ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ১০

0
240

ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ১০
অরিত্রিকা আহানা

দুপুর বেলা খাবারের সময় বিশেষ কথাবার্তা হলো না দুজনের মাঝে। ফাগুন সংকোচের কারণে চুপ করে ছিলো। আর সৃজন। ও খাবার টেবিলে এমনিতেই কথাবার্তা কম বলে। সুধা থাকলে সেটা অন্য ব্যাপার। সুধার সঙ্গে ওর সমস্ত আলোচনা খাবার টেবিলেই হতো।

রাতেও একই ঘটনা ঘটলো। কথা বলার একান্ত ইচ্ছে থাকলেও বলার মত কোনো কথা খুঁজে পেলো না ফাগুন।

রাত সাড়ে বারোটা!
অনেকক্ষণ একা একা জেগে থাকার পর সামান্য একটু তন্দ্রা লেগে এসেছিলো ফাগুনের। এমন সময় কাঁঁচের জানালায় হঠাৎ ছুরি ঘষার মতন আওয়াজ কানে এলো। আওয়াজটা ফাগুনের ঘর বরাবর ঠিক নিচতলা থেকে আসছে। রাতের বেলা সব নিরব থাকে। এইজন্য স্পষ্ট শোনা যাছে।

ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ফাগুনের। লাইট অন করারও সাহস হলো না। হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। বুকের মধ্যে ধুকধুক করছে। সৃজনকে বিষয়টা জানানো প্রয়োজন। মোবাইল নিয়ে সোজা সৃজনের ঘরের দিকে ছুটে গেলো।

সৃজন ঘুমে বেঘোর। জ্বর আর ঠান্ডায় শরীর কাহিল। ফাগুন সামান্য ঝুঁকে ফিসফিস করে ডাক দিলো,

‘এই যে, শুনছেন?’

সৃজনের ঘুম ভাঙলো না। ফের ডাক দিলো ফাগুন। বাহুতে হাত রেখে হালকা ঝাঁকি দিলো। সৃজন সজাগ হলো। ফাগুনকে দেখে ঘুমের ঘোরে চমকে উঠলো। বিস্মিত কন্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই ফাগুন ফিসফিস করে বললো,

‘বাড়িতে মনে হয় ডাকাত পড়েছে। আমার ভীষণ ভয় করছে!’

সৃজন প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না। অবাক হয়ে ফাগুনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলো। পাশের টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে আলো জ্বালালো। নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি করে বুঝলে?’

‘নিচতলায় কে যেন জানালার গ্রিল কাঁটার চেষ্টা করছে।’

সৃজন কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইলো। এই সময় মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। আলমারি থেকে একটা টর্চ বের করলো। টর্চের হাতল পুরোটাই লোহার। অনেক আগেকার দিনের টর্চ। সৃজনের দাদা আমলের। সেটা নিয়ে নিচে নামার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। সঙ্গেই সঙ্গেই ওর হাত চেপে ধরলো ফাগুন। ভয়ে ভয়ে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছেন? আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন।’

ফাগুন ভয় পাচ্ছে! ভয়ে ওর শরীর কাঁপছে! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সৃজন ওর ভয়ার্ত চেহারা দেখে আশ্বস্ত করে বললো,

‘ভয় নেই। কারখানায় ফোন করে দিলে ছেলেপেলেরা দুই মিনিটের মধ্যে হুন্ডা নিয়ে হাজির হয়ে যাবে। নিচের পরিস্থিতি কেমন সেটা দেখতে যাচ্ছি। সিউর হয়ে তারপর কারখানায় ফোন করবো।’

ফাগুন হাত ছেড়ে দিলো। কিন্তু ভয় কমলো না। সৃজন ওর মোবাইল থেকে কারখানার ফাগুনের মোবাইলে ম্যানেজার ছেলেটির নাম্বার তুলে দিলো। ইশারায় দরজা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললো,

‘আমি আড়াল থেকে দেখেই ফিরে আসবো। না ফেরা পর্যন্ত কোনোমতেই দরজা খুলবে না। আর যদি আমার দেরী দেখো তাহলে এই নাম্বারে ফোন করে দেবে।’

ফাগুন হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। কিন্তু এত কিছুর পরেও ভয় গেলো না। সৃজন একা একা বেরিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো বিপদ হয়ে। ফের সৃজনের হাত চেপে ধরলো। অনুনয় করে বললো

‘আমি আপনার সঙ্গে যাই না প্লিজ? আমি কোনো শব্দ করবো না। শুধু আপনার পিছু পিছু থাকবো।’

সৃজন রাজি হলো না। ফাগুনকে নিয়ে নিচে নামাটা রিস্কি। ফাগুনের অনুনয়ে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘যা বলেছি করো। এখন কথা বাড়ানোর সময় নেই।’

ফাগুনের চোখে পানি চলে এলো। ওর চিন্তার কথাটা একবারও বুঝতে চাইছে না সৃজন। চোখের পানি আড়াল করার জন্য অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কান্না চেপে বললো,

‘আমি জানি আমি পাশে থাকলে আপনার ভালো লাগে না। কিন্তু একা একা আমি আপনাকে নিচে যেতে দেবো না।’

সৃজন সরাসরি ফাগুনের চোখের দিকে চাইলো! বেশকিছুক্ষণ কোনো কথা বললো না।
ভেবেছিলো ফাগুন বেশি জোরাজুরি করলে ওকে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে যাবে। কিন্তু ফাগুন সব চিন্তাভাবনা এলোমেলো করে দিলো। সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি কিচ্ছু বুঝতে চায় না ফাগুন। সৃজন ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘এই সময়টা এসব ভাবার মত নয়। আমি তোমাকে উপরে থাকতে বলছি তার কারণ কোনো বিপদ হলে তুমি সাহায্য করতে পারবে। সেইজন্যই তোমার ফোনে ম্যানেজারের নাম্বার সেইভ করে দিয়েছি। দুজন একসঙ্গে বিপদে পড়লে তো কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবো না।’

ফাগুন চুপ করে রইলো। অগত্যা ওকে সঙ্গে নিয়েই নিচে নামতে হলো সৃজনকে।
নিচতলায় নেমে প্রথমে বাড়ির মেইন সুইচ অফ করে দিলো সৃজন। অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। চুপচুপি ফাগুনের ঘর বরাবর এগিয়ে গেলো।

ফাগুন ভয়ে সৃজনের জামার পিছনটা খামচে ধরেছে। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে আসছে। আওয়াজটা এখনো আসছে। ঘরের দরজা খোলা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। সৃজন লাইট জ্বালালো।

সঙ্গেই সঙ্গেই জানালার বাইরে বিড়ালের অবয়ব স্পষ্ট ফুটে উঠলো। চট করে ফাগুনের মুখের দিকে চাইলো সৃজন।
ফাগুন লজ্জা পেলো। সৃজনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে লাজুক কন্ঠে বললো,

‘দোতলা থেকে আওয়াজটা অন্যরকম মনে হচ্ছিলো।’

সৃজন কিছু বললো না। মেইন সুইচ অন করে বসার ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিলো। তারপর গেট খুলে বেরিয়ে গেলো বিড়াল তাড়ানোর জন্য। ফাগুনও পিছু নিলো।
বাইরে বেরিয়ে সৃজন জানালা বরাবর টর্চের আলো তাক করতেই এক লজ্জাজনক দৃশ্য নজরে পড়লো ফাগুনের। ঘরের ভেতর থেকে বিষয়টা বোঝা যায় নি। মাঝরাতে ভালোবাসাবাসি করছে বিড়াল সম্প্রদায়। লজ্জায় একছুটে দোতলায় উঠে গেলো সে। অতি উৎসাহী হয়ে সৃজনের পেছন পেছন বেরোনো একদম উচিৎ হয় নি। এখন কি লজ্জাটাই না পেতে হয়েছে! সৃজন বিড়ালদের বিরক্ত করলো না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেলো।

সকাল বেলা লজ্জায় আর সৃজনের সামনে এলো না ফাগুন। টেবিলে নাশতা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। সৃজন প্রথমে বিষয়টা বুঝতে না পারলে ধীরে ধীরে ফাগুনের কর্মকান্ড দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো। বাড়ির বাইরে বিড়াল দেখলে ফাগুন তাড়িয়ে দেয়!

তাহেরা ফেরার পর আজ প্রায় দুদিন বাদে কারখানায় এসেছে সৃজন। এই দুই দিনে কাজ অনেক বেড়ে গেছে। ডেস্কে বসে ডেলিভারির হিসেব নিকাশ করছিলো। এমন সময় হঠা আসাদ এসে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে নিজে নিজেই চেয়ার টেনে বসলো। কন্ঠস্বরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো,

‘আপনার কাছে বিচার নিয়ে এসেছি। আপনার বউ আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে!’

সৃজন হিসেব থামিয়ে দিয়ে সরাসরি আসাদের দিকে চাইলো। আসাদ পুনরায় কন্ঠস্বরে বিষ ঢেলে বললো,

‘আমার সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করে আমাকে ঠকিয়েছে। ওর নজর এখন আপনার টাকা পয়সার দিকে পড়েছে।’

সৃজন শান্ত কন্ঠে বললো,

‘দেখো তোমার সঙ্গে ওর কি ঝামেলা হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু ও যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ও তোমার কাছে ফিরবে না তাহলে ওকে জোর করো না। কারো ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াটা মোটেও ভালো কাজ নয়!’

আসাদ তেতে উঠে বললো,

‘এসব জ্ঞানের কথা রাখুন। আসল কথা আপনি ওকে আটকে রাখতে চান। নইলে এতকিছুর পরেও ওকে ডিভোর্স কেন দিচ্ছেন না?’

‘আমি মোটেও আটকে রাখি নি। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তুমি ওকে রাজি করিয়ে নিয়ে যাও।’

আসাদ রাগে দাঁতেদাঁত ঘষলো। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,

‘আপনি জানেন ওর সঙ্গে আমার কত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো?’

অন্তরঙ্গ কথাটা শুনে কড়া চোখে আসাদের দিকে চাইলো সৃজন। শীতল কন্ঠে জানতে চাইলো,

‘কতটা?’

আসাদ জবাব দিতে পারলো না। চট করে সৃজনের রাগত চাহনি ওর কথা গুলিয়ে দিলো। সৃজন হিসাবের খাতাটা বন্ধ করে ফের ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো,

‘কি হলো জবাব দিচ্ছো না কেন? কতটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো?’

আসাদ এবারেও চুপচাপ। সৃজন এমন রেগে যাবে ও ভাবতে পারে নি। সৃজন ওর দ্বিধান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,

‘তুমি ওর প্রেমিক আর আমি ওর স্বামী। ও কাকে নিজের কতটা কাছে যেতে দিয়েছে সেটা আমার চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। খামোখা কথা বাড়াচ্ছো তুমি।’

সৃজনের ইঙ্গিত টুকু ধরতে পারে নি আসাদ। আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বললো,

‘তারমানে আপনি বলতে চাইছেন আমি মিথ্যে বলছি?’

‘আমার স্বীকৃতির কি প্রয়োজন? সে যদি সত্যিই তোমার কাছে গিয়ে থাকে তাহলে তো অন্য কারো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই তোমার।’

আসাদ ফের তেতে উঠলো,

‘তারমানে আপনি ওকে ডিভোর্স দেবেন না?’

সৃজন মুচকি হাসলো। আসাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘না। অনেক আগেই ওকে আমি নিজের সঙ্গে বেধে নিয়েছি। তুমি যেটাকে অন্তরঙ্গ বললে ঠিক সেভাবে!’

আসাদ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো! কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলো না। সৃজনের সঙ্গে ফাগুনের কোনো সম্পর্ক হতে পারে একথা স্বপ্নেও ভাবে নি সে। কন্ঠে জোর দিয়ে বললো,

‘মিথ্যে কথা!’

সৃজন এবারেও পূর্বের ন্যায় শান্ত। বললো,

‘অন্য কারোর স্বীকৃতি প্রয়োজন নেই আমার। আমি নিজে জানি ফাগুন আর আমার মধ্যে কি ঘটেছে। তুমি শুধু এইটুকু জেনে রাখো আমার চেয়ে বেশি ওর কাছে কেউ যেতে পারে নি। আমার করা প্রতিটা স্পর্শই বলে দিয়েছে ফাগুন কতটা আমার। ওকে আমি কোনদিন ত্যাগ করবো না।’

আসাদ ভেবেছিলো সৃজনকে ফুসলিয়ে সংসারটা ভেঙে দিতে পারলে ওর কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ফাগুনের। কিন্তু সৃজনের সঙ্গে কথা বলে ও নিজেই অবাক হয়ে গেলো। রাগের মাত্রাটা হঠাৎ বেড়ে গেলো। ক্রদ্ধ কন্ঠে বললো,

‘কিন্তু আপনার বউ যে আপনার নাক কান ডুবিয়েছে তার কি করবেন? লোকে তো ছি ছি করছে।’

‘আমার বউ যখন স্বীকার করেছো তারমানে ও আমার। অতএব আমার বউকে আমার হেফাযতে ছেড়ে দাও।’

‘ওর নজর এখন আপনার টাকার দিকে।’

‘আমার টাকায় আমার বউয়ের নজর থাকলে সেটাতে তোমার এত আপত্তি কেন!’

আসাদ আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। চলে গেলো! হতাশ, রাগ, ক্ষোভ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু সৃজন কাজে মন বসাতে পারলো না! চিরাচরিত শান্ত মস্তিষের সৃজন যেন আজ বড্ড অশান্ত হয়ে পড়েছে। বুকের ভেতরটা জ্বলছে। আসাদের অন্তরঙ্গ কথাটা ঠিক হৃদয়ে গিয়ে লেগেছে।

সৃজন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ফাগুনকে ও এখনো অনেক বেশি ভালোবাসে। যতই দূরে সরে থাকার ভান করুক না কেন এখনো ওর মনের মধ্যে ফাগুনই রাজত্ব করছে। চাইলেও ওর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না সৃজন! নইলে এত রাগ হলো কেন আসাদের ওপর?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here