পয়মন্তী,পর্ব ২
তামান্না জেনিফার
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো ৷ বাবার এত ক্ষমতা আর লোকবল কোনটাই কাজে লাগলো না ৷ বকুল আপাকে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া গেলো না ৷
আমার বৃদ্ধ বাবা ঘরে একা বসে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন ৷ আমার বোকা মা কাঁদছে ৷ আমরা বোনেরা চুপচাপ বসে আছি ৷ আসলে কি করা উচিত আমরা বুঝে উঠতে পারছি না ৷
হঠাৎ পারুল আপা উঠে বাবার ঘরের দিকে যেতে শুরু করলো ৷ আপার পেছন পেছন আমরাও গেলাম ৷ শুধু শিমুল আপা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘরে শুয়ে রইলো ৷ আপার বোধহয় জ্বর এসেছে , নয়তো এই গরমে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে কেন ! অবশ্য শিমুল আপার দিকে দেখবার সময় এখন আমাদের কারোই নেই ৷ আমরা সবাই পারুল আপার পিছুপিছু বাবার ঘরে গেলাম ৷
আপা বাবার পিঠে হাত রাখলো ৷ তারপর বললো ” আব্বা আপনে তাদের খবর পাঠান , আমি বিয়াতে রাজি ৷ আপনের মান আমি যাইতে দিমু না , বিয়া হইবো ৷”
আপার কথা শুনে আব্বা যেন অকুল দরিয়ায় খড়খুটো পেলো আঁকড়ে ধরার জন্য ৷ আপার মাথায় হাত দিয়ে দ্রুতসাদা পাঞ্জাবী আর পায়জামা পরে রওনা হলো পাত্রপক্ষের বাড়িতে ৷ বাবার সাথে গেলো গ্রামের আরো গন্যমান্য লোকজনেরা ৷ এরা আড়ালে আবডালে বাবাকে অপছন্দ করলেও সামনে সবাই চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য জান দেয় !
বাবা ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পর ৷ বাদ আছরে পাত্রপক্ষ আসার কথা ছিলো ৷ বাবা ফিরেই গলা বাড়িয়ে বললেন ” ওরে কে কোথায় আছিস , আমার পারুল মায়েরে একটু হলুদ ডইলা গোসল দে ৷ সময় বেশি নাই ! জলদি জলদি কামে লাইগা পর ৷ বাদ আছর বিয়া হইবো ৷ আমার পারুল মায়ে আইজ বাপের নাক বাঁচাইছে ”
এবার আর অত আয়োজন , রীতিনীতি কিছুই হলো না ৷ কারো যেন কোন আগ্রহ নেই ৷ পারুল আপা নিজেই কিছু হলুদ গায়ে মেখে গোসল করে আসলো ৷ আমরা সবাই অবাক হয়ে আপার কীর্তিকলাপ দেখতে থাকলাম ৷ কি হচ্ছে , কেন হচ্ছে এসব বোঝার অবস্থায় আমরা নেই !
কোন রকম শোড়গোল ছাড়াই পারুল আপার সাথে নওপাড়া গ্রামের ইসমাইল শেখের বড়পুত্র ইমরান শেখের সাথে দশ হাজার এক টাকা মোহরানা ধরে পারুল আপার বিয়ে হয়ে গেলো ৷ মাগরিবের নামাজ পড়লো সবাই বিয়ে পড়িয়ে ৷ এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে গেলো তারা পারুল আপাকে নিয়ে ৷ কনের বাড়ী থেকে নাকি কাউকে সাথে যেতে হয় , সেমন্তী এই দায়িত্ব পালন করলো ৷ পারুল আপার সাথে সেমন্তীও গেলো আপার শ্বশুড়বাড়ি ৷
পুরো বাড়িটা কেমন যেন মরা বাড়ির মতো চুপচাপ হয়ে গেছে ৷ বাড়িরও সম্ভবত প্রাণ থাকে ৷ আজ বাড়িটাকে মৃত মনে হচ্ছে আমার কাছে ৷
আমি সবসময় বকুল আপা আর সেমন্তীর সাথে ঘুমাতাম ৷ আমার বড্ড ভূতের ভয় ৷ গাছের পাতা নড়লেও আমি ভূত ভেবে ভয় পাই ৷ সেমন্তী ছোট হলেও তাই ওকে কখনোই মাঝখানে শুতে দিতাম না আমি ৷ বকুল আপার গায়ের সাথে মিশে মাঝখানে শুয়ে ঘুমাতাম ৷ আজ আমি এই ঘরে একা ৷ আমার ভীষণ ভয় ভয় করছে ৷
ইচ্ছে করলে শিমুল আপার কাছে যাওয়া যায় ৷ কিন্তু বোনদের মধ্যে শিমুল আপার সাথেই আমার দুরত্ব সবচেয়ে বেশি ৷ শিমুল আপা বড্ড কথা কম বলে ৷ সারাদিনে সে দশটা বাক্য বলে কি না সন্দেহ আছে ৷ মাঝে মধ্যে বকুল আপা আমাদের রাতের বেলা ভূতের গল্প শোনাতো ৷ রক্ত হীম হওয়া ভয়ঙ্কর সব গল্প ৷ এসব গল্প শুনতে পারুল আপা আমাদের ঘরে চলে আসতো ৷ আমাদের বিছানায় গুটিশুটি হয়ে গল্প শুনতো , তারপর আমাদের সাথেই ঘুমাতো ৷ কিন্তু শিমুল আপা কখনোই আসতো না ৷ আপার অতিরিক্ত কথা বলা আর শোনা দুটাই অপছন্দ ৷ এখন আমি হুট করে গিয়ে শিমুল আপাকে কিভাবে বলি ” আইজ রাইতে তোমার লগে ঘুমামু আপা ” .. আপা হয়তো না বলবে না , কিন্তু আমার নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে ৷
এসব ভাবনা চিন্তা করছি এমন সময় শিমুল আপা নিজেই এলো আমার ঘরে ৷
—পয়া , আইজ রাইতে তোর লগে ঘুমাই ? একলা একলা ফাঁপড় লাগতাছেরে বইন ৷
—হ , আইসো ৷ আমারও ডর করতাছিলো ৷ ভাবতাছিলাম তোমার লগে গিয়া ঘুমামু ৷
—তাইলে তো ভালোই হইছে ৷
—তোমার কি জ্বর আইছে ? দুপোরে দেখলাম ক্ষেতা গায়ে দিয়া শুইয়া রইছো !
—না রে বইন জ্বর না ! ডর !
—ডর ? দিনের বেলা কিয়ের ডর আপা ?
—বকুল আপা কই আমি জানি ৷
—ইয়া মাবুদে এলাহী ! এইগুলান কি কও !
—হ , আপার পীরিত আছিলো , যার লগে পীরিত আছিলো তার লগেই ভাগছে ৷
—এই কতাখান তুমি আগে কইলা না ক্যান ! আব্বা তাইলে ধইরা আনতো ৷ হুদা কামে পারুল আপা বিয়া খান করলো !
—এক জনেরে মন দিয়া আরেক জনের লগে ঘর বান্ধবো ক্যামনে ! যার লগে পীরিত তার লগেই সংসার ধর্ম ৷ আরেক জনেরে ঠকানো হইতো না বিয়াখান করলে !
—এত কতা আমি বুঝি না ! বকুল আপার পীরিত আছিলো সেই কথা আব্বারে আগে কইলো না ক্যান ! এমনে আব্বার সম্মান নিয়া খেললো এইটা কি ঠিক আপা ! আব্বার মুখের উপরে কেউ কিছু কইতাছে না ডরে , কিন্তু আড়ালে আবডালে কইতে কি ছাড়তাছে মনে করছো !
—সেই কতা তো আমিও বুঝি রে পয়া !
—তুমি আগে ক্যান কইলা না আমারে কও ? এই কামডা তুমি ভুল করছো আপা ৷
—আমি কি করমু ! আমি কি আগে এইসব জানতাম ! আপা পলানোর টাইমে আমারে ডাইকা তুইলা সব কইলো ৷ তারপর কইলো এই কতাখান আব্বা জানলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি !
—মরা মুখ দেখবি কইলো আর তুমি মাইনা নিলা ! আইজ যদি পারুল আপা আব্বার কথা ভাইবা বিয়াতে রাজি না হইতো মরা মুখ আব্বার দেখন লাগতো ! যা হইছে হইছে বাদ দেও ৷ এগুলান কয়া লাভ নাই ৷ তুমি যে জানো এইটা ভুইলা যাও ৷ আব্বায় জানলে তোমারে পুস্কনিত ডুবাইয়া মারবো ৷
—হ , এই ডরেই মইরা যাইতাছি ৷
—কার লগে ভাগছে বকুল আপা ?
—লতিফ ব্যাপারী
—আকরাম ব্যাপারীর পোলা ?
—হ !
—ইয়া আল্লাহ , ইয়া মাবুদ ! এই কতা শোনের আগে মইরা গেলাম না ক্যান ! দুনিয়ায় কি পোলার অভাব পরছিলো ! আর কেউ ছিলো না ! শ্যাষম্যাশ লতিফ ভাইয়ের লগে ভাগলো ! আপা , তুমি জানোনা ঐ হালায় কেমুন চরিত্রহীন ! গেরামের এমুন কোনো মাইয়্যা আছে যার লগে হ্যায় ইতরামি করে নাই !
—আমি তো জানি ৷ বকুল আপা কি জানতো না ?
—জানবো না ক্যান ? হ্যায় আমার পিছে যহন ঘুরতো আপারে কইনি আমি ? আবার সেমন্তীরে ইশকুলে যাইতে আইতে কম জ্বালাইছে ঐ হারামী ? বকুল আপা সবই জানে ৷ একবার যে ওরে স্যান্ডের খুইলা বাইড়াইছি এই কতাও আপা জানে ৷
—তাইলে আর কি ! জাইনা বুইঝাই গেছে ৷
—আমার মাথায় কিছু খেলতাছে না
—আমার মাথার ভিত্রে মনে হইতাছে কিছু নাই ! কিরাম জানি লাগতাছে আমার ৷ পয়ারে , আমার মাথাত তেল ডইলা দে ! মাথার ভিত্রে বহুত যন্ত্রনা ৷ আমি ঘুমামু ৷ আর কিচ্ছু ভাববার শক্তি নাই আমার ৷
আমি উঠে গিয়ে তেল নিয়ে আসলাম ৷ শিমুল আপার মাথাটা আমার কোলের মধ্যে নিয়ে আপার মাথায় তেল ডলে দিতে থাকলাম ৷ আপা কেমন যেন বারবার কেঁপে উঠছে ৷ শিমুল আপার জন্য এই প্রথম আমার ভীষণ মায়া হচ্ছে ৷ বেচারী এত বড় ঘটণা মেনে নিতে পারছে না ৷ বুঝে উঠতে পারছে কি করবে , কি করা উচিত ৷ আচ্ছা আমিও কি বুঝতে পারছি যে আমার কি করা উচিত ?
শিমুল আপা ঘুমিয়ে গেছে ৷ আমি পাশে বসে জেগে আছি ৷ আমার আর ঘুম নেই ৷ ঘুম আসা সম্ভবও না ৷ এখন কি হবে আমি জানি না , কেউই জানে না ৷ ভবিষ্যৎ বড় কঠিন জিনিস ৷ আজ এই মুহুর্তে আমি বেঁচে আছি , এক মিনিট পরই আমি যে বেঁচে থাকবো তার কি কোন গ্যারান্টি আছে ?
রাতের পর রাত আমরা একসাথে ঘুমিয়েছি ৷ কতরাত সেমন্তী ঘুমিয়ে গেছে , কিন্তু আমি আর বকুল আপা রাত জেগে জেগে গল্প করেছি ৷ আমার ভিতরে তো এমন কোন কথা নেই যেটা আপা জানে না ৷ তাহলে বকুল আপা এতবড় ঘটণা কিভাবে লুকালো আমার কাছে ! হয়তো আগে জানলে আমি আপাকে বোঝাতে পারতাম ৷ কিংবা হয়তো আপা জানে যে জানলে আমি বোঝাবার চেষ্টা করবো তাই হয়তো পুরো ব্যাপারটা গোপন করেছে আমার কাছে ৷ আমার খুব কান্না পাচ্ছে ৷ কি এমন হয়েছিলো যে আপা ঐ লম্পট লতিফের সাথে পালালো ? ভালোবাসা কি আসলেই এতটা অন্ধ , বিচার বিবেচনা বোধ বলে কি কিছুই থাকে না অবশিষ্ট ?
সারাটা রাত নির্ঘুম কেটে গেলো আমার ৷ সকাল বেলা আমাদের বাড়ি থেকে লোকজন গেলো পারুল আপার শ্বশুড়বাড়ি ৷ আমাদের এলাকার নিয়ম হচ্ছে বিয়ের পরদিন মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি থেকে মেয়েকে আনতে হয় ৷ এরপর বাপের বাড়ি একদিন থেকে মেয়ে আবার শ্বশুড় বাড়ি যাবে ৷ সেখানে আটদিন থাকার পর আবার বাপের বাড়ি এসে আটদিন থাকবে ৷ এরপর একবারে চলে যাবে স্থায়ীভাবে শ্বশুড়বাড়ি ৷ তখন শুধু উৎসব অনুষ্ঠানে আসবে ৷ এই পুরো ব্যাপারটাকে বলে ঘুরানি-ফিরানি ৷
দুপুরের আগে আগে পারুল আপা , নতুন দুলাভাই , সেমন্তী আর পারুল আপার ননদ আসলো আমাদের বাড়িতে ৷ পারুল আপার চোখ মুখ আনন্দে চিকচিক করছে ৷ কাল আপাকে যতটা নিষ্প্রান দেখাচ্ছিলো আজ ততটাই প্রানোচ্ছ্বল দেখাচ্ছে ৷ আপার আসাতে আমাদের মৃত বাড়িটাও যেন প্রাণ ফিরে পেলো ৷ পারুল আপাকে দেখা যাচ্ছে সারাক্ষন দুলাভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে ৷ একদিনের মধ্যে কি এমন হলো আমার মাথায় ঢুকছে না ৷ বকুল আপা সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু বলছে না ৷ সবার আচরনে মনে হচ্ছে বকুল আপা বলে কেউ আমাদের মধ্যে কখনোই ছিলো না ৷
আমি সেমন্তীকে ডাকলাম ৷ ওর কাছে পারুল আপার শ্বশুড়বাড়ি সম্পর্কে শুনবো ৷
—সেমন্তী , কেমুন দেখলিরে ?
—ভালাই
—খুইলা ক ! ভালাই আবার কি ?
—ছোটপা , আমার মনে হইতাছে নতুন দুলাভাইয়ের বাড়ির লোকজন বহুত লুভী , আব্বারে চাইছা খাইবো
—কস কি ! তোর এরাম মনে হইলো ক্যান ?
—উত্তরবন্ধে আমরার দশ বিঘা জমিন আছিলো না ? ঐটা আব্বা দান পত্র কইরা দিছে দুলাভাইরে ৷ হ্যারপর দুলাভাই পারুল আপারে বিয়া করতে রাজি হইছে ! জানোনা , সবাই জিগাইতেছিলো কি কি দিছে , কি কি পাইছে ! সবার মুখে খালি লেনদেনের কতা ! ছোটপা শোনো , আমারে যহন বিয়া দিবা যদি এমুন দেখো যে যৌতুক দেওন লাগতাছে , তাইলে না কইরা দিবা ৷ আমি বিষ খামু তাও যৌতুক দিয়া বিয়া বসমু না !
আমি ফ্যালফ্যালিয়ে তাঁকিয়ে রইলাম সেমন্তীর দিকে ৷ আজ আমার বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে …. কন্যা সন্তানের বাবা হওয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ ৷ আমার বাবা বোধহয় ব্যর্থ সেই চ্যালেঞ্জে ..
চলবে