প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৫,৫৬

0
1691

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল-৫৫,৫৬

৫৫.
দুপুর গড়াতেই পরিষ্কার আকাশে মেঘ জমেছে। কালো মেঘেদের দল ভেসেছে। তাদের নিয়ে নানান জাতীয় ঐক্য বানানো যেতেই পারে। হুটহাট মেঘ ডাকছে তীব্র শব্দে। ভাপসা গরম খানা এখনো উপলব্ধি করার মতো। রোদের তাপমাত্রায় জমিন এখনো ভ্যাপসা গরম। মৃদু বাতাস বইছে। মারজি বাইরে নজর রাখতে চাচ্ছে। তবে প্রকৃতি আর তার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, জানালার কাঁচ৷ আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কী লোকটার সাথে? নামাতে বলবে কী কাঁচটা? কাঠকাঠ অবস্থায় বসা মারজিকে পরখ করে নিয়েছে মাহিন। হুইলের হাতচারণ কমে এলো। ঘুরে তাকাল। আন্দাজ ধরে প্রশ্ন করল, ‘কোনো সমস্যা? ফিল ফ্রি টু টেল মি!’

মারজি ছোট্ট করে বলল, ‘কাঁচ নামানো যায়?’
‘এ.সি ওন করা তো।’
‘বন্ধ করে দিন।’
‘আর ইউ শিয়র?’

মারজি মাথা দোলাল। মাহিন এ.সি বন্ধ করে কাঁচ নামিয়ে দিল। মারজি প্রাণ খুলে শ্বাস নিল। সময় নিয়ে ফিরে তাকাল। মনে পড়লো তার কাছে টাকা নেই। মাত্র একশো আছে। রিক্সা ভাড়া। সম্পুর্ন দুহাজার টাকা ভেঙেছে আজ৷ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল। সাথে টুকটাক কেনাকাটা করলো। এখন? থতমত গলায় আওড়াল, ‘আমার কাছে কিন্তু টাকা নেই। লাঞ্চ কী আপনি করাবেন? আমি কিন্তু হাফ পার্সেন্ট ও দিতে পারবো না।’

মাহিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। দৃঢ় দৃষ্টিতে মারহিকে দেখছে। তার এই গাঢ় চাহনি মারজির হজম হলো না৷ অপ্রস্তুত বোধ করলো। এভাবে তাকানোর কী আছে? অন্যকেউ হলে চওড়া গলায় ধমকে পুরো গুষ্টি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ফেলত সে। কিন্তু সামনের এই সুদর্শন পুরুষকে যে তার পছন্দ হয়েছে। লম্বাচওড়া, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। একদম তার মনের মতো। বয়স’টাও মানানসই। তার তো সর্বদাই একটু বয়সী পুরুষের সখ ছিলো। ম্যাচিউরড অ্যান্ড কাম কালেক্টেড টাইপ। ইশ, এক দেখায় এতটা পছন্দ করে বসেছে যে, এখন মারজির একটু ভয় লাগছে। তাকে আবার রিজেক্ট করে দিবে নাকি? দিতেও পারে! তার চরিত্র তো ফুলের মতো পবিত্র। এই পবিত্র চরিত্র দেখে না আবার পালিয়ে যায় লোকটা! এইযে এতো করে একটু ঠিকঠাক সুচরিত্রবান হতে চাচ্ছে, পারছে কই? কথায় আছে স্বভাব যায় না ইহকালে। মারজি মুখশ্রী অন্ধকার করে রেখেছে আনমনে। ভাবনায় গভীর ভাবে বিভোর। মাহিন আনমনে হাসলো। দীর্ঘ হাসি। মারজিকে খুব করে দেখে নিয়ে বলল,’আজ নাহয় আমি দিলাম।’

মাথা দোলাল মারজি। পুনরায় বাইরে নজর রাখল। মারজির দৃষ্টির আড়াল হতেই মাহিন নিঃশব্দে হাসলো। ঝকঝকে সুন্দর দাঁত গুলো দৃশ্যমান। চোখের কোণ ডুবে গিয়েছে, ভাজে ভাজে৷ বিড়বিড়িয়ে আওড়াল, ‘ইন্ট্রেস্টিং’।
________
অয়ন বাড়ি ফিরছে না বেশ কিছুদিন ধরে। নিজের টাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে। ঠিক তাদের অফিসের সামনে। আপাতত সেখানেই থাকে। লতা বেগম ছেলের জন্য কেঁদেকেটে অস্থির। খাওয়া দাওয়া একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছেন। ঠিকমতো ঘুমোচ্ছেন না। সৈকত সাহেব হাজারো চেষ্টা করেও স্ত্রীকে সামলাতে পারছেন না। দুর্বল শরীর নিয়ে বিকেল দিকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন লতা বেগম। বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হলো। সেইমুহুর্তে সৈকত সাহেব ছেলেকে খবর দিলেন। অয়ন ফিরতে সময় নেয়নি। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে ছুটে এসেছে। ঘেমে-নেয়ে একাকার সে মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তার তখনো বসে পরিক্ষা করছেন লতা বেগমকে। কিছু ঔষধ পত্রের নাম লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাকে এগিয়ে দেবার জন্য সাথে গেলেন সৈকত সাহেব। অয়ন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। একমনে চেয়ে থাকলো মায়ের পানে। জন্মদাত্রী মায়ের এই অবস্থা মানতে পারলো না। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখল। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। সামনে তার বাবা দাঁড়িয়ে। মাথাটা বাবার কাঁধে এলিয়ে দিল। সৈকত সাহেব ছেলেকে আস্থা দিলেন, ‘ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না।’

অস্বাভাবিক করুণ গলা শোনালো অয়নের, ‘আমি খুব ভালোবাসি শাবিহাকে বাবা। আই কান্ট লিভ উইদাউট হার!’
‘আমি জানি তো।’
‘মা কেন বুঝতে চাচ্ছে না!’
‘বুঝবে। তুই ভেঙে পরিস না!’

লতা বেগমের চোখজোড়া নড়েচড়ে ওঠে। বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে ঘুরে শুলেন। অস্পষ্ট ভাবে চোখ মেলে তাকালেন। দৃষ্টি নিবদ্ধ দেয়ালে। ভাবনায় মশগুল তিনি। ছেলের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে। মস্তিষ্কে পৌঁছে দিচ্ছে।

অয়ন নিজ হাতে খাবার নিয়ে এসেছে। মায়ের পাশে বসেছে। প্লেট হাতে সে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর খুব ধীর স্বরে ডাকে, ‘মা!’

লতা বেগমের জবাব নেই। তবে চোখ মেলে তাকালেন তিনি। অয়ন হাত বাড়ায়, ‘উঠো। আমি খাইয়ে দেই।’

লতা বেগম উঠে বসলেন দুর্বল শরীর নিয়ে। চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন ছেলের পানে। অয়ন মুঠো ভাত এগিয়ে ধরতেই মুখ খুললেন। খেয়ে নিলেন চুপচাপ। সৈকত সাহেব হাসিমুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকলেন। তিনি এখনো অফিস কোর্টে। হয়তো অফিস যাবেন। লতা বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তৈরি হয়ে নাও। আমরা বেরোবো।’

সৈকত সাহেব ভুরু জোড়া কুঁচকে শুধালেন, ‘কই বেরোবা?’
‘শাহজাহান বাড়ি। শাবিহার হাত চাইতে। আমার ছেলের জন্য।’

অয়নের হাত থমকে গেল। ফট করে নজর তুললো। মায়ের নরম দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিললো। লতা বেগম মলিন মুখে হাসলেন, ‘আর দেরি নয়। আমরা আজই যাবো।’

অয়ন চমকে। পলকহীনভাবে তাকিয়ে। যেমন কথাগুলো এখনো সে হজম করতে পারিনি। সৈকত সাহেব শব্দ করে হাসলেন। কক্ষ জুড়ে তার হাসির বিচরণ বয়ে চলেছে। অয়ন চোখ বুঝল। স্তব্ধ খেয়ে বসে সে। হুট করে লতা বেগমকে জড়িয়ে নিল শক্ত করে। ‘ধন্যবাদ মা।’
_________
তন্ময় ঢাকার বাইরে যাবে। কাজের সূত্রে। দুদিনের জন্য। রাতে বেরোবে। নয়টার আগ দিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে পাঁচটায়। অফিস থেকে মাত্রই ফিরেছে। টুকটাক কাজ গুলো বাড়িতে করে নিবে। বসার কক্ষে এসেই, সোফায় শরীর ছেড়ে বস পড়লো। চারিপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে নিল। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নামতে থাকা দীপ্ত বিষয়টি খেয়াল করেছে। ফুটবল হাতে সে বাইরে যাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে। যাবার পূর্বে তন্ময়কে তথ্যসূত্র দিয়ে গেল,’অরু আপু ঘরে। শুয়ে আছে। শরীর ভালো না। লাঞ্চও করেনি।’

তন্ময়ের শান্ত চেহারা থমথমে হয়ে উঠলো মুহুর্তে। কপালের মধ্যস্থানে ভাজ পড়ল। উঠে দাঁড়ালো। জবেদা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। গ্লাস করে পানি নিয়ে এসেছেন ছেলের জন্য। তাকে পেতেই তন্ময় শুধালো, ‘অরু সারাদিন নাকি খায়নি! অসুস্থ?’
‘কত করে ডেকে আসলাম! মেয়েটা কথা বলছে কই? বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কী হলো! তোর চাচ্চু ডাক্তার ইমরানকে আনবে আজ। মেয়েটাকে দেখাতে হবে!’
‘খাবার দাও। আমি যাচ্ছি।’
‘বাড়া আছে। দিচ্ছি দাঁড়া!’

অরু হাসফাস করছে। এতো অস্থির কেন লাগছে। বিছানায় রীতিমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে। শান্তি পাচ্ছে না ঘুমিয়ে। তবুও মরার মতো চোখ বুজে। খিদে ও লেগেছে। তবে খেতে ইচ্ছে করছে না। দরজা খোলার কিঞ্চিৎ শব্দ শুনতে পেল অস্পষ্ট ভাবে। চোখ খুলে তাকাবে যে সেই শক্তিটুকুও পাচ্ছে না। আঁধারে তলিয়ে যাওয়া কক্ষে বাতি জ্বলে উঠলো। চোখে আলো লাগতেই অরু মৃদুস্বরে ‘উফ’ আওড়াল। চোখ মেলে তাকাল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। হাতে প্লেট। গলায় এখনো টাই ঝুলানো। উষ্কখুষ্ক চুল। অরু চোখজোড়া পিটপিট করলো। তড়িতগতি উঠে বসলো। দেয়াল ঘড়িতে চোখ বোলালো। মাত্র পাঁচটা বিশ। এতো তাড়াতাড়ি তন্ময় চলে এলো? নিশ্চয়ই কারণ আছে! অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার লোক তো তন্ময় নয়। তাই ঘটা করে প্রশ্ন করল ‘এতো তাড়াতাড়ি এলেন যে? আপনি কী বিজনেস ট্যুরে যাবেন?’

অরুর সন্দেহ সঠিক। তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। বিজনেস ট্যুর নিয়ে অরুকে কিছু বলবে না ভেবেছিল! মেয়েটা শুনলেই মন খারাপ করবে! সঙ্গে যেতে চাইবে। বাহানা করতে বসবে! এতগুলো কারণ ধরে লোকাতে চেয়েছে। পারলো কই? তন্ময়ের জবাব না পেয়ে অরু পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাবেন? কতদিনের জন্য?’
‘বলছি। খেয়ে নে…’
‘শুনি আগে। বলেন!’
‘অরু!’

তন্ময়ের ধমকে দমে গেল অর। মিনমিনে গলায় বলল, ‘খাইয়ে দেন।’

তন্ময় ওয়াশরুমের দিক এগোল। অরু চোখমুখ অন্ধকার করে রেখেছে। এভাবেই সকাল থেকে খারাপ লাগছিল। এখন তার খারাপ লাগা আকাশ ছুঁয়েছে। তন্ময় কাছাকাছি থাকবে না ব্যাপারটা সে মানতেই পারে না। কষ্ট হয়। দম আটকে আসে৷ তন্ময় ততক্ষণে হাত ধুয়ে এসেছে। প্লেট হাতে অরুর পাশে বসেছে। লম্বা আঙুল গুলো ভাত নাড়ছে। মেখে পাঁচ আঙুলের মুঠোয় নিয়ে, অরুর মুখের সামনে ধরলো। অরু ঝটপট খেয়ে নিল। মুহুর্তেই পেট নড়েচড়ে ওঠে। বমি বমি ভাব! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধালো, ‘আপনি খেয়েছেন?’
‘না।’
‘আমি খাইয়ে দেই?’

তন্ময় মাথা তুলে তাকাল। অরুর ফোলা ফোলা ঘুমন্ত মুখশ্রী’তে নজর বোলালো। তবে মুখে কিছু বললো না৷ না হ্যাঁ কিছুই করলো না। কয়েক নালা খেয়ে অরু থমকে গেল। এবার প্রখর ভাবে পেট গুলিয়ে আসছে। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তন্ময় জোর করে আরও দু মুঠো খাওয়াতেই, বিপত্তি ঘটলো। তন্ময় অবস্থা বুঝে প্লেট সরিয়ে রাখল, ‘খারাপ লাগছে? আর খেতে হবে…’

তন্ময়ের কথা শেষ হতে পারেনি। অরু মুখ চেপে ছুটে গেল ওয়াশরুম। গদগদ করে একগাদা বমি করে বসলো। পেটে যা ছিলো সবই ফেলেছে। তন্ময় ইতোমধ্যে ছুটে এসেছে। অত্যন্ত চিন্তিত সে দিশেহারা। অরুর মাথা আগলে ধরেছে। চুল গুছিয়ে মাথায় পানি ঢেলে দিল। মুখ পরিষ্কার করে বিছানায় এনে বসালো। কপালে হাত ছোঁয়ালো, ‘কী হয়েছে? জ্বর তো নেই। তাহলে?’
‘ভীষণ খারাপ লাগছে।’

অরুর মাথাটা তন্ময়ের কোলে হেলে পড়ল। চোখ বুজে সে সেভাবেই রইলো। হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের কোমর জড়িয়ে নিল। সেই চিরচেনা পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। অরু কয়েক দফায় শুঁকে নিল। নেশা ধরে যায় এই ঘ্রাণে। এই ঘ্রান তো একান্তই তার তন্ময় ভাইয়ার৷ অরু তার ছোট নাক ঘষে দিল তন্ময়ের কোমরে। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘আপনার থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে। আমার খুব ভালো লাগে।’
‘শুয়ে পড়। দেখি…’

অরুকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে বসলো। চুলে আঙুল চালালো। অরু গভীর ভাবে তন্ময়ের বাম হাত দু’হাতের মুঠোয় নিয়েছে। সেভাবেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল। তন্ময় তবুও ঠাঁই বসে। চুপটি করে অনেকক্ষণ, একমনে চেয়ে থাকলো। অধর জোড়া এগিয়ে নিয়ে অরুর কপালের মধ্যস্থান ছুঁয়ে দিল। ধীর স্বরে আওড়াল, ‘এইযে মুগ্ধ নয়নে তোকে দেখতেই থাকি, তবুও তো দেখার সাধ মিটে না।’
_________
এখন রাত নয়টা। তন্ময় বেরিয়েছে সাতটায়। খুব ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং। নাহলে সে যেতো না। অরুকে এভাবে রেখে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। দ্রুত গিয়ে দ্রুত ফিরবে বলেই বেরোনো। জ্যামে আটকে সে পুনরায় কল করলো বাবাকে। মোস্তফা সাহেব ধরলেন গম্ভীরমুখে, ‘হ্যাঁ।’
‘হ্যালো বাবা?’
‘হু।’
‘আশরাফুল আঙ্কেল এসেছেন?’
‘না। আসবে এখনই।’
‘অরু ঘুম থেকে উঠেছে? বেশি খারাপ… ‘

মোস্তফা সাহেব ভোঁতা মুখে বললেন, ‘বাবা তুমি নিশ্চয়ই একা চিন্তিত নউ! আমরাও একইভাবে চিন্তিত। কাজ করতে গেছ, যাও। আমরা আছি অরুকে দেখার জন্য।’
‘সিরিয়াস কিছু হলে বলো।’
‘হু।’

জবেদা বেগম রান্না করছেন। অরুর পছন্দের তরকারি। চিংড়ির কোপ্তা। মেয়েটার মুখে সাধ নেই। তাই স্পেশাল কিছু রান্না করছেন। সুমিতা বেগম একটু পরপর উপরে যাচ্ছেন। মেয়েকে দেখে আসছেন। পায়েস, রসমালাই কতকিছুই নিয়ে গেলেন। কিচ্ছুটি মুখে তুলছে না। বমি করে বসছে। দীপ্ত ফিরেই অসুস্থ অরুর পাশে বসে। একেএকে বাড়ির সবাই অরুর কক্ষে চলে এলো। ডাক্তার আশরাফুলও ইতোমধ্যে চলে এসেছেন। আপাতত অরুর পাশে চেয়ার পেতে বসে হাতের নলি চেক করছেন। অরুর বন্ধ চোখ খুলে দেখে নিলেন। সময় নিয়ে বেশ কয়েকবার একইভাবে চেক করছেন। ভুরু জোড়া কুঁচকে এসেছে। লাগাতার আরও কয়েকবার একই পদ্ধতিতে কিছু চেক-আপ করে নিলেন। মোস্তফা সাহেব চিন্তায় পড়লেন। এগিয়ে এসে শুধালেন, ‘কী হয়েছে আশরাফুল? সিরিয়াস কিছু নাকি?’

আশরাফুল সাহেব হাত উঁচিয়ে থামতে বললেন। সময় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরিক্ষা নিরিক্ষা করে, ফিরে তাকালেন। চোখমুখ উজ্জ্বল। মুচকি হাসি ঠোঁট জুড়ে লেপ্টে। মোস্তফা সাহেব ভড়কে গেলেন, ‘কী হয়েছে?’
”আমার কাছে আয়।’

মোস্তফা সাহেব সামনাসামনি আসতেই, শব্দ করে হেসে আশরাফুল সাহেব মোস্তফা সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন। পাশাপাশি হেঁটে কক্ষ থেকে বেরোচ্ছেন। পেছন পেছন বাকিরাও আসছে। ঘুমন্ত অরুকে সকলে রেখে আসলো। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় আশরাফুল সাহেব বললেন, ‘বন্ধু বাড়িতে মিষ্টি আছে তো?’
‘মানে! মিষ্টি….’
‘না থাকলে আনা। মিষ্টি মুখ ছাড়া কিন্তু আমি যাচ্ছি না।’
‘অ্যাহ?’
‘বন্ধু! দাদা হতে যাচ্ছিস খুব শীগ্রই।’

নিস্তব্ধতা, নিরবতা বয়ে গেল। থমকে গেল চারিপাশ। রুখে গেল শ্বাসপ্রশ্বাস। চমকের চিহ্ন সকলের মুখশ্রীতে লেপ্টে। আনোয়ার সাহেব দু’কদম পেছনে চলে গেলেন। অবাকের চুড়ান্তে তিনি। কাঁধ রীতিমতো কেঁপে উঠেছে৷ সুমিতা বেগম কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরেছেন। চোখজোড়া বড়বড়। শাবিহা চিৎকার করে বসেছে। মোস্তফা সাহেব তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তার পা জোড়া থমকে যেমন। কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতেও ভুলে গেলেন।

চলবে~
‘নাবিলা ইষ্ক’

‘প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল’

৫৬.
স্তব্ধতায় আবব্ধ শাহজাহান বাড়ি৷ অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল। মোটেও বিশ্বাস করার মতো নয়। আপন বন্ধুর মুখ থেকে না শুনলে, কখনোই বিশ্বাস করতেন না মোস্তফা সাহেব। কতটা পারদর্শী ডাক্তার তার বন্ধু সে খুব ভালোভাবে জানে। অহেতুক ফাজলামো করার মানুষ সে নয়। তাহলে? বুকের ভেতর চিনচিন করছে। বুক ব্যথাটা আবারো শুরু হয়েছে! বুক আঁকড়ে বসে পড়লেন সোফায়৷ চোখমুখ থমথমে। বড্ড নাজেহাল অবস্থা তার! মানুষ ঠিক কতটা আশ্চর্য হলে, এভাবে থমকে যায়?

সুমিতা বেগম এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে আছেন৷ নড়ছেন অবদি না। বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। স্তব্ধ আনোয়ার সাহেব ঘুরে তাকালেন, বড়ো ভাইয়ের দিকটায়৷ পিটপিট চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, পরপর স্ত্রীর দিক দৃষ্টিপাত ফেললেন। সুমিতা বেগম তার নজর উপলব্ধি করে, ফিরে তাকালেন। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল দুজনের। আনন্দে বিমোহিত সুমিতা বেগম মুহুর্তে অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে দিলেন। ডুকরে কেঁদে স্বামীর উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমাদের অরু! ওগো, আমাদের অরু.. আমাদের ছোট্ট অরু… ‘ তার কথাগুলো জড়িয়ে আসছে। গুলিয়ে ফেলছেন। ঠিকভাবে বলতেও সক্ষম হচ্ছেন না। খুব বড়সড় শক পেয়েছেন। এতো দ্রুত কাটাতে পারবেন না।

সর্বপ্রথম শাবিহা নড়েচড়ে উঠলো। থমকে যাওয়া পা’জোড়া বহুক্ষণ লাগিয়ে সামনে বাড়ালো। কম্পিত গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘আশরাফুল চাচা।’

ডাক্তার আশরাফুল সাহেব ভীষণ বিরক্ত তখন। সরু চোখে শাহজাহান বাড়ির সদস্যদের মেপে নিচ্ছেন দুচোখে। বিশেষ করে অবাস্তবিক মোস্তফা সাহেবকে। এমন রিয়াকশন তিনি মোটেও আশা করেননি। কই ভাবলেন, তাকে কোলে তুলে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি হবে। চেঁচামেচি হবে, সোরগোল হবে। অথচ হলো কী? তার দেখা এই প্রথম পরিবার যারা, এতো মিষ্টি সুসংবাদ শুনে স্তব্ধীকৃত হয়ে গিয়েছে। শাবিহার ডাকে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলেন আশরাফুল সাহেব। ছোট্ট ‘হু’ শব্দ করলেন গম্ভীরমুখে। শবিহা ফটফট চোখে তাকিয়ে। খুব মেপে তোতলানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘সত্যি.. অ..অরু প্রেগন্যান্ট?’
‘হু।’

শাবিহা চেঁচাল। উচ্চকণ্ঠে। পরপর লাফাল। দু’হাতে মুখ ঢেকে সমানে চেঁচিয়ে চলেছে সে। তার উদ্ভট আচরণে মোস্তফা সাহেব বাস্তবে ফিরলেন যেনো। বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন। শব্দের তোড়জোড়ে কমবেশি সবাই নিজেদের ভাবনার সাগর হতে বেরিয়েছে। শাবিহা ছুটে জবেদা বেগমকে আঁকড়ে ধরেছে। মুখ গুঁজেছে বক্ষস্থলে। কন্ঠের স্বর ছটফট করছে, ‘মা! আমি খালামণি হতে চলেছি। খালামণি’ একটু ভেবে পুনরায় আওড়াল, ‘খালামণি নাকি ফুপিমণি? কোনটা হব? মা তুমি কী হতে যাচ্ছ? নানু নাকি দাদী? আমরা সব হতে যাচ্ছি মা। সব!’জবেদা বেগমের অধর জুড়ে হাসি। চোখ জুড়ে জল। অস্বাভাবিকভাবে মাথা দোলালেন।

আনোয়ার সাহেবের নয়ন জোড়া অজান্তে, আনমনে, বড্ড লুকিয়ে ভিজে উঠেছে। অত্যন্ত ঠান্ডা শ্রোত বয়ে চলেছে বক্ষস্থলে। হৃদ-স্পন্দন রুখে আসছে। তার ছোট্ট মা কখন বড়ো হয়ে গেল? মনে হচ্ছে, এইতো সেদিনই ছোট্ট টুকটুক পদক্ষেপ ফেলে সামনে এসেছে। সমানতালে কেঁদে বায়না ধরেছে, তার সঙ্গে অফিস যাবে। পিছু ছাড়বে না কোনোমতেই। তার সেই ছোট্ট মেয়েটা, তার অরুর কোল জুড়ে সন্তান আসছে! সে নানা হতে যাচ্ছে। এরথেকে সুখের সংবাদ কী হয়? হয়না!

মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়েছেন। আনচান করছেন সে। ছোট ভাইয়ের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। এতো বড়ো সু-সংবাদ শুনেও, গোপনীয় কারণ বসত সুখের বহিঃপ্রকাশ করতে পারছেন না। কীভাবে পারবেন? নিজের মেয়ে মাস্টার্স শেষ করে ফেলেছে। এখনো বিয়ে দেননি। এতো সময়, আহ্লাদ দিয়েছেন। অথচ নিজের আরেক মেয়েকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলেছে, তারই ছেলে। ভাইকে কীভাবে মুখ দেখাবেন সে? স্বল্প বয়সের অরু। কতটুকু বুঝ আছে তার? বিয়ের বা কতমাস হলো? আনুষ্ঠানিক বিয়েটাও এখনো দেননি। ভেবেছিলেন অরুর অনার্স শেষ করুক। তারপর নাহয় ধুমধামে বিয়ে দিবেন ছেলেমেয়ের। তারপর মাস্টার্স শেষ করল। তারপর নাহয় নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরা বেছে নিবে। কিন্তু কী হলো? তাদের অরু যে খুব ছোট, অবুঝ! কেবলই জীবন শুরু হয়েছে তার। এখনই তো ভার্সিটি জীবন উপভোগ করার সময়। এসময়…! মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তাভাবনা, দাদা হবার অগাধ খুশি ঢেকে দিয়েছে। দাউদাউ জ্বলছে ভেতরটা।

আনোয়ার সাহেব যেমন নিজের ভাইকে বুঝতে পেরেছেন। এগিয়ে গেলেন কাছাকাছি। খুব ভদ্রভাবে ডাকলেন, ‘ভাইজান!’

মাথা তুলে তাকালেন মোস্তফা সাহেব। আনোয়ার সাহেব প্রাণবন্ত রূপে হেসে বললেন, ‘নানা হচ্ছি।’

মোস্তফা সাহেবও দমে গেলেন। ঠোঁটের দু’প্রান্ত উঁচিয়ে আসছে, ‘আমি দাদা।’

মুহুর্তেই আনোয়ার সাহেব দুহাত মেলে দিলেন। খুব আলগোছে সমানতালে লম্বাটে, দু’ভাই বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হলো। ঠোঁটে দীর্ঘ হাসি তাদের। হাজারো অমত, হাজারো নগন্য চিন্তাভাবনা, এই আকাশকুসুম সুখের সামনে ফিকে পড়ে গেল মুহুর্তেই।

আশরাফুল সাহেব ছোট্ট স্বরে কাশলেন। গম্ভীরমুখে বললেন, ‘শাহজাহান বাড়ির মিষ্টি কী আমার নসিবে হবে?’

ওহী সাহেব হাসলেন। শব্দময় হাসি। হাসির রেশ ধরেই বললেন, ‘এই সু-সংবাদের জন্য তাজা মিষ্টি দ্বারাই মিষ্টিমুখ করাব। কতরকম মিষ্টি খাবেন, সবরকম খাওয়াবো। এই আকাশ! যাও…যতরকম মিষ্টি আছে, নিয়ে আসো।’

আকাশ হেসে মাথা দোলাল। পা বাড়াবে, পূর্বেই শুনল মোস্তফা সাহেবের গম্ভীর স্বর, ‘আকাশ! হতচ্ছাড়া’টাকে কল করো। এক্ষুনি ফিরতে বলো।
ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। অভদ্র ছেলে!’
_________
ভিন্নভাবে ভিন্ন অনুভূতি’তে ভেসে বেড়ানো শাহজাহান বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো হুট করে! এমন সময় কে এসেছে? কারো তো আসার কথা নয়! তন্ময়ের ফিরতে তো নিম্নে দু’ঘন্টা। বেশ খানিকটা দূরে চলে গিয়েছে সে। তাহলে কে? দীপ্ত লাফিয়ে ইতোমধ্যে ছুটে গিয়েছে দরজা খুলতে। খুশিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে সে। কখন যাবত খুশিতে লাফাচ্ছে সে, বলা মুশকিল। সদর দরজা সটানভাবে মেলে দিলো। দুয়ারে দাঁড়িয়ে লতা বেগম, পাশেই সৈকত সাহেব। অয়ন তাদের পেছনে লম্বাটে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। মাথা উঁচু। তার সাথে ড্রাইভার রোহান সাহেব ও উপস্থিত। হাত জুড়ে হরেকরকম মিষ্টান্ন। যতরকম মিষ্টি আছে, সবইতো এনেছেন মনে হচ্ছে!

অ-সময়ে এমন রাত করে, বিনাআমন্ত্রণে তাদের দেখতে পেয়ে ইতস্তত অনুভব করলেন মোস্তফা সাহেব। বড্ড চিন্তায়ও পড়লেন। এতসব মিষ্টি দেখে খানিক ভড়কেও গেলেন। সুসংবাদ তো মাত্রই এলো, সবেই শুনেছেন তারা। কাউকে তো বলা হয়নি। তাহলে এরা জেনেছে কীভাবে? মিষ্টি নিয়েও হাজির? তারাই তো এখনো মিষ্টিমুখ করতে পারেন নি! আনোয়ার সাহেব এগিয়ে গেলেন। প্রচেষ্টার সহিত হাসিমুখে স্বাগতম করলেন। লিভিং রুমে নিয়ে আসলেন। বসতে বললেন। নিজেও অপর পাশে বসলেন। অয়ন ঠিক মোস্তফা সাহেবের পাশে বসেছে টানটান হয়ে। আঁড়চোখে চারিপাশে তাকাচ্ছে। খুশিতে বাগবাকম মোস্তফা সাহেবের ভুরু-জোড়া খানিকটা কুঁচকালো। মনে মনে ছেলেটাকে আচ্ছা করে ধমকে দিলেন। অসভ্য পোলাপান আজকালকার! কই গুরুজনের সামনে মাথা নত করে, চুপসে লাজুক চোখে বসে থাকবে, তা না!

এতক্ষণ যাবত উৎসুক ভঙ্গিতে লাফানো শাবিহাও দমে গিয়েছে। মায়ের পেছনে লুকিয়েছে। আলগোছে আড়ালে আবডালে, রান্নাঘরে ছুটেছে।
সেখান থেকেই কয়েকবার লুকিয়ে তাকিয়েছে। হৃদকম্পন খেলায় মেতেছে হৃদয়। ধড়ফড় করছে ভেতরটা। নানান প্রশ্ন ভেসে উঠছে মস্তিষ্কে। এসময় কী করছে এখানে অয়ন? কই তাকে তো কিছুই বলেনি? উত্তেজিত শাবিহা, ঘাবড়ে গিয়েছে। ওড়নায় কোণ সমানে ঘষছে। পেছন দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কামরায় ফিরে মোবাইল হাতে নিল। অয়নকে মেসেজ দিল, দ্রুত হাতে। অয়নের জবাব এলো না। আরও কয়েকবার মেসেজ করলো, নো রিপ্লাই! বড্ড অস্বস্তিতে পড়েছে শাবিহা৷ আজ চারপাশ থেকে শুধু উত্তেজনা। উত্তেজনায় কী শাবিহা মরে টরে যাবে?

বাড়ির গিন্নি রা আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রুবিও তাদের সাহায্যের জন্য রয়ে গিয়েছে। এটাসেটা করে দিচ্ছে। হঠাৎ বুক চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো। মায়ের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘অরুকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব করে। মা আমি ওকে একটু দেখে আসি।’ বলেই সে ছুটে গেল। মুখ চেপে সিঁড়ি বাইছে। সে খুব ভালোভাবে একটু অরুকে দেখবে। কপালে একটা চুমুও খাবে। তার মন হাসফাস করছে। তাদের ছোট্ট অরুটা মা হতে যাচ্ছে, ইশ!

লিভিং রুমে বড়দের আসর। বড়দের সামনে শুধু ছোট্ট দীপ্ত দাঁড়িয়ে। দাঁত কেলিয়ে চলেছে সে। উৎসুক আচরণ করছে, অজানা তথ্য ছড়িয়ে দেবার জন্য। ওহী সাহেব চোখ রাঙিয়েছেন দু’বার। তাতে কাজ হলো বলে মনে হচ্ছে না। দীপ্ত মুচকি হাসছে। অয়ন হাতের ইশারায় ডাকল। দীপ্ত ছুটে তার রানে চেপে বসলো। অয়ন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এতো খুশি কেন?
‘সুসংবাদ।’
‘কীসের?’
‘আমি মামা, চাচা হতে চলেছি।’
অয়নের হাস্যজ্বল মুখশ্রী থমকে গেল। দু’চোখ বড়সড় আকার ধারণ করেছে। অবিশ্বাস্য স্বরে মিনমিন করে আওড়াল, ‘কী!’
__________
তীব্র বর্ষণ। ঝোড়ো হাওয়া। অশান্ত আঁধারে প্রকৃতি। রিমঝিম সুরে দুলছে গাছপালা। ফ্যাচফ্যাচে রাস্তা। ভ্যাপসা প্রাকৃতিক গন্ধ ভেসে আসছে। অত্যন্ত মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়া লেপ্টে। পিচ্ছিল রাস্তা ধরে চলছে আকাশী রংয়ের গাড়িটি। ছুটছে প্রগল বেগে। অগ্রাহ্য করছে বর্ষণ’কে, অশান্ত প্রকৃতিকে। নিস্তব্ধ গাড়ির মধ্যে সেলফোনটা বেজে উঠলো। তন্ময় পাশ ফিরে তাকাল। স্ক্রিনে আকাশের নাম ভেসে উঠেছে বড়সড় অক্ষরে। তন্ময় গাড়ি থামাল না। সেভাবেই ডান’হাতে হুইল সামলিয়ে, বা’হাতে এয়ারপোড কানে ঢোকাল৷ মুহুর্তেই আকাশের বিচলিত স্বর শোনা গেল। সে বেগতিক গতিতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় ফির। সর্বনাশ হয়ে গেছে।’

তন্ময়ের হৃদ স্পন্দন থমকে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস রুখে গিয়েছে। তার আতঙ্কিত জবাবের অপেক্ষা করলো না আকাশ। নিজের বক্তব্য শেষ করে, পরপর কল কেটে দিয়েছে আকাশ। তন্ময় ছটফটিয়ে ফের কল লাগালো। অশান্ত প্রকৃতি, পিচ্ছিল ফ্যাচফ্যাচে রাস্তার কথা মস্তিষ্ক থেকে ফেলে দিল। অসাবধানতার সহিত গাড়ি না থামিয়ে, হুইল ঘুরিয়ে গাড়ি বাড়ি ফেরা পথে নিতে উদ্বিগ্ন হলো। সর্বোচ্চ রিচ বাড়ালো গতির। কল লাগছে না। কেন? কী হয়েছে? তন্ময় ধড়ফড়িয়ে মোস্তফা সাহেবের সেলফোনে কল লাগাল। রিং হচ্ছে, রিসিভ হচ্ছে না। সবকিছু উলটপালট হয়ে আসছে চোখের সামনে। প্রকৃতির থেকেও অশান্ত তন্ময়ের ভেতরটা। ভয়ে রীতিমতো তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। অরুর ছটফটানো শরীর, ব্যথিত চেহারা ভেসে উঠছে চোখের সামনে বারংবার। তাকে দু’হাতে আঁকরে ধরে রেখেছিল। যেতে দিতে চাচ্ছিল না কোনোভাবেই। তন্ময় সেগুলো উপেক্ষা করে এসেছে। এগুলো ভাবতেই চাপা কষ্টে বুকে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। মস্তিষ্ক নানান খারাপ, বিশ্রী চিন্তাভাবনায় ভরে গিয়েছে। নাজেহাল করে তুলছে। গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধছে অরুর মুখশ্রী। তার আজ আসাটা ভুল হয়েছে। একদম ঠিক হয়নি! তার অরুর কিছু হলো না তো? হুইলে থাকা হাতটা কাঁপছে তন্ময়ের। বড্ড গোপনে দগ্ধ উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে। বক্ষস্থল অশান্ত সাগরের ন্যায় নিমজ্জিত। কিছু সেকেন্ডর জন্য দু-চোখ বুজে এলো যেমন। ঝোড়ো বর্ষণ ভেদ করে দেখা মিলছে ট্রাকের! সামনে বড়ো হলদে ট্রাক! সমানতালে, সমান গতিতে ছুটে আসছে এই ছোট্ট রাস্তা জুড়ে। চোখ মেলে তাকাতে দেরি করে ফেলেছে তন্ময়। ইতোমধ্যে ট্রাক তার গাড়ির সামনে চলে এসেছে। এতটা নিকটে, জরুরি বেগে ছুটে আসা গাড়িটি দেখে ভড়কে গেল সে। হইলে থাকা হাতটা স্তব্ধা খেয়ে বসলো। নিজের গাড়ির গতিও সে সর্বোচ্চ বাড়িয়ে রেখেছে। হুট করে ব্রেক কষাও অসম্ভব বটে। তন্ময় হন্তদন্ত ভঙ্গিতে হুইল ঘোরাতে চাইল। আশেপাশে কী আছে খেয়াল করলো না। তীব্র বৃষ্টির তন্দ্রাঘোরের আঁধারে বিলীন হলো যেন, আকাশী রঙের গাড়িটি। হুংকার ছুটিয়ে শব্দ করলো নিস্তব্ধ রাস্তায়। চারপাশ জুড়ে পোড়ানো ধোঁয়া উড়ছে। অস্পষ্ট আর্তনাদ, চিৎকার শোনা গেল। খানিকক্ষণের মধ্যে ফিরিয়ে দিয়ে গেল, একই নিস্তব্ধতা। পরমুহূর্তেই চারপাশ হতে ছুটে এসেছে জনগণ। চেঁচামেচি শুরু হয়েছে অনেকের। এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে তোড়জোড় করছে সকলে।

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here