প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫১,৫২

0
1799

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫১,৫২

৫১.
মাহিনের হাতে সেলফোন। স্ক্রিনে একটি নাম্বার। কল দিতে নিয়েও সংকোচবোধ করছে। হাসফাস করছে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সে। বড়সড় কোম্পানি চালায়। শত মানুষ তার ইশারায় চলে। আর সে কিনা এক পুচকে মেয়ের ঝাঁজালো কন্ঠের স্বরে ব্যাকুল হয়ে গেল। এসব আদৌ মানা যায়? অল্পবয়সী ছেলেদের মতো হৃদয় ব্যাকুল হবার দিন কী তার আছে? তাও আবার একটুখানি মেয়ে! উর্ধ্বে গেলে চার-পাঁচ বছরের গ্যাপ মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এতটা! মাহিন দ্বিধায় জর্জরিত। মন ভেবে বসলো শুধু একটু কথাই তো। ক্ষতি কী! পুচকে মেয়েটাকে একটু বাজাবে। বেশ খানিক্ষন বিবেচনা করে এই রাতবিরেত কল লাগালো মাহিন। ওপাশে রিং হয়ে যাচ্ছে। রিসিভ হচ্ছে না। শেষমুহুর্তে রিসিভ হলো। শান্ত কন্ঠের স্বরে পকপক করে উঠলো, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, দ্রুত কথা বলে ফুটে পড়।’

মাহিনের ঠোঁট জুড়ে হাসির বিচরণ। হাসি দমিয়ে শুধালো, ‘আত্নীয় স্বজন কিংবা মুরব্বি কেউ হতে পারতো। তখনো এভাবে কথা বলতে?’
‘দেখেন ভাই! এটা আমার পার্সোনাল নাম্বার। বেস্ট ফ্রেন্ডস ছাড়া কেউ জানে না। তাই মুরব্বিদের কল আসার চান্স নেই। এখন ভালোয় ভালোয় নিজের পরিচয় দিয়ে দেন। কোন ভার্সিটি, কোন ইয়ার, নাম কী, ফোন নাম্বার কে দিল…’
‘আমি মাহিন।’

মারজি থমকে গেল। মনে পড়লো তখনকার ভদ্রলোকের কথা। চাহনি কঠিন হলো। মুখশ্রী শক্ত হলো। কন্ঠের স্বর ঝাঁজালো, ‘কী সমস্যা মিস্টার! ডিস্টার্ব করার ধান্দায় আছেন নাকি! আমার চাচা পুলিশে। কমপ্লেইম করে দিলে সোজা হাজতে বুঝলেন। ভালোয় ভালোয় শুধরে… ‘
‘পড়াশোন কেমন চলছে!’
‘আপনাকে বলবো কেন!’
‘খাওয়া দাওয়া হয়েছে!’
‘এই মিয়া!’

মাহিন নিঃশব্দে হাসলো, ‘হু!’
‘কি ব্যাপার বলেন তো!’
‘ব্যাপারটা একটু ডিফিকাল্ট এক্সপ্লেইন করা। উম, এতো ঝাঁজালো কন্ঠ সচরাচর শোনা হয়না আমার। হঠাৎ শুনেছি তো। নিতে পারিনি। বুকে গেঁথে গেছে। তাই ভাবলাম আরেকবার শুনে নেই।’

কিছুক্ষণ ওপর পাশ হতে নিরবতা। পরপর টুট শব্দে কল কেটে গেল। মাহিন নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা বড্ড নাজুক, একটু লাজুক ও বটে। শুধু মুখেই সব চঞ্চলতা। এই চঞ্চল মেয়েটাকে মাহিনের দেখার স্বাদ জেগেছে। খুব করে দেখতে ইচ্ছে করছে। কেমন হবে দেখতে? কন্ঠের স্বরের মতো ঝাঁজালো নাকি নরম তুলতুলে? যুবক বয়সে চুটিয়ে প্রেম করেছে কতশত। কই এমন অনুভব তো কখনো করেনি!
_________
তন্ময়ের ধৈর্যের সকল বাঁধ আজ যেমন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তার ব্যাকুলতা অরুর নরম তুলতুলে শরীরে তুফান উঠিয়ে ছেড়েছে, বিধস্ত করে ছেড়েছে। এখন মধ্যরাত। নিস্তব্ধ, নির্জন কক্ষ। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে তিনটে বিশে। মেঘেদের রাজত্ব শুরু হয়েছে আকাশের বুকে। চাঁদ হারিয়ে গিয়েছে। পুনরায় দেখা মিলেছে কালো মেঘের। চাঁদের আলো বিহীন কক্ষটি আঁধারে তলিয়ে গেল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরছে বাহিরে। ভেজা ভেজা শব্দ তুলছে প্রকৃতি। খোলা জানালা দ্বারা দুমড়ে প্রবেশ করছে দমকা হাওয়া, সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা। দু’ধারে মেলে দেওয়া সাদা পর্দা গুলো শান্ত নেই। অশান্ত বেগে দুলছে। কক্ষে ফুলের সুবাস। সুবাস লেপ্টে চারিপাশে। গোলাপ, জবা এমন হরেকরকম ফুলের সুগন্ধী মিলেমিশে অনাকাঙ্ক্ষিত সুবাসের উৎপত্তি ঘটেছে।অরু অর্ধজ্ঞান। আবছায়া হয়ে সবকিছু উপলব্ধি করতে পারছে। তার নিশপিশ চোখের পাতা মৃদু কাঁপছে। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠছে একটু পরপর। মুচড়ে উঠছে শরীর। ব্যথাতুর মায়াবী মুখশ্রী লাল বর্ণে রাঙিয়ে।

তন্ময় পাজাকোলে অরুকে তোলার প্রচেষ্টায়। দু’হাতে তুলতে নিলেই অরু অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে দেয়। শরীরে সামান্য নড়াচড়া টুকুও সহ্য করছে না। একেকটি শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গেও ব্যথা জর্জরিত হয়ে আছে যেন। তন্ময় পুনরায় কোমর বেঁকিয়ে ঝুকে। বিছানার চাদর সহ অরুকে হুট করে ফট করে পাজা’কোলে তুলে নেয়। অরুর নাজেহাল অবস্থা! সে চোখ মেলে তাকাতে চায়। জানতে চায় তন্ময় এখনো এমন কেন করছে! তুলতুলে বিছানায় ঘুমোতে কেন দিচ্ছে না! অস্পষ্টভাবে চোখ মেলে তাকায় বহুক্ষণ পর। সে ওয়াশরুম। তন্ময় তাকে আড়ষ্টভাবে জড়িয়ে। পরপর ঠান্ডা পানি শরীর ছুঁতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মৃদু আর্তনাদ করল, ‘জ্বলছে!’

তন্ময়ের ধীর গলার স্বর ‘একটু সহ্য করে নে জান।’

চোখের কোণ ভিজে গিয়েছে অরুর। শরীর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে যেন। তন্ময়ের বাহু থেকে ছোটার আপ্রান চেষ্টা। তাকে ছোটার সুযোগ দেওয়া হলোনা। পুনরায় একজোট পানি এসে ছুঁয়ে গেল। গোসল করতে হচ্ছে! এতরাত করে! তন্ময়ের হাতে! তাও ঠান্ডা আবহাওয়ায়। লজ্জায় হতভম্ব অরুর জমিন ফাঁক করে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। তবে সেই শক্তিটুকুও নেই। সে’তো অজ্ঞান হবার পথে।

সোফায় শুয়ে আছে অরু। জড়সড় হয়ে। শরীরে শার্ট জড়ানো। তন্ময় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ হবে। অস্পষ্ট ভাবে শুনতে পারছে ওয়াশরুম হতে আসা পানির শব্দের। তন্ময় গোসল নিচ্ছে। সময় নেয়নি বেশি। খুব দ্রুত ফিরে এসেছে। কোমরে তোয়ালে পেঁচানো। এসেই বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে নিয়েছে। ইতোমধ্যে অরুকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। পাতলা কম্বল শরীরে মেলে রেখেছে। জানালার পর্দা টেনে দিল। তবে জানালা লাগালো না। মেলে রাখল। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। অরু বিছানায় হাসফাস করছে। ছটফট করছে। বড্ড অশান্ত সে। যন্ত্রণায় পেট গুলিয়ে আসছে। তন্ময় প্যান্ট পরে ফিরে এসেছে। আলগোছে অরুর পাশে বসেছে। কপালে হাত ছুঁয়েছে। ভেজা চুল মেলে দিয়েছে, ‘খুব খারাপ লাগছে?’

দুর্বল হাতে অরু তন্ময়ের হাত ধরলো। হালকা টান লাগালো। অনুসরণ করে তন্ময় বিছানায় পা ওঠাল। পাশে শুয়ে পড়লো। অরু মুহুর্তে তন্ময়ের খোলা প্রসস্থ বুকে থুবড়ে লেপ্টে গেল। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এতটুকু ব্যথা সে চুপসে সহ্য করে নেবে, যদি তন্ময় তার পাশে থাকে। তার কাছে থাকে। তাকে ধরে রাখে। তার যত্ন করে। আদর করে। তাকে আদুরে গলায় ছোট নামে ডাকে! এসবের জন্যে হলেও অরু এতটুকু কষ্ট সহস্রবার সুগভীরে মেনে নিবে। দুর্বল কন্ঠে বলল, ‘খারাপ লাগছে না আমার। একটুও লাগছে না।’

তন্ময় অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে সমানে। কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। মুখশ্রী করুণ দেখাল। ব্যাকুলতা আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেপ্টে রয়েছে। বড্ড হেল্পল্যাস লাগছে তাকে। অরুর পিঠে থাকা হাতের বাঁধন দৃঢ় হল। আঁধার কক্ষে তার গলার স্বর বড়ো গভীর, ‘তোর সব কষ্ট আমার হোক।’
___________
‘শাবিহা!’

নরম মৃদুস্বরে নড়েচড়ে ওঠে শাবিহা। চোখ মেলে তাকায়। মুখের সামনে ঝুকে অয়ন। পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে। শাবিহা ভড়কে গেল। অয়ন শুধালো, ‘খিদে পেয়েছে না!’

শাবিহাকে মুহুর্তে চিন্তিত দেখাল। হাত ঘড়িতে রাত তিনটা ত্রিশ। এতরাত করে কোনো হোটেল রেস্টুরেন্ট কি খোলা? তার খাবারের বিষয়টা মাথায় আসেনি। আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অসহায় গলায় বলল, ‘আশেপাশে হোটেল আছে? এতরাতে খোলা পাব?’

অয়ন হাসলো, ‘খাবার নিয়েছি।’

চমকাল শাবিহা, ‘কখন?’
‘তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যখন।গাড়িটা কোথাও সাইড করে নেই। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে তাই না? আমারও। আজ জম্বেশ খেতে পারবো বুঝলে। খাবার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকবে না!’

শাবিহা অগোচরে তাকাল। মন খারাপ করল। নিঠুর অয়ন! কি সুন্দর অনায়াসে বলে দিল। কই শাবিহাও তো পর্যাপ্ত ঘুমোতে পারেনি, খেতে পারেনি। সে তো এভাবে বলতে যাচ্ছে না। অয়ন পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করেছে। শাবিহা আলগোছে নিজের পেট ছুঁয়ে দিল। আসলেই অসম্ভব খিদে পেয়েছে তার। চোখের তৃষ্ণা মিটেছে ওমনি পেটের গহ্বর বেজে উঠছে।

বৃষ্টিস্নাত রাতে গাড়ি মেঠোপথ ধরে যাচ্ছে। কাঁচে স্পষ্ট বৃষ্টির রেখা বইছে। বাহিরে সবুজ গাছপালাদের ভেজা-ভেজা দৃশ্য। রাস্তাঘাট পরিষ্কার এবং নির্জন। আশেপাশে গাড়ি নেই। শুধু তাদের গাড়ি একান্তই ছুটে যাচ্ছে। শাবিহা দু’বার কাঁচ নামিয়েছে। অয়ন নির্বিকার ভঙ্গিতে লাগিয়ে দিয়েছে। খুলতে দিচ্ছে না। শাবিহা শক্ত চোখে তাকাল, ‘কি সমস্যা!’
‘অনেক সমস্যা!’
‘পাগল।’
‘শুধু তোমার জন্য।’

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অয়ন। শাবিহার মুখশ্রীতে রাগরাগ ভাব লেপ্টে। তবে সত্যিকার অর্থে তার রাগ লাগছে না। বরং আড়চোখে অয়নের হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখে, তারও হাসতে ইচ্ছে করছে।
অন্যপাশ ফিরে নিঃশব্দে হেসেও নিল। নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, ‘কাঁচ নামাতে দিচ্ছ না কেন!’
‘এসি ছাড়া!’
‘বন্ধ করে দাও।’
‘বৃষ্টি আসে।’
‘ফোঁটা ফোঁটা! ঝুম বৃষ্টি নামেনি তো।’
‘ভিজে যাবে। ঠান্ডা লাগবে।’
‘অয়ন তুমি কী খুলবে?’

এসি বন্ধ করে অয়ন কাঁচ নামিয়ে দিল শাবিহার পাশের। মুহুর্তে ঠান্ডা হাওয়া বেগতিক বেগে ছুটে এলো। চোখমুখে ছিটিয়ে দিল ঠান্ডা বৃষ্টির স্পর্শ। চোখবুঁজে এলো শাবিহার। শান্তিতে বুকে স্রোত বইছে। চোখ মেলে তাকাল। স্বতঃস্ফূর্ত নিয়ে বলল, ‘গান ছাড়ো!’

অয়নের ইচ্ছে করছে গাড়িটা থামাতে। অনিমেষ নজরে শাবিহাকে দেখতে। কতটা আদুরে লাগছে সেটা কী জানে? একনজর দেখে হাত বাড়িয়ে রেডিও ছাড়লো। একটা গান প্লে হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির গান। গানটি শাবিহা বেশ কয়েকবার শুনেছে। একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখনো অনেকেই শোনে। গানের সঙ্গে অয়ন শব্দ করে গাইতে শুরু করলো,
‘রিমঝিম এ ধারাতে চায় মন হারাতে
এই ভালোবাসাতে আমাকে ভাসাতে।
এলো মেঘ যে এলো ঘিরে
বৃষ্টি সুরে সুরে শোনায় রাগিনী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো,
এই কি শুরু হল প্রেমের কাহিনী ।

হুট করে ঘুরে তাকাল অয়ন। দৃষ্টি ঠেকল শাবিহার অপলক মুগ্ধ নয়নে। চোখাচোখি হলো। শাবিহা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ব্যস্ত হাতে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজতে লাগলো। অয়ন শব্দ করে হাসলো। দৃষ্টি সামনে রেখে বলল, ‘তুমি একজন বেস্ট ভাই পেয়েছ শাবিহা!’
‘হু? হ্যাঁ। সে তো সর্বদাই বেস্ট। সবকিছুতে বেস্ট!’
‘তন্ময় ভাই আর অরুর বিয়েটা মেনে নিয়েছে? কোনো গন্ডগোল হয়নি?’

শাবিহা ভাবুক হয়ে পড়লো, ‘সপরিবার রাজি। শুধু আত্নীয় স্বজন নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল। এখন ঠিকাছে। অরু ছোটো। সবে ইন্টার শেষ করেছে। বাবা এরজন্য দোটানায়। ভাবছে অরুর উপর চাপ না পড়ে যায়। পড়াশোনায় অমনোযোগী না হয়ে পড়ে!’
‘অরু তো পাগল তন্ময় ভাইয়ের জন্য। ছোটাছুটি করতে থাকে পিছেপিছে। ওকে বেশ হ্যান্ডেল করতে পারে ভাইয়া। বিয়েটা মেনে নিলে তো আরও ভালো হয়। পড়াশোনায়ও দুর্দান্ত করবে।’
‘এখনই না। অনুষ্ঠান করবে। বছর খানেক সময় নিবে হয়তো!’
__________
নতুন দিনের সূচনা। রাতের বৃষ্টির ছিটেফোঁটা নেই। সূর্য উঠেছে। সাদা পাতলা পর্দা ভেদ করে আসছে আলো। অতিষ্ঠ হয়ে চোখ মেলে তাকাল অরু। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো সিলিন ফ্যানের দিক বেশ কিছুক্ষণ। অদ্ভুত সব দৃশ্য মস্তিষ্কে হানা দিতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। দ্রুত পাশে ফিরল। তন্ময় নেই। কক্ষের কোথাও নেই! স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে, উঠে বসতে নিতেই লজ্জায় কুঁচকে গেল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। এসব কী হয়ে গেল! অরু বাকরুদ্ধ! বিমুঢ়! বড্ড অস্থির। গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ। শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিল। কম্বল সরাতে নিয়ে আবারো পেঁচিয়ে নিল। তন্ময়ের শার্ট শরীরে শুধু। ইশ!

অরুর বক্ষস্থলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ধুকপুক ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। মস্তিষ্কে বেজে উঠছে তন্ময়ের বলা সব আদুরে কথাবার্তা। দূর হতে পায়ের শব্দ ভেসে আসছে। অরু হন্তদন্ত ভঙ্গিতে পুনরায় শুয়ে পড়েছে। কম্বল মাথা অবদি টেনে নিয়েছে। নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে রেখেছে। এই মুখ সে তন্ময়ের সামনে কীভাবে নিবে! অরু বেশ উপলব্ধি করতে পারছে একজনের অস্তিত্ব। তন্ময় বিছানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কম্বল মুখের সামনে থেকে নামাতে চেয়েছে। অরু শক্ত করে ধরে রাখল। তন্ময় ডাকল, ‘অরু!’

অরু অস্পষ্ট স্বরে আওড়াল,’হু।’

জবাব দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। মুখটা এতো আগে আগে চলে কেন! তন্ময় বলল,’উঠে বোস। খেয়ে নে প্রথমে। ওষুধ খেতে হবে।’
‘না।’
‘আমার দিকে তাকিয়ে বল।’

অরু নাকমুখ কুঁচকে রাখল। ধমকানো হচ্ছে! রাতে, জানপ্রাণ, শোনা কে ডাকল! অরু নির্লজ্জ হলে ঠিক মুখের উপর বলে দিতো। দুষ্টু লোক! তন্ময় কিছুটা শক্তি প্রয়োগ করেই সরিয়েছে কম্বল। অরু এবার দু’হাতে মুখ ঢেকে রাখল৷ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে তাকাল৷ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল। তাজ্জব বনে অরু আবারো শক্ত করে চোখ ঢেকে ফেললো। তন্ময়ের গলার স্বর নরম হয়ে এলো,
‘খারাপ লাগছে? ব্যথা হচ্ছে?’

লালিত মুখশ্রী ঢেকে রাখা অরু মাথা নাড়াল, ‘অল্প!’
‘ঔষধ নিলে চলে যাবে।’

অরু হাত সরাল। আঁড়চোখে তাকাল। তন্ময় প্যান্ট শার্ট পরে ফিটফাট হয়ে আছে। পারফিউম ঘ্রাণ আসছে নাকে। অরুর চোখের সামনে ভেসে উঠল তন্ময়ের নগ্ন সুঠাম দেহের দৃশ্য। লজ্জায় কাবু হয়ে পড়লো মুহুর্তে। অরুকে চমকে তন্ময় হুট করে মাথা ঝুকাল। তার ঠোঁটে শক্ত চুমু খেয়ে বসলো আচমকা। বড়সড় চোখে তাকানো অরুর ঠোঁটে আরেকদফা চুমু পড়লো।

ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে। ঔষধ তন্ময় নিজ হাতে এগিয়ে দিয়েছে। অরু প্রশ্ন করল, ‘কীসের ওষুধ?’
‘ব্যথার।’

অরু মুখে পানি নিয়ে খেল। পরপর আরেকটি ওষুধ এগিয়ে দিল তন্ময়। অরু এবারও প্রশ্ন করল, ‘এটা কীসের ওষুধ?’
‘চুপচাপ খা।’

বাইরে থেকে ইব্রাহিমের চওড়া গলা শোনা যাচ্ছে, ‘তন্ময় তাড়াতাড়ি আয়। দেখে যা…’
‘আসছি।’

তন্ময় পুনরায় অরুকে বলল, ‘খা।’
‘খাচ্ছি তো।’
‘খেয়ে নে, আমি একটু আসছি।’

টেবলেট তালুতে দিয়ে দরজার দিক অগ্রসর হলো। দরজার সামনে থেকে ফিরে তাকাল। পুনরায় খেতে বলে গেল৷ এতো তাড়া কীসের! অরু টেবিলের দিক এগোল৷ টেবলেটের পাতা রাখা। এখান থেকেই ওষুধ বের করেছিল। অরু নাম দেখল! কী মনে করে গুগলে নাম লিখে সার্চ করলো। ‘বার্থ কন্ট্রোল’!
সময় নিয়ে পড়লো। সবকিছু জেনে সে আর টেবলেট খেল না। আলগোছে জানালা দিয়ে ফেলে দিল।
____________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫২.
অয়ন লম্বা শ্বাস ফেলছে। মুখশ্রী বেশ করুণ। রুদ্ধশ্বাস নিয়ে একটু নরম গলায় বলল, ‘তোমার কী মায়া নেই? আমি কি এভাবে গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াবো? জানো, কতটা ঘুম পেয়েছে আমার? এভাবে ঘুমানো যায় না। শরীর ব্যথা করছে!’

শাবিহা চোরাচাহনি নিক্ষেপ করলো। প্রচন্ড মায়া হলো।তবে তার গলাটাও শুকিয়ে আছে। অনুভূতি ঝেঁকে বসেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে৷ অয়নকে সে কীভাবে বলবে, ভয়টা সে নিজেকে নিয়ে পাচ্ছে! নিজের উপর তার ভরসা নেই। খুব ভেবেচিন্তে ছোট গলায় বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’

অয়ন যেমন উগ্র সমুদ্রে জাহাজ পেয়ে বসেছে। উড়োজাহাজের গতিতে ছুটলো। বাছাই করা হোটেল রিসার্ভ করে রেখেছিল। সোজাসাপটা গিয়ে পৌছালো। শাবিহা বিরক্ত হলো বটে! ছেলেটা প্রচন্ড খারাপ। খারাপের ঘরে খারাপ। এতক্ষণ যাবত, মুখটাকে প্যাঁচার ন্যায় করে রেখেছিল।

খুব গোছালো দীর্ঘ কামরা। বড়ো বিছানা। শাবিহা ইনিয়েবিনিয়ে বলল, ‘আরেকটা রুম নেওয়া যাবেনা?’

অয়ন শুনেও যেমন শুনল না। টি-শার্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে মারল। প্রশস্ত দীর্ঘ পিঠ শাবিহার চোখের সামনে। বুকটা ধক করে উঠলো। দৃষ্টি নড়েচড়ে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত। এদিকসেদিক নজর ঘোরাতে চাইল। পারলো না। বেহায়া চোখজোড়া ফুলো বাহু দেখতে ব্যস্ত। ওয়ার্ক-আউট করা শরীর। দেখতেই আকর্ষণীয়। নজর ফেরানো দায়। অয়ন বেহায়ার ন্যায় ঘুরে দাঁড়ালো। শাবিহা গোপনে হাসফাস করে বারান্দার ছুতোয় চলে গেল। অয়ন আনমনে হাসলো। ওয়াশরুম গেল। শাবিহাকে সে মোটেও বিরক্ত করবে না। কোনো স্পর্শ করবে না। সে শাবিহাকে বাধ্য করবে, যেচে এসে তার স্পর্শ নিতে। তার স্পর্শের আকাঙ্খা গড়তে!
—–
‘পিল নিয়েছিস?’
‘হু!’
‘কই দেখি বড়ো হা কর।’
‘কীসের পিল ছিলো বলেন আগে!’

তন্ময় মহা বিরক্ত হলো। দু আঙুল দিয়ে অরুর ঠোঁট চেপে ধরলো। চোখ রাঙিয়ে ইশারায় বোঝালো, মুখ খুলতে। অরু তবুও খুলছে না। নাছোড়বান্দা! তন্ময় টেবিলের দিক এগোল। আরেকটি নিবে ঔষধ এমন হাবভাব! সেটা দেখে অরু ঘাবড়ে গেল। ছটফট করে মুখ খুলে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ালো, ‘এইযে দেখেন! আমি খেয়েছি। সত্যি। দেখেন…’

তন্ময় সেই ছোট্ট মুখের দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। গোলাপি ঠোঁট জোড়া দুপাশে ছড়িয়ে। ফুলোফুলো গাল জোড়া, খুব আকর্ষণ কাড়ছে। তন্ময়কে ডাকছে যেমন। সে মুখ বাড়ালো। শক্ত করে কামড় বসালো তুলতুলে নরম গালে। হঠাৎ আক্রমণে অরু তাজ্জব, কিংকর্তব্যবিমুঢ় এবং ব্যথিত! এমনটা তার তন্ময় ভাই করেছে বিশ্বাস করতে পারলো না। বড়ো বড়ো গোল চোখে দেখতে থাকলো। তন্ময় হাসলো নির্বিকার ভঙ্গিতে। হেসে গাল টেনে ধরলো, ‘ট্রাস্ট করবো?’
‘হু। আমিতো আমাদের ভালো চাই।’
‘আমাদের?’

অরু খানিক লজ্জাও পেলো! একটু কষ্ট ও পেলো। কিন্তু সে তো ভালোই চায়। তাই না? ভালোর জন্য একটু মিথ্যে বললে কিছু হয়না।
______
মাহিন অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে সোফায় বসে। মুখশ্রী বড্ড নাজুক। বেচারা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে, প্রকৃতির উপর। এসব রোমান্টিক ওয়েদার কী তার জন্য নাকি! যদি তার জন্য না হয়, তাহলে দরকার নেই এইরকম ওয়েদারের। সে ঘুরতে এসেছে, ঘুরবে। রোমান্টিক বৃষ্টি দেখে, যাকে তাকে নিয়ে ভাবতে বসবে না,’বাল! বৃষ্টিও তন্ময়ের সাইডে মনে হয়। হানিমুন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার সব, ওয়েস দিয়ে দিচ্ছে শালারে! আর আমরা যে ট্যুর দিব ভেবে আসলাম, সেটার কী হবে? বেরোতেই পারছি না। সকাল থেকে বৃষ্টি! দেখতে দেখতে বিকেল! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে ভাই! ঘুরাফেরা কী আদৌও হবে?’

তন্ময় ভ্রুক্ষেপহীন। চুপচাপ বন্ধুদের মধ্যে বসে। মাহিনের থমথমে চেহারার চটচটে মেজাজের বকবক নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনছে। ইব্রাহিম শব্দ করে হাসলো। সেলফোন পকেটে ঢোকাল। সাজেশন দিল, ‘রেইনকোট পরে নেই চল। তারপর বাইক নিয়ে বেরোই! ব্যাপারটা জোস হবে।’
‘হ্যাঁ! তারপর ব্যাচেলর আমি কোনো চিপায় পড়ে মরেটরে যাই। রাস্তাঘাট উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাকেও ভাসিয়ে দিবে শালা!’
‘তুই কোনো ব্যাটা না!’
‘হ আমি তোর ব্যাটি। দে বাবা বিয়ে দে! পকপক করে মাথা খা.. কাজের কাজ ত…’

মাথা গরম মাহিনকে থামাতে শুহানি নরম সুরে বলল,’আচ্ছা হোম গেমস খেলি? আরেকটা নাইট ইভেন্ট? হাও এবাউট ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার? বাগানে ত ব্যবস্থা করাই। আমরা শুধু খাবার টাবার স্যাট করবো। গানটান বাজাব, খাব, এঞ্জয় করবো। কেমন হবে?’

মাহিন তার বিরক্ত মুখ খুলবে ভাব, পূর্বে শুহানি ওয়ার্নিং দিয়ে দিল, ‘খবরদার আমাকে তেঁতো কথা শোনাতে আসবি না। মনে রাখবি আমি মেয়ে।’
‘কলিজা কেটে দিয়ে দেই? তুই ভুনাখিচুড়ি করে, সবাইকে বিলিয়ে দে! বালসাল!’

মাথা গরম মাহিনের তেঁতো কথা কমবেশি গ্রুপের সবাই গিলেছে। গিলে কেউই আর আগ বাড়িয়ে সাজেশন দিতে গেল না। তন্ময় দু’পাশে মাথা নাড়াল। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কেয়ার টেকার চাচাকে বলল, ‘দুটো ছাঁতা হবে? থাকলে দিন চাচা!’

কেয়ার টেকার চাচা ‘জি’ বলে ছুটে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিয়ে আসল। এগিয়ে দিল। তন্ময় একটা ছাঁতা নিয়ে আরেকটা মাহিনের দিক ছুড়ে মারল, ‘নে। আয় বাইরে।’

ছ্যাত করে উঠে দাঁড়ালো মাহিন। ছাঁতা হাতে ধেইধেই করে তন্ময়ের পিছু গেল। বিরক্তিতে রীতিমতো তার চাপা কাঁপছে। কাকে ঝাড়া যায়? তন্ময়কে তো একদম নয়। এই ছেলে দেখতে শান্ত। কিন্তু মুখ চললে অশান্ত। খবর করে দিবে তার।
একপ্রকার বাধ্য ছেলের ন্যায় বেরোলো। তন্ময় ছাতা মাথায় যাচ্ছে বাগানের দিক। মাহিন পিছু চলল। উদাসীন পায়ের গতি। দুজন বাগানের নিরিবিলি জায়গায় আসতেই থামলো। দৃষ্টি দুজনের এদিকসেদিক। নিরবতা ভাঙলো মাহিন, ‘আমারে দেখ! কতো মেয়ে পেছনে ঘুরেছে, ঘুরছে কাউন্ট করে শেষ করতে পারবি দোস্ত? পারবি না। অথচ, আধবয়সী ছোট ইঁদুর একটা মেয়ে, আমাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। আমি.. আমি মাহিনের কল রিসিভ করে না। কত্তবড় সাহস! এসব একটুখানি মেয়ে আমার দাম বুঝবে কীভাবে! কদর করবে কীভাবে! জানেই না আমি কে! শালার কতো মেয়ে পিছু ঘোরালাম, ডেট করলাম, ছুড়ে মারলাম হিসেব নেই। আর এখন এই বয়সে এসে, কীসব দেখতে হচ্ছে!’

গলা পরিষ্কার করে আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক তাকাল, ‘ওই মেয়েটা! মানে মারজি.. ওর ছবি আছে?’

তন্ময় মাথা ঘোরালো। নিবিড়ভাবে মাহিনকে পর্যবেক্ষণ করছে। মাহিন নড়েচড়ে ওঠে, ‘এভাবে তাকাস কেন!’
‘তোকে সুবিধার লাগছে না।’
‘লাগবে কীভাবে! থাকলে দেখা…’

তন্ময় পকেটে হাত দিল। সেলফোন বের করবো। হুট করে মাথা উঁচু করলো। অযথাই চোখ গেল উপরে। দোতলার পশ্চিম দিকের বারান্দায় তার বোকাসোকা অরু দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির মধ্যে। এভাবে থাকলে ধীরেধীরে ভিজে যাবে ত! ঠান্ডা লাগবে। তারপর সারাদিন নাক ধরে বসে থাকবে! তন্ময় পা বাড়ালো ঘরের দিক। যাবার আগে বলে গেল, ‘পাঠিয়ে দিচ্ছি হোয়াটসঅ্যাপে!’

মেঘ ডাকছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে। প্রকৃতি বড্ড ঠান্ডা, শান্ত। বাহিরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তাঘাট স্যাতলা! গাছগাছালী নরম এবং ভেজা। আবহাওয়া জানান দিচ্ছে, এই ঝুম বৃষ্টি নামবে বলে! হুট করে বৃষ্টি নামলে অরু ভিজে যেতে পারে। সে তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আসমানের নিচে। সটান মেরে। নড়চড় নেই। একমনে, চিন্তিত মুখে আকাশকুসুম ভাবনায় মশগুল। এতসব ভাবতে গিয়ে ভুলে বসেছে জগৎ। তার তন্ময় ভাইয়া ভীষণ দায়িত্বশীল এবং ধৈর্যবান ব্যক্তি। উপর দিয়ে একটু গম্ভীর আর থমথমে চেহারার অধিকারী। তবে ভেতরে নরম তুলতুলে। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই, এই লোক বাচ্চাকাচ্চা কতটা পছন্দ করে।
ছোটবেলা থেকে তন্ময়কে দেখে এসেছে। খুবকরে চেনে তন্ময়কে। এইযে, দীপ্তকে তন্ময় পেলেছে বললে মোটেও ভুল হবেনা। ছোট থেকেই দীপ্ত তন্ময় বলতেই অজ্ঞান! রাতবিরেত মায়ের বুকের দুধ ফেলে, তন্ময়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছে। দিন নেই সকাল নেই, তন্ময়কে তার মর্জি মোতাবেক ঘুরতে বেরোতে হয়েছে। এমনকি কোলে করে অফিস গিয়েছে। পাশে রেখে মিটিং সেরেছে। ছোট বোন শাবিহাকেও কম আদরে পালেনি সে! যা চেয়েছে দিয়েছে, দিচ্ছে! না নেই। এসব বিচিত্র চিত্র গুলো সকাল থেকে হানা দিচ্ছে অরুর মস্তিষ্কে। তার তন্ময় ভাইয়া একজন সুপুরুষ। ভালো ছেলে, ভালো ভাই তেমনি একজন ভালো হাসবেন্ড। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই একজন বেস্ট বাবাও হবে? অরু খুব করে চায় তন্ময় বাবা হোক। আর সে মা। তাদের দুজনের অংশ আসুক। হ্যাঁ, তাদের বিয়ের বয়স কম। সে খুব ছোটো। তার সম্পুর্ন ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তাতে কী! তন্ময়ের তো বাবা হবার বয়স হয়েছে। তাতেই হবে।
সকাল থেকে গিল্টি ফিল করা অরু আকাশকুসুম ভেবে, মনকে শান্ত করলো। অতি ভেবেচিন্তে সে আর পিলের বিষয়টি তন্ময়কে বলবে না ভাবলো। তাকে কে’টেকুটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও বলবে না! যখন তন্ময় জানবে তখন নিশ্চয়ই একটা চড় মারবে তাকে! মারুক! অরু সহ্য করে নিবে। সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিবে।

‘এই ছোট্ট মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস!’

অরু চমকে উঠলো। ভীষণ ভড়কে গিয়েছে। রীতিমতো কেঁপে উঠেছে! কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। অরুর বেলায় বুঝি তাই! তড়িৎ গতিতে পেছনে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। একদম কাছে…তার পিঠ ঘেঁষে। চেহারায় চিন্তার ভাঁজ। সে খুব গুঁছিয়ে অরুকে দেখে নিচ্ছে। এই মেয়েটাকে সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে। মুখমন্ডল, আচার-আচরণ, হাবভাব দেখেই বুঝতে পারে, কিছু একটা তো চলছে! অরু বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে বোকার মতো হাসলো। অন্ধকারী বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সামনে, এই সাধারণ পোশাকে লম্বা চুল ছেড়ে রাখা বোকা অরুকে, এক রাজ্যের মায়াবতী লাগছে। আদুরে লাগছে। তন্ময়ের ছোট্ট সন্দেহ বহু দূরে পালালো। মস্তিষ্ক শীতল পড়ে গেল। থেকে গেল বুকের বা’পাশের চিনচিন ব্যথা। দু’পা এগোল। অরু তখনো নিজেকে বাঁচাতে বেশ তোরজোড় করছে, ‘কিছু ভাবছি না। আমিতো মেঘলা আকাশ দেখছিলাম। বলুন আমি কী মিথ্যে বলি! আমার মতো সত্যবাদী কি কেউ….’

পিঠে এবং হাঁটুর নিচে হাত চেপে অরুকে পাজাকোলে তুলে নিল তন্ময়। ঘটনাটি বেশ দ্রুত ঘটেছে। ভীতু অরু কুকড়ে গিয়েছে। চোখমুখ খিঁচিয়ে মৃদু আর্তনাদ করেছে। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপ্টে ধরেছে তন্ময়ের গলা। আসমান তখনও কাঁদতে ব্যস্ত। জল ভীড় জমিয়েছে তন্ময়ের ঘাড়ে। টি-শার্ট জুড়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ছাপ। অরুর উদাসীন চেহারার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গে। মাথা নত, দৃষ্টি লাজুক। এদিকসেদিক তাকাচ্ছে। চোখ তুলে তন্ময়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না৷ মস্তিষ্কে ঘুরেফিরে চলে এলো রাতের দৃশ্য। আরেকদফ লজ্জার সম্মুখীন। ছোট করে ‘নামিয়ে দিন’ বলতেও দ্বিধাবোধ করছে। তন্ময় ভেতরে হাঁটা ধরেছে।
ঘর এখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এইতো সকালে কেয়ার টেকার চাচা কাজের লোক দ্বারা পরিষ্কার করিয়েছেন।

বিছানায় বসে অরু হাসফাস করছে। ঘরবন্দী ভালো লাগছেনা। বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। আঁড়চোখে তন্ময়কে দেখে নিল। এলোমেলো চুপসে যাওয়া গলায় আবদার ধরলো, ‘বাইরে যাবো না?’

তন্ময় ঘুরে তাকাল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে!’
‘সুন্দর আবহাওয়া তো।’

তন্ময় কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
‘রেডি হয়ে নে।’

অরু হাসলো। ল্যাগেজ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিক। সে আর তার তন্ময় ভাই বেরোবে। লং-টার্ম ড্রাইভিংয়ে। হে হে….তারা ত হানিমুনে আছে।
_______
বৃষ্টি যেমন শপথ নিয়ে নেমেছিল। তিনদিন পইপই করে ঝরতে থাকলো। মেঘলা আকাশ রয়ে গেল সর্বক্ষণ। আজ তাদের যাওয়ার পালা। ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। এইতো আর মাত্র দু’ঘন্টা। প্রায় চলে এসেছে। অরু গভীর রাতের উষ্ণতা মাখিয়ে নদীর পানির স্রোতের পানে চেয়ে। খুব উপভোগ করেছে এই তিনদিন। এমন কিছু ঘটেছে যা আর কখনো ঘটেনি। তার আর তন্ময়ের একান্ত ব্যক্তিগত সময় গুলো, এতটাই প্রাইসল্যাস ছিলো যে অরু ভাবতে বসলেই, এক রুপকার রাজ্যে হারিয়ে যায়। অনুভূতির সাগরে ভেসে বেড়ায়। খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বাড়িতে গেলে তো আর এমন হবেনা। একসাথে থাকা হবে না। একসাথে ঘুমোনো হবে না। এইযে এই তিনদিন অরু তন্ময়কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। তন্ময়ের বুকে মাথা রেখেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। তন্মুয়ের শরীরের সুগন্ধি শুকতে শুকতে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলেছে। এগুলোতো আর করতে পারবেনা। অরুর ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে! বুকে যন্ত্রণা অনুভব করছে!
‘কী হয়েছে?’

তন্ময়ের গম্ভীর গলা। সে মাত্রই এলো। এতক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে বাহিরে ছিলো। প্রচন্ড গরম। শরীরের ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে ফেলল মুহুর্তে। ল্যাগেজ হতে টিশার্ট নিতে নিয়ে অরুর মুখশ্রী দেখতে পেল। মেয়েটা কেঁদেছে নাকি? তন্ময় চিন্তিত ভাবে এগিয়ে গেল। থুতনি চেপে মুখ তুলে ধরলো চোখের সামনে। তুলতুলে নরম মুখ। লালচে নাক। ভেজা চোখ। বেশ আবেদনময়ী বৈচিত্র্য, ‘প্রশ্ন করলাম তো!’
‘কিছু না।’

তন্ময় যেমন সব বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অরুকে বুকে মিশিয়ে নিল। তার উদোম প্রশস্ত বুকে গিয়ে ঠেকেছে অরুর ভেজা গাল। গরম উষ্ণ আভাস। শরীর শিউরে উঠলো অরুর। তীব্র ব্যাগে ছুটছে রক্ত চলাচল। ঘনঘন তপ্ত শ্বাস ফেলছে। হৃদয় খানাও বাজতে ব্যস্ত। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালো লাগা ছেয়ে বসেছে। নিবিড়ভাবে চোখজোড়া বন্ধ করে রাখল। মনোযোগী হলো তন্ময়ের বুকের গতিপথ মাপায়। জীবন থমকে যাক এখানেই, এভাবেই, এসময়!

লঞ্চ থেমেছে। শাব্বির শেখ সাহেব দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। পেছনে দু’হাত গম্ভীরমুখে পেঁচিয়ে রেখেছেন। তন্ময় অরুকে নিয়ে ল্যাগেজ হাতে এগিয়ে গেল। সালাম জানাল। কুশল বিনিময় করে নিল। ঘড়ির কাঁটা তিনটা বিশে। তন্ময় অয়নকে কল করলো। ছেলেটার সঙ্গে তার রাত দশটায় একবার কথা হয়েছে। বলেছে সদরঘাট সময় মতো চলে আসবে। এসেছে কিনা! মাহিনকে বিদায় দিয়ে, সামনে এগোল। বেরোতেই একগাদা সিএনজির মধ্যে সাদা গাড়ি দাঁড়ানো দেখতে পেল। শাবিহা ছুটে আসছে। হাস্যজ্বল, ভরাট মুখশ্রী। তিনদিনে মেয়েটার সবকিছু কেমন উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেমন! অরু সেই যে হাত ধরেছে শাবিহার, ছাড়ার নাম নেই। গাড়িতে উঠেও সে শাবিহার সাথে লেপ্টে বসে থাকলো। অয়ন দিব্বি তাদের ঘোরাফেরার বর্ননা করছে। অরু মনোযোগ সহ শুনছে। হুটহাট প্রশ্ন করছে। কাহিনি শোনার আগ্রহ প্রকাশ করছে। সে প্রেম বিষয়ক টপিকে ভীষণ চঞ্চল!
_____
মোস্তফা সাহেব আর আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে। দুজন এই রাতবিরেত চা খাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢুলতে ঢুলতে মুফতি বেগম এলেন। হাতে ট্রে! সেখানে আরও দু’কাপ চা। সেই বারোটা থেকে চা বানিয়ে চলেছেন। না ঘুমিয়ে দু ভাই, চায়ের পর চা পান করছেন, ঘুম তাড়াবার জন্য! কেন ভাই! বাড়ির ছেলেমেয়ে ফিরবে, ফিরে তো ঘুমোবে। সকালে দেখা করা যাবে না? আশ্চর্য! বিরক্ত মুফতি বেগম একা নন। জবেদা বেগম ও চরম বিরক্ত। তিনি একটু আগে গটগট পায়ে ঘুমোতে গিয়েছেন৷ পরপর আবার ফিরে এলেন। আসলে তিনি নিজেও ছেলেমেয়ের চিন্তায়। তিনটা দিন ধরে ঘরবাড়ি ফাঁকা হয়ে আছে। নিস্তব্ধ, নির্জন। এতো খারাপ লেগেছে বলে বোঝানো যাবেনা। আর কিছুক্ষ মাত্র। সব আগের মতো হবে। ঘরবাড়ি উজ্জ্বল হয়ে পড়বে। এইতো অরু এসেই নাক টেনে বলবে, ‘বাবা! চাচ্চু! তোমাদের কী আমার উপর মায়া নেই? এইযে আমি তিন ধরে বাহিরে। কই আমার তো খবর নিলে না!’ বলতে বলতে হয়তো কেঁদেও দিতে পারে….

_________
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here