ফাগুন _এলো_বুঝি #সূচনা পর্ব

0
2829

#ফাগুন _এলো_বুঝি
#সূচনা পর্ব
#লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

ঠিক ভোর ছয়টা পয়তাল্লিশ।ঘুম থেকে তড়াক করে উঠে বসলো পূর্ণতা।দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চোখ কপালে উঠে গেল।হাঁসফাঁস করে বলল,
“এইরে! আজ এত দেড়ি হয়ে গেলো উঠতে? এবার তুই শেষ রে!
তড়িঘড়ি করে খোলা চুল হাত খোপা করে পূর্নতা ওয়াশরুমে ছুটলো।কোনও রকম হাত মুখ ধুয়েই ছুট লাগালো রান্নাঘরে।গায়ের ওড়না কোমড়ে বেঁধে প্রস্তুত হলো নাস্তা বানাতে।
বাড়িটা আহামরি বড় নয়।সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িতে সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন।বাড়ির কর্তা আশরাফুল ইসলাম বেশিরভাগ থাকেন ঢাকার বাইরে।
এছাড়া আর দুজন বাকি পূর্নতা ছাড়া।দুজনের জন্যে দুরকম নাস্তা,জুস এত কম সময়ে বানাতে পূর্নতার হিমশিম খাওয়ার অবস্থাপ্রায়।

ঠিক আটটা নাগাদ সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন সায়রা বেগম।উঁচু কন্ঠে হাঁক পারলেন
“পূর্ণতা!
এক ডাকেই রান্নাঘর থেকে ছুটে বের হলো পূর্ণতা।গরমে ঘামে অস্থির অবস্থা।
‘ডাকছিলে ছোটমা?
সায়রা বেগম ভ্রূ কোঁচকালেন।কর্কশ কন্ঠে বললেন,
‘রুমে চা দিয়ে আসিস নি কেন?আর টেবিল খালি কেন?
পূর্নতা মাথা নিচু করে ফেলল।
– আসলে ছোটমা আজকে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে।
” দেরি হয়েছে মানে?আমি বলেছি তোকে দেরি করে উঠতে?এখন আবার অজুহাত দিচ্ছিস?একটু পর মিশরা বের হবে। কী খেয়ে যাবে ও?
সায়রার গরম চোখ দেখে পূর্নতা ভয়ে ভয়ে বলল,
“আমার বেশি সময় লাগবেনা ছোট মা।
‘তাড়াতা__
কারো পায়ের শব্দে কথা আটকে গেল সায়রার।দুজন এক যোগে ফিরে তাকালো।সূচালো হিল পায়ে পরে হেলেদুলে নিচে নামছে মিশরা।পড়নে লাল টপ্স কালো জিন্স।মিশরা সিড়ির শেষ ধাপে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালো।হেসে বলল,
‘আমাকে কেমন লাগছে মম?বিউটিফুল না?
সায়রার রাগি চেহারাটা নির্নিমেষ পালটে গেল। গমগমে কন্ঠে বললেন,
‘মাশআল্লাহ, কারো নজর না লাগুক আমার মেয়ের ওপর।
মিশরা রাজ্যজয়ী হাসলো ‘
ব্রেকফাস্ট রেডি?
সায়রার হাসিটা নিভে গেল।ঠাঁয় দাঁড়ানো পূর্নতার দিক আগুন চোখ নিক্ষেপ করে বললেন,
-আমাকে জিজ্ঞেস কেনো করছিস? ওই নবাবজাদি কে জিজ্ঞেস কর,সকাল থেকে পরে পরে ঘুমিয়েছে।নাস্তা রেডি হবে কি করে শুনি?

” এখনও হয়নি?Today’s my versity’s first day mom।ভুলে গেলে তুমি?
পূর্নতা নিঁচু কন্ঠে বলল,
“তুমি একটু বোসো। আমার এক্ষুনি হয়ে যাবে।
মিশরা তেঁতে বলল,
” তুই চুপ কর।আমি তোর সাথে কথা বলছিনা।কারণ ছাড়া আমি যার তার সাথে কথা বলিওনা।

পূর্নতার মুখটা চুপসে গেল।সায়রা ধমকে বললেন,
” তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস?যা!
কেঁপে উঠলো পূর্ণতা।এক ছুটে চলে গেল।
মিশরা হাত ঘড়ি দেখে বলল,
‘আমাকে বের হতে হবে মম।সময় নেই।
বাড়ি থেকে ভার্সিটি বেশ দূরে।এখন খেতে গেলে আমার আজ আর পৌঁছানো হবেনা।আর এমনিতেও এই মেয়েটা সময় মত একটা কাজও করে রাখতে পারেনা।আজকাল তোমার ট্রেনিং কম হয়ে যাচ্ছে মম।ওকে আরেকটু টাইট দেয়া উচিত তোমার।আমি বরং ক্যানটিনে খেয়ে নেবো।
আজ ওর জন্যই আমাকে না খেয়ে যেতে হচ্ছে। যত্তসব!
রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো মিশরা।সায়রার একটা কথাও কানে নিলোনা।
মেয়ে না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার রাগ সম্পূর্ন গিয়ে পূর্নতার ওপর পরলো। রেগেমেগে রান্নাঘরে চলে গেলেন সায়রা।পূর্নতা ব্যাস্ত হাতে পরোটা শেকছে।সায়রা হাত বাড়ালেন পূর্ণতার চুলের মুঠি ধরতে।হঠাৎ কিছু একটা মনে করে থেমে গেলেন।ওপরের ঘর গুলোর দিক একবার চোখ বুলিয়ে কিড়মিড় করে চলে গেলেন ঘরে।যেতে যেতে বিড়বিড় করলেন,

“আজ তোর বাবা বাড়িতে আছেন বলেই তুই বেঁচে গেলি।নাহলে আমার মেয়ে না খেয়ে বেরোনোর শাস্তি তোকে আজই দিয়ে দিতাম।

হাতের সব কাজ সেড়ে পূর্ণতা গেলো তৈরি হতে।
আজ ভার্সিটিতে তারও প্রথম দিন। মিশরা আর ও একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।শুধু ভার্সিটিই নয়, স্কুল,কলেজ কোচিং সব এক ছিল।এমনকি দুজনেই ব্যাবসা বিভাগের ছাত্রী।মিশরা আর পূর্নতার বয়স কাছাকাছি হওয়ায় আশরাফ দুজনকেই একসাথে ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে।

পূর্নতা একটা কালো চুড়িদার পরেছে।মাথায় ঘোমটা টেনে কাঁধে ব্যাগ ঝোলালো।তার মুখ কালো।মনেও অন্ধকার। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।সেই ছোটবেলা থেকেই জীবনের বিশেষ দিন গুলোতে বাবা পাশে থাকতেন।আজ নেই।পূর্নতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।নিজের মত ভাবলো ‘আজ বোধ হয় বাবা বেশিই ব্যস্ত।নাহলে ঠিক আসতেন।যেতে যেতে দেয়ালে ঝোলানো মায়ের হাস্যজ্বল ছবিটির দিক চোখ বোলালো পূর্নতা।মাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়না।অথচ সে রোজ ছোঁয় মায়ের স্নিগ্ধ ফর্সা মুখটা।মন দিয়ে ছোঁয়,চোখ দিয়ে ছোঁয়।এই বা কম কীসে?আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন?জীবনের গল্প টা কি অন্যরকম হতো আমার ?পূর্নতা নিজেকেই শুধালো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধ থেকে জামাটা সরিয়ে কালশিটে দাগ গুলো দেখলো।ছুঁয়ে দিলো আলতো হাতে।এগুলো তার ছোট মায়ের ভালোবাসা।যা দীর্ঘদিন ধরে গেঁথে আছে শরীরে।এমন আরো অনেক দাগ আছে।পূর্নতার চোখ দুটো ভিজে উঠলো।জামা ঠিকঠাক করে লম্বা, ক্লান্ত শ্বাস ফেলে ঘর থেকে বের হলো।নিজেকে সান্ত্বনা দিলো ‘সবার জীবন সুখের হয়না’।

বসার ঘরের সোফায় এক ভদ্রলোক বসে।পত্রিকা পড়ছেন তিনি।ওপর থেকে দেখেই চিনে ফেলল পূর্নতা।এতক্ষনের মিইয়ে যাওয়া মুখটা চকচক করে উঠলো।’বাবা’ বলে এক ছুটে সিড়ি বেয়ে নামলো পূর্নতা।ডাক শুনে পত্রিকা থেকে চোখ ওঠালেন আশরাফ।মেয়েকে দেখে বিস্তর হাসি ফুঁটলো ঠোঁটে। উঠে দাঁড়াতেই পূর্নতা এক প্রকার আছড়ে পরলো বুকের ওপর। আশরাফ মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
‘কেমন আছো মামুনি?
পূর্নতা তাকালো,
‘তুম্মি কখন কখন এসছো ববাবা?
আনন্দে কথা জড়িয়ে গেল পূর্নতার।আশরাফ সুন্দর করে হেসে বললেন,
‘ভোরে এসেছি।
পূর্নতা এক প্রকার আর্তনাদ করে উঠলো।
‘ভোরে?আমাকে ডাকোনি কেন তাহলে?আমি আরো কত কী ভেবে ভেবে মন খারাপ করে বসেছিলাম।
‘কী করে ডাকব,তুমি যে ঘুমোচ্ছিলে।আর তারপর আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি।এইতো একটু আগে উঠলাম।

“কিন্তু, তুমিতো বলেছিলে তোমার আসতে অনেক দেরি হবে এবার।অনেক কাজ!
“আমিতো তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে বলেছিলাম।
পূর্নতা ফের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘ আই মিস ইউ বাবা।
আশরাফ পূর্নতার মাথায় চুমু খেলেন
‘মিস ইউ টু মা।

হঠাৎ পূর্নতার কাঁধ ব্যাগ আর বেশভূষার দিক চোখ পরলো আশরাফের।ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘কী ব্যাপার? কোথাও যাচ্ছিলে তুমি?
‘হ্যাতো,আজ আমার ভার্সিটির নবীনবরন বাবা।মনে নেই তোমার?
পূর্ণতার কন্ঠ ভারি উৎফুল্ল শোনালো।সারাদিন একটা ঘরের মধ্যে গুমড়ে থাকা মেয়েটা এই একটা মানুষের কাছে এলেই যেন প্রান ফিরে পায়।উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
আশরাফ জ্বিভ কামড়ালো।একদম ভুলে বসেছিল কথাটা।ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
‘তুমি পাঁচ মিনিট দাড়াও। আমি এক্ষুনি আসছি।
পূর্নতা অবাক কন্ঠে বলল,
‘ তুমি যাবে আমার সাথে?
আশরাফ হাসলেন।পূর্নতার গাল ধরে বললেন,
‘কেন যাবোনা?আমার মেয়েটা আজ এত্ত বড় একটা ধাপে পা দিতে চলেছে জীবনের,আমি সঙ্গে থাকবনা?
পূর্নতা খুশিতে কেঁদে দিল।এই মানুষটার জন্যেই এত দুঃখেও তার আনন্দ আসে।
মেয়ের চোখের পানি দেখে বুক ভার হয়ে এলো আশরাফের।তহমিনা মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটাকে ঠিক ভাবে হাসতেও দেখেনি।নিজের ভালোবাসা,নিজের স্ত্রী হারানোর কষ্ট ভুলতে সেতো পালিয়ে বেড়িয়েছে।কিন্তু মেয়েটা! রাজকন্যার মত মেয়েটার আজ কি অবস্থা?আর সে নিজেও তো কোনও কিছুই মনে রাখতে পারেনা।এই যে আজ তার ছোট্ট প্রিন্সেস এত বড় হয়ে গেল, আঠেরো পেরিয়ে উনিশে পা দিলো।সব তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো সে।তাও মেয়েটা কখনও বিন্দুমাত্র অভিযোগ জানায়নি।হয়ত কোনো দিন জানাবেনা। ভাবতে ভাবতেই রেডি হয়ে নিচে নামলেন আশরাফ।মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে বের হলেন তিনি।ওপর থেকে দেখছিলেন সায়রা।রাগ,ক্ষোভ শিরায় শিরায় ছুটছে তার।
“বাহ আশরাফ বাহ! নিজের মেয়েটাকে নিয়ে বের হলে,কই?মিশরার কথাতো একটাবারও জিজ্ঞেস করলেনা!তফাত শুধু আমিই করিনা আশরাফ। তুমিও চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দাও,মিস্রা আর পূর্নতা তোমার কাছে এক নয়।আলাদা।সায়রা চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গাল অব্দি নামলো।শক্ত চোয়ালে ভাবলেন,
“ঠিক আছে আশরাফ!আমার মেয়ে যদি এত অবহেলা পায়, তোমার মেয়েও শান্তি পাবেনা।
_____
ভার্সিটির ক্যান্টিন বিরাট বড়।মাঝের একটা টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে মিশরা আর ইশিতা।ইশিতার সাথে কলেজ লাইফ থেকেই ওর সখ্যতা।মেয়েটা একদম মিশরার মনের মত।নরম,বোঁকাসোকা।ধমক দিলে চুপ করে থাকে।বামে যেতে বললে বামে যায়।কখনও ভুলেও ওর মুখের ওপর কথা বলেনা।ইশিতা বিরক্ত হয়ে হাতঘড়ি দেখলো।
‘দশটা তো বেজে গেছে মিশু।এখনও অনুষ্ঠান শুরু করছেনা কেন?
মিশরা কাঁধ উচু করে বলল,
“কি জানি!হয়তো কোনও কিছুর জন্য ওয়েট করছে।
ইশিতা মেনে নিল।পরমুহূর্তে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আচ্ছা পূর্ণতা আসবেনা?
মিশরা কপাল কুঁচকে বলল
” ও আসলেই বা কি? আর না আসলেই বা কি?তাছাড়া সকালে যা করেছি না, আজ মা ওকে আস্ত রাখবে বলে মনে হয়না।
মিশরার মুখে টিমটিমে হাসি।

‘আবার কি করেছিস?
“ইচ্ছে করে না খেয়ে এসেছি।আর আমি না খেয়ে বেরিয়েছি, মা কি ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে নাকি? দ্যাখ হয়তো মারের চোটে উঠে দাড়াতেও পারছেনা।
মিশরা হৈ হৈ করে হাসলো।ইশিতার একটুও পছন্দ হলোনা কথাটা।
‘ আজকে এরকম করার কি খুব দরকার ছিলো?
মিশরা সরু চোখে চেয়ে বলল,
” তোর দেখছি ওর ওপর মায়া জাগছে!
ইশিতা আগের থেকেও বিরক্ত হয়ে বলল ‘ বাদ দে।

মিশরার চোখ আচমকা পৌঁছোলো গেইটের দিক। মাত্রই একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়েছে সেখানে।
মিশরা ভীষণ অবাক হলো।
“এটা তো বাবার গাড়ি, বাবার গাড়ি এখানে? এখন?
গাড়ির দরজা খুলে আশরাফ কে নামতে দেখে মিশরার মুখে হাসি ফুঁটল।পরপর অন্য পাশ থেকে পূর্ণতাকে নামতে দেখে হাসিটা দপ করে নিভে গেল।

“অল দ্যা বেস্ট!
আশরাফ পূর্নতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
” থ্যাংকস বাবা।
” এবার তাহলে আমি আসি?আমার আবার দুপুরের দিকে একটা কনফারেন্স আছে।তুমি কিন্তু একদম নার্ভাস হবেনা।ওকে?
পূর্নতা মাথা নাঁড়লো।আশরাফ চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে পূর্ণতার ডাকে থেমে গেলেন।
“কিছু বলবে?
“তুমি আবারও কিছু ভুলে যাচ্ছো বাবা।
আশরাফ ভেবে বললেন ‘ কী বলোতো?
পূর্নতা উশখুশ করে বলল
‘এটা মিশরারও ভার্সিটি।আর আজ ওর ও প্রথম দিন।ওকে শুভেচ্ছা জানাবে না? আদর করবেনা?

আশরাফ মাথায় হাত দিয়ে বললেন
“এইরে! দেখেছ? তোমার বাবা কতটা ভুলোমনা!আচ্ছা ও কোথায় বলোতো? সকাল থেকেই দেখলামনা।

“ওতো অনেক আগেই চলে এসেছে বাবা।একদম সকাল সকাল উঠেছে জানো।হয়তো আশেপাশেই আছে,তুমি দাঁড়াও আমি ওকে খুঁজে আনছি?
আশরাফ বাঁধা দিলেন,
“থাক।তুমি ওকে খুঁজে পেতে পেতে আমার অনেক দেড়ি হয়ে যাবে। তার থেকে আমি বরং ওকে ফোন করে বলি গেটের কাছে চলে আসতে।
পূর্নতা স্বায় দিল,
“আচ্ছা।কল দাও।

ব্যাগের ভেতর ফোনের ভাইব্রেটের শব্দে গেট থেকে চোখ ফেরাল মিশরা।ফোন বের করে স্ক্রিনে বাবার নম্বর দেখে অভিমানটা তীব্র হলো।মিশরা দাঁতে দাঁত চেপে লাইন কেটে দিলো।কল কেন ধরবে?বাবা পূর্নতাকে নিয়ে এসছেন সাথে করে।আর আমি?আমার কথা ভুলে গেলেন?নিজের মেয়ে হলে পারতেন এত অবহেলা করতে?মিশরার চোখ চিকচিক করছে।সে আশরাফের দিক চেয়ে বিড়বিড় করলো,
‘আমি তোমার নিজের কেউ নই।তাই এত অবজ্ঞা তাইনা বাবা?
ইশিতা চুপ করে দেখছিল সবটা।মিশরার কথাগুলো শুনতে না পেলেও চোখে জল দেখে আন্দাজ করেছে।আজ নতুন দেখছেনা মিশরা আর পূর্নতাকে।পূর্নতাকে নিয়ে রেশারেশি মিশরার সময় কাটানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মিশরা লাইন কেটে দেয়ায় আশরাফ ক্ষুন্ন হলেন।কষ্ট পেলেন।পূর্নতাকে ধরা না দিতে মেকি হেসে বললেন,
“ধরলোনা। হয়তো শুনতে পাইনি।চারপাশে এত শব্দ কিভাবেই বা শুনবে?
আমি যাই পূর্না।তুমি আজ রিক্সা করে যেওনা বাড়িতে।বাবা গাড়ি পাঠাব।গাড়ি করে ফিরো।
পূর্নতা ঘাড় কাঁত করলো।
আশরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।পূর্নতার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।আশরাফ যতই কথা কাটানোর চেষ্টা করুক,সে জানে মিসরা হয়ত ইচ্ছে করেই ফোন তোলেনি।এই ঘটনা আজ নতুন নয়।বাবাকে নিয়ে মিশরা তাকে প্রতিপক্ষ ব্যাতীত কিচ্ছু ভাবেনা।পূর্নতা অনেক বার চেয়েছে মিশরাকে বোঝাতে, কিন্তু ভয়ে কখনও মিশরার ধারেকাছে ঘেষার সাহস হয়নি তার।ওইজন্যেই সুপ্ত একপাক্ষিক যুদ্ধ টা আজও চলছে।হয়ত সারাজীবন চলবে।পূর্নতা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে খুব করে চাইলো,
‘এই যুদ্ধ শেষ হোক।বাবা মা দুজনেই তাদের দুবোনের হোক।কবে আসবে সেই দিন?আদৌ আসবেতো!
__
বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো পূর্নতা।কাঁপা হাত পা নিয়ে ভার্সিটির ভেতর এগোলো। আশরাফ নার্ভাস না হতে বললেও তার নার্ভাসনেস থামছেনা।পূর্ণতা গোটা ভার্সিটিতে একবার চোখ বোলায়।এত্ত বড় একটা জায়গায় মাত্র দুজন মানুষ তার পরিচিত।একজন মিশরা আর অন্যজন রুপ।তার সব থেকে ভালো বন্ধু।পূর্ণতা এদিক ওদিক তাকালো।রুপ কী এসছে?নাকি লেট লতিফটা আজকেও দেরি করবে?

হঠাৎ কিছু একটাতে হোচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পরতে নিয়েও কোনও রকমে নিজেকে সামলালো পূর্ণতা।সামনে তাকাতেই দেখলো বুকের সাথে দু হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে মিশরা।পাশেই কাচুমাচু চেহারায় দাড়িয়ে ইশিতা।মিশরার যেঁচে পরে পূর্ণতাকে জ্বালানোর ব্যাপার গুলো একদম ভালো লাগেনা তার।মুখচোরা স্বভাবের দরুন কিছু বলতেও পারেনা।
পূর্নতা মিশরাকে দেখেই বুঝলো আসলে কীসে বেঁধে পরতে যাচ্ছিলো।নির্ঘাত এই মেয়ে ইচ্ছে করে পা বাড়িয়ে দিয়েছে।আশেপাশ দেখার উৎসুকতায় পূর্নতা খেয়াল করবেনা ভেবেই।পূর্নতা মনে মনে স্বস্তি পেল। ভাগ্যিস! নিজেকে সামলে নিয়েছিলো।এত গুলো মানুষের মধ্যে পড়ে গেলে হয়তো মিশরা অনেক মজা পেত কিন্তু তার মান ইজ্জ্বত ধুয়ে যেত।পূর্নতা ভুলে গেল ওসব।একটু আগের ঘটনা মনে করে উদ্বেগ নিয়ে বলল,

” মিশু কই ছিলে তুমি?বাবা তোমা__
মিশরা আটকে দিয়ে বলল,
“এই, তোকে না কতবার বলেছি,তুই আমাকে মিশু বলে ডাকবিনা?তোর সাহস দেখি অনেক বেড়ে যাচ্ছে আজকাল।
মিশরার ঝাঝালো কন্ঠ।পূর্নতা চুপ করে গেল।মিশরা একদম কাছে এসে দাঁড়ালো।কটমট করে বলল,
“খুব আদর খাওয়া হচ্ছিলো তাইনা!আর তুই জানতিস যে বাবা আসবে?মম জানলে আমিও জানতে পারতাম।তার মানে আমি যখন জানিনা, মমও নিশ্চয়ই জানতোনা।বাহ! কি বুদ্ধিরে তোর!সবটাই আমাদের থেকে লুকিয়ে গেলি?যাতে বাবা আসলেই আমাদের নামে আগেভাগে কান ভাঙানো যায়?
পূর্নতা ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
“না না তুমি ভুল ভাবছো,আমি নিজেও__

“চুপ কর!তোকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি। তুই কি ভেবেছিস? বাবা আসাতে বেঁচে যাবি?হাহ! বাবাতো আজ বাদে কাল আবার চলে যাবে।আর এই ভার্সিটিতে যদি তোর সাথে আমি কিছু করিও বাবার কানে দেয়ার মত কেউ নেই।কি হবে বলতো এবার?কে বাঁচাবে তোকে?কেউ না। তোর জীবন হারাম করতে এই মিশরাই যথেস্ট।
কথা শেষ করে পূর্নতাকে ধাক্কা মেরে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো মিশরা।গটগট করে হেটে গেল।পূর্নতার দিক অসহায় চোখে চেয়ে চেয়ে পিছু নিলো ইশিতা।
মিশরার যাওয়ার পথে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো পূর্ণতা।মিশরা তাকে কতটা অপছন্দ করে সে জানে।অথচ কষ্ট হয়।ভীষণ কষ্ট।কারণ টা তার নিজেরও অজানা।পূর্নতা আঙুল দিয়ে চোখের পানি টুকু মুছে নেয়।এগুলো তার ছোট বেলার সঙ্গী। হয়ত বাকি জীবনেও থাকবে।
___
কোন দিকে যাবো আমি?কাউকে চিনিওনা। আর যাদের চিনি তাদের দেখতেও পাচ্ছিনা।ওদিকটায় যাবো? গিয়েই দেখি।
একা একা বিড়বিড় করে ডান দিকে হাটা দিলো পূর্নতা।পেছন থেকে হঠাৎই ওড়নাটা টেনে ধরলো কেউ।পূর্নতার পা দুটো থমকে গেল।আসঙ্কায় বুক ঢিপঢিপ শুরু হলো।
পূর্ণতা শুকনো ঢোক গিলল।প্রথমেই মাথায় এলো সিনিয়রদের র‍্যাগিংয়ের কথা।
পূর্নতার কপালে ঘাম জমলো
“এখন যদি আমি র‍্যাগিং এর খপ্পরে পরি? কি করবো তবে? এমনিতেই আমি যা ভীতু!দেখা যাবে ভয়ে হার্টঅ্যাটাক করে ফেলেছি!তখন কি হবে? র‍্যাগিং এর ভয়ে একটি মেয়ের মৃত্যূ হবে শেষ মেষ?
পূর্নতা ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো।চমকে উঠলো সাথে সাথে।ওড়নার মাথাটা ধরে দাড়িয়ে আছে একটা ছেলে।ঠিক দাঁড়িয়ে নয়।ছেলেটার ঘড়িতে তার ওড়নার সুতো আটকে গিয়েছে।আর ছেলেটা সেই সুতো ছাড়াতে ব্যাস্ত।কার ওড়না কিভাবে আটকে পড়লো, সেসব জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই।ছেলেটিকে একবার পা থেকে মাথা অবধি দেখলো পূর্ণতা।অতীব সুদর্শন খেতাবটি হয়তো একেই দেয়া উচিত!পূর্নতার মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো
‘কি কিউট!

তার ভালো লাগা টুকুন চট করে উবে গেল ছেলেটির কথা কানে আসায়।
সে মহাবিরক্ত।
” উফ! আজ এমনিতেই I’m late! আর তার ওপরে এই উটকো ঝামেলা!সামলাতেই যখন পারেনা তো পরতে যায় কেনো?
সুতো ছাড়াতে ছাড়াতে আওড়ালো ধ্রুব।সুতোতো এক বিন্দু ছাড়াতে পারছেনা উলটে আরো পেঁচিয়ে যাচ্ছে।যদি পারতো পুরো ওড়না কুচিকুচি করে কেটে ফেলতে শান্তি মিলতো তবে।

“আমাকে দিন, আমি ছাড়িয়ে নিচ্ছি।
মৃদূ মেয়েলি একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।ধ্রুব থেমে গিয়ে সামনে তাকালো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here