ফাগুন চেয়েছে মন,পর্বঃ৯
অরিত্রিকা আহানা
সৃজনের ঘুম ভাংলো সকালে। পাশের চেয়ারে বসে ওর বুকর ওপর মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে ফাগুন। এলোমেলো চুলগুলো খোঁপা ছাড়িয়ে সৃজনের গলায় বিধে আছে। সৃজন আস্তে করে ওর মাথাটা বালিশে রেখে উঠে বসলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। জ্বর ছাড়লেও শরীরের অবসাদ কাটে নি। ধীরপায়ে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। চট করে ওর হাত চেপে ধরলো ফাগুন। ঘুমঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
ওর মুখে তুমি সম্বোধন শুনে অবাক হলো সৃজন। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। স্মরণ করার চেষ্টা করলো কাল রাতে কি ঘটেছে। সাড়ে আটটার দিকে তাহেরা ফোন করে ছিলো। কথা বলার পর সৃজন জানতে পারলো ওর বাবার অসুখ। গ্রামের বাড়িতে গেছে। ফাগুন বাড়িতে একা। তাড়াহুড়ো করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে গেছিলো সৃজন। ফলাফল স্বরূপ রাতে প্রচণ্ড জ্বর আসে। বাসায় ফিরতেই ফাগুন ওর মাথায় পানি ঢালে, জল পট্টি দেয়। এরপর আর কিছু মনে নেই।
ফাগুনের ঘুমন্ত ঘুমের দিকে ইতস্তত করে বললো,
‘ওয়াশরুমে!’
ফাগুন হাত ছেড়ে দিলো। সৃজন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামলো। তারপর ওয়াশরুমের দিকে গেলো।
ফাগুনের ঘুম ইতোমধ্যে ভেঙ্গে গেছে। ঘুম ভাঙতেই বিছানায় সৃজনকে দেখতে না পেয়ে আশেপাশে চাইলো। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনে বুঝতে পারলো সৃজন ওয়াশরুমে আছে।
দ্রুত নিচে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। রান্নাঘরে ঢুকে আনাড়ি হাতে নাশতা তৈরী করে ফেললো।
সৃজন একেবারে কারখানার জন্য রেডি হয়ে নিচে নেমেছে। ওকে দেখে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো ফাগুন। ইতস্তত করে বললো,
‘নাশতা দিয়েছি টেবিলে।’
সৃজন চুপচাপ টেবিলে গিয়ে বসলো। নাশতার সময় ফাগুন পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। সৃজনের নাশতা শেষ করে উঠে যাবে এমন সময় তড়িঘড়ি করে বললো,
‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
সৃজনকে বিশেষ আগ্রহী দেখালো না। ওর ধারণা পুনরায় ডিভোর্স নিয়ে কোনো আলোচনা করবে ফাগুন। তথাপি পুনরায় বসে পড়লো।
ফাগুনের বড্ড নার্ভাস লাগছে। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘কালরাতে আসাদ এসেছিলো।’
সৃজন চুপচাপ শুনলো। জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো না কখন এসেছিলো আসাদ। ফাগুন নিজে থেকেই বললো,
‘রাতে আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর এসেছিলো। আমি জানতাম না ও আসবে।’
এবার খানিকটা আশ্চর্য হলো সৃজন। ফাগুনের কথার আগাগোড়া কিছুই বোধগম্য হলো মা। ফাগুন তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘না মানে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলো। অন্যরকম কিছু না। আমি কখনো ওর সাথে তেমনভাবে মিশি নি।’
ফাগুনের কন্ঠে কৈফিয়তের সুর। তবুও সৃজনের শুনতে ভালো লাগছে না। চারদিক থেকে এত অসম্মান আর অপমানের পর ওর আর নতুন করে কোনো অপমান সহ্য করার শক্তি ওর নেই। ফাগুন কি কারণে এসব কথা বলছে ও জানে না! অতএব চুপ করে বসে রইলো।
ফাগুন পূর্বের কথার রেশ টেনে বললো,
‘ও আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি যাই নি।’
এবার সরাসরি ফাগুনের মুখের দিকে চাইলো সৃজন। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি। ফাগুনের কথা এখনো বোধগম্য হচ্ছে না ওর। ফাগুন বড় করে দম ফেলে মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে নিলো। শক্তি সঞ্চয় করে বললো,
‘আজকে আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে সব খুলে বলতে চাই। আপনার সঙ্গে আমার এমন এক পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছিলো তখন আমি আপনাকে তো দূরে থাক নিজেকেই ঠিকমত বুঝতে পারি নি। আমার মনে হয়েছিলো বাবা আসাদের ওপর জেদ করে আমাকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। বিয়ের আগে আসাদের সঙ্গে আমার দুইমাসের প্রেম ছিলো। একেবারে নতুন নতুন প্রেম। এর আগে আমি কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে অতো ঘনিষ্ঠভাবে কথাবার্তা বলি নি। তাই ওর প্রতি আবেগটা অনেক বেশি ছিলো। সেইজন্য আপনাকে মন থেকে মেনে নিতে পারি নি। তাছাড়া..’
ফাগুন ফের ইতস্তত করলো। ভেবেছিলো সৃজন জিজ্ঞেস করবে ‘তাছাড়া কি?’ কিন্তু সৃজন কিছুই বললো না। একেবারে চুপচাপ বসে রইলো। ফাগুন বুঝলো ওর সম্পর্কে জানবার কোনো কৌতূহল নেই সৃজনের। তবুও নিজের মনের কথা গুলো খুলের বলার চেষ্টা করলো। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
‘সবাই বলছিলো আপনার বয়স বেশি। এই জন্য আমি কিছুটা অখুশি ছিলাম আপনার প্রতি। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আমি ভুল করেছি।’
ফাগুন থামলো। ভয় হলো এক্ষুণি হয়ত সৃজন মুখ ফুটে বলবে,’ভুল কি করে হলো ফাগুন? এখন নিশ্চয়ই আমার বয়স কমে যায় নি? আমি তো এখনো সেই তেত্রিশ বছরের মানুষটাই আছি।’
তখন ফাগুন কি জবাব দেবে। মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা কি বলতে পারবে? সাহস করে বলতে পারবে এখন আপনাকে ভালোবাসি বলেই আপনার বয়স নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই?
কিন্তু সৃজন তেমন কিছুই বললো না। চুপ করে ফাগুনের কথা শুনলো।
ফাগুনের এবার আরো বেশি অসহায় বোধ করলো। বয়সের কথাটা একদমই বলা উচিৎ হয় নি। এবার হয়ত সৃজন আরো দূরে সরে যাবে। ইতস্ততা ফেলে রেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘আমি আপনার সঙ্গে নতুন করে আবার শুরু করতে চাই।’
সৃজন পূর্ববৎ শান্ত! সঙ্গে সঙ্গেই কোনো জবাব দিলো না। ফাগুনের মত হুট করে কোনো কথা বলে ফেলে পরে সেটা নিয়ে আফসোস করার মতন ছেলে ও নয়। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলো কথা গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। তারপর একেবারে ধীরস্থির ঠান্ডা গলায় বললো,
‘তোমার সঙ্গে আমার ধর্মমতে বৈধ ভাবে বিয়ে হয়েছে। সেই হিসেবে তুমি আমার স্ত্রী। তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। কর্তব্য আছে। তোমাকে আমি অস্বীকার করতে পারবো না। আর করবোও না। তুমি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তুমি এই সংসারে থাকবে তাহলে থাকবে। তোমার সেই অধিকার আছে। আবার তোমার যদি মনে হয় তুমি এই সংসারে থাকবে না, যেমনটা তোমার ইতোপূর্বে মনে হয়েছিলো সেটাও তোমার তোমার ব্যক্তিগত মতামত। আমি তোমার সিদ্ধান্তের ওপর কখনো হস্তক্ষেপ করবো না। সুতরাং এই ব্যাপারে আমার থেকে অনুমতি নেওয়ার কিছু নেই।’
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে দায়িত্ব কর্তব্য ছাড়াও ভালোবাসা নামক একটা বিষয় আছে। সেই ভালোবাসার কথাটা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে সৃজন। সরাসরি ফাগুনকে আঘাত করে কিছু বলে নি। কিন্তু তবুও ফাগুন বুঝে গেছে সৃজন ওকে ভালোবাসবে না এটা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। ফাগুনের প্রতি যা করবে দায়িত্ব আর কর্তব্য বোধ থেকে করবে।
আসাদের ব্যাপারে যেদিন প্রথম সৃজনকে বলেছিলো সেই মুহূর্তটার কথা মনে পড়ে গেলো ফাগুনের। সেদিন রাগে দুঃখে অনেক কঠিন কথাবার্তা বলেছিলো সৃজনকে। অহংকারী মন ঘোষণা দিয়েছিলো সৃজনকে ও মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নেবে না। অথচ আজ সৃজন বুঝিয়ে দিলো আঘাত না করেও কত শান্ত ভাবে কাউকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘আপনি উকিলকে ফোন করে ডিভোর্সের ব্যাপারে নিষেধ করে দিন। আমার ধারণা আসাদ উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপনাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবে।’
সৃজন সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালো। তারপর নাশতার টেবিলে ছেড়ে উঠে গেলো। বাইরে বেরোনো পূর্বে পকেট থেকে একটা চাবির রিং বের করে ফাগুনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘এটা গেটের চাবি। আমি চলে গেলে সাথে সাথে গেটে তালা বন্ধ করে দেবে। আমি না আসা পর্যন্ত খুলবে না। আমি দুপুরের আগেই ফিরে আসবো। না গেলে মাল ডেলিভারি হবে না। নাহলে আজকে অফ দিতাম।’
ফাগুন হাত বাড়িয়ে গেটের চাবিটা নিলো। কিন্তু এই অসুস্থ অবস্থায় সৃজনকে কারখানায় যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না। বাধা দেবেই না কি বলে? আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সৃজন সেটা বুঝতে পেরে বলল,
‘কোনো সমস্যা?’
‘না মানে আজকে কি মাল ডেলিভারি দিতেই হবে? না গেলে হয় না? আপনার শরীর খারাপ? গতকাল রাতে অনেক ভুগেছেন।
‘এখন ঠিক আছি।’
সৃজন সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো। ফাগুনের মনে হলো সুধা থাকলে এই অবস্থায় কিছুতেই সৃজনকে কারখানায় যেতে দিতো না। আর ওর কথা কখনোই ফেলতো না সৃজন। বুকের ভেতর আক্ষেপ ফুটে উঠলো।
ফাগুনের সে ক্ষমতা নেই যে সৃজনকে আটিকাবে। চট করে সামনে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ানোর মত সাহসও নেই। সংকোচ আর দ্বিধাগ্রস্ততা পা টেনে ধরবে।
পুনরায় ইতস্তত করে বললো,
‘একা বাড়িতে আমার ভয় লাগে।’
সৃজন হাটা থামিয়ে ফাগুনের দিকে চাইলো। ফাগুনের চোখেমুখে বিন্দুমাত্রও মিথ্যের আভাস নেই। কথা না বাড়িয়ে ঘরের দিকে ফিরে এলো সে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোজা দোতালায় উঠে গেলো।
ফাগুনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ভাগ্যিস ভয়ের কথাটা মাথায় এসেছিলো!
★
দুপুর বেলা চুপিচুপি সৃজনের ঘরের বাইরে উঁকি দিলো ফাগুন। সৃজন বিছানায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে। পাশের টেবিলের ওপর ওর ল্যাপটপ রাখা। জ্বরের কারণে শরীর দুর্বল ছিলো। তাই কাজ করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছে।
ফাগুন পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকে পড়লো। সৃজনের পিঠের দিকে দাঁড়িয়ে পুরো ঘরটা একবার ভালো মতন পর্যবেক্ষণ করলো।
দেওয়ালে সুধার ছোটবেলার কয়েকটা ছবি টাঙানো। এর আগে যেদিন ফাগুন এইঘরে এসেছিলো সেদিন এই ছবিগুলো খেয়াল করে নি।
একধ্যানে চেয়ে রইলো ছবিগুলোর দিকে। প্রত্যেকটা ছবির মধ্যে বিরাজমান সুধা নামক মেয়েটা অনেক বেশি ভাগ্যবতী। ফাগুনের চাইতে অনেক বেশি জায়গা দখন করে আছে সে সৃজনের জীবনে। সৃজন ওকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসে। এই ভালোবাসায় আহামরি কোনো প্রকাশ নেই, অতিরঞ্জন নেই। তবুও ফাগুন জানে এর চাইতে সুন্দর, পবিত্র, নিখাদ ভালোবাসা আর হয় না।
ফাগুন ঘুমন্ত সৃজনের দিকে চাইলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আমি কোনোদিন আপনার জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারবো না তাই না? আমি জানি। কিন্তু তারপরেও আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।’
সৃজন ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে চাইলো। চোখজোড়া ঈষৎ লাল। ফাগুনকে ওর ঘরে দেখে চমকে উঠলো। ঘুম চোখে রেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলো,
‘কি?’
ফাগুন যেনে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। দুইটা বাজে। ভাত খাবেন না?’
সৃজন কপালে আঙুলে চেপে ধরে উঠে বসলো। ধীরেসুস্থে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চাইলো। তারপর হাই তুলে বললো,’আসছি।’