ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ৫
অরিত্রিকা আহানা
দুপুরের খাবার শেষে সৃজন পুনরায় কারখানার জন্য বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আসাদের ডাক শুনে থেমে গেলো। এতক্ষণ বসার ঘরে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলো আসাদ। কাছে গিয়ে সালাম দিলো। ফাগুনও এসেছে পেছন পেছন। আসাদ মৃদু হেসে অতন্ত আন্তরিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছেন ভাইয়া?’
সৃজন সালামের জবাব নিলো। পাশে দাঁড়ানো ফাগুনের উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,
‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘আমিও ভালো আছি। আসলে ভাইয়া আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো। আপনি কি ফ্রি আছেন?’
সৃজন একমুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর সোফার দিকে ইঙ্গিতে করে বললো,
‘এসো।’
আসাদ ওর কথামত সোফায় গিয়ে বসলো। তারপর গলা খাঁকারি কোনো রকম ইতস্তত বোধ না করেই বললো,
‘ফাগুন এবং আমার ব্যাপারে। আমার ধারণা ফাগুন আপনাকে বলেছে। তবুও আমি সবকিছু আবার আপনাকে ক্লিয়ারলি বলতে চাই না।’
সৃজনকে বিশেষ আগ্রহী মনে হলো না। নতুন করে ওদের প্রেমকাহিনী শোনার কোনো ইচ্ছে ওর নেই। তবুও চুপচাপ বসে রইলো। আসাদ আচানক নিজের বসার ভঙ্গি অত্যন্ত বিনয়ী করে নিয়ে বললো,
‘আসলে ভাইয়া আমরা চাইছি যত তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের ঝামেলাটা সেরে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। ফাগুনের বাবাকে তো চেনেনই। রাগী মানুষ। ডিভোর্স এর কথা শুনলে তিনি একটা ঝামেলা ঠিক বাঁধাবেন। আপনি যদি কাইন্ডলি বিষয়টা একটু দেখেন ভাইয়া। তাহলে আমাদের ভীষণ উপকার হয়।’
সৃজন একঝলক চাইলো ফাগুনের দিকে। ফাগুন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ না থেমেই বললো,
‘মিউচুয়ালি হলেও কোনো সমস্যা নেই। তাহলে আপনারও আর কাবিনের টাকা নিয়ে ঝামেলা করতে হলো না?’
টাকার প্রসঙ্গ উঠতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো ফাগুন। বিব্রত হলো। কাবিনের টাকা অনেক আগেই শোধ করে দিয়েছে সৃজন। প্রথম যেদিন কাছে এসেছিলো দুজনে সেদিন। যদিও সেই টাকা ফাগুন নেয় নি। আলমারিতেই পড়ে আছে। তবুও আসাদ কাবিনের টাকার প্রসঙ্গ তোলায় লজ্জা পেলো। অস্বস্তি নিয়ে সৃজনের মুখের দিকে চাইলো। ভেবেছিলো সৃজন নিশ্চয় সত্যিটা বলবে।
কিন্তু সৃজন কিছুই বললো না। যেন টাকার দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে গিয়ে।
সৃজনের বাস্তবিকই এই নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। টাকা যাকে দেওয়ার ও দিয়েছে। সেটা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন বোধ করলো না। চুপচাপ বসে রইলো।
নিজের বক্তব্য শেষে আসাদ স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘আপনার কোনো আপত্তি থাকলে আপনি বলতে পারেন। ‘
আসাদের কথা শেষ হলে সৃজন উঠে দাঁড়ালো। শান্ত গম্ভীর গলায় বললো,
‘উকিলের সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানালেই হবে। আমি সাইন করে দেবো।’
যে চলে যেতে চায় তাকে আটকে রাখার চেষ্টা বৃথা! ফাগুন তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চায়। ওর ধ্যান জ্ঞান পড়ে আছে আসাদের কাছে। সৃজনের সঙ্গে এই অযাচিত সম্পর্কে ও কোনোদিন ভালোবাসা খুঁজে পাবে না। নইলে প্রথম কাছে আসার দিনই সে বুঝতে পারতো কত ভালোবাসায়, যত্নে ওকে সেদিন কাছে টেনে নিয়েছিলো সৃজন। ভালোবাসায় কতটা গভীরভাবে মুড়িয়ে দিয়েছিলো!
সৃজন ঠোঁটের কোনে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে আসাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ঠিক আছে থাকো তাহলে। আমি আসি।’
সৃজন বেরিয়ে গেলো। ফাগুন প্রথমে ভীষণ অবাক হলো। অদ্ভুত রকমের মানুষ! নিজের স্ত্রীকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু পরে মনে হলো যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। এই লোক কোনোদিন ওকে সুখি করতে পারবে না! আসাদ ডিভোর্সের কথা বলে ভালোই করেছে।
সৃজনের জায়গায় আসাদকে কল্পনা করে দেখলো সে। এইপরিস্থিতে আসাদ কখনোই ওকে ছেড়ে চলে যেতে দিতো না। ভালোবাসায়, মায়ায় আগলে রাখার চেষ্টা করতো। আসাদের মুখের তাকিয়ে মনে হলো কোনো ভুল করে নি ও।
এদিকে আসাদ বিস্ময়ে, আনন্দে আত্মহারা! সে এখন বুঝতে পারছে কেন ফাগুন এখনো তাঁকে ভুলতে পারে নি। এমন গোবেচারা, নির্বোধ পুরুষ মানুষের সঙ্গে কোনো মেয়েই থাকতে চাইবে না। মেয়েরা স্বামী হিসেবে ভালোবাসায় যত্নে আগলে রাখার মতন মানুষ চায়। যে তাকে পাওয়ার জন্য সবরকম পাগলামি করবে। আগলে রাখার ক্ষমতা না থাকলে মেয়েদের মন পাওয়া যায় না। মুচকি হেসে ফাগুনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ভালোই হলো কি বলো? অনেকদিন বাদে তোমাকে একা পাওয়া গেছে।’
ফাগুন কি যেন ভাবছিলো। চিন্তা ভঙ্গ হতেই আসাদের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। এই ছেলেটা ওকে পাগলের মতন ভালোবাসে। এখনো ফাগুনকে ফিরে পাওয়ার জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে সে। মুচকি হেসে বললো,
‘চলো তোমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই।’
★
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলো। বস্তুত ফাগুনই এটা ওটা বলছিলো আর আসাদ গল্প করার বাহানায় অপলক ওর দিকে চেয়ে ছিলো। চোখে তার রাজ্যের মায়া! ওকে পলকহীন ভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ফাগুন থমকে গেলো। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কি?’
আসাদ জবাব না দিয়ে হাসলো। ফাগুন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
‘হাসছো কেন? হাসার মতন কিছু বলেছি?’
‘এমনি তোমাকে দেখছিলাম।’
ফাগুন হাসলো। হাঁটতে হাঁটতে বাগানের অন্যদিকে চলে গেলো। পেয়ারা গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে নিয়ে সেটা দোলাতে দোলাতে বললো,
‘এই বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে যতটা ভালো লাগে ভেতর থেকে দেখলে তার চেয়ে বেশি ভয় করে। আমার তো দিনের বেলাতেও ভয় লাগে।’
‘আর রাতের বেলা?’
‘রাতের বেলাতো ভয়ে ঘুমই আসে না। প্রায় দিন লাইট জালিয়ে বসে থাকি।’
আসাদ শব্দ করে হাসলো। বললো,
‘তারমানে রাত জাগার অভ্যেস আছে তোমার? ভবিষ্যতে তাহলে কোনো অসুবিধে হবে না।’
জবাবে ফাগুনও ঠাট্টার সুরে বললো,
‘কেন চোর পাহারা দেওয়াবে নাকি আমাকে দিয়ে?’
আসাদ চট করে ওর কাছে এগিয়ে গেলো। হাতে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,
‘ছাত্রী হিসেবে এখনো ভীষণ কাঁচা তুমি। তোমাকে দেখছি একেবারে হাতে কলমে শেখাতে হবে।’
তারপর আঙুলের ডগায় ফাগুনের মুখটা তুলে ধরলো আসাদ। প্রায় পাঁচমাস পর দুজনের দেখা হওয়ার মুহূর্তটা আরেকটু ঘনিষ্ট করে নিতে চাইলো। ফাগুন চট করে দুপা পিছিয়ে গেলো। ওর চোখে পানি। আসাদ বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘তুমি আমাকে রিফিউজ করলে ফাগুন? আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
ফাগুন ভেজা, অনুতপ্ত গলায় বললো,
‘আমি তোমাকে রিফিউজ করছি না আসাদ। কিন্তু আমি এটাও ভুলতে পারছি না এখনো আমার গায়ে উনার স্ত্রীর তকমাটা লেগে আছে। চাইলেই কারো কাছে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ভ্রষ্টাচারী হলে উনার অসম্মান হবে।’
আসাদ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কিসের ভেতর কি ঘটে গেলো! ফাগুন চাইছে টা কি? পরোক্ষণেই মনে হলো ফাগুনকে এখন বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। স্মিত হেসে বললো,
‘রিলাক্স। এতে কান্না কিছু হয় নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে কোন কিছু নিয়ে জোর করবো না। যা হবে তোমার সম্মতিতেই হবে। তোমার কোনো অসম্মান হোক সেটা আমি কোনোদিন চাইবো না।’
ফাগুন তখন আবেগ আর বিবেকের লড়াইয়ে ভীষণরকমভাবে বিধ্বস্ত। কি করার উচিৎ বুঝতে পারছিলো না। আসাদের স্নেহভরা কন্ঠ শুনে খানিকটা শান্ত হলো। হাসির রেখা ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোনে।