ফাগুন_এলো_বুঝি! (৩৩)

0
982

#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(৩৩)

ঘরের মধ্যে নীরবতার বাতাস বইছে।দুই মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দুজন।তখন হুট করেই পূর্নতার কী যেন হলো!মাঝপথেই ধ্রুবকে ছেড়েছুড়ে নেমে এল ছাদ থেকে।ধ্রুব এল খানিকক্ষন পর।ঘরে এসে পূর্নতার মুখ থেকে একটা শব্দও শুনলনা।সেই থেকে বারান্দায় বসে আছে।ধ্রুব কতবার ডেকে এল।উত্তর অব্দি দিলোনা।এতেই যেন চরম হতাশায় ঘিরে ধরল তাকে।
ভাবল,
” সব কিছু খুলে বলার পরেও দূরে সরে থাকতে চাইছো মায়াপরী?থাকো।আর বিরক্ত করবনা তবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দা থেকে চোখ ফেরাল ধ্রুব।বিছানায় শুয়ে বামহাতটা আড়াআড়ি রাখল কপালের ওপরে। কখন ঘুমিয়ে পরল নিজেও বুঝলনা।পূর্ণতা তারও অনেক পরে রুমে ঢুকল।বিছানায় গিয়ে ধ্রুবর গায়ে পাতলা কাথা টেনে দিল আগে।কপালের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে বুকের ওপর রাখল ধ্রুবর।এরপর নিজেও আলগোছে শুয়ে পরল পাশে।অনেকক্ষন ঘুমোনোর চেষ্টা করেও কাজ হলোনা।আজকাল সহজে ঘুম আসেনা পূর্নতার।অনেক রাত করে ঘুমোয়,ওঠেও বেলা করে।ভাগ্যগুনে মামুনিকে শ্বাশুড়ি হিসেবে পেয়েছিল,অন্য কেউ হলে খবর করে ছাড়ত।সব শ্বাশুড়ি বউদের বেলা করে ঘুম ভালো চোখে দেখেনা।
সেলিনার কথা মনে পড়তেই পূর্নতা উঠে বসল।ধীরেসুস্থে নেমে ওনাদের ঘরের দিকে এগোল।কাল থেকে ভার্সিটি যাবে।রোজকার আড্ডা হবেনা।হলেও খুব কম।তাই এখন গিয়েই একটু কথা বলে আসবে নাহয়!
______
পূর্ণতা ঘরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পরল।সেলিনা ফ্লোরে বসে,সোফায় মেহবুব।সযত্নে স্ত্রীর চুলে তেল লাগাচ্ছেন।বোতল থেকে একটু একটু করে তেল তালুতে ঢেলে মেখে দিচ্ছেন চুলে।পূর্নতার চোখ জুড়িয়ে গেল।নীচের দিক চেয়ে মুচকি হাসল সে।পরপর গলা ঝেড়ে বলল
“আসতে পারি?
মেহবুব-সেলিনা একসঙ্গে তাকালেন।সেলিনার ঠোঁটে ভর করল শুভ্র হাসি।কিন্তু মেহবুব অবাক হওয়ার ভাণ করে বললেন,
” ওরে বাবা! এ কে এলো আমার ঘরে?
পূর্ণতা ঠোঁট ওল্টাল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“এভাবে বলছো কেনো মামা?আমি বুঝি আসিনা?
” সেতো মামুনির কাছে আসিস।আমি থাকাকালীন কবার এসছিস বলতো?
“আমি তোমাদের দুজনের কাছেই আসি।বুঝলে!
সেলিনা হেসে বললেন,
” বোস!ধ্রুব ঘুমিয়েছে?
পূর্ণতা সেলিনার মুখোমুখি মেঝেতেই বসল,বাবু হয়ে।
“হ্যা।
” তুই এখনও জেগে কেন?
‘আমার ঘুম আসছেনা।তুমি রাতের বেলায় চুলে তেল লাগাচ্ছো মামুনি?সব তো বিছানায় মাখবে।
“আমি লাগাতে চাইনি।তোর মামার ভালোবাসা হঠাৎ উত্থলে উঠল আজ,ধরেবেধে বসিয়ে দিল।তার নাকি শখ জেগেছে চুলে তেল লাগাবেন।

মেহবুব বাচ্চাদের মত গাল ফুলিয়ে বললেন
” এভাবে বলছো শেলী,আমার যত্নের দাম দিচ্ছোনা?
“হ্যা তাইজন্যে গত আধঘন্টা ধরে খালি তেলই মাখছো।আমার যে ঘাড় সব ব্যাথা হয়ে গেল?তার বেলা?
মেহবুবের ফোলানো গাল এবার চওড়া হলো আরো।পূর্নতা সেটা দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
সেলিনা মুখ কুঁচকে বললেন,
‘তুই হাসছিস?তোর মামার পাগলামোর কথা তো জানিস না ভালো করে।সকালে হয়েছে কী শোন,
আমার বারান্দায় দুটো গোলাপ ফুঁটেছিল না?
পূর্ণতা মাথা নাড়ল ‘ হ্যা।
” ঘুম থেকে উঠে দেখি একটা ফুল গায়েব।

“কে ছিড়ল?
“কে আবার?এই যে এই ভদ্রলোক।ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে আর কোত্থাও ফুল পাননি উনি।তাই আমার অবলা গাছ টার বারোটা বাজালেন।
পূর্নতা তাকাতেই মেহবুব অসহায় মুখ করে বললেন,
“কি করবো বল,,টাটকা ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানাতে যে আনন্দ, সেটা কি দোকানের মরা ফুল দিয়ে আসে?তুই-ই বল!
পূর্ণতা মুখ চেপে হেসে বলল,
” এটা কিন্তু মামা ঠিক বলেছে মামুনি।থাক, তুমি এতো রাগ করোনা,,ও ফুল আবার ফুঁটবে।
মেহবুব উদ্বেগ নিয়ে বললেন
” না না,তিনি রাগ করেনি।বরং কানের পাশে ফুল গুঁজে__
সেলিনা যত্র থামিয়ে দিলেন,
“উফ তুমি থামবে! বাচ্চা মেয়েটার সামনে কি সব বলছো?
পূর্ণতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আমি বাচ্চা নই মামুনি।আমি সব বুঝি!

“হ্যা হ্যা যেমন মামা তার তেমন ভাগ্নী!এখন তো আবার যোগ হয়েছে শ্বশুর -পুত্রবধু!
সেলিনা উঠে দাঁড়ালেন।মেহবুবের হাত থেকে চিরুনি আর পাশ থেকে তেল নিয়ে রেখে দিলেন ড্রেসিং টেবিলের তাকে।চুল হাত খোপা করতে করতে পূর্নতাকে শুধালেন,
” মিশুর শরীর এখন কেমন রে?সারাদিন বলছিল ভালো লাগছেনা।
‘আমি তো জানিনা মামুনি।সন্ধ্যের পর দেখা হয়নি।
মেহবুব সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“হ্যা গো,আজকের পত্রিকা কোথায়?পড়া হয়নি।
‘এখন কয়টা বাজে দেখেছ?অফিস যাবেনা কাল?পত্রিকা পড়তে বসলে ঘুমোবে কখন?
মেহবুব নিশ্চিন্ত কন্ঠে বললেন,
‘এখন কী আর আগের মত চাপ পড়বে ঘাড়ে?এখন আমার ছেলে ব্যাবসার ভার নিয়েছে।আমার আরামের সময় এলো বলে।

মেহবুব উঠে গেলেন পত্রিকা আনতে।সেলিনা পূর্ন দৃষ্টিতে পূর্নতার দিক চোখ বোলালেন।ওকে চুপচাপ দেখে বললেন,
” তোর কী মন খারাপ?
পূর্ণতা ঘাড় কাত করে তাকাল ” না তো।
‘চুপ করে আছিস কেন?কথা বল।গল্প কর।
পূর্ণতা মৃদূ হাসল।সেলিনা বিছানার চাদর টেনে ঠিকঠাক করছেন।পূর্ণতা তার দিকে ঘুরে বসে বললেন,
“আচ্ছা মামুনি, তোমাদের তো লাভ ম্যারেজ।তাইনা?
সেলিনা উত্তর দিলেন,
” হ্যা।
“তোমাদের এই ভালোবাসার সম্পর্কে কখনও ভুল বোঝাবুঝি বা ঝগড়া হয়নি?
সেলিনা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।ভ্রু কপালে তুলে বললেন,
” ঝগড়া আবার হয়নি?আমাদেরতো ঝগড়া লেগেই থাকে।এখনও হয়।দুদিন পরে দাদা-দাদী হব অথচ কোমড় বেঁধে ঝগড়া করি।কিন্তু তবুও আমরা কেউ কারো হাত ছাড়িনি।সব সময় একে অন্যকে বিশ্বাস করে গেছি।আসলে কি বলতো পূর্নতা,ভালোবাসার মূল ভিত্তিইতো বিশ্বাস,ভরসা।অপরপাশের মানুষটার প্রতি আস্থা।
সেলিনা মৃদূ হেসে বারান্দার রকিং চেয়ারে বসা মেহবুবের দিকে তাকালেন।তার গভীর মনোযোগ খবরের কাগজে।সেলিনা ফের তাকালেন ভাবুক পূর্নতার দিকে।বললেন,
“তাছাড়া সামান্যতম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও অপর পাশের মানুষ টাকে বলতে সুযোগ দিয়েছি তাই আর দুরুত্ব বাড়েনি।তা হঠাৎ এসব কথা কেন?
পূর্ণতা ছোট করে বলল,” এমনি।

পূর্ণতা উঠে দাঁড়াল।
“অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।ঘুমিয়ে পরো।আসছি এখন।
” দাঁড়া।
সেলিনা এগিয়ে পূর্নতার কাছে এলেন।ওর থুতনী ধরে বললেন,
“ধীরকে ভালোবাসলেও তোর বিয়েটা ধ্রুবর সঙ্গে হয়েছে।ধরে নে এটাই ভাগ্য।আল্লাহ আগে থেকে লিখে রাখেন সেখানে কে থাকবে!ধ্রুব ছিল বলে ওই হয়েছে তোর স্বামী।সম্পর্কটা সহজ,সুন্দর করার চেষ্টা কর।ধ্রুবকে সুযোগ দে।তুইও উদ্যোগ নে,মনের দুরুত্ব ঘোচানোর।সুখি হবি,দেখিস!
পূর্ণতা কিছু বললনা।মামুনিতো আর জানেনা,সে ধ্রুবকে ভালোবেসেই কূল কিনারা হারাচ্ছে।ধীরের সেখানে কোনও জায়গাই নেই।মাথা নাড়ল শুধু। এরপর গুটিগুটি পায়ে ত্যাগ করল ঘর।ভাবল,
” দুরুত্ব তো অনেক বেড়েছিল।এবার সময় হয়েছে সব ঘুচিয়ে নেওয়ার।
____
সকাল সকাল খান বাড়িতে আশরাফ-সায়রাকে দেখে অবাক হলেন মেহবুব।অথচ হেসে বললেন,
‘আরে তোমরা যে!এসো এসো।তা এলে কখন?
আশরাফ বললেন,
‘কাল রাতে ল্যান্ড করেছি ভাইজান।জানানো হয়নি আপনাদের।
‘বসো।ভালো হয়েছে এসেছ।মিস করছিলাম তোমাদের।
আশরাফ-সায়রা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বসলেন।মেহবুব উচু কন্ঠে বললেন,
“শেলী দেখো কে এলো।তিন কাপ চা পাঠাও।
‘কে এসছে?
সেলিনা গলা নামিয়ে উঁকি দিলেন।সায়রাদের দেখতেই উৎফুল্ল পায়ে এগিয়ে এলেন।
সায়রা উঠে দাঁড়ালেন।দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন তারপর ।
” কেমন আছো?
“ভালো।তুমি?
‘খুব ভালো।
সায়রা আশরাফের দিক তাকালেন।তাদের মুখে চিন্তার ছাপ।অথচ ভাইয়া ভাবিকে কি চনমনে লাগছে!তবে যে ধীর___
সেলিনা রাহেলাকে চা দিতে বললেন।তারপর নিজেও বসলেন ওদের পাশে।মেহবুব ব্যাবসা সম্পর্কিত কথা তুললেন।ধ্রুব ব্যাবসায় যোগ দিয়েছে এটাই মূল বিষয় আলোচনার।এর মধ্যে বেনি চা দিয়ে গেল।আশরাফ, সায়রা দুজনেই চুপচাপ শুনছেন।আশরাফের হাতে চা তুলে দিলেন সেলিনা।সাথে বললেন,

” আপনারা এসছেন খুব ভালো হয়েছে আশরাফ ভাই।কাছের মানুষরা বিদেশে থাকলে ভালো লাগে?মেয়েদুটোও কী মিস করছিল আপনাদের!
আশরাফ শেষমেষ আর টিকতে পারলেন না।বলেই ফেললেন,
“বাড়িতে কী কোনও সমস্যা হয়নি ভাবি?
সেলিনা বুঝতে না পেরে মেহবুবের দিক তাকালেন।মেহবুব বললেন,
” সমস্যা বলতে?ঠিক বুঝলাম না আশরাফ।
সায়রা থেমে থেমে বললেন,
‘আসলে ভাইজান,ভোরের দিকে ধীর আমাদের ফোন করেছিল।বলল বাড়িতে একটা সমস্যা হয়ে গেছে,সকাল সকাল যেন চলে আসি আমরা।কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারিনি এর আগেই লাইন কেটে দিল।তোমরা ঘুমে থাকবে ভেবে কাউকে ফোন ও করিনি।ওই জন্যেইতো আমরা এত সকালে এলাম!

‘ধীর এসব বলেছে?কেন?
“জানিনা ভাবি।
মেহবুব বললেন,
” আমিওতো কিছু বুঝতে পারছিনা।সবতো ঠিকঠাকই আছে।ধীরকে ডেকে পাঠাওতো সেলিনা।উঠেছে ও?
“দেখছি!
সেলিনা উঠতে নিলেন,ওপর থেকে তখন ধীরের কন্ঠ ভেসে আসে।
” দরকার হবেনা,আমি চলে এসেছি।
ধীরের পাশাপাশি নামছে মিশরা।ধীরের স্ফূর্ত ভাবমূর্তি
থাকলেও মিশরা অনুচিন্তায় মগ্ন।ধীর এসে সিড়ির শেষ ধাপে দাঁড়াল।মিশরা গেল মা-বাবার কাছে।
ধীর বেনিকে ডাকল।বেনি আসতেই হুকুম দিল,
‘পূর্নতা আর ধ্রুবকে ডেকে নিয়ে আয়।
‘ওদের এখানে কী দরকার?ওরা ঘুমোচ্ছে যখন__
“দরকার আছে মা।পূর্নার থাকা সবচে বেশি জরুরি এখানে।
কেউ-ই কিছু বুঝে উঠলেন না।সায়রা চাপা কন্ঠে মিশরাকে শুধালেন,
” কী হয়েছে রে?
মিশরা নিশ্চুপ।একটু পর বেনি আগে আগে নামল।পেছনে এল পূর্নতা।ধ্রুব নেই দেখে ধীর বেনিকে জিজ্ঞেস করল,
‘ধ্রুব কোথায়?
‘আসতেছেন।
পূর্ণতা বাবা – মাকে দেখেই দৌড়ে গেল।আগে গেল সায়রার কাছে,
‘কখন এলে ছোট মা?
সায়রা পূর্নতাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে।
‘একটু আগে।
পূর্ণতা বাবার কাছে গিয়ে তাকেও জড়িয়ে ধরল।
‘তোমরা আসবে বলোনি তো আমায়।
আশরাফের আগেই ধীর বলল,
‘ওনাদের আমি আসতে বলেছি।
“সেটাইতো প্রশ্ন ধীর।তুমি ওদের মিথ্যে বলে এনেছ কেন?
মেহবুবের কথায় ধীর পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়াল।
‘শুনবে বাবা।সব শুনবে।তবে আজ আমি কিছুই বলবনা।যা বলার মিশু বলবে।
ধীর মিশরার দিক চেয়ে বলল,
” কীরে মিশু, শুরু কর!
______
বসার ঘরে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত পরল।মিশরার কথায় প্রত্যেকে বাক্যহারা এখন।বিয়ের দিন ঘটানো সব কথা একে একে স্বীকার করে মাত্রই থামল সে।অকপটে স্বীকার করল”সব দোষ তার।ধীর ছিল নির্দোষ!সেই থেকেই বলার মত কিচ্ছু পেলনা কেউ।থমথমে চেহারায় যে যার জায়গায় স্থির হয়ে থাকল।
মেহবুব লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে রেখেছেন।চোখ তুলতে পারছেন না।সেদিন ধীরকে অবিশ্বাস করে জোড়পূর্বক মিশুর সাথে বিয়ে দিলেন।পূর্নতাকে গছিয়ে দিলেন ধ্রুবর সঙ্গে।ইশ!কত বড় ভুল করে ফেললেন!ছেলে মেয়ে গুলোর জীবন নিজ হাতে নষ্ট করে দিলেন।
পূর্নতা পিলারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।দৃষ্টি টাইলসের মেঝেতে।এই ঘটনা নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যাথা নেই।হ্যা মিশরার কান্ডে অবাক হয়েছিল,ধীরের জন্যে মায়াও লেগেছে,কিন্তু একটা ব্যাপার তো ভালো ঘটল এতে।বিয়েটা আটকে গেল।নাহলে পূর্নতাতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেদিন।শুনতে খারাপ লাগলেও,ভেবেছিল বিয়ের আগেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে।
তাহলে কি বলা যায় এখন,আল্লাহ যা করেছেন ভালোর জন্যেই?এরকম বলাতে সেকি খুব স্বার্থপর হয়ে গেল?

আশরাফ রেগে গেলেন।লজ্জ্বায় তার মাথা কাঁটা যাচ্ছে।লম্বা পায়ে গিয়েই ঠাস করে এক চড় মারলেন মিশরার গালে।হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সকলে।মিশরা গাল চেপে ধরল।পূর্নতা সচকিত হয়ে বলল,
– বাবা? এ কি করলে?
“একি করলেন আসরাফ ভাই?এত বড় মেয়েটার গায়ে হাত তুললেন?
কারোর কথার কোনও জবাব এলোনা।আশরাফ তপ্ত চোখে মেয়ের দিক চেয়ে।
মিশরা ছলছল চোখে তাকাল।
“আমাকে তুমি মারলে বাবা!
আশরাফ রেগে আগুন হয়ে বললেন,
” হ্যা। মারলাম।তোমার মত মেয়েকে মারাই উচিত।
মিশরা অপরাধির মত মাথা নামিয়ে নিল।মেহবুব বোঝানোর ভঙিতে বললেন,
” আশরাফ শান্ত হও,এটা মাথা গরম করার সময় নয়।
“আমাকে বলতে দিন ভাইজান।আমার আর আমার মেয়ের মাঝে আপাতত কেউ আসবেন না।
আশরাফ ফের মিশরার দিক তাকালেন।
” আমাদের শিক্ষায় কি এতোটাই গলদ ছিলো মিশু,যে তুমি তার এই প্রতিদান দিলে?নিজেকে বেইজ্জতি করে, জোর করে, ধীরকে বিয়ে করে কি লাভ হলো তোমার?
আর আমরা তোমাকেই বিশ্বাস করলাম সেদিন।ওই নির্দোষ ছেলেটার একটা কথাও শুনলাম না।ভুল বুঝে পূর্নতার সাথে বিয়ে ভেঙে দিলাম।আমার ভাবতেও লজ্জ্বা লাগছে,তুমি আমার মেয়ে?এই দাম দিলে আমার ভালোবাসার?ছি!ছি!
আশরাফের রাগের মধ্যেও গলা ভেঙে এল।মিশরা সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে বাবার পায়ের কাছে বসে পরল।দুহাতে পা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা!আমার ভুল হয়ে গিয়েছে!ও মম বাবাকে বলোনা,বাবাকে বলোনা মম আমাকে ক্ষমা করে দিতে।
মিশরা কেঁদেকেটে বলল।
সায়রা নিশ্চুপ।শুধু চোখের গড়িয়ে পরা পানি হাত দিয়ে মুছলেন।এখানে কিছু বলার মত মুখ তার নেই।
কিই বা বলবে?,ছোট বেলা থেকে মেয়েকে যা শেখাল, যা দেখাল,এসব তারই প্রতিফলন।তাই এখানে পুরোপুরি দোষের ভাগিদার সে-ই।মিশরা নয়।

পূর্নতা দ্রুত গিয়ে মিশরাকে ধরে ওঠাল।মিশরা কাঁদছে।পূর্নতা ওর চোখ মুছিয়ে দিল কোমল হাতে।এরপর বাকিদের দিক চেয়ে বলল,
” আচ্ছা,তোমরা আমাকে একটা কথা বলবে,মিশরাতো এসব আমার ক্ষতি করার জন্যেই করেছিল।যাতে আমার আর ধীর ভাইয়ার বিয়ে না হয়।তাহলে অবশ্যই সবার আগে আমার রাগ করা উচিত।কিন্তু আমার তো বিন্দুমাত্র রাগ হচ্ছেনা।তাহলে তোমরা কেন এতো রিয়্যাক্ট করছো? যা হওয়ার হয়েছে।এই নিয়ে আর কোনও কথা হবেনা। মিশরাকে তোমরা কেউ কিচ্ছু বলবেনা।কোনও কথা শোনাবেনা।

ধীর ছিল নিরব দর্শক।এতক্ষনের সব মেলোড্রামা পর্যবেক্ষণ করেছে।এবারে মুখ খুলল সে।পূর্নতার সঙ্গে তাল মেলাল,
– হ্যা, মিশু কে আর কেউ কিছু বলোনা প্লিজ!বেচারীর কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ধীর এবার মেহবুবের দিক তাকাল।
” দেখলে বাবা! সেদিন হাজার বার বলেছিলাম”আমি কিছু করিনি!অথচ তুমি শুনতেই চাইলেনা।আজ তো প্রমান পেয়েছ?
মেহবুব চোখ নামিয়ে মাথা নাড়লেন।অপরাধি কন্ঠে বললেন,
“পারলে তোমার বাবার অন্যায় কে ক্ষমা করে দিও ধীর।বড় ভুল করে ফেললাম!
ধীর মুচকি হাসল,
“ওসব আমি মনে রাখিনি।তুমিও রেখোনা।খালি ভুলটা শুধরে নাও বাবা।এটাইতো সময় তার।
মেহবুব তাকালেন।কপাল কুঁচকে বললেন
‘ভুল শুধরাব?মানে?
ধীর এগিয়ে এসে দাঁড়াল।
” মানে খুব সহজ।সেদিন যা করেছ, আমার সাথে মিশুর বিয়ে আর পূর্নার সাথে ধ্রুবর বিয়ে দিয়ে,যে ভুল তুমি করেছ সেটা কী এখন শুধরে নেওয়া উচিত নয়?
মেহবুব তখনও বুঝলেননা।বললেন,
“পরিষ্কার করে বলো।

ধীর বুক টানটান করে বলল,
“এখন আর বলার কী আছে? সত্যিটা তোমরা সবাই তো শুনলে।তাহলে এই মিথ্যে সম্পর্ক ঝুলিয়ে রেখে কি লাভ?তাই আজই আমার আর মিশরার,আর ধ্রুবর সাথে পূর্নার ডিভোর্স হবে।তারপরপরই পূর্নাকে বিয়ে করব আমি।

সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়!এতগুলো চোখ স্তব্ধ হয়ে ধীরের দিক তাকিয়ে।মিশরা বিহ্বল হয়ে বলল,
” এসব তুমি কি বলছো ধীর ভাইয়া?তুমিতো অামাকে বলেছিলে___
ধীর কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” আমি কি বলেছিলাম ওসব তুই ভুলে যা মিশু।এখন কি বলছি সেটা শোন।
“তার মানে তুমি আবার আমাকে মিথ্যে বলেছ?
ধীর সোজাসাপটা বলল,
” তুই যদি মিথ্যে বলে আমাকে চরিত্রহীন প্রমান করতে পারিস,তার কাছে এটা তো মামুলি ব্যাপার!
” তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস ধীর?কি বলছিস এসব?মিশু তোর স্ত্রী!
মায়ের কথায় চেঁতে গেল ধীর।চেঁচিয়ে বলল,
” মানিনা।আমি ওকে আমার স্ত্রী বলে মানিনা।কিসের স্ত্রী?এই পৃথীবিতে আমার স্ত্রী শুধু মাত্র পূর্না হবে আর কেউ না।
মিশরা গিয়েই ধীরকে নিজের দিক ঘোরাল।দুইবাহু আকড়ে ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
“এভাবে বোলোনা ধীর ভাইয়া! আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।
” কিন্তু আমি তোকে ঘৃনা করি।আই যাস্ট হেইট ইউ!
সর্বচ্চ চিল্লিয়ে বলল ধীর।পরপর মিশরাকে ধাক্কা মারল। শক্ত হাতের ধাক্কায় মিশরা আছড়ে পরল মেঝের ওপর।আশরাফ উদ্বিগ্ন হয়ে মেয়েকে ধরে ওঠালেন।নির্বাক প্রত্যেকে,ভাষাহীন।পূর্নতা অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
“এ তোমার কেমন আচরন ধীর ভাইয়া!
তোমার মনে হচ্ছেনা তুমি বাড়াবাড়ি করছো?

ধীর পূর্নতার সামনে এসে দাঁড়ায়।নিক্ষেপ করে করুন দৃষ্টি।
” বাড়াবাড়ি করলে করছি।তোর জন্যে আমি সব করব পূর্না।তোকে পাওয়ার জন্যে যতদূর যেতে হয় আমি যাব।প্লিজ পূর্না, তুই ধ্রুব কে ছেড়ে আমার কাছে চলে আয়।

ধীর ব্যাস্ত হাতে পূর্নতার দুহাত মূঠোয় তুলল। কাতর গলায় বলল,
“আমি তোকে খুব, খুব,খুব ভালোবাসি।বিশ্বাস কর,পৃথিবীর সব সুখ আমি তোর পায়ের কাছে এনে দেব।শুধু আমাকে একটু ভালোবাস তুই!
সবার সামনে লজ্জ্বায় পূর্নতা টিকে থাকতে পারছেনা।অথচ ধীর কী অবলীলায় বলছে!পূর্নতা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল,
“হাত ছাড়ো ধীর ভাইয়া।ধীর ভাইয়া হাতটা ছাড়ো।
ধীর তবুও ছাড়লনা দেখে পূর্নতা জ্বলে উঠল এবার।
“অসভ্যতামির একটা সীমা আছে ধীর ভাইয়া।কি হয়েছে তোমার?তুমিতো এমন ছিলেনা!পাগলের মতো করছো কেন?আর আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।বাসিওনি।আর না কখনও বাসব।আমি শুধুমাত্র ধ্রুবকেই ভালোবেসেছি, আর কাউকেনা।
সায়রা,মিশরা ব্যাতীত প্রত্যেকে বিস্মিত হলেন খুব।পূর্নতা ধ্রুবকে ভালোবাসে?এতো জানা ছিলনা।

ধীরের নরম চোয়াল ধীরেধীরে কঠিন হতে লাগল।পূর্নতা শক্ত কন্ঠে বলল
“আমার আর ধ্রুবর ডিভোর্সের কথা মুখে আনার সাহস কোথা থেকে পাও তুমি?একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাকে আমার স্বামীর থেকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা। তুমিতো নয়-ই।

ধীরের আর সহ্য হলোনা।ক্রোধে আসল রুপটা বেরিয়ে এল বাইরে।মিশরার সঙ্গে করা এতদিনের অভ্যেস প্রয়োগ করে ফেলল ধীর।ক্ষুব্ধতায় পূর্নতার গাল চেপে ধরল।আঁতকে উঠল সকলে।ধীর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“তুই তো এমন ছিলিনারে পূর্না।এতোটা জোর তোর গলায় কবে থেকে এলো?তোকে নরম-সরম মানায়।যে পূর্না কোমল গলায় ডাকবে আমায়।কান খুলে শোন,
তুই আমাকেই ভালোবাসবি,আর আমারই বউ হবি।

পূর্নতা ধীরের আচরনে কথা বলতে ভুলে গেল।মেহবুব হূঙ্কার দিলেন,
” ধীর!অসভ্যতামির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি।
ধীর তোয়াক্কাই করলনা।
পালটা হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
‘গেলে যাচ্ছি।তোমরা কেউ আসবেনা আমাদের মাঝে।এই ব্যাপার আমার আর পূর্নার।
পূর্নতা হাত ছোটাতে চেষ্টা করল।শক্তিতে কূলালোনা।তবুও নির্ভীক কন্ঠে বলল,
‘আমি আফনান খান ধ্রুবর স্ত্রী।মরার আগ অব্দি এই পরিচয়ই থাকবে আমার।তোমার ইচ্ছে কোনও দিন পূরন হবেনা।
ধীর আগুন হয়ে গেল।
‘তোকে আমি__
হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে পূর্নতাকে মারার জন্যে হাত ওঠাল ধীর।সেই হাত পূর্নতা অব্দি পৌছানোর আগেই কেউ একজন ধরে ফেলল।
ধীর ঘাড় কাত করে তাকাতেই খুঁজে পেল ধ্রুবর কঠিন মুখটা।দুই ভাইয়ের চাউনি মিলে গেল।নিষ্প্রান থেকে আরও নিষ্প্রান হলো।উপস্থিত সকলকে আভাস দিল,সামনে আগত এক ভয়াবহ পরিস্থিতির।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here