#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,পর্ব-০১,০২
#আফসানা_মিমি
প্রথম পর্ব
–” বড়ো মা, গ্রামের সকল মেয়েদের মত আমাকেও কী ষোল বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দিবে?”
মধ্যরাতের সময়। বড়ো মা তন্দ্রাচ্ছন্ন। তবে আমার আঁখিদ্বয়ে তন্দ্রার ভাব গতি নেই। মনটা বিষন্নতায় ঘিরে আছে। কারণ আছে বৈকি! গতকাল আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী নীলাকে জোর করে, বিয়ের পিড়িতে বসানো হয়। বর ছিল চাচার সমেত। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। নীলার বয়সের ব্যবধানে চাচা বলছি। বড়ো মাকে বার পাঁচেক ডাকার পর ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বরে হু হু করে আবারো ঘুমিয়ে গেলেন। আমার প্রশ্নের উওর এখনো অজানা। বড়ো মাকে আবারো ডাকলাম। রক্তিম চোখ দেখে ভয় পেলাম বটে। তবুও প্রশ্নে অনড়। –“বলো না বড়ো মা!”
–” ঘুমোতে দে মনা! সকালে মক্তব পড়তে না উঠলে তোর বাবা খুব বকবে।”
দম বন্ধকর অবস্থা। বড়ো মায়ের লাঠির বাড়ি হজম করা যাবে তবে সকালে বাবার কথার ঝুড়ি সহ্য করা দুষ্কর হয়ে যাবে। ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। রূপকথার জগতের রাজপুত্রের দেখা না পেলেও স্বপ্নে ভূত প্রেতদের দেখা পাই। বন্ধুত্ব করতে আসে, তবে অসুস্থ করে যায় আমাকে।
ভোর সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজে শোনা যাচ্ছে। যেন তারা বলছে,’ উঠো উঠো সময় হয়ে গেছে।’
ফজরের সময় বড়ো মা একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে আমাকে উঠালেন মক্তবে যাওয়ার জন্য। আমি প্রতিদিনের মতো আজও আলসেমি করছি, না যাওয়ার জন্য। কিন্তু বড়ো মার সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব। ঘুম জড়ানো চোখে ঢুলে ঢুলে নামাজ পড়ে মাথায় হিজাব পরে ছুঁটছি মক্তবে উদ্দেশ্যে।
চারদিক এখনো অন্ধকার হয়ে আছে। পাশের বট গাছ থেকে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। সূর্যের আলো থেকে বাঁচতে মাথার উপর দিয়ে বাদুড় নিজের গন্তব্যে যাচ্ছে। শুধুমাত্র মাঝরাস্তায় বড়ো মা এবং আমাকেই দেখা যাচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে অন্যতম মক্তব। কাঙ্খিত জায়গায় আমাকে রেখে বড়ো মা চলে গেলেন বাসায়। কারণ তিনার এখন অনেক কাজ।
আমি মেহরিন মায়া চৌধুরী। জামান চৌধুরীর মানে আমার দাদাজানের দুই সন্তান। একজন আমার বাবা রৌনক রহমান চৌধুরী অপরজন জবরুল চৌধুরী। আমি আমার বাবা অর্থাৎ রৌনক চৌধুরীর বড়ো মেয়ে। ছোট এক ভাই, এক বোন আছে। তারা দুইজন জমজ। নাম মালা,মেহেদী। জমজ হলেও তাদের দুই জনের মধ্যে কোনো মিল নেই। সুরজাহান বেগম আমার মা। আরো একজন আছেন ফুলবানু। তিনি আমার বড়ো মা অর্থাৎ সৎ মা। বড়ো মা বন্ধ্যা। কোনো সন্তান না হওয়াতে বাবা আমার মাকে বিয়ে করেন। আমরা তিন ভাইবোন বড়ো মা বলতে পাগল। সবকিছুতে বড়ো মা কে চাই-ই চাই। ঐ যে বলে না! কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন! নাড়ির টান না থাকলেও মোহব্বতের টান রয়েছে। বড়ো মার কাছেই আমাদের সকল আবদার।
গজীপুরের ধলি পাড়ায় থাকি আমরা। আমাদের বাসার দুই গলির পর তিন তলা বিশিষ্ট এক দালানে রাজিয়া আন্টির কাছে আরবি পড়ি রোজ। রাজিয়া আন্টি অত্যন্ত ভদ্র মহিলা। উনার কথার আওয়াজ বাহিরে যায় না। উনার কোরআন তেলওয়াত শুনলে অশান্ত মন ও শান্ত হয়ে যায়।
মক্তবে এসে নিজের পড়া শেষ করে রাজিয়া আন্টির কাছে সবক (পড়া) দিতে বসি। সবক দেয়া শেষে নিত্যদিনের মতো রুমু, সুমুকে পড়া শেখাতে চলে যাই। রুমু, সুমু দুইজনের বয়স পাঁচ বছর হবে। দুইজন চাচাতো বোন, খুবই দুষ্টু। এদের যদি কেউ আয়ত্ত করতে পারে সে হচ্ছি আমি।
–” কিরে দুষ্টুগুলো পড়া হয়েছে?”
সুমু, রুমুর সামনে আসন পেতে বসলাম। আমি জানি এই বিচ্ছুদের আজও পড়া শিখা হয়নি। আর হবেই বা কী করে! পড়তে এসে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌঁড়াদৌড়ি করে বেড়ায় এই দুইজন।
–“মায়া আপু, তুমি জানো তুমি অনেক ভালো। এর সাথে বুদ্ধিমতি,কেশবতী, রূপবতী।” রুমু বলে ওঠে। পাশ থেকে রুমুর পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে সুমু বলে ওঠে,”শুধু রূপবতী না ঐ কি যেনো বলে! গুনবতী গুনবতী নয়তো এতো সুন্দর করে আমাদের মতো গাঁধীদের পড়াতে পাড়ে!”
–” কী ব্যাপার!আজও পড়া হয়নি তোদের তাই না!তাই তো এজন্য আমাকে এমন তেল মাখছিস। আজ তো রাজিয়া আন্টিকে বলব-ই বলব। তোদের এমন পাকা পাকা কথা বের করছি দাঁড়া।
মুখ ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীতে দুইজন দুইপাশে বসে আছে। শেষে দেখা যাচ্ছে রোজকারের মতো আজও বেচারি দুইজনকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ।
—————————-
সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুর আসতে যেখানে দুই ঘন্টা সময় লাগে সেখানে চার ঘণ্টা সময় লাগল যাবির ভাইয়ার। কেননা আজকের ঢাকা শহর, ব্যস্ততায় ভরপুর। ছুটির দিন বলে কথা। যেহেতু দুইদিন আগে কর্মস্থল মানুষদের বেতন হয়েছে। তাই তো ছুটির দিনে আপনজনদের জন্য কেনাকাটা করতে এসেছে সবাই। আর সন্ধ্যা হলো উওম সময় কেনাকাটা করতে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর পড়তে ঢাকায় আসা যাবির ভাইয়ার। বড়ো ভাইয়া আল মাহমুদের বাসায় থেকে পড়ে। অবশ্য যাবির ভাইয়া হোস্টেলে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু নুসরাতের ভাবির জন্য থাকা হয়নি। আছেন দুই বছর ধরে। উনার ভাবির মতে হোস্টেলে থাকলে নাকি যাবির ভাইয়া অসুস্থ হয়ে যাবেন তাছাড়া পড়াশোনা হবে না।
লম্বা জার্নি করে ঘুমিয়ে সকাল সাতটা বাজিয়ে ফেলেছেন যাবির ভাইয়া। মক্তব থেকে এসে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম। ভাবীর কাছে গতকাল শুনেছিলাম আসবেন। প্রায় আড়াই মাস পর এসেছেন তিনি। উনাকে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলাম এই কয়েকদিন। উনার সাথে দেখা হওয়ায় ঘটনা ছিল ঠিক এই রকম,
দুই বছর আগের কথা,সপ্তম শ্রেণীতে ছিলাম তখন। মাথায় তেলে চুবচুবে। দুই বিনুনি করে দিয়েছেন বড়ো মা। পরিধানে গোল ফ্রক। হেলে দুলে ছাঁদ থেকে নামছিলাম। কপোল বেয়ে ঘামের সহিত তেলও ঝড়ছিল। এমনিতেই আমি শ্যামবরণ, তেলের কারণে পাতিলের তলার কালো রঙের মত দেখাচ্ছিল। গেটের কাছের রাস্তায় ভাবীর সাথে হাঁটছিলেন তিনি। নুসরাত ভাবী আমার খুব প্রিয়। পাশের বাসায় থাকেন। সম্পর্কে কিছুই না। যাবির ভাইয়াকে তখনো দেখিনি। ভাবীকে দেখে লাফিয়ে উঠি। লোকজনের পরোয়া না করেই ভরা রাস্তায় জাপটে ধরি। আকস্মিক আ’ক্র’ম’ণে’র জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ভারসাম্যহীন হয়ে দুজনই পড়লাম যাবির ভাইয়ার উপরে।
মেয়ে লোকের শরীরে মাংসের তুলনায় হাড্ডি বেশি, তারজন্য ওজনও বেশি থাকে। দুই রমণীর নিচে পড়ে যাবির ভাইয়ার অবস্থা নাজেহাল। কন্ঠনালী থেকে আস্তে স্বরে শুধু বলছে, –” ভাবী বস্তা উঠাও কষ্ট হচ্ছে।”
যা লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। মালা,মেহেদী এসে আমাদেরকে উঠায়। লাজে যাবির ভাইয়ার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এমনই ছিল আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। বলে রাখি, যাবির ভাইয়ার কাছে মালা-মেহেদী প্রাইভেট পড়ে। সেই সুবাদে আমিও কিছু ফায়দা লুটে নেই। কখনো বীজগণিতের সূত্র নিয়ে তো কখনো রসায়নের রাসায়নিক বিক্রিয়া অধ্যায় নিয়ে হাজির হই। প্রথম প্রথম খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতো কিন্তু পরবর্তীতে উনার আসল রুপ দেখায়। কথায় কথায় ধমক, আর শাস্তি। আমার জীবনটা তেজপাতার মত পাতলা করে দিয়েছেন।
যাবির ভাইয়ার ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে সময়ের হিসেব ভুলে গেছি। নড়াচড়া করতে দেখলাম উনাকে। দেখতে পেলে নির্ঘাত শাস্তি দিবেন। চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলাম। কিন্তু তা আর হলো কোথায়! ঐ যে কথায় আছে না, অভাগী যেদিকে তাকায় সেদিকেই বিপদ দেখতে পায়! আমার বেলাও তাই।
–” মায়া! ভেতরে আসো। চো’রে’র মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছো কেনো?
জরিনা, ছকিনা, খালেদা,হামিদা এসব বলে সম্বোধন করতো! শেষ চোর বানিয়ে ফেলল! কী এমন চুরি করেছি? মনটাই তো! তবুও উনার অজান্তে।
ভাবীদের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চঞ্চল চোখ জোড়া যাবির ভাইয়াকে খুঁজতে ব্যস্ত। অবশেষে সামনাসামনি দেখা মিলল উনার। পাঞ্জাবী পরতে পরতে এগিয়ে আসছেন। দুই হাত উপরে তুলে শরীরের আলস্য দূর করার ভঙ্গিতে বললেন, –” কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো বিশ মিনিট। কথার নড়চড় হলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।”
পাংশুটে মুখশ্রীতে তাই করলাম। রাস্তার পথচারীরা কেউ হাসছে তো কেউ ‘বড়ো মেয়ে কানে ধরেছে’ বলে উপহাস করছে।
–” অপরাধটা বলুন?”
ব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে ব্যস্ত উনি। টুথপেস্ট শেষের পথে। দুই হাতে চেপে একটুখানি বের করে ব্রাশের আগায় লাগালেন। যেন উনি আমার কথা শুনতে পাননি।
–” অপরাধীদের ঘাট বলতে নেই, শাস্তি দিতে হয়।”
–” কোন আইনে আছে এই বার্তা?”
উওর পেলাম না। যাবির ভাইয়া ব্রাশ করতে করতে কল পাড়ে চলে গেলেন। আমার অবাধ্য চঞ্চল মন কি আর বেঁধে রাখা যায়! যথাস্থান থেকে সরে ভাবীর ঘরে উঁকি দিচ্ছি কারণ শাস্তি মওকুফের জন্য। সময়ের খেয়াল হতে পূর্বের স্থানে চলে এলাম।
–” চিঠি লিখতে জানো, মায়া?”
–” গরুর রচনা লিখতে পারি। লিখে দেখাবো?
জিহ্বা কে’টে উনার দিকে তাকালাম। হাতের কাছে তোয়ালে না পেয়ে পাঞ্জাবীকে তোয়ালে বানিয়ে ফেলেছেন। নিচু হয়ে মাথা মুছে এখন হাত মুছছেন। মায়া হলো খুব। আমাকে বললে পরিধানের ওড়না এগিয়ে দিতাম! তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করলে খারাপ লাগতো না। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কি দুর্দান্ত চিন্তা ভাবনা আমার! মাথায় আঘাত পেলাম। যাবির ভাইয়া ভ’য়া’ন’ক দৃষ্টিতে অবলোকন করছেন আমায়।
–” তোমার থেকে মালা,মেহেদী খুবই চতুর। পড়াশোনায়ও ভালো। আক্কেল আছে তাঁদের। কি করতে এসেছিলে?”
–” আপনাকে দেখতে এসেছিলাম।”
–” আমি দেখতে কী ভ’য়ং’ক’র লাগে! নাকি চিড়িয়াখানার প্রাণী?”
মুখে রসের ‘র’ নেই। ভালো ছাত্ররা হয়তো এমন-ই। পূর্বে তো হেসে কথা বলতো। বর্তমানে মুখটাকে পেঁচার মত ফুলিয়ে রাখে। মনে হয় কেউ জোর করে শ-খানেক মার্বেল মুখে ঢুকিয়ে রেখেছে। নিজে যা বুঝে তাই। কান থেকে হাত ছেড়ে দিলাম। উওর দিতে হবে। নয়তো শান্তি পাবো না। মাটির উঠোন। কাদায় চুবচুবে। সাবধানে পা না ফেললেই কাম সাবার। আমার বেলায়ও তাই। পা পিছলে পড়ে গেলাম সাথে এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটালাম। নিজেকে বাঁচাতে সদ্য পরে আসে যাবির ভাইয়ার পাঞ্জাবীর বক্ষঃস্থল থেকে নিচ পর্যন্ত ফ্যারফ্যার করে ছিড়ে ফেললাম। শুভ্র,শুকনো বক্ষঃস্থল সম্মুখে দৃশ্যমান। ছাটনির হাড্ডি গননা করা যাবে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছি সেদিকে। নিজের দিকে লক্ষ্য করে যাবির ভাইয়ার করুণ স্বর,
–” এটা কী করলে মায়া! তুমি কী আর ভালো হবে না?”
চলবে…..
#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|দ্বিতীয় পর্ব |
প্রভাতের হেলানো বাতাস। আবহাওয়া অশান্ত, শীতল। পলাশ গাছ তলায় ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে বাতাসে ফুল ঝড়ছে আর আমার মনে কাল বৈশাখী ঝড় তাণ্ডব চালাচ্ছে।
ধলি পাড়ার পরিচিত স্থান, যেখানে কপোত-কপোতিরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বসে গল্প করে। পরিচিত বলার কারণ, সেখানে একপাশে সবুজে সমারোহ আরেকপাশে মরুভূমির প্রান্তর। এজন্যই সকলে শুভ্রপুষ্প ডাকে জায়গাটাকে। আরো একটা কারণ আছে। ফাল্গুনে যেমন কৃষ্ণচূড়া,পলাশ ফুটে শরৎকালে মরুভূমিতে কাশবন গজে উঠে। সাদা কাশবনের পরিবেশ তখন শুভ্রপুষ্প হয়ে উঠে।
ওড়না ভর্তি পলাশফুল। সুই সুতার অভাবে বয়ে নিয়ে আসা। স্কুলের সময় হয়ে উঠেছে নয়তো শুভ্রপুষ্পে বসেই মালা গাঁথা শুরু করতাম।
চুপি চুপি ঘরে এসে মালা গেঁথে নিলাম। আঁখি দ্বয়ের সামনে মালা উঁচু করে সেখানে যাবির ভাইয়াকে কল্পনা করলাম। লাজুক হেসে উনাকে পরিয়ে দিচ্ছি। উনার বাঁকা দাঁতের হাসি দেখে ঘায়েল হচ্ছি। ভাবনায় রোধ করল মালা এসে। হাতের মালাখানি মালার গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে। চোখে আনন্দ,মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, –” বুবু, আমার জন্য আনছো? মেহেদীর জন্য আনো নাই? আমারটা দেখলেই চাইবে। আমি দিবো না।”
–” দিস না। তোদের মাস্টার আসছে। পড়াতে আসবে কখন?”
–” মা বলল বিকেলে। কেন? তুমিও পড়বা নাকি?
ছোট বাচ্চারা যখন ছোট থাকে, দেখতে-শুনতে ভালো দেখায়। তবে তারা যদি বড়দের মত আচরণ করে তা অভদ্রতা দেখায়। মালার দিকে কঠিন দৃষ্টিপাত করলাম। বুঝেছে সে ব্যাপারটা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দুই পা পিছিয়ে বলল, –” আমাকে মারবা না।” দাঁড়ালো না মালা। পলায়ন করল ঘর থেকে।
স্কুল ড্রেস পরিধান করে, মাথার চুলে দুই বিনুনি করে পরিপাটি হলাম। বড়ো মা বসে আছেন আমাদের জন্য। খাইয়ে স্কুলে নিয়ে যাবেন।
———–
ফাগুন লেগেছে অন্তরের গহীনে। ভাবছি তার কথা, কবে দিবে সে দেখা! অনেক কথা জমে আছে হৃদয়ের গোপন কক্ষে। আসবে কী সে! ভালোবাসার আবদারে!
–” মালার বইয়ের ভাজে কাগজ কে রেখেছে?”
দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। বসার ঘরে মালা মেহেদীকে পড়াচ্ছেন যাবির ভাইয়া। দুই মাসে দুজনের মাথায় গোবরে পোকা বাসা বেঁধেছে। আমি পড়িয়েছিলাম কতদিন কিন্তু তাদের মন মত হয়নি। তাঁদের ভাষ্যমতে,আমি নাকি পড়া চোর। পড়ার মধ্যে ডাল,ভাত মাখিয়ে পড়াই। যাবির ভাই নাকি মসলা মেখে গোস্ত রান্না করে পড়ায়। উদাহরণ শুনলে নিজের-ই মাথা ঘোরায়। পড়ার মধ্যে শুধু ডাল,ভাত বা মাংস কীভাবে আসে? মাথায় ঢুকে না। এজন্যই আমাকে গাঁধী বলে যাবির ভাইয়া। পুনরায় ধমকে উঠলেন তিনি। বুঝতে পারলাম আমার উদ্দেশ্যে কথা বলা, –” পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসো। আমি জানি তুমি এখানেই।”
পর্দা মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে মুখশ্রী ঢেকে নিলাম। মিনমিন করে বললাম, –” আপনি ভেবে নিন, আমি এখানে নাই।”
সম্মুখে যাওয়ার মত মনে সাহসটুকু নেই। লজ্জা,ভয় একসাথে গ্রাস করছে। পর্দার আড়ালে যে আমি নিশ্চিত হলেন কীভাবে? তারমানে উনি কি আমাকে অনুসরণ করেন? চোখ খিচে বন্ধ করে রাখলাম। আমি যে চুরি করে ধরা পড়ে গেছি।
–” আমি ভেবে নিয়েছি, আঙ্কেল একটু পর এলে তোমার সব তথ্য ফাঁস করব।”
অপরাধীর ন্যায় বেরিয়ে এলাম পর্দার আড়াল থেকে। নত মাথা তুলার ক্ষমতা নেই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বললাম,
–” আমি ডায়েরিতে লিখেছিলাম কথাগুলো।”
–” এখানে আসলো কীভাবে?”
–” মালা হয়তো রেখেছে।”
স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি ডায়ের ছেঁড়া পাতার অংশবিশেষ। যেখানে আমার কলমের ছোঁয়া রয়েছে। যাবির ভাইয়া সেটা চার ভাজ করে পকেটে পুরে নিলেন। চোখ বড়ো হয়ে আসলো আমার। পরমুহূর্তে উনার তিক্ত কথা শুনে মন ছোট হয়ে গেল।
–” কাগজখানা রেখে দিলাম। আগামীকাল আঙ্কেলকে দেখাবো যে তার মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হওয়ার এই কারণ।”
ভোঁতা মুখশ্রীতে আবারো অবলোকন করলাম মাস্টারকে। যিনি এখন মালা,মেহেদীকে পড়াতে ব্যস্ত।
–” মায়া এদিকে আয় তো দেখি! বিছানা ছাড়তে পারছি না। আমাকে তোল?” মায়ের ডাকে ভয় পেলাম। বুকে থু থু দেয়ার ভঙ্গিতে সামনে ফিরে তাকালাম। যাবির ভাইয়া ভ্রু-দ্বয় কুঁচকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভেংচি কে’টে চলে আসলাম সেখান থেকে। সেখানে থাকা মানে ফ্রি ফ্রি মাস্টারের শাস্তি পাওয়া।
——–
–” কি রোগ হইলো রে মনা! উঠতে পারি না,বসতে পারি না। নে ধরে তোল আমাকে।”
–” ডাক্তার বলেছে তোমাকে হাঁটা চলা করতে। তা তো করবে না। সারাদিন শুয়ে আরো রোগ বাড়াচ্ছো।”
মাকে ধরে শোয়া থেকে উঠাতে সাহায্য করলাম। কোমড়ের হাড্ডি ক্ষয়ের সাথে কিডনির সমস্যা। হাঁটা চলায় সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়ে।
টেবিলের উপরে পানি ভর্তি জগ থেকে গ্লাসে ঢেলে মায়ের দিকে এগিয়ে দিলাম। পানি পান করে মা এদিক সেদিক কী যেন খোঁজ করছেন। বুঝতে পারলাম সাথে বিরক্ত হলাম প্রচুর। অবশেষে মা বলেই ফেললেন, –” তোর বাবা কোথায় রে? বড়ো আপার কাছে গেছে নাকি?”
আমাদের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাকে কখনো বড়ো মায়ের কাছে যেতে দেখিনি। তবুও আমার মায়ের এক কথন। সমাজের চোখে আমরা সুখী পরিবার কিন্তু আমরা জানি যে আমরা কতটুকু সুখী। মনের তিক্ততা আর ধরে রাখতে পারলাম না। হেয় হয়ে বললাম, –” তুমি জানো বাবা এখন চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। তুমি বড়ো মায়ের সাথে এত লাগো কেন, বুঝিনা।”
–” এসব বড়োদের ব্যপার তুই বুঝবি না। সতিনের ঘর করছি। বিছানায় পড়ে থাকলেও জামাইকে হাতের মুঠোয় রাখি।”
আপন মা হলেও, মায়ের সাথে আমার বনে কম। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন নাকি মা হয়। আমার ক্ষেত্রে আমার আপনজন বড়ো মা। মনের সকল কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। পড়ার বাহানা করে চলে আসলাম ঘর থেকে। আমি জানি সেখানে থাকলে মা বড়ো মায়ের বিরুদ্ধে নানান কথা বলবে। যা আমার সহ্য হবে না।
—————
প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে দশটা শ্রেণীকক্ষ। একই মাঠে প্রাইমারি এবং হাইস্কুল দুটোই বেশ সুনিপুণভাবে পরিচালনা করেন শিক্ষকরা।
টিফিনের ঘণ্টা বেজেছে। শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে বাহিরে বের হয়েছে টিফিন খেতে কিংবা খেলতে।
বাহিরের পরিবেশ অবলোকন করে নিলাম একবার। শ্রেণীকক্ষে পনেরো মিনিট কেউ আসবে না। ব্যাগের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছবি এবং সাদা রুমাল বের করলাম। ছবিখানা যাবির ভাইয়ার। সাদা রুমালের উপর এই ছবি এঁকে নকশি করব, নিচে দুই হাত একসাথে করার চিত্র আঁকব। এবং নিচে লিখে দিবো,’ এই বন্ধন কখনো ছাড়বো না।’
বন্ধন তৈরি হয়নি অথচ ছাড়ার নাম নিচ্ছি। পেন্সিল দিয়ে আঁকতে চেষ্টা করছি। মুখের আকৃতি এঁকে বসে আছি কারণ আছে বৈকি। এত সুন্দর হাসির চিত্র যে আমার হস্ত দ্বারা সম্পন্ন হবে না। আঁকা বাদ দিয়ে হাস্যজ্বল মুখশ্রীর মানবটির প্রতিচ্ছবি দেখায় মনোযোগ দিলাম। তখনই আগমন ঘটে আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী সায়মার। আমাকে মনোযোগ দিয়ে উনার ছবি দেখতে পেয়ে বলল, –” আমরা সাত গ্রাম ঘুরে,খেলে চলে এসেছি। আর ইনি বসে বসে প্রিয়তমেষুর ছবি দেখছে।”
–” তুই বুঝবি কিরে সখি! প্রিয়তমেষুর প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি নৌকায়। ভাবছি মাঝি হবে সে, কিন্তু সে তো নৌকার ধারে কাছেই আসে না।”
–” তোর মাঝির তোর মনের খবর বুঝতে জনম পাড় করে দিবে রে মায়া! শেষে দেখবি নৌকা চালানোর বৈঠাও পাবি না।”
–” মাঝিকে তো পাবোই সাথে নৌকা,বৈঠাও পাবো।”
ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাসি বিদ্যমান। যার নাম জপে দিবস,রজনী পাড় করি সে আমার সামনেই ঘুর ঘুর করছে। অনেকের সাথে নাকি এমন হয়। আপনি যার কথা বেশি ভাবেন সে আপনার সামনে এমনিই চলে আসবে, মনের টানে। এসব কথা বিশ্বাস করি না। পরিস্থিতি মানুষকে যে কোন স্থানে নিয়ে আসতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। টিফিনের আরো দশ মিনিট সময় বাকি আছে। কাপড়,কলম,সুই সুতা ব্যাগে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে বের হয়ে আসলাম শ্রেণীকক্ষ থেকে।
আয়ুব চাচার হাতের বানানো ঝালমুড়ি অমৃত স্বাদ। সিদ্ধ ছোলা বুট থেতলে নরম বানিয়ে মুড়ির সাথে মাখায়। মুখে দিতেই যেনো গলে যায়। যাবির ভাইয়া এসেছেন মুড়ি খেতে। ভেবেছিলাম আমাকে বা অন্য কোন মেয়েকে দেখতে এসেছেন কিন্তু না, উনি মুড়ি খাচ্ছেন। মুখের ভাবগতি এমন যেন পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানি খাচ্ছেন। জিভে জল এসে পড়েছে। আমি শুধু যাবির ভাইয়ার ঠোঁট নাড়াচাড়া দেখছি। সুস্বাদু খাবার তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে ভাবনার জগতে বিচরণ শুরু করলাম, উনি নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন মাঝে মাঝে ঠোঁটের চারপাশের লেগে থাকা খাবার যত্ন সহকারে মুছে দিচ্ছেন। আমি লজ্জায় লাল নীল হচ্ছি। দুই হাতে মুখ লুকাচ্ছি।
ঘণ্টার আওয়াজে কল্পনার রাজ্য থেকে ফিরে চলে আসলাম। আমার ঠিক সামনে যাবির ভাইয়া দাঁড়িয়ে। হাতে ঝালমুড়ির ঠোঙা। বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি খুশি মনে হাত দিয়ে ধরতেই উনি বললেন, –” যতটুকু আছে সব তোমার। ঠোঁটের নিচে থুতনির উপরের লালাটুকু মুছে নাও। নয়তো বেঁচে থাকা সম্মানটাও হারাবে।”
চলবে…….