‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৩,৫৪
৫৩.
শাবিহা বেশ চুপচাপ। একটি টু-শব্দ করছে না। দৃঢ় দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। একমনে, নিশ্চুপ হয়ে। পাশে অরু ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথা খানা এখনো হেলেদুলে, চলেছে তার। বেকায়দায় পড়লে মাথায় আঘাত পেয়ে বসবে নিশ্চিত। তন্ময় উপরের আয়না দ্বারা দৃশ্যটি বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে। রাস্তায় মনোযোগ দিতে পারছে না। একপ্রকার অস্বস্তি অনুভব করছে। এবার সে গলা উঁচিয়ে শাবিহাকে ডাকল। শাবিহা নিরুত্তেজ! ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে অন্য বিষয়ে হয়তো। বাধ্য হয়ে অয়ন হাত বাড়িয়ে ছুয়ে দিল, ‘এইযে।’
হুড়মুড়িয়ে তাকাল শাবিহা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই, গাঢ় করে চোখ রাঙাল। মুখশ্রী খিঁচিয়ে ফেলেছে। সমানে দৃষ্টি দ্বারা আগুন ছুড়ে চলেছে যেন। অয়ন বুঝেও বুঝলোনা! হেসেখেলে শুধালো, ‘ওমা, এমন করে তাকাচ্ছ কেন! ভাইয়া ডাকছে শুনছ না! অরু ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথাটা কোলে নাও। ঘাড়ে ব্যথা পাবে।’
শাবিহা পাশে তাকাল। অরুর মাথাটা তখনো দুলছে। এবার পড়ে যাবে প্রায়! সঙ্গে সঙ্গে অরুর মাথাটা ধরে ধীরেসুস্থে কোলে রাখল শাবিহা। সামনের চুলগুলো গুঁছিয়ে দিতে নিয়ে পুনরায় আড়চোখে তাকাল অয়নের দিক। পুনরায় দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল। ডান চোখ আলগোছে বুজে অয়ন দুষ্টু হাসলো। কত্তবড় সাহস আবার চোখ মারে! শাবিহা দ্রুত নজর ফেরালো। জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখল। শক্ত করে নয়ন জোড়া বুজে নিল। বেগতিক গতিতে ছুটছে ভেতরের গরম তরল রক্ত। বেসামাল হয়ে পড়েছে হৃদয়। ছটফট করছে। ধুকপুক করছে। বন্ধ দু চোখের পাতায় ভেসে উঠল, গতকাল রাতের দৃশ্য। শিউরে উঠলো মুহুর্তে। শুকনো ঢোক গিলল। এখনো উপলব্ধি করতে পারছে, তখনকার শক্ত মজবুত হাত জোড়ার স্পর্শ। গরম নরম ঠোঁটের ছোঁয়া। ক্রমাগত শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত হয়ে উঠছে। মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিল শাবিহা। এই কী করে বসলো….
ভোর চারটা। গাড়ি থেমেছে শাহজাহান বাড়ির সামনে। তন্ময় আগে বেরোলো। অয়ন ও বেরিয়েছে। বেরিয়ে সে পেছনের বিপরীত পাশের দরজায় পিঠ হেলিয়ে
দাঁড়িয়েছে। মুলত শাবিহাকে বেরোতে দিবে না। যেমন এইযে শাবিহা দরজা খুলতে চাচ্ছে, পারছে না।
তন্ময় ইতোমধ্যে দরজা খুলে অরুকে কোলে তুলে নিয়েছে। ঘুম থেকে ডেকে তোলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেনি। শান্ত সুরে যাবার পূর্বে শাবিহার উদ্দেশ্যে বলে গেল, ‘তাড়াতাড়ি আয়।’
শাবিহা কীভাবে আসবে? তাকে তো বেরোতেই দিচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে ওপর পাশ দিয়ে বেরোবে এমতাবস্থায়, অয়ন ভেতরে এসে ঢুকে বসেছে। দরজা লক করে দিয়েছে। শাবিহা রাগান্বিত হবার প্রচেষ্টায়। কড়াকড়ি চোখে তাকাল, ‘কী সমস্যা?’
অয়ন নির্বিকার ভঙ্গিতে নিবিড়ভাবে শাবিহাকে দেখছে। মেয়েরা লাজুক হলে তাদের সৌন্দর্য হাজারগুন বেড়ে যায় নাকি? বাল্বের সামান্য আলোয় শাবিহার মুখ খানা বড্ড লাল। নাকের ডগায় কেউ হয়তো, লাল রঙ ছুঁয়ে দিয়েছে। ভেজা ঠোঁট জোড়ায় চোখ যেতেই বুকের আকুতি বেড়ে গেল। এই ঠোঁটের স্বাদ কতটাই না গভীর ভাবে নিয়েছে সে রাতে। শাবিহার দুপাশে হাত ছড়িয়ে রাখল। বন্দী করে রেখেছে বুকের পিঞ্জিরায়। ঘামতে শুরু করেছে শাবিহা। মস্তিষ্কে হানা দিতে শুরু করেছে , সেই অঘটনের দৃশ্য গুল। মুখা বাড়ালো অয়ন। শাবিহার ঠোঁটের সামনে ঠোঁট এনে রেখেছে। ছুঁইছুঁই। আরেকটু বাড়ালেই স্পর্শ। ধীর স্বরে আওড়াল, ‘রেগে আছ কেন! তুমি স্বেচ্ছায় এসেছিলে আমার কাছে।আমিতো যাইনি। তাহলে… হু?’
শাবিহা দরজা খুলতে চাইল। এই বাঁধন হতে মুক্ত হওয়ার আপ্রান চেষ্টা তার। অয়ন দু’হাতের বাঁধন দৃঢ় করল। দূরত্ব সম্পুর্ন ঘুচিয়ে দিল। শাবিহার নরম ঘাড়ে মুখটা নিয়ে রেখেছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে, ‘একটু চুমু খেয়েছি। আর ছুঁয়েছি মাত্র। এতেই এমন অবস্থা তোমার! এ-র বেশি করলে কী করবে? অজ্ঞান হয়ে পড়বে? আমি কিন্তু তখনো ছাড়বো না। বিয়েটা শুধু হতে দাও। আমাকে যতটা জ্বালিয়েছ, এরথেকে ত্রীপল জ্বালাব তোমায়।’
পরপর শক্ত করে কামড় বসালো শাবিহার তুলতুলে নরম ঘাড়ে। শাবিহার সীৎকার অগ্রাহ্য করে, কামড়ের স্থানে শব্দ করে চুমুও খেল। ব্যস্ত হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। শাবিহা তখন ব্যথিত স্থান চেপে রেখেছে।আতঙ্কিত পাখির মতো ছটফট করছে। ছেলেটা এতো ফালতু। উফ!
______
বাড়ি আবছা অন্ধকার। বাতি সবগুলো ওফ, ড্রয়িংরুমের’টা ব্যতীত। তন্ময় অরুকে নিয়ে উপরে চলে এলো। নিজের ঘর ডিঙিয়ে অরুর ঘরে প্রবেশ করলো। আলতো হাতে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। পাশে বসে হাত বাড়িয়ে জুতো জোড়া খুলে রেখেছে। কাঁথা টেনে শরীরে মেলে দিল। অরু আড়মোড়া ঘুরেফিরে তন্ময়ের দিক কাঁত হয়েছে। আবছা চোখ মেলে তাকায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন স্বরে ডাকে, ‘তন্ময় ভাইয়া!’
‘হু।’
‘ঘুমাবেন না? আসুন!’
খালি জায়গাটুকু অরু হাতড়ে দেখিয়ে দিল। তন্ময় অশান্ত মনকে শান্ত করছে যেমন! মিইয়ে যাওয়া অস্পষ্ট কন্ঠে বলল, ‘পড়ে ঘুমোচ্ছি। তুই ঘুমো।’
অরুর কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। তন্ময়ের উত্তর তার মোটেও পছন্দ হলোনা যেন! হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের শক্ত হাত আঁকড়ে ধরলো। বিরক্ত ভঙ্গিতে চাপাস্বরে কিছু একটা আওড়াল। ঘুমের ঘোরে হয়তো। তন্ময় মুখ বাড়িয়ে কপালের মধ্যস্থান ছুঁয়ে দিল। হাতটা ছাড়াতে চাইল। অরু শক্ত করে ধরে। তন্ময়কে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হলো। অরুর বাঁধন ঢিল হতেই, ধীরেসুস্থে উঠে কামরা হতে বেরিয়ে গেল। যাবার পূর্বে দরজা ভালোভাবে চাপিয়ে গেল। বসার ঘরে আসতেই মোস্তফা সাহেবের সঙ্গে দেখা। মোস্তফা সাহেব সোফায় বসে আছেন। তন্ময় ডাকল, ‘বাবা!’
‘হু।’
‘তুমি এখনো জেগে যে?’
‘ঘুম আসছিলো না। ওখানে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?’
‘না। সব ঠিক ছিলো।’
‘অরুর ভার্সিটির এপ্লিকেশন চলছে শুনলাম। গতকাল সময় করে কয়েকটায় এপ্লাই করে দিও!’
‘আচ্ছা।’
‘শুয়ে পড়ো গিয়ে।’
তন্ময় যেতে পা বাড়ালো। মোস্তফা সাহেব পিছু ডেকে বললেন, ‘শাবিহার মানসিক উন্নতি হয়েছে কী?’
তন্ময় হেসে বলল, ‘অনেক! চিন্তা করো না।’
_______
ঢাকা ফিরেই তন্ময় কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তিন চার দিনের কাজ পেন্ডিং-য়ে। কিছু বায়ার’দে কথা দিয়ে গিয়েছিল! পুরান ঢাকার ফ্যাক্টরি নিয়ে বেশকিছু মিটিং আছে তার। চোখমুখ থুবড়ে কাজ করতে হচ্ছে! তাকে বাড়িতে পাওয়া মানে, চাঁদ হাতে পাওয়া। প্রত্যেকদিন ঘুম থেকে উঠতে অরুর দেরি হয়ে যায়। হৈচৈ করে উঠে নিচে এসে শুনবে, ‘তন্ময় বেরিয়ে গিয়েছে।’ তখন আর গলা দিয়ে খাবার যেতে চায় না তার! দুচোখ ভিজে উঠে। আফসোসে বুক ভাড় হয়ে থাকে! রাতে ফিরতে ফিরতেও লোকটা এগারোটা- বারোটা বাজিয়ে ফেলে। তাও ডিনার সেরে আসে। অরু সেই-মূহুর্তে অথৈজলে ঘুমোতে ব্যস্ত। এতো চেষ্টা করে, তবুও ঘুমকাতুরে সে ঘুম থেকে রক্ষ পায় না। আজকের দিন নিয়ে দু-সপ্তাহ! দু সপ্তাহ ধরে অরু তন্ময়কে দেখে না! বুকে একরাশ অভিমান। সেই অভিমান ডিঙিয়ে কলও দিচ্ছে না আগ বাড়িয়ে।
বৃহস্পতিবার। সকাল থেকে অরু ঘর আটকে বসে। দু’একবার আয়নায় মুখ দেখে কেঁদেছে। কেঁদেকেটে মুখ ধুয়ে খেতে গিয়েছে। খেয়ে দেয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। সেলফোন ঘাটিয়ে তন্ময় আর তার ছবি গুলো দেখতে বসলো। তাদের অনেক ছবি! গ্যালারি জুড়ে শুধু ছবি আর ছবি। সাদা শাড়ি পরিহিত সে আর পাশে বসে তন্ময়। কী সুন্দর ছবি! ছবি গুলো দেখতে নিয়ে অরু আবারো একটু কেঁদে নিল। টিস্যু নাকে চেপে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার তন্ময় ভাই কি তাকে ভুলে গেল?
দীপ্ত এসেছে। হাতে প্যাড৷ মুভি দেখছে। ইন্টারেস্টিং পার্ট চলছে হয়তো। একমুহূর্তের জন্যেও চোখ ফেরাচ্ছে না। লাফিয়ে উঠে বসলো অরুর বিছানায়।
চিৎপটাং শুয়ে মুভি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অরু এগিয়ে এসে পাশে বসলো। যথেষ্ট নরম গলায় শুধালো, ‘তন্ময় ভাইয়ার সাথে দেখা হয়েছে তোর?’
‘হু। সকালে হলো ত। আমাকে মিল্কশেক কিনে দিয়ে গেল।’
‘ক’টা বাজে তখন?’
‘ছ’টা ত্রিশ।’
অরু বিষন্ন অনুভব করলো। সে উঠেছে আটটা ত্রিশে। এরজন্যই ত তন্ময়কে পায়না। আজ আকাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রোদ উঠেছে হালকাপাতলা! হিম বাতাস বইছে। অরু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, মারজি আর এহসান আসছে। দু’ভাইবোনের মাথায় সাদা ছাতা। গরমে ত্যক্ত মারজি নিচ থেকে চেঁচাল, ‘অরু নাম তাড়াতাড়ি!’
‘কেন!’
‘নতুন ভার্সিটি দেখে আসি। ক্যাম্পাস ঘুরবো!’
‘আয় ভেতরে।’
‘না। রেডি হয়ে নাম। আমরা গাড়িতে বসি!’
‘আচ্ছা।’
অরু সময় নিয়ে সেজেগুজে নিল। তন্ময়ের বিরহে কয়েকদিন যাবত সাজগোছ ও করছে না। বেরোনো ও হচ্ছে না! সুযোগের বেশ ভালোভাবে সৎ ব্যবহার করলো। চমৎকার রূপে আবদ্ধ হয়ে বেরোলো। ধেইধেই করে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেছে। অরু জানালার পাশে বসেছে। তার পাশে মারজি। ড্রাইভারের সঙ্গে এহসান। মারজি কনুই দ্বারা খোঁচাল অরুকে, ‘কী ব্যাপার বলত?’
অরুর মুখশ্রী মুহুর্তে করুণ বনে গেল। কয়েকবার চোখের পলক ফেললো, ‘কিছু না।’
‘তন্ময় ভাইকে জ্বালাচ্ছস নিশ্চিত!’
অরু রেগে গেল, ‘তুই এমন কেন মারজি! আমি জ্বালাই? আমাকে জ্বালাচ্ছে যে! জানিস সেই যে ফিরেছি, আর দেখাসাক্ষাৎ নেই।’
‘তুই দেখিস না তবে ভাইয়া তোকে ঠিকই দেখে। এক কাজ কর কল দে। ভাইয়া হয়তো ব্যস্ত৷ কাজ ফেলে ঘুরেফিরে এসেছে। কাজগুলো কভার-আপ করতেও ত সময় লাগে!’
‘তাই বলে এতো!’
অরু অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে চুপ রইল। হাতে সেলফোন। তন্ময়ের নাম্বার সে অনেকবার ডায়াল করতে চেয়েছে। কিন্তু করেনি। মারজি বোঝানোর সুরে বলল, ‘তোর মধু লোভী তন্ময় ভাই, মধু ছাড়া বাঁচবে না! তোর মধুর ফায়দা নে।’
‘মধুর ফায়দা?’
মারজি ফিসফিস করে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝ মাথায় ঢেলে দিল। অরু হ্যাবলার মতো শুনে বলল, ‘ছিঃ। এসব কখনো করবো না। যা ভাগ!’
অরুর কামরার দরজা আবছা ভেড়ানো থাকে। লক করেনা সে সচরাচর। আজ অরু দরজা লক করে ঘুমিয়েছে। মারজির কথা খানা তার মনে বিঁধেছে। নিশ্চয়ই তন্ময় রাতে রুমে আসে। নাহলে এসির ট্রেম্প্রেচার বাড়ায় কে? অরু ত ভীষণ কমিয়ে ঘুমোয়। শরীরে কাঁথা বা কে মেলে দেয়? নিজে এসে দেখে যায় অথচ অরুকে দেখতে দেয়না, তা তো হবেনা। তাই অরু আজ থেকে দরজা লক করে ঘুমাবে।
পরপর পাঁচদিন অরু দরজা লক করে ঘুমালো। দু’দিনই মধ্যরাতে দরজায় করাঘাত পড়েছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে শোনা যাত ঠকঠক শব্দের। রাগে দুঃখে অরুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজে প্রত্যেকদিন আসে। অথচ অরুকে ডাকে না! আজ শব্দগুলো শুনেও না শোনার ভান করে পড়ে থাকলো।
_________
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পঁয়তাল্লিশে। অরুর দুচোখের পাতায় সারা বিশ্বের ঘুম এসে জড়ো হয়েছে। একটু পরপর ওয়াশরুম গিয়ে চোখমুখে পানি দিচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলে মাথা বের করলো। সবগুলো বাতি নেভানো। অন্ধকার। কেউ নেই চারিপাশে। অরু পা টিপে টিপে তন্ময়ের কামরায় ঢুকলো। দরজা আবছা লাগিয়ে দিল। অন্ধকারে হাতড়ে বড়ো বিছানার, আরাম করে শুয়ে পড়লো। মুহুর্তেই নাকমুখে আছড়ে পড়ল তন্ময়ের ঘ্রাণ। কোলবালিশ বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল। বালিশে নাক গুঁজে রাখল। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আহা!
দরজা খোলার শব্দ। অরুর ঘুম খানিক কেটে গেল৷
তন্ময় ফিরেছে। ডান হাতে কোর্ট আর বাম হাতে অফিস ব্যাগ। ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাতের ব্যাগ আর কোর্ট সোফায় রেখে, ওয়াশরুম ঢুকে গেল। বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন বোধ করলো না। তাতে বরং অরুর জন্য ভালোই হলো। সে দিব্বি পুনরায় চোখ বুজে ঘুমানোর প্রচেষ্টায়। এবং ঘুমিয়েও গেল। তন্ময় কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়েছে। অন্ধকার কামরায় বাতি জ্বালাল। চুল ঝেড়ে ড্রেসিং টেবিলে দাঁড়াতেই চমকে গেল। বিছানায় তার মাতই গিয়েছে। অরু ঘুমিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে। স্কার্ট পরে শুয়েছে। ফলস্বরূপ ফর্সা স্লিম পা জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যমান! পরনের গেঞ্জির হাবভাব ও ভালো নয়। তন্ময় অশান্ত মন নিয়ে এগিয়ে গেল। গলার স্বর সাংঘাতিক ছোট করে ডাকল, ‘অরু?’
কাঁচা ঘুম অরুর আবার কাটলো। আবছা চোখে তন্ময়কে পরখ করে নিল। নিবিড়ভাবে, একমনে। উদোম প্রশস্ত বুকে নজর আটকে গেল। ফোটা ফোটা জল এখনো দৃশ্যমান৷ পেশিবহুল হাত জোড়া ফুলে আছে। দেখতে আকর্ষণীয়! ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ঘুম সম্পূর্ণ কাটতেই লাফিয়ে উঠে বসলো অরু। অভিমানী চোখে তাকিয়ে আছে। ধীরেসুস্থে আঁখিদুটি ভিজে উঠছে। একসময় চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। তন্ময় হাত বাড়ালো। অরু দূরে সরে বসলো, ‘ছুঁবেন না। আপনি আমাকে মোটেও পছন্দ করেন না। একটুও ভালোবাসেন না। ওগুলো সব মিথ্যে ছিলো।’
তন্ময়কে খানিক ব্যাকুল দেখাল। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে অরুর হাতটি চেপে ধরলো। টেনে আনল নিজের দিক। জাপ্টে ধরলো ছটফট করতে থাকা অরুকে। একপ্রকার কোলে উঠিয়ে নিয়েছে। কোমল স্বরে আওড়াল, ‘আম সরি। রাগ করে না সোনা। একটু ব্যস্ত ছিলাম।’
অরুর কান্নার গতি বেড়েছে। দুচোখ বেয়ে ঝড়ছে অজস্র ক্ষুদ্র জল। ফুপিয়ে বলল, ‘ভালোবাসার মানুষের জন্য কোনো ব্যস্ততা থাকেনা। ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে তাই আপনি…’
‘চুপ! একদম চুপ।’
অরুর নাক ফুসছে। ধমক খেয়ে সে থমকে আছে। তন্ময় তার অগোছালো লম্বা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিল, খুব যত্নসহকারে। কপালে চুমু খেল, ‘সময় দে। বাড়িতে বিয়েটা মেনে নিলে, তোকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। হু? কান্না করে না জান। থাম… ‘
‘আমি কান্না করলেই বা কী! আপনার কোনো যায় আসে?’
‘হু আসে। অনেক আসে।!
‘মিথ্যে। না আসেনা। একদম আসে না।’
তন্ময় হাসলো। অরুর লাল নাক টেনে দিল। কোল থেকে নামাতে চাইল। তাগাদা দিল, ‘কাল তাড়াতাড়ি আসব। এখন যা রুমে। রাত হয়েছে।’
অরু তন্ময়ের গলা দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরলো শক্ত করে সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলো। তন্ময়ের উদোম শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। থরথর করে কেঁপে উঠেছে দেহ খানা। চোখমুখ খিঁচে তবুও জড়িয়ে রাখল। তন্ময় শান্ত নেই। বড্ড অশান্ত। যেই ভয়ের জন্য দূরে দূরে থাকছে, সেটাই যেচে সামনে এসে বসে। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। কন্ঠ নামিয়ে ডাকল, ‘অরু!’
‘এখানেই থাকব। আপনার সাথে। কোত্থাও যাব না।’
‘না। রুমে যাবি!’
তন্ময়কে ছেড়ে অরু বিছানায় শুয়ে পড়লো, ‘এখানেই ঘুমাব।’
‘জেদ করে না।’
অরুকে কোলে তুলতে নিতেই ঘটলো অঘটন। তন্ময়ের কোমরের তোয়ালে ঢিল হয়ে গেল। খুলে পড়ে যাবে যাবে ভাব৷ অরু চিৎকার করে দুচোখের উপর দুহাত চেপে ধরল। লজ্জায় সে হতভম্ব। দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। তন্ময় নিঃশব্দে হাসলো। সে তোয়ালে ঠিক করতে নিতেই, অরু লাফিয়ে উঠলো। দরজার সিটকানি আটকে দিল। যত যাই হোক, আজ সে এখানেই ঘুমাবে। তন্ময়ের কথা একদম শুনবে না।
_________
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’
‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’
৫৪.
‘অরু! মাইর দিব কিন্তু!’
স্ব-শব্দে, গম্ভীর স্বরে তন্ময় ধমকে উঠে নিস্তব্ধ কক্ষে। অরু ঘাবড়ে যায়। থমকে যায় পা’জোড়া। থমথমে চেহারায় ফিরে তাকায়। করুণ দৃষ্টি। নাজুক অবস্থা! নাক ফুলিয়ে বিছানায় উঠে বসে। টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। মুখশ্রী মলিন হয়ে আছে। তন্ময়ের ধমক এসময় হজম হলো না তার। এটা সময় ধমকে উঠার? আর অরু কী এমন করেছে যে ধমক দিতে হবে। অরু অভিমানে পাশে ফিরে গেল। তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। কপালে আঙুল ঘষে, এগিয়ে গেল। আঁটসাঁট ভঙ্গিতে এক গ্লাস পানি গটগট করে খেল। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন বারবার। মাথাটাও ধরে আসছে। বুকে অশান্তি। মেয়েটা তাকে কিছুতেই শান্তি দেয়না। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে ব্যস্ত থাকে! তন্ময় দুপাশে অশান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। কাবার্ডের দিক এগোয়। সহিসালামতে রাখা ফাইল খানা হাতে নেয়। টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে৷ হাতের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে, একটু মনোযোগ হবার প্রচেষ্টায়। তবে তা অসম্ভব। তার অবাধ্যগত ঘূর্নিঝড় তো পাশেই। এই ঘূর্ণিঝড় চারিপাশে থাকলে কাজ করা অসম্ভব। অরু ইতোমধ্যে গুটিগুটি পায়ে, তন্ময়ের পাশে বসে দাঁড়িয়েছে। মাথা ঝুকিয়ে ফাইল দেখছে। তন্ময় ফাইল বন্ধ করে ফেললো। মাথা উঁচু করে তাকাল। অরু মিনমিনে গলায় বলল, ‘কী? ঘুম ধরছে না তো! না ধরলে আমি কী করবো!’
‘আমাকে খেয়ে ফেল।’
তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। অরুকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিল, ‘চুপচাপ ঘুমা!’
‘আপনিও আসেন।’
তন্ময় বাধ্য ছেলের মতো বিছানার অপরপ্রান্তে উঠে বসলো। আধশোয়া হয়ে শুল। অরু জড়সড়ভাবে তন্ময়কে জড়িয়ে ধরেছে। সঙ্গে মৃদু কেঁপেও উঠেছে। তবুও ছাড়েনি। ধরেই রাখল। বুকে মাথা পেতে দিল। দুচোখের পাতা বন্ধ করলো। ঘুমানোর চেষ্টা করছে, হচ্ছে না। দ্রিমদ্রিম শব্দে বুক ধড়ফড় করছে। তন্ময় পাশে থাকলে এই এক সমস্যা। বুকের গতিপথ সাধারণ থাকতেই চায় না৷ অরু বিচলিত ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকায়। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যায়। অরু আহত গলায় বলে, ‘ঘুম ধরছে না৷ গান শোনাবেন?’
তন্ময়ের গম্ভীর স্বর আরও গম্ভীর শোনালো, ‘এটা গান গাওয়ার সময়!’
‘এমন করেন কেন! একটু শোনালে কী হয়?’
তন্ময়ের জবাব এলো না। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। অরু মাথা নুইয়ে অন্যপাশে ঘুরে গেল। চোখমুখ অন্ধকার। জামার ফালি সরে, ধবধবে ফর্সা পেটের কিছু অংশ দৃশ্যমান। তন্ময় নিজের দুচোখ ইচ্ছে মতো ডলে নিল। এই নির্বোধ মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়তে ইচ্ছে করছে তন্ময়ের। অবুঝের বাচ্চা! হাত বাড়িয়ে অরুকে বুকে টেনে নিল। চুলে আঙুল বোলালো। খুব ধীর স্বরে একটি গানের লাইন আওড়াল। নিভু নিভু গলার স্বর। স্তব্ধ, বিমুঢ়, নিস্তব্ধ আঁধার কক্ষে, গভীর শোনাল। অরুর সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। বুকের ভেতর ঢেউ খিলখিল করে উঠলো। উথাল-পাতাল অবস্থা,
‘ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান, ঘুমাও আমার কোলে
ভালবাসার নাও ভাসাবো, ভালবাসি বলে
তোমার চুলে হাত বুলাবো, পূর্ণ চাঁদের তলে
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার, জোসনা পড়ুক কোলে
এত ভালবাসা গো জান,
রাখিও আঁচলে
দোলাও তুমি, দুলি আমি,
জগত বাড়ি দোলে ‘
অরুর কী যে হলো! সে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটাল। তন্ময়ের কোলে চড়ে বসলো। চোখমুখ বন্ধ করে তন্ময়ের গালে চুমু বসালো। এতো আদুরে, তার তন্ময় ভাই যে অরুর খেয়েই ফেলতে ইচ্ছে করে। বুকের গতিপথ ও তো ঠিকঠাক চলছে না। চুমু খেয়ে সেই অজ্ঞান হয়ে যাবে, এমন ভাব। অপরদিকে তন্ময়ের এতক্ষণের ধৈর্য্য ভেঙেচুরে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে।
__________
ভার্সিটির জীবন শুরু অরুর। এখন সে ভীষণ ব্যস্ত। মারজি আর তার সাবজেক্ট এক। একই ডিপার্টমেন্ট। ক্লাসগুলো একসাথে করছে। চতুর্থ দিনের মধ্যেই, ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট হতে চারজন বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে। শুভ, জয়, রাহিতা,শান্তি। তাদের ছ’জনের ভালো বন্ডিং হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। এখন ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া তাদের রোজকার বিষয়। একসাথে কফিশপে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো হয়। আজ ছজন ক্যান্টিনে বসে। গোলাকার ভঙ্গিতে একেকজন একেক চেয়ারে আয়েস করে বসে। অরু কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। মারজি তর্ক করছে জয়ের সঙ্গে। জয়ের গার্লফ্রেন্ড সুবিধার নয়। ধান্দাবাজ মেয়ে একটা। মারজি মেয়েটাকে দেখতেই পারে না। এটার সাথে কেন প্রেম করছে, মাথায় আসে না তার। শুভ হাত উঁচিয়ে বলে, ‘শান্ত হ আমার মা। প্লিজ লাগে।’
মারজি বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে রাখল। অরু নিজমনে চুপচাপ বসে৷ সাড়াশব্দ নেই কোনো। তাকে অন্যমনস্ক দেখে জয় শুধালো, ‘কিরে? হইছে কী তোর?’
‘হু? কই না কিছু না!’
রাহিতা শব্দ করে হাসলো, ‘হাসবেন্ড নিয়ে চিন্তিত আমাদের অরু! তাই না? ঝগড়া করে এসেছিস নিশ্চয়ই? মারধর করেছে নাকি?থাক দোস্ত! বিবাহিত জীবনে এই টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকে!’
মারজি হেসে উঠলো, ‘মারধর? ভাইয়াকে দিয়ে?অসম্ভব! ঝগড়া তাও ওদের মধ্যে? কখনোই না। তন্ময় ভাই একটা জ্বলজ্যান্ত আইটেম। ধৈর্যের সাগর। মহা পুরুষ। তোরা তো তাকে দেখিস নাই। জানোস ও না কেমন! তাই বলতে পারছিস। এটাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে ভাইয়া। সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়।’
শান্তি হতাশ গলায় বলল, ‘ভাইয়াকে খুব দেখার ইচ্ছা রে!’
‘আমারও। তাও আবার অরুর কাজিন। একই বাসায় থাকা হয়। আমার ভাই ভাবতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। কী রোমান্টিক! এই অরু, একদিন ইনভাইট কর না তোদের বাসায়। দেখে আসি!’
অরু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘হু।’
সকাল থেকেই অরুর শরীর ভালো না। ঠিক সকাল থেকে নয়। কিছুদিন ধরেই এক অদ্ভুত খারাপ লাগা কাজ করছে। কেমন শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। খেতে ইচ্ছে হয় না। আবার হুট করেই অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে হয়। মাথা ঘুরিয়ে উঠে। নাহলে বোমি চলে আসে। এইতো রাতে মাছের ঘ্রাণ শুনে, একগাদা বোমি করে বসেছে। সকালে আসার সময় মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। কয়েকটি সিঁড়ি বাইতেই শ্বাসপ্রশ্বাস অশান্ত হয়ে উঠে৷ শরীর অল্পতেই ক্লান্ত। আজ আবার দুপুর হতে না হতেই, দুচোখ ঘুমে কাতর হয়ে গিয়েছে। বিছানা পেলেই ঘুমিয়ে পড়বে। অরু টেবিলে দুহাত বিছিয়ে মাথা রাখল। একটু রেস্ট নিবে ভেবেছে। কখন ঘুমিয়ে পড়লো অজানা। মারজি ছুঁয়ে দিল, ‘এই অরু!’
অরু চোখজোড়া পিটপিট করে মেলে চাইল। সবকিছু চোখের সামনে ক্লিয়ার হতেই উঠে বসলো, ‘আমি আজ আগে বেরিয়ে যাই। শরীর ভালো লাগছে না।’
শুভ উঠে দাঁড়ালো অরুর সঙ্গে, ‘চল গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসি। তোরা বোস। আসছি আমি।’
অরু সকলকে বিদায় জানিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। খুব ধীরেসুস্থে হাঁটছে। হাঁপিয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে শুভ শুধালো, ‘দোস্ত, কোনো সমস্যা? তোর জামাই কী তোকে..মানে তোর পরিবার… ‘
অরু ক্রমাগত মাথা নাড়াল। শুভর সন্দেহজনক গলার আভাস পেয়েই, চমকে উঠেছে সে। হাঁটা থামিয়ে দিল। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শুভর চোখে দৃষ্টি রাখল। দৃঢ় গলায় বলল, ‘শুভ! আমার তন্ময় ভাই বেস্ট। সবদিক দিয়েই বেস্ট। তার মতো জীবনসঙ্গী আমি খুব ভাগ্য করে পেয়েছি। আমি কখনোই আমার পরিবার হতে, খারাপ আচরণ পাইনি। আমি হাতেহাতে পুতুলের মতো বড়ো হয়েছি। কিছুদিন ধরে আমার শারিরীক দুর্বলতা বেড়েছে এই যা!’
‘যাক। শান্ত করলি। খুব টেনশন হচ্ছিলো।’
‘করিস না। সামনেই গাড়ি। তুই যা!’
‘উঠ গাড়িতে, চলে যাব।’
অরু হাসলো। এগোল গাড়ির দিক। ড্রাইভার চাচা অপেক্ষা করছে। অরু দূর হতে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। ঝটপট উঠে বসলো গাড়িতে। হাতপা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখল। অস্থির গলা উঁচিয়ে বলল, ‘এসির টেম্প্রেচার আরেকটু কমিয়ে দিন চাচা। প্রচন্ড গরম!’
‘বেশি খারাপ লাগছে?’
‘একটু।’
‘পানি নাও।’
ড্রাইভার চাচা পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। অরু খেল অল্প করে। খেয়ে পুনরায় সিটে মাথা এলিয়ে দিল। অরু অস্থির হয়ে উঠছে। নড়েচড়ে উঠছে বারংবার। ড্রাইভার চাচা চিন্তিত মুখে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়েটার কী হলো!
________
মারজি আড্ডাস্থল থেকে উঠেছে দুটোর দিক। মাত্রই বেরিয়েছে ভার্সিটি থেকে। আজ গাড়ি আসেনি। গাড়ি করে তার মা নানুর বাড়ি গিয়েছে। রিকশা করে যেতে হবে। সে হাঁটা ধরবে সেমুহুর্তে সেলফোন বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে বের করে স্ক্রিনে নজর বোলালো। সেই চিরচেনা নাম্বার। মারজির মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। মাস খানেক ধরে কল আসেনি। মারজি ভেবেছে লোকটা হয়তো ভুলে গিয়েছে। সেও ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। তবে হুট করেই মনে পড়ে যেতো। এতদিন পড় হঠাৎ কেন কল করেছে? মারজি সংকোচবোধ করছে। ধরবে কী না! সময় নিয়ে ধরলো, ‘হ্যালো?’
মাহিনের গলার স্বর ফোনের ওপর পাশ হতে গম্ভীরই শোনাল, ‘হোয়াইট টপ, হোয়াইট স্নিকার্স, কাঁধে ব্যাগ, মেয়েটা তুমি তো?’
মারজি চমকে উঠলো দৃশ্যমান রূপে। বড়ো চোখে তাকাল চারিপাশে। চোখ গেল সামনে। রাস্তার ওপর প্রান্তে। একটি কালো গাড়ির সামনে, ফর্মাল ড্রেসে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। লম্বাচওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। গাল জুড়ে চাপদাড়ি। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে সেলফোন চেপে রেখেছে। নজর মারজির দিকই। মারজির হৃদপিণ্ড লাফিয়ে চলেছে সমানে। বিচলিত নয়নে আশপাশ তাকাচ্ছে। কী করবে? ইতোমধ্যে মাহিন রাস্তা পেরিয়ে আসছে। মিনিটের মধ্যে চলে এলো মারজির সামনে। লম্বাটে মাহিনের পানে তাকাতে মারজি মাথা উঁচু করলো। পরপর নজর ফিরিয়ে নিল। কী করবে বুঝতে পারছে না! ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে সে। মাহিন হাসলো। দীর্ঘ হাসি তার, ‘আমি মাহিন।’
মারজির মুখ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চলল, ‘তো আমি কী করবো!’
বলে আহম্মক বনে গেল। মুখটা এতো আগে আগে কেন চলে! অবশ্য ভুল কিছু বলেনি। তার আরও কিছু কতজা শোনাতে ইচ্ছে করছে। একমাস কোথায় ছিল? মনের এক কোণে পুষে রাখা অভিমান রয়েছে মারজির। মাহিন শব্দ করে হাসলো, ‘আই লাইক ইট। আই মিন দ্যা ওয়ে ইউ আর।’
মারজির চোখের পল্লব সামান্য কেঁপে উঠল। থতমত খেয়ে অন্যপাশে নজর রাখল। মাহিন শুধালো, ‘লাঞ্চ হয়েছে? আমার সাথে লাঞ্চ করবে মারজি?’
মারজির খিদে পেয়েছে। মুলত লাঞ্চ করার জন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে। বাসায় গিয়ে খেতে বসবে বলে! আঁড়চোখে আরেকবার সামনের সুদর্শন লোকটাকে দেখে নিল। মিনমিনে সুরে বলল, ‘করা যায়!’
__________
অয়ন ইদানীং ব্যস্ত থাকে। খুবই ব্যস্ত। সচরাচর তাকে পাওয়া যায় না। শাবিহা ঘুম বাদে জেগে থাকে। অয়ন বেশ রাত করে কল করে। বারোটায় ঘড়ির কাঁটা তখন। শাবিহা সবেই শুয়েছিল। কল পেয়ে উঠে বসলো। অয়ন ভিডিও কল করছে। বুকে ওড়না পেঁচিয়ে রিসিভ করলো। অয়ন উদোম প্রশস্ত বুক চোখের সামনে চলে এলো। গোসল সেড়ে এসেছে হয়তো! ফোঁটা ফোঁটা পানি সর্বাঙ্গে। শাবিহা নজর ফেরালো। অয়ন চুল মুছতে নিয়ে কথা বলছে, ‘জেগে ছিলে আমার জন্য?’
‘এতো দেরি করে আসছ যে?’
‘নতুন প্রজেক্ট করলাম। আজই শেষ। ভালো ফলাফল পাব মনে হচ্ছে!’
‘খেয়েছ?’
‘না। দেখেছ তোমাকে কেন লাগবে তাড়াতাড়ি? এইযে এখন তুমি থাকলে খাইয়ে দিতে, তোমার নরম তুলতুলে হাত দিয়ে। এতো কষ্টে থাকতে হতো?’
‘ফাজলামো রাখবে?’
‘আচ্ছা রাখলাম। কাল বেরোবে। বিকেল দিক। আমি নিতে আসব তৈরি থেকো!’
‘না পারবো না।’
‘পারবে। না পারলে তোমার বাড়িতে চলে আসব। তারপর তোমার ঘর। বুঝছ? আরে সামনে আসো। ক্যামেরার পেছনে কী করো! তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না তো! অস্থির লাগে। কতদিন দেখা হয়না বলো ত? অসম্ভব মিস করছি। একটু ছাদে আসবা?’
‘পাগল তুমি? কী টায়ার্ড দেখাচ্ছে! এক্ষুনি ঘুমাবে।’
‘কিছু মিনিট শুধু। প্লিজ, প্লিজ। শাবিহা….’
শাবিহা বিরক্ত হলো। এতরাত করে ছাঁদে! বাবা দেখলে খবর হয়ে যাবে! তবুও সে ওড়না পেঁচিয়ে বেরোলো। অয়নের মুখশ্রী দেখার লোভ সামলাতে পারলো না।
___________
চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’