ফাগুন_এলো_বুঝি (১৫)

0
994

#ফাগুন_এলো_বুঝি
(১৫)

রুপের হেচকি উঠে গেছে কান্নার প্রকোপে।পূর্ণতা ওর মাথায়,পিঠে হাত বুলিয়ে বেঞ্চের ওপর বসাল।ব্যাগ থেকে পানি বের করে দিলে দুই ঢোক খেল রুপ।একটু ধাতস্থ হতেই পূর্নতা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল
‘এবার বল,কি হয়েছে?
রুপের চোখ আবার ভিজে উঠল।
‘রাতুল আর আমার ব্রেক- আপ হয়ে গেছে।
পূর্ণতা অবাক হয়ে বলল ‘ সেকি! কবে?
‘পনের দিন হবে।
‘আমাকে কিছু জানালিনা তো!
রুপ তাকাল,
‘কি জানাব আমি?আজ এক বছরের রিলেশনে আমি কথায় কথায় ব্রেক- আপ করেছি।এক ঘন্টার মাথায় আবার সব ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু এবার রাতুল আমাকে এমন ভাবে ঠকাল আমি ভাবতেও পারছিনা।
‘ঠকিয়েছেন?কী করেছেন উনি?

‘কি করেছেন?
রুপ একটু চুপ থেকে বলল,
‘ও এখন ফিজিক্যাল হতে চাইছে।হোটেল বুক করার কথা বলছে ও।
পূর্ণতার চোখ বেরিয়ে এল।
‘কী?
‘হ্যা।
‘তুই কি বলেছিস?
‘আমি রাজি হইনি বলেইতো ব্রেক-আপটা হল।আর এরকম একটা নোংরা কারনে ব্রেক আপ,সেটা তোকেই বা কীভাবে জানাতাম?
“বুঝলাম।কিন্তু আমিতো তোর চেহারার এমন অবস্থা গত দুদিন ধরে দেখছি রুপ।পনের দিন আগের সম্পর্ক ভাঙার শোকতো এটা নয়।এর কারন ভিন্ন।

রুপ দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
‘ভেবেছিলাম,যে ছেলে বিয়ের আগে ফিজিক্যাল হতে না পেরে সম্পর্ক ভেঙে দেয়, তাকে আর জীবনে রাখবনা।মুখ ও দেখবনা ওর।কিন্তু হয়নি।রাতুল আমার পেছন ছাড়ছেনা পূর্ণতা।উলটে ভয়াবহ ভাবে আমাকে ব্লাকমেইল করছে।আমার যত ছবি আছে ওর কাছে সব এডিট করে ভাইরাল করবে ইন্টারনেটে,এরকম হুমকি দিচ্ছে।
পূর্ণতা আর্তনাদ করে বলল,
‘কি বলছিস?রাতুল ভাই এমন?
রুপ কেঁদে ফেলল শব্দ করে।
পূর্ণতা রুপের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘তুই কি ওনাকে ওমন কোনো ছবি__
রুপ দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘না।খুব খোলামেলা কিছু কখনও দেইনি।তবে একবার একটা নাইটি পরা ছবি দিয়েছিলাম।ক্লিভেজ বোঝা যাচ্ছিল।ওটাই যদি ভাইরাল করে দেয়?তাতেই আমার মানসন্মান কোথায় নামবে ভাবতে পারছিস?
রুপ কাঁদছে।পূর্ণতা চিন্তায় একশেষ। কি করবে এখন?মেয়েটার বিপদে পাশে দাঁড়াবে কি করে?
‘আমি কি একবার ওনাকে বোঝাব রুপ?কথা বলে দেখি?
রুপ কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘লাভ নেইরে!হারামিটা শুনবেনা।কত বুঝিয়েছি এই দুটোদিন!ওর একটাই কথা,তিনদিনের মধ্যে ওকে জানাতে হবে আমি রাজি কীনা!নাহলে সব নেটে ছড়িয়ে দেবে।
‘কোথায় থাকে ঐ ছেলে?
ধ্রুবর শক্ত কন্ঠ শুনে চমকে উঠল রুপ-পূর্ণতা দুজনেই।দ্রুত পেছন ফিরল।ধ্রুব একা নেই,রিদ ও দাঁড়িয়ে পাশে।তার চোয়াল কঠিন।রুপ,পূর্ণতা দাঁড়িয়ে পরল।একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।এরা এখানে এলো কিভাবে?ধ্রুব কিছু বলতে ধরল, এর আগেই রিদ গিয়ে রুপের সামনে দাঁড়াল।
‘ওই ছেলের ঠিকানা দাও। নাহয় ফোন নম্বর।
রুপ বিস্ময়ের মাত্রা তখনও কূলোতে পারেনি।ঢোক গিলে বলল,
‘ককেন?
‘দিতে বলেছি দাও।
রিদ ধমকে উঠল।রিদের উদগ্রীবতা দেখে ধ্রুব আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলনা।রুপ পূর্ণতার দিক তাকাল।কি করা উচিত ওর?পূর্ণতা চোখের ইশারায় আশ্বাস দিল।ধ্রুবকে ও চেনে বলেই এই নিশ্চয়তা।রিদ অধৈর্য হয়ে বলল,
‘কি হলো?তোমাকে আমি কিছু বলেছি রুপ?
রুপ আগের থেকেও অবাক হলো।রিদ এই কদিনে যতবার দেখেছে ওকে সঠিক নামে ডাকল এই প্রথম।ঠোঁট নেড়ে শুধু রাতুলের ফোন নম্বর আওড়াল রুপ।সাথে ছোট করে বলল
‘উত্তর বাড্ডায় থাকে।
রিদ ফোনে নম্বর টুকে নিল।রুপের দিক তাকাল ক্ষুব্ধ চোখে।
‘হারাম**দার কত বড় কলিজা আমিও দেখছি..
পূর্নতা বারবার ধ্রুবকে দেখছে।রিদের এমন আচরনের আগামাথা বুঝছেনা সে।অথচ ধ্রুব চুপচাপ।পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে সে।শান্ত তার মুখস্রী।যেন তল পেয়েছে রিদের ভেতরে কি চলছে সেসবের।রিদ ধ্রুবকে বলল,
‘ফাংশনের এরেঞ্জমেন্টে তোকে দরকার ধ্রুব।তুই বরং থাক।আজ আমিই এটা সামলাচ্ছি।
ধ্রুব মেনে নিল,
‘যা।তবে একা নয়।সুমন, শাফিন ওদের নিয়ে যাস।
“ঠিক আছে।
রিদ আরেকবার তাকাল হা করে থাকা রুপের দিকে।দাঁত পিষে বলল,
‘পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে জানা মেয়েগুলো আসলেই নির্বোধ হয়।তোমাকে দেখে আরো একবার প্রমান পেলাম।
রুপের হা’টা দীর্ঘ হলো।রিদ ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান নিল।মাথা তেঁতে গেছে।আজকে ওই ছেলের দফারফা করবে।রুপ পূর্ণতার দিক চেয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘এবার কী হবেরে পূর্ণতা?উনি আবার রাতুল কে মারবেন নাকি.?
পূর্ণতার আগে উত্তর দিল ধ্রুব।
‘এমন ছেলেকে মারাইতো উচিত।অসভ্য ছেলেটার পাল্লায় তুমি কি করে পরলে আমিতো সেটাই বুঝতে পারছিনা।
রুপ মাথা নিচু করে ফেলল।পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে ধ্রুবর দিক চেয়ে ভাবল,
‘আর নিজে যে আমার সাথে সারাদিন অসভ্যতা করছে,তার বেলা?

ধ্রুব পূর্ণতার দিক তাকাতেই পূর্ণতা চটজলদি ভ্রু শিথিল করে মুখ স্বাভাবিক করল।ধ্রুব পালটা ভ্রু কুঁচকে রুপকে শুধাল,
‘আচ্ছা শালিকা,আমার বউয়ের আবার এরকম কোনো ব্যাপার আছে নাকি!
রুপ চোখ পিটপিট করল,
‘আমার তো কোনো বোন নেই ভাইয়া।আমি আপনার শালি কীভাবে হলাম?
ধ্রুব হেসে পূর্ণতার দিক ফিরল।পূর্ণতা মুখ কুঁচকে আছে।ধ্রুব বলেই ফেলল,
‘চোখের সামনে তোমার জ্বলজ্যান্ত বান্ধবিকে রেখে এই কথা বোলছো?
রুপ অবাক হয়ে পূর্ণতার দিক তাকাল।পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরল।ধ্রুবর জ্বালায় সে অতিষ্ঠ।এই মিষ্টি যন্ত্রনার শেষ কোথায়?
___
মেহবুবের অফিস নেই আজ।ইচ্ছে করেই যাননি।নিজের ব্যাবসা,নিজের মনমর্জি।বয়স হচ্ছে।শরীর একটু বিশ্রাম খোঁজে। পরিশ্রম করতে করতে তো এতদূর এলো।ধীরটা যদি ব্যাবসায় হাত লাগাতো,এতদিনে এটুকুও ছোটাছুটি করতে হতোনা।ছেলেটা ক্রিকেট-ক্রিকেট করে ক্যারিয়ার মাথায় তুলেছে।মেহবুব-সেলিনা ছেলেদের ইচ্ছের ওপরে কোনও দিন প্রেশার ক্রিয়েট করেনি।যে যেটা হতে চাইছে হোক।স্বপ্নের পেছনে ছুটছে ছুটুক।ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে,বিশ্রাম নেবে নাহয় বাবার টাকাতেই।বাপের তো কম নেই।ধীরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছেন মেহবুব।এখন আশার আলো ধ্রুবকে নিয়ে।এম-বি-এ করে যদি ব্যাবসার ভার কাঁধে নেয়!তবেই মেহবুবের অবসর মিলবে।সেলিনা নতুন নতুন রেসিপি তৈরী করবেন,আর সে চেখে চেখে মন্তব্য জানাবে।জীবন হবে সুন্দর,সাবলীল। দুটো ছেলের বিয়ে দেবেন,বউ আসবে।একটা সময় নাতি-নাতনীদের পিঠে চড়িয়ে খেলবেন।দক্ষিনের মুক্ত বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল মেহবুবকে।মেহবুব হেসে উঠলেন।নিজের ভাবনার দরুনই হাসি পেল।ছেলেরা বিয়ের নাম শুনলে পালাতে চায়,আর সে কতদূর ভেবে ফেলল!
তখন সেলিনা এসে পাশে দাঁড়ালেন।আস্তে-ধীরে বসলেন কাঠের পুরোনো দোলনায়।মেহবুবের দাদার আমোলের এটা।মেহবুবের ফুপি যখন খুব ছোট, বায়না ধরেছিলেন একটা দোলনার জন্যে।মেহবুবের দাদা টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন।ডিজাইন ও দিয়েছেন উনি।ফুপুর বিয়ে হলো ভালো ঘরে।দোলনাটা রয়ে গেল।বাবার স্মৃতি হিসেবে যত্ন করে রাখলেন মেহবুবের বাবা আশফাক খান।এখন যেমন যত্নে রাখছেন মেহবুব।এটাকে দেখলে তার বাবার কথা মনে পড়ে।ছোট বেলার কথা মনে পড়ে।ফুপু ছিলনা,কিন্তু সে দোল খেয়েছে কত!এ বাড়িতে দুটো দোলনা।একটা তাদের ঘরে,অন্যটা ছাদে।ওটা আবার দামী, নতুন।
সেলিনা বসতেই শব্দ করে দুলে উঠল দোলনাটা।মেহবুব চিন্তাভগ্ন হয়ে তাকালেন। সেলিনার মুখভঙ্গি দেখে শুধালেন,
“কিছু বলবে?
সেলিনা উশখুশ করছেন দেখে হেসে ফেললেন মেহবুব।
‘আমার সাথে কথা বলতে আজকাল ইতস্তত করছো শেলী?
সেলিনা বললেন,
‘ওরকম কোনও ব্যাপার নয়।একটা কথা বলার ছিল।
‘হ্যা,তো বলো।শুনতেই তো চেয়েছি।
সেলিনা বললেন,
‘ধীরকে দেখেছ তুমি?
মেহবুব ভ্রু কোঁচকান,
‘ধীরকে আবার দেখার কী হলো?সকালেও নাস্তার টেবিলে দেখলাম।একটু পর আবার দেখব।দেখাতো রোজই হয়।
সেলিনা উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘আরে ঐ দেখা নয়।আমি বলতে চাইছি আজকাল ধীরকে লক্ষ্য করেছ?খেয়াল করেছ ওর হাবভাব?

‘কেন?কিছু করেছে ও?
‘তার মানে লক্ষ্য করোনি তাইতো!
‘আসলেই করিনি।
সেলিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
‘তাহলে তোমাকে বলা না বলা সমান।ছাড়ো।আসি।

সেলিনা উঠতে নিলে হাত টেনে আবার বসিয়ে দিলেন মেহবুব।বোঝানোর ভঙিতে বললেন,
‘আরে শোনো,আমি ধীরকে কীভাবে খেয়াল করব বলো?ওর সাথে আমার সকাল আর রাত এই দুটো সময় দেখা হয়।তাও খাবার টেবিলে।আমি নিজেও তো অফিস নিয়ে ব্যাস্ত থাকি।তা কী করেছে তোমার গুনধর ছেলে?
” কী করেছে?বলো কি করছে,আগে যে ছেলেকে আমি বাড়িতে ধরেবেঁধেও রাখতে পারিনি সে দুটোদিন যাবত ঘর থেকে বের হচ্ছেনা।যদিওবা বের হয়,এক ঘন্টার মাথায় ফিরে আসে।কাল শুনলাম ধ্রুবদের ভার্সিটিতেও গিয়েছিল ওদের আনতে।

মেহবুব এবার সিরিয়াস হলেন ‘ তাই?
‘হ্যা।তোমার মনে আছে,ধ্রুব যখন ফার্স্টইয়ারে,ক্লাশের এক ছেলের সঙ্গে মারামারি করেছিল?গার্ডিয়ান ডাকা হয়।তুমি ঢাকার বাইরে থাকায় ধীরকে যেতে বললে।গেছিল সে?যেতে হলো আমাকে।সে আজ কেন গেল?কি দরকারে?

মেহবুব মাথা দোলালেন ‘ তাইতো!ব্যাপারটা চিন্তার।
সেলিনা কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,
‘আমার কি মনে হয় জানো,এসব পূর্ণতার জন্যে হচ্ছে।
‘পূর্নতা? ও আবার কি করলো?লক্ষী একটা মেয়ে।
সেলিনা কপাল চাঁপড়ালেন,
‘আচ্ছা তুমি কি কঁচি খোকা?বোঝোনা কিছু? আমি বললাম,ধীর হয়ত পূর্ণতাকে পছন্দ করে।তাই সব সময় ওর আগেপিছে ঘুরঘুর করছে।

মেহবুব বললেন
‘হ্যা হতে পারে।ছোট বেলা থেকেই ধীরের পূর্ণতার প্রতি একটা সফটকর্নার ছিল।হতে পারে বড় হয়ে সেটা ভালোবাসায় তৈরি হয়েছে।
‘হ্যা।আর এরকম যদি হয়না,আমার থেকে খুশি কেউ হবেনা।পূর্ণতাকে আমার ভারি পছন্দ।

মেহবুব সেলিনার ঝলমলে চেহারার দিক চেয়ে বললেন,
‘সে ওকে আমারও পছন্দ।ভদ্র মেয়ে।

‘তাহলে আমি ধীরের সঙ্গে কথা বলি?
‘বলতে পারো।তবে পূর্ণতা কি ধীরকে পছন্দ করে?সেটা জানাও তো জরুরি।
‘করবেনা কেন?ওতো ধীর বলতে পাগল।সারাক্ষন ধীর ভাইয়া, ধীর ভাইয়া করতে থাকে।যেদিন দেখা হলো?ওইদিন ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।তুমি ছিলেনা বলে দেখোনি।আমি নিশ্চিত, পূর্ণতাও ধীরকে পছন্দ করে।
সেলিনার দৃঢ় কন্ঠ।মেহবুব বললেন,
‘তাহলে তো হয়েই গেল।দুজন দুজনকে পছন্দ করলে আর দেরি করবনা।আশরাফের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত বিয়ে পড়িয়ে দেব।
সেলিনাও একমত।মেহবুব ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,
‘যাক,একটা ব্যাপার ভালো হলো এতে।
‘কী?
‘বউমা যখন তোমার মনের মতো হচ্ছে,তবে আর তোমার দজ্জ্বাল শ্বাশুড়ি হওয়ার চান্স রইলনা।
সেলিনা চোখ কপালে তুলে বললেন
‘কী বললে তুমি?আমি দর্জ্জাল শ্বাশুড়ি হতাম?
আমি?

‘না আমি সেটা কখন বলেছি?আমিতো__
সেলিনা দাঁড়িয়ে গেলেন।
‘থাক!আপনাকে আর কিছু বলতে হবেনা।আমি সব বুঝি।তবে আমিও একটা কথা বলছি শোনো,আমার দুই ছেলের বউকেই না আমি মাথায় তুলে রাখব।ওরা বুঝতেই পারবেনা আমি ওদের মা নাকি শ্বাশুড়ি। বুঝেছ?

মেহবুব তুষ্ট কন্ঠে বলতে নিলেন,
‘হ্যা আমি জানিতো তু__
‘হুহ।
কথার মাঝে মুখ ভেঙচিয়ে চলে গেলেন সেলিনা।মেহবুব হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকলেন।সেলিনা দরজার কাছাকাছি আসতেই পর্দার আড়াল হতে একটি ছায়ামূর্তি সরে গেল।সেলিনা দেখতে পাননি।হেটে গেলেন নিজের মতোন।
—–
তখন রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। খেয়েদেয়ে যে যার ঘরে আরাম করছে।পূর্ণতা ঘুমানোর জন্যে আলো নেভালো।চুলে বিনুনি বেঁধে বিছানায় কেবল শুয়েছে এর মধ্যেই ফোন বাজলো তার।বালিশের নিচে থাকায় কান ধরে গেল পূর্ণতার।ধড়ফড় করে উঠে ফোন বের করল।স্ক্রিনে অচেনা নম্বর ভাসছে।পূর্ণতার ফোনে খুব কম সংখ্যক লোকের কল আসে।বলতে গেলে আশরাফ আর রুপই কল দেয় তাকে।ইদানীং সেলিনা, ধীর এরাও দেয়।কিন্তু আনসেভ নম্বর থেকে কল আসা বিরল ঘটনা।তাও এত রাতে?পূর্ণতা ভেবে ভেবে রিসিভ করল।মিহি কন্ঠে শুধাল,
‘হ্যালো,কে বলছেন?
ওপাশে থেকে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
‘আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে,নিজে ঘুমাচ্ছো মায়াপরি?
এই এক ডাকেই পূর্ণতা বুঝে ফেলল অজ্ঞাত ব্যাক্তির পরিচয়।ধ্রুব ফোন করেছে।
‘আপনি আমার ফোন নম্বর কোথায় পেলেন?
ধ্রুব বলল,
‘যেখানে তোমাকে পাচ্ছি,সেখানে ফোন নম্বর আর এমন কি?
‘নম্বর কোথায় পেলেন?
পূর্ণতার কন্ঠ সিরিয়াস। ধ্রুব বলল,
‘বলব?বলা কি উচিত?আচ্ছা বলছি,মায়ের ফোন থেকে নিয়েছি।
পূর্ণতা অবাক হয়ে বলল,
‘আপনি দেখছি শুধু মেয়েদের সাথে ফাজলামোই করেননা।তার সাথে সাথে চুরিও করেন।

ধ্রুব ভ্রু গোঁটায়,
‘কি চুরি করলাম?
‘কাউকে না বলে তার ফোন থেকে অন্যের নম্বর নেয়াটা এক ধরনের চুরি।
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠল।ফোনের ভেতর ধ্রুবর হাসি এই প্রথম শুনলো পূর্ণতা।ভেতরটা কেমন করে উঠল।ছেলে মানুষের হাসির শব্দ এত সুন্দর হয়?
পূর্ণতা বুকে ওঠা তোলপাড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘কেন ফোন করেছেন?
ধ্রুবর জবাব,
‘সেটা জানতে হলে, ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাদে চলে এসো।
পূর্ণতা সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব নাকচ করে বলল,
‘আমার জানার কোনো দরকার নেই।
‘তার মানে তুমি আসবেনা?
পূর্ণতা মুখের ওপর বলল,
‘না।
‘সত্যিই আসবেনা?
‘কক্ষনও না।
ধ্রুব কাঁধ উঁচু করলো,
‘বেশ।এসোনা।তাহলে বরং আমিই তোমার রুমে চলে আসছি।ভেবনা দরজা -জানলা লাগিয়ে রাখলেই আফনান খান ধ্রুব প্রবেশ করতে পারবেনা।এটা আমাদের বাড়ি।কোন জায়গা থেকে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, আমি খুব ভালো করে জানি।
পূর্ণতা কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আপনি কি মিস্টার ইন্ডিয়া?যে দরজা ভেদ করে চলে আসবেন?
ধ্রুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” মজা নিচ্ছো?আচ্ছা শোনো তাহলে, তোমার রুমে ঢোকার জন্যে একটা গুপ্ত রাস্তা আছে।যেটা আমরা বাড়ির কজন ছাড়া কেউ জানেনা।আমি বরং সেই রাস্তা ধরেই চলে আসব।আর এত রাতে আমাকে তোমার রুমে দেখলে কে যে ঠিক কী কী ভাববে!এ বাবা,আমার তো ভাবতেই লজ্জা লাগছে!কী আসব?
ধ্রুবর হুমকিতে বোঁকা পূর্ণতার মাথা চক্কর দিলো। লাফিয়ে উঠে বলল,
‘না।আসতে হবেনা।আমি এক্ষুনি আসছি।
‘দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল!রাখছি।ঠিক পাঁচ মিনিট ওকে?
ধ্রুব লাইন কেটে দিল।পূর্ণতার কেঁদে ফেলার যোগাড়। বাড়ির সবাই কি ঘুমিয়েছে?না তো।তাহলে তাকে ছাদে যেতে দেখলে কি না কি ভেবে বসে।বিশেষ করে ধীর,আর মিশরা।এইদুজন দেখলে একশ একটা প্রশ্ন করবে।পূর্ণতা কাঁদোকাঁদো হয়ে,গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে রুম থেকে বের হলো।স্লিপার খুলে রেখে এসেছে।বাইরে থেকে দরজা চাপিয়ে দিলো,যাতে কেউ দেখলে ভাবে পূর্ণতা ভেতরেই।খালি পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে উঠল পূর্ণতা।যেতে যেতে দেখল ধীরের ঘরের আলো জ্বলছে।তার মানে সে জেগে এখনও।

সিড়িঘরের লাইট জ্বালানো থাকায় উঠতে অসুবিধা হয়নি পূর্ণতার। দরজা টপকে ছাদে কেবল পা রেখেছে ওমনি কেউ হাত টেনে দেয়ালে ঠেসে ধরল।আচমকা ঘটনায় ভয় পেল পূর্ণতা।ওপাশের ব্যাক্তিটি রীতিমতো মিশে আছে তার সাথে।শরীর থেকে ভেসে আসা কঁড়া পারফিউমের গন্ধে পূর্ণতা চিনে ফেলল ব্যাক্তিটি কে!ধ্রুব যতবার কাছে এসেছে এই সুন্দর গন্ধটাই পেত।পূর্ণতা মুচড়ে উঠল,
‘ছাড়ুন!
বরাবরের মত ধ্রুব সড়লনা।বলল,
‘আজ আর ছাড়বনা মায়াপরি!
পূর্ণতা ঘাবড়ে গেল।
‘ছছাড়বেন না মানে?
‘ভয় পাচ্ছো কেন?
‘এত রাতে ছাদে ডেকে আনলেন,আর জিজ্ঞেস করছেন ভয় পাচ্ছি কেন?
পূর্নতার কাঁপা-কাঁপি টের পেয়ে ধ্রুব সরে দাঁড়াল।ওকে আশ্বস্ত করতে হেসে বলল,
“বি কুল মায়াপরি!তোমার ধ্রুব অতটাও খারাপ নয়।
” তোমার ধ্রুব”
শব্দটা তীরের মত বুকে গিয়ে বিঁধল পূর্ণতার।ধ্বক করে উঠল।হার্টবিট বেড়ে গেল।স্তম্ভিত চেয়ে থাকল সে ধ্রুবর মুখের দিকে।
ধ্রুব বলল,
‘এসব ছাড়ো।আমাকে একটা কথা বলবে,তুমি পায়ে নূপুর কেন পরোনা?
পূর্ণতা হঠাৎ জেগে ওঠা অনুভূতিদের সামলালো।নীঁচু কন্ঠে বলল,
“এটা বলতে ছাদে ডাকতে হয়?ফোনে বললে___
ধ্রুব চোখ ছোট করে বলল,
‘মেয়েরা কি সব সময় বেশি কথা বলে?যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বললেই হচ্ছেতো!
পূর্ণতা ছোট করে বলল,
‘এমনি।
বাবা তো কখনও বলেনি পরতে।
ধ্রুব চোখ পিটপিট করলো।মেয়েটা কী বোঁকা?পায়ে নূপুর বাবা পরতে বলে?হাসিটা চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলল ধ্রুব।পূর্নতার মুখ চুপসে গেল।নির্ঘাত সে বোঁকা বোঁকা কথা বলেছে,তাই ধ্রুব হাসছে।ধ্রুব হঠাৎ ঝুঁকে এলো, নিরেট কন্ঠে বলল,
” কিছু জিনিসে শুধুই প্রেমিকের অধিকার থাকে মায়াপরি।বাবা-মায়ের সেখানে হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ।
পূর্ণতা বুঝলোনা।ধ্রুব পূর্ণতার প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে থাকা চেহারার দিক তাকিয়ে মনে মনে বলল,

‘আমি জানি,তোমার বাবাই তোমার পৃথিবী। মায়ের কাছে সব শুনেছি।অনেক কষ্ট পেয়েছ ছোট থেকে।কথা দিচ্ছি সব কষ্ট মুছে দেব মায়াপরি!আমার ভালোবাসা দিয়ে সুখ লেপ্টে দেব তোমার দুহাতে।তোমার আরেকটা পৃথিবী হব আমি।যেখানে কোনো দুঃখ তোমায় ছোঁবেনা।
পূর্নতা বলল,
“আমি এখন যাই?
ধ্রুবর ভাবনায় ছেদ ঘটে।
‘তোমাকে যেতে বলেছি?
পূর্ণতা কপাল কোঁচকালো।ধ্রুব বলল,
‘আগে তোমার জীবনে আমি ছিলাম না,তাই কেউ নূপুর পরতে বলেনি।এখন আমি এসেছি, এখন থেকে পরবে।
পূর্ণতা এবারেও বুঝলনা।বলল,
‘এখন থেকে পরব কী করে?ছাদে কি নূপুর হাওয়ায় ভেসে আসবে?
ধ্রুব বলল,
‘মোটেইনা।আমি থাকতে হাওয়ায় ভেসে আসবে কেন?
‘আপনার কথার মাথামুণ্ডুও বুঝতে পারছিনা আমি।
‘তোমাকে এত বুঝতে কে বলেছে?
‘তাহলে কি করব?
‘শুধু দেখবে।
‘কি দেখব?
‘চাইলে আমাকেও দেখতে পারো।বা এটাকে…..
ধ্রুব পূর্ণতার সামনে এক জোড়া নূপুর ঝুলিয়ে ধরল।পূর্ণতা প্রচন্ড বিস্মিত হয়।ধ্রুব তাকে আরো এক দফা চমকে দিয়ে হাটুগেড়ে বসল।একদম পূর্ণতার সামনেই।নিজের হাটু ইশারা করে বলল,
‘এখানে পা রাখো।
পূর্ণতা চোখ বড় করে পিছিয়ে গেল।
‘না। ছি!আপনি আমার বড়।আপনার গায়ে পা রাখব?
‘আমিইতো রাখতে বললাম।রাখো।
পূর্ণতা দুদিকে মাথা নাড়ল,
” না।
‘রাখবেনা?
‘উহু।
‘বেশ।
ধ্রুব উঠে দাঁড়ায়।পূর্নতা স্বস্তি পেল খানিক।ভাবল ধ্রুব মেনে নিয়েছে।কিন্তু ধ্রুব আচমকা কোলে তুলে নিল তাকে।পূর্ণতা হকচকাল।পরে যাবে ভেবে ধ্রুবর শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল।
‘কি করছেন?নামান আমাকে।পরে যাব।
‘যার বাহুডোরে সারাজীবন থাকবে,তার বাহুর ওপর ভরসা নেই মায়াপরি?
ধ্রুবর শীতল স্বর।কথাটায় কিছু একটা ছিল।পূর্ণতা চুপ করে গিয়ে এক যোগে চেয়ে থাকল ওর ফর্সা চেহারায়।ধ্রুব পূর্ণতাকে কোলে নিয়েই এগিয়ে চলল।চিলেকোঠার সামনে পেতে রাখা সাদা দোলনার ওপর বসাল ওকে।পূর্ণতার নরম পা দুটো সিমেন্টের মেঝে ছুঁলো।ধ্রুব আবার হাটুগেড়ে বসল।নিজেই পূর্ণতার পা নিয়ে নূপুর জোড়া পরিয়ে দিল।পূর্ণতা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল।তার মুখে শব্দ নেই।ধ্রুব তাকাল একবার।আবার পায়ের দিক চেয়ে বলল,
‘এবার থেকে যখনি তুমি হাটবে,এই নূপুরের রিনিঝিনি শব্দে আমি বুঝে যাব।বুঝে যাব আমার মায়াপরি আমার কাছেই আসছে।
পূর্ণতার গাল দুটো লজ্জ্বায় লালচে হলো।চোখ নামালো সে।ধ্রুব উঠে দাঁড়ায়। দোলনার হাতলে দুইহাত রেখে মধ্যিখানে বন্দি করে পূর্ণতাকে।ঝুঁকে যায় ওর দিকে।পূর্ণতা পিছিয়ে যাওয়ায় পিঠ লেগে যায় দোলনার সঙ্গে। ধ্রুব পূর্ণতার সারামুখে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘তুমি এরকমই থাকবে মায়াপরি।চালাক হবেনা।
পূর্ণতা ভ্রু গোঁটাতেই ধ্রুব মিটিমিটি হেসে বলল,
‘এটা কোন রাজা-মহারাজার প্রাসাদ নয় মায়াপরি।যে গুপ্ত রাস্তা থাকবে।তাই তোমার রুমে যাওয়ার ও কোনো ভিন্ন রাস্তা নেই।
পূর্ণতা ঠোঁট ফাঁকা করে বলল,
“তার মানে আপনি আমাকে বোঁকা বানালেন?
‘একটুতো বানিয়েছিই।সাথে প্রমান ও পেয়েছি,তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস করেছ।
তবে কি জানো,তোমার রুমে যাওয়ার গুপ্ত রাস্তার সন্ধান না জানলেও আমি কিন্তু তোমার মনে প্রবেশ করার রাস্তার সন্ধান জানি।
শুনবে সেটা কী?
পূর্নতা ঠোঁট নেড়ে শুধাল,
‘কী?
ধ্রুব আরেকটু ঝুঁকে এল।পূর্ণতা নড়লনা এবার।ধ্রুব পূর্ণতার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
” ভালোবাসা”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here