#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,১১,১২
#আফসানা_মিমি
| এগারো তম পর্ব |
স্বচ্ছ,পরিষ্কার পানিতে যাবির ভাইয়া মুখখানা ধৌত করে নিলেন। আমি মুখে হাত দিয়ে কূপ থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি। গতকাল রাতের আঁধারে এলাকা দেখা হয়নি। আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে দেখলাম, কূপ থেকে কিছুটা দূরে একটি মাটির মসজিদ রয়েছে। খুব কাছ থেকে দেখলে বুঝা যাবে মসজিদটি মাটির। নানান রং দিয়ে খোদাই করে কারুকাজ করা। আরবি অক্ষর, আয়াত লিখা। ছোট বাচ্চাদের আরবি পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। রুমু,সুমুর কথা মনি পড়ে গেল। গত সপ্তাহে বাসায় এসেছিল দুই দুষ্টু। আমার ঘরে এসেই লেপের নীচে ঢুকে রাজ্যের গল্প শুরু করে দিয়েছিল। গল্পগুলোর মধ্যে একটা গুজব এমন ছিল, –” রাতের আঁধারে আমি আর রুমু কাউকে কিছু না বলে বের হয়েছিলাম। জানো মায়া আপু, আমরা একটুও ভয় পাই নাই। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক অনেক দূরে একটা খেজুর গাছ থেকে দুই দুই কলস খেজুরের রস চুরি করে নিয়ে আসি। তুমি জানো! গাছের মালিক এসেছিল আমাদেরকে ধরতে। এমন দৌড় দিয়েছি গো, মালিক আমাদের ধরতে পারেনি।”
গুজব শুনা ভালো তাই বলে এমন গুজব? দুই দুষ্টু গল্প বলে জোরে জোরে হাসছিল। আমি জানতাভ গল্পটা মিথ্যা কেননা আমাদের বাড়ির বিশ কিলোমিটার পর্যন্ত কোনো খেজুর গাছ নেই।
মুখের পর পানির ঝাপটা পড়তেই আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। যাবির ভাই পাশে দাঁড়িয়ে। পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী পাঞ্জাবী দ্বারা মাথা মুছে নিচ্ছেন। নিজের কাজ সম্পন্ন করে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনো নিজের করা বিশ্রী কাজে অনুতপ্ত। পকেট থেকে আমার দেয়া রুমাল বের করে কিছুক্ষণ দেখে প্রশ্ন করলেন, –” তুমি এঁকেছ?”
–” হ্যাঁ, ভালো লাগেনি?”
–” খুব সুন্দর। তবে সাথে তোমার একটা ছবি থাকলে বেশ হতো। সমস্যা নেই আমি এঁকে নিবো।”
লজ্জায় মাথা নত করে রাখলাম। উনার সাথে আমার ছবি থাকবে। দেখতে কেমন লাগবে? আমার নিশ্চুপতায় উনি আবার বলে উঠলেন, –” থাকবে কতদিন?”
–” সাত থেকে আটদিন।”
–” তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।”
–” নিবো না।”
জাবির ভাইয়া যেন একটু রেগে গেলেন। আমার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন, –” যার জন্য করি চু’রি সেই বলে চো’র। তোমার জন্য টাকা জমিয়ে ফোন করে কিনে নিয়ে এসেছি। শুধুমাত্র কথা বলার জন্য। আর তুমি বলছো নিবে না?”
ফোনের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। ফোন চালায় কীভাবে তাই তো জানিনা। আর মানুষটা নাকি আমার জন্য ফোন কিনে নিয়ে এসেছে। ভাবা যায়! আমি সরল মনে প্রত্যুত্তরে বললাম, –” আমি তো ফোন চালাতে পারি না। দেখা যাবে পরে আপনার ফোন নষ্ট করে বসে আছি।”
আমার গতকালের দেয়া মেরিল ঠোঁটে লাগিয়ে উনি বললেন, –” ফোন চালানোর পাশাপাশি প্রেমটাও শিখিয়ে দিবো। বাচ্চা মানুষদের নিয়ে একটাই সমস্যা, সবকিছুতেই না না।”
মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সবসময় অপমান করে লোকটা। উনি ব্যাগ থেকে ফোনের একটা বক্স বের করলেন। এত বড়ো বক্ত সাথে নেয়া যাবে না তাই ফোন এবং চার্জার আমার হাতে দিয়ে বললেন, –” এই যে, এটা হচ্ছে ফোন। এই ফোনে যখন কল আসবে তখন বাম পাশের দুই নাম্বার বাটনে চাপ দিবে। তাহলেই কথা বলতে পারবে। উলটা পালটা না বুঝে চাপবে না তাহলে ফোন নষ্ট করে বসে থাকবে। তখন আমও যাবে সাথে ছালাও যাবে।”
কথায় কথায় অপমান করা লোকটার স্বভাবে গেল না। মুখফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আমি সময়ের ব্যপারে বেমালুম। বড়ো মার স্বর কানে আসতেই নড়াচড়া দিয়ে দাঁড়ালাম। যাবির ভাইয়া ততক্ষণে বুঝতে পারলেন এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। ভীত নয়নে বড়ো মার আসার পথে তাকালাম। বড়ো মা এখনো মসজিদে আড়ালে। শুধু স্বর শোনা গেছে।
যাবিরর ভাইয়াকে তাগাদা দিয়ে বললাম, –” এবার চলে যান। নাকি এখানেই থাকবেন? কোথায় থাকবেন? আপনার বন্ধুর বাসা আছে?”
আমার অস্থিরতা দেখে যাবির ভাইয়া হেসে উঠলেন এবং বললেন, –” এটা কী সিনেমা পাইছো কন্যা! যে নায়িকা যেখানে থাকবে সেখানেই নায়কের বন্ধুর বাসা গড়ে উঠবে? আমার কোন বন্ধুর বাসায় এখানে নেই। শুধুমাত্র তোমার জন্যই সাত সমুদ্র তের নদী সরি সরি রাতে এত কষ্ট করে বাসে এসেছি। ফোন সাথে রাখবে কেমন? আমি কল করব।”
যাবির ভাইয়ার কথা এক কান দিয়ে ঢুকাচ্ছি আর অন্য কান দিয়ে বের করছি। আমার সকল ধ্যান, ধারণা মায়ের দিকে। বড়ো মা এসে যদি আমার সাথে উনাকে দেখে ফেলেন তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর মধ্যে যাবির ভাই আবার বললেন, –” আমার কথা কি শুনেছো?”
–” হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি, চলে যান যান তো!”
আমার অবহেলা যেন উনি সহ্য করতে পারলেন না। যাচ্ছি বলে টুপ করে আমার গালে উনার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে চলে গেলেন। এবার আমার সম্পূর্ণ ধ্যান যাবির ভাইয়ার দিকে। গালে হাত দিয়ে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। উনি মসজিদের অপর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন। হাতে ইশারা দিয়ে বলছেন চলে যেতে। কিন্তু আমার ধ্যান-ধারণা অন্যদিকে ফিরছে না। উনি মনে হয় বুঝতে পারলেন যে আমি যাব না। অগত্যা হেসে চোখের আড়ালে চশে গেলেন।
–” কি রে মায়া, এখানে কি করছিস? গালে কি হয়েছে ধরে রেখেছিস কেন?”
–” পোকায় কামড় দিয়েছে, মা।”
আমার কথা শুনে বড়ো মা রেগে গেলেন। আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে বলতে লাগলেন,–” কি বলিস? কী পোকা কামড় দিয়েছে? বিষাক্ত পোকা নাকি, দেখি তো?”
বড় মাকে আর গাল ছুঁতে দিলাম না। বাহানা করে বড়োমাকে সাথে নিয়ে চলে আসলাম বাড়ির আঙিনায়।
————-
ইতিমধ্যে বাবা এসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়া শুরু করেছেন। গতকাল রাতের আঙ্কেলের নাম জাহাঙ্গীর আলম। দুই বন্ধু খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। উনাদের একজন ছেলে আছে। নাম মুলাশলা। আসল নাম মুবিন। মানসিক প্রতিবন্ধী। কথা কাজে ঠিক থাকে না। কথায় কথায় হাসে। আবার রাগ হলে মা’রে। উঠোনে বসে পিঠা খাচ্ছিলাম সেই সময়ে মা মুলাশলার ব্যপারে জানালেন।
খাবারের পর্ব সেরে ঘরে চলে আসি। ওড়নার নিচে লুকিয়ে রাখা কালো ছোট ফোনটার দিকে নজর দেই। আমাদের এলাকায় ফোন খুবই কম। কারোর ফোন ব্যবহার করা দেখে যে শিখে নিবো তার সুযোগ পাই নি। হঠাৎ টিংটিং করে ফোন বেজে উঠলো। প্রথমে ভয় পেয়ে যাই, ফোনটা হাত থেকে পড়ে যেতেও পড়তে দেইনি। বড় মা বাবা যদি শুনতে পায় তাহলে চরম বিপদে পড়তে হবে। কীভাবে রিসিভ করতে হবে তা তো ভুলে গিয়েছি। বর্তমানে মহা বিপদে পড়ে গেলাম। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়েই গেল। ফোনের আওয়াজ যেন বাহিরে না যায় তার জন্য ফোন বালিশের নিচে রেখে চাপ দিয়ে বসে ছিলাম। ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবারো হাতে নিলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ফোন ব্যাগের ভিতর ঢুকতে যাবো তখন আবারও ফোনটা বেজে উঠে। টিং টিং টিং আওয়াজ করে যাচ্ছে। অবশেষে মনে করলাম কী বলেছিলেন উনি। সেই অনুযায়ী চাপ দিয়ে কানে ধরলাম।
–” যাক ভালোভাবে ফোন রিসিভ করতে পেরেছো। এত দেরি করলে কেন?”
–” আপনি কি চলে গেছেন।”
–” আমি এখনো রাস্তায় হাঁটছি। বাসতো বারোটার আগে পাবো না। তাই হেঁটে হেঁটে জায়গা দেখছি।”
–” আমাকেও সাথে নিয়ে যান। এখানে ভালো লাগছে না।”
–” সব সময় যে প্রেমিক পুরুষকে সময় দিতে হবে সেটা কোন বিধানে নেই। পরিবারকে সময় দাও। এই কয়েকদিন পরিবারের সাথে হেসে খেলে সময় কাটাও। তারাও খুশি হবে, তুমিও আনন্দ পাবে। বলা তো যায় না কতদিন তাদের কাছে আর থাকবে।”
–” এভাবে বলবেন না। যা হবে পরিবারের মতে হবে। অমতে কিছুই হবে না।”
–” সেটা সময় বলে দিবে। আপাতত রাখছি। পরে কথা হবে।”
ফোন কে’টে গেল। এদিকে আমি পড়েছি মহাবিপদে। আবার যদি ফোন আসে তখন আবার বিপদে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ বসে থেকে বুদ্ধি বের করলাম। ফোনকে কীভাবে লুকানো যায় পেয়েও গেলাম। আমার ওড়নার ভিতর ফোন রেখে মোটা করে পেচিয়ে নিলাম। এরপর ঘরে আলমারির ভেতর রাখা কাপড়ের ভাজে ফোনটা রেখে দিলাম। যেন শব্দ হলে বাহিরে না আসে।
–” তুমি এখানে কি লুকাচ্ছো?”
কারো কথার আওয়াজ এ পিছনে ফিরে তাকালাম। ফোন যে লুকিয়েছে দেখে ফেলেছে কিনা ভেবে থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আগন্তুক মানুষটা আমার নিকট এসে বলল, –” যা লুকিয়েছো আমি দেখে ফেলেছি। আমি সবাইকে বলে দিব।”
বলে আগন্তুক বাহিরে চলে গেল। মা মা বলে চিৎকার করছে আমার কানে আসছে। এবার আমি ভয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। বিড়বিড় করে বললাম, –” এবার কী হবে?”
চলবে…….
#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|বারো তম পর্ব |
–” আমার লাউ গাছের আম মেহমান চুরি করে আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছে।”
ঘটনাটা আংশিক সত্যি হলেও খুশি হতাম। তবে যেই অপবাদ আমার উপর আরোপ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। লাউ গাছে যে আম ধরে তা মুবিনের কাছে প্রথম শুনলাম। আমি ভেবেছিলাম মুবিনের সম্পর্কে যা শুনেছি তা মিথ্যা অথচ এই মাত্র ছেলেটার গোবরে মাথার পোকা কথা শুনে বুঝতে পারলাম আসলেই ছেলেটা প্রতিবন্ধী। এতক্ষণের জমিয়ে রাখা নিশ্বাস ফোঁস করে ছেড়ে দিলাম। ফোনের চিন্তা বাদ দিয়ে অদ্ভুত মুবিন নামক মুলাশলার কথার মর্মার্থ ঘোরাতে বাহিরে বের হলাম।
মুবিনের মা কান মলে ছেলেকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে উনার সাবর শুনতে পেলাম মুবিনের উদ্দেশ্যে বলছে, –” তোর মাথার মগজে পোকা ধরেছে, গাধা। মেহমানদের বিরক্ত করলে ঘরে আটকে রাখব।”
মুবিনের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। এই ছেলে আর যাই হোক কারোর ক্ষতি করতে পারবে না।
অপরাহ্নের শেষ সময়। আবহাওয়া থমথমে। তীব্র শীতের আগমনের বার্তা নিয়ে আসছে বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে নাকি শীত বাড়ে। শীতকাল হচ্ছে ঘরের কোণে বসে থাকার সময়। বাহিরে বের হলে শরীর হিম হয়ে কাঁপতে থাকে। মধ্যাহ্নভোজের পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এই সময়ের মধ্যে ফোন একবারও বাজেনি তার জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানিয়েছি। আমার যে যাবির ভাইয়ার কথা মনে পড়েনি তা না। অনেকবার স্বরণে এসেছে। তবে ফোনের বিষয়ে মূর্খ বলে কিছুই করতে পারিনি। আজ অর্ধদিনে আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করে বুঝতে পারলাম, এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ কিন্তু লোকজনের আসা যাওয়া কম। ঘর থেকে বের হয়ে আবহাওয়া দেখে আনন্দিত হলাম। মুন্সী বাড়ির প্রধান ফটক পর্যন্ত ঘুরে আসব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। একা যাওয়া কটু দেখায় বিধায় মালা মেহেদীকে সাথে নিবো ভেবে নিলাম। তবে আশেপাশে দুই ভাই,বোনের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম বড়ো মাকে সাথে নিয়ে ঘুরবো। উনাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা কামড়ায় যাবো তার আগেই জানালায় বড়ো মা এবং বাবাকে দেখতে পেলাম। বাবা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে নিচে বসে থাকা বড়ো মাকে গভীরভাবে দেখছেন। বড়ো মা লাজুক মুখে পানের বাটা সাজাচ্ছেন। বর্তমানে বাবা এবং বড়ো মাকে সবচেয়ে সুখী দম্পতি মনে হচ্ছে। উনাদের জ্বালাতন করার ইচ্ছে করল না। গায়ে চাদর জড়িয়ে একা পথে ঘুরে বেড়াবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
কূপের বিপরীত দিক দিয়ে যাওয়ার সময় যাবির ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। উনার কথা স্বরণে আসতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে গেলাম। মুবিন মাঝরাস্তায় আসায় আমার হাঁটা থেমে যায়। এই ছেলেটাকে বড্ড ভয় পাই। একটা কথা বললে উলটা বুঝে। যদি বলি চলো জঙ্গলে যাই প্রত্যুওরে বলবে, –” ঐখানে যেও না মায়া, ঐখানে হাপ আছে হাপ!”
আমার ভাবনা ফুরালো না। মুবিনের বোকা কথা কানে আসে, –” আমাদের পাট ক্ষেতে আগুন লেগেছে। মাছগুলা দৌড়ে পালাচ্ছে। ঐখানে যেয়ো না মায়া, তোমাকে মাছ কামড় দিবে।”
মুবিনকে সবাই মুলাশলা ডাকে কেন তার প্রমাণও পেলাম। একজন মহিলা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মুবিনের কথা শুনে মাথায় গাট্টা মেরে বললেন, –” পাগলে কয় কী। এই মাইয়া এই পাগলের কথা একদম বিশ্বাস করবা না। তোমার মাথা এমন আওলায় দিবে যে তুমি কূল কিনারা পাবা না।”
মুবিন চিৎকার করে উঠে। মহিলার দিকে ইট নিক্ষেপ করে বলে, –” তুই পাগল বেডি। আমারে পাগল কয়। আমি হলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুবিন হক। আমার কথায় মুন্সী বাড়ি চলে।”
মহিলা আরো বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলে গেলেন। আমি মুবিনকে পাত্তা দিলাম না। মুন্সীবাড়ির প্রধান ফটক থেকে কিছু দূর পর্যন্ত হাঁটা ধরলাম।
ছোট্ট একটা পুকুর। যার চারপাশ ঘিরে বসতি রয়েছে। কয়েকটি বসতির মাটির রাস্তা এসে পরেছে পুকুর ঘাটে। তীব্র শীতেও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন বাচ্চারা পুকুরে ঝাপ দিচ্ছে।শীতের দিনে পানিগুলো শীতল হয়। বাচ্চাদের দৌড়ঝাপ দেখে শরীর আরো হিম হয়ে আসলো। আমার পিছু পিছু মুবিনও এসে হাজির হয়। পুকুরের পাড় বিস্তৃত। হাঁটা চলার জায়গা আছে। বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। তাই করলাম, ধীরপায়ে হেঁটে একটা বাঁশের মাচায় গিয়ে বসলাম। আকাশ অন্ধকার, হয়তো কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি ঝড়বে। বাচ্চারা আমাকে দেখে আরো বেশি পুকুরে ঝাপ দিচ্ছে। কিছু বাচ্চারা এমন হয়, মানুষ দেখলে আনন্দে যা ইচ্ছে তাই করে থাকে হোক সেটা ভালো বা খারাপ। বাঁশের মাচার নিচে পানি ভর্তি বয়াম ও বোতল দেখতে পেলাম। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম বয়ামের ভেতর ছোট ছোট চিংড়ি মাছ আটকে রেখেছে। অপর বয়ামে পুঁটি মাছ। বোতলগুলোতে ছোট ছোট শিং মাছ। আমি বুঝতে পারলাম এগুলো বাচ্চাদের। ইতিমধ্যে সবগুলো বাচ্চারা আমাকে চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একজন বাচ্চা বলে, –” আপনি কী বিদেশি?”
আমি নিজের দিকে খেয়াল করলাম। আমার পোশাকে বিদেশি নারীদের চিহ্ন নেই তবুও এই বাচ্চাদের কাছে আমি বিদেশি হয়ে উঠেছি। আমি প্রত্যুওরে হেসে বললাম, –” আমি এলাকায় নতুন ঐ যে মুবিনদের মেহমান।”
আমার কথা শেষ হতেই বাচ্চারা পাগল বলে মুবিনকে ক্ষ্যাপাতে থাকে। কয়েকটা বাচ্চা বোতল বয়াম হাতে তুলে মুবিনকে বলে, –” পাগলা তোর পাগলি কই। হাঁড়ি ভেঙে আনবি খই।”
মুবিন চিৎকার করে উঠে। ততক্ষণে বাচ্চারা পারাপার। আমি হতভম্ব, গ্রামাঞ্চলির বাচ্চারা কী এমন হয়! মুবিনকে টেনে বাড়ি চলে আসলাম।
দশের লাঠি একের বুঝা। বড়ো মা একাই একশ আমাদের সামলাতে। বর্তমানে মালার মাথার চুলের সাথে যুদ্ধ করছেন। বেড়াতে এসেও সারাদিন এখানে সেখানে দৌঁড়াদৌড়ি করেছে দুজন। মাথায় চুলের জট। আমাকে আসতে দেখে বললেন, –” তোর বাবা ডাকছে। ভাবী খেজুরের রস জাল দিয়ে রসি বানিয়েছেন। তোর না খুব প্রিয়!”
প্রিয়র তালিকায় তো অনেক খাবার আছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ঐ সাদা চিকন যাবির ভাইয়ার হাতে মসলা মাখিয়ে গাপুস গুপুস খেয়ে ফেলতে। মজাদার হবে হয়তো। পরক্ষণে মনের অদ্ভুত দুষ্টু চিন্তা বাদ দিয়ে মার কথামতো বাবার কাছে গেলাম।
————-
রাতের ভোজনের পর্ব সেরে ঘরে আসলাম। মালা ঘুমিয়ে কাতর। আমিও বিছানায় শুয়ে পড়েছি। শীতে থরথর কেঁপে উঠছি। গ্রামের মানুষগুলো বড়োই অদ্ভুত। সন্ধ্যা হতেই দরজা আটকে ঘরে বসে থাকে। আটটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের পরিবারের সকলের অভ্যাস দেরি করে ঘুমানো। মালা এই পরিবেশে এসে তাদের মত হয়ে গেছে। নীরব পরিবেশে আকস্মিক আওয়াজ হলে যে কেউই ভয় পাবে আমার বেলাও তাই। ফোনের ক্রিংক্রিং আওয়াজে ধরফরে উঠে বসলাম। আলগোছে দৌড়ে আলমারি থেকে ওড়না মুড়ানো ফোন বের করলাম। ফোন লাগাতার বেজে যাচ্ছে। ভয়ে শীতেও ঘামছি। পনেরো প্যাঁচের ভিতর ছিল ফোন। ইতিমধ্যে ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। উলটা পালটা একটা বাটনে চাপ লাগায় দৃশ্যমান হয় সত্তরটা মিসড কল। ফোনের ব্যাপারে মূর্খ হলেও আমি পড়াশোনায় তো অজ্ঞ। চোখ বড়ো করে তাকিয়ে রইলাম। ফোন হাতে নিয়ে ভাবছি, এতোবার ফোন বেজেছে আর কেউ টের পায়নি। পরক্ষণে মনে পড়লো, আমার বিশেষ প্রতিভার কথা। নিজের বুদ্ধিমত্তায় হেসে ফেললাম। ফোন বেজে উঠলো সাথে আমার হৃদপিন্ডের আওয়াজ বেড়ে গেলো। সময় নিয়ে ফোন কানে ধরলাম।
যাবির ভাইয়া নিশ্চুপ। শুধুমাত্র শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি কথা বলছি না যধি কেউ কথা শুনে ফেলে এই ভয়ে। কিন্তু উনার কী হয়েছে? উনিও কী আমার মতো ভয় পাচ্ছে? আমি যতটুকু জানি, ছেলেরা সাহসী হয় উনি দেখছি ভীতুর ডিম। মনে মনে প্রস্তুত নিচ্ছি আমিই কথা শুরু করব, ঠিক তখনই উনার স্বর কানে আসে, –” চলো আসো, মায়া! তুমিহীনা খুব শূন্য লাগছে।”
–” এভাবে বলছেন কেন? আপনি কী অসুস্থ?”
আবারো নিশ্চুপতা। এবার ভয় পেলাম। মানুষটার কী কঠিন অসুখ হয়েছে? কিন্তু আমার ভাবনা ভুল। উনার আবেগমাখা কথা শুনে নুয়ে গেলাম।
–” তোমাকে দেখার তৃষ্ণা জেগেছে আমার দুই চোখে। চলে আসার সময় মনে হচ্ছিল আমার প্রাণ বুঝি রেখে এসেছি অচিন দেশে।”
–” আমাদের পথচলার এই সময় পর্যন্ত আমরা কখনো দূরে থাকিনি। তাই আপনার এমন অনুভব হচ্ছে।”
–” তোমার কষ্ট হচ্ছে না? আমার কথা স্বরণে আসে না?”
–” আমার স্বরণে, স্বপ্নে আপনার কাছে না আসার বাহানা নেই। আপনার হাতের ছোঁয়া লেগেছে আমার হাতে। আপনার ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে আছে গালে। আপনি কী ভুলে থাকার সুযোগ দিয়েছেন?”
যাবির ভাইয়া নীরব। শুধুমাত্র দ্রুতগতির শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। উনার কথা শোনার আগেই বড়ো মার কথা শুনতে পেলাম। দরজার কাছে এসে জোরে কড়াঘাত করছেন। আমার নাম ধরে সম্বোধন করে বলেন, –” মায়া, ভয় পাচ্ছিস মা? একা কার সাথে কথা বলছিস। আমি আসবো? তোর সাথে থাকলে ভয় কে’টে যাবে।”
মায়ের কথায় কী বলব বুঝে আসছে না। অনেকেই বলে প্রেমে পড়লে নাকি মিথ্যার আশ্রয় নেয়, দোষ গুন কিছুই চোখে পড়ে না। সকাল বিকাল কোনো কিছুরই খবর থাকে না। আমি মিথ্যার আশ্রয় নিলাম। ঘুম জড়ানো স্বরে বললাম, –” মশার সাথে কথা বলছি। যা অত্যাচার করছে! তুমি ঘরে যাও, বাবা অপেক্ষা করছে।”
বড়ো মা বিশ্বাস করলেন। চলে গেলেন দরজার সামনে থেকে।
–” মিথ্যা বলা শিখেছো।”
যাবির ভাইয়ার কথায় লজ্জা পেলাম। গায়ের শাল আরো গভীরভাবে জড়িয়ে বললাম, –” কই, মিথ্যা তো বলিনি। আমি তো বড়ো মশার সাথে কথা বলছি,তাই বললাম।”
অপরপাশে শুধু যাবির ভাইয়ার জোরে জোরে হাসার শব্দ শুনতে পেলাম। চোখ বন্ধ করে ভাবছি উনার হাসিমাখা মুখখানা। উনার সাথে আমিও হাসছি। হাসি, কথার মাঝেই আমরা মধ্যরাত পর্যন্ত পাড় করেছি। উনি কখনো পড়াশোনা নিয়ে উপদেশ করেছেন তো কখনো বাচ্চা বলে ক্ষ্যাপিয়েছেন। আজকে এক নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছি। নতুনভাবে যাবির ভাইয়ার প্রেমে পড়েছি। সব মিলিয়ে আজকের রাতটা আমার নিকট স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শেষ রাতে ঘুমানোর ফলে বেশ বেলা করে আমার ঘুম ভাঙে। তবুও বাহিরের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে। স্পষ্টত কর্ণধারে আসছে কতজন মহিলাদের কান্নার আওয়াজ। একেকজনের আহাজারি শুনে অন্তর কেঁপে উঠছে। হাত পা কাঁপছে। ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোন দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। বিছানা থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত আগাচ্ছি আর মনে মনে বলছি, –” খারাপ কিছু যেন না হয়।”
চলবে……..