পয়মন্তী,শেষ পর্ব (১৫)

0
1027

পয়মন্তী,শেষ পর্ব (১৫)
তামান্না জেনিফার

আমি মতিউর রহমান , লোকে আমায় বলে মইত্যা চেয়ারম্যান ৷ পাঁচ কন্যার বাবা ৷ আড়ালে গাঁয়ের মানুষ আমাকে নিয়ে হাসে ৷ বয়সকালে সেই হাসি আমার গায়ে লাগতো , বকুলের মাকে ভীষণ যন্ত্রনা দিতাম ৷ খারাপ ব্যবহার করতাম , মারপিটও করতাম ৷ দ্বিতীয় বিয়েও করেছিলাম , সেই বিয়ে টেকেনি ৷

সময়ের সাথে সাথে আমি বুঝলাম , আমার ভাগ্য কতটা ভালো যে কারনে আমি মেয়ের বাবা ৷ আমার মেয়েরা খুব একটা আমার কাছে ঘেষে না ৷ আমাকে একটু এড়িয়েই চলে ৷ ওরা হয়তো বোনেরা গল্প করছে , আমারও ইচ্ছে করে মেয়েদের পাশে গিয়ে মেয়েদের পাশে বসি ৷ কিন্তু মেয়েরা আমি কাছে গেলেই সব একসাথে চুপ হয়ে যেতো ৷ কোনদিনও নিজের ভালোবাসা ওদের দেখাতে পারিনি , ওরাও সহজভাবে নেয়নি ৷ আসলে আমার সবসময়ই কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করতো , মনে হতো যখন আমার যৌবনকাল ছিলো , মেয়েগুলো ছোট ছোট ছিলো , আমার দিকে হাত বাড়ালেও আমি ওদের দিকে ফিরেও দেখতাম না ৷ সে স্মৃতি হয়তো ওদের মনে নেই , কিন্তু আমার তো আছে !

বড়মেয়ে বকুল অবশ্য আমার ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছিলো ৷ ওকে আমি ধমক দিয়ে সরাতে পারতাম না ৷ চোখ ফুলিয়ে কেঁদে কেঁদে আবার আমার কাছেই আসতো ৷ একমাত্র বকুলই বোধহয় আমার স্নেহ পেয়েছে ৷ এ আমার ভারি অন্যায় ! আমি জানি , কিন্তু ঠিক করার উপায়ও জানি না , সাহসও নেই আমার … আমি বৃদ্ধ দূর্বল বাবা , সারাজীবন মেয়েদের বঞ্চিত করা বাবা …

সবচেয়ে বেশি অপরাধবোধ হয় আমার চতুর্থ মেয়ে পয়মন্তীর দিকে তাকালে ৷ এ মেয়েটি আমার ভারি বুদ্ধিমতী , ওর উপর দিন দিন আমি যে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি তা বোধহয় ও আজকাল টের পায় ৷ আমাকে ভরসা দেয় , আমার সাহস হয়ে আমার পাশে থাকে ৷

মেজো মেয়ে পারুলের দূর্দশার জন্য আমি নিজেও দায়ী ৷ শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে ওকে , যৌতুকের জন্য ৷ পয়া ঠিক বলেছে , ও বাড়িতে দিয়ে দিয়ে আমিই ওদের লোভ বাড়িয়েছি ৷

যাই হোক এইমাত্র পারুলের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরলাম ৷ পয়া ঠিক বলেছিলো ৷ যেই মুহূর্তে আমি ওদের বললাম আমি পারুলকে আর এই বাড়িতে পাঠাবো না , ওরা দেখি আমাকে তেলানো শুরু করলো ৷ পারুলের জামাই আমার পা ধরে ক্ষমা চাইলো , বললো পারুলকে আজই ফেরত নিয়ে যাবে ৷ আমি মেয়েকে ফেরত পাঠাবো , মেয়েটা আমার তার স্বামীকে বড় ভালোবাসে ৷ ওর সুখের জন্যই ফেরত পাঠাবো ৷ তবে মুখে ওদের বলেছি আমি ভেবে জানাবো ৷ বাড়ি এসে কথাটা পারুলকে জানাতেই ও যে কি খুশিটাই হলো ! মেয়েটার চোখ মুখ চিকচিক করছে ৷ আমি বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজই করেছিলাম , বিয়েতে নগদ অর্থ ছাড়া যা দিয়েছি সব আমার পারুলের নামেই দিয়েছি ৷ ওরা লোভী , লোভের বশে হলেও আমার মেয়েকে ভালোই রাখবে ৷ আর এখন আমি জানি , আমার মেয়েকে ভালো না রাখলে আমার কি করতে হবে …

আমার আজ আনন্দের দিন ৷ আমার পয়মন্তীর বুদ্ধিতে আজ আমার এ আনন্দ , অথচ এই মেয়েকে জন্ম দেবার অপরাধে ওর মা কে আমি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম ! এ লজ্জা আমার আমৃত্যু কাটবে না …

পারুলকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালাম আরো সাতদিন পর ৷ এর মধ্যে জামাই দুবার এসেছিলো , আপ্যায়ন করেছি তবে মেয়ে দেইনি ৷ শেষবার পুরো পরিবার এলে তারপর মেয়েকে পাঠিয়েছি , তবে তার আগে উকিলের কাছ থেকে ডিড করে এনে তাদের সই সাবুদ নিয়েছি ৷ আমি মূর্খ মানুষ , এত বুদ্ধি আমার কই ! এ ও আমার পয়ার বুদ্ধি !

এর কিছুদিন পর শিমুল ওর স্বামী আর জুনায়েদকে নিয়ে নিজের আলাদা সংসার পাতলো গঞ্জে ৷ জয়নালের দোকান এখন ভালো চলে ৷ ওরা আলাদা সংসার পাততে চাইলে আমি আর না করিনি ৷ ওরা ওদের মতো ভালো থাকুক …বাবা হিসেবে আমার চাওয়া শুধু এটুকুই , আমার সন্তানেরা ভালো থাক ..

জুনায়েদ আমার বকুলের সন্তান ৷ অথচ শিমুল যখন ওকে নিয়ে গেলো ওর কোন অনুভূতিই দেখলাম না ৷ বরং ওকে খানিকটা নিশ্চিন্ত মনে হলো ৷ বকুল অনেকদিন পর যেন স্বাভাবিক আচরণ করলো ৷ শিমুলকে শুধু বললো , “জুনায়েদরে কুনোদিন কইস না ওরে আমি জনম দিছি” …

আজকাল আমার বকুলকে নিয়েই চিন্তা হয় ৷ ওর জন্য কিছুই করা হলো না ৷ ওকে আবার পড়তে বলেছিলাম , ও রাজি না ৷ তবে আমার সয়সম্পত্তির দেখাশোনা করছে ও ৷ বর্গাদারদের কাছে যাচ্ছে , সব বুঝিয়ে দিয়ে আসছে , ভাগের ধানের দেখভাল করছে ৷ ও বোধহয় এতেই খুশি ৷ আমি ঠিক বুঝি না … কাগজে কলমে লতিফের সাথে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ৷ সময় হলে দেখে শুনে আমি বকুলের আবার বিয়ে দিবো , যদি ওর মত থাকে !

পুরো বাড়িটা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে ৷ তবে আজকাল সেমন্তী আমার সাথে অনেক সময় কাটায় ৷ আমার দেখভাল করে ৷বাইরে বের হবার সময় পাঞ্জাবী এগিয়ে দেয় , মাঝে মধ্যে টুকটুক করে গল্পও করে ৷ আমার বেশ ভালো লাগে ৷ এই মেয়েটি আমার কবে এত বড় হলো আমি বুঝতেও পারলাম না ! বকুলের মা আর আমার নিত্যক্ষনের সঙ্গী এখন সেমন্তী ৷ এ মেয়েটিও আমার ভীষণ বুদ্ধিমতি ৷

যে মেয়েদের আমি অবহেলা করেছি সারাটা জীবন , আমার বেলাশেষে অবাক হয়ে দেখছি ওরাই আমার বৃদ্ধকালে লাঠি….

********

ছয়মাস ! ছয়টা মাস আমি বাড়ি যাইনি … এর মধ্যে পুরো বাড়ির গল্পগুলো বদলে গেছে ৷ আজ ছয় মাস পর আমি বাসে , যাচ্ছি আমার বাড়ির পথে , আমার শৈশবে… একটু একটু করে বাস এগুচ্ছে আর আমি যেন আমার শৈশবের গন্ধ পাচ্ছি ..

অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে ৷ বাসের জানালার বৃষ্টি জমে যাচ্ছে … আমার ইচ্ছে করছে জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখি ৷ কানে হেডফোনে বাজছে

“হয় যদি হোক গল্প শেষ
যাক না এমন এইতো বেশ

হয় যদি হোক গল্প শেষ
পূর্ন হৃদয় ভুলবে সেদিন সময় শূন্যতার..”

কি অদ্ভুত না লাইন গুলো ! এত হৃদয়ছোয়া ! এ গান তো আগেও বহুবার শুনেছি ৷ এমন তো আগে কখনো লাগেনি !

আমি বাড়ি গিয়ে প্রথমেই কি করবো ? মা কে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরবো নাকি মায়ের বুকে আমি লুকাবো ! আচ্ছা আমার কি কান্না পাবে ? আমি কি মা কে দেখে কাঁদবো ? গত ছয় মাসে আমি কাঁদিনি একবারও , অনেক কান্না জমেছে আমার !

ক্লাস করতে ভালো লাগে , পড়তেও ভালো লাগে ৷ মিডটার্মগুলোতে ভালো রেজাল্ট করছি বলে স্যার ম্যামরাও আমাকে চিনে ফেলেছেন ৷ তাদের আদরমাখা কথাগুলো আমাকে ভীষণ শান্তি দেয় ৷ তবে বাড়ির জন্য আমার যে মন খারাপ ,তা যেন কিছুতেই ঠিক হয় না ৷ শূন্যতা রয়েই যায় !

আমার নতুন রুমমেটের নাম মনি , আমার সমবয়সী ৷ বন্ধত্বটা এখনো হয়নি , তবে হয়ে যাবে আমি জানি ৷ খোলস ছেড়ে বের হওয়াটা শিখে ফেলেছি এই অর্ধবছরে ৷ সবার সাথে মিশতে পারাটা শিখেছি ৷ ক্লাসের ফাঁকে হাই বেঞ্চে বসে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে হেরে গলায় গান গাইতে শিখেছি , রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা ফুসকা খাওয়াটা শিখেছি ! আমি বোধহয় বেশ ভালোই বদলে গেছি !

প্রতিমাসে বাবা টাকা পাঠালে প্রথমেই নীলক্ষেত যাই ৷ বই কিনি ৷ একটা দোকান থেকেই কিনি ৷ দোকানদার মামা আমাকে এখন বেশ আদর করেন ৷

এবার সেমন্তীর জন্য অনেকগুলো বই কিনেছি ৷ ও বই পড়া শিখুক , বইয়ের জগৎের সুখ পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই ৷

আমি যাচ্ছি জন্য আমার বোনেরা সবাই এসেছে ৷ পারুল আপা সন্তান সম্ভবা , ভেবেছিলাম ও হয়তো আসবে না ৷ কিন্তু দুলাভাই নিজে এসে ওকে রেখে গেছে ৷ বোনটা আমার ভালোই আছে ৷

বকুল আপা একটা স্কুল খুলেছে শুনেছি ৷ স্কুলের নাম আনন্দলতা ৷ এখানে সব বয়সের সবাই পড়তে পারবে ৷ রোজ রাতে আমাদের আঙিনায় এখন বকুল আপার স্কুল বসে ৷ ছোট ছোট শিশু থেকে বয়স্কা নারী পুরুষ সবাই আসে ৷ আমার বোকা মা নিজেও এই স্কুলের ছাত্রী ৷ মায়ের জন্য খাতা আর রঙিন কলম কিনেছি ৷ শাড়ি কিনতে চেয়েছিলাম , পরে মনে হলো মা এটাতেই খুশি হবে .. বাবার জন্য কিনেছি একটা আতরের শিশি ৷ সুগন্ধী আমার বাবার ভীষণ প্রিয় …

আর অল্প খানিকটা পথ ৷ বাস থেকে নামলাম ৷ বাকি পথটা ভ্যানে যেতে হবে ৷ ভ্যানে করে যাচ্ছি , সবাই আমাকে দেখছে ৷ গাঁয়ের মেয়ে গাঁয়েই যেন অতিথি এখন ! আসলেও অতিথির মতোই যাচ্ছি , ছুটি মাত্র পনেরো দিনের !

বাড়ির ভেতরে পা দিতেই আমার বুকের মধ্যে থাকা হৃদপিন্ডটা লাফাতে শুরু করলো ঝড়ের গতিতে ৷ আমার যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে এমন মনে হচ্ছে ৷

সাদা পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষ আমার দিকে ছুটে আসছে ৷ মানুষটার সাথে সাথে মাথায় কাপড় দেয়া গোলগাল মুখের একজন মাঝ বয়সী রমনী ছুটে আসছে আমার দিকে ৷ আমি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি , সামনে আগাবার শক্তি আমার নেই ৷

সাদা পাঞ্জাবী পরা মানুষটা আমাকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছে “পয়া , আমার মা , আমার মারে…আমার মা আসছে …” এই মানুষটা আমার বাবা ৷ পাশে দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছে আমার বোকা মা …

এ কান্না আনন্দের !
আজ তাদের পয়া ঘরে ফিরেছে…

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here