ফাগুন_এলো_ বুঝি! (৩৬)

0
1012

#ফাগুন_এলো_ বুঝি!
(৩৬)

তখন রাত।ধ্রুব ঘুমিয়ে আছে পাশে।কপাল আর চোখ ঢেকে আড়াআড়ি হাত রাখা।পূর্নতা একধ্যানে ধ্রুবর মুখের দিক চেয়ে রয়েছে।
মানস্পটে বিয়ের আগের মুহুর্ত গুলো ভাসছে। কী সুন্দর ছিল দিনগুলি!ধ্রুবর দুষ্টুমি,প্রেম- প্রেম অনুভূতি, ধীরের সাথে কত গল্প,কত আড্ডা!ধীরের কথা ভাবতেই পূর্নতার বুক মুচড়ে উঠল।ছোটবেলা থেকে ধীর তাকে আগলে রেখেছিল।নিজের কেউ না হওয়া সত্ত্বেও ধীরের কাছে প্রায়োরিটি পেয়েছে,আদর পেয়েছে,পেয়েছে যত্ন।পূর্নতা সরল মনে সেসব দেখেছে সেসব।বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা জন্ম নিয়েছে ধীরের জন্যে।অথচ,ধীরের এই আচরনের পেছনে লুকোনো ছিল ওর ভালোবাসা।কেন ধীর ভাইয়া ভালোবাসতে গেল ওকে?তাহলেতো সুন্দর,সুস্থ সম্পর্কটা নষ্ট হতোনা।ধীরের মত আপনজনকে হারাতোনা পূর্নতা।সেদিন সকালের কথা মনে পড়তেই পূর্নতা আরেকদফা আঁতকে ওঠে।চট করে ধ্রুবর দিক তাকায়।ধীর ওর ঠোঁটের পাশটায় ঘুষি মেরেছিল।না জানি কত ব্যাথাই পেয়েছে!পূর্নতা কোমল হাতে ধ্রুবর ঠোঁটের পাশে পরশ বোলাল।আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে ধ্রুবর চোখের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে আনল।নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গভীর চুঁমু খেল ধ্রুবর কপালে।

” মাঝরাতে একটা ছেলের সতীত্ব হরন করছো?
আচমকা কথায় পূর্নতা চমকে তাকাল।ধ্রুব মিটিমিটি হাসছে।পূর্নতার গোল গোল চোখ দেখে হাসিটা প্রকান্ড হল।পূর্নতা ঘনঘন পাতা ফেলল চোখের।তড়াক করে উঠে বসে বলল,
” আপপনি জজেগে ছিলেন?

ধ্রুবর সহজ-সুলভ জবাব,
“ভাগ্যিস জেগে ছিলাম,নাহলে বউয়ের এমন ভালোবাসা মিস হয়ে যেত।
“ধ্যাত!
পূর্নতা লজ্জ্বায় হাঁসফাঁস করে চলে যেতে ধরতেই হাতটা ধরে ফেলল ধ্রুব।পরপর টান বসাল।পূর্নতা আছড়ে পরল ধ্রুবর চওড়া বুকে।মাথার লম্বা চুল এসে মুখ ঢেকে দিল।ধ্রুব আলগোছে সব কানের পিঠে গুঁজে দেয়।

পূর্নতার গালদুটো লালিত।লজ্জ্বাভাব চিহ্নিত সেখানে।সময় নিয়ে মৃদূ স্বরে বলল,
” একটা কথা বলব?

ধ্রুব দুষ্টুমি করে বলল,
“একটা কেন, তোমার জন্য আমার কাছে টকটাইম অফার আনলিমিটেড।
পূর্নতা মুখ কোঁচকাল
” বি সিরিয়াস!
ধ্রুব চেহারা সিরিয়াস করার ভাণ করল।
“ওকে হলাম।বলো এবার।
পূর্নতা সরতে চাইল ধ্রুবর বুকের ওপর থেকে। ধ্রুব দিলনা।বলল,
” এখানে থেকেই বলো।আমি শুনছি।
পূর্নতা মুচকি হাসল।পরমুহূর্তে মুখ কালো করে বলল,
” আ’ম স্যরি!
ধ্রুব ভ্রু বাঁকায় “কেন?
পূর্নতার চেহারায় ছেঁয়ে গেল অপরাধবোধ,
“এতোদিন ধরে আপনাকে এতোটা কষ্ট দেয়ার জন্যে।আমার অভিমানের পাহাড় এতোটা উঁচু ছিল, যে আপনার কোনও কথাই শুনতে চাইনি আমি।চেষ্টাও করিনি আপনাকে বুঝতে।
অথচ আমার থেকেও দ্বিগুন মানসিক চাপ আপনার ছিল।আমাকে ক্ষমা করে দিন!কথা দিচ্ছি আর কখনও আপনার মায়াপরী আপনাকে ভুল বুঝবেনা।
পূর্নতার চোখ ছলছল করছে।ধ্রুব ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
‘ক্ষমা করব,তবে একটা শর্ত আছে।
পূর্ণতা অবাক হলো ‘ কী শর্ত?
‘একবার ভালোবাসি বলবে?
ধ্রুবর কন্ঠে কাতরতা।পূর্নতা লজ্জ্বায় নুইয়ে গেল।ধ্রুব ফের বলল,
‘যেদিন বলেছিলে,শুনেও প্রকাশ করতে পারিনি নিজের খুশিটাকে।তারপর যতবার বললে সেসব বাড়ির সবার সামনে।এখন একবার বলবে মায়াপরি?
পূর্ণতার রক্তিম গাল আরো লাল হলো।ধ্রুবর থেকে চোখ নামিয়ে তাকাল ওর শার্টের বোতামের দিকে।তারপর মিহি কন্ঠে বলল,
” আই লাভ ইউ!
ধ্রুব তৎক্ষনাৎ পূর্নতাকে শুইয়ে দিয়েই নিজে আধশোয়া হলো ওর ওপরে।পূর্নতা ভঁড়কে বলল,
‘এটা কী হলো?
ধ্রুব উত্তর দিলনা।নিষ্পলক চেয়ে থাকল।পূর্নতাও মিলিয়ে গেল ধ্রুবর সম্মোহনী চাউনিতে।চোখ স্থির রেখে ঠোঁট নেড়ে ডাকল,
“ধ্রুব!
ধ্রুবও তেমনি জবাব দেয়,
“হু?
“আমিও মা হতে চাই!
পূর্নতার নিষ্পাপ আবদার।ধ্রুবর চোখ কপাল ছুঁলো।পূর্নতা এতে কুন্ঠায় মিশে গেল আরো।দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।পরপর পেল হাতের ওপর ধ্রুবর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ।ধ্রুব হাতদুটো সরাল পূর্নতার।উন্মুক্ত করল ওর স্নিগ্ধ মুখ।পূর্নতা তাকাল নিভু নিভু চোখে।ধ্রুব গভীর চুঁমু খেল পূর্নতার কপালের ঠিক মাঝখানে।চোখ বন্ধ হয়ে এল পূর্নতার।ধ্রুব চুুমু খেল ওর বন্ধ চোখের পাতাতে।একটা সময় ধ্রুবর ঠোঁট পৌঁছাল পূর্নতার ঠোঁট, গলায়।
কামনা-বাসনার জোয়ার উত্থলে উঠল। প্রবল স্রোতে গা ভাসাল দুজন।মেঝেতে পরে থাকা বস্ত্রগুলো দেয়ালকে শাষাল,কুন্ঠায় মিইয়ে যেতে।
কারন,দুটো মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস,দুটো দেহের সঙ্গে দুটো মন আজ মিলেমিশে এক হচ্ছে।সাথে রচিত হচ্ছে আরেকটি ভালবাসার গল্প!সেই গল্প কানে কানে বলে গেল,
‘এতদিনে ফাগুন এলো বুঝি জীবনে!বসন্তের মত সুন্দর হয়ে উঠল জীবন।কোকিল বুঝি গান শোনাল ভালোবাসা-বাসির।
_______
শোঁ শোঁ শব্দ বাতাসের।গাছের ডাল একটা অন্যটার সঙ্গে বারি খাচ্ছে ক্রমশ। ছাদের কার্নিশে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ধীর।দুলতে থাকা নারকেল গাছের পাতায় তার চোখ নিবদ্ধ।গভীর ভাবনায় তলিয়ে সে।যেখানে কূল নেই,কিনারা নেই।আছে প্রবল স্রোত।
হঠাৎ কাঁধের ওপর কারো স্পর্শ।ধ্যান ভাঙল ধীরের।চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে তাকাল।পূর্নতাকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল,
” তুই?
এতো রাতে ছাদে এলি যে!
“তোমার কাছেই এলাম।
ধীর আগের থেকেও অবাক হল,
‘আমার কাছে?
আমার কাছে তুই কেন আসবি?
পরমুহূর্তে অন্যদিকে মুখ ফেরাল সে
‘ নিচে যা।তোর স্বামী দেখলে আবার কী না কী ভেবে বসবে!

পূর্নতা মৃদূ হাসল ‘ ভাববেনা।সে আমায় বিশ্বাস করে।
ধীর ঠান্ডা চোখে তাকাল।
” তুই কী আমার ভালোবাসা নিয়ে মজা নিচ্ছিস পূর্না?এই যে আমি তোর জন্যে এত পাগলামো করছি,সেসব ভীষণ এঞ্জয় করিস তাইনা!
“তুমি বুঝি আমাকে এই চিনলে ধীর ভাইয়া?
ধীর পূর্নতাকে চমকে দিয়ে যত্র ওর দুটো বাহু নরম হাতে আকড়ে ধরল,
পূর্নতা হকচকাল খানিক।ধীর বোজা গলায় বলল,
” আমার জীবনটা এরকম এলোমেলো করে দিলি কেন পূর্না?কেন ধ্রুবকে ভালোবাসলি?আজ আমায় ভালোবাসলে আমাদের একটা সুখের সংসার হতোনা?
পূর্নতা স্থির চোখে চেয়ে বলল,
“ধ্রুবই আমার ভাগ্যে ছিল ধীর ভাইয়া।তাই তোমার ভালোবাসা আমি অনুভব করিনি।না অনুভব করেছি তোমাকে।অথচ দেখো,ধ্রুবর নাম আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেছে।
ধীরের চোখ ভিজে উঠল,পূর্নতা বলল,
” তোমার ভালোবাসাকে আমি ছোট করছিনা ধীর ভাইয়া।আমি শ্রদ্ধা করি তোমাকে,শ্রদ্ধা করি তোমার অনুভূতিকে।কিন্তু ভাগ্যটা আমাদের মেনে নেয়া উচিত।তোমার বোঝা উচিত,আমি অন্য কারো।তুমি যেমন আমাকে ভালোবেসে আমাকে চাইছো,আমিও তেমন ভালোবেসে ধ্রুবকে চাই।আর,আর মিশরাও ভালোবেসে তোমাকে চায়।
ধীর জ্বলে উঠল মিশরার নাম শুনেই।পূর্নতার থেকে সরে এল তৎক্ষনাৎ। কটমট করে বলল,
“মিশরা!এই মেয়েটাই আমার লাইফটা হেল করে দিল।আমার থেকে সব কেড়ে নিল।সব।
পূর্নতা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” না ধীর ভাইয়া।এরকম তুমি ভাবছো।ও তোমার থেকে কিচ্ছু কেড়ে নেয়নি,বরং ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে তোমার কাছে।
আর,আর সেদিন যদি মিশরা এরকমটা ভুল করেও না করতো,তাহলেও তুমি আমায় পেতেনা।
আমিতো ভেবেই নিয়েছিলাম,আমি আত্মহত্যা করব।
ধীর চকিতে তাকায়।আর্তনাদ করে বলল,
“পূর্না!কী বলছিস?
” হ্যা।ঠিকই বলছি।ধ্রুব ছাড়া আমার মনে আর কেউ নেই।কেউ ছিলওনা।মাত্র কটা দিনেই ওর ভালোবাসায় জড়িয়ে আমার কী যে করুন দশা হলো,যে মরার কথাও ভেবে নিয়েছিলাম।ভাগ্যিশ!মিশুটা ওমন করল,আমি বেঁচে গেলাম।
ধীরের দৃষ্টি থমকানো।তার উত্থলানো কষ্ট চাউনিতে স্পষ্ট।পূর্নতা বলল,
“এবার তো তুমি বুঝলে ভাইয়া,ধ্রুবকে আমি কতটা ভালোবাসি!
” আর আমার ভালোবাসা?তার কোনও মূল্য নেই?
ধীরের কাতর স্বর।
“কেন থাকবেনা?ভালোবাসা কখনও মূল্যহীন হয়না।কিন্তু তোমার ভালোবাসার সবটুকু এখন একমাত্র মিশরার প্রাপ্য।শরীয়ত মোতাবেক ওই তোমার স্ত্রী।
এখন আর অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা নাই বা বললে!মিশরা মা হচ্ছে ধীর ভাইয়া।তোমার রক্ত বেড়ে উঠছে ওর গর্ভে।তুমি বিশ্বাস না করলেও সত্যি পাল্টাবেনা।আচ্ছা,এক মুহুর্তের জন্যে মেনে নাও আমাদের কথাই ঠিক।ধরে নাও,তুমি বাবা হচ্ছো এ সত্যি।তাহলে, তাহলে কী তোমার এসব ছেড়ে মিশরার পাশে থাকা উচিত না?
“বাবা” শব্দ কত ভারি!কত দায়িত্ব তাদের!শব্দটাই একটা ধাঁধার মতন।যে সন্তানকে মাঝে রেখে চারদিক থেকে ঘিরে রাখে।বাবা মানে সেই নীল আকাশ,যেদিক তাকিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়।বাবা মানে পায়ের তলার সেই শক্ত মাটিটা,যাকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে ওঠা যায়।বাবা মানে সেই ঠান্ডা বাতাস,যাতে শ্বাস নিতে নিতে বেঁচে থাকা যায়….
তোমার কী উচিত নয়,সেই আদর্শ বাবা হয়ে ওঠা?তোমার সন্তান কেন বাবার ছত্রছায়া থেকে বঞ্চিত হবে ধীর ভাইয়া?সে কেনো একটা সুস্থ পরিবেশে বড় হবেনা?কেন বাবা মায়ের ভালোবাসা পাবেনা?
কেন তার মনে হবে,দুনিয়াতে তার আসার খবর পেয়ে তার বাবার মুখে হাসি ফোঁটেনি।তার জন্মের সময় তার মায়ের যত্ন নেয়নি।সে কেনো গর্ব করে বলবেনা” যে আমার বাবা, পৃথীবির শ্রেষ্ঠ বাবা!

ধীর ঝিম মেরে গেল।পূর্নতার কথাগুলো মস্তিষ্কে বাজতে থাকল।প্রতিটি নিউরন যেন সজাগ হলো।
“এখনও সময় আছে ধীর ভাইয়া, নিজের সন্তানের জন্যে হলেও সব ভুলে মিশুর হাত আকড়ে ধরো।এই সময় টাতে মেয়েদের সব থেকে বেশি দরকার হয় তার স্বামীকে।
আচ্ছা,তুমি একটা বিষয় একটু ভেবে দেখোনা,
যে মিশরা কখনও জিন্স ছাড়া পরেনি,আজ সে তোমার জন্যে শাড়ি পরে।রান্নাঘরের আশপাশ দিয়েও হাঁটেনি,সেই মেয়ে আজ যেঁচে তোমার জন্যে রান্না করতে চায়।মামুনির কাছে আবদার করে রান্না শেখার।প্রেম- ভালোবাসা, সংসার এসব যার কাছে সময় নষ্ট মনে হতো, আজ সে তোমাকে ভালোবেসে সংসার করার স্বপ্ন দেখে।
না চাইতেও পাওয়া এমন ভালোবাসা এভাবে পায়ে ঠেলে দিওনা ধীর ভাইয়া।একদিন হয়ত এই ভালোবাসার অভাবেই ছটফট করবে তুমি।একবার মিশরার প্রতি ধ্যান,জ্ঞান দাও,ওকে মন থেকে মেনে নাও,দেখবে তোমার সুখ ওর মাঝেই।

পূর্নতা থামল।শ্বাস নিল।ধীর রেলিং ধরা হাতদুটো দৃঢ় করল।অবিচল দৃষ্টি বোলাল দূরের রাস্তায়।কি ভাবল,কে জানে!হঠাৎ কিছু না বলেই ছাদ থেকে লম্বা পায়ে চলে গেল।পূর্নতা হতাশ হয়।মুখটা ছোট হয়ে আসে।এত কিছু বলেও কী ধীরকে সঠিক রাস্তায় আনতে পারলনা তবে?

ধীর ঘরে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে গেল।পুরো ঘর অন্ধকার।বাইরে থেকে রোডলাইটের আলো আসছে,তাতেই যা বোঝা যায়।ওর মধ্যেই কারো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ।ধীর দাঁড়িয়ে থাকল।কে কাঁদছে বুঝতে বাকি নেই।আবছা আলোয় বেশ বুঝল,মিশরা জায়নামাজে বসে।তাহাজ্জুদ পড়ছে।বিড়বিড় করে মোনাজাত করছে,সাথে কাঁদছে অঝোরে।কান্নার তোপে কথাগুলো অস্পষ্ট। ধীরের অবাক লাগল।মিশরাকে কখনও নামাজ পড়তে দেখেনি।একটু আগে পূর্নতার কথাগুলো এক এক করে মনে পড়ল ধীরের।সব মিলিয়ে দেখল,হ্যা সব সত্যি।ওইতো শাড়ি পরিহিতা মিশরা তার সামনে।তাহলে সত্যিই কী মিশরার পরিবর্তন হচ্ছে?

মিশরা যতক্ষন নামাজ আদায় করল,ধীর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। নামাজ শেষে উঠে দাঁড়ায় মিশরা।জায়নামাজ গুছিয়ে ওয়াড্রবে ভরে রাখল।ঘুরতে যাবে হঠাৎ কেমন মাথা চক্কর দিল।ঘুরে পরতে নিলো, ধীর এসেই জাপটে ধরল ওকে।প্রথম দফায় ভয় পেলেও,অল্প আলোয় ধীরের মুখটা দেখে অবাক হলো মিশরা।এর থেকেও অবাক হলো তখন,যখন ধীর নরম কন্ঠে বলল,
‘সাবধানে।পরি যাচ্ছিলিতো!
___
পরেরদিন দুপুর বেলা রিপোর্ট এল বাড়িতে।ধীরের বন্ধু তার ড্রাইভার দিয়ে পাঠাল।দরজা খুলল বেনি।সবাই তখন ডায়নিং রুমে।দুপুরের খাবার খাচ্ছে।ধীর,ধ্রুব, মেহবুব সকলেই আছেন।আশরাফ,সায়রা চলে গেছেন বাড়িতে।
পূর্নতা,সেলিনা খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে।মিশরাকে অনেক ডাকার পরে ধীর পায়ে নামল ও।খাওয়ার রুচি একদমই নেই।মাথাও ভনভন করছে। গা গুলোচ্ছে।সেলিনা ওকে এনে বসালেন ধ্রুবর পাশের চেয়ারে।পূর্নতাকে হাজার বার বসতে বললেও মেয়েটা শোনেনা।ধীর চুপচাপ খাচ্ছিল।তার মুখোমুখি ধ্রুব,আর মিশরা।ধ্রুবর সঙ্গে সেদিনের পর থেকে একটা কথাও হয়নি।
বেনি এসে দাঁড়াতেই সেলিনা জিজ্ঞেস করলেন,
‘কে এসছিল?
‘চিনিনা।কইলো বড় ভাইজানের বন্ধু পাডাইছে।এই কাগজ টা দিতে কইল।
সকলের খাওয়া সেখানেই থেমে যায়।এক যোগে বেনির দিক তাকাল।এতগুলো দৃষ্টি একসাথে পরায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল বেনি।ধীর দাঁড়িয়ে যায় খাওয়া ছেড়ে।বাম হাত বারিয়ে ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
“দে।
বেনি রিপোর্টের কাগজ ধীরের হাতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
ধীর খাম খুলতে নিলে সেলিনা বললেন,
‘আগে খেয়ে নে। পরে দেখিস নাহয়!
” এটা সব থেকে জরুরি।
ধীর এঁটো হাতের পরোয়া করলনা।দুহাতের ব্যবহারেই খাম খুলে রিপোর্টের কাগজ বের করল।
সেই একই সব কিছু। রিপোর্ট পজিটিভ!
ধীরের হৃদপিণ্ড এক মুহুর্তের জন্যে অবশ হয়ে যায়।কথা বলতে পারেনা।রিপোর্ট হাতে নিয়ে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
পেছন থেকে মেহবুব জিজ্ঞেস করলেন,গম্ভীর তার স্বর,
‘কী এলো রিপোর্টে? নেগেটিভ? মিশরা তাহলে টাকা খাওয়ালো রুকমানকে?
মেহবুবের কথায় খোঁচা মারার আঁচ।ধীরের বুঝতে সময় লাগেনা।
অথচ সে শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
‘পজিটিভ!
মিশরা চোখ বুজে শ্বাস নিল।প্রচন্ড ভয়ে ছিল সে।কেন ছিল জানেনা।তবুও ছিল।এদিকে ধ্রুব বিস্মিত হয়।সে শতভাগ নিশ্চিত ছিল ধীর রিপোর্ট বদলে দেবে।যাতে প্রমান হবে মিশরা অন্ত:সত্ত্বা নয়।আর সেই সুযোগ লুফে নিয়ে পূর্নতা আর তার মধ্যে ঝামেলা পাঁকাবে ধীর।সাথে মিশরার কপালে যোগ হবে আরো এক নতুন দূর্ভোগ।
কিন্তু এখন তো ব্যাপারটা ঘুরে গেল।ধীর এরকম কিছুই করলনা। কেন?

ধীর আস্তেধীরে সবার দিকে ঘুরে তাকায়।সবার উৎসুক দৃষ্টি তার দিকে।এখন কী শোনাবে ধীর?
শুধু মিশরা,তার চাউনি ভাতের প্লেটে।আঙুল নাড়ছে সেখানে।একজন মানুষ ও কথা বললনা।সকলে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষন করছে ধীরের অভিব্যক্তি। শেষে পূর্নতাই শুধাল,
‘তাহলে এখন,প্রমান যখন পেলে,কথা রাখবে নিজের?
ধীর তখনও মিশরার দিকেই তাকানো।আচমকা মিশরার মধ্যে নিজের সন্তানের মায়ের ছাপটা খুঁজে পেল যেন।ভেতরের সত্ত্বাটা চেঁচিয়ে অনুরোধ করল,
“অনেক হয়েছে ধীর,এবার থাম।ভাগ্যকে মেনে নে।
ধীর ঢোক গিলল।সুস্থির পায়ে এগিয়ে এল ধ্রুবর দিকে।এসে ওর পাশে দাঁড়াল।ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে কৌতুহলে উঠে দাঁড়াল।ধীর গলা ঝেড়ে সময় নিয়ে বলল,
‘আ’ম স্যরি ধ্রুব! ক্ষমা করিস আমায়।
ধ্রুব চমকে গেল।
‘আমায় স্যরি বলছিস কেন?
“কারন সব থেকে বড় অন্যায়টা আমি তোর সাথে করেছি।স্বার্থপরতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছিলাম।তোদের কথা ভাবিনি।এমনকি তোর গায়ে অব্দি হাত তুলেছি।লোক দিয়ে তোকে মারতে চেয়েছি,আঘাত করিয়েছি।পারলে আমায় ক্ষমা করিস ভাই।
ধীর হাত জোড় করল।মাথা নিচু তার।স্বর অতীব নম্র।
উপস্থিত প্রত্যেকে দৃঢ়ীভূত।প্রবল বিস্ময়ে একে অন্যের মুখ দেখল।ধীরের শিথিল কন্ঠেই ঝরে পরল তার অনুতাপ। ধ্রুবর জমানো রাগ, ক্ষোভ সব উবে গেল।আবেগপ্রবন হয়েই ভাইকে জড়িয়ে ধরল সে।
” আমি সব ভুলে গেছি ভাইয়া।তুই শুধু আমার আগের ভাই হয়ে থাক।আমার আর কিচ্ছু চাইনা।
ধীরের অনুতাপ হাজার গুন বৃদ্ধি পেল এতে।ধ্রুব কত ভালো!কত উদার!আর সে?

ধীরও হাত উঠিয়ে ধ্রুবকে ধরল।চোখ বুজতেই সেখান থেকে ঠান্ডা অশ্রু গড়াল।দুই ভাইয়ের ঝামেলা মিটে যাওয়ায় প্রশান্তি, স্বস্তি পেলেন মেহবুব, সেলিনা।আনন্দে তাদের চোখ ও ভরে ওঠে।খানিক পর দুই ভাই সরে আসে দুজনের থেকে,
ধীর না তাকিয়ে,মাথা না তুলেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” আমি তোমাদের সবার কাছেই ক্ষমা চাইছি,আমার জঘন্য অপরাধের।চেষ্টা করব তোমাদের আগের ধীর হয়ে ওঠার।পূর্নার সেই পুরোনো ধীর ভাইয়া হওয়ার।
শেষ কথাটা পূর্নতার দিক চেয়ে বলল।পূর্নতার চোখে জল চিকচিক করছিল,মৃদূ হাসল সে।

মেহবুব অনিশ্চিত কন্ঠে বললেন,
” তুমি কী সত্যিই তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ?
ধীরের সহজ জবাব,
‘জানিনা।মনে হচ্ছে অনেক বড় অন্যায় করলাম।তাইজন্যেই ক্ষমা চাওয়া।
ধীর এরপর এগিয়ে এল পূর্নতার দিকে।ওর মাথায় হাত রাখল।কাঁপছিল সে হাত।
“তুই আমাকে বড় ভাইয়ের মতোন ভালোবেসেছিলি।আমিই হয়ত এলোমেলো করে দিলাম তোর পবিত্র সেই অনুভূতি,কলুষিত করলাম তোর ভালোবাসাটাকে।যে মানুষটার পেছন পেছন ভালোবেসে,স্নেহের টানে ঘুরঘুর করতিস,সেই মানুষটাই সব থেকে বেশি আঘাত দিল তোকে।আমায় ক্ষমা করবিত পূর্না?
পূর্নতা ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলল। ।মাথায় রাখা ধীরের হাতটা মুঠোয় এনে বলল,
‘আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি ধীর ভাইয়া।আমরা সবাই তোমাকে চাই,একসঙ্গে হেসেখেলে বাঁচতে চাই।
ধীর কিছু বললনা।চোখ ইশারা করে বোঝাল তাই হবে।
সব শেষে ধীরের চোখ যায় মিশরার দিকে।জলের পুকুর দুটো চোখ নিয়ে নিষ্পলক,অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে।ধীর কেন যেন কিছু বলতে পারলনা।তার আর খাওয়াও হলোনা।চুপচাপ সিড়িবেয়ে উঠে গেল।
মিশরা আহত হল খুব।সবাইকে কত কী বলল,অথচ তাকে!কেন?ধীরের কী তাকে কিছুই বলার নেই?

নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
চলবে….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here