প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৪৮,৪৯

0
1685

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৪৮,৪৯

৪৮.
আকাশ পরিষ্কার। কালো আকাশ জুড়ে লক্ষ্য লক্ষ্য নক্ষত্র। রয়েছে গোলাকার সাদা ফকফকে চাঁদ। চাঁদের সৌন্দর্য আজ দ্বিগুণ রূপে জ্বলজ্বল করছে যেনো। আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারিপাশ। সম্পুর্ন ছাঁদ জুড়ে মানুষের হাঁটাহাঁটি, হাসাহাসি, তর্কবিতর্কের তীব্র শব্দ।

ছাঁদের মধ্যখানে গোলাকার ভঙ্গিতে চেয়ার বসানো হয়েছে। চেয়ার গুলোর মধ্যেস্থানে বড়ো টেবিল। টেবিল জুড়ে রয়েছে নানান প্রকার খাবার। ইব্রাহিম সমান তালে খেয়ে চলেছে। চোখমুখ শক্ত। পাশে রুস্তম বসে। সেও চোখমুখ ক্রোধে ললাটে রূপ ধারণ করে খেয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলছে। দুজন একসময় দাঁড়িয়ে পড়লো। যেমন তর্কাতর্কি এখনম মারামারির পর্যায়ে আসবে। দুজন মুখোমুখি ছুঁইছুঁই হয়ে। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে একে অপরের পানে। তন্ময়, মাহিন, সৈয়দ তারা ছাঁদে উঠেছে কেবলই। মাহিন চেঁচাল, ‘কি রে! এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যেমন চুম্বনে লিপ্ত হবি দুজন! একটা রুমের চাবি কী দিব?’

অপ্রত্যাশিত কথায় ভড়কে গেল ইব্রাহিম। নাকমুখ কুঁচকে গেল মুহুর্তে। সাপের ন্যায় ফোসফোস করে সরে এলো। রুস্তম কম কীসে? সোজাসাপটা তেড়ে গিয়েছে মাহিনের দিক। কিছু বোঝাপড়া এখনই করবে সে। মাহিন দৌড় লাগিয়েছে। হেঁসে উঠেছে বাকি সকলে। খোলামেলা শব্দময় হাসি একেকজনের।

তন্ময় ছাঁদে উঠতেই, তাকে এ-সে অনেকেই ডাকছে। এতদিন পর দেখা৷ ডাকাডাকি স্বাভাবিক। তন্ময় হেসে বলেছে, ‘আসছি।’ অরুকে চেয়ারে বসতে ইশারা করলো। অরু বসবে না। সে ঐ কোণায় গিয়ে রেলিঙের পাশে দাঁড়াবে। নদীর পানি দেখবে। লঞ্চ ছাড়ার মুহূর্ত উপভোগ করবে। শব্দ করে বললো, ‘ওপাশে যাই আমি?’
‘না। বোস।’

অরু কিছুই শুনতে পেল না। তীব্র গানের শব্দ। এতো মানুষ, অথচ একটি শব্দ তার কানে আসছে না। অরু ভাবলো এক কানের ইয়ারফোন খুলে ফেলবে। কিন্তু তন্ময় একটু পরপর চেক করছে। কানের দিক ভালোভাবে তাকাচ্ছে। আশ্চর্য! এতো কেয়ারফুল হবার কী আদৌও প্রয়োজন আছে?

অরু তন্ময়ের চোখ রাঙানো দেখে বসলো এক কোণে। চুপচাপ বসে। হাত দুটো সামনে। তন্ময় হাতের ইশারায় ঠাঁই বসতে বলে, তারপরই অন্যদিকে হাঁটা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর শব্দ করে অরুর পাশে এসে বসলো সৈয়দ। অপরপাশে শুহানি এসে বসেছে। সামনে রিহান আর মাহিন বসে। অরু চারপাশ হতে ঘেরা। বোকার মতো তাকিয়ে আছে। শুহানি অরুর কান থেকে ইয়ারফোন খুলে নিল। হেসে শুধালো, ‘কি গান শুনছ অরু?’

অরু নাম বললো, ‘তেরি কাসাম।’

মাহিন হতাশ গলায় বলল, ‘আহারে! তুমি এভাবে অন্যের গান কেন শুনবে বলোতো? তোমার ভাইয়া থেকে হয়ে যাওয়া সাইয়া কিন্তু খুব ভালো গান গায়। সেদিন শুনলে না? এই ছেলে ভার্সিটির কতো মেয়েদের কানে কানে গিয়ে গান গেয়েছে, বলে শেষ করা মুশকিল। তোমার কানে গান গেয়েছে?’

অরুর উজ্জ্বল মুখশ্রী বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে। শুহানির ভীষণ মায়া হলো। সে অরুকে পাজাকোলে চেপে নিল। ধমকের সুরে মাহিনকে বলল, ‘চুপ থাক তুই!’
‘তোর নোংরা বাম হাত ঢোকাবি না। খবরদার। কথা বলতে দে। তো অরু! বলো গান গেয়ে শুনিয়েছে কানে কানে?’

অরু মাথা নাড়াল, ‘না।’
‘ইশ! ওই মেয়েটাকে দেখ। ওইযে জিন্স-টপ পড়ে। তন্ময়ের পাশে দাঁড়িয়ে। আমাদের ক্লাস টপার ছিল। তন্ময়ের জন্য পাগল। এই মেয়েকে কিন্তু তন্ময় কানে কানে গান শুনিয়েছে। আমার নিজের চোক্ষে দেখা।’

অরুর বিশ্বাস হলো না মোটেও। তার গম্ভীর শান্তশিষ্ট তন্ময় ভাই, এমনটা আদোও করতে পারে? অরু বলল, ‘সত্যি?’
‘হু। এখানে উপস্থিত অনেক মেয়ের সাথেই লাইন ছিলো বুঝলে। সব গোপনে। গোপনীয়তা বজায় রেখে চলত ছেলেটা। দেখতে তো ভোলাভালা। টেম্পো চালাতে জানে, সেটা কে জানত বলো!’

অরুর মুখ ভোঁতা হয়ে আছে। সেই মুখ আরও ভোঁতা করতে রিহান বলল, ‘আরে মাহিন তোর শীলার কথা মনে আছে? ওই মাদবরের নাতনি’টা। ওটার সাথে তো তন্ময় ভালোই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল! মনে পড়ে?’

মগজধোলাই হওয়া অরুর চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল। মাহিনের মুখের ভঙ্গিমা দেখে তার সব কথা সত্য মনে হতে লাগলো। নিমিষেই চোখজোড়া জ্বলতে শুরু করলো। এরজন্য কী তন্ময় তার কানে ইয়ারফোন দিয়েছে? যাতে সে এগুলো না শুনতে পায়? মাহিন আলগোছে উঠে গেল। তন্ময় আসছে তাড়াহুড়ো পায়ে। রিহান ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিকসেদিক তাকিয়ে কেটে পড়েছে। অরুর পাশে শুধু শুহানি বসে। সে নরম সুরে বলল, ‘ওদের কথা বিশ্বাস করো না। ফাজলামো করছে তোমার সঙ্গে। তুমিতো জানো, তন্ময় কেমন! তবে কানে কানে গান শোনার আবদার খানা করতেই পারো। এটা কিন্তু আমিও পার্সোনাল ভাবে উপভোগ করেছি। রিহান থেকে। অনুভূতি খুব স্বচ্ছ এবং দারুণ। ট্রায় করতেই পারো।’

অরু তাকাল অসহায় নয়নে। শুহানি শব্দ করে হাসছে। তন্ময় সামনে আসতেই বলল, ‘দোস্ত তোর বউয়ের মগজধোলাই করে গেছে ওই দুজন। সামলা তাহলে। আমি একটু আসছি।’

তন্ময় বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো মাহিন, রিহানকে চোখও রাঙাল। ছেলেগুলোর জ্বালায় সে বাঁচবে না বেশিদিন। অরুর ভোঁতা মুখশ্রী খানায় দৃষ্টিপাত করে প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে?’
‘কিছুনা।’
‘কী বলেছে?’

অরু চুপ রইলো। তন্ময় হাত বাড়াল, ‘দেখি আয়।’

অরু উঠে দাঁড়ালো। তন্ময়ের হাত ধরলো। চুপচাপ সঙ্গে হাঁটছে। তার হঠাৎ মন খারাপ হলো। সে জানে মাহিনের কথা সত্য নয়। তাও কেন মন খারাপ হচ্ছে?

দুজন এসে দাঁড়িয়েছে ছাঁদের এক কোণে। এখানটা বড্ড নিরব। নিরবতা ভাঙলো রুস্তমের গলার স্বরে। লঞ্চ ছাড়া হবে এক্ষুনি। পরপরই শোনা গেল লঞ্চ ছাড়ার তীব্র শব্দ। অরু ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়লো সেই শব্দে। তাকিয়ে থাকলো নদীর পানির দিক। পানির উচ্ছাস অবস্থা। উথালপাতাল গাঢ় ঢেউ। দিশেহারা, অবিকল ভাবে মেতে চলেছে।

ধীরে লঞ্চ চলতে শুরু করেছে নদীর বুকে। সেই কী অদ্ভুত অনুভূতি! অরু এবার রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো আরেকটু কাছে গিয়ে। মাথাটা নিচু করতে চাইল। তন্ময় দিল না। সে অরুর পেছন দাঁড়িয়ে। স্বাস্থ্যসম্মত দু’হাত দুপাশে দেওয়া। দূর থেকে মনে হচ্ছে, অরু তন্ময়ের বাহুতে আটকে। তবে কাছাকাছি তেমনটা মোটেও নয়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে কিছুটা। অরু আঁড়চোখে পেছন তাকাল। তন্ময় তখনো নদীর দিক তাকিয়ে। তবে অরুর নজর ঠিক উপলব্ধি করলো, ‘কী?’
‘হু।’
‘বল।’
‘আপনি কখনো প্রেম করেছেন?’

প্রশ্নটা করতেই অরুর বুকের উঠানামার গতি বেড়ে গেল। ভেতরটা ধুকপুক করছে। তন্ময় সময় নেয়নি। মুহুর্তে জবাব দিল,’না।’
‘কখনো করেননি?’
‘কখনো না।’

অরুর হুট করে খারাপ হয়ে যাওয়া মন স্বতঃস্ফূর্ত হলো মুহুর্তে। জ্বলজ্বল চোখে ফিরে চাইল। তন্ময়কে পলক ভরে দেখে বলল, ‘আপনি কখনো কানে কানে গান গেয়ে শুনিয়েছেন?’
‘তোর মাথায় কী ঢুকিয়েছে এরা! কানে কানে গায় কীভাবে! আশ্চর্য!’

কানে কানে কীভাবে গান গায় তাই জানে না?শুহানির বলা কথাগুলো অরুর মস্তিষ্কে জড়াল ভঙ্গিতে লেপ্টে এলো। কানে কানে গান শোনার এক আলাদা অনুভূতি আছে। শুহানিকে রিহান শুনিয়েছে। অরুরও আগ্রহ জেগেছে এবিষয়ে। সে চাচ্ছে তন্ময়ও তাকে গেয়ে শোনাক। কেন শোনায় না! অরুও উপভোগ করতে চায় ওই অনুভূতি। নজর ফিরিয়ে নদীর দিক তাকাল। নদীতে চাঁদের ঝলক। আসমানের প্রতিভাব। দেখা মিলছে উপচে পড়া রূপের।

বেশ খানিক্ষন বাদে কানের কাছে উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শ পেল অরু। কোমরে শক্ত হাতের ছোঁয়া। জামার ভেতর দিয়ে গিয়েছে সেই হাত। মুঠো করে ধরেছে সেখানে। অরু চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। তন্ময় বলল,’খুব জ্বালাতন করিস!’

অরু কষ্ট পেল। জ্বালাতন তো তাকে করা হচ্ছে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,’ছাড়ুন। আমি কী বলেছি শোনাতে!’

তন্ময়ের গম্ভীর কন্ঠের ধীর হাসির শব্দ শোনা গেল।
‘ওহ!’
‘সরুন।’
‘তুই তো দিব্বি আমাকে জোরপূর্বক চুমু খেতি। এখন আমি ধরতে পারবো না? সার্টিফিকেট পেয়েও?’
‘কী!’

অরু আশ্চর্যের শেষ সীমানায় চলে গেল। কীসব বলছে! সেই কবে অরু গালে একটা চুমু দিয়েছিল, সেটা নিয়ে বসে আছে। তখন তো অরু ছোট, অবুঝ ছিল। অনুভূতির চাদরে ঢেকে কয়েকটি ভুল স্টেপ নিয়েছিল। তাই বলে এভাবে বলবে? সেও তো অরুর সাথে কতকিছু করেছে। অরু তো বলতে যায়নি, ‘আমি কখনো এমন করিনি। মানে.. মাত্র একবার।’
‘একবার? আচ্ছা ওই একবার কেন চুমু খেয়েছিলি?’

অরু দিশেহারা হয়ে পড়লো। কেন খেয়েছিল! না খেলে এতকিছু তো শুনতে হতো না। দুঃখিত গলায় বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে।’
‘শাস্তি তো পেতে হবে।’

হঠাৎ কানের কাছটায় নিশ্বাসের ইঙ্গিত পেল। কেঁপে উঠলো অরু। এভাবে কানে মুখ নিয়ে রেখেছে কেন! পরপর নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। দম আটকে রাখল অরু। ভালোভাবে শ্বাস নিতে পারছে না। রুদ্ধশ্বাস ফেলে নড়েচড়ে উঠলো তন্ময়ের বাহুতে। কিন্তু সরতে পারলো না। তন্ময় শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করে যাচ্ছে কানের লতিতে। বিচরণ করছে সেখানে। পরপর সেই চিরচেনা গম্ভীর স্বরে সুরের তাল শুনতে পেল। ভীষণ কাছ থেকে। খুব ধীরে। অরুর উথালপাতাল ধুকপুক বেড়ে গেল শত গুনে।

‘যাব তেরি উঙলিয়া মুঝকো ছু যাতি হে,
তু কাহি খোয়াব দিল মে জাগা যাতি হে,
ইতনি বে-রাঙ ভী তো নেহি জিন্দেগী,
হার মুলাকাত মুঝছে এ কেহ যাতি হে..

তেরি-হি বাহো মে, ফানাহো-মে,
রেহনা মুঝে হার দাম ছাদা,
তেরি-হি ইয়াদো-মে, নিগাহো মে
রেহনা মুঝে হার দাম ছাদা…

তেরি জুলফ যাব ভী বিখার যাতি হে,
অ্যা হাসি তু হাসি, ওর হো যাতি হে,
যো কিতাবো-মে পাঢতে রাহে আজ তাক,
ওহ পারি হাম-কো তুঝ মে নাজার আতি হে,
___________
রাত তিনটা পঁয়ত্রিশ। অরু সোফায় বসে। হাতে কফির মগ। ধীরে কফিটুকু খাচ্ছে। চোখজোড়া জ্বলছে রীতিমতো। মাথাটাও ভাড় হয়ে আছে। এমন গান শুনিয়েছে লোকটা যে অরু দু’দন্ড আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি ছাঁদে। হাঁটু কেঁপে ভেঙে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস তন্ময় ধরে রেখেছিল নাহলে তো পড়ে যেতো। বুকের ভেতর এখনো সমানতালে কাঁপছে। গলাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে।

তন্ময় একটা পঁয়তাল্লিশে বেরিয়েছে। বাহির থেকে রুম লক করে গিয়েছে। সঙ্গে ভেতর থেকেও করতে বলেছে অরুকে। সেলফোন দিয়ে গিয়েছে দরকার পড়লে কল করতে। অরুর প্রয়োজন পড়েনি। সে চুপচাপ বসে থাকলো পুরো সময়। লঞ্চ নারায়ণগঞ্জের ত্রিসীমা চলে এসেছে। দূর থেকে দেখা মিলছে বড়ো অট্টালিকার। গাছপালা, ঘন জঙ্গল সবই আবছা দৃশ্যমান। অরু বারান্দার চেয়ারে বসে তাকিয়ে রইলো। বুকে হাত চেপে রাখল। চোখ বুঝল।

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৪৯.
‘অত্যন্ত ভালোবাসতে নেই। হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। হয়তো সুখে নয়তো যন্ত্রণায়। আমার হৃদয় কেন পুড়ছে শাবিহা?’

শাবিহা দৃষ্টি সরাল। বুকের চিনচিন ব্যথা অগ্রাহ্য করলো, ‘পরিবারের কথা শোনো। তারা তোমার খারাপ চায়না।’
‘তুমি কী চাও?’
‘যা তোমার জন্য ভালো।’

অয়ন হাসলো নির্বিকার ভঙ্গিতে, ‘আমার জন্য ভালো কী?’
‘এতসব জানি না।’
‘তুমি কিচ্ছু জানো না। বোঝ না। তুমি শুধু আমাকে পোড়াতে জানো।’

শাবিহার চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে। দুচোখ ভিজে উঠেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে সিটে হেলান দিয়ে রইল। চোখজোড়া বুজে রাখল।

অয়ন কপালে আঙুল চেপে ধরেছে। হৃদয় এতটা ব্যাকুল কেন হবে? ভালোবাসার মানুষ সামনে আসতেই রাগ প্রেমের সমুদ্রে ডুব কেন দিবে? রাগ কেন রাগের জায়গায় সটান মেরে থাকে না? অভিমানী মন শক্তপোক্ত হতে পারেনা কেন?
এইযে অয়ন মাস খানেক ধরে জ্বলন্ত আগুনে দাউদাউ করে জ্বলল। পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। রেগেমেগে অস্থির হয়ে থাকলো। দিনরাত জেগে কাটাল। একমুহূর্তের জন্য দুচোখের পাতা বুজতে পারেনি, শান্তিপূর্ণ ভাবে ঘুমাতে পারেনি।
খুব করে মনকে শক্ত করেছিল। ভেবে রেখেছিল, শাবিহা সামনে আসলে তাকেও নিজের আগুনে জ্বালাবে। পইপই করে ভেবে রেখেছে। অথচ এখন হচ্ছেটা কী? শাবিহার আঁখিদুটির কোণে জল ঘেঁষতে দেখে মুহুর্তে গলে রসমালাই বনে গেল। রাগ, অভিমান, জেদ সবকিছু উবে গেল। আপাতত বুক ভর্তি ভালোবাসা উতলে উঠছে। হাসফাস করছে বুকের ভেতরটা। শাবিহাকে শক্ত করে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে বক্ষস্থলে।

বিরক্ত ভঙ্গিতে কপালের চুলগুলো দু-হাতের সাহায্যে উঠিয়ে নিল। ঘুরে তাকাল পাশে। শাবিহা ঘুমিয়ে পড়েছে। সিটে মাথা এলিয়ে নিশ্চিন্ত চোখবুজে আছে। মায়াবিনী একটা। অয়নকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ঘুমাতে ব্যস্ত।অয়ন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঘুমন্ত শাবিহার পানে চেয়ে রইল। চোখমুখ লাল বর্ণে রুপান্তরিত হয়েছে। কালো রেশমি চুলগুলো চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অয়ন হাত বাড়ালো। মুখশ্রীর সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। থমথমে চোখ নামিয়ে চট করে একটা চুমু খেল। শাবিহা নড়েচড়ে পাশ ফিরেছে। ঘুমের ঘোরে গোঙাল। অয়ন ঠোঁট এগিয়ে নিঃশব্দে আরেকটি চুমু খেল। কতটাই না আকুতি অনুভব করেছে এই মুখশ্রী দেখার জন্য। কীভাবে ছটফট করেছে দিনরাত! ব্যাকুল হয়ে ঘুরেফিরে বেরিয়েছে একটিবার দেখার জন্য। অয়ন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল, ‘বড্ড ছাড় দিচ্ছি৷ একবার নিজের করি। তারপর… খবর আছে তোমার।’

নিস্তব্ধতা ভেঙেছে অয়নের সেলফোনের শব্দে। তন্ময় কল করছে। অয়ন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কোলাহলের তীব্র শব্দ। সবরকম শব্দ মিলেমিশে একত্রে এসে কানে বিঁধছে। সেলফোন কান হতে খানিক সরাল। তন্ময় হয়তো কিছুটা দূরে যাচ্ছে শোরগোল থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে শব্দ কমে এল। সে ডেকে উঠলো, ‘ভাইয়া!’
‘হু। কই?’
‘শহরের বাইরে।’
‘শাবিহা?’
‘ঘুমোচ্ছে।’
‘রাত তো অনেক। কোথায় যাবে ভেবেছ?’

অয়ন হাসল। সে মাদারীপুর যেতে চাচ্ছিল শাবিহাকে নিয়ে। ভেবেছিল, সেখানকার একটা হোটেল বুক করে নিবে দুদিনের জন্য। ঘুরেফিরে ফিরে আসবে সময়মত। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? শাবিহা স্পষ্ট স্বরে নাকচ করে বসেছে। কোনোপ্রকার হোটেল নেওয়া হবে না। কোনোপ্রকার মাদারীপুর যাওয়া হবে না। এভাবে গাড়িতে করে ঘুরবে। নাহলে বাড়িতে দিয়ে আসতে। অয়ন পড়লো বিপাকে। দু-তিনদিন এভাবে গাড়িতে করে থাকা যায় নাকি? পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, ‘ভেবেছিলাম তবে শাবিহা যাবেনা। এভাবেই গাড়িতে থাকবে বলছে।’
‘ভয়ে আছে।’
‘আমি বুঝতে পারছি ভাইয়া।’
‘আমি খুব ভরসা করি তোমাকে অয়ন।’
‘জানি ভাইয়া। নিরাশ করবো না।’
‘সাবধানে থেকো। প্রয়োজনে কল করো। আর হ্যাঁ, টাকা লাগবে? আমি কী পাঠাব?’
‘না না। আছে আমার কাছে।’
‘এঞ্জয়।’
‘সেইম টু ইউ ভাইয়া।’

সেলফোন রেখে পুনরায় নজর শাবিহার দিক রাখল। অশান্ত লাগছে মেয়েটাকে। ঘুমিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। দোনামনা করছে ঘুমের ঘোরে। অয়ন হাত বাড়িয়ে শাবিহার মাথাটা এগিয়ে আনল। ঠিক নিজের পায়ে, রানের উপর রাখল মাথা। পেছন সিটে রাখা কোর্ট এনে শাবিহার শরীরে মেলে দিল। এসির ট্যাম্প্রেচার খানিক কমিয়ে নিল। ধীরেসুস্থে গাড়ি স্টার্ট করলো। টান মেরে চলল মাদারীপুরের উদ্দেশ্যে। এমন সুযোগ বারবার আসবে না। সে সৎ ব্যবহার করবে এই সুযোগের। অবশ্যই!

শান্ত। ভীষণ শান্ত চারিপাশ। কোনোপ্রকার শব্দ নেই কোথাও। শাবিহা চোখ পিটপিট করছে। উঠবে উঠবে ভাব। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে। আরাম করে। শরীর মুচড়ে ওঠতেই অয়ন বা’হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল। শাবিহা মুহুর্তে লাফিয়ে উঠে গেল। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে অয়নের দিক তাকাল। কখন ঘুমিয়েছে আর কখনউ বা অয়নের পায়ে পৌছেছে? বিভ্রান্ত হয়ে গুটিশুটি মেরে বসলো। আঁড়চোখে অয়নকে বারবার দেখে নিল। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। চোখমুখ ছোট হয়ে আছে ঘুমের অভাবে। নিরামিষ ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছে। শাবিহার মায়া হলো। বুকটা আনচান করতে লাগলো। ধীর গলায় শুধালো, ‘একটু ঘুমিয়ে নিবে?’
‘মাস খানেকের ঘুম জড়ো হয়েছে। একটুখানি ঘুমে কিছু হবেনা। অনেক ঘুমাতে হবে।’

শাবিহা চুপ মেরে গেল। অয়ন আঁড়চোখে তাকিয়ে পুনরায় বলল, ‘তোমাকে দেখেছি, ছুঁয়েছি। এখন ভালো ঘুম হবে। তবে ঘুমের জায়গা নেই। অদ্ভুত!’

শাবিহা কথা ঘুরিয়ে বলল,’কোথায় যাচ্ছি?’

অয়ন জবাব দিল না। তবে এবার গাড়ি টেনে চলেছে বিচলিত হয়ে। চারপাশে তাকাচ্ছে বারংবার। যেমন ভালো জায়গা খুঁজছে। একটি শুনশান কোলাহল বিহীন বাড়ির সামনে থামাল গাড়ি। বাড়িটি পাঁচতলা। বেশ দূরে। আশেপাশে আর বাড়ি নেই। তাদের চারপাশে গাছপালা আর ঘাস। অয়ন বেরোলো। অপরপাশে এসে শাবিহাকে বের করল টেনে। পেছনের দরজা খুলে শাবিহাকে বসিয়ে, উল্টো ঘুরে সেও গিয়ে বসলো। ভেতর দিয়ে সম্পুর্ন গাড়ি লক করে ফেললো। হাতপা মেলে মাথাটা শাবিহার কোলে রেখে শুয়ে পড়লো। মুহুর্তে চোখবুঁজে ঘুমিয়ে গেল। শাবিহা স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমুঢ়! চমকে বসে রইল। চোখজোড়া এখনো পলক ফেলতে সক্ষম হয়নি।
____________
লঞ্চ থেকে সকলে নামতে ব্যস্ত। কেউবা নিজেদের ল্যাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে কথাবার্তায় মশগুল। মধ্য দিয়ে মাহিন অরুর সেলফোন হাতে দাঁড়িয়ে। সেলফোন খানা লাগাতার বেজে উঠছে। সেকেন্ডের জন্য ওফ হয়ে আবারো বেজে উঠছে। এমন ভোর সকালে কার এতো তাড়া? পৃথিবী এখনো অন্ধকার। সূর্য উঠেনি। অথচ কলকারী ব্যক্তি বড্ড তাড়াহুড়ায় যেমন। অরুকে ডেকে ফোন দিবে তারও উপায় নেই। সে এখনো ছাঁদে। রুস্তমের সাথে কাজ করছে। একটুপর নামবে। অন্যদিকে তন্ময় অরুকে নিয়ে নেমে গিয়েছে। সেলফোন ভুল বসত ফেলে গিয়েছে। যেটা আপাতত তার হাতে। স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে লেখা ভেসে উঠেছে ‘ফার্মের মুরগী’। নামের কারণে মাহিনের অ্যাটেনশন বৃদ্ধি পেল। কল রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো। তবে পারমিশন বিহীন অন্যের কল রিসিভ করা মোটেও সভ্যতার কাতারে পড়ে না। তাই ধরছে না। সেলফোন পকেটে ঢোকাবে সেমূহুর্তে আবারো কল।

উপায় না পেয়ে, পাশ কেটে একটু দূরে গেল। কলটা রিসিভ করলো। ধমকের সুরে কিছু বলবে পূর্বেই ওপাশ হতে একটি পুচকে মেয়েলী কন্ঠের স্বরে পকপক করে উঠলো, ‘এতো কীসের ব্যস্ততা। সকাল হবে প্রায়। রাতের এক্টিভিটিস তো শেষ, মনে হয়। শোন এখন তাড়াতাড়ি সবকিছু ডিটেইলসে খুলে বল। কি কি করলি! কিচ্ছু মিস দিবিনা। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তোদের কাহিনি শুনব বলে। তাড়াতাড়ি বল! তন্ময় ভাই তো মনে হয়…

মাহিন হকচকিয়ে গেল। আনমনে খু খু শব্দে কেশে উঠলো। তালুতে পানি উঠে গেছে যেমন। চোখ বড়বড়। এমন অসভ্য কথাবার্তা মেয়েদের মুখ থেকে শুনতে সে অভ্যস্ত নয় মোটেও। মোটামুটি তার মুখটাও হা হয়ে গিয়েছে। ওদিকে মারজির বকবকানি থেমে গেল। গলার স্বর চওড়া হলো, ‘কে?’
‘মাহিন।’
‘ওই মিয়া! কল ধরে কথা বলেন না কেন! অসভ্যের মতো শুনে যাচ্ছিলেন। ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নাই নাকি!’

চমকিত মাহিন কিছু বলবার ভাষা খুঁজে পেল না। কথা বলার সময় দিল কই? অসভ্য মেয়েটা তো বকবক করেই গেল। তাকে আরও চমকে মারজি বলল, ‘এইযে মিয়া। অরুকে ফোন দেন। তাড়াতাড়ি। খুব দরকার। কই ও? আপনি কী হোন? ফোন আপনার কাছে কেন!’

মাহিন মেয়েমানুষ দেখেছে অনেক। তবে এমন ঝাঁজালো মেয়েমানুষ দেখেনি। তাও এতটা নির্লজ্জ। কন্ঠ শুনে তো পুচকে মনে হলো। এমন চটাং চটাং কথাবার্তা শিখেছে কোথার থেকে এই মেয়ে? মাহিন ভাষা হারিয়ে বিনাবাক্যে ফোন কানে ধরে রাখল। ওপাশে মারজি চেঁচিয়ে চলেছে, ‘বোবা নাকি! মাহিন এর পর কী আর কোনো কথা নেই আপনার ডিকশিনারি’তে! পড়েন কীসে! কোন কলেজ! নাকি ভার্সিটি। ভদ্রতা জানেন না৷ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়। এভাবে অন্যের ফোন ধরে চুপ থাকতে নেই। শুনুন……’
‘নাম কী?’

মাহিন আনমনে প্রশ্ন করল।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মারজি, ‘নাম কী মানে! দেখেন না স্ক্রিনে? অশিক্ষিত নাকি?’
‘ফার্মের মুরগী।’

মারজি চুপসে গেল যেমন। সে ফট করে কল কেটে দিল। এপাশে মাহিন সবে ঘোর হতে বেরিয়েছে, নরম কন্ঠের তেতো কথাগুলোর সমাপ্তি ঘটায়। স্ক্রিনে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করলো, ‘মেয়ে নাকি আগুন এটা!’
________
নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ঢাকা বিভাগের একটি জেলা। রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী একটি শহর এবং সদরদপ্তর। অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ সোনারগাঁও এ জেলার অন্তর্গত।
এই শহর জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের ৪৩টি বৃহত্তম শহরের মধ্যে এটি ১৩তম। শহরটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এভাবেও নারায়ণগঞ্জ বন্দর দেশের বৃহত্তম নদীবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। এছাড়াও এটি পাট বাণিজ্য ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা এবং দেশের টেক্সটাইল সেক্টরের ব্যবসা ও শিল্পের একটি কেন্দ্র। অনেক পাটকলের উপস্থিতির কারণে এটিকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নামে ডাকা হয়। ৬৮৩.১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলাটি ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে ছোট জেলা। রাজধানী ঢাকার সাথে এ জেলার সীমানাও রয়েছে। নামার সময়টায় ভালোভাবে নজর বোলালে বোঝার উপায় আছে। সঙ্গে আশপাশে দেখা মিলে নতুন প্রকৃতির।

ভ্রমণের উদ্দেশ্যে অনেকে মিলেমিশে এসেছে ঠিক, তবে এখন বিদায়ের পালা। দল নিয়ে একেকজন একেক হোটেলে উঠবে। নিজেদের মতো বেরিয়ে পড়বে। কেউ হোটেল, কেউবা রিসোর্টে। নিজেদের মতো ঘুরেফিরে ঠিক সময় ফিরে আসবে। এমনটাই বলা আছে। অন্যদিকে তন্ময়দের হোটেল বা রিসোর্ট নিতে হবে না। মাহিনের নানার বাংলো আছে ইস্টে। সেটা ফাঁকা করা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব মিলে তারা সেখানেই থাকবে বলে আলোচনা করা আছে। গাড়ি এসেছে পাঁচটা। মিলেমিশে এগুলোর মধ্যে চড়বে। কেউবা এখনই নারায়ণগঞ্জ ঘুরতে বাইক ভাড়া করে ফেলেছে। ঘুরেঘুরে যাবে।

তন্ময় ল্যাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আছে সে। ঘেমে-নেয়ে একাকার। শার্ট পেছন দিয়ে ভিজে উঠেছে।পাশে অরু দাঁড়িয়ে। সেও হাসফাস করছে গরমে। এখানে উপস্থিত সকলেই ক্লান্ত এবং গরমে অতিষ্ঠ। আজ ভাপসা গরম খুব বেশি। তাদের সামনে গাড়ি। বড়ো গাড়ি। সাত আটজন নির্দ্বিধায় এটে যাবে। মাহিন এবং রুস্তম আসলেই উঠে পড়বে গাড়িতে। রিহান কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘অরু ভেতরে বসো শুহানির সাথে। যেই গরম!’

তন্ময় মাথা দোলাল। ল্যাগেজ পেছনে রেখে ফিরে আসল। অরুকে ভেতরে বসিয়ে দিল। শুহানি ততক্ষণে অন্যপাশ হয়ে উঠে বসেছে। বাইরে তন্ময়, ইব্রাহিম, রিহান এবং সৈয়দ দাঁড়িয়ে রইলো। মাহিন এবং রুস্তম এলেই গাড়ি স্টার্ট করা হবে। দুটো গাড়ি অলরেডি বেরিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল দুজনকে। কাছাকাছি আসতেই গাড়িতে উঠে বসল সকলে। ড্রাইভিংয়ে রুস্তম বসেছে। পাশে সৈয়দ। পেছনের সাড়িতে অরু আর শুহানি। মিডেল
সাড়িতে তন্ময়, মাহিন, ইব্রাহিম এবং রিহান। গাড়ির এসি বন্ধ করে দেওয়া হলো। চারপাশের কাঁচ খুলে দিল। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মুহুর্তে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে ঝিম লাগিয়ে দিল একেকজনের শরীর।

অরু পিপাসিত দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার কাটিয়ে পৃথিবীর বুকে সূর্য উঠবে যেকোনো সময়। সুর্যস্তর দেখার বড্ড সখ অরুর। আজ দেখতে পাবে স্পষ্ট ভাবে। কোনো এক নদীর সামনে গাড়ি থামালে মন্দ হয়না। এদিকে প্রকৃতিতে বাতাসের তীব্র হুংকার তুলছে। চোখ বন্ধ করে ফেললো অরু। প্রাণবন্ত প্রকৃতির ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুনরায় চোখ মেলে তাকাতেই দেখল গাছপালা আর নদী।

মাহিন হুট করে ডাকল। অরু ঘুরে তাকাল, ‘জি ভাইয়া!’

মাহিন সেলফোন এগিয়ে দিল। উদ্ধিগ্ন তার দৃষ্টি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। ভেবেচিন্তে শুধালো, ‘ফার্মের মুরগী কে? কল এসেছিল।’

অরু হাসল, ‘মারজি। আমার ফ্রেন্ড।’
‘ওহ। কোথায় থাকে?’
‘পাশাপাশি৷ আমাদের লাইনের মাথার বাড়িটা ওদের।’
‘খুব কথা বলে তাই না? মানে পকপক করে সারাদিন?’

অরু মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ! ওই একটু আরকি।’
‘একই নৌকার মাঝি!’

অরু ভাষাহীন দৃষ্টিতে তন্ময়ের দিক তাকাল। তন্ময় ও তাকিয়ে। হাসি হাসি মুখশ্রী। নরম দৃষ্টি। একদম আদুরে। অরুর বক্ষস্থলে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ইচ্ছে করলো দৌড়ে গিয়ে তন্ময়ের কোলে চড়তে। শব্দ করে দু’গালে গালে চুমু বসাতে। গালে গাল ঘষতে। কিন্তু তা অসম্ভব। লাজুক অরুর জন্য অসম্ভব। উদ্বিগ্ন মন নিয়ে সে প্রকৃতিতে ধ্যানমগ্ন হলো পুনরায়।
_________
সাদা রঙের ডিজাইনিং বাংলো৷ ছয় একর জমিতে গড়া৷ চারপাশ হতে লম্বা দেয়াল টানা। দারোয়ান দাঁড়িয়ে। দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি গুলো একেক করে ঢুকছে৷ দুপাশে বাগান গিয়েছে। মাঝে চওড়া রাস্তা। বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানেই পার্ক করেছে গাড়িগুলো। ভেতর হতে বেরিয়ে এসেছে করীম চাচা। কেয়ার টেকার তিনি। সঙ্গে দুটো কাজের লোক এনেছেন। ল্যাগেজ ভেতরে নিবেন বলে। মাহিন একটি ল্যাগেজ স্পেসিফিকলি দেখিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘চাচা! এই ল্যাগেজ দোতলার কর্নার রুমে নিতে বলবেন।’

তন্ময় কপাল কুঁচকে বসলো। ল্যাগেজটা তার। এটা স্পেসিফিকলি দেখানোর মানে কী? অন্যদিকে রিহান হো হো শব্দে হেসে উঠলো। যেমন সে অনেক কিছুই জানে। তবে বলবে না। ব্যস্ত পায়ে ভেতরে যেতে নিয়ে বলল,’আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। বিকেলে বেরোতে হবে তো। জান তুমি আসো তাড়াতাড়ি।’

শুহানিও মিটিমিটি হাসছে। আলগোছে সেও রিহানের পিছুপিছু চলে গেল। রুস্তম ও আর দাঁড়িয়ে নেই।মুহুর্তে সবাই একেক করে কেটে পড়েছে। শুধু মাহিন দাঁড়িয়ে। ভুবনমোহিনী চেহারা নিয়ে। তন্ময় সন্দেহজনক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী ঝামেলা পাকিয়েছিস?’
‘এই চিনলি বন্ধুরে? দেখলে অরু! এভাবে বন্ধুত্ব টেকসই হয়না৷ প্যাপার্স রেডি করি গিয়ে। এখানেই বন্ধুত্বের ইতি টানব। মানে আমাদের ডিভোর্স!’

অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখিয়ে সামনে অগ্রসর হলো মাহিন। পেছনে রেখে গেল বোকা অরু এবং অতিষ্ঠ তন্ময়কে। দুপাশে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে তন্ময় অরুকে নিয়ে এগোল। দেখানো রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশের কক্ষটি রিহান আর শুহানির। তারা দুজন ইতোমধ্যে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। সেদিকে ধ্যান নেই অরুর। সে অবাক দৃষ্টিতে তাদের রুমের দরজার পানে তাকিয়ে। সাইনবোর্ড লাগানো সেখানে। বড়বড় অক্ষরে লেখা, ‘নিউলি ম্যারিড কাপল, ডু নট ডিস্টার্ব!’

অরুর বুক অজানা আশঙ্কায় ধুক করে উঠলো। মুচড়ে উঠলো ভেতরটা। তন্ময় ভেতরে ঢুকেছে খানিক্ষন হয়েছে। ছোট পা ফেলে অরুও পেছন পেছন ঢুকলো। ঢুকে তৎক্ষণাৎ মুখে দুহাত চেপে ধরল। সম্পুর্ন রুম ফুলের বাগানে রুপান্তরিত হয়েছে। বাসর রাতের ঘর সাজানো যাকে বলে। অরুর হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে হৃদয়। তন্ময়ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে যেন। অগোছালো পায়ে বেরিয়ে পড়ল। শব্দ করে, ‘মাহিন!’ বলে চেঁচাল।

মাহিন ততক্ষণে নিজের রুম লক করে ওয়াশরুম ঢুকেছে। শুধু সে নয়। সবগুলো রুম লকড। কাউকে ধরতে না পেরে তন্ময় ফিরে আসল। অরু তখনো দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে থাকবে না তো কী করবে? বসবার যায়গা কই? যেখানে তাকাচ্ছে সেখানেই ফুল। হরেকরকম ফুল। বাগানের সব ফুল এই কক্ষে নিশ্চিত। চোখমুখ জ্বলছে। নিশ্চয়ই লালচে হয়ে গিয়েছে। তন্ময় গলার স্বর শক্ত করার সামান্য চেষ্টার উদ্দেশ্যে বলল, ‘পড়ে কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিব। আপাতত ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে।’
‘আ..আচ্ছা।’

তন্ময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। নজর বিছানায় সীমাবদ্ধ। সে সময় নিয়ে পুনরায় বলল,’এসব… এসব কী তোর খারাপ লাগছে? ছিঁড়ে ফেলব?’

অরু চোখ তুলে তাকাল। তার লাজুক দৃষ্টি থমকে গিয়েছে। তন্ময়ের দৃষ্টি দৃঢ়। যেমন সে ‘হ্যাঁ’ বললেই সবকিছু ছিঁড়ে ফেলবে। দুজনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। অরু থরথর করে কাঁপতে থাকা, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। লজ্জা, দ্বিধা উজাড় করে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। খুব কষ্টে, আটকে যাওয়া গলায় জবাব দিলো, ‘না। আমার খারাপ লাগছেনা। ছিঁড়বেন না।’

পরপর অরু কম্পিত পায়ের ধাপ ফেলে ল্যাগেজ খুলল৷ কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুম ছুটল। এই বিছানায় সে কীভাবে ঘুমাবে? অরুর যে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে এখনই। তা কী উপলব্ধি করতে পারছে লোকটা?

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here