয়ার পর্ব চুকাতেই মনমেজাজ তরতাজা হয়ে গেল সকলের। পেছনে বসা অয়নের ঠোঁট থেকে গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরু ঘুরে বসলো। অয়নের দিক জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আবদার করল,
-‘ অয়ন ভাইয়া গান শোনাবে? তুমি তো খুব সুন্দর গান গাইতে পারো। ‘
-‘ কে বলল? ‘
-‘ শাবিহা আপু। ‘
শাবিহা আকাশ থেকে পড়ল যেমন। ধমকে উঠলো অরুকে,
-‘ কখন বলেছি তোকে? ‘
দীপ্তও গান শোনার লোভে অরুর সঙ্গ দিলো,
-‘ হ্যাঁ শাবিহা আপু বলেছে। আমিও শুনছি। ‘
নির্বাক শাবিহার পানে হেসে তাকাল অয়ন। নিজেকে বেশ সামলে রেখেছে সে। শাবিহা নিজের পরিবারের সঙ্গে এসেছে। এখানে তার অসভ্যতা বা প্রেমিক গিরি সাজেনা৷ তাই অতটা কাছে যাচ্ছে না বা অযথা কথা বলছে না। শাবিহা এখনো পুরোপুরি মানতে পারেনি তাদের সম্পর্ক! অয়ন বুঝতে পারছে তাই হয়তো একটু দূরত্ব রেখেছে পরিবারের অযুহাত ধরে। আকাশ হুট করে ঘুরে বলল,
-‘ জানো অয়ন, তন্ময় খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে। সাথে গানও গাইতে পারে। তবে শয়তানটা গায় না। ভার্সিটির চতুর্থ ইয়ারে আমাদের গ্যাং পার্টি হয়। ফ্রেন্ড সার্কেল। তো সেখানে যার গান গাওয়ার ছিলো, সে আসেনি। তখন উপায় না পেয়ে তন্ময় গিটার বাজিয়ে গান গায়। সেই কি মারাত্মক দৃশ্য। আমার ল্যাপটপে আছে। ‘
অয়নের কন্ঠে বিষ্ময়,
-‘ তাই বুঝি? আমাকে মেইল করো ত! ‘
তন্ময় বিরক্ত হলো,
-‘ উফ! রাখ এগুলো! ‘
আকাশ চুপ মেরে গেল। কথা আবারো ঘুরে অয়নের দিক ছুটলো। অয়নকে একটি গান গাইতেই হবে! সকলের জোড়াজুড়িতে অয়ন পরিশেষে রাজি হয়। শাবিহা উপরে উপরে পরোয়া না করার ভান ধরলেও, মনে মনে সে ব্যাকুল। ব্যাকুল অয়নের গলায় গান শোনার জন্য। কি গান গাইবে অয়ন?
অয়ন সময় নিয়ে সুর তুলেছে।
হতে পারে এ পথের শুরু
নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী
সাজিয়ে নিবো ভালোবাসায়।
ভালোবাসি বলে দাও আমায়
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল
তুমি শুধু আমারই হবে
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।
হাতে হাত রাখতে পারো
সন্ধি আঙুলে আঙুল
ভালোবাসা বাড়াতে আরও
হৃদয় ভীষণ ব্যাকুল।
নিস্তব্ধ গাড়ির মধ্যে শুধু অয়নের পুরুষালী কন্ঠ। এবং খুব কাছ থেকে সেই কন্ঠে গান শুনছে শাবিহা। বুকের এই উথালপাথালের কোনো নাম আছে?
চলবে ~~
পরের পর্ব থেকে শুরু হবে নতুন চ্যাপ্টার। ?