ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ১১

0
232

ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ১১
অরিত্রিকা আহানা

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সৃজন। কার পাল্লায় পড়েছিলো ফাগুন! এই ছেলের তো ন্যূনতম সম্মানবোধও নেই ফাগুনের প্রতি!

দুপুরে বাড়িতে ফিরে কারো সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বললো না সৃজন। খাওয়া শেষ করে সোজা কারখানায় চলে গেলো। রাতেও একই ঘটনা ঘটলো। খাওয়া শেষ করে চুপচাপ দোতলায় চলে গেলো।

এদিকে ফাগুন সারাদিন অপেক্ষায় ছিলো ওর সঙ্গে নিরিবিলিতে বসে কথা বলার জন্য। অনেকদিন বাদে খালেদ তালুকদারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে ফাগুনের। অভিমান ভুলে বাবার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছে ফাগুন। আগামী মাসে খালেদ তালুকদার ওমরাহ্‌ পালনের জন্য সৌদি আরব যাবেন। যাওয়ার আগে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে যাবেন বলেছেম। এই খবরটাই সৃজনকে জানানোর জন্য সকাল থেকে ব্যাকুল হয়ে ছিলো ফাগুন।

কিন্তু ওর রান্নাঘরের কাজ শেষ হওয়ার পূর্বেই সৃজন খাবার শেষ করে উপরে চলে গেছে। তাই আর কথা বলার কোনো সুযোগ পেলো না। রাতে ঘুম আসছিলো না বিধায় দোতলার বারান্দায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করছিলো। সৃজনের ঘরের দরজা দরজা খোলা। ঘরের ভেতর মৃদু আলো জ্বলছে। সৃজন ভেতরে নেই। ওপাশের বারান্দায় বসে আছে।

ফাগুন বাইরে থেকে একবার উঁকি দিলো। সৃজনের কোনো সাড়াশব্দ হলো না। বেশ কিছুক্ষণ উশখুশ করে শেষে দরজায় টোকা দিলো ফাগুন। সৃজন বারান্দা থেকে পাশ ফিরে চাইলো। এত রাতে ফাগুনকে দেখে অবাক হলেও কিছু বললো না। ফাগুন ভেতরে ঢুকে ইতস্তত করলো। কিছুটা সংকোচ কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

‘আপনার কি শরীর খারাপ?’

সৃজন শান্ত কন্ঠেই জবাব দিলো,’না।’

‘তাহলে এত রাতে বারান্দায় বসে আছেন যে?’

‘এমনি। ঘুম আসছে না।’

ফাগুন জিজ্ঞেস করার মতন আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। সৃজন সামনে না থাকলে সারাদিন কতকথা গুছিয়ে রাখে। কিন্তু সামনে এলে আর মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। খালেদ তালুকদারের আসার কথাটা কীভাবে শুরু করবে সেটাও বুঝতে পারছিলো না। সৃজন ওকে ইতস্তত করতে দেখে বললো,

‘তুমি এতরাত পর্যন্ত জেগে আছো, এখনো ঘুমাও নি কেন?’

‘ঘুম আসছে না।’

ফের দুজনে চুপচাপ। সৃজন অন্ধকারে বাইরের দিকে চাইলো। সকালের ঘটনাটা এখনো ওর মাথার ভেতর চাপ সৃষ্টি করছে। বুকের ভেতরটা অশান্ত হয়ে আছে। বিষণ্ণতা, ক্লান্তি এসে ভর করেছে। ফাগুন আশেপাশে একঝলক তাকিয়ে ফের ইতস্তত করে বললো,

‘আমি আপনার পাশে একটু বসি?’

সৃজন সামান্য হাসলো। সকালের কথাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে বললো,

‘আমার পাশে বসলে যদি তোমার ঘুম আসে তাহলে বসতে পারো।’

ওর কন্ঠে ঠাট্টার সুর। ফাগুন গায়ে মাখলো না। চেয়ার টেনে সৃজনের পাশে বসলো। তাড়াহুড়া করে চেয়ার টানার সময় সেটা উল্টে একবার মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো। সৃজনই সেটা তুলে বারান্দায় এনে দেয়। তারপর ফাগুনকে বসার জন্য ইশারা করে বললো,

‘বসো।’

ফাগুন ভেতরে ভেতরে ভীষণ লজ্জা পেলো। সৃজনের পাশে বসা নিয়ে এতটা উৎসাহ দেখানো ঠিক হয় নি। সৃজন কি ভাবছে কে জানে! মৃদু, লাজুক কন্ঠে বললো,

‘সকালে আব্বা ফোন করেছিলো। আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছেন।’

‘সকালে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেন? কিছু বলেছে? মানে কোনো বিশেষ প্রয়োজন?’

‘তেমন কিছু বলেন নি। শুধু বলেছেন ওমরাহ্‌ করতে যাবেন। তার আগে একবার দেখা করতে আসবেন আমার সঙ্গে।’

‘কবে আসবেন কিছু জানিয়েছেন?’

‘তেমন কিছু বলেন নি। আপনি একবার ফোন করে কথা বলবেন? আব্বা খুশি হবে।’

‘বলবো।’

সৃজনের সম্মতির কথা শুনে ফাগুন খুব খুশি হলো। খুশিতে বেশ কয়েকবার মুগ্ধ চোখে সৃজনের দিকে চাইলো। সৃজন বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে চাইলো। শান্ত কন্ঠে বললো,

‘কালকে আমি খুব ভোরে ভোরে ফুপুকে দেখতে যাবো। ফিরতে দেরীতে হতে পারে। সেইজন্য তোমাকে আগে থেকেই ইনফর্ম করে রাখলাম।

ফাগুনের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। হাসিমুখেই জানতে চাইলো,
‘কখন আসবেন?’

‘সন্ধ্যার আগেই চলে আসবো।’

তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো দুজন। বসে থাকতে থাকতে ঘুমের ঝোঁক এসে গেলো ফাগুনের। হাই তুললো। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার কথা বললো না। চুপচাপ সৃজনের পাশে বসে রইলো। সৃজন সেটা দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিন্তার মাঝখানেও সামান্য হাসি পেলো ওর। গায়ের পাঞ্জাবিটা টেনেটুনে ঠিক করে নিয়ে বললো,

‘চোখ জ্বালাপোড়া করছে। মনে হয় ঘুম আসবে। তুমি কি আরো কিছুক্ষণ বসবে না রুমে যাবে?

সম্বিৎ ফিরে পেলো ফাগুন। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। ঘুম ঘুম আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,

‘না। রুমে যাবো। ঘুম আসছে।’

ফের হাই তুললো ফাগুন। যাবো বলেও বেশকিছুক্ষণ ঢুলুঢুলু করলো। তারপর ধীরেসুস্থে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট করে একটা নিশ্বাস ফেললো সৃজন! ফাগুন ইদানীং ঘরে ঢুকলে যেতে চায় না! বাড়িতে এলেই আশেপাশে ঘুরঘুর করে!

দুদিন পরের ঘটনা,
সৃজনের বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। গরিব দুঃখীদের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সেই উপলক্ষ্যে ফের এই বাড়িতে আগমন ঘটলো সুধার। সৃজনের সঙ্গে যেহেতু ফাগুনের ডিভোর্সের খবরটা চাপা পড়ে গেছে সেহেতু এই বাড়িতে আসতে কোনো বাধা রইলো না সুধার। যদিও দুচারজনের মন্দ কথা এখনো থামে নি। তবে সবাইকে পাত্তা দিয়ে চলার মতন মেয়ে সুধা নয়।

ও আসাতে সৃজনের পরিশ্রম অনেকখানি কমে গেলো। বাইরের কাজ গুলো সৃজন করলেও, ভেতরের কাজ যেমন বাজারের লিস্ট করা, আত্মীয়স্বজনদের আমন্ত্রণ জানানো, রান্নাবান্নার ঝামেলা সব সুধাই সামাল দিলো। এসব নিয়ে সৃজনকে মাথা ঘামাতে হলো না।

ফাগুন দূরে দূরে রইলো। একে তো সে এসব কাজে আনাড়ি তার ওপর সুধা! সৃজনের একান্ত আপনজন! কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। কিন্তু রাগ হলো সৃজনের ওপর! সারাদিনে হাজারবার স্মরণ করে সুধাকে। অথচ মুখ ফুটে একবার ফাগুনকে কাছে ডাকে না।

সুধা কিন্তু ফাগুনের কর্মকাণ্ড গুলো বেশ লক্ষ্য করলো। সংসারের প্রতি উদাসীন মেয়েটার হঠাৎ করেই সৃজনের প্রতি অতিরিক্ত দায়িত্বশীল হয়ে যাওয়া, মুগ্ধ মায়াভরা চোখে সৃজনের দিকে চেয়ে থাকা, সারাক্ষণ সৃজনের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে বসে থাকা এসব কিছুই ওর নজর এড়ালো না। কিন্তু সৃজন যেন কিছুই বুঝতে পারে না। এখনো নিজের সমস্ত প্রয়োজনে সুধাকে ডাকে। ফাগুনের এত আকুলতার বিপরীতে সৃজন যেন একটু বেশিই উদাসীন!
এভাবে তো সংসার চলতে পারে না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া দুদিক থেকে হওয়া চাই। ভালোবাসার উচাটন দুদিকেই থাকতে হবে। দুদিন বাদে এই নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে আলাপে বসলো সে।

সৃজন তখন বারান্দায় বসে বই পড়ছিলো। সুধা ওর জন্য কফি বানিয়ে ওর ঘরে গেলো। কফির দেওয়ার সময় অনুযোগ করে বললো,

‘সারাদিন থাকো বাইরে বাইরে। বাসায় এসে আবার বই নিয়ে বসো। এমন হলে কি করে চলবে?’

সৃজন বই থেকে চোখ সরিয়ে সুধার দিকে চাইলো। কফির মগ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বললো,

‘কেন রে? এত রাতে আবার আমাকে দিয়ে কি কাজ?’

‘সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকলে বুঝবে কি করে কি কাজ? এই যে রোজরোজ তোমার বউ তোমার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকে, যত্ন করে নিজে হাতে খাবার তৈরী করে রাখে, তোমার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তুমি বলার আগে ছুটে আসে সেসব তুমি বোঝো?’

সৃজন হাসলো। যেন ওর আগে থেকেই জানা ছিলো সুধা এই অভিযোগ নিয়ে হাজির হবে! এদিকে ওকে হাসতে দেখে বিরক্ত হলো সুধা। অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,

‘হাসবে না ভাইয়া। আমি হাসার মতন কিছু বলি নি।’

সৃজন হাত ইশারায় কাছে ডাকলো সুধাকে। ইশারায় ওকে পাশে বসার নির্দেশ দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,

‘এতো রাগারাগির মতন কিছু হয় নি। শান্তভাবে আমাকে বল কি হয়েছে? আমর সুন্দরভাবে আলোচনা করি।’

‘কি আলোচনা করবো? তুমি কিছু বোঝা?’

সৃজন ফের হাসলো। বললো,

‘কে বললো বুঝি না?’

‘সত্যিই বোঝো?’

‘সত্যিই বুঝি। তুমি আমার চেয়ে আটবছরের ছোট হয়ে যদি বুঝতে পারিস ও আমাকে ভালোবাসে। তাহলে আমি কেন বুঝবো না? আমি তো ওর চোখের দিকে তাকালে ওর মনের কথা বলে দিতে পারি।’

কথাটা মিথ্যে নয়! সত্যিই ফাগুনের মনের কথা বলে দিতে পারে সৃজন! নইলে সেদিন আসাদের কাছে গর্ব করে ফাগুন সম্পর্কে অতোগুলো কথা বলে দিতে পারতো না।

সুধা এসব জানে না। ওর চোখের সামনে যেটা ধরা পড়েছে ও সেটা নিয়েই কথা বলতে এসেছে। ফের দ্বিধান্বিত কন্ঠে জানতে চাইলো,

‘তাহলে এত কষ্ট দাও কেন? বেচারি সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রাখে।’

‘থাকুক আর কিছুদিন এমন। পাগল সোজা করতে হলে একটু আধটু কষ্ট দিতে হয়। নইলে পাগল সোজা হয় না।’

এবারে সুধা শান্ত হলো। ফাগুন ইতোপূর্বে কি করেছে সেগুলো ওর অজানা নয়। তবুও সৃজনকে একটু বেশিই কঠিন মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে স্ত্রীর ওপর অন্যায় করার মতন মানুষ সৃজন নয়। সময় হলে ঠিক কাছে টেনে নেবে। মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওর। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,

‘আসলে আমি নিজে মেয়ে তো সেইজন্য আরেকটা মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারি নি। এই কয়েকদিন এই বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ‘

সৃজন হাসলো। ওর মাথায় হাত রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,

‘যা ঘরে যা। এসব নিয়ে এত টেনশন করিস না। যার টেনশন করার দরকার সে করুক। তুই আর আমি থাকবো শান্তিতে। আমরা কেন খামোখা টেনশন মাথায় নিয়ে কষ্ট পাবো?’

সুধা হাসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ তারপর?’

‘তারপর আর কি? লাগুক ফাগুনের বুকে আগুন!’

মৃদু শব্দ করে একসঙ্গে হাসলো দুজন। সুধা ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে বললো,

‘যাই তাহলে। তোমার বউয়ের ঘরে গিয়ে একটু আগুন লাগিয়ে আসি। এখনো নিশ্চয়ই বসে বসে তোমার কথা ভাবছে।’
সৃজন মৃদু হেসে সম্মতি জানালো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here