পয়মন্তী,০৬,০৭
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৬
_________________
একটা একটা করে দিন যায় ৷ আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বাবাকে রাজি করাতে পারলাম না , বাবা সিলেট গেলো না ৷ মা আড়ালে চোখ মুছে ঘরের কাজ করে যেতে লাগলেন ৷ আমরা সবাই যেন হাসতে ভুলে গেছি ৷ সবার মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা ৷ পরিবর্তন শুধু একটাই ৷ একদিন ভোরবেলা বাবা নিজে মলিদা দাদীকে আবার তার বাড়িতে রেখে আসলেন ৷
কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না , এ কথাটি শুনেছিলাম ৷ সত্যতার সন্ধান পেলাম মলিদা দাদীর সংস্পর্শে এসে ৷ সেদিনের বিচারের পর মলিদা দাদী দুই তিনদিন চুপচাপ ছিলেন ৷ এরপরই আবার তার রং দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছিলো ৷ নানা ভাবে জয়নাল দুলাভাইকে সাথে নিয়ে আমাদের সবাইকে যন্ত্রনা দিচ্ছিলেন তিনি ৷ মায়ের সাথে বান্দীর মতো ব্যবহার করতেন ৷ আমি মনে মনে ভাবছিলাম মলিদা দাদীকে আবার একটু টাইট দিবো , বাবা সে সুযোগ দিলেন না ৷ বাবা বুঝেছিলেন জল ঘোলা হচ্ছে ৷ তাই খারাপ কিছু হবার আগেই আপদ বিদায় করলেন ৷
জয়নাল দুলাভাইকে আমার খারাপ মানুষ মনে হয় না ৷ মলিদা দাদীর সাথে সাথে থাকতেন জন্য বিরক্ত লাগতো ৷ এখন দাদী চলে যাবার পর সারাক্ষন শিমুল আপার পেছন পেছন ঘোরে ৷ লোকটা আসলে স্বর্ণলতা ধরনের , পরাশ্রয়ী ৷ শিমুল আপা তাকে সবসময় এড়িয়ে চলে ৷ মাঝে মধ্যে রাতে আমাদের সাথে ঘুমাতে চলে আসে আপা ৷ শিমুল আপার সাথে আমাদের খুব একটা গল্প হয় না , আগেও হতো না ৷ তবে ইদানীং আপাকে খুব দুঃখী লাগে ৷ আপা হয়তো মন থেকে বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি ৷
আমার প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা অবশেষে শেষ হলো ৷ এবার আমার ঢাকা যাবার পালা ৷ কোচিং করতে হবে ভালো কোথাও চান্স পাবার জন্য ৷ কোন রকম ভনিতা না করে বাবাকে সরাসরিই বললাম ৷ বললাম আমি ঢাকা যেতে চাই ৷ বাবাও কোন রকম ভনিতা করলেন না ৷ সরাসরিই বললেন ” যাইতে চাইলে যাইবা , তয় কোচিং টোচিং করাইতে পারমু না ৷ এইহানে থাইকাই যা পারো পড়ো ৷ নিজ যইগ্যতায় ভার্সিটিতে ঢুকতে পারলে যাইবা ৷ সত্যি লেহাপড়ায় মন থাকলে পড়ায় জোর দেও , যা আইবো বইয়েত থেইকাই তো আইবো ৷ বইখান ভালা কইরা পড়ো ৷ আমি এক কথার মানুষ ৷ কইছি যা তাই হইবো ৷ অহন তুমি যাও ৷ ”
আমার বাবার কথা পছন্দ হলো ৷ মানুষটা বলেছে চান্স পেলে আমাকে ঢাকা যেতে দেবে ৷ আমার জন্য এটুকুই যথেষ্ট ৷ আপাতত পড়ায় মন দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত ৷ পরীক্ষা শেষে আমার বান্ধবীরা যখন এ বাড়ি ঘুরছে , আমি দরজা বন্ধ করে শুধু পড়ছি ৷ সারাক্ষন পড়ি , সারাক্ষন পড়ি ৷ সেমন্তীটা মুখ বাঁকা করে ঘোরে , আমি দেখেও দেখি না ৷ ও আমার ন্যাওটা খুব , হঠাৎ করে ওর দিক থেকে মনোযোগ বাদ দিয়েছি বলে ও বোধহয় দিশেহারা বোধ করছে ৷ তবে কথা হয় , রাতে যখন ঘুমাতে যাই সারাদিনের গল্প শোনায় ও আমাকে ৷ সেদিন বললো , মা নাকি বলেছে আমাকে জ্বীনে ধরেছে , নাহলে সারাদিন দরজা লাগিয়ে থাকি কেন ! আমার বোকা মা , বোকাই রয়ে গেলো ৷
পারুল আপা বেড়াতে আসলেন দুলাভাই সমেত ৷ বাড়িতে আবার উৎসব আমেজ তৈরি হলো ৷ বাজার থেকে কালো খাসি এলো , জয়নাল দুলাভাইকে দেখলাম খুব আগ্রহ নিয়ে খাসী কাটাকাটি তদারকি করছে ৷ জয়নাল দুলাভাই আজকাল বাড়ির অনেক কাজই করে ৷ লোকটার মন পরিষ্কার , এটা এখন সবাই বোঝে ৷ শুধু শিমুল আপা ছাড়া ৷ শিমুল আপার ভাব দেখলে মনে হয় জয়নাল দুলাভাই কোন ছোয়াচে রোগের রোগী , তার থেকে দূরে থাকাতেই যেন মঙ্গল ৷
পারুল আপার স্বামী পরদিন চলে গেলেন ৷ যাবার আগে জয়নাল দুলাভাইকে কটাক্ষ করে বললেন “আমার কি আর শ্বশুড়বাড়ি পইড়া থাকনের উপায় আছে ! কত কাম আমার …” এই অপমানটা জয়নাল দুলাভাইয়ের গায়ে লাগলো না , বরং এ কথা শুনে শিমুল আপা ঘরে দরজা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলেন ৷ শেষে পারুল আপা বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে ঘর থেকে বের করলো ৷
শিমুল আপার সাথে পারুল আপার বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি ৷ আমাদের সাথে যেমন ছিলো বকুল আপার ৷ হতে পারে একসাথে থাকার জন্য এমনটা হয়েছে ৷ সন্ধ্যায় পারুল আপা আর শিমুল আপাকে পুকুড় পাড়ে বসে থাকতে দেখলাম ৷ আমাদের বাড়ির মেয়েদের সন্ধ্যার পর পুকুড় পাড়ে বসার অনুমতি নেই , বাবা ভীষণ রাগ করেন ৷ অবশ্য বিবাহীত মেয়েদের উপর বাবার শাষনের তীব্রতা আর তেমন থাকে না ৷ বিয়ে হয়ে যাবার পর মেয়েরা বোধহয় বাবার থেকেই সবচেয়ে বেশি দূরে চলে যায় ৷ অনেক কথা বাবারা চাইলেও বলতে পারেন না তখন আর মেয়েকে ৷ দূরত্বটা দেখা যায় না , শুধু অনুভব করা যায় ৷ এখন যদি আমি বা সেমন্তী এভাবে পুকুড় পাড়ে বসে থাকতাম , বাবা নিশ্চিত আমাদের বাজখাঁই গলায় ডাকতো ৷ তারপর দিতো একটা ধমক ৷ অথচ শিমুল আপা বা পারুল আপাকে বাবা কিছুই বলছেন না ৷ শুধু গম্ভীর মুখে লম্বা টানা বারান্দায় পায়চারি করছেন ৷ বারান্দা থেকে আপাদের দেখা যাচ্ছে ৷ আমি নিশ্চিত তিনি আপাদের নজরে রেখেছেন , কিন্তু ধমক দিচ্ছেন না ৷ হয়তো ভাবছেন এরা এখন পরের বাড়ির মানুষ ৷ ওখানে কেমন থাকে না থাকে , কতটা পরাধীন কে জানে ৷ বাপের বাড়ি এসেছে , স্বাধীনতার সুখটুকু পাক ৷ পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত , কেমন যেন বুকের পাজর ভেঙে হৃদপিন্ড বের করে দিয়ে হাসিমুখে থাকার বৃথা চেষ্টা করে বাবারা ৷ এই যে বাবা বকুল আপাকে আনতে সিলেট গেলেন না জেদ করে , আমরা সবাই তার উপর অসুন্তষ্ট হলাম ৷ কিন্তু বাবার না জানি কতটা কষ্ট হচ্ছে ৷ এ জন্যই বোধহয় শিমুল আপার জন্য বাবা ঘর জামাই এনেছেন , বাবার মতো করে বাবার জন্য কোনদিনও ভাবিনি ৷ আমারা সব বোনেরাই মায়ের ভক্ত ৷ বাবার সাথে আমাদের আজন্ম দূরত্ব ৷ এক বকুল আপা ছাড়া বাবার সাথে সহজভাবে কেউই কথা বলতে পারতাম না ৷ সেই বকুল আপার কাছেই বাবা সবচেয়ে বেশি কষ্টটা পেয়েছেন , তার অভিমানেরও তো দাম আছে ! আজ আমার খুব বাবার জন্য মায়া হচ্ছে ৷ ইচ্ছে হচ্ছে বাবার পাশে গিয়ে বাবার হাত ধরে বলি ” আব্বা , আপনে চিন্তা কইরেন না , আপনের মাইয়্যারা সবাই ভালো থাকবো , সুখেই থাকবো ৷ ”
ইচ্ছে করলেই কি সব করা যায় ? এতদিনের দূরত্ব হুট করে মেটানো সম্ভব নয় ৷ হুট করে গিয়ে বাবাকে ভালোবাসি বলা সম্ভব নয় ৷ মায়ের গলা ধরে আহ্লাদ করা যতটা সহজ আমাদের জন্য , বাবার পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সাধারন কথা বলাও তার দ্বিগুণ চৌগুণ কঠিন ৷
আজ রাতে আমরা চার বোন আবার একসাথে শুলাম অনেক দিন পর ৷ কিন্তু কোন গল্প হলো না ৷ সবাই কেমন যেন ক্লান্ত ৷ শুধু সেমন্তী পারুল আপার বুকের মধ্যে শুয়ে অনেকক্ষন গুজগুজ করে কিসব বললো , হয়তো বাড়ির খবর দিলো , মলিদা দাদীর গল্প বললো.. সেমন্তীর গল্পের অভাব নেই ৷ আমি তখনও পড়ছিলাম ৷ অবশ্য আজ আমারও পড়ায় মন বসছে না ৷ বই বন্ধ করে এসে শিমুল আপার পাশে শুয়ে পড়লাম ৷ অযথাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি ৷ কিছুতেই ঘুম আসছে না ৷ হঠাৎ পারুল আপা ডাকলো ..
—পয়া , ঘুমাইছোস ?
—না আপা , কিছু লাগবো ?
—চল আঙিনায় গিয়া বসি , ঘুম আইতাছে না ৷ চান্নি উঠছে , চল মেলাদিন চান্নি দেহিনা ৷
—আচ্ছা চলো ৷
আমরা দুজনে আঙিনায় গিয়ে পিড়ি পেতে বসলাম ৷ খুব সুন্দর বাতাস বাইরে ৷ আঙিনায় বসতেই যেন শরীর জুড়িয়ে গেলো ৷ আকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে , সেই চাদটা মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে বারবার ৷ আজ চাঁদের এত আলো যে মেঘের বাঁধা অতিক্রম করে চাঁদের আলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে আমাদের আঙিনায় ৷ আমরা দুজনেই চুপচাপ বসে আছি ৷ আমাদের না বলা অনেক কথাগুলো থমকে আছে , মৃদুমন্দ বাতাসে আমাদের ভাষারাও যেন পথ হারিয়েছে ৷ গল্প করার গল্প নেই , শব্দ নেই , শুধু আছে চাঁদের আলোর ভয়াবহ তীব্রতা ৷
পারুল আপা আমার গায়ে হাত রাখলেন ৷
—পয়া , তুই বলে ঢাকাত যাবি ?
—হ , আব্বায় কইছে চান্স পাইলে ভর্তি করায়া দিবো
—খুব ভালো হইবো ৷ তুই গিয়া সেমন্তীরেও লইয়া যাস ৷ এই গেরামে ওর পড়ালেহা হইবো না ৷ ওর এমনেই পড়ায় মন নাই ৷ একটা বার নিজ ইচ্ছায় পড়তে বসতে দেহি না , আর তুই সারাদিন বই লইয়া থাকোস
—ভালা কথা কইছো ৷ এরে একটু বুঝাইও তো ৷ এমন কইরা পড়লে মেট্টিক পাশ দিতে পারবো না ৷ আব্বায় ধইরা বিয়া দিয়া দিবো ৷
—ওয় তো বিয়া হইলে মনে হয় খুশিই হইবো ৷ ছোট মানুষ বুঝে না বিয়া মানে কি ! বয়স যত কম থাকে বিয়ার আগ্রহ তত বেশি থাকে ৷ বিয়ার পরের জীবনখান স্বপ্নের লাহান লাগে ৷ বাস্তবে জীবন বহুত কঠিন বইন !
—আপা , তুমি ভালা আছো তো ?
—ভালা মন্দের ফারাক ভুইলা গেছিরে পয়া ৷ তয় আইজ শিমুলের কথা শুইনা মনে হইতাছে , আমি ওর থেইকা ভালা আছি ৷ আমার সোয়ামী তাও পুরুষ , শিমুলরে আব্বা একখান মাইগ্যার লগে বিয়া দিলো কেমনে ! আমার কলিজাডা পুইড়া যাইতাছেরে পয়া ৷ আর পারতাছি না সহ্য করতে …
—এইগুলান কি কইতাছো তুমি ?
—হাছা কতা কই বইন ৷ জয়নাল একটা মাইগ্যা , পুরুষ মানুষের যইগ্যতা হ্যার নাইরে বইন !
—আপা আমি কিছুই বুঝতাছি না ৷
—এরচে খোলাসা কইরা কইতে পারুম না বইন ৷ খালি বুইঝা নে সোয়ামীর সোহাগ যারে কয় , হেইটা আমরার শিমুলের কপালেত নাই …
আমি হতবাক হয়ে পারুল আপার দিকে তাকিয়ে রইলাম ! আপা এসব কি বলছে !
চলবে
পয়মন্তী
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৭
_________________
বকুল আপাকে নিয়ে চিন্তায় আমি অস্থির থাকি সবসময় ৷ নতুন করে যুক্ত হলো শিমুল আপাকে নিয়ে টেনশন ৷ আবার আমাকে পড়তে হচ্ছে এর মধ্যেই ৷ কারন আমাকে ভার্সিটিতে টিকতে হবেই ৷
অনেক ভেবে ঠিক করলাম শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে যাবো ৷ ওখানে পড়ার উদ্দেশ্যে নয় , সিলেটে বকুল আপা আছে ৷ তাকে দেখতে যাবার জন্য ৷
বাবাকে গিয়ে বললাম কথাটা ৷ আজকাল আমি তার সাথে সরাসরিই কথা বলি ৷ যা দেখলাম তিনি সরাসরি কথাই পছন্দ করেন , মাধ্যম ধরে কথা বলতে গেলে বিপদ ৷ এরচেয়ে বরং আমি যা ভাবছি তা সরাসরিই বলা ভালো ৷ আমার কথাগুলোতো আমার মত করে বুঝিয়ে কেউ বলতে পারবে না ৷ ভেবে চিন্তে বাবার সামনে গেলাম ৷
—আব্বা কিছু কইতে চাই
—কও মা
—আব্বা আপনে তো জানেন আমি কুনো কোচিং করতাছি না , একলাই পড়তাছি ৷ অহন খালি ঢাকার ভার্সিটিগুলার ভরসায় থাকলে চান্স পাওনের সম্ভাবনা কইমা যাইবো ৷ তাই কইতাছিলাম আপনে যদি আমারে অনুমতি দেন আমি দেশের সেরা ভার্সিটিগুলাতে পরীক্ষা দিতে চাই ৷ নিজেরে যাচাই করাও হইবো আর আমার চান্স পাওনের সম্ভাবনাও বাড়বো ৷ আপনে যা বলবেন তাই হইবো আব্বা ৷ অবাধ্য হমু না আমি ৷
—কতাডা মন্দ কওনি ৷ আচ্ছা , দেও পরীক্ষা তোমার যেহানে যেহানে মন চায় ৷ তয় একলা যাইবা কেমনে ? জয়নালরে সাথে লইয়া যাইবা ৷ আর ঢাকাত আমিই যামু লগে ৷
—আইচ্ছা
জয়নাল দুলাভাইকে সাথে নেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নাই ৷ তবে সবসময় নিজের ইচ্ছের গুরুত্ব দিলে আম ছালা দুটোই যায় ৷ অনেক সময় চুপচাপ সব পর্যবেক্ষন করে উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হয় ৷ নিজের মতামত উপস্থাপন করা এক জিনিস আবার ঘাড় ত্যারামী করা অন্য জিনিস ৷ দুটার ব্যালান্স নিজেকেই শিখতে হয় ৷
যাই হোক আমি পড়ায় মন দিলাম ৷ আমি সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেললাম ৷ এখন সবার দুঃখে দুখী হয়ে আমি যদি পড়া বাদ দিয়ে তাদের চিন্তা করি , তাহলে তাদের কষ্ট চিরতরে দূর করতে পারবো না কখনোই ৷ আমাকে এতটা যোগ্য হতে হবে যেন আমি সবার পাশে দাড়াতে পারি ৷ বোনদের কষ্ট দূর করতে পারি ৷ আমি কে এখন ? কেউ না ! আমার আগে একটা পরিচয় দরকার ৷ আমি পয়া এখন রাগের মাথায় মলিদা দাদীর আঙ্গুল বাঁকিয়ে দিতে পারি , কিন্তু আমি সত্যিকারের যোগ্য তখনই হবো যখন আমার মায়ের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে মলিদা দাদীর মতো মানুষদের দু বার ভাবতে হবে ৷
এরমধ্যে হঠাৎ একটা কান্ড হলো ৷ আমরা সবাই গ্রামের মেয়ে , বাড়ির সামনে মস্ত পুকুর তাই সাঁতার সবাই জানি ৷ কিন্তু শিমুল আপা ছোট থেকেই পানি ভয় পায় খুব , তাই আর সাঁতার শেখা হয়নি ৷ সেদিন আমি গঞ্জে গিয়েছিলাম কম্পিউটারের দোকান থেকে ভর্তি ফর্ম পূরন করতে ৷ সেমন্তী আমার সাথে গিয়েছিলো ৷ মা বোধহয় কোন কাজে বাড়ির বাইরে ছিলো ৷ শিমুল আপা একা বসে ছিলো পুকুর পাড়ে ৷ সে মাঝে মধ্যেই সেখানে বসে থাকতো ৷ সে যখন উঠে আসতে ধরেছে হঠাৎ করেই তার পা পিছলে সে পড়ে যায় পুকুরে ৷ ঘাটে শ্যাওলা জমে ছিলো , অঘটণ ঘটে গেলো আচমকাই ৷ আশে পাশে কেউ নাই , শিমুল আপা খাবি খাচ্ছে পানির ভিতর ৷ সেই সময় জয়নাল দুলাভাই ঘরে শুয়ে ছিলো ৷ তিনি কোন শব্দ পাননি , কিন্তু তার ভাষ্যমতে তার নাকি বুকের মধ্যে কেমন যেন ধরফর করা শুরু করে ৷ ঘরের বাইরে বের হন তিনি একটু খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিবেন বলে ৷ বারান্দা থেকে পুকুরটা দেখা যায় ৷ দুলাভাই দেখলেন কেউ একজন পুকুরে ডুবে যাচ্ছে , বাঁচার জন্য আপ্রান চেষ্টা করছে ৷ দুলাভাই দৌড়ে গিয়ে পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ে দেখেন সেই কেউটা আর কেউ নয় , তার বউ শিমুল ….তাড়াতাড়ি তাকে তুলে পাড়ে নিয়ে আসেন তিনি ৷ দুলাভাই ভেবেছিলেন শিমুল আপা বোধহয় তার সাথে সংসার করতে চায় না জন্য আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো ৷ আপার জ্ঞান ফিরতেই তিনি বলেন ” বউ আমার জন্য তোমার মরন লাগবো না , আমি চইলা যামু বউ , আমি চইলা যামু ..”
এরপর হলো ম্যাজিক ৷ শিমুল আপা সহজ সরল , শারিরীকভাবে অক্ষম মানুষটার প্রেমে পড়ে গেলেন ৷ সবাই যখন এলো দেখলো ভেজা দুটো মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে …
এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত ৷ শিমুল আপা আর জয়নাল দুলাভাইয়ের কেমিষ্ট্রিটা অদ্ভুত মিষ্টি লাগে আমার কাছে ৷ আমি রাত জেগে পড়ি , মাঝে মাঝেই দেখি তারা দুজন গভীর রাতে পুকুরে নেমেছে ৷ দুলাভাই শিমুল আপাকে সাঁতারের ট্রেনিং দিচ্ছে ৷ গভীর রাতে চাঁদের আলোয় দুজন জলকেলি করে , আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি … আমার ভীষণ ভালো লাগে ৷ একদিন দেখলাম শিমুল আপা সত্যিই সাঁতার শিখে গেলো ৷ মাঝ পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে দুজন ৷ আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম .. কখন যে আমার চোখে জল চলে এসেছে আমি বুঝিনি ৷ কী ভীষণ সুখী লাগছে মানুষদুটোকে ! কী ভীষণ পবিত্র তাদের প্রেম …
একদিন শিমুল আপাকে বললাম
—আপা তোমারে কয়ডা কতা কমু ৷ কই ?
—ক , এত অনুমতি লইতাছোস ক্যান ?
—সেইবার যহন পারুল আপায় আইলো আমারে কইছিলো জয়নাল দুলাভাই বলে ..
—কি ?
—থাউক বাদ দেও ৷ এগুলান না কই
—শুরু করছোস শ্যাষ কর , ক সমস্যা নাই
—দুলাভাইয়ের বলে কি জানি সমস্যা
—হ , কতা ঠিক
—তোমার কি কষ্ট হয় আপা ?
—হইতো , অহন হয় না ৷ আমার সোয়ামী আমারে শইল্যের সুখ দিতে পারে না ৷ আমার ঐ সুখের আসলে দরকারও নাই ৷ ভালোবাসা কি খালি শইল্যেই থাকে ? ভালোবাসা অন্য জিনিস ৷ যদি কুনোদিন কাউরে ভালোবাসিস সেই দিন বুঝবি বইন ৷
—আপা এইটা যদি অসুখ হয় , এই অসুখের চিকিৎসাও আছে ৷ রোগ পোষার দরকার কি ? আমি কই কি তোমরা ডাক্তর দেখাও ৷
—এহন আমি যদি হ্যারে ডাক্তরের কথা কই হ্যায় তো দিলে চোট পাইবো ৷ মানুষটা বড় ভালা ৷ আমি তার দিলে চোট দিবার পামু না ৷
—আজব , আইজ যদি দুলাভাইয়ের অন্য কোন অসুখ হইতো তুমি কি তারে ডাক্তর না দেখাইয়া ফালাইয়া রাখতা ?
—কতাডা তো মন্দ কসনি ! আমি তোর দুলাভাইয়ের লগে আলাপ করি ৷
—কয়দিন পর আমার সিলেট পরীক্ষা ৷ দুলাভাই আমার লগে যাইবো ৷ তুমিও যদি লগে যাও , কেউ কিছুই বুঝবো না ৷ ঐখানে তো মানুষ ঘুরতেও যায় ৷ গেলা পরে আমি পরীক্ষা দিলাম , তোমরা ডাক্তর দেখাইলা ৷ আর সিলেট তো বেশী দূরেও না ৷ পরে যদি যাওনও লাগে তাইলেও যাইতে পারবা ৷ আপা , ভালোবাসা ঠিক আছে ৷ আমি তো বিয়াইত্যাও না , তাও আমার বুঝে আসে সংসারে শান্তির জন্যে সব কিছুরই দরকার আছে ৷ ভালোবাসা , টেকা পয়সা , বা শইল্যের সুখ ৷ আমারে খারাপ ভাইবো না আপা ৷
—তোর মেলা বুদ্ধিরে পয়া ৷ বয়সে ছুটো হইলেও বুদ্ধিতে তুই আমার বড় ৷ দেহি , তোর দুলাভাইরে আমি যদি বুঝাইতে পারি তয় যামু তোর লগে ৷
আমি মনে মনে বেশ শান্তি পেলাম ৷ রাতে ঘুমাতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম সেমন্তী কাকে যেন মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে লজ্জা পেয়ে হাসছে ৷ ব্রিটিশ আমলের অনেক পুরানা একটা নকিয়া মোবাইল আছে মায়ের ৷ অবশ্য ওটা শুধু নামেই মায়ের , চালাই আমরা সবাই যখন যার দরকার ৷ মোবাইলের ব্যাটারী ফুলে গেছে অনেক দিন হলো , ব্যাকপার্টটা তাই সহজে লাগে না ৷ টাকা বাধার দুটা রাবার দিয়ে মোবাইলের সাথে ব্যাকপার্ট আটকে রাখা হয়েছে ৷ বেশিরভাগ সময় বন্ধ হয়ে থাকে ৷ অন হয়না সহজে ৷ ফোনটার প্রতি তাই আগ্রহ কমে গেছে আমার ৷ আগে খুব সাপের গেমটা খেলতাম এই মোবাইলে ৷ খাবার খেয়ে খেয়ে সাপটা বড় হতো , তারপর দেয়ালের সাথে বা নিজের গায়ে লাগলেই গেম অভার ৷ কি যে মজা লাগতো ৷ সেই ভাঙা ফোনে সেমন্তী কাকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে হাসছে ! ওর বয়সটা খারাপ , ওর দিকে নজর দিতে হবে ৷ সেমন্তী আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী , সাহসী ৷ হার মানে না সহজে ৷ শুধু পড়ালেখার উপর ভালোবাসা জন্মেনি ওর ৷ এখানে হার মেনে বসে আছে ৷ কাল ওর সাথে কথা বলতে হবে ৷ নিজের পড়ায় অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে আমি সেমন্তীর দিকে তাকাবার অবসর পাইনা ৷ কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দেরী করলে বিপদও হতে পারে ৷ এরচেয়ে বরং কথা বলা ভালো ৷
এই বয়সে বুদ্ধিমতীরাও অবুঝ হয়ে যায় ৷ পাশে থেকে শক্ত করে হাত ধরে থাকতে হয় আপনজনদের ৷ শাষন নয় বরং গল্পে গল্পে সমাধান করতে হয় জীবনের জটিলতাগুলো ৷ এমন সময়ে আমি বকুল আপাকে খুব মিস করি ৷ আমার বকুল আপাই ছিলো আমাদের মধ্যমনি , পুরো বাড়ির প্রাণ , আপা আজ কেমন আছে , কিভাবে আছে আমরা কেউই জানি না ৷ অথচ দিব্বি আমরা বেঁচে আছি … আমাদের জীবন চলছেই , থেমে থাকেনি এক মুহূর্তের জন্যেও ..
চলবে