#ফাগুন_আমায়_ভালবাসেনা,পর্ব-১,০২,০৩,০৪
এমি
০১
কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যাবে বলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল তিতির। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখল বড়খালা রেহানা বেগম গাড়ী থেকে নামছেন। বড় খালাকে দেখেই সে একটু মিইয়ে গেল। এখনি কিনা কি লেকচার শুরু হবে আল্লাহ জানে। তাই দরজা খুলে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে রইল সে। খালা বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন, কিরে ধিঙ্গি মেয়ে, শাড়ী পরে নায়িকা হয়ে কোথায় ছুটলি?
তিতির ধীরে ধীরে বলল,
-কলেজে অনুষ্ঠান আছে খালা।
-তুই জানিস না আমি এসব পছন্দ করি না, তারপরেও কথা শুনিসনা কেন? তোর মা কোথায় মাকে ডাক দে। আমার অনেক কাজ আছে। তোদের নিয় আর পারা যায় না।
তিতলি মা কে ডাকতে রান্না ঘরের দিকে ছোটে। পুরোনো দিনের বাড়ী তাই রান্না ঘরটা উঠানের উ্ল্টা দিকে। মাকে ডেকে দিয়ে সে বাড়ীর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর যাই হোক বড় খালার সামনে পড়া চলবে না।
রেহানা তখন খাবার টেবিলের চেয়ার টেনে বসেছেন। তিতিরের মা ঘরে ঢুকেই বড় বোনকে সালাম করেন।
-এই সব আদব কায়দা মেয়েকে তো কিছু শেখাস নাই। সারাদিন শুধু ধিঙ্গিপনা। যাক যেই কথা বলতে আসা তিতিরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই কিন্তু আমি মাহমুদের সাথে এর বিয়েটা দিয়ে দেব। তাই মেয়েকে এখন থেকেই একটু লাগাম দে। আর ঘরের কাজ কিছু শেখা। মাহমুদ তো আর বউ ছেড়ে একা থাকবে না।
-কিন্তু আপা তিতির তো এই বিষয়ে কিছু জানে না আর ওর বাবাও কি এত তাড়াতাড়ি বিয়েতে রাজি হবে? এখনও তো ও অনেক ছোট। আর তুমি অনেক আগে এমন বলেছিলে কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম তুমি এমনিতেই বলেছ।
-কি সব বলিস হাসনা, তোর সাথে কি আমার ঠাট্টা মসকরার সম্পর্ক। এমন একটা বিষয় নিয়ে আমি তোর সাথে মজা করবো। তুই তোর পরিবারের সবার সাথে কথা বলে আমাকে জানাবি। আর যা এখন চা করে আন। চা খেয়ে বিদায় নেই।
হাসনা চিন্তিত মুখে রান্না ঘরের দিকে এগুতে থাকেন। অবশ্যই মাহমুদ ভাল ছেলে। সেনাবাহিনীতে সে বেশ মেধাবী অফিসার বলেই পরিচিত কিন্তু তিতির তো কিছুতেই রাজি হবে না, ছোট থেকে নিজ ভাই বোনের মত বড় হয়েছে, কি করে যে আপাকে বোঝাবে। খাবার ঘর থেকে আপার ডাক শুনতে পায়।
-কিরে হাসনা এক কার চা আনতে তো দেখি সারা দিন লাগিয়ে ফেললি। তিতির কই গেল। ডাক দে তো।
হাসনা ফুলির মাকে বলে,
-তিতির কই ডাক। বল বড় খালা ডাকে।
-আম্মা আপাতো পেছনের দরজা দিয়ে বাহির হইয়া গেছে।
হাসনা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন, এখন না আবার কি কথা শুনতে হয়। মেয়েটাও এমন অবুঝ। একটু পরে বাহির হলে কি ক্ষতি হত।
তিনি চা নিয়ে বোনের সামনে এসে বসলেন।
-তিতির কই?
-আপা তিতির তো কলেজে চলে গেছে। ওদের তো আজ অনুষ্ঠান। কিছু বলবে ওকে?
-কি আর বলব বল, একি শহরে থাকি তবু তোদের কোন খোঁজ পাই না। ফোনটাও নষ্ট হয়ে আছে। তোদের কত করে বলি একটা মোবাইল ফোন কেনার জন্য । কিছুই তে শুনিস না । তিতিরকে আমার বাসায় পাঠিয়ে দিস। ইভানার জন্য নতুন মাস্টার রেখেছি। দুই বোন এক সাথে পড়বে। প্রতিদিন বিকাল পাঁচটায় আসবে। ওকে যেতে বলিস। মাস্টারকে দুই জনকে পড়াতে হবে এটাই বলা আছে। আর জানিস তো আমার কথার এদিক সেদিক হলে আমার মেজাজ কতটা খারাপ হয়।
-আপা ইভানা তো ক্লাস টেনে মাত্র। ওরা এক সাথে কি পড়বে। আমি বরং তিতির কে জিজ্ঞেস করে তোমাকে জানাবো।
-তোর কি মাথা খারাপ হাসনা? রেহানা বেগম ঝংকার দিয়ে ওঠেন। কাল থেকে তিতিরকে পাঠাবি। পাঁচটায় মনে থাকে যেন।
রেহেনা বেগম চেয়ার ছেড়ে ওঠেন। দরজার কাছে এসে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, আর শোন কাল মাহমুদ ও পনেরো দিনের ছুটিতে বাড়ি আসবে। তাই তিতিরকে একটু ভাল কাপড় পরে পাঠাবি। কি সব যে পরে ঘোরে মেয়েটা। মনে হয় গরিব ঘরের মেয়ে।
বড় আপা যাবার পর হাসনা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসেন।কি করবেন তিনি এখন। তিতিরের বাবাকেও এই বিষয়ে কখনও কিছু জানানো হয় নাই। আর মেয়ে এই কথা শুনলে কি কুরুক্ষেত্র বানাবে?
তিতিরের বাবা মোস্তফা সাহেব অফিস থেকে ফিরেই টেলিভিশন খুলে বসেন। হাসনা চা নাস্তা নিয়ে এসে বসলো তার পাশে। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার খবরে মনোনিবেশ করলেন। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। মেয়েটা এখনও বাড়ি ফেরেনি।
-তুমি একটু তিতিরের কলেজে যাও। অনেকক্ষন তো হয়ে গেল। এখনও ফিরছে না।
মোস্তফা সাহেব একটু বিরক্ত হন। তারপরেও ওঠেন। দিনকাল ঠিক ভালো না। তিনি কাপড় পরে কলেজের দিকে হাটতে থাকেন। কিছুটা এগুতেই দেখেন তিতির আর তার বন্ধুরা গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরছে। ছোট শহর, আর কলেজটাও তো বেশি দূরে নয়। যাক কষ্ট করে আর যেতে হলো না। তিনি তিতিরকে নিয়ে বাসার দিকে হাঁটত থাকেন।
২.
-কি হয়েছে বলো তো? সন্ধ্যা থেকে দেখছি মনমরা হয়ে আছ?
হাসনা একটা জামায় এমব্রয়ডারির কাজ করছিলেন। তিতিরের বাবার কথা শুনে সেগুলো গুটিয়ে রাখলেন। এখন বলা কি ঠিক হবে? তিনি বুঝতে পারছেন না।
-তেমন কিছু না, পরে বলবো। তুমি বিশ্রাম নাও। আমি যাই দেখি তিতিরের সাথে একটু কথা বলে আসি।
মেয়ের ঘরে ঢুকতেই দেখেন তিতির বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে।
-কি মা? তোমার মন খারাপ নাকি? নিশ্চই বড় খালা উল্টা পাল্টা কিছু বলেছেন। তোমার বোন পারেও মা। এমন আজব মহিলা আমি আমার বাবার জন্মেও দেখি নাই। সারাক্ষন কটকট কর বেড়ান।
তিতিরের বলার ধরনে হাসনা হাসেন।
-তোকে কাল থেকে এ বাড়িতে যেতে হবে। ইভানার জন্য মাস্টার ঠিক করেছে তোর খালা। তার কাছে তুইও পড়বি। বিকাল পাঁচটায়।
তিতির চট করে উঠে বসে।
-তুমি কি পাগল হলে মা। আমার কি সময় আছে। বিকালটা একটু ফ্রি থাকি। আর খালা আমাকে কেন ইভানার সাথে জুটিয়েছে তুমি জান না? ওনার মেয়েকে পাহারা দেবার জন্য। আমি পারবো না। তুমি মানা করে দাও।
-পাগলামি করলে হবে তিতির। তোর খালা রাগ করবে। কয়েকদিন যা, তারপর নাহয় কোন কারন দেখিয়ে মানা করে দেব। তুই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আমি ফুলির মাকে বলছি তোকে খাবার দিতে।
তিতিরের মেজাজ পুরাই খাপ্পা হয়ে গেল। মানুষ খালি নিজেরটা বোঝে। অন্যেরও যে মতামত থাকতে পারে তার কোন খেয়ালি নেই। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে এসে। সে শুয়ে পড়ে।
মোস্তফা সাহেব প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হাসনা পাশে এসে বসলেন।
-কি গো তিতিরের বাবা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
-নাহ বল কি ব্যাপার। বিকাল থেকেই তো দেখছি মুখ ছোট করে ঘুরছো, নিশ্চই কোনো সমস্যা হয়েছে।
-সমস্যা কিনা বুঝতে পারছি না। বড় আপা এসেছিলেন। মাহমুদ এর সাথে তিতিরের বিয়ে দিতে চান। কি বলবো বলো তো?
-কি বলো এসব? মাহমুদ অবশ্যই ভালো ছেলে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিতিরের কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?
-বড় আপা আমাকে আগেও দুই একবার এই কথা বলেছিলেন কিন্তু আমি তো ভেবেছি মজা করেছেন। মানা করে দিলে তো আপার সাথে সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
-এক্ষুনি কিছু বলার দরকার নেই। তিতিরের পরীক্ষার এখনো তো বেশ কিছুদিন বাকি। চিন্তা ভাবনা করতে দাও। আর তিতিরকে কিছু জানাবার দরকার নেই।
-দেখো তুমি ভেবে। আমারতো এই চিন্তায় ঘুমও হবে না ঠিক মত।
মশারী টানিয়ে তিনি তিতিরের ঘরে গেলেন মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। মশারীটা ঠিক করে আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। একটা মাত্র সন্তান তাদের। মাহমুদের সাথে বিয়ে হলে নিশ্চই ভালই থাকবে। মাহমুদ তো তার ছেলের মতই। কিন্তু বড় আপা যে কড়া? মেয়েটা কি পারবে মানিয়ে নিতে? শত চিন্তা মাথায় নিয়ে তিনি ঘুমাতে গেলেন।
৩.
-কিরে তিতির এখনো রেডি হলি না? তোর খালা তো রাগ করবে।
কলেজ থেকে ফিরে কেবল মাত্র খাওয়া দাওয়া করে সে একটু বিছানায় গা টা এলিয়ে দিয়েছিল। মায়ের চিৎকারে মেজাজটা আরো খারাপ হল। একে তো সারাদিন পর এই সময়টা একটু বিশ্রাম করে। সেটাও সহ্য হচ্ছে না যেন। তিতির চুপ করে থাকে। মা এসে বিছানায় বসেন।
-ওঠ মা। তোর খালা রাগ করবে। আর একটু ভালো কাপড় পরে যা।
-কেন ? পড়তে যাচ্ছি নাকি পাত্রী দেখতে আসবে কেউ। কি যে যন্ত্রনা কর না তোমরা।
তিতির উঠে পড়ে। গায়ের রংটা শ্যামলা হলেও দেখতে সে বেশ ভালো, আর সাজলে তাকে পরীর মতই লাগে। সাদা একটা সালোয়ার কামিজের সাথে আকাশ নীল একটা ওড়না পরলো সে। ছোট্ট একটা সাদা টিপ আর চোখে কাজল। একটা সোয়েটার পরে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-দেখ ঠিক আছে কিনা। পরে আবার কিছু বোলোনা।
-সাদা পরলি? আচ্ছা যা, খারাপ লাগছে না দেখতে। রাত করিস না।
তিতির বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিক্সা খোঁজে। ঘড়ির দিকে তাকায়। চারটা পয়তাল্লিশ, যেতে অবশ্য দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। কিন্তু তবুও খালার কচকচানি শুনতে তার ভালো লাগে না। রিক্সায় উঠে তাই হুড তুলে দেয় সে।
খালার বাসার গেট দিঁযে ঢুকেই সে চমকায়। লনে চেয়ার পেতে মাহমুদ ভাইয়া আর একজন কেউ বসা। পেছন ফিরে আছে বলে মুখ দেখতে পেল না। তাকে দেখে মাহমুদ হাত ইশারায় ডাকে। তিতির ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। মাহমুদ ভাইয়াকে তার খুব বিরক্ত লাগে। সব সময় পিচ্চি পিচ্চি বলে এমন ভাব করে। নিজে না জানি কত বড়। লোকটা এমন কেন? বাইরের একজন আছে বলে সে চুপচাপ সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
-কিরে কি খবর তোর? পিচ্চি তো দেখি বড় হয়ে গেছিস।
সে মনে মনে ভাবে এই লোকটা যে কি বাইরের একজন মানুষের সামনেও পিচ্চি বলা লাগে। রাগে গা জ্বলে যায়। চুপ করে রাগটা হজম করে।
-কি রে চুপ কেন? পরিচয় করিয়ে দেই, এই আমার বন্ধু অয়ন। আমার সাথে ঘুরতে এসেছে।
তিতির চোখ তুলে তাকায়। ছেলে মানুষ এত সুন্দর হয় নাকি? মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। অয়নের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় সে।
-কিরে পিচ্চি তোর তো দেখি কথা বন্ধ। অয়ন এ আমার ছোট খালার মেয়ে তিতির।
-হ্যালো তিতির। পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।
– আমিও|
বলেই সে হেসে ফেলল। ইভানা দৌড়ে এল তখনই। এসেই তাকে ভেতরে টেনে নিয়ে এল।
-আপু তুমি ওদের সাথে বাইরে দাড়িয়ে কথা বলছ। মা দেখলে খুব রাগ করবে। এমনিতেই মা খুব রেগে আছে।
-কেন কি হয়েছে এত রাগের?
-আরে ভাইয়া না জানিয়ে বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। সে নাকি এক সপ্তাহ থাকবে। আর তাতেই মায়ের মেজাজ তুঙ্গে। তুমি কিন্তু সাবধানে কথা বোলো। তর্ক কোরো না কোন।
-তোর মাস্টার আসে নাই?
ইভানা মাথা নেড়ে না বলে।
-তাহলে চল যাই খালার সাথে দেখা করে আসি।
রেহানা বেগম বিকালের নাস্তা বানানো নিয়ে ব্যাস্ত। তিতিরকে ভালো করে দেখলেন।
-এত দেরি করলি কেন?
-কেন খালা মাস্টার মশাই তো এখনও আসেন নাই।
-তোর কি সব সময় ফাজলামি করতে ভালো লাগে। আমি কি তোর বান্ধবী। যা দুই জনে ঘরে গিয়ে পড়তে বোস। আর ঐ ছেলের সামনে বেশি যাবার দরকার নেই?
-কোন ছেলে খালা?
-আহা, এলেন আমার পটের রানী। যেন কিছুই বোঝেন না। মাহমুদের বন্ধু। ঐ যে অয়ন না কি যেন নাম। যা এখন এখান থেকে। দুজনে মিলে পড়। মাস্টার তো দেখি প্রথম দিনেই দেরি করতেছে। আসলে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিতির আর ইভানা পড়ার ঘরে বসে।
-আপু ভাইয়ার বন্ধুটা সেই রকম দেখতে না? আর সেই রকম স্মার্ট। আমি তো দেখেই ফিদা।
-ইভানা বই নিয়ে বস তো। খালা বকা দিবেন।
মাস্টার মশাই দেরিতে আসায় পড়া শেষ হতে দেরি হয়ে গেল। খালার কাছে বিদায় নিতে যেয়ে শোনে খালা মাগরিবের নামাত পড়তে বসেছেন। তিতির একটু অপেক্ষা করে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। একা একা যেতে তার একটু ভয় করবে। রেহানা বেগম নামায় শেষে ইভানার ঘরে এলেন।
-খালা আমি যাই। অন্ধকার হয়ে গেছে। মা চিন্তা করবে।
-একা কি যাবি? মাহমুদ এই মাহমুদ তিতিরকে বাসায় দিয়ে আয় তো। এই সন্ধ্যায় মেয়েটা একা যাবে নাকি?
-না খালা আমি একা যেতে পারবো। ভাইয়াকে লাগবে না।
-তুই চুপ কর। বরাবরই সব বেশি বুঝিস।
মাহমুদ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
-তুমি যাও মা, আমি ওকে দিয়ে আসবো। এই অয়ন চল। বাইরে থেকে হেটে আসি।
অয়ন আসার আগেই রেহানা বেগম তার ঘরে চলে যান। এমন বয়সি ছেলেকে কেউ হুট করে বাড়িতে আনে। কে বোঝাবে এই ছেলেকে। ঘরে একটা বোন আছে তো? কিছু বলতেও পারছেন না ছেলেকে।
৪.
নভেম্বরের শেষের দিক। এবার বেশ ভালো ঠান্ডা পড়েছে। তিতির এর গায়ে শুধু একটা পাতলা সোয়েটার। মাফলার বা টুপিতও আনেনি সে। তার আবার ঠান্ডার ধাত। একটু ঠান্ডা লাগলেই গলা ব্যাথা জ্বর। সে ওড়নাটা দিয়ে কান আর গলা ঢাকার চেষ্টা করে। কুয়াশাও অনেক আজ। রাস্তার আলো আর কুয়াশা মিলে অপার্থিব সৌন্দর্য।
-কিরে পিচ্চি হেটে যাবি না রিক্সায়? নাকি গাড়ি বের করবো?
-মাথা খারাপ নাকি? আমি তো আর তোমার মত বড়লোক নই। হেটে যাই চলো।
-বাহ্ ভালোই তো খোঁটা দিয়ে দিলি। চল তাহলে তোকে দিয়ে আমি আর অয়ন রিক্সা করে কিছুক্ষন ঘুরবো। তুই ঘুরবি আমাদের সাথে?
-নাহ ভাইয়া। মা রাজি হবে না। অন্য কোনো একদিন যাবেনি।
মনে মনে ভাবে আমাকে কি পাগল কুকুরে কামড় দিল যে তোমার সাথে যাব।
-কি রে পিচ্চি তোর তো আবার ঠান্ডার ধাত। কুয়াশা তো ভালই পড়ছে। গায়ে তো গরম কাপড় বলতে একটা সোয়েটার। দেখিস আবার জ্বরটর বাধাস না। মা কিন্তু তখন আমায় বকবে।
অয়ন চারপাশ দেখছিল মনোযোগ দিয়ে। মফস্বল শহর, শীতের রাত বলেই তেমন লোক নেই। হঠাৎ করেই বললল,
-সুন্দর একটা নাম থাকতে কি পিচ্চি পিচ্চি বলিস? এই তিতির তোমার রাগ লাগে না।
কি সুন্দর করেই না কথা বলে লোকটা।
-ভাইয়া তো আমাকে খুব বেশি ভালবাসে তাই পিচ্চি বলে। তাই না ভাইয়া।
-তুই একটা গাট্টা খাবি পিচ্চি। তোকে তো কোলে পিঠে বড় করলাম। ছোট বেলায় কতবার পি করেছিস আমার গায়ে। এখন নাকি বড় হয়েছে।
তিতিরের মুখটা লজ্জায় নীল হয়ে যায়। বাকি পথ আর তেমন কথা হয় না কারো। তাকে তাই বাসায় দিয়ে ওরা চলে গেল। সে রাগে আর লজ্জায় ওদের বাসাতেও আসতে বলল না। বাসায় ঢুকেই দেখলো মা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে।
-তোকে কতবার করে বললাম দেরি করিস না? সেই দেরি করে এলি?
-কি করব মা। মাস্টার যে দেরি করে এলো। তবে মাহমুদ ভাইয়া এগিয়ে দিয়ে গেল বাসা পর্যন্ত।
-তুই কি রে? ছেলেটা এতদূরে এলো। তুই বাসায় নিয়ে আসলি না? তোর এই বুদ্ধিটুকু কবে হবে?
– আমার কি এত ঠ্যাকা পড়ছে ডেকে আনার। যার ইচ্ছা হয় সে নিজে আসবে। আমি ওসব পারবো না।
ধুপধাপ করে সে ঘরে চলে এল। হাতমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসল।
-ফুলির মা…..এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।
টেবিলের উপর দুহাত রেখে সে মাথা রাখে। মাথায় হিম পড়েছে বলেই মাথা ব্যাথা শুরু হল মনে হয়। জ্বর আসলেই এখন ষোলো কলা পূর্ণ হয়। চোখ বন্ধ করতেই অয়নের ছবি ভেসে ওঠে। কত সুন্দর করে কথা বলে, আর কি ছিমছাম চেহারা। চোখ দুটোতে মায়ার সাগর। কে হবে তার মায়াবতী?
-আপা চা নেন। ঘুমাইলেন নাকি? আম্মায় কইলাম রাগ করবো। পড়া রাইখা ঘুমাইতেছেন।
-তুমি যাও তো ফুলির মা। খুব বেশী কথা বলো।
চায়ে চুমুক দিতেই চা পুরা বিস্বাদ লাগে। গাটাও কেমন কেঁপে ওঠে। চা টা রেখে বিছানায় শুয়ে সে কম্বলটা টেনে নেয়।
চলবে…