প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৫,৩৬

0
1712

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৫,৩৬

৩৫.
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।
বন্দরনগরী নামে পরিচিত এই শহরটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত।বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাহাড়, সমুদ্রে এবং উপত্যকায় ঘেরা চট্টগ্রাম শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও চিত্তাকর্ষক স্থানের জন্যও এ জেলা বিখ্যাত। দু হাজার সতেরো সালে শহরের জনসংখ্যা ছিল সাতাশি লক্ষের বেশি। ঢাকার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ শহর হচ্ছে চট্টগ্রাম। এখানে দেশের সর্ববৃহৎ বন্দর ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে কর্ণফুলী নদীর তীরে এই শহরটি অবস্থিত। মানবসভ্যতায় ঘেরা এই শহরের গুনের শেষ নেই। বলে কয়ে শেষ করা মুশকিল। পাহাড়ের চুড়া কিংবা গাছের মগডাল থেকে ধরে ব্রীজের সীমান্ত সবই চোখ ধাধানো সৌন্দর্যে ঘেরা। রাস্তাঘাট উন্নয়নের সীমানায় পৌঁছে এক অপরুপ দৃশ্য সৃষ্টি করেছে।

চট্টগ্রাম এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার সখ অরুর ক্লাস সেভেন থেকে। অনেকবারই আসতে চেয়েছে তবে তন্ময় মুখের উপর না করে দিয়েছে! যেহেতু তন্ময় না বলেছে তারমানে না! চাচ্চু, বড়ো মা কেউ তাকে আর রাজি করাতে পারেনি, অরুকে নিতে। এভাবে পরিবারের সঙ্গে যে ফ্যামিলি ট্যুরে যাবে, সেটাও সম্ভব হয়ে উঠেনি। সকলেই ব্যস্ত, ব্যস্ত এবং সর্বদাই ব্যস্ত। ছোটোখাটো ফ্যামিলি পিকনিক দু’বছরে একবার হয়ে থাকে। তাও অরু, দীপ্তর জোড়াজুড়িতে। সেখানে ফ্যামিলি ট্যুরে যাবার স্বপ্ন দেখাটা একপ্রকার বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতো।

তিন ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট গাড়ি চলেছে একটানে। তন্ময়ের সঙ্গে এতক্ষণ একা থাকা এই প্রথম অরুর। এবং সে হাড়েহাড়ে পস্তাচ্ছে। একটা মানুষ এতটা গম্ভীর কীভাবে হতে পারে? নিজ থেকে একটি কথাও বলছে না৷ অরু কথা বললে জবাব দিচ্ছে দু’এক শব্দে। চুপচাপ থাকার মেয়ে তো অরু নয়। সে জোরপূর্বক আজাইরা প্যাঁচাল পেড়ে যাচ্ছে। একসময় তন্ময় ধমকের সুরে চুপ থাকতে বলেছে। রেগে অরু এতক্ষণ যাবত চুপ রইলো। কিন্তু এখন আর পারছেনা। পেট গুলিয়ে আসছে কথার প্যাঁচ লেগে। ইনিয়েবিনিয়ে ডাকল, ‘তন্ময় ভাই! এইযে.. ‘

তন্ময় মাথা না ঘুরিয়ে গভীর স্বরে বলল,’হু!’
‘আর কতক্ষণ?’
‘দু’এক ঘন্টা।’
‘এখনো দু ঘন্টা। আমার কোমর ব্যথা করছে। একটু থামাবেন রেস্ট নেবার জন্য?’
‘না।’
‘একটু প্লিজ!’

তন্ময়ের জবাব এলো না। অরু হাত ঘড়িতে নজর দিল আটটা বেজে ত্রিশ। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। অগোচরে পেট চেপে ধরলো। ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে মনে হচ্ছে! লাঞ্চবক্স কি খুলবে? পাষাণ তন্ময় একটু জিজ্ঞেস ও করছে না। খিদে পেয়েছে নাকি, বোরিং লাগছে নাকি, খারাপ লাগছে নাকি! এতটা জার্নি একদফায় করিয়ে নিচ্ছে। মায়াদয়া কিছুই নেই লোকটাকে মধ্যে। হাত ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছে অরু। এগুলো তাকেই দিয়েছে শাবিহা। সেগুলোর মধ্যে যেটা হাতে উঠেছে সেটাই বের করল। চিপস। চিকন বোতলের মতো বয়ামের ঢাকনা খুলল৷ চিপস খসখস আওয়াজে খেতে লাগলো। আঁড়চোখে তন্ময়কে দেখল। মায়াবতী অরুর মন বিশাল বড়ো। সে একা খেতে দ্বিধাবোধ করছে। তাই বয়াম এগিয়ে ধরলো। তন্ময় তাকাল অবদি না। অন্ধকার মুখে নিজের চিপস নিজেই খেল। একপর্যায়ে অরুর আবারো মায়া জন্মাল। সে দু আঙুলে এটি চিপস নিয়ে তন্ময়ের মুখের সামনে ধরলো। একটু লজ্জা অবশ্য লাগছে। তাতে কী? এভাবেও তন্ময় কখনোই খাবেনা এভাবে। অরু তো তাকে বিরক্ত করার জন্যই এসব করছে। অরুকে আশ্চর্যের শেষে পৌঁছে তন্ময় চিপস খেয়ে নিল। নেবার সময় আঙুলে শক্ত একটা কামড় ও বসিয়েছে। স্তব্দ অরু আঙুল বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। চিনিচিন ব্যথায় তার রুহ চলে যাবার যোগাড়। অরুর কান্নার শব্দ যেমন তন্ময় শুনছে না। সে মুখের চিপসে দু’একটা কামড় মেরে গিলে ফেলেছে।

দেখা গেল তন্ময় গাড়ি মাঝপথে থামাতে রাজি হয়নি। আরও দু’ঘন্টা টানা জার্নি করে চট্টগ্রাম বর্ডার ক্রোস করেছে। ইতোমধ্যে তন্ময়ের ম্যানেজার কল করে জানিয়েছে সে চট্টগ্রাম পৌঁছে গিয়েছে। গতকাল হোটেল বুক করে রেখেছিল সে। গাড়ি থেমেছে লালবাজার রেডিসন ব্লু’তে। বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল। যার অবস্থান লালখান বাজার । এই রেডিসন ব্লু চিটাগং বে ভিউ নামেও পরিচিত। এটি চিটাগং বন্দর শহরের অন্যতম পাঁচ তারকা হোটেল। এবং বাংলাদেশের দ্বিতীয় পাঁচ তারকা হোটেল। সর্বমোট ৪.১৮ একর স্থানে এই হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ২১০০ বর্গ মিটারের একটি বলরুম রয়েছে যা অফিসিয়াল সভাসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি এতে একটি মেজবান হল রয়েছে। এতে ২৪১ টি কক্ষের পাশাপাশি ১৩টি জুনিয়র স্যুট ও ৪টি এক্সক্লুসিভ স্যুট রয়েছে। অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে,
সুইমিংপুল
ড্রিনক বার
রেস্তোরা’র সুবিধা বিদ্যমান। জনপ্রিয় এই হোটেল নামের দিকে বেশ বিখ্যাত।

গাড়ি পার্কিং করতেই ম্যানেজার সুমনকে দেখা গেল। তিনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। গাড়ির নাম্বার চিনেই ছুটে এলেন৷ তার পাশে একজন গার্ড। ইশারা করলেন ল্যাগেজ নিতে। গাড়ির ব্যাক খুলে ল্যাগেজ বের করে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। তন্ময় সময় নিয়ে বেরিয়েছে। পরপর অরুও বেরোলো। তার প্রিয় ল্যাগেজ গার্ডের হাতে দেখে ছুটে গেল। ছোট পুতুলের ল্যাগেজ টেনে নিজের হাতে রাখল। বাকি দুটো ল্যাগেজ নিয়ে দাঁড়ানো গম্ভীর গার্ড নড়েচড়ে সুমনের দিক তাকাল। সুমন মুচকি হেসে স্যুটের চাবি দেখাল। সেখানে ছোট অক্ষরে স্যুটের নাম্বার লেখা। সে অনুযায়ী গার্ড ল্যাগেজ হাতে চলে গেল। ম্যানেজার সুমন চাবি তন্ময়কে দিয়ে বলল,’স্যার মিটিং কাল সন্ধ্যা সাতটায় স্যাট করেছি। ইজ দ্যাট ওকে স্যার?’
‘গুড।’
‘তাহলে স্যার আমি কি চলে যাবো? নাকি খাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দিব!’
‘সমস্যা নেই। আপনি যান আই’ল হ্যান্ডেল।’
‘তাহলে আসি। আসি অরু মামনী!’

অরু হেসে মাথা দোলাল। খিদে’তে যে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে, তা সে কাউকে বুঝতে দিবেনা। অরু তন্ময়ের পেছনে পেছনে যাবে ভেবে রেখেছে। কিন্তু তাকে অবাক করে সে, সেদিনের মতো পুনরায় পিঠের পেছন হাত নিয়ে তার কাঁধ ধরেছে। এবং নিজের সাথে সমান তালে নিয়ে চলেছে। এ’তে তাদের পাশাপাশি হয়ে ঘনিষ্ঠ হতে হলো। অরু স্পষ্ট তন্ময়ের পারফিউমের ঘ্রাণ শুঁকতে পারছে। মাতাল করা ঘ্রাণ। পিঠে অনুভব করছে তন্ময়ের দানবীয় হাতের স্পর্শ। ছোট ল্যাগেজ টেনে অরু তন্ময়ের বড়ো পায়ের ধাপে পা মেলাতে পারছেনা। এতো দ্রুত হাটে কেন! এদিকে বিরক্ত হয়ে তন্ময় অরুর হাত থেকে টেনে ল্যাগেজ নিজে নিল। অরু সঙ্গে সঙ্গে মুখ অন্ধকার করে রাখল। এমন মুড দেখানোর কি আছে!

লিফট ব্যবহার করে তারা নিজেদের স্যুটে চলে এলো। গার্ড দাঁড়িয়ে ল্যাগেজ নিয়ে। তন্ময় চাবি দিয়ে স্যুট খুলে দিতেই ল্যাগেজ ভেতরে নেওয়া হলো। পকেট থেকে কিছু টাকা এগিয়ে দিল গার্ডকে। গার্ড টাকা নিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। পুনরায় ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো,’স্যার খাবারের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করব? ম্যামকে দেখে মনে হচ্ছে তিনিই বেশ ক্ষুদার্ত।’

অরু দ্রুত পেট থেকে হাত সরাল৷ হতচ্ছাড়া লোক! একদিক নজর যায় কেন! অরু পেট ধরলেই বুঝে নিবে ক্ষুদা পেয়েছে? আশ্চর্য! তন্ময় কিছুক্ষণ অরুকে দেখে নিল। হতাশ গলায় বলল,’কল সার্ভিস আছে না? কল করে অর্ডার করে নিব।’
‘জি স্যার।’

গার্ড যেতেই দরজা লাগাল তন্ময়। অরু ঘুরেফিরে স্যুটের ভেতর দেখছে। বড়ো একটা ফ্ল্যাট বলা যায়। পরিপাটি করে রাখা। সবই রয়েছে চারিপাশে। রান্নাঘর দেওয়া। তারমানে নিজ থেকে রান্নাবান্না করার সুযোগ সুবিধা রয়েছে৷ দুটো মাস্টার বেডরুম আছে। ড্রয়িংরুম রয়েছে। টিভি স্যাট করা প্রত্যেকটা বেডরুমে। সাথে অ্যাটাচড বাথরুম তো আছেই। অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল। তন্ময় হাত ঘড়ি খুলছে। যতটুকু তার মনে আছে! বড়ো চাচ্চু পইপই করে বলেছে দুটো রুম নিতে। এসে দেখছে স্যুট। বড়ো স্যুট। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, অন্যদিকে খারাপ। ভালো এরজন্য যে অরু একা-একা ভীষন ভয় পায়৷ খারাপ কারণ তার এখনই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে! মগজে পরিষ্কার গলায় জানান দিচ্ছে, তন্ময় আর সে একই ফ্ল্যাটে আছে। এবং সম্পুর্ন একা। কেউ নেই তাদের মধ্যে। বিষয়টি ভাবতেই তার রক্ত চলাচল বন্ধ হবার যোগাড়। সেদিকে যেমন তন্ময়ের ধ্যান নেই। সে নিজের ল্যাগেজ টেনে একটা বেডরুমে ঢুকে গেল। অরু ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে। পাশের বেডরুমে সে চলে যাবে নাকি? অরু নিজের ছোট ল্যাগেজ টেনে পাশের রুমে ঢুকলো। দরজা লাগিয়ে বড়ো শ্বাস নিল। জামাকাপড় খুলে ওয়াশরুম ছুটলো। শরীর ক্লান্ত৷ একটা গোসল নিলে ভালো লাগবে। গোসল শেষ করে সেলফোন হাতে নিল। পরিবারের অনেকে কল করেছে। অথচ সে দেখেনি। সেলফোন সাইলেন্ট হলো কীভাবে? নাম্বার চেক করতে গিয়ে একটি আননোন নাম্বারে কল পেল৷ ধরলো না। ফোন পুনরায় সাইলেন্ট করে রুমের দরজা খুলে মাথা বের করলো। তন্ময় ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে। উদোম শরীর। শুধু একটা প্যান্ট লুজ করে পরে আছে। গলায় তাওয়াল ঝুলানো। একহাতে চুল মুছতে ব্যস্ত। দ্বিতীয় হাতে কথা বলছে। কথা শুনে বোঝা গেল রাতের খাবার অর্ডার করছে। অরু ফটফট চোখে চেয়ে রইলো। তন্ময়ের পিঠ বেয়ে জল গড়িয়ে প্যান্ট ভেদে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। ফর্সা, পেশিবহুল পিঠ। চওড়া এবং দীর্ঘ কাঁধ। অরু চোখ ফেরাতে পারছেনা। তন্ময় ঘুরতেই চোখাচোখি হলো। অরুর বুক কেঁপে উঠলো। দ্রুত দরজা লাগিয়ে ফেললো। এভাবে কাঁপছে কেন বুক? হার্টএট্যাক করে বসবে নাকি?

অরু ভয়ে আর বেরোলো না। ঘন্টা খানেক বাদ তন্ময়ের আওয়াজ শোনা গেল। অরুকে ডাকছে। পেট চেপে ধরে থাকা অরু দ্রুত বেরোলো। নিশ্চয়ই খাবার এসেছে? ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখা। তন্ময় দাঁড়িয়ে। ফোনে কথা বলছে। কথার ভঙ্গিমায় বুঝতে পারলো, তন্ময় বড়ো চাচ্চুর সঙ্গে কথা বলছে! গম্ভীর তার স্বর। চুপচাপ গিয়ে চেয়ার টেনে বসল অরু। প্লেট টেনে দেখল তার পছন্দের খাবার। ঘ্রাণে পেট ফুলে উঠল তৎক্ষণাৎ। কিছুটা খাবার চামিচে নিয়ে মুখে দিল৷ তখন এক অদ্ভুত বাক্য সে তন্ময়ের মুখ থেকে শুনল, ‘আমি হানিমুনে আসিনি। কাজে এসেছি। এভাবে প্রেসারাইজড করলে ওকে ছুঁড়ে ঢাকা পাঠিয়ে দিব।’
অরু বিষম খেল। গলায় খাবার নিয়ে কেশে উঠল। এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তন্ময় তখন কল কেটে অপর পাশের চেয়ার টেনে বসেছে। চুপচাপ নিজের মতো খেতে শুরু করেছে। অরু আঁড়চোখে কয়েকবার তাকাল। জিজ্ঞেস কি করবে কার সাথে কথা বলছিল? কি নিয়ে বলছিল! খাওয়ার একফাঁকে ইনিয়েবিনিয়ে শুধালো, ‘আপনি সকালে কই যাবেন?’
‘জবাবদিহি করতে হবে তোর কাছে!’
‘তা নয়। মানে… ‘

অরু হাসফাস করল কিছুক্ষণ। সময় নিয়ে বলল,’এমনেই।’

নিস্তব্ধতা চারপাশে। অরু একটুপর আবারো কথা তুলল,’এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে তাই না?’

তন্ময়ের জবাব নেই। অরু মুখ বাঁকাল। লোকটা কী পাথর! নাকি গরু। সে কি বুঝতে পারছেনা অরু কি বলতে চাইছে? এতো বুদ্ধিমান লোক এতটুকু ইঙ্গিত বুঝতে পারছেনা। অদ্ভুত!

পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি বলে কথা আছে। কথাটি যে সত্য আজ তা আবারো প্রমানিত। পেট ভরে খেয়ে অরু আরাম করে চেয়ারে বসে থাকল। তন্ময় ইতোমধ্যে নিজের রুমে চলে গেছে। তন্ময়ের রুম কেমন? দেখার বেশ কৌতুহল জাগল অরুর মনে। সে গুটিগুটি পায়ের দরজার সামনে এলো। দরজা আধখোলা। উঁকি দিল। তন্ময় শার্ট খুলছে। আচমকা অরু শুনতে পেল তন্ময়ের গলা,’কি এখানে ঘুমাবি?’

আতঙ্কে অরু ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। আরেকটু হলে তো সে মরেই যেতো। মাথা না ঘুরিয়ে কীভাবে দেখল দরজায় অরু? মানুষটা কী চার চোখের অধিকারী? মাথার পেছনে লুকানো চোখ আছে নাকি?

চলবে ~
‘Nabila Ishq’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩৬.
ঘড়ির কাঁটা বারোটায়৷ নিরিবিলি ঘরে একা থেকে অরুর মস্তিষ্ক সম্পুর্ন জ্যাম। সে পাশের রুমে তন্ময়কে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেনা। এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলেছে দেহে। দুরুদুরু কাঁপতে থাকা বুকের গতিও নিয়ন্ত্রণে নেই। আজকের অনুভূতি একটু বেশি প্রগাঢ় কী? তন্ময় পাশের রুমে বুঝি তাই? কই তাদের বাড়িতেও তন্ময় আর তার রুম পাশাপাশি। তাহলে? ব্যস্ত পায়ে অরু নিজের ল্যাগেজ খুলল। তার একটি বেশ পারসোনাল ডায়রি আছে। খুব যত্নে সে তা লুকিয়ে রাখে৷ নিজেই খুব একটা ধরে না বা অযথা গুপ্তস্থান থেকে বের করেনা৷ যখন ইচ্ছে হয়, মনের কিছু অনুভূতি লেখা দরকার ঠিক তখনই বের করে। কিন্তু ভুলেও আগের লেখাগুলো’তে চোখ বুলোতে যায়না। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। ক্লাস সেভেন থেকে সে এই ডায়েরি লিখছে। এবং উঠতি বয়সে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা সে ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। আবেগে কীসব উদ্ভট অনুভূতি লিখেছে তা বুঝদার হয়ে পড়ার ইচ্ছে অথবা অবস্থা একদম অবশিষ্ট নেই তার মাঝে৷ এমন নয় যে সে অনেক বুঝদার বা বড়ো হয়ে গিয়েছে। তবে তখনকার থেকে এখন ভালোই আছে। অরু আজকাল ভাবছে ডায়েরি খানা পুড়িয়ে ফেলবে। এই ডায়েরি কারো হাতে গেলে মানইজ্জত আর থাকবে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে বাড়ির ইয়াং জেনারেশনে হাতে, একদম যাওয়া যাবেনা। হট্টগোল পড়ে যাবে। অরু মনে ভয় নিয়েও ডায়েরিতে পুনরায় লিখতে বসলো। এবং তাকে নিয়েই লিখল যাকে নিয়ে সচরাচর সে লিখে থাকে। তার তন্ময় ভাই!

এতরাতে সেলফোন বেজে উঠবে প্রত্যাশা করেনি অরু। স্ক্রিনে মারজির নাম ভেসে উঠেছে। মেয়েটা এতরাত করে কল করলো হঠাৎ? অরু ডায়েরি রেখে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার কোণে বসে কল রিসিভ করল৷ ওপাশ হতে মারজির দুষ্টু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। থেমে থেমে মৃদু স্বরে হাসছে। হাসির শব্দ এতটাই মধুর যে অরুর ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। তবুও ধমকের সুরে শুধালো, ‘কী?’
‘হানিমুন।’
‘কী!’
‘দোস্ত একটা গল্প ভেবেছি। গল্পের নাম হানিমুন। প্লট একদমই টপ নচ। তোকে শোনাবো। দেখি, শুনে বলত এই প্লটে একটা হাই বাজাট্যার মুভি করা যাবে কিনা!’

অরুর ভুরু দু’য়ের মাঝ সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। চিন্তিত সুরে বলল,’সবই ঠিক আছে। কিন্তু হানিমুন নামটা এডাল্ট হয়ে গেল না?’
‘হোক এডাল্ট। তারা যদি এডাল্ট কাজ করতে পারে, আমাদের বলতে সমস্যা কোথায়।’

অরু স্পিচল্যাস বনে গেল। চুপচাপ শুনতে চেষ্টা করলো মারজির হানিমুন গল্প।’গল্পের নায়কের নাম সুলতান। নায়িকার নাম সুলতানা।’

এতটুকু বলতেই মারজিকে থামিয়ে অরু বলল,’নাম দুটোর মধ্যে এতো মিল কেন! ভাইবোন মনে হচ্ছে!’
‘ভাইবোনই তো। তারা চাচাতো ভাইবোন বুঝলি? এখন আমাকে আর রুখবি না। শেষ করতে দে গল্পটা। পরপর লম্বা একটা ঘুম দিব।’
‘আচ্ছা।’
‘তাদের দুজন সম্পুর্ন ভিন্ন দুটো মানুষ। বিবরণ দিতে গেলে বলা যায়, সুলতান হচ্ছে খাবার। আর সুলতানা হচ্ছে মাছি। খাবারে মাছি ভনভন করে তাই না? তেমনি সুলতানের চারিপাশে সুলতানা ভনভন করে৷ একদিন ঘোষণা শোনা গেল, সুলতানকে নির্বাসনে যেতে হবে৷ সুলতানা কিভাবে থাকবে একা? সেও ছুটে গেল সঙ্গে। আশ্চর্যজনক ভাবে নির্বাসনে গিয়ে নির্বাচন করে ফেললো তারা। মানে দুজনের হানিমুন হয়ে গেল। দুজন গেল ফিরে এলো চারজন হয়ে। এটাই কাহিনী! বল কেমন লাগলো? আরে ব্যাটা নারী আর পুরুষ হলো চুম্বক। নির্বাচন না হলে আমি ভাবতাম সুলতানের মধ্যে গন্ডগোল আছে বুঝলি।’

অরুর নাক ফুসছে। তার আর বুঝতে বাকি নেই কিছু! দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে গেল। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,’মারজি তোর মতো অসভ্য মেয়ে আমি আর দুটো দেখিনি! জাহিল। খবরদার আমাকে কল দিবিনা। ফাজিল। ইনহিউম্যান!’

রাগে থরথর করে কেঁপে অরু কল কেটে দিল। এর পূর্বে সে মারজির সয়তানি হাসির ঝংকার শুনতে পেয়েছে। সঙ্গে ফোন সুইচড ওফ ও করল। এই মেয়েটা কতটা বাজে! কীসব চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে রেখেছে! এরজন্যই তো আন্ডা পায় পরিক্ষায়। পড়াশোনা রেখে এসব ভাবলে কি গোল্ডেন পাবে? রাগ কমে যেতেই অরুর গাল দুটো জ্বলে ওঠে। মুখশ্রী থেকে গরম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। লজ্জায় হতভম্ব সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো।
__________
হুশিয়ার সাহেবের কল এসেছে। মোস্তফা সাহেব চিন্তিত চেহারায় কল রিসিভ করেছেন। এবং অপর পাশ থেকে যা শুনলেন, তা বিশ্বাস করার মতো নয়। তৎক্ষণাৎ চুপসে গেলেন। হাতটা সামান্য কেঁপে উঠলো। হুশিয়ার সাহেব কল কেটে দিয়েছেন খানিকক্ষণ হয়েছে। মোস্তফা সাহেব তখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে। জবেদা বেগম চিন্তিত সুরে বললেন, ‘কি হলো?’

মোস্তফা সাহেব জবাব দিতে পারছেন না। তিনি ঠিক কিভাবে বলবেন বুঝতে পারছেন না। তবে বলতে তো হবে৷ এভাবে চুপ করে থাকলে তো চলবে না৷ স্ত্রীর দিক চাহনি নিবদ্ধ করে বললেন,’কলি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে।’

জবেদা বেগমের হাতে কাঁচের গ্লাস ছিল। সেটা শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। ভেঙেচুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। সেই শব্দে ড্রয়িংরুমে অনেকে ছুটে এসেছে। এমনকি শাবিহা! সে কথা বলছিল অয়নের সাথে।কি ঘটেছে শুনে স্তব্ধ খেয়ে বসলো। দেখতে পেলো জবেদা বেগম হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে চলে গেলেন। এখনই সিলেটের উদ্দেশ্যে বেরোবেন হয়তো। মোস্তফা সাহেবও ছুটেছেন। শাবিহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে এলো। অয়ন তখনো সমানে কল দিয়ে চলেছে। হঠাৎ কল কেটেছে তাই হয়তো চিন্তা করছে। সে প্রথমে তাকে কল ব্যকা করে বলল, ‘পড়ে কল করছি।’
‘কিছু হয়েছে?’
‘হ্যাঁ! ফ্যামিলি প্রব্লেম।’
‘আচ্ছা। সমস্যা হলে আমাকে জানাও।’
‘হু।’

কল কেটে সে বারান্দায় চলে এলো। এখন তার তন্ময়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু তন্ময়ের ফোন বন্ধ। সুইচডওফ বলছে। অরুর ফোন ও সুইচড ওফ। এই দুই ব্যক্তি ফোন সুইচড ওফ করে কোন ক্ষেতে কাজ করছে? বিরক্তে শাবিহার মাথাটা ধরে এলো।
_____________
শীতকালে বৃষ্টি সচরাচর হয়না। তবে প্রকৃতির হিসেব আলাদা। এই প্রকৃতি সবসময় ক্যালেন্ডার ফলো করে থাকেনা। যেমন হুট করেই আকাশের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দ্রিম দ্রিম বজ্রপাতের শব্দ ভেসে আসছে। অরু দু একবার কেঁপে উঠেছে। ছোট থেকে একা থাকা তার অভ্যাস। এমন বজ্রপাতের শব্দে কখনো ভয় পায়নি। তবে আজ ভিন্ন। এটা তার নিজের বাড়ি নয়। আর সাথে তার পরিবার নেই। মনের মধ্যে খচখচ করছে। এমন সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে কেমন হয়? বেশ বাজে! এমন সেটাই ঘটেছে। প্রখর শব্দে বজ্রপাত হলো এবং সঙ্গে হুট করেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। চোখ ধোঁয়াশা অন্ধকার। মৃদু স্বরে চিৎকার করেছে অরু। সেলফোন খোঁজার চেষ্টা করলো। পেলো না। পরপর অনুমান করে অন্ধকারে ছুটে গেল দরজার দিক। দরজা খুলে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, ‘তন্ময় ভাই!’

তন্ময়ের জবাব সঙ্গে সঙ্গে এলো,’হু। এইযে আমি।’

যেমন সে অরুর সামনেই। অরু হাতড়ে কিছুটা এগোতেই তন্ময়কে ছুঁতে পেল। যা হাতের সামনে এসেছে ধরলো। এবং সেটা তন্ময়ের প্রসস্থ বুক। তন্ময় পুনরায় বলল, ‘হোটেল থেকে কল এসেছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে উপরের সেকশনে বজ্রপাতের কারণে। চলে আসবে ইলেকট্রিসিটি কিছুক্ষণের মধ্যে। ভয় লাগছে?’
‘না এখন লাগছে না।’

বলেই অরু চুপ মেরে গেল। খুব লজ্জা লাগছে তার। তন্ময়কে ছেড়ে দিল। ছেড়ে আবার ভয়ও পেতে লাগলো। দেখা যাচ্ছে না। ভয় তো পাবেই। আবছা যে দেখবে তারও উপায় নেই। অরু ধীর স্বরে বলল, ‘লাইট জ্বালান।’
‘সেলফোন কোথায় যেন রেখেছি। দাঁড়া খুঁজে আসি।’
‘না। আমি সাথে যাই চলুন।’

অরু এগোতে চাইল। তবে উপলব্ধি করলো তন্ময় একইভাবে দাঁড়িয়ে। নড়ছে না। কেন? অরুও দাঁড়িয়ে রইলো কাঠকাঠ হয়ে। সে ভয় পাচ্ছে নাকি নার্ভাস ঠিক বুঝতে পারছেনা। কিন্তু কিছু একটা অদ্ভুত অনুভব করছে। খুব অদ্ভুত। উত্তেজনা, ভালোলাগা, ভয়, নার্ভাসনেস সব মিলিয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছে। অরু আনমনে তন্ময় থেকে সরে গেল। খুব করে সরে দাঁড়ালো। অন্ধকারের ভয় কেন যেনো হুট করে চলে গেল। এখন অন্য এক ভয় মাথায় চেপেছে। বুকের উঠানামার গতি বেড়েছে। সাথে শ্বাসপ্রশ্বাদের নিয়ম। নিস্তব্ধতা চারপাশে। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতায় অরুর শ্বাসপ্রশ্বাস নর্মাল হতে লাগলো। এমন সময় সে নিজের সামনে আরেকটি দেহের উপস্থিতি অনুভব করলো। দেহের সাথে দেহের সংঘর্ষ হতেই, অরু মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘তন্ময় ভাই?’

যেমন এই অন্ধকারে সে শিয়র নয়, এটা তন্ময় কিনা। সময় নিয়ে জবাব এলো, ‘তন্ময়।’
খানিক কেঁপে উঠলো অরু। ভীতিকর কদমে পেছনে চলে এলো কয়েক পা। এই গলার স্বর সে চিনতেই পারছে না। একটা মানুষের গলার স্বর কতটা পরিবর্তন হলে, এমনটা হয়? তার সামনে এক ভিন্ন তন্ময় যেমন। তবে অচেনা নয়। সে এই তন্ময়কে দুবার দেখেছে। সেবার তার রুমে মাতাল অবস্থায়। দ্বিতীয় বার ছাঁদে। সে হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছে কিছু একটা অঘটন ঘটবে ইলেকট্রিসিটি এখনই না আসলে। পিছুপা হয়ে এক মিনিটের স্বস্তি পেয়েছে অরু। তবে এরপর সেই দেহের সংঘর্ষ পুনরায় অনুভব করলো। এবার ঘনিষ্ঠ ভাবে। প্রখর ভাবে। অরু চেঁচিয়ে তন্ময়কে ডাকতে চাইল। কিন্তু পারলো না। কোমরে শক্ত ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো৷ গলায় দাঁড়ির খোঁচা খেল৷ চুলে টান অনুভব করলো। কানে ঠোঁটের স্পর্শ। অরু নড়েচড়ে উঠলো। তন্ময়কে সরাতে তার বুকে দু’হাত রাখল। তীব্র ভবে অনুভব করতে পেলো তন্ময়ের বুকের উঠানামার গতি। গলা শুকিয়ে গেল অরুর। তন্ময়ের নেওয়া ঘনঘন নিশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছে। পরপর সেখানে নরম ঠোঁটের বিচরণ। অরু মরতে থাকা প্রানীর মতো হাসফাস করতে শুরু করলো। এক অদ্ভুত টান মস্তিষ্ক খালি করে দিয়ে গিয়েছে। বুঝতে চাইছে না আর কোনোকিছু। পুরো পৃথিবী অচেনা এবং অজানা হয়ে গেল৷ সামনে শুধু তন্ময়কে অনুভব করতে পারছে। এমন সে মনের এক কোণায় চাচ্ছে, এই অনুভূতি শেষ না হোক। অরুর কম্পিত হাত তন্ময়ের পেছনে চলে গেল। খুব কাঁপছে তার হাত৷ তাদের এই ঘনিষ্ঠতা ঠিক কতটা মাদকতায় ফেলেছে তাকে তা ভাষায় প্রকাশ্য নয়। তন্ময়ের রুমের দরজা খোলা। বারন্দা থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে বৃষ্টির শব্দ। ঠান্ডা হাওয়া। এই আবহাওয়া যেনো আগুনে কেরাসিন ঢেলে দিয়েছে এমন। উত্তপ্ত তন্ময়ের স্পর্শ গাঢ়তর হয়ে গিয়েছে। অরুর কোমরে ঠোঁট নিতেও সময় লাগলো না তার। তার একেকটি স্পর্শ অধীর আকাঙ্খার, আদূরে। কথায় আছে অনুভূতির রাজ্যে হারালে পুরুষ মানুষের আকুতির দেখা মেলে। ভুল নয়। এইযে অরু যখন চোখজোড়া ঠাটিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। ছটফট করে কয়েকবার অনুভূতি থেকে দূরে যাবার চেষ্টা করছে, সে’সময় অস্পষ্ট গভীর স্বরে তন্ময় বলল, ‘নড়ে না জান! প্লিজ!’
থমকানো, বিমুঢ় অরু মুর্তি বনে গেল।

বিশ মিনিট সময় নিয়েছে ইলেকট্রিসিটি আসতে। যখন এসেছে ঘটনা অনেকটাই হাতের বাইরে। তন্ময় হুট করে থেমে গেল। যেমন ইলেকট্রিসিটির সাথে তার মস্তিষ্ক ফিরে এসেছে। সম্পুর্ন শরীর থমকে গেল তার। ভেজা নয়নে চোখ বন্ধ করে থাকা অরুকে দেখে, সে আরও তাজ্জব বনে গেল। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে আওড়াল, ‘শিট, শিট। শিট!”
পরপর হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে গেল। মেঝেতে পড়ে থাকা শার্ট তুলে দৌড়ে ছুটে গেল নিজের রুমে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অরু তখন উঠে বসলো। চোখজোড়া লাল তার। তন্ময়ের দরজায় তাকিয়ে রইলো। এখনো শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ। সময় নিয়ে নিজেও নিজের রুমে চলে এলো। ঠিক কতটা লজ্জায় পড়েছে তা বলার মতো নয়। তার এখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
_________
সকাল সকাল অরুর দরজায় করাঘাতের শব্দ। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে অরু উঠে বসলো। মাথা বিপুল পরিমাণে ব্যথা করছে। খুব চোখে লাগছে রুমের আলো। সে কিছুক্ষণ মাথা ধরে বসে রইলো। অগ্রাহ্য করল দরজার করাঘাত। ধীরে ধীরে গতকাল রাতের সবকিছু পরিষ্কার ভাবে, মাথায় স্যাট হলো। মুখ থুবড়ে পড়লো বিছানায়। অস্পষ্ট মৃদু স্বরে চিৎকার করলো। এই মুখ সে কীভাবে দেখাবে? ঠিক কিভাবে? দরজায় আবারো করাঘাত। এবার তন্ময়ের গলার স্বর ও ভেসে এলো, ‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়৷ ফাস্ট!’

অরু মুখ অন্ধকার করে বসলো। মানুষটার মধ্যে লাজলজ্জা নেই নাকি? এমন একটা ঘটনার পর এমন বুক ফুলিয়ে কিভাবে কথা বলতে আসে?

অরু ফ্রেশ হয়ে বিড়াল ছানার মতো বেরিয়েছে ঘন্টা লাগিয়ে। মাথা এতটাই নত যে মুখ দেখা দ্বায় হয়ে পড়েছে। খেয়াল করলো তন্ময়ের সাথে ম্যানেজার সুমন উপস্থিত। দুজন কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। কোথাও যাবে হয়তো। অরু পিছুপিছু মাথা নত করে গেল। পার্কিং লটে গাড়ির সামনে এসেও মাথা নত করে রেখেছে। গাড়িতে উঠে পেছনে বসেছে। মাথাটা ঘুরিয়ে রেখেছে। লজ্জায় হতভম্ব সে এখন তন্ময়ের দিক তাকাতেও পারছেনা। সুমন সাহেব তন্ময়ের সাথে বসে। তিনি ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,’স্যার আর ইউ শিয়র? মানে এটা সাধারণ বিষয় নয়। একা এভাবে.. ঠিক হচ্ছে কী!’

তন্ময়ের জবাব এলো না। অরু ভালোভাবে শুনতেও পেলো না কিছু। সে তখনও নিজের দুনিয়া নিয়ে বড়োই ব্যস্ত। গাড়ি থেমেছে আধঘন্টা পর। তন্ময় বেরোতেই অরু বেরোলো। ছোটছোট পায়ে সামনে অগ্রসর হতে গিয়ে চারপাশে নজর বোলালো। অফিস? বিল্ডিং? এটা কোথায়? অরু কিছুই বুঝতে পারলো না৷ অজানা সে তন্ময়ের ইশারায় চলল। একটি অফিস রুমের মতো। চেয়ারে টুপি পরে একজন বয়স্ক চাচা বসে। দাঁড়িগোফ সাদ ধবধবে। পাশে দু একজন অজানা মানুষও দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে ফুলের মালা এবং আরও হাবিজাবি কতকিছু। কথাবার্তায় বুঝা গেল লোকগুলো সুমন সাহেবের ভাইপো। তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো। কথাবার্তা সেড়ে তন্ময় চেয়ারে গিয়ে বসলো। অরুকে বসতে ইশারা করলো। চেয়ারে বসে অরুর নেমপ্লেটে চোখ গেল। যা টেবিলের কোণায়। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘কাজি অফিস।’

থমকে গেল অরু। বিষ্ময় নিয়ে পাশে তাকাল। তন্ময়ের হেলদোল নেই। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘যা করতে বলা হবে, কর।’

অরুর কোনোকিছু বিশ্বাস হলোনা। সে পাথরের মতো বসে রইলো। লজ্জাসংকোচ ভুলে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো তন্ময়ের দিক।
_______
মালা পরিহিত অরু গাড়িতে বসে। স্তব্ধ তার চাহনি। তন্ময় স্টেরিংয়ে মাথা দিয়ে রেখেছে। লাগাতার ফোন বাজছে। রিসিভ করছে না। একসময় রিসিভ করলো। শাবিহার কল। রিসিভ করতেই, শাবিহা বলে উঠলো, ‘ভাই বিয়েটা কি করে ফেলেছিস? তোকে বলেছি এবং আবারও বলছি। অরুকে এখনই বিয়েটা করে ফেল৷ যা অবস্থা বাড়ির, মনে হচ্ছে জোরজবরদস্তি কিংবা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে হলেও তোর গলায় কলিকে ঝুলিয়ে দিবে। এই মেয়ে তোর জন্য সুইসাইড এটেম্পট করেছে। বুঝতে পারছিস নানা, নানী কিংবা মা কি চাইবে তোর থেকে?’

অরুর আজ বিষ্ময়ের দিন। সে শুধু ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুনে গেল শাবিহার কথাগুলো। কতকিছু হয়ে গেল সে কিছুই জানেনা। ক্লান্ত অরু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ফেলল। মানসিক ক্লান্তি সবচেয়ে ভয়ানক ক্লান্তি!

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক!’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here