পয়মন্তী,পর্ব ১৪
তামান্না জেনিফার
ক্লাসে গেলাম দূরুদূরু বুকে , একা একাই ৷ তবে যতটা ভয় পাচ্ছিলাম যাবার পর দেখলাম তেমন ভয়ের কিছু নেই ৷ প্রথম দিনেই বসলাম নিপুর পাশে , বাড়ি কুমিল্লা ৷ সহজ সরল সেই সাথে আন্তরিক ৷ এক দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো অদ্ভুত ব্যাপার ! আমি কখনোই এত সহজে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি না , কিন্তু নিপুর সাথে কিভাবে যে এত মিশে গেলাম বুঝলামও না ৷ বন্ধুত্ব বোধহয় এভাবেই হয় …
টিচাররা একে একে সবাই বক্তৃতা দিলেন ৷ আমি যেন মুগ্ধ হয়ে শুনলাম ৷ এভাবে এত মুগ্ধ হয়ে আমি শুনতাম আমাদের রফিক স্যারের কথা ৷ শুধু আমি না , কলেজের প্রত্যেকটা মেয়েই মুগ্ধ হয়ে শুনতো ৷ স্যার আমাদের ইংরেজী পড়াতেন ৷আমাদের ইংরেজী ক্লাস হতো বিশাল এক হলরুমে ৷ সায়েন্স , আর্টস আর কর্মাসের সব মেয়েদের একসাথে ক্লাস হতো ৷ অন্যান্য ক্লাস মিস দিলেও সচারচর নিতান্ত জরুরি কারন ছাড়া কেউ কখনোই রফিক স্যারের ক্লাস মিস দিতাম না ৷
স্যার আমাদের সিলেবাসের পড়া যতটা পড়াতেন তার চেয়েও বেশি পড়াতেন সিলেবাসের বাইরের পড়া ৷ গল্প শোনাতেন জিম এন্ড ডেলার , জিম তার ঘড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলো ডেলার চুলের জন্য চিরুনি কিনতে গিয়ে , আর ডেলা সেই চুল কেটে বিক্রি করেছে জিমের হাতের ঘড়ির জন্য একটা সুন্দর চেইন কিনতে গিয়ে ৷ স্যার সহজ সরলভাবে গল্পটা বলেছিলেন ৷ অথচ গল্প শেষে দেখা গেলো ক্লাসের সব মেয়েদের চোখে পানি টলমল করছে … সেদিন আমিও কেঁদেছিলাম ৷ আরো যে কত গল্প … আমরা গ্রামের মেয়ে , তিনি আমাদের চিনিয়েছেন পড়ার বইয়ের বাইরেও যে পড়ার জগৎ আছে সেটাকে ৷ আমাদের চিনিয়েছেন সমরেশ মজুমদার , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , মানিক বন্দোপাধ্যায় , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরকেও ৷
ক্লাসে এসে একদিন আমাদের শোনালেন শেষের কবিতা গল্পটা নিজের মতো করে ৷ ভরাট গলায় বললেন “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালোবাসারই। কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের ভালোবাসা, সে রইল দীঘি। সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।” সেদিন আগ পর্যন্ত আমি জানতামই না শেষের কবিতা একটা উপন্যাসের নাম ৷ আমার ধারনা ছিলো এটা কবিতার বই … অমিত লাবন্য , আহা ! গোগ্রাসে গিলেছিলাম স্যারের কথাগুলো ৷
আবার একদিন বললেন জন ডেনভারের একটা গানের কয়েকটা লাইন…
Today is the first day of the rest of my life
I wake as a child to see the world begin
On monarch wings, and birthday wonderings
Want to put on faces walk in the wet and cold
And look forward to my growing old…
এত চমৎকার লাইন আমি এর আগে কখনো শুনিনি , এরপরেও কখনো শুনবো বলে মনে হয় না ৷ এরপর থেকে রোজ সকালে আমি নিজেকে বলি “today is the first day of the rest of my life..” যে দিনগুলো গেছে তা তো চলেই গেছে ৷ তা তো শেষ ৷ যা চলে গেছে , শেষ হয়ে গেছে , যা আর শত চেষ্টাতেও ফিরবে না তার জন্য অযথা কেন কান্নাকাটি করবো ৷ বরং আজকের দিনটা আমার জীবনের বাকি দিনগুলোর মধ্যে তো প্রথমদিন ৷ আজ থেকেই সব ভালো হবে , হাল ছাড়ার তো কিছু নেই ৷ আমি হাল ছাড়তে জানি না ৷ যখন যেখানে মুখ থুবড়ে পড়ি , সেখান থেকেই আবার দাঁড়িয়ে ভাবি এখন থেকেই নতুন শুরু .. জন ডেনভারকে আমি চিনতাম না, আমি চিনতাম রফিক স্যারকে ৷ স্যার আমাকে লড়াই করার মূলমন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন ৷ এরপর বাকি পথটুকু লড়াই করতে পারবো আমি জানি , তা সে যে কারনেই হোক ৷ যেমনই হোক…
স্যার বলেছিলেন , ভার্সিটির আঙিনায় পা দেবার পর বুঝবে জীবনের আসল সংজ্ঞাটা কি ! আমি জীবনের সংজ্ঞা খুঁজতেই ভার্সিটিতে এসেছি ৷
দেলোয়ার স্যারের বক্তৃতা শুনে ভাবনার জাল কাটলো ৷ দেলোয়ার স্যার বেশ মজার মানুষ মনে হলো ৷ বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বললেন ” কাঠখোট্টা সাবজেক্ট পড়তে এসেছো , তবে এই কাঠের মধ্যে থেকে যারা রস খুঁজে নিতে পারবা তারাই সামনে আগাবা বুঝতে পারছো ? মানে ঐ আখের ভেতর ভেতর থেকে যেভাবে রস বের করে তোমাদেরও ফার্মেসির বইপত্রে ঐভাবেই আনন্দ খুঁজে বের করতে হবে ৷ মাথা পাগল পাগল লাগলে সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে যাবা , কাউন্সেলিং করা এসে আবার বইয়ে মন দিবা ৷ মন বইয়ে না দিয়ে অন্য কাউরে দিলে কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ ! আগেই বলে রাখলাম , পরে আবার বইলো না স্যার আগে তো বলেননি !….,”
স্যারের কথা শুনে ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো ৷ আমার যে কি ভালো লাগছে আমি কাউকেই বোঝাতে পারবো না ৷
হোস্টেলে ফিরে আসলাম ৷ নিপু আমার হোস্টেলের সামনে দিয়েই যায় ৷ দুজনে তাই একসাথেই হাঁটতে হাঁটতে ফিরলাম ৷ হাঁটছি এমন সময় ও ব্যাগ থেকে একটা অদ্ভুত ফল বের করে দিলো ৷ সবুজ রঙের , অনেকটা কামরাঙির মতো দেখতে ৷ খেতেও টক , তবে ভারি সুস্বাদু ৷ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম “এই ফলের নাম কি ? ” ও নাম জানি না দেখে আমার মতোই অবাক হয়ে বললো “এটার নাম বিলম্বু .. আগে খাসনি !!” আমি না সূচক মাথা নাড়লাম ৷ এরপর বাকি পথ নিপু শুধু বিলম্বুর গল্পই করলো ৷ ওদের বাড়িতে একটা মস্ত বড় বিলম্বুর গাছ আছে জানলাম ৷ এটা যে রান্না করেও খাওয়া হয় জানলাম ৷ ডালে দিলে নাকি ভীষন মজা লাগে , আবার ছোট মাছ দিয়ে টকও করা যায় … আমি বললাম , “আমি যখন বাড়িতে যাবো তার আগে আমাকে এনে দিস ৷ আমি বাড়িতে গিয়ে সবাইকে দেখাবো ” ৷
হোস্টেলে ফিরে আমি আবার একা ! আবার সেই শূন্যতা .. বিছানায় শুয়ে বাবাকে ফোন দিলাম ৷
—হ্যালো , আব্বা .. কেমন আছেন ?
—ভালোই আছি গো মা ৷ তা তোমার কেলাস কেমুন হইলো ?
—ভালোই আব্বা ৷ পারুল আপা বলে বাড়িত ? আমারে কন নাই ক্যান ?
—কি কমু মা ! সব আমার কপাল ..
—আব্বা আপনে যদি অভয় দেন কয়ডা কতা কবার চাই ৷
—হ কও
—আব্বা , পারুল আপারে কি বিয়াতে আপনে কম দিছেন ? তারপরেও হ্যাগো মন ভরেনি ৷ আপনি আরও দিলেও মন ভরবো এর কি কুনো গ্যারান্টি আছে ?
—নাই
—আব্বা আমি ছুটো মানুষ ৷ তয় আমার ছুটো মাথায় একটা বুদ্ধি আইছে ৷ আপনে শোনেন আব্বা , রাখা না রাখা আপনের ইচ্ছা ৷
—কও
—আপনে পারুল আপার শ্বশুরবাড়ি যাইবেন ৷ তারপর সবাইরে এক লগে কইরা কইবেন “আমি আর পারুলরে এই বাড়িত পাঠামু না ৷ আমার মাইয়্যা যা যা লগে আনছে সব ফিরোত দেন , নাইলে আমি কেস করমু , নারী নির্যাতন আর যৌতুকের ৷”
—না না এসব কওয়া যাইবো না, মাইয়্যার সংসার ভাঙবো ! আরআমি থানা পুলিশও করবার পামু না ৷
—আপনের কিছুই করা লগবো না ৷ খালি একটু ধামকি দিবেন এতেই কাম হইবো ৷এরা দেখছে চাইলেই পাওন যায় ! চাইলেই যুদিল পাই তাঅলে চাইতে দোষ কই !
—মা গো , মাইয়্যার বাপের এতু ত্যাজ ভালো না
—এইটা ত্যাজ হইলো কই ! আপনে আমার কতাডা ভাইবেন ৷ আমার মন কইতাছে কাম হইবো …
—আচ্ছা দেখি কি করা যায় !
বাবা কি করবেন জানি না ৷ তবে অন্যায় সহ্য করলে আজীবন সহ্য করে যেতেই হয় ৷ এক কষ্টে বারবার কষ্ট পাবো কেন ?
চলবে