পয়মন্তী,১০,১১

0
380

পয়মন্তী,১০,১১
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১০
_________________

বকুল আপা বাড়ি এসেছেন কিন্তু লতিফ ভাইয়ের বাড়ি থেকে কেউ এলো না ৷ বকুল আপার এতে অবশ্য কোন ভাবান্তর নাই ৷ সে নিজের মতো আছে ৷ প্রচুর খাচ্ছে , আপা খুব সল্পাহারী ছিলো ৷ গর্ভাবস্থায় শেষের দিকে নাকি ক্ষুধা বাড়ে শুনেছিলাম ৷ আমার ধারনা আপা এতই ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে যে এখন হঠাৎ খাবার পেয়ে আপার বোধহয় চোখের ক্ষুধাটা মিটছে না ৷ একটু আগে দেখলাম হাতে দুটো কলা শক্ত করে ধরে আছে ৷ আপার পেট ভর্তি , খেতে পারছে না তাই ধরে আছে ৷ আমি বললাম “আপা দেও রাইখা দেই , পরে খাইও ” .. আপা বাচ্চাদের মতো বললো “একটু পরেই খামু তাই ধইরা আছি ”

আপা যে ফিরেছে এটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার ৷ তবে এই সাত মাসে আপা বদলে গেছে ৷ অনেক বেশিই বদলে গেছে ৷ আপা এখন আর আমাদের সাথে গল্প করে না ৷ খুনসুটি করে না ৷ আগে আমরা তিনবোন একসাথে ঘুমাতাম ৷ এখন আপা আমাদের সাথে ঘুমায় না , তার নাকি একা ঘুমাতে আরাম লাগে ৷ উত্তর একটা ঘর তাই তার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ৷ আপা দিনের বেশিরভাগ সময় তার ঘরে থাকে ৷ চুপচাপ বসে থাকে না হয় ঘুমায় ৷ আপার আচরন আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে ৷ মাঝে মধ্যে আমাদের দিকে এমনভাবে তাকায় মনে হয় সে আমাদের চিনতে পারছে না , তবে চেনার চেষ্টা করছে ৷ মাঝে মধ্যে বাবার কাছে গিয়ে বাবার পায়ের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমায় ,কোন কথা বলে না ৷ আমাদের প্রাণচঞ্চল বকুল আপা তাজা ফুল থেকে শুকনো বকুলে পরিনত হয়েছে ৷

এরমধ্যেই শাহজালাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো ৷ ১২৩ তম হয়ে আমি সেখানে চান্স পেয়েছি ৷ খবর শুনে সবাই খুশি ৷ বাবা আমাকে বললো “সিলেট ভর্তি হয়া যাও মা , আইতে যাইতে সুবিধা হইবো ৷ ” আমি বললাম “ঠিক আছে , তয় আব্বা , ঢাকায় পরীক্ষাটা দিবার চাই ৷ এইখানে পড়লে অনেক ভালো হইবো , তয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার স্বপ্ন আব্বা ৷ আর কুনোখানে পরীক্ষা দিমু না , খালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিবার চাই ৷ ”

বাবা রাজি হয়ে গেলেন ৷ এই প্রথমবার আমার মনে হলো আমি বোধহয় আসলেই ভাগ্যবতী ৷ শাহজালালে পরীক্ষাটা ঠিক কি দিয়েছি কেমন দিয়েছি এটাও আমার মনে নেই ৷ তারপরও চান্স পেয়ে গেলাম কিভাবে স্বয়ং করুনাময় ছাড়া কেউ জানে না ৷

আমার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার দিন চলে এলো ৷ বাবা আমার সাথে গেলেন ৷ প্রথমবার ঢাকায় এসেছি , যাই দেখি তাতেই মুগ্ধ হই ৷ আমি একদম হা হয়ে যাদুর শহরটাকে দেখছিলাম ৷ আগেরদিন গিয়ে থাকলাম হোটেলে ৷ এতদিন প্রচুর পড়াশোনা করেছি অথচ পরীক্ষার আগের এই গুরুত্বপূর্ন রাতে আমার পড়তে ইচ্ছে হলো না ৷ আমি হোটেলের বারান্দা থেকে রাতের ঢাকা দেখতে লাগলাম ৷ একের পর এক গাড়ি ছুটে চলেছে রাস্তা দিয়ে ৷ আমার দেখতে ভালো লাগছে ৷ কেন ভালো লাগছে আমি জানি না ৷ আজন্ম গ্রামে বড় হওয়া আমিটার শহর এত প্রিয় কিভাবে হলো কে জানে ৷ তাহলে কি শহরের চাকচিক্যে আমি প্রভাবিত হচ্ছি ? হতেও পারি ! এতে দোষের কিছু নেই ৷ কার কখন কি ভালো লাগে এটা কি কেউ বলতে পারে ?

আমার পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো ৷ বাবার গ্রামে কাজ ছিলো তাই আমরা আর থাকলাম না , সেই দিনই রওনা দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে ৷

বাড়িতে ফিরে দেখলাম পারুল আপা এসেছে ৷ দুলাভাই আসেনি ৷ বকুল আপা আসার পরই তাকে খবর দেওয়া হয়েছিলো , কিন্তু ও বাড়ির লোকজন তাকে ছাড়েনি ৷ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে সে এসেছে ৷

দীর্ঘদিন পর বাড়িতে আমরা পাঁচবোন ৷ দীর্ঘদিন পর আমার পড়ার চাপ নেই ৷ রাতের বেলা আঙিনায় পাটি পেতে আমরা বসলাম সবাই ৷ আকাশে চাঁদ নেই তবে লক্ষ লক্ষ তারা ৷ তারার মিটমিটে আলোয় একটা রহস্যের ভাব সৃষ্টি হয়েছে ৷

বকুল আপা বললেন “ঐ তোরা গফ শুনবি ? ”

আমরা খুশি মনে বললাম “বলো ”

আপা বললো “মিছা মিছা বানাইন্যা গফ না , এক্কেরে সত্যি কথা ”

আমরা আবার বললাম “বলো তো ! ”

আপা বলতে শুরু করলেন ….

“এক চিয়ারমেনের ঘরে আছিলো পাঁচ পাঁচটা মাইয়্যা ৷ বড় মাইয়্যার গায়ের রংডা কালা , এই ধর আমার মতোন ৷ বাকি চাইরজন এক একজন হুরপরী ৷ বড় মাইয়্যা শিয়ান হইছে , বাপে ভাবলো তারে বিয়া দিবো ৷ ঘটকরে কইলো পাত্র পাঠান ৷ একটার পর একটা বিয়ার সম্বন্ধ আসে , তয় মাইয়্যার গায়ের রঙের কারনে বিয়াগুলান যায় ভাইঙা ৷

এমন চলতে চলতে ঐ মাইয়্যাডার মনে হইলো তার বোধহয় জিন্দেগীতেও বিয়া হইবো না ৷ হ্যায় আবিয়াইত্যা হইয়া থাকলে বাকি চাইরজনেরও বিয়া হইবো না ৷ মাইয়্যাডা সবার সামনে হাসি খুশি থাহে , তয় একলা হইলেই আকুল হয়া কান্দে ৷

ঐ গ্রামেই আছিলো একটা লম্পট , চরিত্রহীন পোলা ৷ হ্যায় প্রেমের প্রস্তাব দিলো মাইয়্যাডারে ৷ মাইয়্যাডা জানতো ভালা কইরাই এই পোলা ভালা না ৷ হ্যায় মানা কইরা দিলো ৷ কিন্তু পোলাডা পিছ ছাড়লো না ৷ একদিন মাইয়্যাডা রাইতের বেলা পিসাব করতে উঠছে ৷ পায়খানায় যাইবো এমন টাইমে হ্যার মুখটা যাইত্যা ধইরা ঐ লম্পট পোলাডা নিয়া গেলো টানতে টানতে নিয়া গেলো পাটক্ষ্যাতে ৷ এরপর সর্বনাশ কইরা ছাইড়া দিলো ৷ মাইয়্যাডা শরমে এই কতাখান কাউরে কইলো না ৷ এর কিছুদিন পর মাইয়্যাডার বিয়া ঠিক হইলো ৷ মাইয়্যার মনে হইলো আরেকজনরে বিয়া করলে তারে ঠকান হইবো , হ্যায় ছুইট্টা গেলো ঐ লুইচ্চা ব্যাটার কাছে ৷ বদমাশটা কইয়া দিলো বিয়া করতে পারবো না সে ৷

দিন যায় , মাস পার হয় মাইয়্যার আর শইল খারাপ হয় না ৷ এর মধ্যে বিয়ার তোড়জোর শুরু হয়া গেছে ৷ মাইয়্যাডা একসময় বুঝলো হ্যার গর্ভ হইছে ৷ হ্যায় গিয়া ঐ বদমাশ ব্যাটার পায়ে পইড়া কানলো ৷ বদমাশটা রাজি হইলো ৷ বিয়ার আগের দিন রাইতে মাইয়্যা পলাইলো ঐ পোলার হাত ধইরা …

মাইয়্যাডার নাম বকুল ৷ হ্যায় সবাইরেই কয় তার সাত মাসের গর্ভ চলে , তয় আসলে গর্ভ সাড়ে আট মাসের ৷ ভাইগা যাওনের পর শুরু হলো অভাব আর কষ্ট ৷ সব জাইনা শুইনাই আসছে , বাড়িত ফিরোনের মুখ আছিলো না ৷ তার উপর কবুল কইয়া বিয়া যারে করছে তারে ফালায়া কেমনে আসে ! ঐ লম্পট মদ , গাঞ্জা খাইয়া আইসা মাইয়্যাডারে বেদম মারতো ! মাইর খায়া মাইয়্যাডা বেহুশ হয়া পইড়া থাকতো , কেউ আছিলো না দেখনের !

তারপর একদিন মাইয়্যাডার বোনেরা গিয়া তারে ফেরত লইয়া আইলো ৷ তার মনে এহন কুনো কষ্ট নাই ৷ তয় গর্ভের সন্তানডার উপরে তার বহুত রাগ ৷ হ্যার মন কয় এই সন্তানডার লাইগাই তার এত যন্ত্রনা ! ”

বকুল আপা চুপ করলেন ৷ আমরা সবাই ও চুপ ৷ কি বলবো জানি না ৷ সেমন্তী হঠাৎ উঠে গিয়ে বকুল আপাকে জড়িয়ে ধরলো ৷ ওর দেখাদেখি আমরাও জড়িয়ে ধরলাম আপাকে ৷ আমরা সবাই কাঁদছি , নিঃশব্দে না , মোটামুটি চিৎকার করে কাঁদছি ৷ এ কান্না নিঃশব্দে কাঁদা যায় না ! চিৎকার ক্রোধে আপনা আপনি চলে আসে ৷

শুধু বকুল আপার মুখটা হাসি হাসি ৷ সে একটু পর পর বলছে “ছাড় আমারে , ছাড় ! যাইত্যাই মাইরা ফালাবি ! ছাড় কইতাছি ! ”

আপা যতবার ছাড় বলে , আমরা আরো শক্ত করে ধরি আপাকে ৷

কান্নাকাটির শব্দে বাবা মা দুজনেই উঠানে চলে আসেন ৷ সেমন্তী বাবাকে দেখে বকুল আপাকে ছেড়ে বাবার হাত ধরে বলে ” আব্বা , আপনি কুনোদিনও বকুল আপারে লতিফ ভাইয়ের কাছে দিবেন না ৷ হ্যায় নিতে আইলেও দিবেন না ৷ বকুল আপারে হ্যায় বহুত কষ্ট দিছে আব্বা …” সেমন্তী বাবার হাত ছেড়ে মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে ৷ বাবা আদর করে সেমন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন ” ঐ লতিফ্যার কাছে আমার মাইয়্যারে আমি জিন্দেগীতেও দিমু না ৷ গর্ভ থাকলে তালাক হয় না , খালাস হইলেই তালাকের ব্যবস্থা আমি করুম ৷ যতদিন আমি বাইচ্চা আছি , আমারু মাইয়্যার কারোরি দরকার নাই ৷ ”

মা বকুল আপাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন ৷ মায়ের ভাষ্যমতে গর্ভবতী মেয়েদের গভীর রাতে ঘরের বাইরে থাকতে নেই ৷ জ্বিন পরীর নজর পরে ৷

পরদিন সকালে মা তার পাঁচ কন্যার জন্য পিঠা করলেন ৷ আমরা চুলার পাশে বসেই সবাই গরম গরম পিঠা খেতে লাগলাম ৷ বকুল আপা পিঠা খেতে খেতে মা কে বললো ” মা মাছ খাইতে মনায় , পুকুরেত জাল ফালানির ব্যবস্থা নেও ৷”

বেলা দশটার মধ্যেই মাছ ধরার জন্য জেলে চলে এলো ৷ জেলের সাথে আধাআধি চুক্তি , যা মাছ পাবে অর্ধেক আমাদের অর্ধেক জেলের ৷

আমরা পাঁচবোন পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল সে কর্মজজ্ঞ দেখতে লাগলাম আনন্দের সাথে ৷ জেলে তার জালটা কেমন অদ্ভুত কায়দায় পুকুরে ছুড়ে দিচ্ছে , সাথে সাথে জালটা গোল হয়ে পড়ছে পুকুরে ৷ এ আমাদের চেনা দৃশ্য , ছোটবেলা থেকে অসংখ্যবার দেখেছি ৷ তবুও যেন প্রত্যেকবার নতুন করে ভালো লাগে ৷

আধঘণ্টার মধ্যে জেলের সাথে রাখা বেতের ঝুড়িটা ভরে গেলো ৷ বড় বড় মাছ উঠেছে সব ৷ জয়নাল দুলাভাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাছ সমান দুই ভাগ করলেন ৷ একভাগ জেলে নিয়ে চলে গেলো ৷ খুশিমনে চলে গেলো কারন মাছের সাথে তাকে একটা লুঙ্গি আর পাঁচ সেড় চাল দেওয়া হয়েছে ৷ এতটা সে আশা করেনি …

বকুল আপা মা কে দেখিয়ে দিলো কোন কোন মাছ সে খাবে ৷ মা সেগুলো আলাদা করে বকুল আপার জন্য রাধলেন খুব যত্ন করে ৷

বকুল আপাকে খাবার দেওয়া হলো ৷ আমরা সবাই আপাকে ঘিরে বসেছি ৷ আপা আগ্রহ করে খাবে আমরা এ দৃশ্য দেখবো ৷

কিন্তু আপা খেতে পারলো না ৷ যতবার মুখের কাছে নেন তার চোখ মুখ কুঁচকে আসে ৷ শেষে প্লেট ঠেলে দিয়ে বললো “ও মা , গন্ধ লাগে মাছে … ”

দুপুরের পর থেকেই আপার প্রসব বেদনা শুরু হলো ৷ এখনো সময় বাকি , তবুও প্রসব বেদনা শুরু হয়েই গেলো ….

চলবে

পয়মন্তী
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১১
_________________

আতুরী দাই চলে এলো কিছুক্ষন পরেই ৷ আমি অনেকবার চেষ্টা করলাম বকুল আপাকে যাতে হাসপাতালে নেওয়া হয় , কারো কাছে তেমন পাত্তা পেলাম না ৷ আমার ভয়ানক চিন্তা দেখে আতুরী দাই বললো “আম্মা , চিন্তা লইয়েন না ৷ বাচ্চা একদম সাইজ মতো আছে ৷ বাড়িতই হইবো ৷ ”

আসলেই তাই হলো ৷ কোন রকম সমস্যা ছাড়াই বকুল আপার পুত্রসন্তান হলো মাগরিবের আগে আগেই ৷ কয়েকবার শুধু বকুল আপার তীব্র চিৎকার শোনা গেলো ৷ আমি , শিমুল আপা আর সেমন্তী একে অপরকে জড়িয়ে ভয়ে জড়িয়ে থাকলাম ৷ আতুরী দাই এসে মায়ের পুরোনো শাড়িতে জড়ানো একটা কাপরের পোটলার মতো বাচ্চা এনে দিলো শিমুল আপার হাতে ৷ আমরা অবাক হয়ে দেখলাম কাপরের পোটলা থেকে ছোট্ট একটা শিশু হাত পা নাড়াচাড়া করছে ৷ সেই সাথে মাঝে মাঝে ঠোঁট বাকাচ্ছে , মনে হচ্ছে কাঁদবে , কিন্তু কাঁদছে না ৷

বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াবার জন্য বকুল আপার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো ৷ সন্তান জন্ম দেওয়ার ধকলে আপা তখন খুব ক্লান্ত ৷ বাচ্চাটা এখন কাঁদছে , ওর ক্ষুধা পেয়েছে ৷ মা বাচ্চাটাকে বকুল আপার কাছে শুইয়ে দিতে দিতে বললো ” বাচ্চাটারে দুধ খাওয়া মা ..”

মায়ের কথা শুনেই বকুল আপা ক্লান্ত গলায় বললো ” মা , প্যাটে থুইছি …উপায় আছিলো না তাই ৷ অহন জন্ম দিছি ৷ অহন আর কুনো দায়িত্ব আমি আমি নিতে পারমু না ৷ যা পারো যেমনে পারো করো , নাইলে ওরে ওর দাদীর কাছে দিয়া আসো ৷ আমারে আর কিছু কইয়ো না ৷ ”

মা অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছিলো না ব্যাপারটা আসলে কি হচ্ছে ! সে আবার বাচ্চাটাকে বকুল আপার পাশে শোয়াতে গেলো ৷ বকুল আপা এইবার আর কিছু বললো না ৷ শুধু আস্তে আস্তে পাশ ফিরে শুইলো ৷ মা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ৷ আমি মা কে ইশারায় ঘর থেকে আসতে বললাম ৷ মা চলে আসলো , কিন্তু তার হতভম্ব ভাব কাটলো না ৷

বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে , সে কান্নায় তার মায়ের কোন ভাবান্তর হচ্ছে না ৷ কিন্তু শিমুল আপা কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না ৷ সে বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বাবা সোনা বলে বলে ঝাকাতে লাগলো ৷ তাতে কি আর ক্ষুধার কান্না কমে ! অবশেষে বাচ্চার দুধের ব্যবস্থা হলো ৷ ফিডারে করে সেই দুধ তাকে খাওয়ালো শিমুল আপা ৷ রাতের বেলা বাচ্চাটাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো শিমুল আপা আর জয়নাল দুলাভাই ৷

পরদিন বকুল আপাকে আবার বোঝানোর চেষ্টা করা হলো ৷ বাবা নিজেও বোঝালো অনেকক্ষন ৷ বকুল আপা চুপ করে রইলো ৷ কিন্তু বাচ্চাটাকে কোনভাবেই একটাবারের জন্যেও কোলে নিলো না ৷

আমি বললাম “আপা বাচ্চাটারতো কোন ভুল নাই ৷ হ্যারে ক্যান কষ্ট দিতাছো ৷ হ্যায় মা থাকতেও বোতলের দুধ খাইয়া বড় হইতাছে ৷ এইডা অন্যায় হইতাছে ! বাপের ভুলের শাস্তি পোলারে ক্যান দিতাছো ?”

বকুল আপা ক্লান্ত গলায় বললো ” তোর মন চাইলে তুই নিয়া পাল , আমার তো আপত্তি নাই ! আমি খারাপ মা , আমার কাছে এরচে বেশি কিছু পাইবি না ৷ যা মন চায় ক ! ”

একসময় সবাই তাকে বোঝাবার চেষ্টা করা বন্ধ করে দিলো ৷ বাচ্চাটা বড় হতে থাকলো শিমুল আপার কাছে ৷ শিমুল আপা মা হলে হয়ে উঠলো এই মা পরিত্যক্ত শিশুটির ৷

ঢাকা ভার্সিটির রেজাল্ট হয়ে গেছে এর মধ্যেই ৷ আমি ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম , মনে বিশ্বাস ছিলো চান্স পাবো ৷ কিন্তু এত ভালো পজিশনে পাবো এটা বুঝিনি ৷ সত্যিই নিজেকে পয়মন্তী মনে হলো ৷ আচ্ছা , পজিশনটা বলি …আসলে নিজের অর্জনটা বলতে ভালো লাগে , একটু একটু লজ্জাও লাগে এটা ঠিক তবে ভালো লাগাটাই যেন বেশি ৷ আমার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি চান্স পেয়েছি দশম হয়ে ভাবা যায় ! অজ পাড়াগায়ে বড় হওয়া একটা মেয়ে কোন রকম বাড়তি সুযোগ সুবিধা ছাড়াই তার স্বপ্ন পূরনের পথ করে ফেলেছে ! কতটা ভাগ্যবতী হলে এটা সম্ভব !

পুরো বাড়িতে সবাই অনেক আনন্দিত হলো আমার অর্জনে ৷ একেক জন আমার মাথায় হাত বুলায় আর আমার ভীষণ কান্না পায় ৷ কিন্তু কাঁদতে পারি না , গলার কাছে শুধু কেমন যেন একটা দলার মত কি যেন আঁটকে থাকে ৷

বকুল আপার ছেলের নাম রাখা হলো জুনায়েদ ৷ শিমুল আপা হেসে হেসে সবাইকে বললো বাপের নামেই পোলার নাম রাখি , হ্যার বাপ জয়নালের জ দিয়া জুনায়েদ ৷ সে জুনায়েদকে একেবারেই নিজের সন্তান ভেবে নিয়েছে ৷ জয়নাল দুলাভাইও শিমুল আপার সাথে একমত ৷ এসব দেখে আমার ভয় হয় , আজ বকুল আপা সন্তানকে গ্রহণ করছে না , কিন্তু সন্তানটাতো তার ! সে যদি কখোনো জুনায়েদকে আবার বুকে টেনে নেয় তখন তো শিমুল আপার বুক খালি হয়ে যাবে ! সে জুনায়েদকে নিজের সন্তান ভেবে নিয়েছে ৷ সারাক্ষন জুনায়েদ জুনায়েদ ছাড়া তাদের স্বামী স্ত্রীর মুখে আর কিছু নেই ৷

জয়নাল দুলাভাইকে একদিন দেখা গেলো সে তার নিজের বাড়িতে গেলো ৷ সেখানে তার অল্প কিছু জমিজমা আছে ৷ দিন সাতেক পর দুলাভাই ফিরলো সেই জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে ৷ বাবার কাছে গিয়ে বললো “আব্বা , গেরামের জমিনগুলা বেঁইচা কিছু টেকা আনছি ৷ আপনি আমারে গঞ্জে দোকান দিয়া দেওনের ব্যবস্থা করেন ৷ এতদিন বইসা বইসা খাইছি , গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘুরছি … অহন পোলা হইছে , অহন তো আর বইসা বইসা খাইতে পারিনা ৷ একটা দায়িত্ব আছে না ! আপনের মাইয়্যা কইলো আব্বারে কও গঞ্জে একখান দোকান দিয়া দিক ৷ টেকা এইখানে আছে সত্তুর হাজার ৷ লাগে আপনে কিছু দিয়েন আব্বা ধার হিসাবে ৷ আস্তে ধীরে শোধ কইরা দিমু ৷”

গঞ্জে দুলাভাই বেশ বড় একটা দোকান দিলো ৷ দোকানের নাম দিলো “জুনায়েদ স্টোর” .. মেয়েদের জিনিসপত্রের দোকান ৷ চুড়ি , ফিতা, দুল ক্লিপ টাইপ ৷ মেয়েদের সব জিনিস পত্রই পাওয়া যায় ৷ অল্পদিনেই জয়নাল দুলাভাই দোকান জমিয়ে ফেললো ৷ দোকান থেকে কিছু দূরেই কলেজ ৷ কলেজের মেয়েরা হুমরি খেয়ে পড়ে দুলাভাইয়ের দোকানে ৷ ভালো টাকা আসতে শুরু করলো ৷ দুলাভাই সারাদিনে বিক্রির সব টাকা এনে শিমুল আপার হাতে দেয় ৷ দুজনে মিলে জুনায়েদের জন্য ভবিষ্যৎের প্লান করে ৷ তাদের দেখলে মনে হয় দুনিয়ায় তাদের মতো সুখী কেউ নাই আর …

বকুল আপা এসব ঘুরেও দেখে না ৷ তার এসবে যেন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ৷ সে একদম নিজের মতো থাকে , তবে বিমর্ষ না ৷ বরং বেশ উৎফুল্য থাকে ৷ একটু যেন বেশিই উৎফুল্য …মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক লাগে ! একা একা হাসে , গান গায় …গভীর রাতে সেজেগুজে পায়ে আলতা পরে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকে ৷ আমার মনে হয় আপার কোন মানষিক সমস্যা দেখা দিয়েছে ৷ আপাকে একজন মানিষক রোগের ডাক্তার দেখানো উচিত ৷ আবার পরক্ষনেই দেখি আপা একদম সুস্থ স্বাভাবিক আচরন করছে ৷ সেমন্তী বা আমার সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে গল্প করছে ৷ তখন আবার নিজেই নিজেকে বোঝাই , আপা হয়তো ভালোই আছে ৷ কিন্তু মনের মধ্যেকার খচখচানি কমে না ৷ সারাক্ষন একটা চাপা অস্বস্তিতে ভুগি …

আমার ঢাকায় যাবার দিন এগিয়ে আসতে লাগলো ৷ এতদিন ঢাকায় যাবার জন্য যত বেশী উৎসাহী ছিলাম দিনে দিনে বাড়ির জন্য খারাপ লাগাটা বাড়তে লাগলো ৷ বারবার মনে হয় আমার ঘর , আমাদের পুকুর ঘাট , আমার বোকা মা সব ছেড়ে আমাকে দূরে চলে যেতে হবে ! যতবার মনে হয় আমার যেন বুকটা ফেঁটে যায় ৷

সেমন্তী ইদানীং সারাক্ষন আমার গায়ে গায়ে লেগে থাকে ৷ অপূর্ব ছেলেটার সাথে সে আর কথা বলে না ৷ মনে মনে খুশি হই যে সেমন্তী ভুল পথ থেকে সরে এসেছে এই ভেবে ..

মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু বকুল আপা না , শিমুল আপারও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ৷ কেন এমন ভাবছি ! আমি জানি না কেন ! তবে জুনায়েদকে নিয়ে সে ভীষণ রকম অবসেসড ৷ হয়তো শিমুল আপা জুনায়েদকে নিয়ে আঙিনায় বসেছে , ওকে রোদ দিচ্ছে ৷ এমন সময় যদি বকুল আপা আঙিনার দিকে আসে তখন সে দ্রুত ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় ৷ ব্যাপারটা শুধু একবার না , বেশ কয়েকবার আমার চোখে পড়েছে ৷

আমি একবার শিমুল আপাকে বললাম ” জুনায়েদকে মাঝে মাঝে বকুল আপাকে দিও , আপা তাতে বুঝবে যে সে জুনায়েদের মা ৷ ” আমার এই সহজ কথাটা শুনে শিমুল আপা ভীষণ রেগে গেলো ৷ অনেকটা ঝগড়ার মতো সুরে আমাকে বললো ” বকুল আপা জুনায়ের মা হইবো ক্যান ! হ্যায় পোলারে ফালায়া দিছে , আমি টুকায়া নিছি …জুনায়েদ আমার পোলা ! খালি আমার পোলা , আর কারো না ৷”

এই সামান্য কথা নিয়ে সে খুব অশান্তি করলো ৷ আমি বোকার মতো তাঁকিয়ে রইলাম !

ঢাকায় যাবার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো ৷ আমার উচিত সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া …কিন্তু আমি যেন সংসারের মায়াজালে আরো বেশি বেশি জড়িয়ে যেতে লাগলাম…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here