#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,০৩,০৪
#আফসানা_মিমি
|তৃতীয় পর্ব|
নীল পাঞ্জাবী পরিহিত মানবের পাশাপাশি হাঁটছি। উত্তপ্ত রোদে একটু পর পর পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছেন। একটা বিষয় বুঝতে পারি না। উনি সবসময় পাঞ্জাবীকে তোয়ালে বানায় কেন? ছেলেরা তো পকেটে রুমাল বা টিস্যু নিয়ে ঘুরে। একমাত্র যাবির ভাইয়াই খালি পকেটে ঘুরে। কিছুক্ষণ আগেও ঝালমুড়ি খেয়ে হাত মুছে নেন পাঞ্জাবীতে। অবশ্য প্রথমে হাত ধুয়ে নিয়েছিলেন। ভাবছি দুইটা রুমাল দিব উনাকে। একটা রাখতে বলব বুকপকেটে অন্যটা হাতে যেন প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে। যথা স্থানে এসে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেল। উনি বাড়ির রাস্তায় হাঁটা ধরেছেন আমি আমার রাস্তায়। পিছনে ফিরে বার বার তাকাচ্ছি যেন একটি পলক ফিরে তাকায়। কিন্তু আফসোস উনার কোনো ভাবান্তর নাই।
“আমার সারাদিনের ভাবনায় তুমি, তোমার বিরহে কাতর হয়ে আমি। দিক বেদিক ভুলে যাই, বেসামাল হয়ে যাই। তোমার জন্য পাগলাটে হয়ে যাই, প্রেম নদী স্থাপন করে সাঁতরে যেতে যাই।”
ডায়েরির পৃষ্ঠা ছিড়ে সযত্নে বইয়ের ভাজে রেখে দিলাম। আগামীকাল আরবি পড়ে ফিরার পথে ভাবীদের বাসায় যাবো। চার লাইনের শব্দাংশটুকু যাবির ভাইয়ার টেবিলের উপর রেখে আসবো। মাঝে মাঝে অন্তরে প্রশ্ন জাগে, দিবসের অর্ধেক সময়ে একজন বুঝদার মানুষের সম্মুখে যদি একটা চঞ্চল পাখি উড়ে বেড়ায় তো সেই মানুষটা অবশ্যই পাখিটা নজরে পড়বে। যাবির ভাইয়ার নজরে কি আমি একবারও পড়ি না? উওরটার জানা নেই।
সায়াহ্নের সময়। আমার পৃথিবীতে বড়ো মায়ের পর বাবার স্থান। ছোট দুই ভাই বোনের তুলনায় বাবা আমাকে বেশি ভালোবাসেন। সন্ধ্যার নাস্তা আমরা একসাথে করি এরপর যে যার কাজ করতে চলে যায়। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। বাবার ডাক পড়েছে। ইতিমধ্যে বসার ঘরে সবাই উপস্থিত হয়েছে। এই সময়ে মারও একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসতে হয়। প্রথমত নিয়ম, দ্বিতীয়ত বড়ো মা থাকবেন যদি স্বামীর ভাগ বসিয়ে দেন এই ভয়ে। আজ নাস্তায় বিশেষ কিছু না। চা এবং পাউরুটি। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে পাউরুটি ভিজিয়ে বাবা খেতে পছন্দ করেন সাথে আমরাও। বড়ো মা সবসময় দূর থেকে বাবার সব বিষয়ে খেয়াল রাখেন। কাছে এসে দুই একটা কথা বলেন। এই যেমন খাবারের টেবিলে কী লাগবে, নামাজে যাবেন অজুর পানি তুলে দিবো ইত্যাদি।
কোনোদিন যদি বড়ো মায়ের সাথে বাবা ইচ্ছে করে কথা বলতে যান তাহলে মা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন। অযথা সংসারে অশান্তি করে লাভ নেই তাই বড়ো মা যেচে কথা বলেন না। আমাদের নিয়েই উনার দিবস রজনী পাড় হয়। বড়োমার হাতে হাতে সবাইকে নাস্তা দিয়ে নিজেও বড়ো মার পাশে বসে পড়লাম। আমার পাশে মালা পর পর হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সাধারণত দুই থেকে একটা হাঁচি দেই সেই জায়গায় মালার হাঁচি শুরু হলে দশ থেকে বারোটাও দিয়ে ফেলে। শুনেছি এলার্জির সমস্যার জন্য নাকি হাঁচি বেশি হয়। গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভাবছি যাবির ভাইয়ার কথা। কী করছে সে এখন? নিশ্চয়ই পড়তে বসেছে। আমি যেমন পড়াশোনায় কাঁচকলা উনি একদম বিপরীত। শুনেছি উনার ডিপার্টমেন্টে টপ পজিশনে আছেন। আমার ভাবনার মাঝে মালার বাম হাত না ঢুকালে হয় না। নাক ঘষে লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, –‘ বড়ো আপু, তোমার চা টা আমাকে দিয়ে দাও। আমার না এতটুকুতে পেট ভরে নাই।”
বড়ো বোন হলে একটাই সমস্যা। ছোটরা যত প্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল আছে সব করবে যতক্ষণ না নিজের কার্য হাসিল হয়। মালার চেহারার অসহায়ত্বতা দেখে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। আচ্ছে বলে আমার চায়ের কাপ মালাকে দিয়ে দেই। মালা চলে যায় বাবার কাছে। শুকনো পাউরুটি কোনরকম গিলে নিয়ে উঠতে নিতেই চোখে পড়ে মালার চা ভর্তি কাপ। ছোটবেলা থেকেই বড়ো মা শিখিয়েছেন, অপচয়কারী শ’য়’তা’নের ভাই। রাজিয়া আন্টিও তাই শিক্ষা দিয়েছেন। মালা মিথ্যা বলে আমার চা নিয়েছে। কিছু না ভেবেই মালার উচ্ছিষ্ট চা নিজেই পান করে নিলাম। নাস্তা করা শেষ। হাত পা নাড়াচাড়া করছি সময় অতিবাহিত হওয়ার জন্য। এর ফাঁকে বাবার চোরা চাহনি দেখছি। যিনি ঘোমটার আড়ালে লুকায়িত বড়ো মাকে দেখার বৃথা চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পর মালা এগিয়ে আসে। আমার হাতে তার চায়ের কাপ দেখে নাক সিটকে বলে, –‘ ইয়াক আপু, তুমি আমার নাকের হিতু পড়া চা সাবার করে ফেলেছো?”
নাকের হিতু মানে কী তা বুঝতে আমার সময় ব্যয় হয়নি। পেটের ভেতরে খাবারগুলো চড়কির মতো ঘুরছে। বাবা সামনে আছেন তাই চলে যেতেও পারছি না। মা বাবার পাশে আয়েশ করে বসে আছেন একটু পর পর বাবার সাথে কথা বলছেন। আজ যেন আসন পেতে বসেই থাকবেন এমন ভাব। মালা আমার অবস্থা দেখে জোরে আবারো বলল, –” আপু, তোমার পেটের ভেতর কী মাথা ঘোরাচ্ছে?” ব্যস এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল। পেটে যা ছিল সব বের করে দেই বাবার সামনেই। বড়ো মা, বাবা দুজনই বিচলিত হয়ে পড়েছেন আমার জন্য। মালা এই সুযোগে পালিয়েছে। মেহেদী ভোম্বল মার্বেল চোখে তাকিয়ে আছে এখনো। মা বসে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছেন আসল ঘটনা। বাবা আমার মাথা ধরে রেখেছেন আর বড়ো মা পেটে চাপ দিয়ে রেখেছেন। চিন্তিত স্বরে বললেন, –” ইশ আমার মেয়েটা, হালুমের মতো চা কেউ খায়? পাতিলে আরো চা পড়ে আছে। দেখ তো বিষম খেয়ে কি হলো?”
–” বিষম খেয়েছে না। তোমার ছোট মেয়ে কি যেন বলেছে। আমি দেখেছি।”
দুর্বল শরীরে খেয়াল করলাম, বড়ো মা নরম চোখে এক পলক বাবার পানে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।
বাবা আরো কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মার চাহনি দেখে চুপ করে রইলেন। হয়তো বুঝতে পারলেন তাদের মাঝে শক্ত একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে যা খন্ডন করা সম্ভব না।
——-
বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি। কারণ আছে বৈকি। ঘরে এসেও বমি করেছি। তেতো পানি বের করে ফেলেছি। এরপর আর খাবার পেটে পড়েনি। এখন রাত দশটা বাজে। বড়ো মা এসে লেবু পানি দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেটা খেতে ইচ্ছা করছে না। মস্তিষ্কে যাবির ভাইয়ার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। দুপুরে কী লজ্জাটাই না পেলাম। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে লজ্জায় সামনে যেতো না। কিন্তু আমি তো আমিই। আগামীকালই উপস্থিত হবো উনার সামনে। শোয়া থেকে উঠে আবারো সেই রুমাল এবং সুতা বের করলাম। এবার খুব সুন্দর করে মুখের হাসিটা এঁকে ফেললাম। শরীরের আকৃতিও ঠিকঠাক সেলাই করলাম। ছবিটা ঠিক বুক পর্যন্ত এঁকেছি এবং সেলাই করেছি। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে সবকিছু বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেললাম। মা এসেছেন ঘরে। সচরাচর মা আমার ঘরে আসেন না। আজ কেন এলেন বুঝতে পারলাম না। আয়েশ করে মা আমার পাশে বসলেন। আমাকে বসা অবস্থায় দেখে কি যেন চিন্তা করলেল। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –“এখন আমার মার শরীরটা কেমন আছে?”
–” ভালো লাগছে কিছুটা। কিছু বলবে মা? ঔষধ খেয়েছো?”
মা দরজায় উকি দিয়ে দেকলেন কেউ আসছে কিনা। এরপর আগের ভঙ্গিতে আবারো বললেন, –” তুই তো তোর বড় মার পাগল। সে ভাল কিনা মন্দ তা যাচাই করিস না। তুই জানিস তোর বড় মার কাছে আমার এক জোড়া বালা আছে। শুধুমাত্র আমার অধিকার সেটাতে। তোর দাদী আমাকে না দিয়ে তোর বড়ো মাকে দিয়ে দিলেন। আমি আমার বাবার বাড়ি থেকে কম সম্পত্তি এনে তো দেইনি। তোর বাবার ব্যবসায় লস খেয়েছিল তখনও টাকা এনে দিয়েছি তাহলে বালা আমি পাবো না কেন? বালা জোড়া আমার চাই। তোর বাবাকে বলছিলাম কিন্তু এনে দিচ্ছে না। তুই একটা কাজ কর। তোর বড় মার কাছ থেকে বালা জোড়া আমাকে এনে দিস তো?”
বিরক্তিকর অবস্থা। আমার ভাবতেই ঘৃণা লাগে উনি আমার মা। কীভাবে মনে এতো বিষ জমিয়ে রাখে? মায়ের পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মার মনে শুধু হিংসা রয়েছে আর রয়েছে অহংকার। বিছানা থেকে নেমে গেলাম। আলগোছে খোঁপা করে দুর্বল স্বরে প্রত্যুওরে বললাম, –” তোমার বাপের বাড়িতে তো কম সম্পদ নেই। মামাদের তো চার পাঁচটা ফ্যাক্টরি আছে। মামাদের না হয় বলো যেন সেই বালা থেকে বড়ো এবং উন্নতমানের বালা যেন তোমাকে কিনে দেয়!”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। মা রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে। মার তাকানো উপেক্ষা করে আবারো বললাম, –” বড়মা তো বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারেনি। তিনি গরীব ঘরের সন্তান। সে বালা জোড়া না হয় শাশুড়ির দোয়া এবং শেষ সম্পদ হিসেবে গচ্ছিত থাক!”
বর্তমানে মায়ের চেহারা দেখতে ইচ্ছে করছে না। আলগোছে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম মা বলছে, –” ডাইনিটা আমার সব সন্তানদের হাত করে নিয়েছে। আমারও দিন আসবে। ঐ বালা জোড়া আমি নিয়েই ছাড়বো।”
————
সকাল সকাল আজ যাবির ভাইয়ার মুখ দর্শন হয়েছে। নামাজ পড়ে হাঁটছিলেন হয়তো। শুভ্র পাঞ্জাবীতে হিরো লাগছিল উনাকে। আরবি পড়ায় আজ মন বসেনি। পাখি হলে উড়াল দিয়ে চলে যেতাম উনার কাছে। সুমু রুমু কান ধরে আজও দাঁড়িয়ে আছে। দুই দুষ্টুদেরকে দেখে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আটল। মক্তব শেষে সুমু, রুমু সহ রওনা হলাম যাবির ভাইয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
পাঞ্জাবীর পরিবর্তে পরিধানে গেঞ্জি দেখে অনেকটাই অবাক হলাম। উনাকে সবসময় পাঞ্জাবী পরা দেখেছি। গেঞ্জি পরিধান করাতে বয়স আরো কম লাগছে। আমাকে এই সময়ে যেন আশা করেননি। মুখ লুকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমার কথায় থেমে গেলেন।
–” সুমু, রুমু আমার সাথে আরবি পড়ে। ওদের মায়েরা বলেছে আপনার থেকে পড়া পানি নিয়ে যেতে।”
থমকে দাড়ালেন উনি। খানিকটা রাগান্বিত স্বরে বললেন, –” এতো বড়ো মেয়ে হয়েও এসব বিশ্বাস করতে লজ্জা লাগছে না? আমি কী হুজুর, নাকি পীর দরবেশ যে পানি পড়া দিবো?”
–” আপনি তো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আমারও দরকার।”
যাবির ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম, অপরপাশে ফিরে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। সময় নিয়ে ফিরলেন আমাদের দিকে। রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন রান্না ঘরে।
সুমু,রুমুকে বারান্দায় বসিয়ে আমি নিজের কাজ সম্পাদন করতে চলে গেলাম। যাবির ভাইয়ার ঘরটা খুবই গোছগাছ। একটা খাট, একটা পড়ার টেবিল, আর একটা আলনা তিনটা বস্তু রয়েছে ঘরটিতে। পড়ার টেবিলে একটা বইয়ের ভাজে গতকালের লিখা কাগজটা রেখে দিলাম। উনার ঘরে একটা জানালা রয়েছে রাস্তার পাশে যেখান থেকে আমি প্রতিদিন উনাকে লুকিয়ে দেখি এবং পরিশেষে ধরা পড়ে যাই। জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছি উনি প্রতিদিন আমাকে দেখেন কীভাবে। এমনিই কর্ণধারে যাবির ভাইয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসে। উনি শান্ত স্বরে বলছেন, –” আমাদের জীবনের নিদ্দির্ষ্ট লক্ষ্য থাকে। তোমার জীবনের লক্ষ্য কী, মায়া?
চাঁদ না চাইতেও হাতে পেলাম যেন। খুশিতে গদগদ হয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনের মানুষকে বিয়ে করা।”
কথা বলা শেষ হতেই যাবির ভাইয়া কাশতে শুরু করলেন। আমি বিচলিত হয়ে নার কাছে গিয়ে মাথা,বক্ষঃস্থল, পিঠে থা’প্প’ড়াতে থাকলাম। কাশতে কাশতে চোখ মুখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসছে। আমার হাত থেমে নাই। অনবরত কিল ঘুসি যাই পারছি দিয়ে যাচ্ছি। অবশেষে উনার কাতর স্বর শোনা যায়। উনি বলছেন, –” এভাবে স্পর্শকাতর স্থানে মারতে নেই মায়া। লজ্জা পাচ্ছি।”
চলবে………
#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|চতুর্থ পর্ব |
লজ্জায় লাজরাঙা হয়ে চোখ ঢেকে রেখেছি। আমিই সবসময় বিব্রত পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। আজও হলাম। যাবির ভাইয়ার কাশি অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে। উনি বর্তমানে আমার সামনে ভেজা গেঞ্জি পরিবর্তন করছেন। অবশ্য আমার চোখ ঢাকা আছে, লাজ আছে বটে। এমনি এমনিই মানুষের উদর দেখার ইচ্ছে নাই। শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবী পরেছেন যা আঙুলের ফাঁকে দেখতে পেলাম। টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে নিলেন। কিছুক্ষণ পূর্বের বলা কথা আবারো পুনরাবৃত্তির করে বললেন, –” দিনে দিনে দেখছি বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো। আমি তখন ঐভাবে না বললে তো মে’রে’ই ফেলতে।”
চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললাম। আমার লজ্জা পাওয়াটা বৃথা গেলো। আমি নিশ্চিত ছিলাম আমার দ্বারা অশালীন কাজ সম্ভবই না। নিজেকে সংযত করে বললাম, –” ছোটদের সামনে বাজে কথা না বললেই নয়?”
–” কে ছোট, তুমি?”
এত বড়ো অপমান। আমি যে ছোট, সাহেবের চোখে পড়ে না বুঝি! মান হলো খুব। মুখ ফুলিয়ে প্রত্যুওরে বললাম, –” আপনার চোখে কি ময়লা জমেছে? আমি তো ছোটই। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়ি।”
যাবির ভাইয়া হাসছেন। ছেলেরা সুদর্শন হলে নাকি হাসলে সুন্দর দেখায়। বয়সের তুলনায় উনি একটু বেশিই রোগা। খাবারের অনিয়ম করে বেশি তাইতো। হাসি থামিয়ে টেবিলের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে রেখে দেওয়া কাগজ বইয়ের ভাজ থেকে বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, –” ছোট বাচ্চারা কী প্রেমপত্র লিখে বেড়ায়?”
চোর ধরা পড়লে যেমন সুযোগ খুঁজে পলায়নের জন্য আমিও তেমন সুযোগ খুঁজছি। যাবির ভাইয়া এখনো হাসছেন আগের ন্যায়। বিছানার তোষক উল্টিয়ে কিছু খুঁজছেন। সুযোগ বুঝে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম উনি বলছেন, –” যেয়ো না মায়া! তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।”
—————–
ছুটির ঘণ্টা বেজেছে সাথে সকলের মনের ঘণ্টাও। দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার রুটিন দেওয়া হয়েছে। ভালো ছাত্রীদের মনে আনন্দের দোলা খাচ্ছে আর আমার মত টেনেটুনে পাশ করা ছাত্রীদের মনে দুঃখে ধরাম ধরাম ড্রাম বাজছে। কারণ, বড়ো মার হাতে রুটিন তুলে দেওয়ার পর পরই আমার বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে দিবে। সকালে মক্তবের অজুহাতে যাবির ভাইয়াকে দেখা হবে না দুই মাসের মত। ভাবতেই চোখ ভর্তি পানি টুঁইটুঁই। সায়মা পরীক্ষামূলক অনেক কথাই বলে যাচ্ছে এই যেমন, আজ বাসায় গিয়ে সে সর্বপ্রথম দৈনিক পড়ার রুটিন তৈরি করবে, প্রতিদিন কোন কোন বিষয়ের কোন কোন অধ্যায় শেষ করবে ইত্যাদি। আমার যে চিন্তা নাই তেমন না। পড়াশোনা সবারই প্রয়োজন ছেলেদের তুলনায় মেয়েদেরও। বর্তমানে শিক্ষা ছাড়া কোন মূল্যবোধ নেই। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কথাটা ভুল নয়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তির মর্যাদা অনেক। যে কোন স্থানে সম্মানের আসনে থাকে। কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রী কোনরকম পাশ করতে পারলেই বাঁচে আমি তাদের মধ্যে একজন। সায়মার কথা থামছেই না। মনে হচ্ছে, আজ সে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছাত্রী হয়ে গেছে। রেগে পিঠে আঘাত করে বললাম, –” আজ বাসা থেকে কী খেয়ে বের হয়েছিস? এত কথা আসছে কোথায় থেকে?”
–” তোর কী হয়েছে শুনি? চিন্তায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে নাকি? পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। তোর তো খুশি হওয়ার কথা। ভাই-বোনের মাস্টারের কাছে এই সুযোগে পড়তে পারবি।”
–” পড়া না ছাই। বাসায় আসলে ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারি না। রেগে গিয়ে চোখ দুটোকে রসগোল্লার মত বড়ো করে রাখে। যেন সে বাঘ আর আমি পিঁপড়ে।”
আমি আর সায়মা রাস্তায় হাঁটছিলাম। আমার কথা শুনে সে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল যেনো আমি মজার কথা বলেছি। রাগ হলো খুব। পায়ের কাছে পেপসির বোতল ছিল। রাগে লাথি দিলাম। সায়মা হাসতে ব্যস্ত ছিল আর এর মধ্যেই অঘটন ঘটে গেলো। বোতলের কিছু না হলেও আমার হয়েছে। সমতল শুকনো স্থানে পা পিছলে পড়ে গেলাম। হাস্যকর হলেও কোমড়ে প্রচুর ব্যথা পেয়েছি। সায়মা ভ্যাবলাকান্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। উপস্থিত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে তার। ব্যথায় আর্তনাদ করছি এমন সময় বলিষ্ঠ এক জোড়া হাত এসে আমার কোমড় আঁকড়ে ধরে। আমার সম্মুখে সায়মা অবাক চোখে মুখে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সায়মার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে ফিরে তাকালাম। যাবির ভাইয়া আমাকে ধরেছেন এবং পিছনে উনার বড়ো ভাইয়া চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। লজ্জায় নতজানু হয়ে উনার হাতের উপর হাত রাখলাম। অজানা অস্বস্তির স্বীকার হলাম। আমার স্পর্শে তার কী হয়েছে জানি না, হাত সরিয়ে নিলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমার অস্বস্তির কারণ! দুই হাতে ধরে উঠাতে চেষ্টা করছেন। গভীর নয়নে উনার চোখ,মুখের ভাবগতি লক্ষ্য করছি। চিন্তিত আঁখিদ্বয় ছোট হয়ে রয়েছে, ভ্রু জোড়া কুঁচকে কপোলে ভাঁজ পড়েছে। ঠোঁট কামড়ে রেখেছেন। মনে মনে হাসলাম। চিন্তা মুখখানা কী আমার জন্যই নাকি সবার জন্য? প্রশ্ন করলাম না। ইতিমধ্যে উনি আমাকে দাঁড় করালেন। চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে প্রশ্ন করলেন, –” বেশি ব্যথা পেয়েছো?”
যাবির ভাইয়ার মুখশ্রী নিয়ে ভাবছিলাম। উনার প্রশ্নে আনমনে উওরে বললাম, –” আপনার ছোঁয়ায় এখন ব্যথা পাচ্ছি।”
ছেড়ে দিলেন হাত। আবারো আর্তনাদ করে উঠলাম। এবার সায়মা আমাকে ধরে রাখল। পাশ থেকে যাবির ভাইয়ার বড়ো ভাই মাহমুদ ভাইয়া বলেন, –” বাসায় যেতে পারবে?”
প্রত্যুওরে মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলাম সায়মার সাহায্যে। কোণা চোখে দেখতে পেলাম যাবির ভাইয়া চিন্তিত নয়নে আমায় দেখছেন। আমাদের এলাকায় রিকশা চলাচল খুব কম। জনসম্মুখে অবিবাহিত পুরুষের কোলে চড়াও দৃষ্টিকটু। যাবির ভাইয়া আবারো এগিয়ে আসলেন। পকেট থেকে দুইটা ট্যাবলেট বের করলেন। একটা আমার অতীব পরিচিত সিভিট, অন্যটা অজানা। উনার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করলাম। বুঝতে পারলেন হয়তো। আমার হাতে ট্যাবলেট দিয়ে বললেন, –” এখানে একটা ব্যাথার ঔষধ, অপরটা সিভিট। আগে ব্যথার ঔষধ খাবে, এরপর মুখে তিতা লাগলে সিভিট পুরে দিবে।”
পাল্টা প্রশ্ন করতে দিলেন না। ধপাধপ পায়ে হাঁটা ধরলেন বড়ো ভাইয়ার সাথে।
————
পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন হলো মা। মায়ের সাথে কারোর তুলনা হয় না। সায়াহ্নের সময়ে বিছানায় শায়িত হয়ে বড়ো মার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছি। পরীক্ষার রুটিন টেবিলে স্কচটিভ দিয়ে আটকে দিলেন। কলাম করে বইগুলো সাজিয়ে রাখলেন। পাশে প্রয়োজনীয় খাতা,কলম,পেন্সিল। যেন আজই পরীক্ষা দিতে চলে যাবো। মায়ের চিন্তার অন্ত নেই। আমার কাছে এসে কপোলে,গলায় হাত রেখে জ্বর আসছে কি না পরিমাপ করেলেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, –” আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, তোর জ্বর আসেনি। ব্যথা আছে এখনো?”
–” হ্যাঁ।”
–” বোস, আগুন ধরিয়ে রেখে এসেছি। মাটির পাতিলে করে কয়লা নিয়ে আসি। হালকা আগুনের গরম ছ্যাঁ’কা খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”
বড়ো মা বরাবরই আমার চিন্তা বেশি করেন। আমাকে বকতে বকতে চলে গেলেন। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। আমার ভাবনায় শুধু একজনই আসে আর তিনি হচ্ছেন যাবির ভাইয়া। উনার চিন্তিত চেহারা চোখে ভাসছে। দুপুরে ব্যথায় ঔষধ খেলেও সিভিট খাওয়া হয়নি সেটা এখন আমার হাতে মুষ্টিবদ্ধ। আদরের দেওয়া জিনিস শেষ হতে নেই। ফুরিয়ে গেলে পাওয়া দুষ্কর। কারোর পদচারণের আওয়াজে চোখ খুলে তাকাই। মেহেদী এসেছে। বাহিরে উঁকিঝুঁকি মেরে আমার কাছে এসে বসে বলল, –” আপা, আজ স্যার তোমার কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে।”
বিস্ময় ভর করলো চোখে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ভুল শুনছি না তো! মেহেদী পকেট থেকে কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে আবারো বলল, –” তোমাকে চুপি চুপি দিতে বলেছে। ঘুষ হিসেবে চারদিনের বাড়ির কাজ বন্ধ। হে হে দারুণ না!”
পিটপিট চোখে তাকিয়ে রইলাম শুধু। বড়ো মার আসার আভাস পেয়ে কাগজ লুকিয়ে ফেললাম। মেহেদীও ততক্ষণে নড়েচড়ে বসেছে।
–” দেখি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে যা তো, মায়া? আগুনের গরম ছ্যাঁকা দিলে আজ রাতের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবি।” আগুনের সরঞ্জাম সাজিয়ে নিলেন। মেহেদীকে এই সময়ে আমার ঘরে দেখে বললেন, –“কিরে মেহেদী, পড়া বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস?”
–” আপাকে দেখতে আসলাম। কোমড় ঠিক আছে কি না যাচাই করতে হবে না! দুলাভাইয়াকে বলতে হবে না! অল্প বয়সে তার বউ কেমন ধুরতুরে ছিলো?”
উড়ন্তপাখি অথবা উড়চন্ডী অথবা চঞ্চল বলা সাজে। তাই বলে ধুরতরে! চোখ গরম করে তাকালাম। মালার মতো মেহেদীও ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,
–” চোখ গরম দেখাচ্ছো? বলে দিবো কিন্তু।”
–” কি বলবে রে,মায়া?”
বড়ো মায়ের কথায় মেহেদীর থেকে ধ্যানচ্যুত হলাম। কথা ঘোরানোর জন্য প্রত্যুওরে বললাম, –” কিছু না মা! কোমড়ে কি করবে করো। ব্যাথা করছে।”
অতীব যত্নে কোমড়ে কাপড়ের সাহায্যে গরম ছ্যাঁ’কা দিচ্ছেন। আরামে আঁখিদ্বয়ে ঘুম চলে আসছে। তবে আমার ঘুমোলে চলবে না। মন উসখুস করছে কাগজে কী লিখিত আছে তা পড়ে দেখার। মাকে বাহানা করে বললাম, –” ক্ষুধা পেয়েছে। আলু ভর্তার সাথে গরম ভাত খাবো।”
সন্তানের মুখের কথা মায়ের সামনে বের হতে দেরী হয় কিন্তু সেই খাবার হাজির হতে দেরী হয় না। বড়ো মা আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে গেলেন।
অন্তরে ডিপডিপ আওয়াজ হচ্ছে, হাত কাঁপছে, অনুভূতিরা দলা পাকিয়ে উঠছে। উৎসুক মন,তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। ভয়ে কাগজ খুলছি না। যদি অপ্রত্যাশিত কিছু লিখা থাকে তাহলে কি আমি সইতে পারবো? হয়তো! চোখ বন্ধ করে কাগজ খুললাম। দৃশ্যমান হলো গোটা গোটা অক্ষরের তিনটা শব্দ। ” কেমন আছো, মায়া?”
উওরে কী বলব, ভালো আছি? আমি তো বর্তমানে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছি তার তিন অক্ষরের বার্তা দেখে। এ রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত সুস্থ হতে পারব না।
–” তোর হাতে এটা কী, মায়া?”
কর্ণধারে কথাটা আসতেই চমকে তাকাই। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বলি, –” তুমি?”
চলবে…