ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,০৭,০৮

0
366

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,০৭,০৮
#আফসানা_মিমি
| সপ্তম পর্ব |

সাঁঝের গল্পের আসরে নিমজ্জিত সবাই। পূর্বের দাদা-দাদীদের আমলের গল্প বলা হচ্ছে। আমরা সকলে সোফায় বসে আছি। গল্প শোনাচ্ছেন বাবা। বাবার ডান পাশে আমি বসেছি বাম পাশে মেহেদী বসেছে আর মালা বাবার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে আছে। বড়ো মা দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী নাস্তা বানানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন।
বাবা মৃত দাদা এবং দাদীর গল্প শোনাচ্ছেন, –” ভাওয়াল রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর জমিদারী করার সময়ে গাজীপুরের বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব প্রদান করতেন। তেমনি গাজীপুরের উওর অংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে শ্রীমান লাজিম মুন্সী নিযুক্ত হোন। উনার অধীনে সাড়ে দশ হাজার শতাংশ বা এর চেয়ে অধিক জমি ছিল। সেই সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার কৃষক,দিন মজুর, গরীব সকলে জড়ো হতেন মুন্সীর বাড়ির মসজিদের সামনে। দলে দলে মানুষ চাল,ডাল আটা নিয়ে যেতেন। জমিদারের তত্ত্বাবধায়ক ইজারাকৃত বস্তু বিলি করতেন। সেই সময়ে ভাওয়াল রাজাও সফর করতে বের হলে পথে মুন্সী বাড়ি উঠতেন এবং বিশ্রাম নিতেন। হাজার হাজার মুসাফির যাদের রাত হলে পথ চলাচলের সমস্যা সৃষ্টি হতো তাদের জন্যও বিশ্রামাগার হিসেবে বড়ো বড়ো কামরা তৈরি করা হয়েছিল। মুসাফিরদের কোনো কষ্ট যেন না হয় সেদিকে সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখতেন। জমিদারের দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষক ছিলেন বিধায় শ্রীমান লাজিমকে ‘মুন্সী’ পদবী দেওয়া হয়। তোমার বড়ো বাবার বন্ধু ছিলেন লাজিম মুন্সি। উনার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ে। এখন জমিদারি নেই ঠিকই কিন্তু সেই লাজিমকে এবং উনার এলাকাকে লাজিম মুন্সী বাড়ি হিসেবে চিনে। তোমাদের এতক্ষণ এতকিছু বলার কারণ হচ্ছে, অতি শীঘ্রই আমরা সেখানে যাচ্ছি।”

বাবার কথায় খুব আনন্দ লাগলো। বাবার সাথে বেড়াতে যাবো। সারাদিন বাবা সাথে থাকবেন। মালা, মেহেদী দাঁড়িয়ে হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছে। ওদের আনন্দ দেখে আমার আনন্দ আরো দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
গল্পের আড্ডায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে, বড়ো মায়ের কথা একপ্রকার ভুলে গিয়েছিলাম। এখনো আমাদের নাস্তা দেওয়া হয়নি বিষয়টি খেয়াল হল। এগিয়ে গেলাম রান্না ঘরের দিকে।
বড়ো মায়ের হাত থেকে নাস্তার বাটি একপ্রকার কেড়ে নিলেন মা। এরপর বসে ব’টি দিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি করতে শুরু করলেন। বড়ো মা বলছেন, –” আমি করি, তোর শরীর খারাপ।”
মা শুনছে না। উল্টো চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে বড়ো মায়ের দিকে। আমি থামাতে যাবো তার আগেই মার গলার স্বর শুনে থমকে যাই। মা বলছে, –” এবার তুমি বিশ্রাম করো আপা। অনেক তো কাজ করেছ। আমার অসুস্থতার অজুহাতে স্বামী, সন্তানদের হাত করে নিতে চাচ্ছো তা কী আমি বুঝি না! ভুলে যেও না আপা, তুমি যেমন এই পরিবারের বউ তেমন আমিও। তোমার চেয়ে আমার মূল্য বেশি। কেন জানো? কারণ আমি সন্তানের মা। আমার দুইটা মেয়ে এবং একটা ছেলে আছে। তুমি তো বন্ধ্যা, কেন পড়ে আছো? এখানে থেকে আমার সন্তানদের বশ করে নিয়েছো। এখন স্বামীর সামনে ঘুর ঘুর করছো যেন সে তোমাকে দেখে!”

মার কথা শুনে আমার চোখে জল চলে আসে। বড়ো মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলাম উনি ছলছল চোখে মার দিকে তাকিয়ে আছেন। মার কথার প্রত্যুওরে ভাঙা স্বরে এইটুকুই বললেন, — আমি তোর কোন কিছুতেই ভাগ বসাইনি। তোর সংসার যেমন ছিল তেমনই আছে।”

বড়ো মা মুখ চেপে কাঁদছেন। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। শব্দ করে হেঁটে মার কাছে গেলাম। বড়োদের সম্মান দিতে হয় সেই শিক্ষা আমাকে দিয়েছেন বড়ো মা। উচ্চ স্বরে কথা বলা শিখায়নি। আজ চুপ থাকতে ইচ্ছে করছে না। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে রাগ কমানোর মিথ্যা প্রয়াস করলাম। মার কাছে গিয়ে বললাম, –” তোমার কোমড় ব্যথা নিয়ে এভাবে বসেছো কেনো? আমাকে দাও আমি করে দেই।”

আমার কথায় মা রেগে গেলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন, –” একদম দরদ দেখাতে আসবি না। কাজের কাজ পারিস না, কী বলেছিলাম সেদিন। আমাকে যদি মা মানতি তাহলে কাজ করতি। দেখিয়ে কাজ করতে হবে না। আমি জানি এই মহিলা তোর মাথা ওয়াশ করে রেখেছে।”
মাকে কিছু বলার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম তখনই বড়ো মার ক্রন্দনরত চোখ দেখতে পেলাম। বড়ো মা ইশারায় কিছু বলতে নিষেধ করছেন। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে রান্নাঘর থেকে একটা পাতিল নিয়ে দেয়ালে ছুড়ে মেরে চলে আসি।

রাতে পড়ার টেবিলে বসে চিন্তা করছি, এখন থেকে ভালোভাবে পড়াশোনা করব যেন বড়ো হয়ে ভালো চাকরি করতে পারি। বড়ো মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। আমার এত বছর বয়সে আমি তার সাক্ষী। রাতের খাবার খেতে যাইনি। আমি জানি খাবারের জন্য বাবার সামনে গেলে বাবা নানান প্রশ্ন করবেন।
বড়ো মা হাতে করে খাবার নিয়ে আসলেন। চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। হয়তো লুকিয়ে কান্না করেছেন! বড়ো মা পাশে বসলেন। সেদিনের মতো ভাতের লোকমা বানিয়ে আমার মুখে পুরে দিয়ে বললেন, –” রাতে না খেয়ে থাকতে নেই মনা! শরীর থেকে এক চড়ুই পরিমাণ গোস্ত কমে যায়।”
বড়ো মার কথা শুনে হাসলাম। ছোটবেলায় খেতে না চাইলে এভাবেই খাওয়াতেন। এখন বড়ো হয়ে গেছি তবুও উনার অভ্যাস বদলায়নি।
————–

রোদের প্রচণ্ড তাপ। স্কুলের পোশাক ভিজে জবুথবু। পরপর তিনটা ক্লাস হয়েছে। চতুর্থটা করলেই ছুটির ঘণ্টা বাজবে। কারণ আজ বৃহস্পতিবার। সায়মার সহ আমারও আজ পড়ায় মনোযোগ নেই। সায়মার কারণটা অজানা তবে আমার কারণ, নিশ্চয়ই সবার জানা! সায়মা খাতায় কুতকুত খেলার ঘর এঁকেছে। শেষ ক্লাসে এমনই হয়। খাতার এক অংশ ছিঁড়ে ছোট ছোট গুটি বানিয়েছে খেলার জন্য। আমাকে বার কয়েকবার বলেছে খেলতে। আমার সেদিকে মন নেই। দৃষ্টি যদিও শিক্ষকের দিকে কিন্তু মনোযোগ যাবির ভাইয়ার ভাবনায়। চোখ নামিয়ে ব্যাগে বড়ো মায়ের বিয়ের গাঢ় গোলাপি শাড়ি দেখে নিলাম। অন্তর আজ অজানা অসুখে আক্রান্ত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর এতো জোরে বিট করছে যে থামাতে আমার পানির পর পানি পান করতে হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে ছুটির ঘণ্টা বেজে গেল। সকল শিক্ষার্থী যার যার রাস্তায় চলে যাচ্ছে। সায়মার পাশে হাঁটছি। সে বরাবরের মত বকবক করছে আর আমি নিশ্চুপ। সায়ভার বাড়ির রাস্তায় আসতে সে থেমে গেল। আমাকে সোজা পথে হাঁটতে দেখতে পেয়ে বলল, –” এই কানির মা! অন্ধের মত হাটছিস কেনো রে? এত কী ভাবিস। তোর উনি এই জনমেও তোর মনের খবর জানতে পারবে না। আমার কথা মেনে নে, উনার আশা ছেড়ে দে।”

সায়মার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালাম। মুখে ভেংচি কে’টে বললাম, –” আমাকে নিয়ে তোর আর ভাবতে হবে না রে সখী! সে আজ আসবে, মনের কথা বলবে। তুই দেখে নিস, সে আমায় অনেক ভালোবাসবে।”

যাবির ভাইয়ার ভাবনায় বিভোর হয়ে রাস্তায় হাঁটছি। গতকাল উনি বলেছিলেন নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকতে। কিন্তু আজ তো হাফ ক্লাস হয়েছে এতক্ষণ আমি কী উনার জন্য অপেক্ষা করব? করতেই হবে। অপেক্ষার ফল মিঠা হয় যে।
শুভ্রপুষ্পে পৌঁছে সেদিনের গাছের নিচে বসে পড়লাম। ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। আমার দ্বারা কখনো শাড়ি পরা সম্ভব হবে না। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে নিলাম কেউ আছে কিনা। শাড়ির একটা ভাঁজ খুলে মাথায় দিলাম। আয়না থাকলে দেখা যেত, ঘোমটা মাথায় কেমন লাগছে। আফসোস করছি, কেন ব্যাগে আয়না বহন করে ঘুরি না! আশেপাশে পুকুর বা খাল নেই যে পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখব। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে নিব তখনই যাবির ভাইয়ার কন্ঠস্বর কানে আসে। উনি স্বাভাবিক স্বরে বললেন, –” ঘোমটার আড়ালে রূপসী সেজে বসে আছে প্রেয়সী প্রিয়তমেষুর অপেক্ষায়। এসেছি তো! অপেক্ষার অবসান হয়েছে তোমার, অজানা অনুভূতিতে ডুবতে দাও এবার!”

লজ্জায় মাথা তুলে তাকাচ্ছি না। উনার বলা কথার অর্থ বুঝতেও চেষ্টা করছি না। মাথার ঘোমটা পড়ে গেল। শাড়ির আধা ভাঁজে ব্যাগে রেখে দেওয়ার প্রচেষ্টায় আছি। উনার কন্ঠস্বর আবার শোনা গেল তবে আমার অতি নিকট থেকে। উনি বলছেন, –” এভাবেই থাকো। নড়বে না।”
আমার চাহনি যাবির ভাইয়ার দিকে নিবদ্ধ। উনি আমার পাশে এসে বসেছেন। শাড়ির আঁচল আবারও মাথায় টেনে বললেন, –” হাতটা বাড়াও।”
আমি তাই করলাম। আজ আমি বাকরুদ্ধহীন হয়ে গেছি। অনুভূতিগুলো মনের ভিতরেই জমে আছে। উনার কথায় হাত বাড়িয়ে দিলাম।
যাবির ভাইয়া ছোট্ট একটা বক্স বের করলেন। যার মধ্যে অনেকগুলো দূর্বাঘাস গোল করে রিং আকারে রাখা আছে। আমার হাত ধরে আঙ্গুলে একটা একটা করে দূর্বাঘাসের রিং পরিয়ে দিচ্ছেন। কোনটা বড়ো হচ্ছে তো কোনোটা ছোট। অবশেষে অনামিকা আঙ্গুলের মাপে একটা পেলেন। আমি অবাক নয়নে পর্যবেক্ষণ করছি। এই মানুষটা আমাকে কতই না উপেক্ষা করেছেন। সবসময় দূরত্ব রেখে থেকেছেন। আজ উনিই স্ব-ইচ্ছায় কাছে। বিশ্বাস হচ্ছে না। আনমনে কখন যে যাবির ভাইয়ার হাত ছুঁয়ে দিয়েছি জানি না। উনার কথায় সম্বিৎ ফিরে আসে। উনি হেসে বললেন, –” আমি সত্যিই এসেছি। এভাবে পরোখ করে দেখতে হবে না।”

মাথা নত করে হেসে ফেললাম। কিছু সময় কা’টে। দুজনের স্বরে কথা নেই। চোখে চোখ পড়তেই চোখে চোখে কথা হচ্ছে। নীরবতা ভেঙে উনি বললেন, –” কিছু বলবে না? আমি চেয়েছিলাম প্রথম এভাবে দেখা করলে কিছু উপহার দিবো। তা আজ হলো না। খুব শীঘ্রই তোমার জন্য উপহার নিয়ে হাজির হবো।”

মাথা নেড়ে না করলাম। আজ কিছু বলার নেই। আজ আমি শুধু দেখব উনি কী করেন। আমার পাশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবী ঝেড়ে হাঁটা ধরলেন। এবারো অবাক হলাম। চুপ করে না থেকে বললাম, –” আর কিছু বলবেন না?”

–” কিছু বলতে এসেছিলাম?”

পাল্টা প্রশ্নে মনক্ষুন্ন হল। এতক্ষণে অনুভূতির সাগরে ডুবে থেকে এখন সব বিষাক্ত লাগছে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। কোনো কথা না বলে অপর রাস্তায় হাঁটা ধরলাম। কিছুক্ষণ পর যাবির ভাইয়ার ডাক কানে আসে। উনি বলছেন, –” অভিমানে রাঙাও তোমার মন প্রেয়সী। ভাঙাতে আসবো আমি কোনো এক দিবসে।”

উনার দিকে ফিরে তাকালাম না। কেন তাকাব শুনি? আমার মন ভাঙতে তার বুক কাঁপেনি? উলটো ফিরেই প্রত্যুওরে বললাম,
–” আমি কবি নই। নই কোনো সাহিত্যিক। সরাসরি বলুন। নয়তো এই আমি চললাম।”

পাল্টা উওর আসছে না। আমার কর্ণধার আকুল হয়ে আছে যাবির ভাইয়ার স্বরে সেই শব্দগুলো শোনার। ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। এবার দাঁড়িয়ে গেলাম। পিছনে ফিরেও তাকালাম। উনার এরূপ অবস্থা দেখে কাঁধ থেকে ব্যাগ ফেলে দিলাম। এসব উনি কি করছেন?

চলবে………

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|অষ্টম পর্ব |

যাবির ভাইয়া দু-হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে চমৎকার হাসি। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছেন। ঐ যে ছোট বাচ্চাদের যেমনভাবে কাছে ডাকে ঠিক সেভাবে। আমি আগাচ্ছি না, ভয় পাচ্ছি। যাবির ভাইয়ার অগোচরে ভালোবেসেছি, মনের সুপ্ত দরজা খুলেছি। তবে সরাসরি এভাবে অনুভব করতে পারিনি। আমার দাঁড়িয়ে থাকা যেন উনাকে বিভ্রান্ত করছে। এক হাত নামিয়ে নিলেন। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, –” আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করেই হাতে হাত রাখি। একে অপরকে সম্মান করি বলে কথা মানি। একে অপরের মনের কথা বুঝতে পারি বলে একসাথে পথ চলি। হাত বাড়িয়েছি, একবার ধরবে? কথা দিচ্ছি আজীবন এভাবেই থাকব, তোমার হয়ে।”

আমার চোখ আজ সবই ভুল দেখছে। কর্ণধারের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। এত সুখ কী আদৌও কপালে ছিল? চোখ ভর্তি জল, মুখে চিলতে হাসির রেখা নিয়ে এগিয়ে আসলাম। যারিব ভাইয়ার হাতে হাত রেখে বললাম, –” এই যে হাতটি ভরসার করে রাখলাম। কখনো ভঙ্গ করবেন না। এই কিশোরীর মনে আপনার জন্য অগাত ভালোবাসা রয়েছে। কথা দিন, কখনো ছেড়ে যাবেন না।”

–” কথা দিলাম।”
——————

হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলা শুরু দুজনের। যাবির ভাইয়া উনার কথা রেখেছে। কখনো কষ্ট দেয়নি। বাবা-মার দৃষ্টির আড়ালে এই মায়াকে সবসময় আগলে রেখেছে। নবম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি। প্রখর শীত। দিবসের অর্ধেক বেলা কুয়াশায় ঢাকা থাকে পথঘাট। বাহিরে বের হওয়ার জো নেই। তীব্র শীতে মানুষজন রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টা করছে। আজকাল সকাল সকাল আরবি পড়তে যেতে পারি না। আমার উপর বাবার কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। ঠান্ডায় কাবু করে রাখা আমাকে ঘরের বাইরে পা দিতে দিচ্ছে না। কিন্তু আমাকে আটকে রাখা কী এতোই সহজ? সকালে গরম শাল গায়ে পরে নিলাম। শালটা বড়ো মার। বড়ো মা এবং বাবার বিয়ের তিন বছর পর বাবা ইন্ডিয়া থেকে এনেছিলেন। বড়ো মায়ের খুব পছন্দের। এজন্যই তো তিনি শীতে কষ্ট করেন কিন্তু এই শাল পরেন না নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে।
বড়ো মা গরম চা ফ্লাস্কে ভরে দিলেন। সকাল বেলায় উড়ুকথা শুনেছেন যে, ভাবী নাকি অসুস্থ। ঠান্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। কথাটা শোনার পর খুব হেসেছি। আমার জীবদ্দশায় শুনে এসেছি ছোট বাবুদের নিউমোনিয়া হয় কিন্তু বড়োদের হয় কী না জানি না। বড়ো মা আমাকে হাত পা মোজা পরিয়ে দাঁড় করিয়ে ঘরে গেলেন। আমি মনে মনে খুব খুশি। ভাবীর অজুহাতে উনার দর্শনও পাওয়া যাবে।
এমনিতে শীত।
ঘন কুয়াশায় দুইহাত দূরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। বড়ো মা চিতই পিঠা, খেজুরের গুর, আর চায়ের ফ্লাক্স আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন।
শীতের প্রকোপে গুঁজে গুঁজে হাঁটছি তখনই দুই বিচ্ছু সুমু,রুমুর সাথে দেখা হয়। আমাকে প্যাকেট অবস্থায় দেখে দুজনই সমান তালে হাসছে। সুমু রুমুকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে , –” তেঁতুল গাছে যেই পেত্নি বসে থাকে, তার নাম দিয়েছিলাম,মায়াভূতী। দেখ রুমু, মায়া আপুকে মায়াভূতী লাগছে।”
–” আমি ভয় পাচ্ছি রে সুমু, চল পাঞ্জাবী কাকুকে বলে আসি।”

আবরি পড়ে দুই দুষ্টু বাড়ির পথে না গিয়ে এখানে ঘুরঘুর করছে। মাথার হিজাব সুন্দর করে না পরে উলটোভাবে বেঁধে চুল বানিয়ে নিয়েছে। আমার আর তাদের গন্তব্য একই। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম এরা পাঞ্জাবী কাকু কাকে বলেছে। ভাই বলা ঠিক ছিল এরা তো একেবারে বাপ,কাকু ডাকছে। রুমু,সুমুর কাণ্ডে হেসে ফেললাম। দুজন দৌড়ে যাবির ভাইয়ার বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবী বলে দুইবার ডাক দিলাম।

গলায় মোটা কাপড় প্যাঁচিয়ে, নাক টানতে টানতে ভাবী ঘর থেকে বের হলেন। চোখ দুটোও ফুলে আছে। বাহ্যিক দিক দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুবই অসুস্থ। মায়া হলো খুব। ভাবীকে ধরে বারান্দার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। গা,কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বুঝে বললাম, –” তোমার কী নিউমোনিয়া হয়েছে?”

ভাঙা স্বরেও ভাবী হেসে ফেললেন। ঘ্যারঘ্যার স্বরে প্রত্যুওরে বললেন, –” টাইফয়েড হয়েছে আর তুই আমাকে নিউমোনিয়ার রোগী, অর্থাৎ বাচ্চা বানিয়ে দিলি?”

–” মায়া তো বাচ্চাই, বড়ো হয়েছে কী? শুধু হাত পা লম্বা হয়েছে।”

সুমু, রুমু দুজন যাবির ভাইয়ার দুই হাতে ঝুলছে। কালো শীতের কাপড় পরিহিত উনি। এক পলক দেখেই লজ্জায় পুনরায় তাকাতে ইচ্ছে করছে না। পূর্বে যেমন আড়ালে আবডালে তাখিয়ে থাকতাম, এখন আর পারি না। অজানা লজ্জায় ডুবে যাই। ভাবী বসে থাকতে পারছেন না। ধরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আসলাম।

বারান্দায় আসতেই যাবির ভাইয়া আমাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে আসলেন। আমাকে বিছানার উপর বসিয়ে নিজেও বসলেন। আকস্মিক ঘটনা ঘটায় অবাক হয়ে রইলাম পরমুহূর্তে আসল ঘটনা বুঝতে পেরে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু যাবির ভাইয়ের কোন হেলদোল নেই। উনি কিছু হয়নি ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। উনার হাসিতে বারবার খু’ন হয়ে যাই। ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু তা এখন আর সম্ভব না। আগের আমি আর এখন আমির মধ্যে অনেক তফাৎ হয়ে গেছি। দিন দিন লজ্জাবতীর উপাধি পাচ্ছি উনার কাছ থেকে। আমি উনার দিকে এক পলকের বেশি তাকাতে পারি না।
যাবির ভাইয়া আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরলেন। আমার দৃষ্টি তখন জমিনে উনার বিছানার উপর আঁকা লাল সাদা ফুলের উপর নিবদ্ধ। উনার শান্ত স্বর শনতে পেলাম, –” তাকাও মায়া?”

যাবির ভাইয়ের কথায়ও আমার কোন হেলদোল নেই। দুই পাশে মাথা নেড়ে না বোধক ইশারা করলাম যে তাকাব না। উনি নাছোড়বান্দার মত আমার থুতনি উঁচু করে ধরলেন ফলস্বরূপ ওনার আঁখি দয় আমার আঁখি দ্বয়ে মিলিত হল।

–” আমার দিকে এক ঘন্টা তাকিয়ে থাকো তো? ইদানিং তোমার প্রেম প্রেম ভাবটা কমে গেছে। ভালো করে আমাকে দেখোও না। আমি কী আগে থেকে বুড়ো হয়ে গেছি? হলেই বা কি। পছন্দ তো তুমি করেছ। আর আমাকে পাগল বানিয়েছ। আমি বুড়ো হলেও কি আর যুবক হলেও কি। আমার সাথেই তোমার থাকতে হবে।”

–“কেন ডেকেছেন? আপনার হাসি সহ্য হচ্ছে না।”

–” যার জন্য এসেছ, তার সাথে দেখা না করে চলে যাবে? এ কেমন বিচার, মায়া?”

যাবির ভাইয়ার কথায় চোখ বন্ধ করে হেসে ফেললাম। আমার ছটফটে ভাবটা উনি কীভাবে যে বুঝে যায়, নিজেও জানিনা। আমি জানি এখন উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুভব করছি উনি এক হাতে আঙ্গ আমার কপলের উপর থেকে চুল সরিয়ে নিলেন। কিছুক্ষণ পর দূরে চলে গিয়ে বললেন, –” গিন্নিদের মতো একটু কাজ করো তো? যা এনেছো তা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসবে। এটা তোমার পরীক্ষা বলতে পারো। কঠিন সময়ে তুমি কীভাবে ধৈর্যশীল হয়ে থাকবে তা দেখব।”

মাস্টারদের কাজই মাস্টারগিরী করা। উনার দিকে বিরক্তিকর চাহনিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, –” আইছে মাস্টার, খালি পরীক্ষা নেয়।”

পিছন থেকে শুনতে পেলাম যাবির ভাইয়া হাসছেন। হেসে হেসে প্রত্যুওরে বলছেন, –” এই মাস্টারের সাথে সারাজীবন থাকতে হবে, আর সকল পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।”

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গরম গরম ধোয়া উঠানোর চা পান করছি। যাবির ভাইয়া জানালার একপাশে আর আমি অপর পাশে। আমাদের মাঝখানে দূরত্ব প্রায় তিন হাত। দিনে দিনে উনার জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে কেমন যেন নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকে। চায়ের কাপের চুমুক দিচ্ছি আর ঘন কুয়াশা দেখছি। একটু পর কোণা চোখে উনাকেও দেখছি। প্রতিবার তাকানোতে ওনার নির্লজ্জ ভরা হাসিও উপহার হিসেবে দেখছি। চা পান করা শেষ। আমাকে বাহিরে যেতে দিলেন না। আমার হাত ধরলেন তারপর বললেন , –” জাদু দেখবে?”

জাদু দেখতে কারই না ভালো লাগে। আমার খুব ভালো লাগে। অবশ্য জাদু টাদু ঐসব কিছুই না। সোজা বাংলায় বলে হাতের ক্যালমা। আমাদের স্কুলে গতবছল জাদু দেখাতে এসেছিল। শো এর শেষ মুহূর্তে কালো টুপি ওয়ালা আঙ্কেলটাই এই কথা বলে গেছেন। কিছু চালাকি আর কলাকৌশল জানা থাকলেই আপনি জাদু দেখানো যায়। যাবির ভাইয়ার কথা শুনে ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি জাদু দেখাবে। উৎসাহের সহিত বললাম, –” হ্যাঁ দেখব।”

জাদু শুরু হল। উনার বাম হাত দ্বারা আমার হাত ধরে রেখেছেন। কখনো ডান হাতের উপর ঘুরাচ্ছেন তো কখনো নিচে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাত দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন তো কখনো আমার নাকে চিমটি কা’ট’ছে’ন আবার কখনো চুল ধরে টানছেন। জাদুর মধ্যে এসবও হয়? জানা নেই। উনার কাণ্ডে আমি হেসে যাচ্ছি। জোরে জোরে হাসছি। খিলখিল করে হাসছি। আমার হাসিতে যেন কুয়ালা আরো ঘন আরো হচ্ছে। অবশেষে আমার হাসি থেমে যায় আমার বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ভারি কিছু অনুভব হওয়ায়।

চোখের সামনে হাত এনে দেখলাম অনামিকা আঙ্গুলে চিকন একটা সোনার আংটি চিকচিক করছে। হঠাৎ করে কেউ তাকালে বুঝবে না, খুব গভীরভাবে মনোযোগ দিলে দেখতে পারবে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে উনার দিকে তাকালাম। প্রত্যুত্তরে উনি মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললেন, –” তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার। ভেবেছিলাম আরো আগে দিব। কিন্তু তখন তো তুমি বাচ্চা ছিলে। আংটির মাপ আমাদের প্রথম দেখায় নিয়েছিলাম। তখন যদি দিতাম তো বলতে,’ কেন দিয়েছেন ভাইয়া? আপনার বাসায় কি স্বর্ণের অভাব পড়েছে? আমার বাবা তো আমাকে অনেক স্বর্ণ দিয়েছে। আমি এটা নিবো না। বড়োমা দেখলে বকবে।’ এখন কিছুই বলতে পারবে না। এখন তো তুমি লজ্জায় মরবে আর আমি মন ভরে দেখব।”

সুখের সময় খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। অতীত হয়ে থেকে যায় সব। সুখ কী সবসময়ই থাকে! কষ্ট আসে না! সুখ দুঃখ নিয়েই তো গল্প তৈরি হয়। ভবিষ্যতে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে জানি না। তবে খুব করে চাই, সকলে মিলে আনন্দে থাকি।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here