ফাগুন_এলো_ বুঝি! (২২)

0
885

#ফাগুন_এলো_ বুঝি!
(২২)

জলপাই রঙের মোটা একটা কাতান শাড়ি।রোগা-শোকা পূর্নতার স্বাস্থ্য যেন বেড়ে গেল দ্বিগুন।খুব গুছিয়ে কাঁধে আঁচল তুলে দিয়েছেন সেলিনা।মাথার তালু ঢেকে ঘোমটা টেনেছেন।দুহাতে শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচিং করে চুড়ি পরিয়েছেন।পূর্ণতার কাছে এই রঙের চুড়ি ছিলনা বলে সায়রা নিজের থেকে দিয়েছেন।সব শেষে পূর্নতার থুতনী ধরে মুগ্ধ হয়ে বললেন
‘মাশআল্লাহ!
এই সবটা হা করে দেখল মিশরা।বাড়ি এসে থেকে দেখছে তার মায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ডকারখানা। কি করছে,কি বলছে মা নিজে জানে?পূর্ণতাকে হঠাৎ এত আদর করছে কেন?
তারপর মনে হলো,
এসব তার মায়ের নাটক।পূর্ণতা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবে খুশি হয়ে করছে এগুলো।মা নির্ঘাত ভাবছে পূর্ণতা গেলে গোটা সংসার তার কব্জায় আসবে এবার। কিন্তু পূর্ণতার বিয়েটাই যদি না হয় মা?কি করবে তখন?
নিজে নিজেই হাসল মিশরা।
সায়রা পূর্নতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বললেন,
“আয়।
পূর্ণতার বুক প্রচন্ড গতিতে ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে।খুব করে প্রার্থনা করছে সে যেমন ভেবেছে তেমনই যেন ঘটে।নরম পায়ে সায়রার সঙ্গে সিড়ি বেয়ে নামছিল পূর্নতা।বসার ঘরের প্রত্যেকের চোখ আটকাল সেখানে।অগোছালো ধ্রুব,আর পরিপাটি ধীরের নিশ্চল চোখ একটাই মানুষের ওপর।মিশরা পেছনে পেছনে নামছে।সেলিনা উঠে গিয়ে পূর্নতাকে এগিয়ে আনলেন।পূর্ণতা কাছাকাছি আসতেই ধ্রুব চোখ নামিয়ে ফেলল।ভেতরের সত্ত্বাটা ধিক্কার জানাল খুব করে,
‘বড় ভাইয়ের বউয়ের দিকে এইভাবে তাকানো শোভা পায়না ধ্রুব।সামলা নিজেকে।
সত্ত্বাটাকে ধ্রুব বোঝাতে গেল,
‘কিন্তু ও যে আমার মায়াপ__
ঠিক তখন সেলিনার কন্ঠে ভেসে এল,
‘দুজনকে পাশাপাশি কী সুন্দর লাগছে!ধ্রুব ধ্যান ভেঙে তাকাল।বুক দুমড়ে মুচড়ে উঠল পূর্ণতাকে ধীরের পাশে বসা দেখে। মনে পড়ল রিদের কথাগুলি,
‘এখনই এত কষ্ট পাচ্ছিস?এরপর যখন তোর চোখের সামনে পূর্ণতার বিয়ে তোরই ভাইয়ের সঙ্গে হবে,দিনের পর দিন ওরা সংসার করবে তখন কী করবি ধ্রুব?
ধ্রুব নিজেই নিজে আওড়াল,
‘সত্যিইতো!তখন কী করব আমি?
পূর্ণতা নিভু নিভু চোখ দুটো তুলে সামনে বসা ধ্রুবর দিকে তাকাল।সেই গতকালকের দেখা ধ্রুবই বসে আছে সামনে। ফোলা,লাল চোখ।খড়খড়ে ঠোঁট, এলোমেলো চুল,অবিন্যস্ত ঘামে ভেজা শার্ট।এসি চলছে অথচ কী হারে ঘামছে ছেলেটা!ছাই রঙের শার্ট ভিজে কালো হয়ে উঠেছে।পূর্ণতা কাতর চোখে চেয়ে ভাবল,
“তোমার চোখে এত কীসের হাহাকার দেখছি আমি ধ্রুব?এই কষ্ট কী আমার জন্যে?তাহলে আমাকে সারাজীবন এর মত দূরে ঠেলে দিয়ে,সইতে পারবে?পারবে ভালো থাকতে?
ধ্রুব মেঝেতে এলোমেলো পাতা ফেলছে।ঢেড় বুঝতে পারছে পূর্ণতা তাকেই দেখছে।ওই নিষ্পাপ চোখে চোখ মেলানোর সাহস তার নেই।সে অপরাধি!ঐ সুন্দর চোখদুটোর কাছে সে অপরাধি!এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
বিয়ে নিয়ে পরিবারের বড়দের আনন্দ কিছু কম নেই।দুই পক্ষের মুখেই পূর্নিমার চাঁদের মত ঝলক।মিশরার এসবে হেলদোল একদম নেই।সোফার এক কোনায় বসে ফ্রি ফায়ার খেলছে সে।মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে ধীর আর পূর্ণতাকে।এইযে ধীর বারবার পূর্ণতাকে দেখছে,মিটিমিটি হাসছে,গা ঘেঁষে বসতে চাইছে এসব দেখে বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল মিশরা।বিড়বিড় করে বলল,
‘হ্যাংলা!একেবারে কোলে উঠে বসলেই পারিস।
ধ্রুব হঠাৎ গিয়ে মিশরার পাশে বসলো।
“কি করছিস?
মিশরার কাছে ছোট বেলা থেকে ধ্রুব প্রিয় মানুষ। বন্ধু,ভাই যেটাই হোক ধ্রুবকে তার ভালো লাগে।ছোট বেলায় পূর্ণতা যেমন ঘুরতো ধীরের পেছন পেছন?মিশরা ঘুরতো ধ্রুবর পিছুপিছু। ধ্রুবকে দেখতেই মুখ গোমড়া করে থাকা মিশরার ঠোঁটে হাসি দেখা গেল,
‘কিছুনা।গেমস খেলছি। ধ্রুব টান মেরে হাত থেকে ফোন নিতেই ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কি হলো?
ধ্রুবর উত্তর,
” এখন এটা আমার দরকার।বাকিটা আমি খেলছি।
‘আমি যেন হেরে না যাই!
‘যাবিনা।
ধ্রুব গেমস খেলছে,আর মিশরা পাশে বসে উৎসাহ নিয়ে দেখছে।মাঝেমধ্যে দুজন সে নিয়ে আলোচনাও করছে।
পূর্ণতা সেসব দেখে সূক্ষ্ণ হাসল,
‘নিজেকে ব্যাস্ত রাখার ভান করছো ধ্রুব?বেশ, দেখি কতটা কী করতে পারো!আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকলে এই বিয়ে সামনে থেকে কিছুতেই তুমি মেনে নেবেনা।সেই ভরসাতেই আমি এখানে সং সেজে এসে বসেছি ধ্রুব।আমার বিশ্বাস,ভরসা মিথ্যে করে দিওনা ধ্রুব।দিওনা!

পূর্ণতার ভাবনায় ছেদ ঘটল সেলিনার আওয়াজে।তিনি হৈহৈ করে বললেন,
“পূর্ণতাকে তো আমি সেই কবে থেকেই নিজের মেয়ে ভেবে বসে আছি।তবে ঘরের বউ করার চিন্তা যে একেবারেই ছিলোনা তা কিন্তু নয়।আমার সেই ভাবনাটা একধাপ এগিয়ে দিলো ধীর এই যা।
ধীর হাসল।আড়চোখে পূর্নতাকে দেখে কপাল কোঁচকাল।পূর্ণতার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল পূর্ণতা ধ্রুবর দিকে চেয়ে আছে।ধীর হেসে পূর্ণতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘ওদের কে পাশাপাশি খুব ভালো মানায় তাইনারে পূর্না?তোর আমার বিয়ের পর মাকে বলব ওদের নিয়ে ভাবতে।
পূর্ণতার ইচ্ছে করল ধীরের গলা চেপে ধরতে।কত বড় সাহস!তার সামনে তারই ভালোবাসার মানুষের অন্যত্র বিয়ের কথা বলছে?
পরমুহূর্তে ভাবল,
‘ধীর সত্যিটা জানেনা বলেই ভাবছে।সত্যিটা জানলে কোনো দিন এরকম বলতোইনা।ধীর ভাইয়ার মত ভালো মানুষ দুটি আছে?
আচ্ছা,আমি কি ধ্রুবর কথা জানিয়ে দেব ভাইয়াকে?বলে দেব আমি এই বিয়ে করতে চাইনা?
কিন্তু বলেও বা লাভ কী?ধ্রুবই তো ঠিক নেই।ও যদি ভালোবাসার কথা স্বীকার করতো,দুনিয়া এফোড় ওফোড় করে হলেও এই বিয়ে আটকাতাম আমি।এখন যে আমার আর কিচ্ছু করার নেই।রাগ,জেদ,পরীক্ষা নেয়া যাই হোক,এই সমন্ধ আমাকে আগাতে হবে।আমিও দেখব,ধ্রুব কতক্ষন সহ্য করতে পারে!

সেলিনার প্রত্যত্তুর করলেন আশরাফ।পূর্ণতার দিক একবার তাকিয়ে বললেন,
“আমি জানি ভাবি,আপনি আমার মেয়েটাকে কতটা ভালোবাসেন! তাইতো এই বিয়েতে মত দিতে আমি দ্বিতীয় বার ভাবিনি।কারণ আমি এও জানি, পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই আমার মেয়েটা আপনার বাড়ির মত সুখ পাবেনা।

মেহবুব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
‘তাহলে আমরা আসল কথা সেড়ে নেই আশরাফ?
‘জ্বি ভাই।
‘আমরা চাইছিলাম এই মাসের শেষ দিকে ওদের বিয়েটা হোক।কিন্তু ধীর আপত্তি করল।ওর আবার পরপর অনেকগুলো ম্যাচ আছে।তাই চাইছিলাম,যদি সামনের সপ্তাহেই___
পূর্ণতা ভয়ার্ত,উদ্বিগ্ন চোখে ধ্রুবর দিক তাকাল।অথচ সে নিরুদ্বেগ।ফোনের মধ্যে ডুবে থাকাই একমাত্র কাজ এখন।ধ্রুবর এমন ভঙিমা দেখে পূর্ণতার গলায় কান্না এসে দলা পাঁকাল।ছুটে গিয়ে ওর কলার ধরে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,

” যদি এভাবেই হাত ছেড়ে দেওয়ার ছিল,তাহলে কেন আমার মনে ভালোবাসা জাগিয়েছিলে?কেন ভালোবাসতে শিখিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছ?

পূর্ণতার কাজলকালো চোখদুটো চিকচিক করছে।হাহাকার করে ধ্রুবকে ডাকছে সে।
“ধ্রুব তুমি কি শুনতে পাচ্ছোনা আমার বিয়ের দিন ঠিক করছে?এতটা নিষ্ঠুর মাত্র দুদিনে একটা মানুষ হতে পারে? তবে কি আমি যা ভেবেছি সবটাই মিথ্যে?তোমাকে কাছে টানার কোনও উপায়-ই কি নেই?

হাতের ওপর উষ্ণ হাতের স্পর্শে তাকাল পূর্ণতা।ধীর আরো শক্ত করে চেপে ধরল পূর্ণতার হাত।ঠিক তখনি ধ্রুব চোরা চোখে পূর্ণতার দিক তাকাতেই এই দৃশ্য চোখ বন্দী হলো ।বিদ্যুৎ বেগে চোখ ফেরাল ধ্রুব।
পূর্ণতার কান্না উপচে আসছে এখন।রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি!কেন এই নিষ্ঠুর মানুষটাকে ভালোবাসতে গেল সে?

ঠিক সেই সময় মেহবুব ঘোষণা দিলেন,
তাহলে এই সপ্তাহে ওদের এনগেজমেন্ট উপলক্ষে একটা পার্টি থ্রো করব,আর তার দুদিন পর বিয়ে।
বাকিরা সহমত পোষণ করলেন।সেলিনা ব্যাগ থেকে আংটির লাল বক্সটা বের করে ধীরের হাতে দিয়ে বললেন,
“নে ধীর,পূর্ণতাকে আংটিটা পড়িয়ে দে!
আশরাফ আপত্তি জানিয়ে বললেন,
‘এখন আবার আংটি কেন ভাবি?একবারে এনগেজমেন্ট -এ না হয়__
‘না ভাইজান,এনেছি যখন পড়াক।তখন না হয় আরেকটা পরাব।আমার বাড়ির বড় বউ হচ্ছে আমাদের আদরের পূর্ণতা।ওর জন্যে এসব কিচ্ছুনা।
আশরাফ হাসলেন।ধীর আংটি নিয়ে পূর্ণতার দিকে হাত বাড়াল।নিরবে হাত চাইল সে পূর্ণতার।পূর্ণতা তাকিয়ে ধ্রুবর দিকে।ধ্রুবর গেমস খেলতে চলমান হাতদুটো থেমে গেছে।থম মেরে চেয়ে রয়েছে স্ক্রিনের দিকে।পূর্ণতা হাত রাখল ধীরের পেতে রাখা হাতে।আঙুলসহ কেঁপে উঠল।ধীর ঠোঁটে বিজয়ের হাসি নিয়ে পূর্ণতার অনামিকায় স্বর্নের আংটিটা পড়িয়ে দিল।

পূর্ণতার ভেতরটা আর্তনাদ করে উঠল তখন।সব আশা ভরসার দেয়াল,চোখের সামনে ধূলিসাৎ হয়ে গড়িয়ে পরতে দেখল।ধ্রুবর এই অভিব্যাক্তিই তার সব বিভ্রান্তির উত্তর জানাল,
‘ধ্রুব তোকে ভালোবাসেনি।সত্যিই বাসেনি।
ধ্রুব হঠাৎই উঠে দাঁড়াল। সবাই যখন এক যোগে তাকিয়েছে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘আমার একটু কাজ পরে গেছে বাবা।আমি আসছি এখন।
ধীর শুধাল ‘ কোথায় যাবি?
‘আসছি।
ধ্রুব আর কারো কথায় কান না দিয়ে লম্বা পায়ে বেরিয়ে গেল।পূর্ণতা ভেজা ভেজা চোখে চেয়ে রইল সেদিকে।
______
ধ্রুব গোছানো ছেলে।বুঝতে শেখা থেকে তার ঘর কখনও সেলিনাকে গোছাতে হয়নি।নিজের কাজ সর্বদা নিজে করেছে।সেলিনা করতে এলেও মানা করত।ঘর গোছগাছ করে পরিপাটি রাখাই ছিল ধ্রুবর স্বভাবের মধ্যে একটি। আজ সেই ধ্রুবর ঘরে ঝড় বয়েছে যেন।বিছানার বালিশটা অব্দি গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোরে।শখ করে কিনে আনা মাটির ফুলদানিগুলো কয়েক টুকরো হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে ধ্রুব বসে পরল চেয়ারে।হাটুর ওপর ঝুঁকে গিয়ে কেঁদে উঠল।
ফ্লোরের এক কোনায় সেই পুতুলটা ভাঙা পরে আছে,যার জোড় পুতুলটা পূর্ণতা ভেঙেছিল।ঘরে ঢুকে সবার আগে ওটাকেই ছুড়ে মেরেছে ধ্রুব।
ধ্রুব কাঁদতে কাঁদতে চেয়ার থেকে লুটিয়ে পরল মেঝেতে।চিৎ হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকাল।হা করে শ্বাস ফেলল তারপর। নিঃশ্বাস এমন আটকে আসছে কেন?যেন কেউ জোড়াল হাতে গলা টিপে মারছে তাকে।

ধ্রুব আর্তনাদ করে উঠল,
“কেনো এলে মায়াপরী? কেনো এলে আমার জীবনে? ভালোই তো ছিলাম।কেনো তোমার মায়ায় জড়ালে আমাকে?
পরক্ষনে বলল,
‘না না তোমার তো কোনও দোষ নেই।সব দোষ আমার।আমিই তোমাকে নিজের করে রাখতে পারিনি।

ছাদের দেয়ালেও যেন অস্থির ধ্রুব পূর্ণতার মুখটা দেখল।শাড়ি পরে যে পূর্ণতা নামছিল সিড়ি বেয়ে।যে পূর্ণতা বারবার দেখছিল তার দিকে।ধ্রুব ঠোঁটে হাসি আনল।খুব সামান্য হাসি।
‘তোমাকে আজ এত্ত সুন্দর লাগছিল কেন মায়াপরি?যেন সত্যিই আকাশ থেকে পরি নেমে আসছিল আমার দিকে।আমি কত কষ্টে চোখ সরিয়েছি জানো?
এবার নিজেই নিজেকে শাসালো ধ্রুব,মোটা কন্ঠে আওড়াল,
‘উম ধ্রুব! তুই তোর ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিচ্ছিস?ছি ছি!
তুই না গুড বয়?তাহলে এরকম করছিস কেন? দুশ্চরিত্র বলবে তো লোকে!
ধ্রুব ফিক করে হাসল।একটুপর মুখ অন্ধকার করে একমনে চেয়ে থাকল ওপরদিকে।দুপাশের কার্নিশবেয়ে অবিরাম জল পরছে।এই ফাঁকা বাড়িটায় তার যন্ত্রনা দেখার কেউ নেই।ভাগ্যিস!পালিয়ে এল ওখান থেকে।নাহলে এতক্ষনে বুক জ্বলে খাক হয়ে যেত।মরে যেত সে।

____
আশরাফ একধ্যানে দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে।এক হাস্যজ্বল রমনী তার পাশে বসে।তাহমিনা!ছবিটা তাদের বৌভাতের।তাহমিনার মুখে ভাত তুলে দিচ্ছেন আশরাফ। আর তাহমিনা লাজুক হেসে তাকিয়ে আছেন।ছবিটা ছিল অপ্রত্যাশিত।দুজনের কেউ জানতেন না ক্যামেরায় ক্লিক করছে কেউ।সাদা-কালো ছবিটা আশরাফের এত ভাল্লাগলো যে বিয়ের সব ছবি বাদ দিয়ে এটাই বড় করে বাঁধালেন।যেখানে যান ছবিটাকে সঙ্গে করে নেন।কেন যেন ছবিটার দিক চেয়ে থাকলে অদ্ভূত এক শান্তি পায় আশরাফ।চোখের সামনে ফেলে আসা সুন্দর,সুখময় অতীত জীবন্ত মনে হয়।তাহমিনা মেয়েটাকে জন্ম দিয়েই মারা গেলেন।ছোট্ট পূর্ণতা আশরাফের দুহাতের মধ্যে গলা ফাঁটিয়ে কাঁদছিল।বাচ্চাটাও বুঝি জেনে ফেলল “মা বেঁচে নেই।”
আর আজ সেই মেয়ের বিয়ে দেবেন আশরাফ।পরের ঘরে বউ করে পাঠাবেন।সংসার করবে সে-ও।ভাবতেই আশরাফের চোখ ছলছল করে ওঠে,অজানা উত্তেজনায়।
‘বাবা!
পূর্ণতার ডাকে আশরাফ ঘোর থেকে বেরিয়ে এলেন।চটপট চোখ মুছে ফিরে তাকালেন দরজায়। হাসি মুখে বললেন,
“পূর্ণতা, এসো এসো।
আশরাফ চোখ মুছলেও পূর্ণতা ঠিক দেখে ফেলল।অবাক কন্ঠে বলল,
” কাঁদছিলে কেন বাবা?
আশরাফ হাসার চেষ্টা করলেন,
‘ককই নাতো!কাঁদব কেন?
” লুকাচ্ছো বাবা?? কোনও লাভ নেই,আমি যে দেখে ফেলেছি।
আশরাফ চুপ করে চোখ নামিয়ে নিলেন।পূর্ণতা ধীরস্থির কন্ঠে বলল
” আমি গেলে তোমার খুব কষ্ট হবে বাবা?
আশরাফ তাকালেন।চোখ ভিজে টইটম্বুর হয়ে উঠল।ডুকরে কেঁদে ফেললেন।পূর্ণতা ত্রস্ত পায়ে এসেই বাবার বুকে ঝাপিয়ে পরল।হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল তারপর।আশরাফ ভগ্ন কন্ঠে বললেন,
‘আমার বড্ড কষ্ট হবেরে মা!কীভাবে থাকব তোকে ছাড়া? ক’টা দিন ও বাড়িতে ছিলি তাতেই বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছিল।এখন তো চলে যাবি সারাজীবনের জন্যে।কী করে থাকব আমি?

পূর্ণতার কান্না বাড়ল।এক বাবার দুঃখ,দ্বিতীয় ভালোবাসার।সময় নিয়ে কান্না থামিয়ে বলল,
” আচ্ছা বাবা, ভালোবাসার মানুষ গুলো ছেড়ে গেলে ভীষণ কষ্ট হয় তাইনা?
আশরাফ তাহমিনার ছবিতে চোখ বুলিয়ে বললেন,
‘খুব কষ্ট হয়।
‘তাহলে কেন চলে যায় তারা?
আশরাফ পূর্নতার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
” কারণ ছাড়া কেউ কি ছেড়ে যায় রে মা?কেউ যায়না।
পূর্ণতা মনে মনে বলল,
‘তাহলে ধ্রুব কেন গেল বাবা?
মুখে বলল,
” আমি যদি তোমার থেকে কিছু চাই, দেবে আমায়?
আশরাফ পূর্নতার মুখটা আজোলে নিয়ে বললেন,
” তুই কিছু চাইবি আর আমি দেবোনা?কি চাই শুধু বল একবার।
পূর্ণতা বাবার হাতটা নিজের মাথায় রাখল।
‘আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও।
আশরাফ নিশ্চিন্ত মনে আওড়ালেন,
‘ছুঁয়েই বলছি।আমার মা যা চাইবে দেব।
পূর্ণতা মাথায় রাখা বাবার হাত মুঠোয় ধরে অনুরোধ করল,
“ছোটমা কে এবার তুমি মেনে নাও বাবা।
আশরাফ বিস্ময় নিয়ে তাকালেন।কিছু বলার আগেই পূর্ণতা বলে ওঠে,
” তুমি আমাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছ বাবা।আমার ক্ষতি হোক চাইবে না নিশ্চয়ই?অনেকতো কাটিয়েছো একা একা।আর নয়,ছোট মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে বাবা!একবার সুযোগ দিয়েই দেখোনা।যে মানুষটা এতকাল তোমার ভালোবাসা ছাড়াই তোমার দেখভাল করেছেন,খেয়াল রেখেছেন তোমার সে তোমার ভালোবাসা পেলে কতটা ভালো স্ত্রী হবেন একবার ভাবো।
‘কিন্তু ও তোর সাথে ___
পূর্ণতা এবারেও আটকে দিল,
“ওসব কিছুনা।সব মায়েরাই তার সন্তান কে শাসন করে।আমি ভুল করেছি তাই ছোটমাও শাসন করেছেন।তিনিও তো আমার আরেক মা তাইনা?তাছাড়া ছোট মা অনেক বদলে গেছে বাবা,বিশ্বাস করো।
আশরাফ চুপ রইলেন।তার নিজের কাছেও মনে হচ্ছে সায়রা পরিবর্তন হচ্ছে।পূর্ণতা ফের শুধাল,
‘রাখবেতো আমার কথাটা?
আশরাফ জবাব দিলেন সময় নিয়ে।ছোট করে বললেন,
– রাখবো।
– পূর্ণতার বিষন্ন মুখ চকচক করে উঠল।ফের জড়িয়ে ধরল বাবাকে।আশরাফ তখনও গভীর ভাবনায়।চোখ ঘুরিয়ে তাহমিনার ছবির দিক তাকালেন।নিজেকে শুধালেন,
‘জীবনটাকে কী আরো একবার সুযোগ দেব? মেয়েটাকে যে কথা দিয়ে ফেললাম।

সায়রা সিড়ি বেয়ে নামছেন।এক পা এক পা করে পার হচ্ছেন প্রতিটি ধাপ।চাউনি সদর দরজার পাশের দেয়ালে স্থির।গাল জুড়ে নোনতা অশ্রুদের দখলদারি।ধীর কদমে সোফায় এসে বসলেন সায়রা।একটা সময় শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
“ছোট থেকে যে মেয়ে টাকে একবিন্দু শান্তি দিলোনা, ভালোবাসা দিলোনা,কারণে অকারনে গায়ে হাত তুললো, আজ সেই মেয়েটাই বাবার কাছে তার হয়ে অধিকার চাইলো?
আফসোস,আহাজারি,বিবেকের দংশনে সায়রার সমস্ত শরীর কাঁপছে।বুক,চোখ কাঁদছে তাল মিলিয়ে।
“কেনো এতো ভালো রে তুই পূর্ণতা?কেনো এতো ভালো তুই?আমাকে অপরাধী করে দিলি?
ক্ষমা চাওয়ারও মুখ রইলনা আমার!
সায়রা কেঁদে বুক ভাসালেন।
একটা সময় চোখ মুছে বললেন,
‘তুই আমার জন্যে যা করলি আজ,এর প্রতিদান আমি ঠিক দেব।মিলিয়ে নিস পূর্ণতা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here