পয়মন্তী,১২,১৩

0
490

পয়মন্তী,১২,১৩
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১২
_________________
দেখতে দেখতে সময় কেমন যেন হুটোপুটি করে চলে গেলো ৷ আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার ভর্তির দিন চলে এলো ৷ এবার আমি ঢাকায় যাবো ৷ শুরু হবে আমার জীবনের নতুন গল্প ৷

নির্দিষ্ট দিনে ভর্তির জন্য চলে এলাম ৷ ভর্তি হলাম ফার্মেসীতে ৷ আরো ভালো সাবজেক্ট পেলেও আমার কেন জানিনা মন ফার্মেসীতেই গেলো ৷ বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম কি করবো ৷ বাবা এসব বোঝেন না , তবে বললেন আমি যেন মনের কথাই শুনি ৷ ভর্তি হয়ে গেলাম ৷

হোস্টেলে সিট পেলাম না ৷ নিবেদিতা আবাসিক হলো আমার নতুন ঠিকানা ৷ এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাছে , হাঁটা পথ ৷ ক্লাস শুরু হতে আরো মাস খানেক দেরি আছে ৷ তবে আমি আর ফিরলাম না ৷ ক্লাস শুরুর আগে নতুন শহরে যেন মানিয়ে নিতে পারি তাই বাবা আমাকে হোস্টেলে রেখে একাই ফিরে গেলেন ৷

আমাদের বাড়িতে আমরা যে ঘরটাতে থাকতাম ঘরটা ছিলো বিশাল বড় ৷ জানালা খুললে শুধু সবুজ আর সবুজ দেখা যেতো ৷ আট তলার উপরে আমার বর্তমান ঘরটা একদমই ছোট , সেখানেই আবার দুটো বিছানা ৷ রুমের দুই প্রান্তে দুটো পড়ার টেবিল ৷ এক কোনায় একটা ছোট্ট আলমারি ৷ আমার রুমমেট বেশ আন্তরিকভাবে আলমারির এক পাশটা আমার জন্য ফাঁকা করে দিলো ৷ বললো আমি যেন আমার জিনিসপত্র সেখানে রাখি ৷ আমার কিছু গোছাতে ইচ্ছে করছে না , আমার কি বাড়ির জন্য মন খারাপ ! আমি আসলে এটাও বুঝতে পারছি না ৷ কেমন যেন শূন্য শূন্য অনুভূতি হচ্ছে আর বুকের মধ্যে কেমন একটা ভোঁতা ঝাঁঝালো ব্যথা ! এই ব্যথার সাথে আমি পরিচিত নই ৷ এটাকে কি বলে আমি জানি না ৷

আমার রুমমেটের নাম রোদেলা ৷ মিষ্টি একটা মেয়ে ৷ হোম ইকোনোমিক্স কলেজে পড়ে , বাড়ি রাজশাহী ৷ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার আপ্রান চেষ্টা করছে কিন্তু স আর ছ এ একটু মাখো মাখো উচ্চারণ বলে দিচ্ছে তার নাড়ি পোতা স্থানের কথা .. রোদেলা আপু আমার দুই বছরের সিনিয়র ৷ তবে এতটাই আন্তরিকভাবে কথা বলছে যেন আমি তার কত দিনের পরিচিত ! আমার একটু একটু লজ্জা হতে লাগলো এই ভেবে যে আমি কেন আন্তরিক হতে পারছি না ! আমিও চেষ্টা করছি রোদেলা আপুর সাথে তার মতো করে কথা বলতে , কিন্তু কথা জড়িয়ে আসছে ! তাকে আপনি বলবো না তুমি এটাও বুঝতে পারছি না , ভাব বাচ্যে কথা চালাচ্ছি ৷ আপু বোধহয় বুঝতে পারলেন আমার এই দ্বিধা ৷ হেসেই বললেন আমি তাকে তুমি বলতে পারি ৷ অদ্ভুত ব্যাপার আমি এরপরও ভাব বাচ্যেই কথা বলতে লাগলাম ৷ আমি কি পারবো এই শহরে মানিয়ে নিতে ! আমি জানি না …

রাত গভীর হলো ৷ রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদেলা আপু ফিশফিশিয়ে কথা বলছে কারো সাথে , মনে হচ্ছে হয়তো তার ভালোবাসার কেউ ৷ আমি আমার টেবিলের পাশে থাকা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম ৷ শহরের আকাশের বুকে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে ৷ মনে মনে খুশি হলাম এই ভেবে যে , চাঁদটা অন্তত আমাকে একা ছাড়েনি , আমার ছোট্ট গেয়ো চাঁদটা যেন আমার জন্যই আজ শহরের ধুলি ধোয়া মাখা আকাশে নিজেকে উজার করে দিয়ে আলো ছড়িয়েছে ৷ হয়তো চাঁদটা বলছে “এই পয়া , দেখ , দেখ … তুই একা কোথায় ? আমি কিন্তু ঠিক চলে এসেছি তোর পিছু পিছু ! ” আমি নিজের ছেলেমানুষীতে নিজেই হাসলাম ৷ আচ্ছা বাড়িতে সবাই কি করছে এখন ? বকুল আপা , শিমুল আপা …মা .. বাবা কি পৌছে গেছে ? এখনো জানালো না কেন ? আমি তো বলে দিয়েছিলাম পৌছেই যেন আমাকে জানায় .. এখন তো আমার নিজেরও ফোন আছে , একটু কল করলেও তো পারে !

বারোটা বাজে , রোদেলা আপু এখনও বারান্দায় ৷ এত রাতে আমাদের বাড়িতে সবার একঘুম হয়ে যায় ৷ অথচ আজ আমিও জেগে আছি ৷ ইচ্ছে করছে রোদেলা আপুকে ডেকে আনি , এনে বলি “আপু আমার একা লাগছে ভীষণ .. আমার কাছে থাকো প্লিজ…” ডাকতে পারলাম না ! আমার ভিতরে যে এত জড়তা , এত সঙ্কোচ লুকিয়ে ছিলো এটা কি আমি জানতাম !

আপু রাতে যখন খেতে বলেছিলো , তখন আমার ক্ষুধা ছিলো না ৷ আপু বলেছিলো খাবার নিয়ে গেলে আর দিবে না ! সেই খাবার রাত দশটায় ফেরত নিয়ে গেছে , আর এই রাত্রে এখন আমার ক্ষুধা লেগেছে ! ক্ষুধাটা যেন সময়ের সাথে বাড়ছে , আমার সব কষ্ট , বাড়ির জন্য মন খারাপ সব তুচ্ছ হয়ে গেলো এক নিমেষেই এই ক্ষুধার কাছে ৷ এতক্ষন একলা লাগলেও রোদেলা আপুকে ডাকিনি যে দ্বিধায় আমি সেটাও বেমালুম ভুলে গেলাম ৷ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই আপু বললো “কিছু লাগবে তোমার পয়মন্তী ? এখনও ঘুমাওনি যে ! ” আমি কিছুক্ষন আমতা আমতা করে বললাম “আপু , খুব ক্ষুধা লাগছে ৷ ঘুম আসছে না ৷

এতক্ষন রোদেলা আপু মোবাইলে হাত চেপে রেখে কথা বলছিলো ৷ এবার ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটাকে বললো “আজকে রাখি , কাল কথা হবে” ৷ ওপাশের মানুষটা বোধহয় রাখতে চাইছিলো না ৷ আপু বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফোন রেখে দিলেন ৷

ঘরে এসে নিজের খাটের নিচ থেকে একটা বয়াম বের করে দিলেন , সেখানে বিস্কিট রাখা ৷ আমাকে বললেন খেয়ে পানি খেয়ে নিতে ৷ আমি বুভুক্ষের মতো সেই বিস্কিট খেলাম ৷ নোনতা স্বাদের সেই বিস্কিট আমার মনে হলো পৃথিবীর সেরা খাবার ৷ কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো আমার …

আমি তো এমন ছিলাম না ! এই শহর কি আমাকে একদিনেই বদলে দিলো !

পরদিন শুক্রবার ৷ আমার ঘুম ভাঙলো দশটায় ৷ এত বেলা করে আমি কখনোই উঠি না ৷ সকালটাই বিষন্নভাবে শুরু হলো ৷ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এভাবে আর না , নিজের রুটিনেই থাকতে হবে ৷ শহরে এসে পয়া শহুরে রঙে নিজেকে রাঙাবে না ৷

রোদেলা আপু এসে বললো

—পয়মন্তী , চলো তোমাকে ঢাকা দেখিয়ে আনি ৷ চলো এই আশেপাশেই যাবো ৷

—আপু , নীলক্ষেত এখান থেকে কতদূরে ?

—কাছেই , কেন নীলক্ষেতে কাজ আছে ?

—না … আসলে শুনেছিলাম ওখানে অনেক বই পাওয়া যায় , দুনিয়ার সব বই নাকি নীলক্ষেতে আছে !

—হা হা হা ! কে বলেছে ?

—আমাদের কলেজের এক স্যার

—হুমমম অনেক বই আছে ৷ আমার আবার বইয়ের তেমন শখ নাই ৷ চলো তোমাকে নিয়ে যাবো ..

আমরা দুজনে বের হলাম ৷ রিকশায় করে গেলে নাকি পাঁচ মিনিটের পথ , অথচ আমরা দশ পনেরো মিনিট প্রায় য্যামেই আটকে থাকলাম ৷ অবশেষে আমরা পৌছালাম নীলক্ষেত … সেখানে গিয়ে আমার আরেকবার মনে হলো ঢাকায় আসাটা আমার জন্য নেওয়া সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো ! এত বই ! এত বই ! আমি কোনদিনও একসাথে এত বই দেখিনি ৷

বাড়ি থেকে আসার সময় বাবা আমাকে টাকা দিয়েছে ৷ গোপনে বেশ অনেকগুলো টাকা দিয়েছে মা ৷ আবার শিমুল আপাও ডেকে টাকা দিয়েছে ৷ এখন তাই আমি অনেক টাকার মালিক বলা যায় ৷ ঘুরে ঘুরে বই ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম ৷ আমার আর বাড়ির কথা মনে নেই , আমার যেন কোন কথাই মনে নেই ৷ আমার সামনে বইয়ের সমুদ্র ৷ বারবার মনে করার চেষ্টা করলাম কোন বইগুলোর কথা স্যার বিভিন্ন সময় ক্লাসে বলেছিলো ! প্রথম আলো , লোটাকম্বল , কালপুরুষ , কালবেলা , সেই সময় , শংসপ্তক , শবনম , পথের পাঁচালী , সাতকাহন … আর কি যেন ছিলো ! কি ছিলো ! স্যার কোন বইয়ের কথা বলেছিলো , “মেয়েরা শোন , এই বইটা একবার পড়লে হবে না .. প্রথমে একবার পড়ে পরে সাথে সাথেই আবার পড়তে হবে ৷ তবেই বুঝবে গল্পটা কি ! ” সেই বইয়ের নাম কি ছিলো ? কিছুইতেই মনে আসছে না ….

সব বই কিনে দুই হাত বোঝাই করে ফিরবো এমন সময় আমার একটা বইয়ে চোখ আঁটকে গেলো ৷ এটাই তো সেই বই , স্যার যেটার কথা বলেছিলো … “গর্ভধারিনী” ৷ আমি আবার পেছনে ফিরে গর্ভধারিনী বইটা কিনে ফেললাম ৷ রোদেলা আপু অবাক বিষ্ময়ে আমাকে দেখছে ৷ হয়তো পাগল টাগল ভাবছে ৷ কিন্তু আপু তো জানে না , কুয়োর ব্যাঙ সমুদ্রে এসে পড়লে তার অবস্থা এমনই হয় !

আজ রাতটা আমার ভালো কাটবে ৷ ইচ্ছে করছে সারা বিছানায় বই বিছিয়ে দিয়ে আমি মাঝখানে শুয়ে থাকি … কড়কড়ে নতুন বইয়ের ধোঁয়া উঠা উষ্ণ গন্ধ , আমার মনটা চনমনে হয়ে গেলো ৷

রোদেলা আপু রিকশায় বসে তার প্রেমিক পুরুষটির গল্প বললো ৷ ছেলেটা পড়াশোনা শেষ করেছে , এখন চাকরি যুদ্ধের সৈনিক ৷ ভীষণ কেয়ারিং , ভীষণ ভালো একজন মানুষ … আমি আপুর কথাগুলো শুনছি , কিন্তু আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না ৷ কখন এই য্যাম শেষ করে হোস্টেলে পৌছাবো ! কখন আমি নতুন বইগুলো খুলে পড়বো …..

ঢাকা শহরের সব ভালো শুধু এই য্যামটাই বিশ্রী !

চলবে

পয়মন্তী
তামান্না জেনিফার
পর্ব ১৩
_________________

কিভাবে দিনগুলো গেলো আমি বুঝলাম না ৷ অথচ গত একমাসে কত কিছু হয়ে গেছে ! রোদেলা আপুর সেই কেয়ারিং ভালোবাসার মানুষটা চাকরি পাবে জন্য অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলেছে ৷ যেদিন বিয়ে করেছে তার আগের দিনও গভীর রাত পর্যন্ত তারা প্রেমালাপ করেছে বারান্দায় বসে ৷ পরের দিন সকালে খুব স্বাভাবিকভাবে জানিয়েছে সে বিয়ে করছে , পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তার জন্য চাকরি খুব দরকার…

প্রথম কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করে রোদেলা আপু কেমন যেন চুপ হয়ে গেলো ৷ আমার সাথেও তেমন কথা বলে না , ঠিকমতো ক্লাসও করে না ..তারপর একদিন হোস্টেল ছেড়ে চলে গেলো ৷ আমি এখন এই রুমে একাই থাকি ৷ তবে নতুন কেউ রোদেলা আপুর বিছানায় চলে আসবে শুনেছি ৷ এখানে কারো ফেলে যাওয়া বিছানা ফাঁকা থাকে না কখনোই … একজনের ফেলে যাওয়া ঘরে অন্য একজন তার ঠিকানা গড়ে তোলে ৷

এখন আমি যেখানে আছি , এ বিছানাটাও হয়তো অন্য কারো ছিলো ৷ সে মেয়েটা কেমন ছিলো আমার খুব মনে হয় মাঝে মাঝে ৷ আমি কল্পনায় দেখি শ্যামলা কাজল নয়না এক মেয়ে আমার বিছানাতে শুয়ে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজাচ্ছে ! এমন কেন মনে হয় আমার আমি জানি না ৷ হয়তো এমনও হতে পারে যে মেয়েটা ছিল সে ছিল ভীষণ সুখী কেউ ৷ আমি কল্পনায় একটা সুখী মুখ ভাবতে চাই , কিন্তু পারি না … বারবার সেই শ্যামলা মেয়ের দুঃখী মুখটাই বারবার আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ৷

বাড়ি থেকে একমাসে চিঠি এসেছে তিনটা ৷ দুটো চিঠি পাঠিয়েছে মা ৷ আসলে লিখেছে সেমন্তী , মায়ের জবানীতে ৷ আর একটা চিঠি লিখেছে শিমুল আপা ৷

মায়ের চিঠিতে কোন দরকারি কথা থাকে না ৷ তবে অনেক কথা থাকে ৷ বাড়ির গরু ছাগলের কথাও মা লিখতে ভোলে না ৷ কিন্তু আমার বোনেরা কে কেমন আছে , কি করছে এসব একদমই লেখে না ৷ বাবার কথাও তেমন থাকে না ৷ একটা চিঠিতে মা লিখেছে ” রানতে গিয়া দেখি চুলার একখান মাথা ভাঙ্গা ! কেমুন লাগে ক ! এই কাম কেডায় করলো কে জানে .. চুলা ঠিক করনের কুমোর মাটি নাই ৷ আবার জয়নালরে পাঠাইলাম মাটি আনতে ৷ হ্যায় তো আজকাল বিরাট ব্যস্ত , তাও আমি কিছু কইলে ফালায় না ৷ হ্যায় মাটি আনতে আনতেই আজান দিলো , এইদিকে তোর বাপ ক্ষিদায় অস্থির ৷ কোনমতে চুলা ঠিক কইরা ডাল ভাত রাইন্ধা তোর বাপেরে দিলাম ৷ কি যে অবস্থারে পয়া দেখলে বুঝতি …” সামান্য চুলা ভেঙেছে এটা নিয়েই এত কথা , অথচ পারুল আপাকে যে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে এ কথা মা লেখেনি ৷ মা লেখেনি পারুল আপা এখন আমাদের বাড়িতে ৷ এসব কথা শিমুল আপার সেই চিঠিটা পড়েই জানলাম !

গঞ্জে জয়নাল দুলাভাইয়ের ভরাপুরা দোকানের খবর পেয়ে পারুল আপার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভেবেছে এই দোকানটা বাবা করে দিয়েছে ৷ এক মেয়েকে এত বড় দোকান দিয়ে দিলো , অথচ আরেক মেয়েকে দিলো না এটা তাদের খুব আত্মসম্মানে লেগেছে ৷ বাবা অনেকবার বলেছেন দোকান জয়নাল ভাই তার গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করা টাকায় করেছে , কিন্তু এসব তারা বিশ্বাস করেনি ৷ পারুল আপা কোন এক অজানা কারনে শিমুল আপার সাথে কথা বন্ধ করেছে ৷ এক বাড়িতে থেকেও তাদের দুজনের সাধারণ কথাবার্তা বন্ধ !

আমার ধারনা পারুল আপার মনে হচ্ছে শিমুল আপার জন্য তার ঘর ছাড়তে হয়েছে ৷ শিমুল আপা এখন পুরো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষ ৷ স্বামী আর সংসার দুটোই তার হাতের মধ্যে ৷ এর মধ্যে সিলেটে সেই ডাক্তারের কাছে তারা আবার গিয়েছিলো , অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো , আপা এই কথাটাও লিখেছে ৷ তবে পারুল আপার উপর তার রাগ চিঠিতে স্পষ্ট , এই রাগের কারন আমি চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না ৷

যাই হোক , এসব নিয়ে ভেবে আসলে আমি কোন কূল কিনারা পাই না ৷ আমি ভেবেই বা কি করবো ! আমার কি করার আছে এত দূরে বসে ! আমি চিঠি লিখতে বসি ৷ প্রথমে চিঠি লেখি মায়ের কাছে ৷ তারপর লেখি শিমুল আপার কাছে ৷

মা ,
আমার সালাম নিও ৷ কেমন আছো তুমি ? বাবা কেমন আছে ? আর সবাই কেমন আছে ?

সাদা গরুটার বাছুরটার নাম কি রাখছো ? ওই বাছুরটা কি মায়ের মতো সাদা হয়েছে ? যদি একদম মায়ের মতো সাদা ধবধবে হয় , ওর নাম রেখো ধবলি ৷ আর যদি একদম সাদা না হয় তাহলে নাম রেখো সুবর্না ৷ এই দেখো না , আমি কি বোকা ! বাছুরটা ছেলে না মেয়ে সেটাও তো বলোনি ! আমি এদিকে মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছি !

মা , পুকুরে কি জাল ফেলেছিলে আর ? জাল না ফেললে আবার ফেলো ৷ ঝুড়ি ভর্তি জীবন্ত বড় বড় মাছগুলো দাপটের সাথে লেজ নাড়ায় , আমার যে কি ভালো লাগে দেখতে …আমি তো দেখতে পারবো না , আমার হয়ে তুমিই দেখে নিও ৷

মুরগির বাচ্চা ফোঁটাতে দিয়েছিলে দেখে এসেছিলাম ৷ এগারোটা ডিম দিয়েছিলে , তার মধ্যে পাঁচটা ছিলো হাঁসের ডিম .. সবগুলো কি বাচ্চা হয়েছে ? দুই একটা ডিম নষ্ট হলে তুমি সারাদিন মন খারাপ করে থাকো , আমার যে তখন কি মায়া লাগে … ও মা , এবারও কি দুই একটা নষ্ট ডিম ছিলো ? তুমি কি সারাদিন মন খারাপ করে ঘুরেছো মা ? হাসের বাচ্চাগুলো পুকুরে বোধহয় মনের সুখে ভাসে তাই না মা ? ওদের মতো করে ভাসতে পারলে ভীষণ শান্তি পেতাম ..

জমিলা খালা কি প্রতিদিন আসে ? কাজ টাজ ঠিক মতো করে তো ? না আসলে তার বাড়িতে লোক পাঠাবে ৷ সব কাজ একা করতে হবে না তোমার ৷ আর না হলে শিমুল আপা , বকুল আপা , সেমন্তী আছে , তাদের বলবে যেন তোমার সাথে হাতে হাতে সাহায্য করো ৷

দুই একবার রান্নায় দেরী হলেও কোন সমস্যা নেই মা ৷ তবে তুমি কুমোর মাটি বেশি করে এনে রেখো ৷ তাহলে আর এমন হবে না ৷

তুমি নিজের খেয়াল রেখো মা ৷ অনেক ভালো থেকো ৷ আমার ক্লাস শুরু হবে আগামী কাল ৷

মা , আমি ভালো আছি , আমায় নিয়ে ভেবো না ..

ইতি ,
তোমার পয়া

প্রিয় শিমুল আপা ,
আশা করি ভালো আছো ৷ আমিও ভালো আছি ৷

আপা , জীবনে এমন অনেক সময় আসে , তখন চুপচাপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ ৷ কিছু মানুষ এমন থাকে যাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্যটা দেখানো হলেও তারা চোখ ডলে নিয়ে আবার সেটাই দেখে যেটা সে দেখতে চায় ! এদের সত্য দেখাতে চেয়ে আসলে কোন লাভ নেই ৷ দিনশেষে তারা সেটাই বুঝবে যেটা তারা বুঝতে চায় ৷

পারুল আপা খুব ভালো করেই জানে তার শ্বশুড়বাড়ির মানুষজন কেমন , কতটা লোভী ৷ আমাদের বাড়িতে আসলে বাবা জীবন দিয়ে চেষ্টা করে তাদের সর্বোচ্চ সম্মান করতে , অথচ প্রত্যেকবারই তাদের সাথে পারুল আপাও এমন একটা ভাব দেখায় যে আসলেই তাদের কোন সম্মান করা হয়নি ৷ তোমার কি মনে হয় , পারুল আপা এসব জানে না ! জানে , কিন্তু মানতে চায় না ৷ সে বোধহয় এই মিথ্যাতেই বাঁচতে চায় যে তার স্বামী , তার শ্বশুড়বাড়ির মানুষজন একদম বকসাদা মনের ! তাহলে তাকে সেটাই ভাবতে দাও ৷

সবসময় তার অন্যায় রাগ ভাঙাতে হবে , ব্যাপারটা এমন হবে কেন ? তুমি একদম স্বাভাবিক থাকো ৷ তার উপর রাগ হবারও দরকার নেই ৷ তাকে তার মতো ভাবতে দাও , তাকে তার মতো চলতে দাও ৷ বোঝাতে যেও না , সে বুঝবে না ৷

সেমন্তীর দিকে একটু খেয়াল রেখো ৷ ওর বয়সটা ভালো না ৷ তুমি ছাড়া আর কাকেই বা বলবো ওর দিকে খেয়াল রাখতে ?

দুলাভাইকে আমার সালাম দিও , জুনায়েদকে আমার আদর দিও ৷

ইতি
পয়া

দুটো চিঠি আলাদা খামে ভরে ব্যাগে রাখলাম ৷ কাল আমার প্রথম ক্লাস ৷ আমার মাথায় অদ্ভুত সব চিন্তা ঘুরছে ৷ আমি কি খাতা নিয়ে যাবো নাকি ডায়েরী .. সিনেমায় দেখেছি ভার্সিটিতে নায়ক নায়িকা শুধু ডায়েরী নিয়ে যায় ৷ কাকে জিজ্ঞেস করবো সেটাও তো বুঝতে পারছি না … আচ্ছা আমি নাহয় দুটোই নিয়ে যাবো , গিয়ে সবারটা দেখে সেই মতো বের করবো ৷ ..

একলা ঘরে আমার ঘুম আসে না ৷ জন্ম থেকেই বোনদের সাথে সাথে থেকেছি , এখানে আসার পর ছিলো রোদেলা আপু ৷ এখন আর কেউ নেই ৷ পুরো ঘরটা খাঁ খাঁ করছে ৷ আমার সাথে সাথে গ্রাম থেকে আসা বোকা চাঁদটাকেও দেখা যাচ্ছে না ৷ আজ আমি একা ! ভীষণ রকম একা ৷ কাল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস , অথচ আমার সাথে যাবার কেউ নেই ! আমি কি বেশিই বড় হয়ে গেলাম ? এত বড় তো আমি কখনোই হতে চাইনি ৷

প্রথমদিন আমার সাথে কলেজে গিয়েছিলো বকুল আপা ৷ বাড়ির কাছেই কলেজ , অথচ আমি একা যেতে কি ভয়টাই না পাচ্ছিলাম ! আজ আমি গ্রাম থেকে কত দূরে ঢাকায় , বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো আমি একা ! আমি বোধহয় প্রয়োজনের চেয়েও বেশি

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here