ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ৪
অরিত্রিকা আহানা
দুপুরবেলার সময়টাতে পুরো বাড়ি একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সামান্য গাছের পাতা নড়লেও শব্দ শোনা যায়। অন্যদিন এইসময়ে খাবার খেয়ে বিছানার সঙ্গে গা এলিয়ে দেয় ফাগুন। কিন্তু আজকে নিজের ঘরটা পরিষ্কার করতে করতে সামান্য দেরী হয়ে গেলো। সারাদিন বিশেষ কোনো কাজ থাকে না। তাই সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যেই নিজের ঘর পরিষ্কার করে।
গোসল সেরে সবে খেতে বসেছিলো। কলিং বেলের মৃদু আওয়াজে খাওয়া থামিয়ে ঘড়ির দিকে চাইলো। ঘড়িতে তিনটা পঁয়তাল্লিশ! এইসময়ে যদিও সৃজনের আসার কথা নয় তবুও কান খাড়া করে রইলো ফাগুন। সৃজন হলে খাবার নিয়ে ভেতরে ঘরে চলে যাবে।
অন্যদিন সৃজন আড়াইটার মধ্যেই খাবার খেয়ে করে কারখানায় ফিরে যায়। কিন্তু আজকে এখনো আসে নি। তাহেরাকে গেছে দরজা খুলতে। বসার ঘর থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। ফাগুন টেবিলে বসে থাকা অবস্থাতেই রুমের ভেতর উঁকি দিলো।
সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো! বসার ঘরে আসাদ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো।ফাগুন উত্তেজনা, ভয়ে আতংকে চোখ বড় বড় করে ফেললো। কথা ছিলো সৃজনের সঙ্গে কারখানায় দেখা করতে যাবে আসাদ। কিন্তু সোজা বাড়িতেই চলে এসেছে!
আসাদ ওর কাছে এগিয়ে এসে বললো,
‘কি রান্না করেছো?’
ফাগুন বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘তুমি? তুমি এখানে? আমি কি ভুল দেখছি না তো?
‘তুমি একদম ঠিক দেখছো। তোমার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আসাদ। তোমার অভাগা প্রেমিকপুরুষ।’
ফাগুন আশেপাশে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো। আসাদ এই সময়ে এখানে চলে আসবে ও ভাবতেই পারে নি। ফিসফিস করে বললো,
‘তাহেরা কিছু জিজ্ঞেস করে নি?’
আসাদ বুঝতে পারলো ওর জন্য দরজা খুলে দেওয়া মেয়েটির নাম তাহেরা। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
‘কি জিজ্ঞেস করবে? ভুলে যাচ্ছো কেন তোমার বর আমার আত্মীয়। আত্মীয়র বাড়িতে আমি আসতেই পারি।’
‘না মানে তাহেরা তো তোমাকে চেনে না।’
‘হ্যাঁ। সেইজন্যই প্রথমে গোল গোল চোখ করে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। যেন আমি চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু। তারপর যখন বললাম আমি এই বাড়ির মালিকের আত্মীয়, ভেতরে ঢোকার পারমিশন দিলো।’
ফাগুন চুপ করে রইলো। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না আসাদ ওর সামনে বসে আছে। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় মনে হচ্ছে সব কিছু। আসাদ বাটিতে বেড়ে রাখা খাবারের দিকে লক্ষ্য করে বললো,
‘কি রান্না করেছো? আমি কিন্তু খেয়ে আসি নি।’
ফাগুন নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিলো। কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনায় কথা গুলিয়ে এলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। আসাদ ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
‘কি নিয়ে ভাবছো তুমি? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না আমাকে দেখে খুশি হওয়ার চাইতে বেশি ভয় পাচ্ছো। এত কষ্ট করে এতদূর থেকে তোমার জন্য ছুটে এলাম আর তোমার কোনো রিয়েকশনই নেই।’
ফাগুনের ধ্যান ভাঙ্গলো। কিঞ্চিৎ লজ্জিত গলায় বললো,
‘না মানে, আমি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছি না তুমি আমার সামনে বসে আছো। কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে।’
‘বিশ্বাস না হলে আমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারো। চাইলে দু একটা চুমুও খেতে পারো আমি কিছু মনে করবো না।’
জবাবে ফাগুন সামান্য হাসলেও বিশেষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেলো না। বরঞ্চ কন্ঠস্বরে একরাশ উদ্বেগ ঝরে পড়লো,
‘মজা পরে হবে। তার আগে বলো উনি বাসায় এলে কি বলবো?’
‘সেটা আমি বুঝে নেবো। তুমি তাড়াতাড়ি খাবার সার্ভ করো। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ভেবেছিলাম দুএকটা চুমু খেয়ে পেট ভরাবো কিন্তু তুমি তো পাত্তা দিলে না। চুমু যখন দাও নি তখন ভাত দাও। ভাত খেয়েই খিদে মেটাই।’
আসাদ সত্যি সত্যি ক্ষুধার্ত বুঝয়ে পেরে ফাগুন রান্নাঘর থেকে আরেকটা কাঁচের প্লেট নিয়ে এলো ওকে খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য। আসাদ ওর হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিজেই খাবার বেড়ে নিতে শুরু করলো।
এই ফাঁকে ফাগুন একবার বসার ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে এলো। ভয়ের কারণ নেই। তাহেরা মনোযোগ সহকারে টিভি দেখছে। ডাইনিং এর দিকে বিশেষ খেয়াল নেই। নিঃশব্দে আবার ডাইনিং রুমে ফিরে এলো ফাগুন।
আসাদ খেতে বসেছে। মুরগী মাংসে লবণ বেশি হয়েছে। কিন্তু আসাদ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ফাগুন বেশ কিছুক্ষণ নিরবে চেয়ে রইলো আসাদের দিকে।
বোধহয় ভাবছে আহা! পাগল প্রেমিক!
ভেবেছে ফাগুন রান্না করেছে। তাইতো অতিরিক্ত লবণ দেওয়া তরকারিও অমৃত মনে করে খাচ্ছে। ফাগুনবাটি থেকে আরেক পিস মাংস তুলে দিতে দিতে বললো,
‘খুব মজা হয়েছে না? রান্না তাহেরা করেছে।’
আসাদ খাওয়া থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে ফাগুনের দিকে চেয়ে রইলো। ওর রিয়েকশন দেখে ফাগুন হেসে ফেললো। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
‘কি হলো? এখন আর মজা লাগছে না? লবণ বেশি মনে হচ্ছে?’
জবাবে আসাদও হেসে ফেললো। ওদের হাসাহাসির মাঝেই হঠাৎ ঘরে ঢুকলো সৃজন। বসার ঘরে টিভি চালু থাকায় দরজা খোলার শব্দ শুনতে পায় নি। কিংবা খেয়াল করে নি! অকস্মাৎ মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো ফাগুনের।
দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় এসেছে সৃজন। ডাইনিং টেবিলে ফাগুন আর আসাদকে একসঙ্গে বসা দেখে ওদের মত সেও অবাক হয়ে গেলো। বাসায় এসে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখতে হবে সে ভাবতেই পারে নি!
ফাগুন ইতোমধ্যে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। আসাদও খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বিব্রত মুখে তাকিয়ে আছে। সৃজন যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি নিঃশব্দে উপরের ঘরে চলে গেলো।
রক্ত সরে গেছে ফাগুনের মুখ থেকে! হঠাৎ করেই নিজেকে কেমন ছোট মনে হলো! এই লোকটা হয়ত কোনো প্রতিবাদ করছে না। কিন্তু মনে মনে নিশ্চয়ই খুব খারাপ ভাবছে ফাগুনকে!
★
সৃজন গোসল সেরে নিচে নামলো। তাহেরা ওর খাবারের আয়োজন করছে। বসার ঘর থেকে সেদিকে একবার উঁকি দিলো ফাগুন। লোকটা কোনদিকে না তাকিয়ে কেমন চুপচাপ খেতে বসে গেছে! যেন একটু আগে কিছুই ঘটে নি!
আসাদ বসেছে ওর বিপরীত দিকে সোফায়। এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে ঘরের জিনিসপত্র দেখছিলো। দেখতে দেখতে বললো,
‘একা একা বাড়িতে সারাদিন সময় কাটে কি করে তোমার?’
ফাগুন ডাইনিং থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। আসাদের কথার জবাবে সামান্য হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘সারাদিন শুয়ে বসেই কাটাই। এছাড়া আমার কোনো কাজ নেই।’
‘দমবন্ধ লাগে না?’
ফাগুন ফের অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। এই বাড়িতে ও ভীষণ একা। কথা বলার মানুষ পর্যন্ত নেই! তাহেরা ওকে সহ্য করতে পারে না। দূরে দূরেই থাকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘লাগে। মাঝেমাঝে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।’
আসাদ যেন এমন কিছু শোনার অপেক্ষাতেই ছিলো। বললো,
‘আর কিছুদিন অপেক্ষা করো। এবার তোমাকে এখান থেকে না নিয়ে আমি যাচ্ছি না।’
সৃজন রোজকার মতন চুপচাপ ভাত খাচ্ছে। তাহেরা ওর পাশে দাঁড়িয়ে এটা সেটা বকছে। ফাগুন সেদিকে একঝলক তাকিয়ে বললো,
‘আমার একমুহূর্তও এই বাড়িতে থাকতে মন চায় না।’
আসাদ সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ সংসার নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলো। কি করে নিজের একটা ছোট সংসার সাজাবে এই নিয়ে কথাবার্তা। কিন্তু ফাগুন হু হা জবাব দিলো। একটু আগের ঘটনাটা এখনো মাথা থেকে সরাতে পারে নি সে। আসাদ সেটা বুঝতে পেরে ডাইনিং বসে থাকা সৃজনের দিকে ইশারা করে কিঞ্চিৎ ঠাট্টার সুরে বললো,
‘তোমার বর একা একা খাচ্ছে। যাও তাকে খাইয়ে এসো।’
‘তিনি একা একাই খান।’
‘দেখলেই বোঝা যায় বেরসিক।’
‘বাদ দাও। এখন বলো তুমি উনার সঙ্গে কি কথা বলতে চাও?’
‘তোমার ডিভোর্সের ব্যাপারে আলোচনাটা সেরে ফেলতে চাই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ঝামেলা শেষ করতে হবে। তোমার বাবাকে বিশ্বাস নেই। নইলে দেখা যাবে আমার নামে অপহরণের মামলা দিয়ে বসে আছেন।’
‘কিন্তু ডিভোর্সের কথা বললে বাবা জেনে যাবে না?’
‘জানলে সমস্যা কি। তোমার বাবার বোঝা উচিৎ জোর করে কারো উপরে কিছু চাপিয়ে দিলে সেটার ফলাফল ভালো হয় না।’
নতুন করে শুরুর করতে হলে পুরোনো সম্পর্ক শেষ করতে হবে। কিন্তু ফাগুন আসাদকে এই ব্যাপারে সৃজনের সঙ্গে কথা বলতে দিতে রাজি হলো না। যা বলার ও নিজেই বলবে! আসাদ বললে যদি সৃজন আবার অন্য কিছু মনে করে। বাধা দিয়ে বললো,
‘এই ব্যাপারে উনার সঙ্গে আমি কথা বলবো। তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই।’
‘তুমি ভয় পাচ্ছো কেন ফাগুন?’
‘ভয় পাবো কেন?’
‘সেটাই ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। আমি উনার সঙ্গে কোন অভদ্র আচরণ করবো না। আমি জানি যা হয়েছে তাতে উনার কোনো দোষ নেই।’
ফাগুন চুপ করে রইলো। ও জানে সৃজন ওকে আটকাবে না। কিন্তু তবুও মুখ ফুটে ডিভোর্সের কথা বলা ওর পক্ষে সত্যিই সম্ভব হবে না। ঝামেলাহীন, শান্ত প্রকৃতির লোকটা মুখে কিছু না বললেও তাকে ফাগুনের ভয় হয়! শেষমেশ ভাবলো আসাদই বলুক!