প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩১,৩২

0
1642

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩১,৩২

৩১.
ছাঁদে পা রাখতেই দেখতে পাওয়ার যাবে, পা’পাশে সবুজ বোর্ডে, বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘গ্রিন ল্যান্ডে স্বাগতম’। নামটির যথার্থ পরিচয় দিয়েছে। ফ্লোরে সবুজ ঘাসের মেলা। বোঝার উপায় নেই যে এখানে প্লাস্টিকের ঘাসের ব্যবহার হয়েছে। দেয়ালেও সমানতালে ঘাসের ব্যবহার। মধ্যখানে দু’লাইন গেঁথে বড়ো দুটো টেবিল গিয়েছে। আসন দেয়া রয়েছে মোট চল্লিশ জনের। ড্রাম, গিটার এমন নানান রকমের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে আশপাশে। গোল কুশন বালিশ গুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেকেই। এতগুলো অজানা মানুষ একত্রে দেখে অরু হকচকিয়ে গেল। সেই মানুষ গুলোর নজর তন্ময়ের উপর পড়তেই, একেকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সে তন্ময়ের পেছনে চলে এলো। ভয়ে ধকধক করছে ভেতরটা। একপ্রকার গুটিয়ে গিয়েছে সে। এমন হট্টগোল মোটেই আশা করেনি।

বারো, চৌদ্দ জন পুরুষ হবে একত্রে। এবং প্রত্যেকে স্যুট-কোট পরে। একেকজন পুরুষের পাশে সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে। বোঝাই যাচ্ছে তাদের জীবনসঙ্গিনী। তারা দিব্বি তন্ময়কে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডেকে চলেছে,’এই আমাদের চ্যাম্প চলে আসছে। সাইড, সাইড! যায়গা দেন।’
‘এতবড় তন্ময় এতটুকু যায়গায় আটব ত?’
‘এই ব্যাটা! এতবড় তন্ময় মানে! তোর’টা কি
ছোটো?’
‘এইযে বড়ো তন্ময় চাচা দেখে নেন চোখ খুলে, ঠিক কে আগে অশ্লীলতা শুরু করছে! চোখ খুলে দেখে নেন সবাই! মাহিননা শুরু করছে! আমি আবার সবসময় অশ্লীলতার খেতাবে অংশগ্রহণ করতে চাই না।’
‘এই মাদার’বোর্ড তুই এতবড়ো বলতে কি বুঝাইছস এটা আগে বল।’
‘এতবড় মানে বড়ো! বড়ো ইংলিশে হলো, ‘বিগ’! বিগার বিগ!’
‘শা’লা অশ্লীল! তুই দেখে আসছস বিগ না স্মল। গে একটা!’
‘এই খবরদার! মুখ সামলে কথা বলবি, ছোটো মিয়া!’
‘আহিস দেখাব ছোটো না বড়ো।’
‘একদম খুলে?’

অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে একেকজনের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। ভীতু সে একটি কথার মানেও বুঝে উঠেনি। কি রেখে কী বলছে ভালোভাবে শুনতেই পারছেনা! বুঝবে তো দূরের বিষয়। সে বরং আলগোছে তন্ময়ের শার্টের একটি অংশ চেপে রেখেছে। তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে সকলকে দেখছে। একসময় দৃষ্টি গিয়ে থামলো ইব্রাহিমের দিক। ইব্রাহিম একটি গ্লাস হাতে বসে। আপাতত ঠিক অরুর দিক তাকিয়ে মুচকি হেসে চলেছে। গ্লাসের সাথে গ্লাস মেরে উচ্চস্বরে বলল, ‘তোরা ইম্পর্ট্যান্ট গেস্ট মিস করে যাচ্ছিস!’

ইব্রাহিমের আঙুল তোলায় এবার সকলেই তন্ময়ের পেছনে তাকাল মনোযোগ দিয়ে। সুঠাম দেহের তন্ময়ের পেছনে পাতলা, ছোটো গড়নের অরুকে লক্ষ্য করা আসলেই কষ্টসাধ্যের বিষয়। কিছু সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা বয়ে গেল। পরপর পুনরায় হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ! মাহিন অধৈর্য গলায় শুধালো, ‘এটা অরু না?’
‘অরুকে এনেছিস? সিরিয়াসলি! সূর্য কোথা থেকে উঠছে?পূর্ব?’
‘শা’লা অশিক্ষিত সূর্য পূর্ব দিক থেকেই উঠে!’
‘সূর্যমামা আর আমি ভাইরা ভাই! এখন ভাই-ভাই হয়ে তো আর তাকে উল্টো দিক থেকে উঠতে বলতে পারিনা!’
‘ইয়াক!’

অরু এখনো চমকে তাকিয়ে। সকলেই তার নাম জানে।কিভাবে জানে? সে তো এই প্রথম তাদের দেখছে। এর আগে কখনো দেখেনি। তন্ময় বন্ধুবান্ধব বাড়িতে আনেনা খুব একটা। ক্লোজ ফ্রেন্ড ইব্রাহিম হাতেগোনা দু’একবার এসেছে। আর সকলেই তাকে কেমন নাম ধরে, মজার সুরে কথা বলে চলেছে। যেনো বছর বছর ধরে তাদের সম্পর্ক, পরিচয়, চেনাজানা।

তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে অরুর দিক তাকাল। এগিয়ে নিয়ে গেল তার বন্ধুবান্ধবদের সামনে। চোখে চোখ রেখে নরম সুরে বলল, ‘দে আর মাই ফ্রেন্ডস।’

অরু ছোটো স্বরে সালাম জানাল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘আলাইকুমস সালাম। আলাইকুমস সালাম।’ জবাব খানা সকলের থেকে ফিরে আসলো। তন্ময় একটি কুশন এগিয়ে দিয়ে বসতে ইশারা করলো অরুকে। অরু বসলো জড়সড় হয়ে। তার পাশেই তন্ময় বসেছে ছুঁই ছুঁই হয়ে।

সর্বদা গম্ভীরমুখের তন্ময়কে এখন আর গম্ভীর লাগছে না। সে মুচকি হেসে তাকিয়ে বন্ধুদের পানে। দু’একবার মাথা দুলিয়েছে। কথা বলছে! এক সুন্দর পরিবেশ। হাসাহাসির ঝড় বসেছে। ঠাট্টার সুরে রিহান বলে, ‘এতবড় তন্ময়ের জন্য অরু ছোটো হয়ে গেল না!’

হাসাহাসির ঝড় নেমে এলো। ইব্রাহিম হাসতে লুটিয়ে পড়েছে। চোখের কোণে তার জল জমেছে। নিজেকে সামলে চোখে কোণ মুছে নিল। মাহিন অতিষ্ঠ সুরে ভেঙাল,’ সেই তন্ময়েরটা নিয়েই ওর যত মাথা ব্যথা! দেখে আসছে যে বড়ো! আর তোর’টা! ওটা যে ছোটো শুহানি জানে? এই শুহানি এটাকে ডাক্তার দেখাস না কেন!’

রিহান সকলের থেকে বেশি দুষ্টু প্রকৃতির। তা তার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে। তার পাশে ফর্সা, লম্বাচওড়া দেখতে মেয়েটি হলো শুহানি। অরু মনোযোগ দিয়ে মেয়েটিকে দেখল।কথাবার্তায় বুঝে নিয়েছে মেয়েটিও তন্ময়ের ফ্রেন্ড সার্কেলের একজন। তুই তুকারি তো আর যে সে লোক করেনা। লক্ষ্য করেছে তন্ময়কেও তুই করেই সম্বোধন করেছে। ইভেন রিহানকেও! শুহানি নাক কুঁচকে বলেছে,’ডাক্তার দেখিয়েছি, সার্জারী করতে হবে!’

রিহান বুকে হাত চেপে রেখেছে, ‘ বেবি! ডার্লিং! সুইটহার্ট হাও ক্যান ইউ সে দিস!’
‘চুপ থাক!’
‘এভাবে বলেনা যান! কষ্ট পাই।’
‘তুই মর।’
‘আমি মরলে কেম্নে হবে জান!’

রসিকতা সকলের মধ্যে বিদ্যমান। মাহিনের বা’পাশের ছেলেটা সৈয়দ। শান্তশিষ্ট ধরনের। তবে এবার মুচকি হেসে অরুকে জিজ্ঞেস করলো,’অরু তো এবার ইন্টার পরিক্ষা দিয়েছ না? তুমি করে বলছি কারণ ভীষণ ছোটো। আমাদের সকলের মাস্টার্স কমপ্লিট বুঝলে? আমরা তোমার সিনিয়রদের ঘরের সিনিয়র। তা এতবড় সিনিয়র বয়ফ্রেন্ড পেয়ে কেমন বোধ করছ?’
‘তারউপর সিনিয়র বয়ফ্রেন্ড কাজিন!
‘ওহো!’

অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাচ্ছে মাথা নত করে। ঠিক কতপ্রকার লজ্জা সে পাচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রীতিমতো গালে গরম আভাস পেয়ে চলেছে। মাথা তুলে তাকাতে পারছেনা। তন্ময় ঠোঁটে স্মিথ হাসি রেখে আছে। অরু খুব সময় নিয়ে নিচুস্তর স্বরে বলল,’জি। ইন্টার দিয়েছি।’
‘বি কম্ফোর্টেবল অরু! আমরা আমরাই তো।’

সৈয়দের পাশে রুবেল বসে। সে শুধু হেসেছে এবং টুকটাক মতামত দিয়েছে। এবার সেও কথা বলল,
‘এমন সুন্দরী শান্তশিষ্ট পিচ্চি কাজিন আমাদের নেই কেন!তাহলে তো আর মেয়ে খুঁজতে হতোনা! বাচ্চাকাল থেকে পড়িয়ে, শিখিয়ে নিজের মতো বড়ো করে, বিয়ে করে ফেলতাম!’
‘কাজিন গুলো সব বিয়েসাদী করে আঙ্কেল বানিয়ে ফেলেছে!’
‘সব লাক তন্ময় চাচার।’

অরু টানটান হয়ে বসে। ঘনঘন তন্ময়ের দিক তাকাতে ইচ্ছে করছে। কারণ তন্ময়ের হাত তার পিঠে। একটু পরপর বুলিয়ে দিচ্ছে। যেমন শান্ত করছে অরুকে। কিন্তু অরুর তো অস্বস্তি হচ্ছে না। একটু লজ্জা এবং ভয় লাগছে। তেমন ভালোও লাগছে।

ইব্রাহিম শব্দ করে হেসে উঠলো, ‘শান্ত? তাও অরু!অসম্ভব।’

শুহানি হেসে শুধালো, ‘অনেক দুষ্টু নাকি?’
‘দুষ্টু না! দুষ্টুর নানি। তন্ময়কে নাকে দরি লাগিয়ে ঘুরায়। অচেনা মানুষদের সামনে এমন পুতুল সেজে থাকে। কিন্তু বাড়িতে ও একটা জলজ্যান্ত জ্বালানি।’

অরু লজ্জায় মাথা নত করে রেখেছে। মনেমনে ইচ্ছে মতো বকে দিল। পেয়ে নেক একবার সামনে। ইতর, বাটপার একটা। মাহিন ইন্টারেস্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি নাকি তন্ময়?’

তন্ময় উচ্চস্বরে করে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকাল। বন্ধুদের সঙ্গে তাহলে তন্ময় এমন থাকে? কতটা সুন্দর লাগছে তার আইডিয়া আছে লোকটার? অরুর বুক দুরুদুরু করে কেঁপে উঠছে। বুকে অশান্তি অনুভব করছে। এভাবে তার সামনে কেন হাসেনা? এইযে হেসেছে বলে গহব্বরে হারিয়ে গিয়েছে মায়াবী চোখ দুটো। ঠিক কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, তা তো অরু ভালোভাবে দেখতেই পারছেনা।

তন্ময় হেসে বলল,’দুরন্তপনায় ঘেরা। ড্রামা বা মুভিস দেখতে হয়না। সি’জ এনাফ।’

শুহানি হেসে বলল, ‘ড্রামা কুইন আহা! লটারি জিতছস দোস্ত!’

অরু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। শুহানির কথায় পুনরায় লজ্জায় হতভম্ব হয়ে গেল। পরপর বন্ধুদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। নানান রকমের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। অরু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। একসময় ওয়েটার এসে ড্রিংকস দিয়ে গিয়েছে। সে মেজেন্টা নিয়েছে। ধীরেসুস্থে একটু একটু করে খেয়ে চলেছে। এরমধ্যে শুহানি এবং উপস্থিত কিছু মেয়ের সাথে তার কথাবার্তা হলো! তাদের কথায় অরু বুঝতে পারলো তারা সবাই তাকে চিনে। তন্ময়ের সেলফোন থেকে নাকি ছবি দেখেছে। মজার মজার অনেক ইন্সিডেন্ট শুনেছে। অরু বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। নাহিন দুষ্টু সুরে বলল, ‘তোমাকে মজার একটা বিষয় বলি অরু! তখন আমরা মাস্টার্স প্রথম বর্ষে। তন্ময়কে আমাদের ক্লাস লিডার তন্নি প্রপোজ করে। মাঠে ভরা জনগণ! পাব্লিক প্রপোজ বুঝো ত? পাব্লিক প্রপোজ করে বসে। সেই কি কান্ড! ভাবতেই হাসি চলে আসছে!’

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তার সঙ্গে বাকিরাও যোগদান করেছে। কিন্তু অরু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাকিটা শোনার জন্য। মাহিন বলল, ‘বাকিটা আমি বলি শোনো। তন্ময় খুব নিট অ্যান্ড ক্লিন! এটা আমরা সকলেই জানতাম। ও আগে থেকে ছোট গার্লফ্রেন্ড বাড়িতে বড়ো করছে, তা তো আর তন্নি বেচারি জানে না! ও তন্ময়ের পেছনে আঠার মতো লেগে পড়ল। কি খাটনি না খেটেছিলাম এই মেয়েকে সরাতে।’

অরু চোখমুখ অন্ধকার করে তন্ময়ের দিক তাকাল। তন্ময় জিজ্ঞেস করলো,’খারাপ লাগছে?’
‘না।’
‘ঠান্ডা লাগছে?’
‘উহু!’
‘ডিসকম্ফোর্ট ফিল করলে জানাবি!’
‘হু।’

নাহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’হাও কিউট! এই কেয়ারিং তন্ময়কে আমি প্রথম দেখছি!’
‘মি টু!’
‘আমিও!’

অরুর বলতে ইচ্ছে করলো, সেও এই প্রথম দেখছে। এমন কেয়ারিং, হাস্যজ্জ্বল সুন্দর তন্ময় আগে দেখেনি। দেখেনি বললে ভুল হবে। খেয়াল করেনি। মাহিন তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এই তুই এভাবে তুই তুকারি করছিস কেন অরুকে!’
‘অভ্যাস।’ তন্ময়ের ছোট জবাব। থেমে আবারো বলল, ‘পরিবর্তন করা যাবে বলে মনে হয়না।’
‘জান, টান ডাকিস না? না মানে কোনো নিক-নাম দিস নাই?’

অরু লজ্জায় পুনরায় হতভম্ব হয়ে রইল। তন্ময় আগেই যেই ওয়ার্নিং দিয়েছে তাকে, তার যথাযথ কারণ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে অরুর। বন্ধুদের মস্করার গুলো তন্ময় কি ইজিলি হ্যান্ডেল করছে। যে যা বলছে, সে সেটাই মেনে নিচ্ছে। জবাব দিচ্ছে! অরু চুপচাপ জড়সড় হয়ে সকলের আলাপ-আলোচনা শুনে গেল।
____________
ডিনার শেষ করে সকলে পুনরায় শুয়ে, বসে রয়েছে। মজামাস্তি থামেনি তাদের এক সেকেন্ডের জন্য। কিছুক্ষণ পর রুবেল গান নিয়ে কথা তুলেছে।ব্যস, সকলের রিকোয়েস্ট মেনে রিহান গান গাইল শুহানির জন্য। একটি বাংলা রোমান্টিক গান। অরু সমানে হাতে হাত, ছুঁয়ে তালি দিচ্ছে। লাজুক হেসে মনোযোগ সহকারে শুনছে। কি সুন্দর গেয়েছে! নিশ্চয়ই প্রায়শই গান গায় তারা! গান শেষ হতেই একসময় রূপম বলল, ‘অরু তোমাকে তন্ময় গান শুনিয়েছে ত?’

অরু প্রায়সময় শুনেছে তন্ময় ভালো গান গায়। গিটার বাজাতে পারে। কিন্তু কখনো শোনেনি। অরু মাথা নাড়লো। শোনেনি! মাহিন চেঁচিয়ে উঠলো,’কি বলো! তোমাকে গান শোনায়নি? পৃথিবীতে এমন প্রেমিক আছে নাকি, যে নিজের প্রেমিকাকে গান শোনায় না?’
‘আরে ওদের বিষয়টা তো ভিন্ন অন্যদের থেকে। দে আর কাজিনস!’
‘তাতে কি! কাজিনদের চান্স আরও হাঈ মাম্মা!’
‘এই ব্যাটা চল তাড়াতাড়ি গান গেয়ে শোনা একটা অরুকে! তুমি শুনতে চাও ত অরু?’

চুপসে গেল অরু। সকলের নজর তার উপর। এমনকি তন্ময়ের! সেও তাকিয়ে তার রায় জানার জন্য। লজ্জায় এখান থেকে অরুর লাফিয়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে তন্ময়ের মুখে গানও শুনতে চায়। অবশেষে হালকা মাথা দোলাল। মুহুর্তে রিহান তার হাতের গিটার ছুড়ে মা’রে তন্ময়ের দিক।
ইব্রাহিম উৎসাহ দিল, ‘চল শুরু কর!’

তন্ময় গিটার হাতে মাথা নত করে, গিটারে টুং টুং শব্দ করছে। অরু ধ্যান মে’রে দিয়ে তাকিয়ে। বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঠিক কতটা এক্সাইটম্যান্ট তার ভেতরে কাজ করছে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সে কখনো কল্পনা করেনি, তন্ময় তার জন্য গান গাইবে। গম্ভীর তন্ময়কে এভাবে কল্পনা করার সাহস সে জীবনেও পায়নি।

পরিবেশ শান্তশিষ্ট হয়ে গেল মুহুর্তে। কোনো শব্দ নেই। সকলেই নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। তবে ঠোঁটে মৃদু হাসি! মাহিন আঙুলের সাহায্যে শিঁষ বাজিয়েছে দুবার। ইব্রাহিম মোবাইলের ক্যামেরা ওন করে দিয়েছে। তন্ময়ের ভারী, গভীর কন্ঠের স্বর ধীরে শোনা গেল।

‘চাহে কুছ না কেহনা, ভালে চুপ তু রেহনা
মুঝে হে পাতা, তেরে প্যায়ার কা
খামোশ চেহরা, আখো পে পেহরা
খুদ হে গাওয়া, তেরে প্যায়ার কা,

তেরি ঝুকি নাজার, তেরি হার আদা
মুখে কেহ রাহি হে এ দাস্তা ,
কই শাকস হে যো কে ইন দিনোন
তেরে যেহেন-ও-দিল পে হে ছা গায়া!’

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩২.
জবেদা বেগম শাবিহার রুমে এসেছেন। তিনি মেয়ের পছন্দের ভুনাখিচুড়ি প্লেটে সাজিয়ে এনেছেন। সঙ্গে গোস্তো এবং পাশে সামান্য আচার দিয়ে।শাবিহা কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে অফিস থেকে। তখন সে মোবাইল হাতে পায়চারি করছিলো কক্ষ জুড়ে। মায়ের হঠাৎ আগমনে দাঁড়িয়ে পড়ল। নাকে ভেসে এলো সুগন্ধ! ঘ্রাণে চারিপাশ মৌ মৌ করছে। হেসে শুধালো,’কি এনেছ? খিচুড়ি মনে হচ্ছে!’

জবেদা বেগম প্লেট টেবিলের উপর রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে শাবিহা উড়ে গিয়ে বসলো চেয়ার পেতে। কোনোমত এক ঢক পানি খেয়ে, খিচুড়ি খেতে শুরু করেছে। জবেদা বেগমের রান্নার হাত চমৎকার। তার হাতের ভুনাখিচুড়ি চেটেপুটে খেতে হয়। সাধারণ একটি খাবারও জবেদা বেগমের হাতে, সুস্বাদু হয়ে উঠে। তিনি শাবিহার পাশে গিয়ে বসেছেন। আগ্রহী চোখে মেয়ের খাওয়া দেখছেন।

খাওয়ার একপর্যায়ে শাবিহা হেসে বলল,’কিছু কী বলবে মা!’

জবেদা নড়েচড়ে বসলেন। তিনি কিছু নয় অনেককিছু বলতে এসেছেন। অনেকদিন ধরেই মেয়ের সাথে একান্তভাবে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। তবে সময় হয়ে উঠছিল না। আজ বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা। মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব অফিসে আছেন। মুফতি বেগম পাশের বাড়িতে রয়েছেন। সুমিতা বেগম ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন। দীপ্ত আকাশের সঙ্গে বেরিয়েছে। রুবি বান্ধবীর বাড়িতে! অরু তন্ময়ের সাথে বেরিয়েছে। বাড়িতে আপাতত তিনি আর তার মেয়ে ছাড়া কেউ নেই। এটাই তো ভালো সুযোগ মেয়ের সাথে আলাপ করবার। তিনি বললেন, ‘খেয়ে নে। ধীরেসুস্থে বলি।’
‘এইতো খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে আসি!’

শাবিহা ওয়াশরুম ঢুকে হাত ধুয়ে ফিরেছে। একটা টিস্যু নিয়ে সেটায় হাত মুছতে নিয়ে জবেদা বেগমের সামনে বসলো, চেয়ার পেতে। হেসে বলল, ‘দেখি বলো কি বলার আছে তোমার!’

জবেদা বেগম আলাপের সুর তুলেছেন মেয়ের শৈশব কৈশোরের বিষয় নিয়ে।’একটুখানি ছিলি! মনে হয়, এইতো গতকাল ড্রয়িংরুম জুড়ে ছোটছোট পা ফেলে দৌড়েছিস! তন্ময় ধমক দিতেই কেঁদেকেটে আমার পিছুপিছু ঘুরে বেড়াতি আঁচল ধরে৷’ভাইয়া মেরেছে, ভাইয়া মেরেছে’ বলে গুনগুন করে চলতি। দেখ, সময় কতটা পরিবর্তন হয়ে যায়। সেই ছোট্ট মেয়েটা আমার কি সুন্দর ভাবে বড়ো হয়ে গিয়েছে। এখন তার বিয়ের সম্বন্ধ এসে চলেছে সমানে। নাকেমুখে দম ফেলার সময় নেই।’

শাবিহার ঠোঁটের স্মিত হাসি থমকে গেল। একসময় ঠোঁটের থমকে যাওয়া হাসি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। থমথমে অবস্থা মুখশ্রীর। মায়ের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জবেদা বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মা আমার এভাবে জেদ ধরে থাকেনা! তুই এখন আর ছোটো নেই। বিয়ের বয়স পেড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। তোর কথায় তোর বাবা এতগুলো বছর বিয়ের বিষয় এড়িয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবেশীদের কানাঘুঁষা, সমালোচনা তো চলছেই। আজকাল আত্নীয় স্বজন ও মুখের উপর কথা বলছে! এভাবে আর কতদিন?’

শাবিহা নিশ্চুপ হয়ে রইলো। তার বলার মতো কিছুই নেই। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা! কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা! পরিস্থিতি যে তার বোঝার বাইরে। দিশেহারা অবস্থায় উঠে দাঁড়ালো। মোবাইল বেজে চলেছে। অয়নের কল! শাবিহা ফোন সাইলেন্ট করে টেবিলে রেখে দিল। জবেদা বেগম পুনরায় বললেন, ‘ আশরাফুল ভাইয়ের কথা মনে আছে? তোর বাবার বন্ধু! ওইযে আমাদের পাশে বাড়ি থাকতো। বাড়ি বিক্রি করে সুইজারল্যান্ড শিফট হয়েছিলো না? তারা ফিরে এসেছে। তার ছেলে মুবিনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? তোরা দুজন একসঙ্গে খেলেছিস মনে নেই, বুঝি? তোর বাবা ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে। ভীষণ ভদ্র এবং সুশীল। শিক্ষিত, মার্জিত! সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। আশরাফুল ভাই প্রস্তাব দিতেই, তোর বাবা সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমারও ভালো লেগেছে। আগামী সপ্তাহে তোকে দেখতে আসবেন তারা। অবশ্য, তোকে তাদের দেখা। তবুও সামনাসামনি দেখে নিবে নাহয়। ছেলের সাথে একটু কথা বল, ভেবে দেখ তারপর! আমার মনে হয় তোর পছন্দ হবে!’

মেয়েকে ভাবনাচিন্তা করার সুযোগ দিয়ে, জবেদা বেগম প্লেট হাতে বেড়িয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় দরজা চাপিয়ে গেলেন। জমিনে স্তব্দ, বিমুঢ় দৃষ্টি রেখে শাবিহা দাঁড়িয়ে থাকলো। নড়ল না বেশ খানিক্ষন। পা জোড়া ধরে গিয়েছে, তবুও দাঁড়িয়ে।
মস্তিষ্কের মধ্যে জটিল জট বেধেছে। সবকিছু ঘোলাটে লাগছে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে শাবিহার। কি করবে সে?

ভারী পা জোড়া টেনে বিছানায় বসলো। মুখমণ্ডল দু’হাতের ভাঁজে গুঁজে ডুকরে উঠলো। সাধারণ একটা মেয়ে সে। বাবামায়ের, পরিবারের দুলালি। তেমন শক্তিশালী হৃদয় বা মস্তিষ্ক তার নেই। খুব অল্পতেই কষ্ট পায়, ভেঙে পড়ে। আজও একই অবস্থা!
_____________
ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে দশটা পঁয়তাল্লিশে। অরু তন্ময়ের পেছন পেছন গাড়িতে উঠে বসেছে। এখন তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোবে। রাত হয়েছে অনেক! মোস্তফা সাহেব বেশ কয়েকবার কল করেছেন। তন্ময় ঘন্টাখানেক আগে কল রিসিভ করে, আসছি বলে কেটে দিয়েছে। এখন অবদি আর একটি কল সে রিসিভ করেনি। সিটবেল্ট বেঁধে অরু গালে দু’হাত চেপে ধরলো। গাল গরম! শুধু গাল নয়, ঘাড় থেকে সম্পুর্ন মুখ গরম হয়ে আছে। এতটা ভয়ংকর লজ্জার সম্মুখীন যে হবে কে জানত?

মস্তিষ্ক সম্পুর্ন ফাঁকা হয়ে আছে অরুর। কি রেখে কি নিয়ে ভাববে দিশে পাচ্ছে না। মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন রয়েছে তার। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। সঙ্গে অভিমান করে বসেছে তন্ময় উপর। এতো লুকোচুরি কেন! সবকিছু অন্যদের থেকে কিংবা নিজ থেকে তাকে কেন বুঝে নিতে হবে!

তন্ময় আগেরকার মতো ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। অরু পিটপিট করে আঁড়চোখে তাকিয়েছে কয়েকবার। গলায় কথা আটকে আসছে। লজ্জা এবং সংকোচ এড়িয়ে কথা বলতে মুলত দ্বিধাবোধ করছে সে।

অরুর পাশের কাঁচ নামানো। ঠান্ডা বাতাস হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছে গাড়িতে। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের পশম গুলো পরম আবেশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। শীতে জুবুথুবু খেয়ে গেল মুহুর্তে। চোখ বন্ধ করে শীতে কেঁপে উঠলো। একটা শাল বা কার্টিগ্যান কিছুই আনেনি সঙ্গে। আসলে তার মনে ছিলো না। তাড়াহুড়ো এবং আবোলতাবোল চিন্তা মস্তিষ্কে নিয়ে সবকিছু ভুলে বসেছিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে উষ্ণতা ছিলো বিদায় শীত তেমন গায়ে লাগেনি। তবে এখন শীতল অনুভব করে জড়সড় হয়ে আসছে শরীর। একসময় মনোযোগ বাইরে দেওয়ার চেষ্টা করলো। গাছের পর গাছ পেছনে চলে গিয়েছে নিমিষেই। গাড়ির পর গাড়ি ফেলে এগিয়ে চলেছে তাদের গাড়ি।

নিস্তব্ধতা ভেঙে তন্ময়ের কন্ঠের স্বর শোনা গেল, ‘কাঁচ লাগিয়ে দে।’
‘থাক না।’

অরুর কথার অগ্রাহ্য করে, তন্ময় গাড়ি চালানোর ফাঁকে কাঁচ উঠিয়ে দিল। অরু সঙ্গে সঙ্গে মুখের খারাপ অবস্থা করে বসলো। ঠোঁট গাল ফুলিয়ে রাখল। ভুরু দু’য়ের পাশে সূক্ষ্ম ভাজ। তন্ময় দু’একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখল। এতটুকু বিষয় নিয়ে অরুর মুখ ফুলানোর কারণ খুঁজে পেল না। অবশেষে বিরক্ত সুরে বলল, ‘এমন ঠান্ডা বাতাস আসছে, তবুও তোর আক্কেল আসছেনা কেন!’

অরু থমথমে গলায় বলল,’আপনি চুপ থাকেন!’
‘আমার গাড়িতে আমি চুপ থাকব?’
‘তো? আমাকে বের করে দিবেন? হ্যাঁ? আপনার সাহস আছে! ভীতু একটা! আপনি তাজা গোস্তের কুমির, জানেন সেটা?’

অরু এই লোকটার উপর চরম বিরক্ত। বিরক্ত হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে আজ। চোখের সামনে সবকিছু পরিষ্কার তার। ঝকঝকে পকপকে পরিষ্কার। তার বুঝতে আর বাকি নেই কিছু! এতক্ষণ যাবত সব কথা মিলিয়েছে। তন্ময় তাকে খুব আগে থেকে পছন্দ করে। তাইতো ক্লাসমেট তন্নিকে রিজেক্ট করেছিলো। একটাও প্রেমের রেললাইন চড়েনি অরুর জন্য। ফিরবার সময় তাকে মাহিন খুব সাবলীল গলায় বলেছিল, ‘আমার বিশ্বস্ত বন্ধু তন্ময়। দেখে রেখ কিন্তু তাকে! উপরে একটু গম্ভীর তবে মনের দিকে তুলো একদম। অবশ্যই তুমি এগুলো জানো, তাও বলছি আরকি! জানো ত তোমাকে কতটা ভালো…’

কথাগুলো শেষ করতে পারেনি মাহিন। পূর্বেই রুবেল ডেকে উঠেছিলো। কিন্তু অরু স্পষ্ট বুঝেছে। সে তো বাচ্চা নয়। মাহিন নিশ্চয়ই বলতে নিয়েছিল, ‘তন্ময় তাকে ভালোবাসে?’

অরু পেছনে মাথাটা দুলিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো। সেই রাত্রের দৃশ্যটি চোখের পাতায় ভেসে উঠলো পুনরায়। মাতাল, দিশেহারা তন্ময় নিজের গাম্ভীর্যকে দূরে সরিয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে আত্নসমর্পণ করেছিল অরুর সামনে। জ্ঞান হারাবার পূর্বের কথাগুলো অরুর কানে এখনো স্পষ্ট। কমবেশি প্রতিদিন ভাবতে বসে আদৌও কী তন্ময়ের কথাগুলো সত্য ছিলো? আধার রাতে নিস্তব্ধ রুমে অরুর কানের কাছে অস্পষ্ট গম্ভীর স্বরে বলা, ‘ভালোবাসি’ এখনো সর্বাঙ্গ শরীর জুড়ে শিহরণ বইয়ে দিয়ে যায়। সেই অনুভূতি কাঁপিয়ে তুলে অরুকে। কতটা সাবলীলভাবে বলেছিল! অরুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। কষ্ট হয়েছে বলে ভুল হবে, একপ্রকার সে ভেবে নিয়েছে মাতাল হয়ে আবোলতাবোল বকেছিল লোকটা। কিন্তু আজ? মাহিনের কথাগুলো অরুর চোখের সামনের পর্দা উঠিয়ে দিয়েছে। স্পষ্ট দেখতে এবং বুঝতে পারছে সবকিছু। তন্ময় কেন এতো লুকোচুরি খেলছে তার সাথে?

‘কি হয়েছে?’
‘ব্রিজের উপর একটু থামাবেন গাড়ি?’

তন্ময় গম্ভীরমুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নাচক করলেও শেষপর্যন্ত গাড়ি থামিয়েছে। কয়েক জোড়া কপোত-কপোতীর দেখা মিলছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তারা স্নিগ্ধ শীতল বাতাসে ভিজতে ব্যস্ত। অরু একটি ফাঁকা যায়গায় দাঁড়ালো। রেলিঙ ঘেঁষে নিচে তাকাল৷ জলের স্রোত বয়ে চলেছে। সঙ্গে বইছে তুমুল বাতাস। চুল উড়ে মুখের সামনে চলে আসছে বারংবার। বিরক্তভাবে চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দিল। আনমনে বলল, ‘এখান থেকে পড়লে কী আমাকে বাঁচানো যাবেনা?’

তন্ময় বিরক্ত ভঙিতে অরুর হাত ধরতেই থমকে গেল। ঠান্ডায় শরীর বরফের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। ছোঁয়া দুষ্কর৷ তবুও মেয়েটার দুরন্তপনা ছুটে না। মহাবিরক্ত হলো সে। টেনে নিতে চাইল তবে অরু নড়ল না। সে ঘুরে দাঁড়ালো তন্ময়ের দিক। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চারিপাশে নজর বোলালো। কেউই আশেপাশে নেই। নির্জন এবং ফাঁকা রাস্তা। হুট করে দ্রুত পায়ে গিয়ে তন্ময়ের কোমর দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরলো। তার মাথা ঠেকেছে তন্ময়ের বুকে। ঠিক এভাবেই সে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে। ভালোলাগায় আবেশে চোখ ভিজে এলো। তন্ময়ের বুকে মাথা রাখতেই পৃথিবী শুন্য মনে হতে লাগলো। জীবনে আর কিছুই লাগবে না তন্ময় ছাড়া, এমন অনুভূতি হচ্ছে। শান্তিতে তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। পরপর অনুভব করলো তন্ময়ের হাত তার পিঠে। অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে যেন৷ অরু স্মিথ হাসলো। লজ্জার মাথা খেয়ে কী তন্ময়ের বুকে একটা চুমু খাবে?
__________
অয়ন একটা সিগারেট ধরে রেখেছে দু’আঙুলের ফাঁকে। কয়েকবার সিগারেট জ্বালাতে গিয়েও জ্বালায়নি। আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে পাশের ছাঁদে। শাবিহা কল ধরছে না। মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? এতো দ্রুত তো ঘুমায়না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে চারপাশে নজর বুলিয়ে আবারো কল করেছে। এইবার শাবিহা কল রিসিভ করল। অয়ন অশান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কল ধরছিলে না যে?’

শাবিহা নিজেকে সামলে নিয়েছে। তবে কিছুক্ষণ কান্না করেছে বিদায় মুখশ্রী লাল বর্নে ধারণ করেছে। গলার স্বর ভেজা এবং গম্ভীর, ‘ওয়াশরুম ছিলাম।’
‘কি হয়েছে? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন! দেখি ছাঁদে আসো ত!’
‘না এখন ঘুমাব। আসতে পারব না।’
‘কি হয়েছে শাবিহা? আমাকে কি বলা যায়না?’
‘কিছু হলেনা বলবো!’
‘আচ্ছা। একটুখানির জন্য ছাঁদে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।’

শাবিহাকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিল না। মুহুর্তে কল কেটে দিলো। ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করে চলেছে। শাবিহার কন্ঠের স্বর বড়োই চিন্তায় ফেলেছে অয়নকে। কান্না করেছিলো কী? নাহলে ওমন শোনাবে কেন! শাবিহাকে একবার সামনাসামনি দেখে না নিকে অয়ন অন্তরে শান্তি পাবেনা।

শাবিহা বেশ সময় নিয়ে এসেছে। একটা চাদর শরীরে পেঁচিয়ে রেখেছে। ছাঁদের লাইটস ওফ! আকাশের চাঁদে তার লাল মুখশ্রী দৃশ্যমান। অয়ন বাউন্ডারি পেড়িয়ে চলে এলো শাবিহার কাছে। বিচলিত ভঙ্গিতে শাবিহার মুখমণ্ডল দু’হাতে তুলে ধরলো চোখের সামনে। গালে আঙুল ঘষে বলে উঠলো, ‘কান্না করেছিলে কেন?’

শাবিহা থমথমে গলায় বলল,’এভাবেই।’
‘এভাবেই? এভাবেই কাঁদা যায় বুঝি? তাহলে আমিও কি একটু চেষ্টা করবো এভাবেই কাঁদার? কি বলো!’
‘তুমি কি বলবে বলো! নাহলে আমি যাচ্ছি।’

বলতে বলতে শাবিহা ঘুরে পা বাড়ালো চলে যাবার উদ্দেশ্যে। অয়ন পেছন থেকে শাবিহাকে জড়িয়ে ধরলো। একটি সুন্দর সুভাষ নাকে লাগছে। শাবিহার চুলের ঘ্রাণ অয়নের ভীষণ পছন্দের। শুকলেই মাতাল মাতাল লাগে নিজেকে। ডান হাতে চুলের ক্লিপ খুলে দিলো, শাবিহার অমতে। লম্বা, ঘন রেশমি চুলে মুখ ডুবিয়ে দিল। লম্বা বড়ো বড়ো কয়েকটি শ্বাস নিল। সেভাবেই অস্পষ্ট স্বরে বলল,
‘কি সমস্যা আমাকে না বললে আমি কিভাবে জানব হু?’
_____________
অরু ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তন্ময় যখন গান গেয়েছিল সেটার ভিডিও করতে দেখেছে ইব্রাহিমকে সে। তাই দ্রুত মেসেঞ্জারে ঢুকে ইব্রাহিমকে ম্যাসেজ করলো। বলল তখনকার করা ভিডিওটি সেন্ড করতে। ইব্রাহিম সময় নিয়ে পাঠিয়েছে। ভিডিও সেইভ করে ফেললো। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে প্লে করলো। লজ্জায় তখন ভালোমতো দেখতেই পারেনি। শুধু শুনেছে! এখন ভিডিওটা মনোযোগ দিয়ে দেখবে এবং শুনবে।

তন্ময়ের এই গম্ভীর স্বরে গাওয়া গান অরুর মস্তিষ্ক থেকে যাচ্ছেই না। এভাবে আর কখনো কি শুনতে পারবে? বাংলা গান শুনতে কেমন লাগবে এই স্বরে? ভাবতেই অরুর ভেতরে কম্পন শুরু হয়ে গেল৷

চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here