পয়মন্তী,০৪,০৫

0
370

পয়মন্তী,০৪,০৫
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৪
_________________

দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হলো ৷ প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা তখনও বাকি ৷ খাতা সই করা হয়নি ৷ গ্রামের কলেজগুলোতে প্রাকটিক্যাল খাতার ব্যাপারে স্যার ম্যাডামদের আগ্রহ কম ৷ খাতা নিয়ে তাদের পেছন পেছন ঘোরা লাগে ৷ আমি সকালে বের হই , সারাদিন খাতা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরি ৷ এতদিনে এসে তারা বলছে খাতায় কোথায় কোথায় ভুল ৷ আমার অসহ্য লাগে ! আমি আবার নতুন করে ভুল ঠিক করতে বসি ৷ পরদিন আবার যাই , তবুও খাতা সই করাতে পারি না ৷ জানা যায় হয় স্যার আসেননি , না হয় এসেছিলেন চলে গেছেন ৷ একেকবার মনে হয় প্রাকটিক্যাল খাতা ছিঁড়ে ফেলি ৷ পরীক্ষা দিতেও এত কষ্ট হয়নি , যতটা এই আটটা খাতা ভোগাচ্ছে ৷

একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখলাম কলেজের কাছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে লতিফ ব্যাপারী ৷ তাকে দেখেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো ৷ আমি দ্রুত বাড়ির দিকে পা চালালাম ৷ লাভ হলো না , লতিফ ভাই আমাকে দেখে ফেললো ৷ উনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসতে শুরু করলেন ৷ সাইকেল নিয়ে আমার চারপাশে গোল গোল ঘুরতে শুরু করলেন তিনি ৷ আমি প্রাকটিক্যাল খাতা বুকে চেপে ধরে শক্ত গলায় বললাম

—পথ ছাইড়া খাড়ান লতিফ ভাই

—ক্যান ! না ছাড়লে কি করবি ?

—আমি কিন্তু চিক্কুর দিয়া লোক জড়ো করমু

—কর , কর না .. তোর বড় দুলাভাই আমি ৷ শালী লগে ইতরামি না করলে কার লগে করুম ! আমার ছুটু শালী কই ? রসোগোল্লাটা ! বকুলরে যতবার দেখি খালি মনে মনে আফসুস করি ছুটু শালীডার জন্য !

—লতিফ ভাই , পথ ছাড়েন ! ইতরামি অন্যখানে গিয়া কইরেন ৷ আমি বকুল না , আমি পয়া ৷ আমার লগে ইতরামি করলে ফল ভালো হইবো না ৷

—এতদিন পরে দেখা হইলো কই দুলাভাই দুলাভাই কইয়া আদর সোহাগ করবি তা না , খালি দেমাগ ! তোর দেমাগ সবটির চায়া বেশি ৷ শোন মাগী মানুষ এত দেমাগ দেখাইবি না , থাকনতো লাগবো সেই আমরার পায়ের তলাতেই , খিক খিক

আমার আর সহ্য হলো না ৷ কি অবলীলায় নোংরা ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে লোকটা ৷ এই লোকটা নাকি সম্পর্কে আমার দুলাভাই ! আমার একটাবারও মনে হলো না বকুল আপার কোন খবর নেই ৷ বরং বকুল আপার উপর ভীষণ রাগ হতে লাগলো ৷ আমাদের বাড়ির আজ যে পরিস্থিতি তার শুধুই বকুল আপার জন্য ৷

বাড়ি ফিরে এসে সোজাসুজি কুয়োতলায় গেলাম ৷ আমাদের জন্য বাবা বাথরুম বানিয়ে দিয়েছেন গোসলের জন্য ৷ কিন্তু কুয়োর পানি ভীষণ ঠান্ডা ৷ আমার মাথাটা আগুনের মতো গরম হয়ে আছে ৷ আমি ঠান্ডা পানি তুলে মাথায় ঢালতে লাগলাম ৷ মাথায় পানি ঢেলে ঘরে আসবো দেখি মলিদা দাদী মায়ের সাথে রাগারাগি করছেন ৷

“আমরার মইত্যা হাভাইত্যার ঘরেরথন মাইয়া লইয়া আইছে ৷ দশজন মাইনষের একবেলার খাওন কতডি চাউল লাগে তারও হিসাব জানে না ! জানবো কইথ্থে ! বাপের ঘরে দেখছেনি এত খাওন ! ”

আমার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেলো ৷ খাতা সই করতে না পারার রাগ , লতিফ ভাইয়ের নোংরা কথা , মলিদা দাদীর গজগজানি সব মিলিয়ে আমি খুব খারাপভাবে ফেঁটে পরলাম ৷ একজন বয়স্ক মানুষের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সে কথা আর আমার মনে রইলো না ৷ মা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো ,মলিদা দাদী আঙ্গুল তুলে তুলে মায়ের গুষ্ঠী উদ্ধার করছিলো ৷ আমি ধীর পায়ে তার সামনে গেলাম , তারপর তার আঙ্গুলটা ধরে উল্টা দিকে দিলাম একটা চাপ ৷ ঘটণার আকষ্মিকতায় মলিদা দাদী ঘাবরে গিয়ে চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে লাগলো “ওরে মইত্যা , মইত্যা রে দেইখা যা আমার আঙ্গুল ভাইঙা ফালাইলো রে … ”

মলিদা দাদীর চিৎকার শুনে বাবা ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে আসলেন ৷ বাবাকে দেখে আমি দাদীর হাত ছেড়ে দিলাম ৷ তারপর একদম বাবার চোখে চোখ রেখে বললাম “আপনের ফুফুরে বুঝাইয়া দেন , আমার মায়ের দিকে আঙ্গুল তাক করলে হ্যার আঙ্গুল আমি ভাইঙা দিমু ৷ তারপর হ্যারে সহ আপনেরে জেলের ভাত খাওয়ামু ৷ আপনের ফুফুরে কতাডা বুঝাই দিয়েন ৷ আমার মায় একলা আছিলো , বহুত অত্যাচার করছেন ৷ আমার মায়ে অহন একলা না ৷ ”

আমার হঠাৎ এত ধারালো কথা শুনে বাবা আর মলিদা দাদী দুজনেই চুপ হয়ে গেলেন ৷ আমিও চুপ ৷ এতক্ষন ভয় পাইনি কিন্তু এখন আমার ভয় লাগছে ভীষণ ৷ তাড়াতাড়ি মা কে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম ৷

মা অবাক হয়ে আমাকে দেখছে ৷ তারপর বললো “মাগো মাইয়্যা মাইনষের এত জবান ভালো না ৷ হ্যায় তোমার দাদী , বয়সে বড় , আমরার গুরুজন , হ্যার লগে এমুন ব্যবহার করা তোমার ঠিক হয়নাই মা ৷ মাটির উপ্রে দিয়া কত জীবে হাঁটে , মাটি কি কতা কয় ? সবার দেয়া বেদনা সইহ্য কইরা চুপচাপ রয় ৷ মাইয়্যা মানুষের হইতে হয় মাটির মতোন ৷ মানুষে যত যন্ত্রনাই দিক , রাও কাটা যাইবো না ৷ ”

এই মানুষটাকে আমি কি বলবো ৷ এত অপমান সহ্য করেও তার মনে হচ্ছে মেয়ে মানুষকে মাটির মতো সহনশীল হতে হবে ৷ খুব ইচ্ছে করলো বলি ” মা , মাইয়্যা মানুষ মাটি না , মাইয়্যা মানুষরে হইতে হইবো আগুন ৷ অন্যায় দেখলে যেন সব জ্বালায়া পুরায়া দিতে পারে ..” আমি কিছুই বললাম না ৷ শুধু শক্ত করে মা কে আমার বুকের মধ্যে ধরে রাখলাম ৷

রাতে বিচার বসলো বাড়ির উঠানে ৷ বিচারক আমার বাবা , অপরাধী আমি ৷

বাবার পাশে চেয়ার নিয়ে বসেছেন মলিদা দাদী আর জয়নাল দুলাভাই ৷ জয়নাল দুলাভাইয়ের মুখ হাসি হাসি ৷ এমন একটা বিচার কার্যের অংশ হতে পেরে তিনি বেশ খুশি ৷

মা একটু দূরে একটা টুল নিয়ে বসেছেন ৷ মায়ের পাশে শিমুল আপা , আমি আর সেমন্তী দাঁড়িয়ে আছি ৷ মলিদা দাদীর আঙ্গুল ফুলে গেছে , সেখানে তিনি চুন লাগিয়ে রেখেছেন ৷ আমার মনে হলো আজকের বিচারে আমার শাস্তি ঠেকাতে হবে ৷ আজ যদি আমি শাস্তি পাই মলিদা দাদীর জয় হবে ৷ আমি জানি আমি অন্যায় করেছি , আমার এভাবে একটা বয়স্ক মানুষের হাতের আঙ্গুল বাঁকানো ঠিক হয়নি ৷ তবে মলিদা দাদী যা করছেন তারও একটা শাস্তি হতেই হতো ৷

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম বাবাকে কি বলা যায় নিজের শাস্তি ঠেকানোর জন্য !

বাবা ইশারায় আমাকে সামনে ডাকলেন ৷ মলিদা দাদী আমাকে দেখেই আঙ্গুল ধরে আরেক দফা কুঁকিয়ে উঠলেন ৷ তারপর বললেন ” মইত্যা , তোর এই মাইয়্যা যদি কানে ধইরা আমার কাছে মাফ না চায় আমি এই বাড়িত আর থাকুম না , ওয় কানে ধরবো , নাকে ক্ষত দিবো তারপর হ্যারে মাফ দিমু ”

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷

বাবা বললো “তোমার দাদী কি কইছে শুনছো ? যা কইছে তাই করো , হ্যারপর হ্যার পায়ে ধইরা মাফ চাও , কথা বাড়াইবা না ”

আমি বললাম “আব্বা , আপনি বললে আমি অবশ্যই মাফ নিমু ৷ তার আগে আমারে একখান কতা কন আব্বা ৷ শুনছি আপনের বাপ মাও যেইবেলা মরছে পথে পথে ঘুরছেন ভাতের লেইগা ৷ আপনের এই ফুফু তখন আছিলো বড়লোকের বাড়ির বউ ৷ কয়বেলা আপনেরে ডাইকা খাওয়াইছিলো আব্বা ? আরেকখান কতা কন , ছোটমায় যহন আপনেরে হাজত খাটাইলো , আপনের কোন স্বজনডা আপনের কাছে আছিলো ? এক আমার মায়ে ছাড়া আর কেডা আপনেরে ছাড়ানের জন্যে খাঁটছে আমারে কন ৷ এই দুইখান কতার উত্তর দিবেন , হ্যার পর আমি কানেও ধরুম , নাকে খতও দিমু , দাদীর পাও ধইরা মাফও চামু ”

আমি কথাগুলো বলে নিজেই নিজের পিঠ চাপরালাম ৷ উচিত কথাগুলো জায়গামতো ব্যবহার করতে পেরেছি ৷ দেখলাম বাবার মুখটা শুকিয়ে গেছে ৷ জয়নাল দুলাভাই আর মলিদা দাদীর মুখও চুপছে গেছে ৷ মলিদা দাদী বুঝলেন বল তার কোর্ট থেকে এখন আমার কোর্টে চলে এসেছে ৷ তিনি কিছু একটা বলতে চাইলেন , ঠিক তখনি শিমুল আপা ছুটে এসে আমার হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়ালো ৷ একটু পর সেমন্তী এসে আমার অন্য হাত ধরে দাঁড়ালো ৷ আমি বুঝলাম আমি আর একা নই ৷ আমার এতক্ষন বেশ ভয় ভয় লাগলেও হুট করে যেন আকাশ সমান সাহস পেলাম ৷

বাবা অনেকক্ষন চুপ থেকে উঠে দাড়ালেন ৷ তারপর হাত উঠিয়ে বললেন “সবাই যার যার ঘরে যাও … বকুলের মা , আমার খাওন দেও ”

সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো ৷ আমরা তিন বোন উঠানেই বসে রইলাম ৷

কিছুদিন আগেও এই উঠানে আমরা পাঁচবোন বসে আড্ডা দিতাম ৷ এখন সংখ্যাটা তিনে এসে ঠেকেছে ৷ শিমুল আপা চলে গেলে দুই হয়ে যেতো ৷ একদিক থেকে ভালোই হয়েছে শিমুল আপাকে যে যেতে হয়নি ..

হঠাৎ মনে হলো লতিফ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিলো এই কথাটা কাউকে বলিনি ৷ আমি শিমুল আপাকে ডেকে বললাম “আপা জানো , আইজ লতিফ ভাই আমার পথ আটকাইছিলো ”

শিমুল আপা অবাক হয়ে বললো ” লতিফ ভাই গেরামে ? তাইলে বকুল আপা কই ? ”

অদ্ভুত ব্যাপার এই প্রশ্নটা আমার মাথায় এলো না কেন !

চলবে

পয়মন্তী
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৫
_________________

পরদিন খুব ভোরে উঠলাম ৷ তখনও সূর্য ঠিকমতো উঠেনি ৷আমার উদ্দেশ্য লতিফ ভাইয়ের বাড়ি যাবো , গিয়ে জিজ্ঞেস করবো বকুল আপা কই ৷ একা যেতে আমার ভয় ভয় লাগছিলো ৷ সেমন্তী তখনও গভীর ঘুমে ৷ ওকে ধাক্কা দিয়ে তুললাম ৷ ও তো কিছুতেই উঠবে না , আমি সাথে নিয়ে যাবোই ৷ আর কি করা , চোখ ডলতে ডলতে সেমন্তী আমার পেছন পেছন আসতে লাগলো ৷

লতিফ ভাইদের বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলাম আমরা ৷ গ্রামের বাড়ি , সদর দরজায় আলাদা কোন তালা দেওয়া নেই , খোলা দরজাটা শুধু চাপিয়ে রেখেছে ৷ একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো ৷ এ বাড়িতে আগেও বহুবার এসেছি ৷ চাচী আমাদের খুব আদর করতেন ৷ লতিফ ভাইয়ের ঘরও চিনি ৷ সেই ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় নক করলাম ৷ নিজের সাহস দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি ৷ এখন আমি বিপদেও পরতে পারি ৷ ভয় পাচ্ছি ঠিক , কিন্তু দরজায় শব্দ করা থামালাম না ৷

দরজা খুলে দিলো লতিফ ভাইয়ের বোন , শ্যামলী আপা ৷ আমি তাকে দেখে অবাক হলাম আবার সাহসও পেলাম ৷ শ্যামলী আপাকে বললাম ” আপা , লতিফ ভাই কনে , হ্যারে ডাকো , হ্যার লগে কতা আছে ”

আপা শান্ত গলায় বললেন ” হ্যায় কাইল বিয়ানে যখন আইছিলো আব্বায় জুতা দিয়া এমুন পিটান পিটাইছে , মাইর খায়া হ্যায় ঐবেলায় গেছেগা , আর আহেনি ৷”

আমি বললাম ” আপা , লতিফ ভাই কি একলাই আইছিলো ? নাকি লগে বকুল আপা আছিলো ? ”

শ্যামলী আপা বললো ” একলাই আইছে ”

সেমন্তী আমার ওড়না ধরে টানছে , ও বাড়ি যেতে চায় ৷ আমিও বুঝলাম শ্যামলী আপার কাছে আর কোনো খবর আমি পাবো না ৷ তাই বাড়ির পথে পা বাড়ালাম ৷ গেট পার হবো এমন সময় শ্যামলী আপা ডাকলো ” পয়া , শুইনা যা ”

আমি সেমন্তীর হাত ছেড়ে দৌড়ে শ্যামলী আপার কাছে গেলাম ৷ আপা আমার কাঁধে হাত রেখে বললো ” হ্যারা সিলেট থাকে ৷ আমার কাছে ঠিকানা আছে ৷ কাইল ভাই আমারে ঠিকানা দিয়া গেছে ৷ কইছে আব্বারে ঠান্ডা করাইয়া আমি য্যান চিঠি লেখি ৷ আমার ভাইডা অমানুষ , বকুল আপা নিশ্চিত কষ্টে আছে ৷ তুই ঠিকানাডা চেয়ারম্যান চাচারে দিস ৷ চাচারে কইস বকুল আপারে য্যান দেইখা আসে, অবস্থা বুইঝা লাগলে য্যান ফেরত লইয়া আসে ৷ বকুল আপা বলে পোয়াতী , তুই চাচারে যেমনে পারিস বুঝায়া পাঠা সিলেট ৷ আমিও আব্বার লগে কতা কমু ৷ লাগে আব্বারেও পাঠামু চাচার লগে ৷ আমার ভাইডা অমানুষ , ওরে বিশ্বাস পাইনারে পয়া ৷ বকুল আপারে গেরামে আনোনের ব্যবস্থা করন লাগবো ৷ আইজ আমিই যাইতাম তোগো বাড়ি , তুই আইসোস ভালা হইছে ”

শ্যামলী আপা একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো এনে দিলো আমাকে ৷ আমি নিঃশব্দে সেই কাগজের টুকরো নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম ৷

ততক্ষনে মা উঠে গেছে ৷ গোয়াল ঘর থেকে একটা বড় সীসার গামলা ভর্তি গোবর কাঁখে করে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির পেছনে ৷ এই গোবরগুলো মা ঘুটে বানাবে ৷ আমি মায়ের পেছন পেছন গেলাম ৷ পাটকাঠির গায়ে গোবর চেপে চেপে মা লম্বা লম্বা ঘুটে বানিয়ে শুকাতে দিচ্ছে ৷ এই কাজটা মা সূর্য উঠার আগেই শেষ করে ৷ এরপর পুকুরে গোসল করে এসে চুলার পাড়ে ঢোকে ৷ সারাটাদিনে মা একটা ঘণ্টাও অবসর পায়না ৷ কাজের লোক আছে , আমরা বোনেরা আছি , তবুও মায়ের কাজ শেষ হয় না ৷ কাজের লোকের চেয়ে দশগুণ বেশি কাজ মা একাই করে ৷

আমাকে এত ভোরে বাইরে থেকে আসতে দেখে মা বেশ অবাক হলেন ৷ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন

—কনে গেছিলি মা ?

—লতিফ ভাইগো বাড়ি

—ঐহানে গেছিস ক্যান ? তোর আব্বায় জানলে মাইরাই ফেলবো তোরে ৷ সেমন্তীরেও লইয়া গেছিলি ? তোর বেদম সাহসরে মা , মাইয়্যা মানুষের এত সাহস ভালা না ৷

—মা , তোমার বকুল আপার কতা মনে পরে না ?

—যারে কলিজার ভিত্রে গাইথা রাখছি , তারে আবার আলদা কইরা কি মনে পরবো ! ভুললে না ইয়াদ করুম !

—মা , শোন , বকুল আপার খোঁজ পাইছি ৷

‘—কই আছে বকুলে ?

—সিলেট ৷ আমার লগে ঠিকানা আছে ৷ আপার সন্তান হইবো ৷ মা শোন , আব্বার লগে কতা কও ৷ তারে সিলেট পাঠায়া আপারে লইয়া আসো ৷

—তার লগে এইসব কইতে পারুম নারে মা ৷ ওয়াদা দিছি , কুনোদিন বকুলের নামে তারে কিছু কমুনা ৷ যা তো মা , মুরগির খোয়ার খুইলা দে , মুরগিগুলারে খাওন দে ৷ বাড়িত যা , আমি পুস্কনিত থেইকা ডুব দিয়া আসতাছি ৷

বুঝলাম মা এই বিষয়ে কথা বলতে চায় না ৷ আমি ঘরে চলে এলাম ৷ মুরগির খোয়ার খুলে দিলাম না ৷ থাকুক বন্ধ , রোজ তো আমি খুলিনা ৷ রোজ যে খোলে সেই খুলবে ৷ ঘরে ঢুকে দেখি শিমুল আপা আমার বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ৷ আজ সবার ঘুম সকাল সকাল ভাঙলো কেন কে জানে ৷ আমি ঘরে ঢুকে শিমুল আপার পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম ৷ একটু পর দরজার কাছ থেকে জয়নাল দুলাভাইয়ের মিহি গলা শোনা গেলো “শিমুল , ও বউ , ঘরেত আসো , শিমুল , ও বউ…”

শিমুল আপার কোন সারা শব্দ পাওয়া গেলো না ৷ সে জেগেই আছে , কিন্তু কোন উত্তর দিচ্ছে না ৷ আমি বললাম , ” আপা , দুলাভাই ডাকতাছে তোমারে শোনোনা ? ” শিমুল আপা ক্লান্ত গলায় বললো “ডাকুক ”

এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ সমস্যায় আছে ৷ সবার সমস্যাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ৷ কিন্তু সমস্যা সমাধানের চেষ্টাটা কারো মধ্যে নেই ৷ মা যদি শক্ত করে সংসারের হালটা শুরু থেকেই ধরতো তাহলে হয়তো বাড়ির চেহারা এখন অন্যরকম হতো ৷ এ বাড়ির জন্য আসলে ছোটমাই উপযুক্ত ছিলো ৷ আমার মায়ের মতো নরম স্বভাবের মানুষেরা সারা জীবন কষ্ট করে যায় , এই বোধটুকুও তাদের মধ্যে আসে না যে তার সাথে অন্যায় হচ্ছে ৷

আমি এই বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাই ৷ পরীক্ষার পর আমাকে এই বাড়ি ছাড়তেই হবে ৷ ঢাকায় যাবো আমি ৷ এর পরের পড়া পড়বো ঢাকাতেই ৷ বাবা রাজি হবেনা আমি জানি ৷ কিন্তু রাজি তাকে হতেই হবে ৷ আমি সয়ে সয়ে ক্ষয়ে যাওয়া মানুষ নই ৷ নিজের অধিকার আমি আদায় করে নিতে জানি , আমাকে জানতেই হয়েছে ৷ তিনবোনের বিয়ে হয়ে গেলো , সিরিয়ালে নিশ্চয় আমি ৷ বাবা কিছু বলার আগে আমাকে বলতে হবে ৷ তবে এখন না ৷ আগে বকুল আপাকে গ্রামে আনা জরুরি ৷ অসুস্থ অবস্থায় কিভাবে যে বকুল আপা দিনাতিপাত করছে স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না ৷ মা বাবার সাথে এবিষয়ে কথা বলবে না , যা বলার আমাকেই বলতে হবে ৷

বেলা হয়েছে ৷ মায়ের নাস্তা বানানো শেষ ৷ এখন জয়নাল দুলাভাই আর মলিদা দাদীর জন্য প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে ভালো ভালো খাবার রান্না হয় ৷ আজ দেখলাম মা তেমন কিছু করেনি ৷ ঘরজামাই ব্যাপারটা বোধহয় এমনই ৷ দীর্ঘদিন শ্বশুড়বাড়িতে জামাই মানুষ যখন থাকে তখন আস্তে আস্তে ঘরের বাসন কোসনের মতো জামাইও পুরাতন হয়ে যায় ৷ তাদের জন্য আলাদা করে চৌদ্দ পদ আর রান্না করতে হয় না ৷

মা খিঁচুড়ি আর ভর্তা করেছে সকালের জন্য ৷ বকুল আপার প্রিয় খাবার এটা ৷ বকুল আপা ছাড়া আর কেউই তেমন পছন্দ করেনা এটা ৷ খেতে বসে বাবা খানিকক্ষন হাতাহাতি করলেন খিঁচুড়ি নিয়ে ৷ কিন্তু খেতে পারলেন না বোঝাই গেলো ৷ নাড়াচাড়া করে প্লেট রেখে চলে গেলেন ৷ মায়ের মুখে বেশ রহস্যময় হাসি দেখা গেলো ৷ আমি অবাক হয়ে মায়ের চোখের দিকে তাঁকিয়ে রইলাম ৷ মা কি ইচ্ছে করে বকুল আপার প্রিয় খাবার রেধেছে যাতে বাবার বকুল আপার কথা মনে পড়ে ! আমার মায়ের এত বুদ্ধি কবে হলো ?

আমার সন্দেহ ঠিক ৷ মা চেষ্টা করছে বাবাকে বারবার বকুল আপার কথা মনে করাতে ৷ বকুল আপা তাদের প্রথম সন্তান ৷ প্রথম সন্তান অনেক বেশি আবেগের হয় ৷ মা সেই আবেগগুলোই মনে করাতে চেষ্টা করতে থাকলো ৷ একবার শুনলাম বাবা বাজখাই গলায় ডাকছেন ” পয়া , সেমন্তী এই দিকে আয় ”

দৌড়ে গিয়ে দেখলাম বাবার হাতে একটা ঝুনঝুনি ৷ প্লাস্টিকের রাণী গোলাপী আর টিয়া রঙের ঝুনঝুনি ৷ আমাদের বাড়িতে তো ছোট বাচ্চা নেই , এটা কই থেকে এলো ভাবতেছি ৷ বাবাই বললেন ” তোর মায়ে আমার লগে সাপ লুডু খেলে ? বকুলের ঝুনঝুনি বিছনাত ফালায়া রাখছে ৷ বকুলের জামা বাইরে মেইলা দিছে , বকুলের পছন্দের খাওন রানতাছে … তোর মায়ে কি আমারে গাধা ভাবছে ? আমি এগুলান বুঝিনা না ! হ্যারে কইয়া দে , বকুলরে আমি ত্যাজ্য করছি ৷ আমার মনে বকুলের লেইগা আর কুনো ভালোবাসা নাই ৷ যেই মাইয়্যা বিয়ার দিন বাপের সম্মানের কতা চিন্তা না কইরা এক বাদাইম্যার হাত ধইরা পলায় , হ্যারে আমি জিন্দেগীতেও মাফ করমু না ”

শেষের কথাটা বাবা বেশ জোরে বললেন ৷ উদ্দেশ্য যেন মা ও শুনতে পায় ৷

আমি অনেক সাহস করে বাবাকে বলেই ফেললাম ” আব্বা , বকুল আপার সন্তান হইবো , তারে বাড়িত ফিরায়া আনেন ৷ হ্যায় বহুত কষ্টে আছে আব্বা ৷ তারে মাফ কইরা দেন …”

বাবা নিঃশব্দে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলো খানিকক্ষন ৷ তারপর তার হাতের ঝুনঝুনিটা আমার গায়ে ছুড়ে দিয়ে বললো ” বাইর হ ! বাইর হ আমার ঘর থেইকা…”

পরিবেশ খারাপ হয়ে আসছে ৷ আমি দ্রুত বাবার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলাম ৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here