প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৭,৩৮

0
1500

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৩৭,৩৮

৩৭.
বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন। আবার বলা যায় বৈধ চুক্তি! যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। শুধু দাম্পত্য সম্পর্ক নয় সাথে দুটো পরিবারের বিশেষ সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। বিয়ে নিয়ে পরিবারের থাকে হাজারো স্বপ্ন, সখ, আহ্লাদ, ইচ্ছে। ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়েতে বাবামা, আত্নীয় স্বজন অনেকেই অনেক কিছু করার স্বপ্ন বুনে থাকেন। তাই অবশ্যই বিয়েটা একান্ত ভাবে সেড়ে ফেলার মতো বিষয় নয়। শাহজাহান পরিবারের মতো সুনামধন্য পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য তো অবশ্যই নয়। তাদের জন্য কাজি অফিসে একান্ত গিয়ে বিয়ে করা আর গলায় ছু*রি তাঁক করা একই বিষয়। ব্যাপারটা সুমন সাহেব বড্ড ভালোভাবে বুঝে গিয়েছেন। এবং বেশ এলোমেলো হয়ে পড়েছেন। প্রেসার বেড়ে গিয়েছে তার। হাসফাস করছে বুক। তন্ময়ের পারমিশন পেয়ে গোসল ও করে নিয়েছে। তবুও দম বন্ধ হয়ে আসা অনুভূতি থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। চিন্তিয় তিনি যেকোনো সময় হার্টএট্যাক করে ফেলতে পারেন। কী জবাব দিবেন সে মোস্তফা সাহেবকে?সেই তো গার্ডিয়ানের সাক্ষর দিয়েছে। সবকিছু স্ব-চোক্ষে হতে দেখেছে। সবকিছুই সে করেছে নিজ দু’হাতে। এগুলো নিশ্চয়ই মোস্তফা সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে! নাহলে এমন পাগলের মতো কলের উপর কল কেন করবেন! এইযে দুইশো ছাপ্পান্ন কল ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। কলের নাম্বার দেখেই গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ তার। কপালে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন শব্দ করে। স্বেচ্ছায় এই কি জ্বালা কাঁধে নিলেন। চাকরি তো যাবে সাথে প্রাণ খানাও। অসহায় দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিক তাকালেন। তন্ময় লাঞ্চ করছে ডাইনিংয়ে বসে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে এতবড় তান্ডব করেছে। ছেলেটা কী বুঝতে পারছে সে কী করেছে? কতটা ভয়ানক কাজ করেছে? এদিকে সুমন সাহেব স্পষ্ট পাশের রুম থেকে অরুর অস্পষ্ট কান্নার শব্দ শুনতে পারছেন। মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে! সেই সকাল থেকে অনবরত কেঁদে চলেছে। পানি পর্যন্ত গলায় দেয়নি। হুট করে কি হয়ে গেল! কোথাকার জল কোথায় এসে গড়ালো। তিনি অসহায় সুরে তন্ময়ের উদ্দেশ্যে বললেন,’স্যার মামণী না মানে..মেয়েটাকে.. মানে ম্যামকে থামাবেন না? সকাল থেকে কিছুই খায়নি! অনবরত কাঁদছে।’
‘সুমন সাহেব!’
‘জি স্যার!’
‘আমার মনে হয় আপনার নিজেকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত।’
‘স্যার আমার চাকরি কী থাকবে?’

তন্ময় টিস্যুতে হাত মুছতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সাবলীল গলায় বলল,’আমার থাকলে আপনার ও থাকবে।’

সুমন সাহেব অন্ধকার মুখে মিনমিন সুরে আওড়ালেন,’আমার চাকরি আর প্রাণ দুটোই গেল বলে!’
‘এক্ষুনি বেরোতে হবে। সঙ্গে আসছেন তো?’

সুমন সাহেব মাথা দোলাল। না যেয়ে উপায় আছে বুঝি? ঝামেলা তো তাকে ঘিরে। সে না গেলে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। সুমন সাহেব নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন আপাতত। কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু সাহস নেই মোস্তফা সাহেবের সামনাসামনি হবার।
তন্ময় অরুর রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকবার করাঘাত করেছে। কষাঘাতের শব্দে অরুর কান্না থেমেছে। তবে সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তন্ময় পুনরায় করাঘাত করল। গম্ভীর স্বরে
বলল, ‘ল্যাগেজ গুছিয়ে নে৷ এক্ষুনি বেরোবো।’

ভেতর থেকে অরুর বিষন্ন কন্ঠের স্বর শোনা গেল, ‘আমি যাবো না। একদম যাবো না।’
‘দরজা খোল। অরু!’
‘যাবো না।’
‘তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আয়। আমি এসে যদি দেখি তুই রেডি!’

কথাটুকু বলে সে ব্যস্ত পায়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। ড্রয়িংরুমে সাধারণ সুমন সাহেব বসে রইলেন মাথা নত করে। মোস্তফা সাহেবের কল পুনরায় আসছে। এটা নিয়ে ছাপ্পান্ন হবে। এই কল কী ধরবেন? ধরে কেঁদেকেটে মাফ চেয়ে নিবেন এখনই?
_____________
গতকাল রাতের ঝুম বৃষ্টির আভাস প্রকৃতেতি এখনো বিদ্যমান। রাস্তাঘাট, গাছপালা সবকিছু ভেজাচ্ছন্ন। সাথে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শীতল আবহাওয়া। যাবো না বলতে থাকা অরু, শরীরে চাদর পেঁচিয়ে গাড়িতে বসে। তার পাশের জানালার কাঁচ নামানো বিদায়, হাওয়া এসে সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এতো সুন্দর আবহাওয়া অথচ সে উপভোগ করতে পারছেনা। ভয়ে জড়সড় হয়ে গিয়েছে হৃদয়। হাতপা ঠান্ডা হয়ে আছে। ঠিক কি রেখে কী নিয়ে ভাববে মাথায় আসছে না। মস্তিষ্ক বড্ড ফাঁকা। রাতে সেলফোন বন্ধ করেছে এখনো খোলেনি। বাবা-মা, চাচ্চু, বড়ো মা, ছোট চাচ্চু, চাচী তারা নিশ্চয়ই অরুর উপর নিরাশ হবেন। বকবেন হয়তো মারবেন ও! চিন্তিত অরু তন্ময়কে ভিষণ ভাবে অগ্রাহ্য করলো। তাকাল না অবদি। বাইরে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছে। কপালে হাত ছোঁয়াল। গরমে কপাল পুড়ে যাবার যোগাড়। জ্বর আসছে মনে হয়। অরু নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথাটা সিটে হেলান দিয়ে রাখল। তাদের কী মেনে নিবে পরিবার? এর উপর একটি বাজে সিচুয়েশন ঘটেছে। কলি সুইসাইড করেছে। তন্ময়ের জন্য। যেই তন্ময় এখন তার ভাই নয় তার স্বামী! তার জীবনসঙ্গী! কি হবে! কি বলবে!

সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সন্ধ্যা ছ’টা। গাড়ি মৌলভীবাজার জেলায় পৌঁছে, খান বাড়ির উদ্দেশ্যে না গিয়ে সোজা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছুটেছে। তন্ময় দ্রুত পায়ে বেরিয়েছে। পিছু পিছু অরু এবং সুমন সাহেব ও যাচ্ছেন। সুমন কিংবা অরু দুজনের একজনের ও পায়ের গতি নেই। ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন। এদিকে তন্ময় তার পূর্বের রূপে সাচ্ছন্দ্যে হেঁটে অগ্রসর হচ্ছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সে হারিয়ে গেল অরুর চোখের সামনে থেকে। অরুর চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা লাগছে। দেখতে পারছেনা চারিপাশ। যতটা এগোচ্ছে সঙ্গে কেঁপে উঠছে বুকের ভেতর।

মোস্তফা সাহেব ব্যস্ত পায়ে করিডরে হাঁটছেন। দূর থেকেই তার চারিপাশে এক অদ্ভুত ভয়ংকরী আভাস ঘুরঘুর করছে যেন। কাছে ঘেঁষার সাহস পাওয়া মুশকিল। হুশিয়ার সাহেবকে তার থেকে কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে। চোখমুখ শক্ত। ওহী সাহেব কপালে আঙুল চেপে বসে আছেন। আনোয়ার সাহেব উৎসুক দৃষ্টিতে চারপাশ তাকাচ্ছেন। কারো আসবার কথা যেমন! তাদের এমন করুণ অবস্থার একটাই কারণ হতে পারে। নিশ্চয়ই তারা জেনেছেন অরু তন্ময়ের বিয়ের ব্যাপারটা। তন্ময়কে দেখে মোস্তফা সাহেবের পা থেমে গেল। দৃষ্টি স্থির হলো। তার নেওয়া ঘনঘন রাগী শ্বাসপ্রশ্বাসের দেখা মিলছে, বুকের উঠানামার গতিতে। বাকরুদ্ধ, হতভম্ব হুশিয়ার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে। বৃদ্ধ তার হাতে শক্ত মজবুত লাঠি। তন্ময় সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে। যেমন কোনো গুরুতর বিষয় ঘটেনি সেভাবে প্রশ্ন করলো,’কি অবস্থা কলির?’

তার বাচনভঙ্গি স্বাভাবিক। অত্যন্ত স্বভাবিক! তন্ময়ের গলার স্বরে পেসেন্ট রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন জয়া বেগম, মোজাহিদ সাহেব। পরপর আরও অনেকেই বেরিয়েছে। লম্বা করিডর মুহুর্তে তাদের পরিবারের একেকটি সদস্যের দ্বারা জ্যাম হয়ে গেল। মোজাহিদ সাহেব অত্যন্ত রেগে। মুখমণ্ডল লাল এবং কঠিন। তিনি তেড়েমেরে এগোলেন। কিছু বলবেন পূর্বেই হুশিয়ার সাহেব বললেন,’এখানে কোনো কথা নয়। বাড়ি ফিরে নেই তারপর।’

গুরুজনের কথায় অবস্থা কিছুক্ষণের জন্য ধামাচাপা দেওয়া গেল। তবে কতক্ষণের জন্য? অরু দুরুদুরু পায়ে এসেছে। তাকে দেখে আনোয়ার সাহেব ছুটে গেলেন। চোখমুখে তার চিন্তার ছাপ। পিছু গেলেন সুমিতা বেগমও। কিন্তু তার মুখে ক্রোধ। চিন্তার ছিটেফোঁটা আপাতত অবশিষ্ট নেই। আনোয়ার সাহেবের পূর্বে মেয়ের কাছে চলে এলেন। স্পষ্ট শব্দে চড় বসিয়ে দিয়েছেন মেয়ের গালে। চড়ের শব্দ এতটাই প্রগাঢ় যে উপস্থিত সকলে শুনতে পেল। আনোয়ার সাহেব তাজ্জব বনে গেলেন। তার পায়ের গতি থেমে গেল মাঝপথে। মেয়েকে গিয়ে ধরতে অবদি পারেননি এখনো। সুমিতা বেগম আবারো হাত তুলবেন যেমন। তন্ময় খুব দ্রুত পায়ে অরুকে নিজের পেছনে টেনে নিয়েছে। অরু ততক্ষণে নিজের গাল ধরে রেখেছে। দুচোখের পাতায় অশ্রু টলটল করছে। ব্যথিত নয়নে মায়ের পানে তাকিয়ে সে। মানছে ভুল করেছে। এরজন্য এতগুলো মানুষের সামনে চড় মারবে বুঝি? সুমিতা বেগম তন্ময়ের দিক তাকালেন। তন্ময়ের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খুব দৃঢ় গলায় বলল, ‘এভাবে ওকে মারবেন না চাচী। আমার পছন্দ না। কথাবার্তা যা হবে পড়ে। এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না।’

মোস্তফা সাহেব বুক ধরে চেয়ারে বসে পড়েছেন। খু খু শব্দে কেশে উঠলেন। তিনি অবিশ্বাস্য চোখে ছেলের দিক তাকিয়ে। বিশ্বাস করতে পারছেন না যা তিনি শুনেছেন এবং যা তার সামনে ঘটছে।
___________
হাত কাঁ’টার সামান্য চেষ্টা। অতটা গাঢ়তর ভাবে হাতের নলি কা’টতে পারেনি। কিছুটা কেটেছে। মুলত ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। রিস্ক থেকে মুক্ত। কলিকে বাড়িতে নেওয়ার পারমিশন দেওয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে। রাত দশটার মধ্যে খান বাড়িতে পৌঁছেছে সকলের গাড়ি। মেয়েকে মোজাহিদ সাহেব ধরে ভেতরে নিচ্ছেন। সোজা রুমে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীকে মেয়ের পাশে রেখে বেরিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে সকলে উপস্থিত বৈঠক ঘরে। এমনকি সুমন সাহেব ও। তিনি যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় চোখ রাঙিয়ে তার দিক তাকিয়েছেন মোস্তফা সাহেব। সেই চাহনিতে রয়েছে আগুনের ফুলকি। থরথর করে কেঁপে উঠে তিনি ডাকলেন, ‘স্যার!’

মোস্তফা সাহেব বুকে হাত চেপে আছেন। চোখজোড়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করলেন। নিজের ত্যাড়া ছেলেকে জিজ্ঞেস করার থেকে উত্তম ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করা। তিনি চোখজোড়া খুলে কোনোরকমে প্রশ্ন করলেন সুমন সাহেবকে,’মাহবুব সাহেব যা বলেছেন তা কী সত্য?’

মাথা নত করে আছেন সুমন সাহেব। ভীত ছোট গলায় জবাব দিলেন, ‘আজ্ঞে জি স্যার!’

মোস্তফা সাহেব হাঁসফাঁস করে উঠলেন। অরু ফ্রিজ থেকে একটি ঠান্ডা পানির বোতল হাতে সোফায় বসেছে। ঢকঢক শব্দে পানি খেয়ে বোতল টি-টেবিলে রাখল। বাবার উদ্দেশ্যে বলল,’বিয়েটা আমি করেছি। সুমন সাহেব নন।’
‘তন্ময়!!’

চেঁচিয়ে উঠলেন মোস্তফা সাহেব। তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছেন রাগে। ভয়ে অরু কেঁপে নিঃশব্দে কেঁদে উঠেছে। সে আনোয়ার সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে। আনোয়ার সাহেব বিন্দুমাত্র রেগে নন। আসলে সে রাগবেন নাকি হাসবেন বুঝতে পারছেন না। মানে তিনি রাগান্বিত হবার কোনো কারণ দেখছেন না। তন্ময় ভালো ছেলে। ঘরের ছেলে। নিজের মেয়ের জন্য উত্তম পাত্র যা তিনি স্বপ্নেও পাওয়ার কথা ভাবেননি। সে ছেলে স্বেচ্ছায় তার মেয়ে বিয়ে করেছে। এখন থেকে মেয়ে তার সারাজীবন নিজের কাছে থাকবে। আপন হয়ে। এটা তো দুঃখের বিষয় নয়। বরং তার মনে হচ্ছে এরথেকে উত্তম কিছু আর হতেই পারেনা।

হুশিয়ার সাহেব শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন। ঠান্ডা মাথা শুধালেন,’এভাবে হুট করে বিয়ে করার মানে কী তন্ময়? পরিবার নেই তোমার? কারো রায় নেবার প্রয়োজন বোধ করলে না! কেন?’

মোজাহিদ সাহেব নিজেকে চুপ রাখতে পারলেন না। চেঁচিয়ে উঠলেন,’আমি তো দেখছি সব দোষ এই মেয়ের। আমি শুনেছি তো! এই মেয়ে ইচ্ছে করে সঙ্গে গিয়েছে তন্ময়ের। ওর মাথা খারাপ করে দিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। আমার মেয়ে কলি এসেই বলেছে, এই মেয়ের সম্পর্কে! দুশ্চরিত্রা! এই মেয়েই আমার মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

হতবাক হয়ে পড়েছেন মোস্তফা সাহেব। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছেন মোজাহিদ সাহেবের দিক। তারপর তাকালেন হুশিয়ার সাহেবের দিক৷ তারপর নিজের স্ত্রীর দিক। এসব কথা তিনি মোটেও শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হুশিয়ার সাহেব শব্দ করে ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। এরমধ্যে যা বলার তা বলে ফেলেছেন মোজাহিদ সাহেব। তন্ময় স্তব্ধ মেরে বসেছিল। এবার উঠে দাঁড়ালো। মোজাহিদ সাহেবের চোখে চোখ রেখে তাকাল। লাল হয়ে চোখের সাদা অংশটুকু। ক্ষিপ্ত মুখশ্রী। মোস্তফা সাহেব ছেলেকে আটকানোর সামান্য প্রচেষ্টা করলেন। পূর্বেই তন্ময় বলে ফেলেছে, ‘আপনি যার সম্পর্কে কথা বলছেন সে আমার স্ত্রী। মুখ সামলে কথা বলবেন।’

আনোয়ার সাহেব নড়ে উঠলেন। হাতের শক্ত মুষ্টিবদ্ধ ঢিল হলো। আটকে রাখা প্রখর শ্বাস ফেললেন। লাল চোখজোড়া কিছুটা শান্ত হলো। কিন্তু রাগে থরথর করে কাঁপতে শরীর এখনো গরম। অরু বাবার হাত চেপে ধরেছে। নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সে। মোস্তফা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। শক্ত গলায় বললেন, ‘ভুল আমার হয়েছে। আমাদের পরিবারের বিষয় এখানে তোলা ঠিক হয়নি। ছেলে আমার ভাতিজিও আমার। তাদের নিয়ে কথা বলার অধিকারও আমার। আমরা নিজেরাই হ্যান্ডেল করে নিব, বাবা। আসছি! নাতির বিয়ে খেতে চলে আসবেন। চলো জয়া!’

তিনি একমুহূর্ত দাঁড়াননি। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। ছেলের উপর যত রাগ ছিলো সব উবে গেল। একরাশ যন্ত্রণা দিয়ে গেল বুকে। নিজের বাড়ির মেয়ে সম্পর্কে এসব কথা তিনি বরখাস্ত করবেনা না। ওহী সাহেব তার ভাই আনোয়ার সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। অরুকে সহ সদরদরজার দিক এগোলেন। হুশিয়ার সাহেব উদ্ধিগ্ন সুরে মোস্তফা সাহেবকে ডেকে চলেছেন। কাজ হলো না। মোজাহিদ সাহেবও আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। জয়া বেগমও আর আশপাশ তাকালেন না। বাবামায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।

চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৩৮.
প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আছে হয়তো। দ্রিমদ্রিম শব্দে বজ্রপাত হচ্ছে। আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামেছে। রাস্তাঘাট ভিজিয়ে দিয়েছে৷ প্রকৃতি উচ্ছ্বসিত! জানালার কাঁচে বৃষ্টির রেখা। অরু ধ্যান মেরে তাকিয়ে থাকতে চাইল। বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছে। সে আর তন্ময় একই গাড়িতে। আনোয়ার সাহেব তাদের আলাদা যেতে দিয়েছেন মুলত। অবশ্য মোস্তফা সাহেব অমত করেছেন। তবে কে শোনে কার কথা! অরু আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক আবারো তাকাল। গতকাল রাত থেকে তন্ময়ের বলা কিছু শব্দ তার হৃদয়ে তীরের ন্যায় চুবেছে। এইযে
রাতে তাকে গভীর গম্ভীর স্বরে ‘জান’ বলে ডাকল। তখন সে দুনিয়া ভুলে গেল। ভুলে গেল চারপাশ। এতটুকু জীবনে কখনো এভাবে ডাকতে শোনেনি তন্ময়কে সে। কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তন্ময় এভাবে বলতে পারে! এইযে এখনো তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সেই রাতের ঘটনা ভাবতেই। তারপর আজ যেভাবে মায়ের থেকে তাকে রক্ষ করলো। তারপর স্ত্রী বলে রুখে দাঁড়ালো। অরুর তখন মনে হলো, বাবার পড়ে তন্ময় তার দেয়াল। তাকে রক্ষা করার দেয়াল। তার ভালোমন্দ বুঝে নেবার মানুষ! স্বামী স্ত্রীর এই বন্ধন খুব ভালোভাবে অরুকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হুট করে তন্ময়ের ফোন বেজে উঠল। তন্ময় কল রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়েছে। ওপাশ থেকে হাস্যজ্বল পুরুষালি কন্ঠের স্বর ভেসে এলো, ‘দোস্ত! যা শুনলাম সত্যি নাকি!’
‘কি শুনেছিস!’
‘ভাব কম নে মাম্মা! অবশেষে আমাদের মতো মিঙ্গেল হয়েই গেলি। আচ্ছা হঠাৎ বিয়ের কারণ কী? কীরে ভুল হয়ে গেছে নাকি তোর দ্বারা? আমি নিশ্চিত বিজনেস ট্যুরে গিয়ে ফ্রুটস খেতে হাত বাড়িয়ে ছিলি। বেসামাল হয়ে গেছিলি। তোকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি ব্যাটা! হে হে! দোস্ত… ‘
‘অরু পাশে।লাউডস্পিকার দেওয়া। আম ড্রাইভিং।’

মাহিনের অনর্গল কথা বন্ধ হয়ে গেল। পরপর কল কেটে গেল। অরু লজ্জায় হতভম্ব। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে অন্যপাশে ফিরে গেল। ছি!
_____________
অরু ঠিক জানে, তাদের এই বিয়ে এতো সহজে মেনে নেওয়া হবেনা। তখন রাগের বসে হয়তো মেনে নিয়েছে। নিশ্চিত বড়সড় ঝড় অপেক্ষা করছে বাড়িতে। বাড়িতে পা রাখতেই, আসল রূপ বেরোবে সকলের। হয়তো মা আরেকটি চড় বসাবেন গালে। চাচ্চু গম্ভীরমুখে অরুকে ডাকবেন সামনে। বকাঝকা করে অরুকে বান্দরবন পাঠিয়ে দিবেন। নয়তো বা বড়ো মা অভিমানী স্বরে কথা শোনাবেন। চাচী খুব করে রেগে হয়তো বলবেন, ‘এই কাজ কীভাবে করলি বলত অরু? আমাদের কথা একবার ভাবলি না। তোকে দিয়ে এটা একদম আশা করিনি।’ তখন অরু জবাব দিতে পারবেনা। কেঁদে ভাসিয়ে দিবে শাহজাহান বাড়ি। অবশ্য এখনই তার হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই ভয় নিয়ে তো থাকতে পারছেনা। ভয়ে সাড়া শরীর কেঁপে উঠছে খানিক্ষন পরপর। এই পরিস্থিতি হাওয়া হয়ে গেলে কেমন হয়? ভ্যানিস হয়ে যাক! অরু এই থমথমে সিচুয়েশন আর নিতে পারছেনা। সকলের গম্ভীরমুখ সহ্য করতে পারছেনা। সবাই কেমন করে তাকে শুধু দেখেছে। কথা বলছে না, আদর করে ডাকছে না। কেন! অরু কি এমন করে ফেললো!

পাঁচ ঘন্টার জার্নি করে রাত চারটায় গাড়ি বাড়ির সামনে পৌঁছেছে। অরু আসামির ন্যায়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলো। বাড়িতে প্রবেশ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে পড়লো। আঁড়চোখে তন্ময়কেও দেখে নিল। তন্ময় সোফায় বসেছে। তার ভেতর কোনো আতঙ্ক, ভয় কিংবা জড়তার চিহ্ন নেই। অথচ অরু ভয়ে শ্বাস ফেলতে পারছে না। মাথা উঁচু করে বাবামায়ের মুখের দিক তাকাতে পারছেনা। বিশেষ করে বড়ো চাচ্চু আর বড়ো মায়ের পানে।

একটি বিয়ে পুরো পরিবারকে অপ্রস্তুত সিচুয়েশনে ফেলে দিল। সম্পর্কের দ্বিতীয় প্যাঁচ বেরোলো। এতো বছরের সাধারণ মধুর সম্পর্কের মধ্যে, ভিন্ন স্বাদের সম্পর্ক জুড়ে গেল। যার স্বীকারোক্তি দেওয়াটা দুশ্চিন্তা এবং দ্বিধা জড়িত বিষয়।

আশ্চর্য! চোখের পলকে আনোয়ার সাহেব নিজের ভাইপোর শ্বশুর হয়ে গেলেন। সুমিতা বেগম শ্বাশুড়ি বনে গেলেন। আহাম্মক মোস্তফা সাহেব ভাতিজির শ্বশুর হয়ে গেলেন। জয়া বেগম শ্বাশুড়ি! সাধারণ সম্পর্ক গুলো মুহুর্তে অসাধারণ রূপ নিয়ে ফেলেছে। এই অসাধারণ সম্পর্কের রূপ বুঝে শাহজাহান বাড়ি গুরুজনেরা বড়োই সমস্যায় পড়ে গেলেন। এইযে,
মোস্তফা সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কেশে উঠেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে আনোয়ার সাহেবও কেশে উঠলেন। ওহী সাহেব গলা খাকড়ি দিয়ে, অন্যপাশে তাকালেন। জয়া বেগম এবং সুমিতা বেগম নিঃশব্দে চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। পরিবেশ ভীষণ থমথমে এবং অপ্রস্তুত। মনে সকলের হাজারো কথা। কেউই আগ বাড়িয়ে কথাবার্তার শুরুটা করতে পারছেন না। দ্বিধাবোধ করছেন! অবশেষে মোস্তফা সাহেব ছেলের দিক চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। তন্ময়ের মুখ ভোঁতা হয়ে আছে। বাবার চোখ রাঙানো অগ্রাহ্য করে বলল,’এভাবে বসে থাকব? কিছু বললে বলো! আমি রুমে যাবো।’

ছেলের কথায় মোস্তফা সাহেবের দ্বিধাবোধ পুরোদমে কেঁটে গেল। গর্জিয়ে উঠলেন রাগী স্বরে, ‘এতবড় তান্ডব করে আবার গলা বাড়িয়ে কথা বলছ! লজ্জা করছে না তোমার! এই মুখ আমার সামনে এনেছ কীভাবে? ওয়াদা ভঙ্গ করেছ তুমি ! ছিঃ! তুমি আমার ছেলে তা তো আমি ভাবতেই পারছিনা। আমি যে কিনা কখনো কথার খেলাপ করিনি জীবনে, সেই আমার ছেলে তুমি হলে কী করে!’
‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।’

ওহী সাহেব এক গ্লাস পানি খেতে নিয়ে বিষম খেলেন। গলায় পানি আটকে লাগাতার কেশে দম আটকে ফেললেন। বুকে এলোপাতাড়ি থাপড়ালেন। মোস্তফা সাহেব স্টোক করে বসবেন! তিনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছেন না। বুকে হাত চেপে কম্পিত আঙুল ছেলের পানে তুললেন। ভেঙে ভেঙে কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। অন্যথায়, তন্ময় আসলে কথাটি বলতে চায়নি। মুখে চলে এসেছে হুট করে। বলে অবশ্য বেশ হালকা অনুভব করছে। বাবার অবস্থা দেখে তার রাজ্যের ঘুম ভ্যানিস হয়ে গেল। খুব আরাম করে সোফায় কাতচিৎ হয়ে বসলো। যার যা অভিযোগ শুনবে যেমন।

ওহী সাহেব শান্ত হয়েছেন। খুব মোলায়েম সুরে কথা শুরু করলেন, ‘কিছু হয়েছিল? এভাবে হুট করে…কী কারণ?’

তন্ময় দূরে কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়ানো অরুকে দেখে নিল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কি হবে! কিছু হয়নি। কোনো কারণ নেই! বিয়ে করতে ইচ্ছে হলো করে নিলাম।’

ওহী সাহেব কথা এগোনোর ভাষা হারিয়ে ফেললেন। অন্য বাড়ির মেয়ে বিয়ে করলে নাহয় মানা যেতো। নিজের বাড়ির ছেলে নিজের বাড়ির মেয়ে বিষয় করেছে! এখানে কি বলবেন বা করবেন বুঝতেই পারছেন না। মোস্তফা সাহেব কিছুটা শান্ত হয়েছেন। তিনি আঙুল তুলে বললেন, ‘তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। এই বাড়িতে তোমার কোনো স্থান নেই।’
‘ঠিকাছে।’

তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। উচ্চস্বরে বলল,’এই অরু ব্যাগ গুঁছিয়ে নে৷’

মোস্তফা সাহেব চোখ বড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘ও ব্যাগ গোছাবে কেন!’
‘আমার বউ আমার সাথে যাবেনা?’

মোস্তফা সাহেব বুকে হাত চেপে সোফায় বসে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে ওহী সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন,’আল্লাহ গো! এই অসভ্য ছেলেকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। এক্ষুনি!’

তন্ময় চলে যেতে পা বাড়ালো। মোস্তফা সাহেব দম নেবার অবস্থায় নেই। তবুও ছেলেকে শুনিয়ে আবারো বললেন, ‘এটা কোনো বিয়ে হলো! এই বিয়ে মানা যায়না! অরুর রুমের ট্রান্সফার করা হোক। আজ থেকে অরু নিচের রুমে থাকবে। জয়া ব্যবস্থা করো! আর তুমি..অসভ্য ছেলে! একশো হাত দূরে থাকবে ওর থেকে।’

বাবা ছেলের মধ্যে এই কীসের যুদ্ধ চলছে, কেউই বুঝে পেল না। উপস্থিত সবাই অসহায় চোখে দেখে গেল। তন্ময় তোয়াক্কা করলো না বাবার কথার। সে উপরে চলে গেল। অরুকে এসে শাবিহা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দীপ্ত চুপচাপ পিছু পিছু গেল তাদের। বুকের ভেতর গুরুমগুরুম করছে। আনন্দে চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। চেঁচিয়ে বাড়িঘর মাতিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না ভয়ে। সবাই গম্ভীরমুখে আছে। নিশ্চয়ই দীপ্তর ব্যাক পিঠের মধ্যস্থান থাপড়ে লাল করে দিবে। ভীতু দীপ্ত বাপ-চাচাদের আড়ালে এসে নেচে উঠলো। তার দীর্ঘ লাফানো’তে ঝাকড়া চুলগুলো দুলছে। যেন তারাও খুশিতে নাচছে।

‘বিয়েটা হয়ে গেল?’
‘হু।’
‘সত্যি? আমার কথা শোনার মতো মানুষ তো ভাই নয়। ও বিয়েটা সত্যি করে নিলো! হুয়াই? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছু কী হয়েছে?’

শাবিহার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অরু থমকে গেল। থমথমে গলায় বলল,’কি হবে!’
‘কিছু একটা কারণ আছে! নাহলে আমার ভাই কথা নড়চড় করার মানুষ নয়। বাবাকে কথা দিয়ে সে নিজেই ভাঙবে এমনটা হতেই পারেনা। কুছ তো গারবার হে দীপ্ত, কুছ ত!’

দীপ্তর চোখমুখে রাজ্যের ঘুম। সে হৈ-হুল্লোড় করে শাবিহার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। শাবিহাও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে শুয়ে পড়লো। অরু শুধু বসে রইলো। ফজরের আজান দিচ্ছে। তার ঘুম আসছে না। আনমনে তাকিয়ে ভাবতে বসলো। হঠাৎ করে জীবনের মোড় ঘুরে গেল অদ্ভুত ভাবে। ভাবতেই বড্ড অবাক লাগে সে এখন বিবাহিত। তার পছন্দের মানুষ, তার কাছের মানুষ, যাকে একসময় ভাইয়া বলে পিছু ঘুরে বেড়াতো, সে তার স্বামী। ওই অসাধারণ মানুষটা অরুর! ভাবনায় আসতেই খুব ভালো লাগছে। বুকে একরাশ অনুভূতি ঘুরঘুর করছে। পেট মুচড়ে উঠছে ভেতর থেকে। তবে যতই ভালো লাগা কাজ করুক না কেন! অরু একটু ক্ষিপ্ত তন্ময়ের উপর!
___________
সুমিতা বেগম হাঁসফাঁস করছেন। আনোয়ার সাহেব শুধালেন, ‘কি হয়েছে?’
‘এই বিয়েটা..মানে ভাইয়া খুব করে বলেছিল! এটা কি হয়ে গেল!’

আনোয়ার সাহেব স্মিথ হাসলেন। স্ত্রীকে ইশারা করলেন পাশে আসতে। সুমিতা বেগম আসলেন। আনোয়ার সাহেবের পাশে বসলেন। আনোয়ার সাহেব মোলায়েম সুরে বললেন,’আমাদের একটি মাত্র সন্তান। ধরো, মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিলাম। চলে গেল শ্বশুরবাড়ি। চোখের সামনে থেকে বহুদূর। মাসে একবার হয়তো বছরে একবার দেখতে পাব। আমাদেরই বা কে দেখবে তখন? এইযে রাতে হুট করে মেয়েটা চলে আসে! কীভাবে যেন বুঝতে পারে আমার মাথা ব্যথা! বলবে, বাবা মাথাটা একটু মালিশ করে দেই? বাবা তোমার বুকে কী আবারো যন্ত্রণা করছে! সেবার তোমার ভীষণ জ্বর হলো! আমি সহ ভাইয়া তুফানের কারণে আটকে। বাড়িতে কেউ নেই! সবাই ফিল্ম দেখতে বেরিয়েছে। মেয়েটা একাই তোমাকে দেখবার জন্য বাড়িতে থেকে গেল। সেবাযত্ন করলো। হঠাৎ করে তোমার অবস্থা খারাপ। দিশেহারা মেয়েটা আমার সেই তুফানের মধ্যে ছুটে বেরিয়েছে পাশের ক্লিনিকের ডাক্তার ডাকতে! কী সাংঘাতিক তোমার অবস্থা হয়ে ছিলো। চিন্তায় মেয়েটা দুদিন তোমার সাথেই ছিল। সেবাযত্ন করলো। একপা নড়ল না তোমার চারিপাশ থেকে। সেই আমাদের আদুরে মেয়েটা চলে যাবার পর আমাদের কী হতো? এভাবে কেই বা দৌড়ে আসত। মাথা ব্যথায় পড়ে থাকলেও কেউ মালিশ করে দিবে বলে দৌড়ে আসত না! কিন্তু দেখ, আল্লাহতালার কী অশেষ রহমত৷ পরের বাড়িতে যাবার জন্য জন্ম নেওয়া মেয়েটা সারাজীবন বাবার বাড়িতেই থাকবে। পাশে। কাছে। দৈনন্দিনের মতো একসাথেই থাকব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মেয়েটা চোখের সামনে থাকবে। এটা কী আনন্দের বিষয় নয় সুমিতা? আবার দেখ, তন্ময়কে ছেলের চোখে দেখে আসলাম। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ছেলে। কোনো কমতি বা খারাপ দিক নেই তার মাঝে। সেই ছেলে আমার একমাত্র মেয়ের জামাই হয়ে গেল৷ আমাদের মেয়ে জামাই। সম্পর্ক দুটো। হয়তো এই সম্পর্ক শক্ত করে রাখতে পরিশ্রম করতে হবে৷ আগের থেকে এখন আরও বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। তবে দিনশেষে আপন সম্পর্ক গুলো চারিপাশে রয়ে গেল না?’

সুমিতা বেগম কেঁদে উঠলেন। ভেঙে পড়লেন স্বামীর বুকে। খুব করে কাঁদলেন। কাঁদতে দিলেন তাকে আনোয়ার সাহেব। একসময় শান্ত হলেন সুমিতা বেগম। খুব ধীর স্বরে বললেন, ‘আমাকে একদিন বলেছিলেন, আপনি সেই দিনের অপেক্ষায় যেদিন আমি নিজেকে আপনাকে সবকিছু খুলে বলব। আমি আজ বলতে চাই৷ আপনি শুনবেন?’

আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘শুনব।’
‘ছোট থেকেই অবহেলিত ছিলাম। বাবামা সবসময় ভাইয়াদের এগিয়ে রাখতেন। ভাইয়ারা সর্বদাই আমাকে অপছন্দ করতেন। আমি সবসময় তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য কাতর হয়ে থাকতাম। তারা আমাকে ভালোভাবে দেখতেনই না। আমার বন্ধুবান্ধবদের ভাইয়া গুলোকে দেখতাম। কতো সুন্দর ব্যবহার তাদের। খুনসুটি, আদর তাদের চারিপাশে লেপ্টে। সেগুলো দেখে কেঁদে ভাসাতাম। স্বপ্ন দেখতাম আমার ভাইয়া, আমার বাবাও এভাবে আমার মাথায় আদূরে ভাবে হাত রাখবে। মন খুলে কথা বলবে। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে! কিন্তু স্বপ্নগুলো স্বপ্ন রয়ে গেল। আপনার সাথে বিয়ে হলো। এই পরিবার, পরিবারের মানুষ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যেখানে আমি বড়ো হয়েছি সেখান থেকে সম্পুর্ন ভিন্ন পরিবেশ ভিন্ন ব্যবহার পেলাম। প্রথম এসে ভেবেছিলাম এখানে হয়তো নাটক চলছে। তাই সবাই এমন ভালো ব্যবহার করছে। দিন যেতে থাকলো আমার ভুল ধারণা ভাঙলো। এই পরিবারের মানুষ গুলো আসলেই সত্যিকারের। খেয়াল করলাম বিয়ের পর ভাইয়াদের ব্যবহারের পরিবর্তন এলো। আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলো। আমার যে কি আনন্দ হলো, আপনাকে বোঝাতে পারবো না। অনাকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন গুলো চোখের সামনে পূরণ হতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। ভাইয়েরা যা বলত করার চেষ্টা করলাম। টাকা দিতে বলত, দিতাম। অফিসের সম্পর্কে জানতে চাইত জানাতাম। সত্যিটা চোখের সামনে থাকতেও তা অগ্রাহ্য করলাম। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য অন্ধ হয়ে গেলাম। মেয়েটাকেও তাদের বাড়িতে পাঠানোর জন্য একপায়ে রাজি ছিলাম। আমি ভালো মা নই। ভালো স্ত্রী নই। আমি.. ‘

অঝোরে কাঁদতে থাকা সুমিতা বেগমকে জড়িয়ে বুকে নিলেন আনোয়ার সাহেব। স্বান্তনা সরূপ কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। তিনি হেসে বললেন, ‘আমার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।’
‘মাফ করবেন আমাকে?’
‘তুমি অন্যায় করোনি সুমিতা। আমি তোমাকে অন্যায় করতে দেইনি। ঠিক এভাবে আগলে রেখেছি। মরার আগ পর্যন্ত আগলে রাখবো। তুমি শুধু পাশে থেক।’
__________
বিয়ের বিষয়টি যেমন ঘটেই নেই। সকলেই নর্মাল। কোনো রিয়েকশন নেই। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে আগের মতো পেলো অরু। ব্রেকফাস্টে খেতে বসে সে ভয়েভয়ে মায়ের দিক তাকাল। সুমিতা বেগম গম্ভীরমুখে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিলেন নিত্যদিনের মতো। অরু একটানে খেয়ে নিল সেটা। ভয়ে নাকমুখ ও কুঁচকায়নি আজ। পরপর তন্ময় এসে পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তৈরি হয়ে এসেছে জনাব। খেয়ে অফিস যাবে বোধহয়। অরু চোরাচোখে তাকেও দেখে নিল। আশ্চর্য! সবাই নর্মাল শুধু অরু বাদে। কেন! সবাই কী ভুলে গেল তাদের বিয়ের কথা? কালই ত বিয়ে করলো তারা। অরু বিবাহিত! ব্যাচেলর নয় আর। এতবড় সত্য কেউই গ্রাহ্য করছে না আর! সবাই কী এই বিয়েটা ভুলে যেতে চাইছে? তন্ময় ও? ভয়ে অরুর বুক কেঁপে উঠলো!

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here