ফাগুন_এলো_বুঝি! (২০)

0
959

#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(২০)

ধ্রুবর বুক কাঁপছে।হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে।মনে হচ্ছে বিশাল আকাশ ভেঙে পরেছে মাথায়।পায়ের নিঁচের জমিন ফাঁকা হয়ে সে তলিয়ে যাচ্ছে তিঁমিরে।ত্রস্ত হাতে ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছে ধ্রুব।আঙুল গুলো কাঁপছে খুব।প্রত্যেকটা পাতায় একের পর এক ধীরের জমানো অনুভূতি লেখা।এই সব অনুভূতি পূর্ণতাকে নিয়ে,ভাবতেই ধ্রুবর মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।ধ্রুবর হাত থেকে ডায়েরিটা ঝুপ করে নিচে পরল।
‘তার মানে ভাইয়াও মায়াপরিকে ভালোবাসে?তাও ছোটবেলা থেকে?
ধ্রুবর ডান পাশের চোখ থেকে সরলরেখার মত অশ্রু গড়িয়ে গাল অব্দি এল।ধ্রুব চট করে মুছে নিল সেটা।পরপর শ্বাস ফেলল।খুব কষ্টে অবশ হয়ে আসা পা দুটো টেনে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরে এসে দরজা ভিজিয়ে দিল ধ্রুব।নিচ থেকে সেলিনার ডাক ভেসে আসছে।খেতে ডাকছেন উনি।ধ্রুব উত্তর দিতেও পারলনা।কথাই বের হচ্ছেনা। জ্বিভের ডগায় শব্দ নেই।ধ্রুব বিছানায় বসল।পুরো শরীর কাঁপছে এখনও।নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকাল থাই গ্লাস ভেদ করে অদূর আকাশে।ফর্সা চেহারা টকটকে লাল হয়ে উঠছে।
ধ্রুব নিজেকেই শুধাল,
‘শেষ পর্যন্ত আমি ভাইয়ার ভালোবাসার দিকে হাত বাড়ালাম?এত নিচে নামলাম আমি?এতটা নিচে?
ধ্রুবর মানস্পটে একেক করে সব মুহুর্ত ভেসে উঠল।পূর্ণতার সাথে তার কাটানো সুন্দর স্মৃতি গুলো।এই মেয়েটাকে কী করে ভুলে থাকবে সে?কী করে?
_____

সায়রা ইদানীং চুপচাপ থাকেন।পূর্ণতাকে তেমন কিছু বলেন না।আগে আশরাফ চোখের আড়াল হলেও যেটুকুন ধমকাতেন এখন তাও করেন না।উল্টে চমকে দেয়া কাজ করছেন।এইতো আজ,পূর্ণতা বাড়ি আসা মাত্র সবার জন্যে সন্ধ্যের নাস্তা বানিয়েছেন নিজ হাতে।পূর্ণতার সামনে দিয়ে বলেছেন,
‘খেয়ে দ্যাখ তো কেমন হলো।
পূর্ণতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল সায়রার দিক।মিশরা খাবার মুখে নিতে নিতেই থেমে গেল।সেও একইরকম বিস্মিত।বাদ যাননি আশরাফ নিজেও।সায়রার এই স্বভাবের সঙ্গে তারা পরিচিত নয়।পূর্ণতার হা’টা বন্ধ হলো সায়রার কথায়।তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
‘তোমরা সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?খাবার ঠান্ডা হচ্ছে, খাও।
সায়রা আর বসেননি।ওপরে চলে গেলেন।
পূর্ণতার মন ফেরার পর থেকে খারাপ ছিল।সায়রার এই অযাচিত ভালো ব্যাবহারেই উবে গেল সেটুকু।খুশি মনে ঘুমোতে গেল সে।ঘুম না আসা অব্দি বারবার ফোন চেক করল। এই বুঝি ধ্রুব কল করে,বা মেসেজ।কিন্তু ধ্রুবর থেকে কোনো সাড়া নেই।লোকটা কী এই ক’ঘন্টায় তাকে ভুলে বসল?
পূর্ণতা যখন প্রায় ঘুমিয়ে পরবে ঠিক তখন ফোন বাজল তার।ধ্রুব ফোন করেছে ভেবে তড়িঘড়ি করে টেবিল হাতড়ে ফোন নিল পূর্ণতা।স্ক্রিনে ধীরের নাম দেখে খুশিটা মিলিয়ে গেল।কেন যেন ধরতেই ইচ্ছে করলনা।আবার কেটে দেয়াও যাবেনা।পূর্ণতা সাইলেন্ট বাটন চেপে ওভাবেই ফোন রেখে দিল টেবিলে।
______

রাত একটা বাজে রিদের ফোন বাজছে।রিদ তখন বারান্দায় বসে।এত রাতে কে কল করবে?দ্রুত পায়ে রুমে এল সে।বিছানার ওপর রাখা ফোন হাতে তুলে নামটা দেখতেই ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে আসে।’অরুপসী’ লিখে সেভ করা।রুপ এই সময় কেন ফোন করল? আর কীভাবে করল?সে না হয় রাতুলের ফোন থেকে রুপের নম্বর নিয়েছিল।রুপ কী তাহলে আজ পূর্ণতাকে নম্বর বলার সময় শুনেছে?মেয়েটা মুখস্থ করেছে তাহলে?ভাবতেই রিদের খুশিটা প্রকান্ড হয়।
ঝলমলে চেহারায় রিসিভ করে বলল,
‘হ্যালো!
ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা মিহি কন্ঠস্বর,
‘আপনি কী ঘুমিয়ে পড়েছেন ভাইয়া?
‘না না।বলোনা কী বলবে!
রুপ বলল ‘ বিরক্ত করলাম নাতো।
‘না। বরং ভালো লেগেছে।কেউ আমার নম্বর শুনেই মনে রাখতে পারে ভেবে।
রুপ লজ্জ্বা পেল।
‘না মানে তখন__
রিদ বলল,
‘কিচ্ছু বলার দরকার নেই রুপ।আমি বুঝেছি।তুমি ফোন করবে আমি ভাবিইনি।ভাগ্যিশ জেগে ছিলাম,নাহলে মিস হয়ে যেত।

রিদের ভরাট কন্ঠে রুপের হার্টবিট বাড়তে থাকল,রিদ তখন বলল’
‘একটা কথা বলব?
‘বলুন।
‘শাড়ি পরলে তোমাকে একদম অরুপসী লাগেনা।
রুপ মুচকি হাসল।রিদ কথা বলতে বলতে বারান্দায় গেল।
‘তা আমার কথাটা কী ভেবেছ?
‘কোন কথা?
‘কেন?আজ বিকেলে যেটা বললাম।ভুলে গেলে?
রুপ চুপ করে থাকল।রিদ কোন সম্পর্কের কথা বলেছে সে বুঝেছে।কিন্তু একটা সম্পর্ক রাতারাতি শেষ করে আরেকটায় জড়ানো যায়?ভাবুক রুপকে ডেকে উঠল রিদ,
‘রুপ!
‘হু?রুপের ক্ষীন কন্ঠ।
রিদ চোখ বুজে শ্বাস ফেলে চটপট আওড়াল,
‘বুড়ো হবে একসাথে?
রুপের বুক মুচড়ে উঠল অনুভূতিতে।আর কথা বলতে পারলনা সে।লাইন কেটে বুকে চেপে ধরল।এই বসন্তে কারো ফাগুনি হাওয়া শুরু হয়,আর কারো জীবনের ফাগুন হারিয়ে যায় বিবেক,মানবিকতার অতলে।
___
পরদিন ভার্সিটিতে ধ্রুব যায়নি।পূর্ণতা সারাটাক্ষন ওর অপেক্ষায় থেকেও ওকে পায়নি।ক্লাশ শুরুর আগে,ক্লাশ শেষ হলে গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।যখন আর ধৈর্য্য কূলালোনা ঠিক তখন রিদকে ফোন করল পূর্ণতা।রিদ জানাল ধ্রুব আজ আসেইনি।পূর্ণতার অবাক লাগছে,ভার্সিটি জয়েন করার পর থেকে ধ্রুব আসেনি এমন এই প্রথম ঘটল।ওদের ক্লাশ না থাকলেও ওরা এসে আড্ডা দিয়েছে এখানে।তাহলে কী হলো হঠাৎ? লোকটার শরীর খারাপ করলনা তো?পূর্নতা ছটফট করে ধ্রুবর নম্বরে ডায়াল করল।রিসিভ হলোনা।কল করে করে ক্লান্ত হয়ে টেক্সট পাঠাল,
‘আপনি কোথায়?ঠিক আছেন আপনি?
উত্তর এলোনা।পূর্ণতা শেষমেষ মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল।রুপটাও আজ আসেনি।পূর্ণতা ঘোষণা করল আজকের দিনটাই খারাপ।

বাড়ি ফিরে অসময়ে আশরাফকে দেখে পূর্ণতা সিড়ির গোড়াতেই দাঁড়িয়ে যায়।দুপুরবেলা আশরাফ সোফায় বসে চা খাচ্ছেন।পাশেই বসে সায়রা।কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তারা।পূর্ণতাকে দেখতেই থেমে গেলেন দুজনে।পূর্ণতা ক্লান্ত কন্ঠে শুধাল,
‘তুমি এই সময় বাড়িতে বাবা?
আশরাফ আদুরে কন্ঠে বললেন,
‘তুমি এসে গেছ মামুনি?এসো এসো বাবার পাশে এসে বসো।
পূর্ণতা এগিয়ে গেল।ঠিক বাবার পাশেই বসল।কাধব্যাগ রাখল কোলের ওপর। সায়রা তখন অবাক করা একটা কান্ড ঘটালেন।নিজ থেকে উঠে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে পূর্ণতার দিক ধরলেন।গতকালকের মতোই পূর্ণতা অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল।আশরাফ ও তাই।সায়রা দুজনকে একবার একবার দেখে অস্বস্তিতে গাঁট হলেন।ছুড়ে ছুড়ে বললেন,
‘খেয়ে নে।ভালো লাগবে।বিধ্বস্ত লাগছে দেখতে।
পূর্ণতার মন ফের জুড়িয়ে গেল।নরম হাতে গ্লাস নিয়ে চুমুক দিল সে।
সায়রা এসে অন্য সোফায় বসলেন।মিশরা তখনও ফেরেনি।
পূর্ণতা গ্লাস টি-টেবিলে রাখতেই আশরাফ রয়ে সয়ে বললেন,
‘পূর্নতা,মেয়েরা বাবার কলিজার টুকরো হয়।বাবারা খুব যত্ন করে ভালোবেসে মেয়েদের বড় করেন।কিন্তু মেয়েরা আসলে থাকে বাবার ঘরে আমানত হিসেবে।একদিন তাদের চিরচেনা বাড়িটা ছেড়ে যেতে হয় অন্য একটা বাড়িতে।যেখানে ঠাঁই হয় মৃত্যু অব্দি।
পূর্ণতা কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইল।আশরাফ বললেন,
‘আমি তোমাকে নিয়ে বরাবর চিন্তায় থেকেছি।তাহমিনার শেষ চিহ্ন তুমি।আমাদের দুজনের ভালোবাসার চিহ্ন।তুমি অনেক নরম।কাঁদামাটির মত।যে মাটিতে মানুষ আছড়াতে বেশি পছন্দ করে।
কথাটা বলে আশরাফ তীর্যক দৃষ্টি সায়রার দিক ফেললেন।সায়রা চোখ নামিয়ে নিলেন।পূর্ণতা ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘থাক না বাবা__
‘আমাকে বলতে দাও।
পূর্নতা চুপ করল।
আশরাফ বললেন,
‘আমি সব সময় চেয়েছি একটা ভালো ঘরে তোমার বিয়ে দিতে।তাদের অঢেল টাকাপয়সা থাকার দরকার নেই।কিন্তু একজন শ্বাশুড়ি থাকবেন,যিনি ঠিক মেয়ের মত ভালোবাসবেন তোমাকে।যার হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দেব সে সব বিপদে আমার মেয়ের ঢাল হবে।অযত্নে,এক সমুদ্র দুঃখ নিয়ে বড় হওয়া আমার মেয়েটাকে ফুলের মত আগলে রাখবে।আর সেই ইচ্ছের একটা সঠিক গন্তব্য আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছেন।
(একটু থেমে)

কিছুক্ষন আগে তোমার মামুনি-মামা দুজনেই আমার সাথে ফোন কথা বলেছেন। তারা চাইছেন,
তারা চাইছেন তাদের ছেলের বউ হিসেবে তোমাকে ঘরে তুলতে।
পূর্ণতা জানত এ কথা।সেলিনা স্বয়ং তাকে জিজ্ঞেস করেছেন সে ধ্রুবকে বিয়ে করবে কীনা!তাই আর অবাক হলোনা।লজ্জ্বা পেয়ে নিচের দিক তাকাল।আশরাফ ফের বলে ওঠেন,
‘ওনারা কাল-পরশু তোমাকে আংটি পরাতে আসবেন।কথাটা শোনামাত্র আমি ছুটে এসেছি বাড়িতে।অপেক্ষা করছিলাম তোমার জন্যে।ভাবি আমাকে বলেছেন এ বিয়েতে তুমি রাজি।উনি কথা বলেছেন তোমার সাথে। তবুও আমি তোমার অমতে কিছু করবনা। তোমার নিজের মুখ থেকে শুনব তুমি সত্যিই চাও কীনা বিয়েটা হোক।
পূর্ণতা মুচকি হাসল।সরাসরি হ্যা বলতে পারলনা জড়োতায়।আশরাফ মেয়ের হাসি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন,
“যাক!আমি আমার উত্তর পেলাম।তুমি আর ধীর যখন একে অন্যকে পছন্দ করো,তবে আমার আর কোনো দ্বিমত নেই।ধীর তোমাকে খুব সুখে রাখবে আমি জানি।

পূর্ণতা চমকে মাথা তুলল।ভ্রু কুঁচকে নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করল,
‘ধধীর ভাইয়া মমানে?
পূর্ণতার চেহারার আমূল পরিবর্তন স্পষ্ট দেখলেন সায়রা।তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললেন,

‘ভাইয়া -ভাবি তোকে ধীরের বউ করতে চাইছেন।ও তোকে ছোট বেলা থেকে ভালোবাসে।
পূর্ণতা স্তব্ধ।বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল সে।অস্পষ্ট কন্ঠে বলল ‘ কী!
পূর্ণতার মাথা ঘুরছে।ধীরের সাথে বিয়ে?এ কি করে সম্ভব? ধীরকে নিয়ে কোনো দিন এরকম কিছু ভাবেইনি সে।মামুনি কী তাহলে সেদিন ধীর ভাইয়ার কথা বলেছেন?আমিই কী বুঝতে ভুল করলাম?না না,এ বিয়ে কী করে হবে?এটাত ভুল বোঝাবুঝি। ধ্রুব কী জানেন এসব?পূর্ণতার কপাল বেয়ে ঘাম পরছে।দুশ্চিন্তায় এসিতেও ঘামছে সে
‘আমি,আমি একটু আসছি বাবা।
ব্যাস্ত কন্ঠে আওড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল পূর্ণতা।এক্ষুনি ধ্রুবর কাছে যেতে হবে তাকে। মেয়ের যাওয়ার দিক চেয়ে আশরাফ সায়রাকে বললেন,
‘ওর কী হলো হঠাৎ?
সায়রা তখনও তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন।কেন যেন মনে হচ্ছে কোথাও একটা গোলমাল চলছে।পূর্ণতা ধীরের নাম শুনে এত চমকাল কেন?
____
ঘরের জানলা দিনের বেলাতেও বন্ধ।ভারি পর্দাগুলোও টেনে দেয়া।দরজায় তুলে রাখা ছিটকিনি।যাতে চাইলেই কেউ প্রবেশ করতে না পারে।রুমের এক কোনার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে ধ্রুব।চারপাশে অসংখ্য আধখাওয়া সিগারেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে।আরেকটা জ্বলন্ত সিগারেট ধ্রুবর আঙুলের ভাঁজে।থেমে থেমে খুকখুক করে কাশছে সে।জীবনে প্রথম বারের মত সিগারেটে ঠোঁট ছোঁয়াল।প্রথম টানেই কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপের দিকে।কিন্তু ধ্রুব দমে যায়নি।একের পর এক সিগারেট টানছে সে।কাল রাতে সেই যে রুমে ঢুকেছে বের হয়নি এখনও।সকালবেলা বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য তাকে ডেকেছে।ধ্রুব উত্তর পাঠিয়েছে,
‘বিরক্ত কোরোনা।যাও।
মেহবুব আর ধীর বেরিয়ে গেলেন কাজে।সেলিনা তারপর আবার ডাকতে এলেন।
‘এই ধ্রুব খাবিনা?খেয়ে যা বাবা।আমি বের হব একটু।
ধ্রুব এবার মায়ের ওপর চেঁচিয়ে উঠল,
‘বলেছিতো বিরক্ত কোরোনা।আমার খিদে পেলে আমি নিজেই খাব।এত ডাকার কী আছে?
ধ্রুবর বন্ধ দরজার দিক চেয়েই সেলিনার চোখ ভিজে উঠল।ধ্রুব কখনও তার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি।অভিমান করে চলে গেলেন।কিন্তু তখনও ধ্রুব দরজা খোলেনি বলে ভাবলেন হয়ত ছেলেটার মন ভালো নেই।বিরক্ত না করাই ভালো হবে।মাঝেমধ্যে ওদেরও একলা ছাড়া উচিত।তারপর আর ডাকেননি সেলিনা।বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।কাল পূর্নতাকে আংটি পরাতে যাবেন।ভালো দেখে আংটি কিনতে হবে আজ।

সময় পার হলো ওভাবেই।খালি পেটে সিগারেট খাওয়ায় ধ্রুব বমি করল দুবার।পড়নের শার্ট বুকের কাছ থেকে ভিজে আছে।কাঁদছে ধ্রুব।নিঃশব্দে,নীরবে।ভালোবাসায় এত কষ্ট?এই অল্পদিনের ভালোবাসা ভুলতে হবে ভেবেই যদি এত কষ্ট পায়,ধীর তবে কী করবে?সেতো সাতটা বছর ধরে পূর্ণতাকে চায়।ওতো মরেই যাবে।না,ধ্রুব কোনও দিন পারবেনা এরকম করতে।ভাইয়ের কষ্টের,যন্ত্রনার কারন হয়ে পূর্ণতাকে আপন করা দুঃসাধ্য। কোনো দিন পারবেনা ধ্রুব।এতটা স্বার্থপর সে নয়।

একপ্রকার ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকল পূর্ণতা।পুরো বাড়ি নিশ্চুপ।রান্নাঘর থেকে টুকিটাকি শব্দ আসছে।কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।পূর্ণতার অত ভাবার সময় নেই।সে ত্রস্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে সোজা ধ্রুবর রুমের দিক গেল।পথে হাজার করা প্রার্থনা ‘ধ্রুব যেন বাড়িতেই থাকে’ফলল যখন দেখল ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।পূর্ণতা একটু হলেও স্বস্তি পেল।যাক,ধ্রুব বাড়িতেই আছে।
দরজায় করাঘাতের শব্দে মুখ বিকৃত করে তাকাল ধ্রুব।
‘মা আমি বলেছিত আমাকে ডাকবেনা।
ওপাশ থেকে উত্তর এল,
‘আমি পূর্ণতা!দরজাটা খুলুন প্লিজ।
পূর্ণতার গলা কাঁপছে।ধ্রুবর বিরক্তি উবে গেল।ভ্রু শিথিল করে দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে।এগোতে ধরবে হঠাৎ কিছু একটা মনে করে দাঁড়িয়ে গেল।
‘মায়াপরি আর তোর মায়াপরি নেই ধ্রুব।মনে রাখিস।
ধ্রুব ঢোক গিলল।দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল পূর্ণতা।দরজা চাপিয়ে কিছু বলতে নেবে এর আগেই ধ্রুব প্রশ্ন ছুড়ল,
“তুমি এখানে?
পূর্ণতা নাকমুখ কুঁচকে ফেলল।ধ্রুবর গাঁ থেকে সিগারেটের উৎক গন্ধ আসছে।রুমের দিক চোখ পরলে দেখল পুরো রুম অগোছালো।ফ্লোরের এক পাশ জুড়ে শুধু পোড়া সিগারেট,আর ছাই পরে আছে।এর থেকেও অবাক হল ধ্রুবর চোখমুখ দেখে।চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে ফুলে আছে।মাথায় জেল দিয়ে সেট করা চুলগুলো আজ এলোমেলো, উসকো খুসকো।গোলাপ পাপড়ির মত ঠোঁট যুগল,শুকনো,খড়খড়ে।পূর্ণতা আর্তনাদ করে বলল,
‘একি!কী অবস্থা আপনা__
‘কেন এসেছ পূর্ণতা?
ধ্রুবর গুমোট কন্ঠ।পূর্ণতা চোখ পিটপিট করল বিস্ময়ে।ধ্রুব আজ অব্দি তো কখনও নাম ধরে ডাকেনি।ভালোবেসে ‘মায়াপরি’ বলেছে।আজ সব কিছু অচেনা লাগছে কেন ওর?তার দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা চোখ গুলোও কেমন নিষ্প্রান।দুষ্টুমিতে মেতে থাকা ধ্রুবকে চিনতে সত্যিই বেগ পোহাচ্ছে পূর্ণতা।
‘তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি পূর্ণতা।
ধ্রুব ফের শুধাল,এবার চড়া হলো তার কন্ঠ।পূর্ণতা নড়ে উঠল ধ্যান থেকে।ধ্রুবর এমন কথার সঙ্গে সে পরিচিত নয়।মাথা নামিয়ে বলল,
‘আপনার কাছে এসেছি।
ধ্রুব ভ্রু কোঁচকালো,
‘আমার কাছে তোমার কী দরকার?
পূর্ণতা তাকাল,
‘কেন?আপনার কাছে আমার কোনো দরকার থাকতে পারেনা ধ্রুব?
ধ্রুব কঠিন কন্ঠে বলল,
‘না।আর আমি তোমার থেকে বড় পূর্ণতা।বড়দের নাম ধরে ডাকাটা বেয়াদবি।তাই ধ্রুব নয়,ভাইয়া বলে ডাকবে।
পূর্ণতার ভ্রু কুঞ্চন গাঢ় হলো,
‘কিন্তু আপনিইতো আমাকে বারন করেছেন।
‘এখন বলছি।তাই এখন থেকে ডাকবে।
পূর্ণতা ধৈর্যহারিয়ে বলল,
‘আপনার কী হয়েছে ধ্রুব?এমন করছেন কেন?আমার সাথে রাগ করেছেন?আমি কী কিছু করেছি?
ধ্রুব স্বাভাবিক ভঙিতে তাকাল,
‘তোমার সঙ্গে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই পূর্ণতা।যাতে আমি তোমার ওপর রাগ করব।
‘এভাবে বলছেন কেন?আমিতো__
ধ্রুব হাত উঁচু করে থামিয়ে দিল,
‘যা বলতে এসেছ তাই বলো।বাড়তি কথা বলে আমার সময় নষ্ট কোরোনা।
পূর্ণতার চেহারায় মেঘ জমল।ধ্রুবর এই রুপ সত্যিই চেনেনা সে।কিন্তু যেটা বলতে এসছে সেটাও তো জরুরি।
পূর্ণতা খুব মৃদূ কন্ঠে বলল,
‘একটা বড় ঝামেলা হয়ে গেছে।বাড়ির সবাই আমার আর ধীর ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করেছে।কাল নাকি মামা মামুনি যাবেন আংটি পরাতে।
” তো?
ধ্রুবর নিরুদ্বেগ জবাবে পূর্ণতা হতবাক হয়ে তাকাল।
‘তো মানে?

“মানে বিয়ে ঠিক করেছে, এটাতো ভালো খবর।এর জন্যে আমার কাছে আসতে হবে কেন?ভাইয়াকে কী তোমার পছন্দ নয়?
পূর্ণতা স্তম্ভিত। আর্তনাদ করে বলল,
“ধ্রুব! এমন একটা সময়েও তুমি মজা করছো?তুমি জানোনা আমার কী পছন্দ?কাকে পছন্দ?
ধ্রুবর কাটকাট জবাব,
“না জানিনা।আর জানার কোনও প্রয়োজনও বোধ করছিনা।বিয়ে ঠিক হয়েছে তো বিয়ে করে নাও।
ধ্রুব ঢোক গিলল ফের।ধ্রুবর শক্ত কন্ঠে পূর্ণতা দৃঢ়ীভূত।
“এসব,এসব তুমি কি বলছো ধ্রুব!আমি কি করে ধীর ভাইয়াকে বিয়ে করব?ধ্রুব আমি,আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে চাই।
শোনামাত্র পেছন ঘুরে গেল ধ্রুব।দেয়ালের দিক চেয়ে চোখের জল গড়াল।আনন্দ,কষ্ট,দুঃখ সব একসাথে আজ গলা চেপে ধরেছে।দম বন্ধ হয়ে আসছে।এই প্রথমবার পূর্ণতার মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনল।অথচ পারলনা একটি বার ওকে বুকে জড়াতে।পারলনা ওর মুখটা আজোলে তুলে কপালে চুঁমু দিতে।আর কখনও পারবেওনা।পূর্ণতাকে ছোঁয়ার অধিকার তার নেই।মায়াপরি তার বড় ভাইয়ের ভালোবাসা।সে অন্য কারো অনুভূতি।অথচ
মনে মনে আওড়াল
“আমিও তোমায় ভালোবাসি মায়াপরি! বড্ড বেশি ভালোবাসি।
ধ্রুব বুকের কাছ থেকে শার্টটা খামচে ধরে শ্বাস টানল।প্রানপণ চেষ্টা করল স্বাভাবিক হওয়ার।সময় নিয়ে ফিরে তাকাল পূর্ণতার দিক।পূর্ণতা কাতর চোখে তাকিয়ে।ধ্রুবর বুক মোচড় দিয়ে উঠলেও সামলে নিল নিজেকে,
“কিছু বলছিলে পূর্ণতা?

পূর্ণতা করুন কন্ঠে বলল,
‘কেন এরকম করছো ধ্রুব?প্লিজ এরকম কোরোনা।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।কয়েক ঘন্টা আগেও তো সব ঠিক ছিলো।তুমি ঠিক ছিলে,আমি ঠিক ছিলাম।তাহলে এর মধ্যে হঠাৎ কী হলো তোমার?
ধ্রুব অন্যদিক চেয়ে বলল,
‘আমি এখনও ঠিকই আছি।

‘না তুমি ঠিক নেই।ভুলভাল বলছো তুমি।ভুল আচরন করছো।এসব ছাড়ো এখন,আমার সাথে চলো ধ্রুব, বিয়েটা আমাদের আটকাতে হবে।আমরা দুজন মিলে সবাইকে বোঝাব, যে তারা যা ভাবছে আসলে ব্যাপার টা ভুল।আমি ধীর ভাইয়াকে নয়,তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো।চলো।
পূর্ণতা ধ্রুবর হাত ধরল।সঙ্গে সঙ্গে হাত ঝাড়া মারল ধ্রুব।অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘ওয়েট ওয়েট!কি বললে তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি? তোমাকে?
শব্দ করে হেসে উঠল ধ্রুব।হাসতে হাসতে বলল,
‘বেস্ট জোক্স অফ মাই লাইফ!
পূর্ণতা গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে।ভেজা কন্ঠে বলল,
” কেন,ভুল কি বললাম? তুমি আমাকে ভালোবাসো এটাই তো সত্যি।
ধ্রুব হাসি থামিয়ে রুষ্ট চোখে তাকাল।শক্ত কন্ঠে বলল,

” না। এটা সত্যি নয়।আমি কেনো তোমাকে ভালোবাসতে যাবো?অদ্ভূত! আমি কখনও বলেছি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি?
আফনান খান ধ্রুবর পেছনে তোমার মত হাজার পূর্ণতার লাইন লেগে আছে।সে তোমাকে ভালোবাসতে যাবে কোন দুঃখে? তোমার মত একটা ঘরকূনো মেয়ে,যার কীনা কোনও যোগ্যতা নেই আমার পাশে দাঁড়ানোর।তাকে আমি ভালোবাসব?আমি?ভেরি ফানি!

পূর্ণতা থমকে গেল।থমকে গেল তার পৃথিবী।চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে গলা অব্দি এল।
“এতটা অপমান আমাকে করতে পারছো ধ্রুব?
পূর্ণতার কন্ঠে অবিশ্বাস।
একটু থেমে বলল
হ্যা তুমি মুখে ভালোবাসি বলোনি।কিন্তু তোমার প্রত্যেক টা কথা,প্রত্যেক টা আচরন,আমাকে বুঝিয়েছে তুমি আমাকে ভালোবাসো।কাল, কালতো বলতেই যাচ্ছিলে ভালোবাসার কথা।তাহলে কেন অস্বীকার করছো ধ্রুব?এতদিন ধরে তোমার ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শে আমি ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি।কাল ওয়াশরুমে আমার ঠোঁটে তোমার ছোঁয়া,সেই ছোঁয়াকি তবে ভালোবাসার ছিলনা ধ্রুব?

ধ্রুব প্রচন্ড অনীহ কন্ঠে বলল,
“ও প্লিজ!এইসব সিনেম্যাটিক ডায়ালগ থামাও।আমিতো বললাম আমি তোমাকে ভালোবাসিনি।আর না বাসব।যা ছিলো তার সবটাই যাস্ট সময় কাটানো,আই মিন টাইম-পাস।তোমাকে বোঁকাসোকা পেয়ে ভাবলাম একটু বাজিয়ে দেখি।আর তুমিও এসব ভালোবাসা ভেবে নিলে?হাউ স্টুপিড ইউ আর!
ধ্রুবর এরকম ছোটখাটো স্পর্শ অনেক মেয়েই পেয়েছে।তাই বলে কি আমি তাদেরও ভালোবাসি?
ইনফ্যাক্ট নোরাকেও তো আমি কিস করেছি, হাগ করেছি।ওর ঠোঁটেও একইভাবে__
ধ্রুবর কথা সম্পূর্ণ হলোনা।এর আগেই পূর্ণতা ঠাস করে চড় বসাল গালে।ধ্রুবর চোখ নিবদ্ধ হলো মেঝেতে।সে আর তাকালনা পূর্ণতার দিক,
‘ছি!এতটা নীচ তুমি?এতটা নোংরা!আই হেইট ইউ।ঘেন্না করি আমি তোমায়।
পূর্ণতা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।যন্ত্রনায় একশেষ মন-মস্তিষ্ক নিয়ে বেখেয়ালে ছুটতে গিয়ে পাপোসে বেঁধে উলটে পরে যেতে ধরল।কোত্থেকে এসে ধরে ফেলল ধীর।উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
‘এক্ষুনি তো পরে যেতিস পূর্না।ছুটছিলি কেন এভাবে?
পূর্ণতা অশ্রুসজল চোখে তাকাল।ধীর হোচট খেল যেন,
‘কাঁদছিস কেন তুই?কি হয়েছে?
পূর্নতা তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে বলল,
‘কিছুনা। ছাড়ো।
পূর্ণতাকে ছেড়ে সরে এল ধীর।তখনও চিন্তিত দৃষ্টিতে পূর্ণতাকে দেখছে সে।পূর্ণতা ধীরের দিকে একবারও না দেখে হাটতে নিল।কিন্তু বাঁধ সাধল বাম পা’টা।কোনার আঙুলদুটো মুচড়ে গিয়েছে।পূর্ণতা ব্যাথা পেলেও টু শব্দ করলনা।বুকের ব্যাথার থেকে এই ব্যাথা হাজারগুনে কম।কিন্তু মুখ বিকৃত করতে দেখেই ধীর বুঝে ফেলল।
ধরতে এলেই পূর্ণতা থামিয়ে দিল,
“আমি পারব।
পূর্ণতার ভাঙা বরফ কন্ঠ।ধীর তবুও মানলনা।কিছু না বলেই কোলে তুলে নিল ওকে।পূর্ণতা রেগেমেগে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।ধীরের তো দোষ নেই কোন।ধ্রুবর মেজাজ ওর ওপর দেখিয়ে কী লাভ?আসল দোষী সে নিজেই।না জেনে,না বুঝে এমন একটা লোককে ভালোবাসল,যে এক বিন্দু দাম দিলোনা তার অনুভূতির।
পূর্ণতা আরো একবার ভেজা চোখে ধ্রুবর দরজার দিক তাকাল।দরজা চাপানো।পূর্ণতার গাল বেয়ে আবার জল গড়াল।ধীর তাকে কোলে নিয়েই বেরিয়ে গেল সদর দরজা হতে।
ধ্রুব ঘরের দরজায় ফের ছিটকিনি তুলল।সাউন্ড সিস্টেমে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে বসে পরল মেঝেতে।গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল তারপর।পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই।কেন?তাদের কী কষ্ট হয়না?তাদের কী বুক পোড়েনা?পোড়েতো।এই যে তার পুড়ছে।ভেতরটা জ্বলছে।ধীরের কোলে পূর্ণতাকে মেনে নিতে পারছেনা।গলা চেপে ধরছে অদৃশ্য কিছু।কিন্তু মানতে যে হবেই।এটাইতো নির্মম, নিষ্ঠুর সত্যি।ধ্রুব কাঁদতে কাঁদতে আওড়াল,
‘আমাকে ভুলে যেও মায়াপরি।ভাইয়াই হোক তোমার সুখ,তোমার ভালোবাসা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here