ফাগুন_এলো_বুঝি,১০,১১

0
1245

#ফাগুন_এলো_বুঝি,১০,১১

(১০)

“আমাকে চিনতে পেরেছো?
ধীর আগাগোড়া নিরীক্ষন করল নীরব দৃষ্টিতে।মেরুন টপ্স পরিহিতা মিশরাকে তখন চোখ ধাঁধানো সুন্দরী লাগছে।ধীর মৃদূ হেসে বলল
‘মিশু তাইতো!
‘কারেক্ট!
‘কেমন আছিস?
‘দরজায় দাঁড়িয়ে বলব?ভেতরে যেতে দেবেনা?
ধীর দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো ‘আয়।
মিশরা ঢুকল।ধীর মাথা উঁচু করে দরজার ওপাশটা দেখছে।পূর্নতাকে খুঁজছে এক কথায়।সেলিনা বলেছিলেন সবাই একসাথে আসবে,তাহলে একজন একজন করে এলো কেন?আর পূর্নাই বা কোথায়?ভাবুক ধীর চমকে উঠলো একদম সামনে সায়রাকে দেখে।সায়রা মাত্রই এসে ঢুকলেন।ধীর কে দেখে হেসে বললেন,
‘তুই ধীর না?
ধীর পা ছুঁয়ে সালাম করলো।সোজা হয়ে বলল,
‘হ্যা।কেমন আছো ফুপি?
সায়রা ধীরের কপালে চুঁমু খেলেন।চোখ রাতারাতি ভিজে উঠল।বোজা কন্ঠেই বললেন,
‘তোদের ছাড়া কেমন আর ছিলাম।তবে এখন ভালো আছি।
ধীর হেসে ফুপির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল
‘ এখন আমরা সবাই একসাথে আছিনা?আমাদের ভালো থাকা আটকাবে কে?
তখন মিশরা বাড়ির চারপাশ তাকাতে তাকাতে বলল,
‘মম দেখেছ,মামুনিদের বাড়িটা এখনও একইরকম আছে।কোনো জিনিসপত্রের ও নড়চড় হয়নি।মামুনি কীভাবে এত যত্নে রাখে এসব?
সেলিনা রান্নাঘর থেকে একরকম ছুটে বের হলেন ওদের গলা শুনে।
‘এসে গেছ তোমরা?আমিতো অপেক্ষা করতে করতে শেষ।
মিশরা এগিয়ে গিয়ে বলল ‘কেমন আছো মামুনি?
‘ভালো আছি মা।পূর্ণতা কোথায়?
মিশরার হাসি কমে গেল।ধীর খুশি হলো।এই প্রশ্নটা করার জন্যে জ্বিভ তখন থেকে নিশপিশ করছিল।মা করে বাঁচিয়ে দিলেন ।
‘এইতো আমি।
পূর্ণতার রিনরিনে কন্ঠস্বর।সোজা যেন বুকে বিঁধল ধীরের।বাকিদের সঙ্গে সঙ্গে সেও এক যোগে তাকাল।দরজায় দাঁড়ানো পূর্নতাকে এক ঝলক দেখতেই হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠল কেমন।ধীর যত্র চোখ নামিয়ে ফেলল।কি আশ্চর্য! এতক্ষন ধরে যাকে দেখার ইচ্ছে হলো তার দিকে কেন তাকাতে পারছেনা এখন?
পূর্ণতা গিয়ে সেলিনাকে জড়িয়ে ধরল।
সেলিনার খুশিটা এবার যেন প্রসস্থ হয়েছে।মিশরা খেয়াল করল।কষ্ট পেল খুব।মামুনি তার নিজের মামুনি হয়েও পূর্নতাকে কেন এত আদর করেন?ভালোবাসেন?

সেলিনা পূর্ণতার থুতনী ধরে বললেন
‘মাশআল্লাহ! একদম লাল পরি লাগছে।
মিশরার কথায় সাদা জামা পালটে লাল পরেছিল পূর্ণতা।মিশরা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আর আমাকে?
সেলিনা বললেন ‘ তুইতো সব সময়ই সুন্দর।
ব্যাস!মিশরা খুশিতে আটখানা হয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।
‘ভাইজান কোথায়?
‘বেরিয়েছে একটু।চলে আসবে।তুমি বোসো সায়রা।বাইরে যা রোদ একটু ঠান্ডা শরবত খেলে ভালো লাগবে।
পূর্ণতা জিজ্ঞেস করলো,
‘মামুনি ধীর ভাইয়া বাড়িতে নেই?

এক কোনায় দাঁড়ানো ধীরের মন জুড়িয়ে গেল।পূর্না তাকে খুঁজছে!ভালোবেসেই খুঁজছে।আবার হাসিও পেল।মেয়েটা মামুনিকে পেয়েই এত খুশি,এই গোটা তাকে খেয়ালই করেনি!
সেলিনা ইশারা করে বললেন ‘ ওইতো ধীর।
পূর্ণতা পেছন ঘুরে তাকালো।দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল তখন।ধীরের বুকটা এফোড় ওফোড় করে দিল পূর্ণতার সরল সুন্দর চোখদুটি।মিশরা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘তুই কি অন্ধ?ধীর ভাইয়াতো এতক্ষন এখানেই দাঁড়িয়ে আছে,দেখতে পাসনি?
ধীর মুখ কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।এই মেয়ের স্বভাব এখনও পাল্টায়নি নাকি?পূর্ণতা ওসব গায়ে মাখলোনা।উত্তরও দিলোনা।খুশিতে সে ছুটে গিয়ে ধীরের বুকে ঝাপিয়ে পরলো।ধীর প্রচন্ড হকচকালো।পূর্ণতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় দ্রিম দ্রিম করে তান্ডব করছে বুকটা।এক্ষুনি ছিড়ে যাবে হয়ত।পূর্ণতা মাথা তুলে তাকালো।চোখে জল।বাচ্চাদের মত করে বলল,
‘আই মিসড ইউ ধীর ভাইয়া!
ধীরের বিস্ময়ের মাত্রা তখনও কাটেনি।ছোট্ট পূর্ণতা তার পায়েপায়ে ঘুরতো।কারন সেলিনার পর ধীরই সব থেকে বেশি আদর করত ওকে।পূর্ণতাকে মারধর,বা ধমকানোর জন্যে মিশরা ওর হাতে কত যে মার খেয়েছে হিসেব নেই। কিন্তু বড় হয়েও পূর্ণতা যে ধীরের সঙ্গে এত সহজ ভাবে মিশবে ধীর ভাবেনি।পূর্ণা তাহলে ভোলেনি আমাকে?ভুলবে কেন?ওতো আমাকে ভালোবাসে।
এরকমই তো হওয়ার কথা।পূর্ণতা তার কাছে আসবে না তো কার কাছে আসবে?সংকোচ কাটিয়ে ধীর হাত রাখলো পূর্নতার বাহুতে।কন্ঠরোধ হয়ে আসছে কথা বলতে।খুব নিঁচু কন্ঠে বলল

‘আই মিসড ইউ ঠু!

কথাটুকু মিস করা অব্দিই সীমাবদ্ধ ছিলনা।পেছনে ফেলে আসা অতীতের প্রত্যেকটা প্রহর জানে ধীর পূর্ণতার শোকে কি পাগলামিই না করেছে।যে পাগলামির সাক্ষী তার ঘরের দেয়াল,আসবাব, বিছানার কোমল বালিশ।

পূর্ণতা হেসে ভ্রু উঁচিয়ে বলল ‘ তুমি কী এখনও স্লো আছো ভাইয়া?নাকি একটু ফাস্ট হয়েছ।
পূর্ণতার চোখে জল, অথচ ঠোঁট দুটো হাসছে।গালের পাশে জেগে উঠেছে সুন্দর টোলটাও।ধীর উত্তর ভুলে চেয়ে রইল।
‘কী হলো?
‘হু?না হইনি।হলে তুই স্লো ভাইয়া বলবি কি করে?
পূর্ণতা খিলখিল করে হেসে উঠল।মিশরা বিরক্তির শীষ টেনে সেন্টার টেবিল থেকে ম্যাগাজিন নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল।এদের নাটক দেখতে অসহ্য লাগে তার।সাথে অসহ্য লাগে ধীর,পূর্ণতা দুটোকেই।ছোট বেলায় এই ধীর কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছিল গালে।তাও পূর্ণতাকে ঠেলে ফেলে দেয়ার জন্যে। সেই থেকেই ধীর হয়ে উঠল তার চক্ষুশূল। সায়রা সেলিনার পিছন পিছন রান্নাঘরে ছুটলেন।ধীর পূর্ণতাকে সোফা ইশারা করে বলল
” আয় বসি।
পূর্ণতা মাথা ঝাঁকায়।খুলে বসে এত বছরে জমিয়ে রাখা কথার ঝুড়িটা।স্কুল কলেজ,কোচিং সব কিছুর গল্প মেলে ধরে ধীরের কাছে।ধীর তার ডায়েরি। ছোট থেকেই।ধীর সোফায় হেলান দিয়ে পূর্ণতার দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছে সেসব।
সত্যিই তার সেই ছোট্ট পূর্ণা কত বড় হয়ে গিয়েছে।কিন্তু গালের সেই টোল পড়া হাসি?
হাসিটা আজও এক রকম।একইরকম আছে পূর্নতার কথা বলার ভঙি।ধীর মনে মনে বলল
‘সারাজীবন এইভাবে তোর কথা শুনতে চাই পূর্না।শোনাবি তো?
এরই মধ্যে ফল,মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন আশরাফ, মেহবুক একসাথে।বাড়ির গেটেই দেখা হলো দুজনের।খোশগল্প করতে করতে হাজির হলেন তারা।ধীর উঠে গিয়ে তাকেও সালাম করলো।

‘থাক বাবা।বেঁচে থাক।কেমন আছ?
‘আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল!আপনি?
‘এইতো চলে যাচ্ছে।
সেলিনা হাতে করে বড় একটা ট্রে আনলেন।তার ওপর সাজানো হরেক রকম নাস্তা।সায়রাও বসেছে এসে।
আশরাফ ঠান্ডা শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে স্বস্তি পেলেন খানিক।বাইরে আসলেই প্রচন্ড গরম।গলার টাই ঢিলে করলেন।বাবার গরম লাগছে বুঝতে পেরে মিশরা এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল।
আশরাফ বুঝলেন।মিশরার দিক হেসে তাকাতেই মিশরা চোখ সরিয়ে সেলিনাকে শুধাল
‘ ধ্রুব ভাইয়া কোথায় মামুনি?এসে থেকে তো দেখলাম না।
সায়রা বললেন,
‘ওরকি এখনো ঘরের মধ্যে বসে থাকা স্বভাবটা আছে ভাবি?নাকি আমাদের ধীরের মত মিশুকে হয়েছে।
সেলিনা দুই ভুরু উঁচিয়ে বললেন,
‘ধীরকে মিশুকে বলছো সায়রা?ওকি করে তুমিতো জানোনা।ছোট বেলায় ধ্রুব যেমন একা একা থাকতে পছন্দ করতো এখন এটা হয়েছে সেরকম।আর মিশবে কী,বাড়িতে থাকে দুদন্ড?আজ তো আমাদের কপাল ভালো জনাবের ম্যাচ ফ্যাচ ক্যান্সেল হয়েছে।নাহলে একে হাতে পাওয়া মানে চাঁদ হাতে পাওয়া।

পূর্ণতা আপেলের টুকরো মুখে দিতে দিতে বলল,
‘আজ তোমার ম্যাচ ক্যন্সেল হয়েছে ভাইয়া?ওনারাও কী টের পেয়েছেন আমরা আসছি?আমাদের জন্যেই কি বিশেষ ছাড় দিল?
ধীর মুচকি হেসে নিচের দিক তাকালো।নিজে নিজে আওড়াল ‘এই ছাড় শুধু তোর জন্যে পূর্ণা।
মিশরা একই প্রশ্ন আবার করল। ধ্রুব কোথায়?সেলিনা বললেন
‘সে এসে থেকে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
‘আমি গিয়ে উঠিয়ে দেই?
‘যাবি?যা।
মিশরা দ্রুত উঠে গেল ওপরে।পূর্ণতা খাচ্ছে মন দিয়ে।আশরাফের পাশে বসেছে সে।ধীর বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে পূর্ণতার দিক।পূর্ণতা তাকালেই আবার চোখ নামিয়ে ফেলছে।
পূর্ণতা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল
‘আচ্ছা মামুনি,তোমাদের ছাদে দুটো পাখি ছিলনা?ধীর ভাইয়া পুষতো?আছে ওরা?
‘না। ওদের ধীর সেই কবেই ছেড়ে দিয়েছে।

‘ছেড়ে দিয়েছে?কেন ছেড়েছ ভাইয়া?ওগুলোতো পোষা পাখি।ওরাতো বন জঙ্গলে থাকতে পারেনা।ওভাবেই ওদের পুষতে হয়।
ধীর জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল
‘ হাত থেকে হুট করে ছুটে গিয়েছিলো ।
মনে মনে বলল ‘ পাখিদুটোও আমাকে জ্বালাতো খুব।ওদের দেখলে তোর কথা আরো বেশি করে মনে পড়তো আমার।তুই সারাক্ষন ওদুটোকে নিয়ে খেলতিস।ওদের সাথে বকবক করতিস।তাই ছেড়ে দিয়েছি।

সেলিনা পরপর বললেন ‘ কিন্তু ধ্রুব নতুন করে আবার দুটো পাখি এনেছে রে পূর্ণতা।নাম রেখেছে দুষ্টু-মিষ্টি।যা দেখে আয়।

পূর্ণতা লাফিয়ে উঠল ‘ তাই?এক্ষুনি যাচ্ছি।
যেতে নিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে বলল ‘ কিন্তু তোমার ছোট ছেলে আবার কিছু বলবে নাতো?
‘ও আবার কি বলবে?তুমি যাও।
মেহবুব বললেন।পূর্ণতা খুশি হয়ে ছুট লাগালো।
এদিকে মুখ অন্ধকার হয়ে এলো ধীরের।পূর্নতার পেছনে যেতে ইচ্ছে করছে।পাছে কে কি ভেবে বসে চিন্তা করে উঠতে পারলোনা।কেউ হয়ত কিছু মনে করতোনা,কিন্তু ওই যে ধীরের অনুভূতি ভীন্ন,তাই সব জড়োতা এসে চেপে ধরেছে তাকে।কেউ যখন কাউকে ভালোবাসে তখন তার আশেপাশে থেকে কথা বলতে গেলেও সংকোচ হয়,ভয় করে এই বুঝি কেউ কিছু ভেবে বসলো।বুঝে ফেলল তার মনের কথা।ধীরেরও হয়েছে তাই।যেতে না পেরে অসহায় হয়ে বসে রইল সে।
পূর্ণতা যখন উঠছে মিশরা তখনই নেমে এসে বলল,
‘ভাইয়াতো রুমে নেই মামুনি।
‘তাহলে গেল কোথায়?

সন্ধ্যে নামার পর সিড়ির লাইট গুলো জ্বালানো হয়নি আজ।ঘর থেকে যতটুকু আলো আসে আবছা বোঝা যায়।এখনো অত অন্ধকার নামেনি।পূর্ণতা হৈহৈ করে উঠছিল।হঠাৎ ছাদের দরজা দিয়ে কেউ বের হতেই আকষ্কিক ধাক্কা লাগলো দুজনের।ঘটনাটার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিলনা।পূর্ণতা টাল না সামলাতে পেরে চিৎ হয়ে পরতে নিল।ওপাশের ব্যাক্তিটি ধড়ফড় করে সরু কোমড় চেপে ধরল তার।বাঁচার চেষ্টায় পূর্নতাও শক্ত হাতে খাঁমচে ধরলো আগন্তুকের পড়নের পোশাক।মোটা টিশার্ট হওয়ায় আজ আর নখ বিঁধলোনা।পূর্ণতা ভয় পেয়েছে।আরেকটু হলেই সিড়ি গড়িয়ে পরে হাত পা ভাঙত।ভীত শ্বাস ফেলে সামনের মানুষটার দিক তাকালো।মুখ হা হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ধ্রুব!
ধ্রুবও স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে।
দুজনের কেউই বুঝে উঠছেনা অপর পাশের মানুষের এই উপস্থিতির যথাযথ কারন।
ধ্রুব বিস্মিত কন্ঠে বলল ‘ তুমি?
পূর্ণতা বলল ‘ আপনি?
হঠাৎ খেয়াল পরলো ধ্রুবর গায়ে লেপ্টে আছে সে।পূর্ণতা তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়াল।

ধ্রুব নিঁচের ঠোঁট কামড়ে ধরে চেয়ে আছে।চোখ দুটো ছোট ছোট।ঘুম থেকে উঠে ছাদে এসেছিল।মিশরাদের দেখেছে ঢুকতে।সাথে দেখেছে পূর্ণতাকেও।কিন্তু শিওর ছিল এটা হ্যালুসিনেশন। কারন পূর্ণতা এখানে আসার কোনো চান্স নেই।নেই মানে এক ফোঁটাও নেই।এই হ্যালুসিনেশনে অভ্যেস ছিল তার।পূর্ণতার প্রতি মন হারানোর পর থেকেইতো মেয়েটাকে কল্পনায় দেখছিল।তাই আর পাত্তা দেয়নি।উলটে বিরক্ত হয়ে ছাদেই বসে ছিল।ভাবল অনুভূতিটা একটু সামলে আসুক,তারপর নিচে গিয়ে ফুপিদের সঙ্গে দেখা করবে।কিন্তু এই মেয়ে এখানেও?একি সত্যি?নাকি এটাও__
ধ্রুব সন্দেহ কাটতে শুধালো,
‘তুমি কি আসল?

পূর্ণতা তাকালো। বুঝতে না পেরে বলল ‘ নকল কীভাবে হব?
ধ্রুবর ভুরু টানটান হয়ে আসে।কথা বলেছে।এর মানে মায়াপরি সত্যিই এখানে?
ধ্রুব এক পা এগিয়ে এলো পূর্নতার দিক।পূর্নতা লেগে গেল দেয়ালের সাথে।ধ্রুব ওর মাথার পাশে এক হাত রেখে বলল,
‘প্রথম দিন আমার ঘড়িতে ওড়না আটকেছে তোমার,কাল ওভাবে এসে আমার বুকের ওপর পরলে।আজ আবার ধাক্কা খেয়েছ আমার সাথে। কেন?বাই এনি চান্স আমার প্রেমে পড়োনিতো?
পূর্ণতা ঠোঁট ফাকা করে তাকালো।ধ্রুব ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘কি?পড়েছ?
পূর্ণতা দুদিকে মাথা নাড়ল।পরেনি।ধ্রুবর মুখ চুপসে গেল এই কথায়।মেয়েটা মুখের ওপর বলে দিল পরেনি?
ভ্রু কুঁচকে বলল
‘তাহলে ধাক্কা খেয়েছ কেন?
পূর্ণতা অসহায় কন্ঠে বলল
‘আমিতো ইচ্ছে করে ধাক্কা দেইনি।হঠাৎ __
‘হঠাৎ?হঠাৎ শুধু আমার বেলায়?কেন?
‘আপনি বোধ হয় রেগে যাচ্ছেন।
ধ্রুব হাসলো,
‘এত নরম কোমল কন্ঠস্বর শুনলে রাগ আসেনা মায়াপরি। প্রেম আসে।
পূর্ণতা থমকে গেল কথাটায়।ধ্রুব নিশ্চল চোখে চেয়ে আছে।
‘আপপনারর,আপনার ককোথাও ভভুল হচ্ছে।আমি মমায়াপরী নই,আমার নাম পপূর্ণতা!
পূর্ণতার গলা কাঁপছে।ধ্রুব এত কাছে এসে দাড়িয়েছে কেন?
ধ্রুব তার কাঁপুনি বাড়াতে মুখটাকে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল,
“সবার জন্যে যে পূর্ণতা।আমার জন্যে সে’ মায়াপরি’। আমার মায়াপরি।

পূর্ণতার শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো।ধ্রুবর গরম নিঃশ্বাস চোখে মুখে পরছে।হাঁসফাঁস করে নিচু কন্ঠে বলল
‘আপনি একটু সরে দাঁড়ান।প্লিজ!

ধ্রুব ঠোঁট চেপে হেসে সরে এলো।পূর্ণতা বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে একটু ধাতস্থ করল নিজেকে।জীবনে প্রথমবার কোনো ছেলের এত সংস্পর্শে আসছে বলেই কী এরকম হচ্ছে?এ কেমন যন্ত্রনা!
ধ্রুব এর মধ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘তুমি এখানে কী করে এলে মায়াপরি?
পূর্ণতা তাকালো।আবার চোখ নামিয়ে নিল সাথে সাথে।

“এটা আমার ছোট মায়ের ভাইয়ের বাড়ি।
ধ্রুব চোখ ছোট করল ‘ কে ছোট মা?
‘আপনার ছোট ফুপি।
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল ‘ তুমি আশরাফ আঙ্কেলের মেয়ে?মানে তুমিই সেই পূর্ণতা,যে বল মেরে আমার শোপিস ভেঙে দিয়েছিল?

পূর্ণতার মুখ একটুখানি হয়ে এল।এখানে এসে ধ্রুবকে দেখেই সে বুঝে ফেলেছে সেই ধ্রুব আর এই ধ্রুব একইলোক।ধ্রুব যখন গভীর ভাবে ভাবছিল,যে এটা সত্যিকারের পূর্ণতা কীনা!পূর্ণতা তখন বিস্ময় নিয়ে ধ্রুবর দিক চেয়েছিল।তার কল্পনার ধ্রুবর সাথে এর বিন্দুমাত্র মিল নেই।কল্পনার ধ্রুবর চেহারা কোথায়,আর এ?এতো আস্ত একটা চকলেট।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে একটুও কষ্ট হয়নি পূর্ণতার।ভেবেছিল,ধ্রুব নিশ্চয়ই ছোট বেলার মত নেই আর।অথচ এই ছেলে তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই পুরনো কথা তুলল।
পূর্ণতা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল
‘আমিতো ইচ্ছে করে করি__

ধ্রুব কথা আটকে দিল,
‘তুমিতো কোনো কিছুই ইচ্ছে করে করোনা মায়াপরি।সব হয়ে যায় ভুল করে তাইনা?
পূর্ণতা মাথা নাড়ল।ধ্রুব আস্তে করে বলল,
‘ভুল করে তাহলে তোমার মন টাও দিয়ে ফেল আমায়।

পূর্ণতা অবাক চোখে তাকাতেই ধ্রুব ঝকঝকে দাঁত বার করে নিষ্পাপ হাসল।পূর্ণতা বিশ্বাস করতে পারলনা সে ঠিক শুনল কীনা!ধ্রুব কী ফাজলামো করছে তার সঙ্গে? এগুলো ঠিক কোন ধরনের ফাজলামোর মধ্যে পরে?
মিহি কন্ঠে বলল,
‘আপনার কথা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে ভাইয়া।
ধ্রুব মুখ থেকে চ বর্গীয় শব্দ করল।
আহত কন্ঠে বলল,
‘উফ!ভাইয়া ডেকোনা তো!তোমার মুখে ভাইয়া ডাক শুনলেই আমার অস্বস্তি হয়।অন্য কিছু ডাকো।
পূর্ণতা বোঁকা বোঁকা কন্ঠে বলল,
‘কি ডাকব তাহলে?

‘যা খুশি।এক্সেপ্ট ‘ভাইয়া।
ধ্রুবর কন্ঠ সিরিয়াস।
পূর্ণতা ভাবতে বসল।ধ্রুব মিশরার মামাতো ভাই।তাহলেতো ভাইয়াই হলো।তবে কেন ডাকবেনা?ভাইয়া না ডাকলে কী ডাকবে?
পূর্ণতা চিন্তামগ্ন যখন,হুট করে ধ্রুব আবার কাছে চলে এলো।পূর্ণতা ভঁড়কে লেগে গেল দেয়ালের সাথে।ধ্রুব অবিচল চোখে চেয়ে নিরেট কন্ঠে আওড়াল,

“আমার কাছে মায়া মানেই তুমি।
প্রতিরাতে স্বপ্নে আমি তোমায় ধরি,
যে স্বপ্নে আলতা পায়ে হেঁটে বেড়াও
আমার ‘মায়াপরি।
ধরতে গেলে পালিয়ে যাও।
ভাইয়া ডেকে ব্যাথা দাও।
এত নিষ্ঠুর না হয়ে একটু ভাবোতো
যে মায়ার কেন্দ্রবিন্দুতে তোমার বিচরন,
তখন সেটাকে কী বলবে,
প্রেম?

পূর্ণতা বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল।ধ্রুব আর দাঁড়ালোনা।সিড়ি বেয়ে নেঁচে নেমে গেল।পেছনে রেখে গেল বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে থাকা পূর্ণতা আর তার ধুকপুক কাঁপতে থাকা হৃদয় খানা।

চলবে,

#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(১১)
ধ্রুব বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেবল।চেহারা ঝলমলে।খুশির ছাপ স্পষ্ট।পূর্ণতা মিশরার বোন শুনে আনন্দে লাফাতে মন চাইছে।মেঘ না চাইতে জল,ঠিক এরকমটাই হলো।তাহলে এখন থেকে পূর্ণতা এ বাড়িতে যাতায়াত করবে!অথবা সেও বিভিন্ন ছুঁতোয় চলে যাবে পূর্নতাদের বাড়ি।ভার্সিটিতে গিয়েই তাহলে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশে আর উঁকিঝুঁকি দিতে হবেনা মায়াপরিকে দেখতে।কিংবা ক্লাস শেষে মাঠের কোনায়ও দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা।খুশিতে আটখানা ধ্রুবর ধ্যান ভাঙলো মিশরার আওয়াজে।

“কোথায় ছিলে তুমি ধ্রুব ভাইয়া?রুমে গিয়ে খুঁজে এসেছি আমি।
ধ্রুব ছোট করে বলল ‘ ছাদে।

এরপর এসে সায়রা আর আশরাফের পা ছুঁয়ে সালাম করলো।সায়রা অবাক কন্ঠে বললেন,
‘এটা কি আমাদের ধ্রুব?
‘কেমন আছো ফুপি?
“আমি ভালো আছি বাবা।তোকেতো চেনাই যাচ্ছেনা।ছোট বেলার মুখের আদল এখন একদম ভিন্ন।রাজপূত্রের মত হয়েছিস।

পাশ থেকে মিশরা বলল
‘ তাই জন্যেতো আমার চিনতে সময় লেগেছে মম।ধ্রুব ভাইয়া আগে কত রোগাশোকা ছিল,এখন দেখেছ,জিম করে বডি কি বানিয়েছে?
ধ্রুব খানিক লজ্জ্বা পেল বড়দের সামনে।মিশরার মাথায় চাটি মেরে বলল,
‘চুপ থাক নির্বোধ।
‘আউ,ব্যাথা পেয়েছি।
মিশরা মাথা ডলতে ডলতে ধীরের দিক তাকায়।ধীরকে এখন একটা রোবট মনে হচ্ছে।যে নড়ছেনা,হাসছেনা, কথা বলছেনা।তবে বারবার ওপর দিকে তাকাচ্ছে।মিশরা ভ্রু কোঁচকালো।ধীরের চোখ অনুসরন করে সেদিক তাকালো।ধীর সিড়ির দিক চেয়ে আছে। মিশরার মনে হলো ধীর পূর্ণতার জন্যেই চেয়ে আছে ওদিকটায়।
‘তাহলে কী এদের মধ্যে কিছু চলছে?

” ধ্রুব! এসো আমার পাশে বোসো।
আশরাফের পাশে গিয়ে বসলো ধ্রুব।
‘কি করছো এখন?
‘ এম-বি-এ করছি আঙ্কেল।
‘বাহ!আমাদের পূর্ণতা,মিশরা ওদেরও একই ডিপার্টমেন্ট তাহলে!
‘জী।
‘ওদের একটু দেখে রেখ বাবা।তুমি থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।
ধ্রুব মৃদূ হেসে বলল ‘ রাখব আঙ্কেল।
লম্বা শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল ‘ আপনি নিশ্চিন্তই থাকুন আঙ্কেল।আপনার পূর্ণতাকে শুধু দেখে রাখা কেন? প্রয়োজনে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখব।
_____
পূর্ণতা পিলপিল পায়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো। শরীরটা এখনো কাঁপছে।কানের কাছে অবিরাম বাজছে ধ্রুবর শেষ কথাগুলো।পূর্ণতা চোখ বুজে মুক্ত শ্বাস নিল।মনে মনে আওড়াল তন্মধ্যে একটি শব্দ
“প্রেম!
কিচিরমিচির শব্দে চোখ খুলল পূর্ণতা।চিলেকোঠার সামনেই ঝুলছে একটা খাঁচা।ভেতরে সবুজ রঙের দুটো ছোট ছোট পাখি।পূর্ণতার ঠোঁট চওড়া হয় সঙ্গে সঙ্গে। সময় না নিয়ে পা বাড়ায় সেদিকে।
‘এই পাখি!আমাকে চেনো তোমরা?আমি পূর্ণতা!
পাখি দুটো পূর্ণতাকে দেখে ভয় পেয়ে খাঁচার অন্য কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো।পূর্ণতা বলল
‘ভয় পাচ্ছ কেন?আমিতো তোমাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছি।
‘আচ্ছা তোমাদের খাবার কে দেয়?ধীর ভাইয়া?নাকি ধ্রুব ভাই___
পূর্ণতা আটকে গেল।মনে পড়লো ধ্রুবর কবিতার এক লাইন ‘ ভাইয়া ডেকে ব্যাথা দাও।
পূর্ণতা আনমনে হেসে উঠল।খাঁচাটা আরেকটু দুলিয়ে ওখান থেকে চলে এলো দোলনায়।পা চেপে দোলনা দোলালো খানিকক্ষণ।চিলেকোঠার এখানে বাল্ব জ্বলছে,তাছাড়া আকাশেও পূর্ণচন্দ্র।জ্যোৎস্নায় সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।পূর্ণতার আর নিচে যেতে মন চাইলোনা।ইচ্ছে করল সারাটাজীবন এখানে কাটাতে।তাদের বাড়ির ছাদে তালা দেয়া থাকে।চাবিটা থাকে সায়রার মুঠোয়।পূর্ণতা আগে কাপড় ধুয়ে মেলতে গেলে একটু উঠতে পারতো ছাদে।এখন তো কোনো কাজ করতে হয়না তাই ছাদেও যাওয়া হচ্ছেনা।সাহস করে সায়রার কাছে চাবি চাইতেও পারেনা।ছোট থেকে ঐ মানুষটাকে জমের মতোন ভয় তার।অথচ পূর্ণতা জানে ছাদ তার কত পছন্দ!

” তুমি মেয়ে মানুষের মত আস্তে আস্তে হাটছো কেন?
“আরে দাঁড়া এভাবে টানলে পড়ে যাবো।
সিড়ি থেকে দুটো কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।পূর্ণতা তাকালো।মিশরা ধ্রুবর হাত জড়িয়ে ছাদে পা রাখলো।
ধ্রুব এসে এদিক ওদিক তাকালো।একটা সময় পূর্ণতাকে দেখল সে।পূর্ণতা চেয়ে থাকায় চোখাচোখি হলো।ধ্রুব দুই ভ্রু উঁচিয়ে আলাপ করল একটু।পূর্ণতা চোখ নামিয়ে নিল সাথে সাথে।ধ্রুব মিশরাকে বলল,

‘ হাতটা ছাড় এখন।

মিশরা চোখ ছোট করল
‘ কেন?ধরে থাকলে অসুবিধে আছে?

মিশরার তখন চোখ পড়লো পূর্নতার দিক।ভ্রু কুঞ্চন গাঢ় হলো।খেঁকিয়ে বলল,
“এই পূর্ণতা! তুই দেখতে পাসনি আমি এসেছি ছাদে? এখনও ক্যাবলার মত বসে আছিস কেন?যা নিচে যা।

পূর্ণতা কেঁপে উঠল এক প্রকার।ধ্রুবর সামনে লজ্জ্বাও পেল।কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ নেমে গেল নিচে।ধ্রুব বিস্মিত,স্তব্ধ।তার মাথায় ঢুকছেনা
মিশরার এটা কেমন ব্যবহার ছিলো?
মনে হচ্ছিলো বোনের সাথে নয় বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে কথা বলল।আর মায়াপরীও কোনও কথা না বাড়িয়ে চলে গেল?কেন?মিশরাকে এত ভয় পেল কেন?

ধ্রুবর ভাবুক চেহারা দেখে মিশরা হাত ঝাঁকাল ওর,
‘ কি ভাবছো?
ধ্রুবর মেজাজ চড়ে গেছে।মিশরার ওপর রাগ লাগছে।এতক্ষন যত সহজভাবে মিশছিল,এখন তার ছিঁটেফোঁটাও পারছেনা।গম্ভীর হয়ে জবাব দিল
‘ কিছুনা।

‘মামুনি বললেন তুমি নাকি ছাদে অনেক গাছ লাগিয়েছ ভাইয়া?আমিতো গোলাপ ছাড়া কোনো ফুলই চিনিনা।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল,
‘এখন আমি কি করতে পারি?
মিশরা বুঝলনা ধ্রুবর বিরক্তি।
‘তুমি আমাকে সব ফুল চিনিয়ে দাও।
ধ্রুবর ইচ্ছে করল মিশরাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে।পূর্ণতার সঙ্গে ওরকম ব্যাবহার‍ কিছুতেই মানতে পারছেনা।পূর্ণতার চুপসে যাওয়া মুখটা মনে করেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ধ্রুব বল প্র‍য়োগ করে মিশরার থেকে হাত ছাড়াল।মিশরা বুঝতে না পেরে বলল,
‘কি হয়েছে?
ধ্রুব নিচের দিক ইশারা করে বলল
‘ মা ডাকছে।আসছি মা আসছি..
লম্বা পা ফেলে ধ্রুব চলে গেল।হতভম্বের মত চেয়ে থাকল মিশরা।মামুনি ডাকলেন?কই আমিতো শুনিনি।

পূর্ণতা এসে বসতেই ধীর যেন প্রান ফিরে পেল।গোমড়ামুখে হাসি ফুঁটল তার।ব্যাপারটা সেলিনা লক্ষ্য করলেন এবার।এতক্ষন ধীর কেমন আধমরার মত পরেছিল।কিছু জিজ্ঞেস করলে হু,হা এর বেশি উত্তর নেই।যেই পূর্ণতা এসে বসেছে ওমনি ডগমগ হয়ে গেল?

‘এতক্ষন ছাদে কি করছিলি?
পূর্ণতা বলল,
‘তোমাদের ছাদটা ভীষণ সুন্দর ভাইয়া।গেলে আসতে মন চায়না।আই উইশ আমি যদি তোমাদের ছাদে একটা ঘর বানাতে পারতাম!বা তোমাদের চিলেকোঠার ঘরটা হলেও চলতো।
ধীর হাসল।বলল,
‘নতুন করেতো আর ঘর বানানো যাবেনা।তবে তুই চাইলে চিলেকোঠার ঘরেই সংসার পাতব আমরা।গভীর রাত অব্দি ছাদে বসে আকাশের দিক চেয়ে থাকব।তুই দেখবি পূর্নচাঁদ,আমি দেখব আমার পূর্নাকে।

বরাবরের মত মনের কথা মুখ ফুঁটে বের হলোনা ধীরের।
ভাবল এতই বা তাড়া কীসের?পূর্না তো সবে সবে এসেছে,মনের কথা আস্তে ধীরে বলাই ভালো।এতগুলো বছর অপেক্ষা যখন করল আর কটা দিন করতে পারবেনা?
ধীরের প্রশান্ত, উৎফুল্ল মন দীর্ঘস্থায়ী হলোনা।মেহবুব একটা বাজারের থলি হাতে হাজির হলেন।পড়নে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি।সাথে আশরাফ।সেও পরেছে একই পোশাক।এটাও মেহবুবের।তাই একটু ফিটিং হয়েছে গায়ে।মেহবুবের থেকে আবার আশরাফের স্বাস্থ্য ভালো কীনা!মেহবুব এসেই ধীরের কাঁধ চাঁপড়ে বললেন
‘চলো ডিয়ার ছেলে,আজ আমরা তিনজন মিলে বাজার করব।
ধীর অবাক হয়ে বলল
‘ আমরা কেন বাবা?আব্দুল কোথায়?

‘আহা,আব্দুল কে দিয়ে তো রোজই বাজার করাই।আজ আমি আর আশরাফ ঠিক করেছি আমরা যাব।

‘তাহলে যাও।আমাকে টানছো কেন?

‘সেকি!তুমি এতদিন পর একটা গোঁটা দিন বাড়িতে আছো,এইটাইতো সময় বাবাকে সঙ্গ দেয়ার।
ধীর অনুরোধ করল
‘প্লিজ বাবা!ধ্রুব কে নিয়ে যাওনা।

‘ধ্রুব তো প্রায়ই যায় আমার সঙ্গে। আজ তুমি চলো।তুমি কখনও যাওনি।
পূর্ণতা পাশ থেকে বলল,
‘মামা আমাকে নেবে?ধীর ভাইয়াতো যেতে চাইছেনা।হয়ত ক্লান্ত।
মেহবুব হেসে আশরাফের দিক তাকালেন।আশরাফ ও হেসে মাথা নাড়লেন।পূর্ণতার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘তুমি যাবে?
পূর্ণতা কিছু বলার আগেই ধীর উদ্বেগ নিয়ে বলল,

‘আমি যাব।যাব আমি।
ধীর ভেবেছিল পূর্ণতাও সাথে যাবে।কিন্তু পূর্ণতা বলল,
‘এইতো ধীর ভাইয়া যাচ্ছে।তাহলে যাও তোমরা।
‘তুই যাবিনা?
‘না।
‘একটু আগে যে বললি যাবি!
‘তুমি যাচ্ছতো।
মেহবুব বললেন
‘ তাছাড়া ও বাচ্চা মেয়ে,রাতের বেলা বাজারে বেশি ভিড় থাকে।তুমি বরং থাকো পূর্ণতা মা।
পূর্ণতা মাথা ঝাঁকায়। সে বরাবর বাধ্য।
‘আচ্ছা মামা।

ধীরের মন ঝুপ করে খারাপ হলো আবার।সে নীরব দৃষ্টিতে মাকে খুঁজল।মা এখানে থাকলে নিশ্চিত বলতেন,
“থাক ও যেতে চাইছেনা যখন জোর কোরোনা।কিন্তু সেও নেই।সেতো তার ননদিনীকে নিয়ে গেছেন নিজের ঘরে।কি নাকি দেখাবেন!ধ্রুব তখনি এসে দাঁড়ালো।
‘কোথাও যাচ্ছ তোমরা? বাবা?

মেহবুব আমুদে কন্ঠে বললেন,
‘ইয়েস মাই বয়,আমরা বাজারে যাচ্ছি।

‘এই রাতের বেলা?

‘বাজার আবার রাত- দিন হয় নাকি!রাতের মেন্যু তোমার মা করে ফেলেছেন।আমি কাল দুপুরের মেন্যুটা কিনতে যাচ্ছি।
ধীর করুন কন্ঠে বলল
‘ এই ধ্রুব, তুই বাজারে যা না বাবাদের সাথে।বিনিময়ে যা চাইবি দেব।
ধ্রুব পূর্ণতার দিক একবার চেয়ে বলল,
‘নো ওয়ে ভাইয়া।আমাকে আজ কয়েক হাজার কোটি টাকা দিলেও ঘর থেকে বের হচ্ছিনা।
তুমিই যাও।
ধীর আর কিছু বলতে পারলোনা।মেহবুব টেনেটুনে সাথে নিয়ে চললেন।যেতে যেতে আশরাফ কত কি বললেন,
‘বাজার করতে যে শান্তি লাগে ধীর,এটা আর কোথাও পাবেনা।
ধীর ও পালটা বলল ‘ আমার শান্তি ঘরে রেখে এসেছি আঙ্কেল।বাইরে সব অশান্তি এখন।
____
সেলিনা আর মেহবুবের ঘর বেশ বড়সড়।বাড়িতে পুরুষ বলতে একমাত্র ধ্রুব।বাকিরা এখনও ফেরেনি।ধ্রুব মায়ের বিছানায় আধশোয়া বসে ফোন টিপছে।সেলিনা সায়রাকে আলমারি খুলে দেখাচ্ছেন নতুন কি কি কিনলেন,কি গয়না গড়ালেন!মিশরা এতক্ষন বসেছিল পূর্ণতার পাশের কাউচে।উঠে গিয়ে ধ্রুবর কাছে বসলো।মিসরা বসাতে ধ্রুব খানিক সোজা, ঠিকঠাক হয়ে বসলো।পূর্ণতাও বেকার বসে নেই।সে সেলিনার রান্নার খাতা উল্টেপাল্টে দেখছে।ঘরের মধ্যে সেলিনা আর সায়রার বকবক ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
সেলিনা হঠাৎ পূর্নতাকে বললেন,
“আজ আমি তোর জন্যে কি রান্না করেছি বলতো পূর্ণতা!
পূর্ণতা তাকালো,
” কি মামুনি?
‘সাবু দানা দিয়ে পায়েস করেছি।খেতে ভালোবাসিস তো অনেক।
পূর্ণতা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
‘পায়েস?নিয়ে এসোনা মামুনি।

‘মামুনি!আমার জন্যে কিছু বানাওনি?
মিশরার কথায় সেলিনা বললেন,
‘কেন বানবনা?তুই তো আবার পায়েস খাবিনা।তোর জন্যে হালিম রেঁধেছি।
একটু পর দুটো বাটি এনে দুজনের হাতে দিলেন সেলিনা।একটাতে পায়েস,অন্যটায় হালিম।পূর্ণতা চামচে পায়েস নিয়ে মুখে দিতে গেল।
ধ্রুব তখনি বলল,

‘মা,তোমার এই দিয়াশলাই কাঠির মত একেকটা ভাগ্নি।অথচ দেখলে বোঝা যায়না এরা এত খেতে পারে।
মিশরা তখনও ফোন টিপছিল।সে ঘাঁড় বাঁকা করে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।পূর্ণতার ও হাত থেমে গেল।সেলিনা চোখ বড় করে বললেন,
“ওমা! এ আবার কি কথা ধ্রুব?ওরা খাবেনা?

‘কেন খাবেনা?নিশ্চয়ই খাবে।কিন্তু খাবারের নাম শুনে যেভাবে একেকজন লাফালো মনে তো হচ্ছেনা এরা কমসম খায়।হ্যা রে মিশু,এত খাস,কিন্তু খাবার যায় কোথায়?
মিশু ঠোঁট উলটে মায়ের দিক ফিরল।সায়রা মুখ টিপে হাসছেন।
সেলিনা মোটা কন্ঠে বললেন,
‘ধ্রুব!তুই কিন্তু আমার মেয়েদের খাবারে নজর দিচ্ছিস।

ধ্রবর নিরুদ্বেগ জবাব,
‘নজর দিচ্ছিনা মা।আমি ওদের ভবিষ্যৎ জামাইগুলোর প্রতি শোক প্রকাশ করছি।এভাবে খেলে দুদিনেই বেচারাগুলো ফকির দাস হয়ে পানিতে ডুবে মরবে।

ধ্রুব পূর্নতার দিক তাকাতেই পূর্ণতা ভেঙচি কাটলো।ধ্রুব থতমত খেল।মিশরা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘দেখলে মামুনি,আমিতো এখনও খাবার মুখেই তুলিনি।অথচ তোমার ছেলে কি সব বলল?

‘ওর কথা ছাড়তো মা।ওর কাজই হলো সবার পেছনে লাগা।
সায়রা বললেন
‘ আমিতো এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা সেই ঘরের মধ্যে ঘাপ্টি মেরে, চুপ থাকা ধ্রুবটা আজ এত চঞ্চল হয়েছে।
পূর্ণতা বিড়বিড় করে বলল,
‘ঘাপটি মেরে থেকেই পেটে পেটে এত শয়তানি পুষেছে।

পূর্ণতা পায়েস মুখে দিয়ে চোখ বুজে ফেলল।সেলিনার হাতের সব রান্নাই অমায়িক।দারুন হয়েছে।পূর্ণতা মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে,আর ধ্রুব সবার চোখ এড়িয়ে ক্লিক দিচ্ছে ফোনের ক্যামেরায়।
_____

পুরো বাজার যেন তুলে এনেছেন মেহবুব।নিয়েছিলেন একটা থলি,অথচ আরো দুটো বাজারের ব্যাগ কিনতে হয়েছে তাকে।তিনজন তিনটি ব্যাগ হাতে বয়ে বাড়ি ফিরলো।ধীরের মেজাজ ভালো নেই। বাজার করতে দু ঘন্টা লাগালো তার বাবা।সাথে মাছের উৎক গন্ধে বমি এসে আটকেছিল গলায়।কিন্তু ধীরের সব রাগ ঢাক উবে গেল পূর্ণতা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হাতে দেয়ায়।সবার জন্যেই এনেছে সে।ধীর মুচকি হেসে গ্লাশে চুমুক দিল।তার মন বলল
‘ পূর্ণা এভাবেই সারাজীবন তার সমস্ত ক্লান্তি অদৃশ্য করে দিক।শুষে নিক ওর হাতের ছোঁয়ায়।

রাতের জন্যে সেলিনা রান্না করে রেখেছিলেন,যাতে মিশরারা এলে আর কাজে ছুটতে না হয়।মন ভরে গল্প করতে পারেন।কিন্তু মেহবুব বাজার থেকে বড় বড় লবস্টার কিনে এনেছেন।সেটা নিয়েই বাড়ি তুলেছেন মাথায়।বলে দিলেন ঝাল ঝাল করে ভুনা করতে।রাতেই খাবেন সকলে।সেলিনা যেতে চাইলেন,কিন্তু সায়রা জানালেন এটা সেই রাঁধবে।অনেক দিন ভাইজান কে নিজের হাতে রেঁধেবেরে খাওয়াতে পারেননি!
রান্না শেষ করে বড় একটা ডিশে পরিবেশন করে মেহবুবের সামনে এনে রাখলেন সায়রা।এই মুহুর্তে সবাই ডায়নিং টেবিল জুড়ে খেতে বসেছে।গন্ধে, আর চেহারা দেখেই জ্বিভে জল এলো মেহবুবের।হৈহৈ করে বললেন,
‘দেখেত মনে হচ্ছে দারুন হবে খেতে।
আশরাফ হেসে বললেন,
‘আপনার বোনের রান্নার হাত মাশআল্লাহ।
আশরাফ আস্তে বলেছিলেন।যাতে শুধু পাশে বসা মেহবুবই শোনেন।কিন্তু ঠিক সায়রার কানে পৌঁছোল।মনে মনে খুশিও হলেন স্বামীর মুখে প্রসংশা শুনে।পরমুহূর্তে মুখ কালো হয়ে গেল।আশরাফের সাথে এই নীরব, না দেখা দুরুত্বের কথা ভেবে।

সেলিনা এক টুকরো ইলিশ মাছ মিশরার পাতে দিতে গেলেন।মিশরা ওমনি হাত উঁচিয়ে বাঁধা দিল
‘না মামুনি আমাকে দিওনা।আমি মাছ খাইনা।
‘একটু খেয়ে দ্যাখ,ভালো লাগবে।
‘না দিওনা।প্লিজ!
তখন আশরাফ বললেন,
‘আপনি ওটা আমায় দিন ভাবি।
সেলিনা তাই করলেন।আশরাফের প্লেটে অলরেডি মাছের একটা বড় টুকরো ছিল।ভাবলেন হয়ত ভালো লেগেছে বলে আরো খাবে।কিন্তু আশরাফ ভিন্ন কিছু করলেন।মাছের কাটা বেছে বেছে দিতে শুরু করলেন মিশরার প্লেটে।মিশরা অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল বাবার দিক।আশরাফ নিজের কাজে ব্যাস্ত।মিশরা সায়রার দিক ছলছল চোখে তাকালে দেখল সে প্রসন্ন হাসছে।মিশরা ঢোক গিলল।ভালো লাগায় ভেতরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে তার।পূর্ণতার দিক চেয়ে দেখল সে গভীর মনোযোগে মাছের কাটা বাঁচছে।প্যাঁচালো মিশরা এবারেও প্যাচিয়ে ভাবল।পূর্ণতার নাজেহাল অবস্থায় হাসি পেল।প্রথমবার পূর্ণতা বাবার এই আদর থেকে বঞ্চিত হলো,আর পেল সে,মিশরার আনন্দ লাগছে।ভীষণ আনন্দ।ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে ওষ্ঠে।
পণ করল
‘ একদিন সবার সব ভালোবাসা আমি পাব পূর্ণতা।তুই পরে থাকবি এক কোনায়।বাবা সবটুকু দিয়ে শুধু আমায় ভালোবাসবেন।শুধু আমায়।

পূর্ণতার খাওয়া থেমে গেল হঠাৎ। তার মসৃন পায়ের ওপর একটা শক্ত পায়ের স্পর্শ পেয়ে।পা’টা আস্তে আস্তে সালোয়ারের নিম্নভাগ ছুঁতেই পূর্ণতা গোলচোখে ধ্রুবর দিক তাকালো।ধ্রুব খাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।পূর্ণতা তার মানে একদম ঠিকঠাক আন্দাজ করেছে।এই কাজ ধ্রুবর।ধ্রুব তাকাতেই
পূর্ণতা চোখ রাঙাল।যার অর্থ
‘পা সরান।
নিরুদ্বেগ ধ্রুব এবারেও নির্লিপ্ত রইল।উলটে বাড়িয়ে দিল পূর্ণতার পায়ে স্লাইড করার পরিমান।পূর্নতার সারা শরীর শিরশির করছে।গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
কাচুমাচু করতে করতে সবার দিক একবার তাকালো পূর্ণতা।সবাই খেতে ব্যাস্ত।এদিকে কারো মন নেই।ধীর একবার তাকিয়েছিল শুধু।পূর্ণতা আবার ধ্রুবর দিক ফিরলো।ওমনি চট করে চোখ টিপল ধ্রুব।পূর্ণতার ঠোঁট আলাদা হয়ে গেল।দ্রুত চোখ নামালো প্লেটের ওপর।ধ্রুব পা তো সরাচ্ছেইনা উলটে আরো ওপরে উঠছে।পূর্ণতা অসহায় মুখ করে তাকালো।যদি একটু মায়া হয় ধ্রুবর।নীরবে বোঝালো
‘ সরান না!
কিন্তু ধ্রুব সরালোনা।উলটে ঠোঁট গোল করে পূর্ণতার দিক ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিল।পূর্ণতা হতভম্ব হয়ে গেল।
রীতিমতো ভাত উঠে এলো তালুতে।বিষম লেগে যাচ্ছেতাই অবস্থা হলো।ধ্রুব পা সরিয়ে পানি দিতে গেল,এর আগেই ধীর ধড়ফড়িয়ে পানির গ্লাশ ধরিয়ে দিল পূর্ণতার হাতে।থেমে গেল ধ্রুব।ধীর বিচলিত হয়ে বলল,
‘খাওয়ার সময় কি যে করিস না পূর্না!
ধীর পূর্নতার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।সেলিনা পিঠে।সবাই খাওয়া থামিয়ে পূর্ণতার দিক উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে।পূর্ণতা ধীরের থেকে গ্লাস নিয়ে চুমুক দিল।পানিটুকু খাওয়ার পুরোটা সময় চেয়ে রইল কাতর চোখে তাকিয়ে থাকা ধ্রুবর দিকে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here