#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,১৩,১৪
#আফসানা_মিমি
| তেরো তম পর্ব |
মুবিনের মা এবং তাঁর পাশে দুইজন মহিলা বসে কাঁদছেন। হাঠৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে পরিচিত মুখ অর্থাৎ বাবা এবং বড়ো মাকে খুঁজছি। আস্তে আস্তে এলাকার মহিলাগণ জড়ো হচ্ছেন বাড়ির উঠোনে। একজন অপরজনের সাথে কানাঘুষো করছেন কোনো এক বিষয়ে। আমি দুই দড়িয়ার মাঝখানে আটকে আছি। আমি চাইছি কেউ বলুক আহাজারির কারণ। আশাহত হয়ে মুবিনের মায়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। উনার কাছে বসে কাঁধে হাত রাখতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, –” আমার মুবিনের কিছু হইবো না তো?”
আমি এতক্ষণে উপলব্ধি করলাম, মুবিন কোথাও নেই। পাশ থেকে একজন মহিলার বিলাপ স্বরের কথা কানে আসলো, –” পাগলরে কেডা কইছিল পুকুরে ঝাঁপ দিতে। নিজেই পাগল, ছোট; হে গেছে আরেক ছোট মাইয়ারে বাঁচাইতে।”
ছোট মেয়ে মানে মালা। মালা মেহেদী আশেপাশে নেই। তারমানে আমাদের মাথার উপর সবচেয়ে বড়ো বিপদ। মুবিনের মা প্রত্যুওরে বলেন, –” আমার ছেলেরে আপনারাই পাগল বানাইছেন পাগল ডাকতে ডাকতে। নইলে যখন এসে বলল যে, মেহমান পানিতে পড়ছে তখনই আমরা চলে যেতাম বাঁচাতে। আপনারা পাগল বলেন বলে সেও পাগলামি করে আর আমরা সবসময়ের মতো কথা উড়িয়ে দেই, আমার আব্বা! কই গেলা গো আব্বা!”
মুবিনের মায়ের কথায় না চাইতেও চোখে পানি চলে আসে। আমাদের সমাজে একদম মানুষ আছেন যারা একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানষকেও মুহুর্তেই অসুস্থ বানিয়ে ফেলতে পারেন। মুবিনের বিষয়টাও তেমন। মুবিন যতটা না মানসিক প্রতিবন্ধী তার চেয়েও বেশি সমাজের মানুষদের কথায় বেশি অতিষ্ঠ। মুবিনের মাথায় সমাজের মানুষেরা গেঁথে দিয়েছে যে পাগল। পথ, ঘাটে, রাস্তায় পাগল বলে ক্ষ্যাপায়। যারা নতুন আসে তাদের চোখেও মুবিনকে পাগল বানিয়ে ফেলেছে। পাগল বলতে বলতে ছেলেটাও মস্তিষ্কবিকৃত হয়ে গেছে উলটি পালটা বলে ঘুলে বেড়ায়। মুবিনের সত্যি কথাও তখন কেউ বিশ্বাস করে না মিথ্যা কথাও না।
–” মা, কাঁদো কেনো? আব্বার কিছু হইছে?”
পরিবেশ থমথমে। এতক্ষণের গুনগুন কানাঘুষোও মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সামনে সুস্থ সবল মুবিন দাঁড়িয়ে আছে। মুবিনের চোখে মুখে বোকা হাসি। তার পাশেই বড়ো মা এবং বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মালা বাবার কোলে আর মেহেদী বড়ো মায়ের হাতে। মুবিনের মা দৌড়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিলেন। আমার আব্বা বলে সারা মুখে চুমু খেলেন। ইতিমধ্যে আমি বড়ো মার পাশে দাঁড়ালাম। মালার মাথা বাবার কাঁধে রাখা। বুঝতে পারলাম মুবিনের ক্ষতি না হলেও মালার ক্ষতি হয়েছে। বাবা মুবিনের মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন, –” আমাদের মুবিন খুব সাহসী ছেলে। মালাকে একাই পুকুর পাড়ে তুলেছে। মানুষের কথায় একদম কান দিবেন পা ভাবি। আমাদের মুবিনের ভবিষ্যত উজ্জ্বল। এখদিন আপনিও মুবিনকে নিয়ে গর্ব করবেন।”
বাবার কয়েক শব্দ যেন একজন মায়ের মনে ভরসা জাগিয়েছে। ছেলের জন্য এত বছর পাগলের মা উপাধি পেতে হয়েছিল উনার।
বাবা এবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। মায়াকে আমার কোলে দিয়ে বললেন, –” একটু দুর্বল, পেট থেকে পানি বের করেছি। শুইয়ে দাও। আর তৈরি হয়ে নাও। বিকেলে বাসায় ফিরব।”
আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি ছয়দিনের জন্য। আজ দুইদিন হয়েছে। হুট করে চলে যাওয়াটা বেমানান মনে হচ্ছে। মালার অবস্থা দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বড়ো মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, শুকনো মুখখানা নিয়ে আমায় কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বলতে পারছেন না।
ঘরে চলে আসলাম। মালাকে শুইয়ে দিয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করলাম।
গতকাল রাতে ফোনের বিষয়ে অনেক কিছু যাবির ভাইয়ার কাছ থেকে শিখেছি। দুই তিনবার উনাকে ফোন করলাম কিন্তু ধরনি। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। মনে হয় উনি ঘুমাচ্ছেন। এখন সময় মধ্যাহ্নের শুরু। মালার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। গতকাল রাতের দুষ্টু মিষ্টি কথা ভেবে হাসছি। ধীরে ধীরে ভালোবাসার অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি। দূর থেকে যাকে চাইতাম সে এখন আমাকে পাগলের মতো চায়। বিয়ে করলে নাকি আমাকেই করবে। তার জন্য পরিবারের অমতে যদি যেতে হয় তাই করবে। তবে আমার ইচ্ছে পরিবারের মতামত থাকবে। হাসি, মজা, আনন্দ থাকবে আমার বিয়েতে।
———-
শব্দহীন ভাবে ফোন বেজে চলছে থামার নামগন্ধ নেই। ফোনের অপরপাশের মানুষটা যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। মালার পাশে বসে থেকে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারিনি। ঘুম জড়ানো স্বরে ফোন রিসিভ করে বললাম, –” কেন জ্বালাচ্ছো দিন বা রাত, তুমি ঘুমাও নিঝুম রাত। আসছি আমি তোমার নিকটে, বলব জমানো কথা শুভ্রপুষ্পে।”
অপরপাশে নীরবতা। ঘন নিশ্বাসের আওয়াজ আসছে। উনি হয়তো ঘুমাচ্ছেন। হেসে ফেললাম, চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা রেখে উনার নিশ্বাসের আওয়াজ শুনতে থাকলাম। এভাবে প্রায় বিশ মিনিট অতিবাহিত হয়ে যায়। ফোন কান থেকে সরাচ্ছি না। কিছুক্ষণ পর ফোনের অপরপাশ থেকে নুসরাত ভাবীর স্বর শুনতে পেলাম। ভাবি বলছে, –” কী ব্যাপার দেবর সাহেব! নতুন প্রেমে পড়েছেন নাকি? বেলা করে তো কোনদিনও ঘুমান না। আজ এত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন কেন?”
লজ্জা পেলাম খুব। প্রেমে পড়লে রুটিন মাফিক চলা দুষ্কর। যাবির ভাইয়া উঠে পড়লেন। ঘুম জড়ানো স্বরের প্রত্যুওরে বললেন, –” বিয়ে করিয়ে দাও ভাবী। ঐ পিচ্চিকে ছাড়া চলবে না।”
আর কিছু শুনতে পেলাম না। ভাবী হয়তো চলে গেছেন। হঠাৎ যাবির ভাইয়ার ঘুম জড়ানো স্বর কানে আসে, –” তুমি আমার কাছে আসতে চাইলে কিছু ভাববে না। সব ঠেলে পিছু ফেলে চলে আসবে। তুমি যেভাবেই কাছে আসবে সেভাবেই আমি তোমাকে গ্রহণ করে নিব।”
–” হঠাৎ এই কথা বলার কারণ টা বলবেন?”
–” আজ শেষ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি।”
উনার কথায় চুপসে গেলাম। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কারোর থেকে শুনেছিলাম, স্বপ্নের কথা বলে দিলে নাকি বিপরীত কাজ করে।কথাটা অবিশ্বাস্যকর। কারিমা আন্টি একবার বলেছিল, স্বপ্নের ব্যাখা ভালো,বিজ্ঞ আলেম দিতে পারেন। তবে স্বপ্ন যে সত্য হয় তা মানা নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই মুহূর্তে যাবির ভাইয়ার স্বপ্ন শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে কথা ঘোরলাম, –” আগামীকাল একটু শুভ্রপুষ্পে আসবেন?”
–” তুমি নেই যেখানে, সেখানে পা রাখতে ইচ্ছে করে না। চতুর্দিক থেকে তোমার স্মৃতি আমাকে আস্টেপিস্টে ধরে।”
কথা বলার মাঝেও সখ্যতা গড়ে উঠে এই কথাটা সত্যি। উনার সাথে কথা বললে বিরক্তিভাব আসে না বরঞ্চ ভালো লাগে। আমি প্রত্যুওরে বললাম, –” এবার না হয় বুকে পাথর বেঁধে চলে আসবেন। একা একা আপনার মায়ার স্মৃতিচারণ করবেন।”
–” আমার মায়ার কথা ফেলা দায়। আমি অবশ্যই সেথায় যাবো। একা একা কবিতা লিখব। সবুজ ঘাসের উপর খালি পায়ে হাঁটব। অনুভব করে নিবো তুমি পাশেই আছো।”
——————-
মধ্যাহ্নভোজের পর বাবার সাথে বসে আছি। বড়ো মার মুখ ফোলা, ভার হয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে কোনো কিছুই ভালো হচ্ছে না। আত্মীয়ের বাড়িতে আসার সময় বড়ো মার মুখে যেই লাজুক হাসি দেখেছিলাম এখন সেটা দেখছি না। বাবাও চুপচাপ।
ইতিমধ্যে মুবিনের বাবা ঘরে প্রবেশ করেন। পরিধানে ঢিলেঢালা পাঞ্জাবী লুঙ্গি। কাঁধে লাল গামছা হাতে চামড়ার ব্যাগ। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, –” তোমাকে কইছিলাম আরো কয়েকদিন থাইকা যাইতে রোনক। থাকবা না তবে আমরা খুব শীঘ্রই আত্মীয় থেকে পরম আত্মীয় হমু। তাই এবারে যাইতে দিলাম। আমার শহরে যাওয়া খুব প্রয়োজন নাইলে পাকা কথা এখনই শেষ করতাম। ভালো থাইকো রোনক, ভাবী আবার দেখা হইবো।”
মুবিনের বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে চলে গেলেন।
ঘরের বাইরে আবারো শোরগোলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এবার কান্নার নয় বরঞ্চ হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি বড়ো মা বাহিরে বের হলাম। দ
কয়েজ
কয়েকজন কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিত মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। এবং তাদের ঘিরে সকল মহিলারা দাঁড়িয়ে হাসছেন আর কী যেনো বলে বলে কানাঘুষো করছেন। দুজন মহিলাদেরমধ্যে একজন বলেন, –” আমরা সানসিল্ক কোম্পানি থেকে এসেছি। আমরা প্রতি মাসে গ্রামে গ্রামে যাই। আধুনিক সভ্যতা সবার কাছে ছড়িয়ে দেই।”
গ্রামের কিছু মূর্খ মহিলারা মুখ ভেংচি কে’টে বলছেন, –” আদিকাল থেইকা শাবান ঘইষা আইতাছি। এহন আবার আধুনিক কী জিনিস?”
আমরা ছোটবেলা থেকেই শ্যাম্পু ব্যবহার করে এসেছি। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে মা চাচীদের দেখা অনুযায়ী মাথার চুলে এখনো সাবান ব্যবহার করে। তারা মনে করে শ্যাম্পু ব্যবহার করলে মাথার চুল ঝড়ে পড়বে। দোকানিরা ব্যবসায় লোকসান হওয়ার ভয়ে শ্যাম্পু কিনে না। এজন্যই সানসিল্ক কোম্পানি নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন।
ইতিমধ্যে দেখতে পেলাম একটা টেবিলের উপর সানসিল্ক কালো পাতা শ্যাম্পু ডজন ডজন রাখা হয়েছে। তার সাথে চিরুনি, কলম রাখা হয়েছে। আপরপাশে এক বস্তা চাল, অনেকগুলো কৌটা এবং পাত্র রাখা হয়েছে।কোম্পানির মহিলা দুজন গ্রামের মহিলাদের বসার জন্য পাটি বিছিয়েছেন। এরপর শুরু করলেন দ্বিতীয় ধাপ। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন,
–” আমরা মেয়েরা যেমন রাঁধতে পারি তেমন চুল বাঁধতে জানি। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের আয়োজন। আপনাদের বিনোদনের জন্য কিছু খেলাধুলার আয়োজন করেছি। যার মধ্যে একটা হচ্ছে কে সর্বপ্রথম নিদ্দির্ষ্ট পরিমানের চাল নিদ্দির্ষ্ট সময়ে পাত্রে রাখতে পারে। এর পরের ধাপ হচ্ছে নিদ্দির্ষ্ট সময়ে মাথার চুল আঁচড়ে খোপা করা। যিনি প্রথম হবেন তার জন্য রয়েছে সানসিল্ক কোম্পানির পক্ষ থেকে দুই ডজন শ্যাম্পুর বক্স আর যিনি দ্বিতীয় হবেন তার জন্য রয়েছে চিরুনি আর যিনি তৃতীয় হবেন তার জন্য রয়েছে কলম যা আমাদের সকলেরই নিত্যদিনে প্রয়োজন হয়।”
খেলা হোক বা প্রচার হোক আমি বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করছি। আমাদেরকেও শামিল হতে বলেছে খেলায়। বিছিয়ে রাখা পাটির উপর আমি এবং বড়ো মা বসে পড়লাম। আমাদের দেখে অন্যান্য মহিলারা বসে পড়লেন। এরপর শুরু হলো প্রাথমিক ধাপ। চালের পাত্র কৌটা সকলের সামনে রাখা হয়েছে। একমিনিটের মধ্যে বিশ কৌটা চাল পাত্রে ঢালতে হবে। এই ধাপে পাঁচ থেকে ছয়জনকে বিজয়ী করা হবে। প্রথম ধাপে জিতে গেছি। এরপরের ধাপে একটি চিরুনি দেওয়া হয়েছে। যেটা দিয়ে নিজেদের মাথা আচড়ে সুন্দরভাবে খোঁপা করতে হবে। যে সর্বপ্রথম সুন্দর সুনিপনভাবে মাথা খোপা করতে পারবে সেই বিজয়ী। দেখা গেছে মহিলারা তাড়াহুড়ো করে প্রায় সকলেই মাথার চুল ভালোভাবে না আচড়ে খোঁপা করেছেন।
আমি বরাবরই চুল বাঁধতে কাঁচা। সবসময় বড়ো মা চুল বেঁধে দেন। বড়ো মা ছাড়া আমার চলেই না। আর এখন তো মনে হয় না এত মানুষের ভিড়ে পারব। হলোও তাই। সকলের চুল বাঁধা দেখে নিজে হা করে তাকিয়ে রয়েছি বিধায় জয়ী হতে পারিনি। প্রাথমিক পর্যায়ে শেষ হয়ে এবার চূড়ান্ত পর্যায় চলে এসেছে। বড়ো মা, মুবিনের মা এবং আরো দুইজন মহিলা অবশিষ্ট রয়েছেন। এখন তাদের মাঝে খেলা শুরু হবে। বড়ো মার মাথার চুল পাতলা বিধায় জয়ী হলেন। বড়ো মা দুই ডজন শ্যাম্পু পেলেন যার সবগুলো গ্রামের মহিলাদের তখনই দিয়ে দেন। এছাড়াও সানসিল্ক কোম্পানির পক্ষ থেকে ছোট বাচ্চাদের সহ বড়ো মহিলাদের ফ্রিতে শ্যাম্পু বিতরণ করেন। মুবিনদের বাসায় খেলা হয়েছে বলে মুবিনের মা অনেক শ্যাম্পুর পাতা উপহার হিসেবে পান।
গ্রামে না আসলে হয়তো এত সুন্দর বিনোদন দেখতে পেতাম না। অপরাহ্নের সময়ে বাসায় ফিরব বলে তৈরী হচ্ছিলাম। তখনই ফোন বেজে উঠে। কিছু সময়ের জন্য যাবির ভাইয়াকে ছটছটে প্রেমিক হিসেবে দেখতে ইচ্ছে করল। ফোন কে’টে বন্ধ করে রাখলাম। আজ আর খুলবো না। আগামীকাল নিদ্দির্ষ্ট সময় সামনে গিয়ে চমকে দিব।
মুবিনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুন্সী বাড়ির প্রধান ফটকে এসে দাঁড়ালাম। এখানেই বাস এসে থামবে। বড়ো মা চুপচাপ, বাবা অনেকক্ষণ যাবত বড়ো মার দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম দুজনের মধ্যে আবারো অভিমান বাসা বেঁধেছে। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করলাম। বাসায় যাচ্ছি, মা থাকবেন বড়ো মা আগের মত সারাদিন কাজ করেই যাবেন। বাবাও মার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিবেন। পরিশেষে দুজন মানুষ দুই প্রান্তে যন্ত্রণায় ছটফট করবে আর আমি দেখে যাবো।
হঠাৎ বড়ো মা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, –” কখনো বাবার অবাধ্য হবি না মায়া। তোকে নিয়ে আমি গর্ব করি, আমার মান রাখিস মা!”
বড়ো মার কথার মানে বুঝতে পারলাম না। তবে খারাপ কিছুর আগমন ঘটেছে আমার জীবনে বুঝতে পারলাম।
চলবে……….
#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|চোদ্দ তম পর্ব |
সবুজে ঘেরা গ্রাম ছেড়ে জন্মভূমিতে চলে এসেছি। দুইদিন পর বাড়িতে এসে সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। মনে হচ্ছে, অনেক বছর পর নিজ গৃহে ফিরে এসেছি।
বড়ো মা বাড়ি ফিরেই কাজে লেগে পড়েছেন। মালা, মেহেদী নিজেদের ঘরে ঘুমাচ্ছে। রজনীর মধ্যভাগ। ভ্রমণের মাঝপথে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সময়ের সংক্রমণে ফিরতেও দেরী হয়ে গেলো। মুঠোফোনের দিকে বার কয়েকবার দৃষ্টিপাত করলাম। মন বলছে, তার কন্ঠনালী থেকে অস্পষ্ট স্বর শুনতে। কিন্তু বাস্তবিকই নিজের অনুভূতিকে আড়াল করলাম। কিছু পেতে হলে কিছু বিসর্জন দিতে হয়। আমি না হয় মনের ইচ্ছেকে বিসর্জন দেই। আগামীকাল হয়তো আমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
শীতের সকালে সূর্যের কিরণ দেখা মিলল তো আপনি ভাববেন, আপনার কাছে আজ বিশেষ দিন। আপনি নাও ভাবতে পারেন তবে আমি ভাবি। ঘুম জড়ানো চোখে যখন সূর্যের আলো চোখে এসে বিঁধে তখনই আনন্দে মন নেচে উঠে। কুয়াশাচ্ছান্ন শীতের প্রভাব বেশি থাকে। নীলাভ আকাশে সূর্যের রশ্মি জমিনে পড়তেই হিম ভাবটা ফুরিয়ে আসে। গায়ের ভারি বস্ত্র ছেড়ে পাতলা শাল গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ঘর থেকে বের হয়ে আমার মন খারাপ হয়ে আসলো। তিনদিনে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার পরিবারেও সংকট আছে। ভালোবাসার সংকট। শান্তির সংকট। মা হাতে ব্যাগ পত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রক্তিম বর্ণ চোখ করে বাবা মার ঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় ব্যয় করে ফেলেছি। মায়ের তাকানোর মর্মার্থ বুঝে ঘামছি। অতি শীঘ্রই বাড়ির পরিবেশ পরিবর্তন হতে চলছে। মা আমাকে আদেশের স্বরে বললেন, –” দরজায় কড়াঘাত করে আয়, মায়া।”
মায়ের শক্ত স্বর শুনে কেঁপে উঠলাম। অন্তরে খুব দোয়া করছি বড়ো মা যেন ঘরে না থাকেন। দরজায় দুইবার কড়াঘাত করলাম। এত বেলা হয়েছে, বড়ো মা শুয়ে থাকার মানুষ না। হয়তো বাবা ঘরে একা আছেন। আরো চার পাঁচবার কড়াঘাত করলাম। বাবা দরজা খুললেন। চোখ কচলে চশমা পরতে পরতে বললেন, –” তোর বড়ো মার রাতে জ্বর এসেছিল। এখন ঘুমাচ্ছে। তুই কিছু নাস্তা বানিয়ে ফেল,মা।”
ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাবা এখনো মাকে দেখেনি। অস্পষ্ট স্বরে প্রত্যুওরে বললাম, –” বাবা, মা এসেছে।”
বাবার মুখ মুহূর্তে শক্ত হয়ে আসলো। চশমা ঠিক করে মার দিকে তাকিয়ে বলল, –” বাড়ির ঝামেলা এবার এত তাড়াতাড়ি মিটে গেছে?”
আগুনে ঘি ঢেলে দিল বাবা। মা হাতের ব্যাগ ফেলে বাবার কাছে এসে চিৎকার করে বললেন, –” এই ছিল তোমার মনে? আমি থাকতে কিছু করতে পারো না বলে আমি চলে গেলে আমারই ঘরে আমার সতিনের সাথে?”
–” গলা নামিয়ে কথা বলো সুরজাহান। ভুলে যেয়ো না, তুমি যেমন এই বাড়ির বউ তেমন ফুলবানুও এই বাড়ির বউ।”
–” সে বউ হলেও আমি তোমার সন্তানদের মা হই। আমার অধিকার এখানে বেশি। সে এই বাড়িতে পড়ে আছে কেনো? তোমার মা তো বেশ বলেছিল, তোমার সংসার তোমার ঘর, তোমার পতি শুধুই তোমার বর। বড়ো আপা ও তা মেনে নিয়েছিল। এত বছরে আমার সন্তানদের হাতের মুঠোয় করল, এখন তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। তোমাকে কী জাদু করেছে। রুপ দেখিয়ে ফাসিয়েছে নিশ্চিত।”
–” সুরজাহান?”
পর পর দুইটা থাপ্পড়ের আওয়াজে চমকে উঠলাম। ইতিমধ্যে বড়ো মা দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। বাবা মার ঝগড়া দেখতে নেই এতে সন্তানের উপর গাঢ় প্রভাব ফেলে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে কাঁদছি। মা আরো বেপোরোয়া হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। ফল কাটার চা’কু এনে বড়ো মাকে আঘাত করতে চাইলেন, পারলেন না। বাবা তার আগেই আটকে দিলেন এবং শক্ত স্বরে বললেন, –” এতবছর মুখ ফুটে কিছু বলিনি সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে। সন্তানরা বড়ো হয়েছে। ভালো মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। আজ আমি রৌনক চৌধুরী বলে রাখছি। এই চৌধুরী বাড়িতে সবার হক সমান। বউদের সাথে সন্তানদের। আমি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফুলবানুকে তার পরিপূর্ণ অধিকার থেকে বঞ্চিত করব না। এক সপ্তাহ ফুলবানুর সাথে থাকব আরেক সপ্তাহ সুরজাহানের সাথে। এই নিয়ে আরেকটা কথা বললে আমার তালাক দিতে বুক কাঁপবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছো?”
মা কিছু বললেন না। হনহন করে ঘরে ঢুকে গেলেন। বাবা বড়ো মাকে ধরে আমাদের ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, –” তোমার কিছু লাগবে?”
প্রত্যুওরে মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, –” সুরজাহানের সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কে চাইবে স্বামীকে অন্য কারোর হাতে তুলে দিতে!”
–” তুমি তো তুলে দিয়েছো।”
বড়ো মা আর কিছু বললেন না। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। বাবা আর কথা বাড়ালেন না। আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, –” কিছু রান্না করে নে, মা।”
প্রত্যুওরে কিছু বলব তার আগেই বড়ো মা উওর দেন, –“তোমার এই মেয়েকে আমি জীবনেও গ্লাস হাতে নিয়ে পানি পান করতে দেইনি। সেখানে রান্না করবে কীভাবে। আমি রান্না করব। মায়া পাশে থাকলেই হবে। তুমি সুরজাহানের কাছে যাও। রাগ জিনিসটা খুবই খারাপ। দেখো ও যেন ভুল কিছু করে না বসে।”
বাবা চলে গেলেন। আমি বড়ো মার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, –” তোমার জীবনে এত কষ্ট কেনো বড়ো মা? আমি তার গর্ভে না এসে তোমার গর্ভে আসতে পারলাম না।”
–” এভাবে বলতে নেই, মা। মা তো মা-ই। মাকে খারাপ বলতে নেই, পাপ হয়। তওবা কর। জীবনে যাই করিস না কেনো, বড়োদের ঝামেলায় জড়াবি না। মাকে ভালোবাসবি।”
বড়ো মার কথায় কিছু বললাম না। জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম পাশে। বিড়বিড় করে বললাম, –” তুমি এতো ভালো কেনো, বড়ো মা?”
————–
ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট গতিতে চলছে। গভীর মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলে শোনা যায় সেকেন্ডের কাঁটার টিকটিক শব্দ। কখনো ঘন্টার স্থানে এসে ঢংঢং আওয়াজ করছে। আমার মনও সাথে সাথে ডিপডিপ আওয়াজ করছে। আর কিছু সময়। আমি নিশ্চিত যাবির ভাইয়া আমার কথা মতো শুভ্রপুষ্পে এসে সে আছে। কথা ছিল আমি উনাকে গিয়ে চমকে দিবো কিন্তু আমি এখনো বাড়িতে। বড়া মাকে কয়েকবার বলতে চেষ্টা করছি, পারছি না। মা ঘুমাচ্ছেন। বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল বিধায় প্রেশার বেড়েছে। ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন। মনে সাহস জুগিয়ে বড়ো মার থেকে অনুমতি নিয়ে নিলাম, –” মা, কাজ শেষ। তুমি এবার বিশ্রাম করো। আমি সায়মার বাসা থেকে ঘুরে আসি।”
বড়ো মা কিছুক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করে রইলেন। অসুস্থ স্বরে আদেশের স্বরে বললেন, –” মেহেদীকে সাথে নিয়ে যা।”
বড়ো মার কথায় খুশি হলাম। হাসিমুখে তৈরি হওয়ার জন্য রওনা হতেই বড়ো মা আবারো ডেকে বললেন, –” তোকে বিশ্বাস করি বলেই একা পথ চলতে দেই। আমাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না।”
মলিন হেসে বের হলাম। মেহেদী আর আমি পথ হাঁটছি। আমি ভাবছি মেহেদীর কথা, শুভ্রপুষ্পে তো আর তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। উনার কথা বাবাকে বলে দিবে। কিছু পথ হাঁটতেই মেহেদী বায়না ধরলো বন্ধুর বাসায় যাবে। আমিও সায় দিলাম। মেহেদীকে বন্ধুর বাড়ি রেখে রওনা হলাম।
অন্তরে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যুগ পাড় হয়ে গেছে উনাকে দেখিনা। মাটির পথ ধরে হাঁটছি। আর কিছু সময় তারপর উনাকে দেখতে পাবো।
শীতকালে শুকনো ঘাসের উপর বসে আছেন যাবির ভাইয়া। কারোর অপেক্ষা করলে যেমন আমরা আনমনে অনিচ্ছায় কাজ করি উনিও তাই করছেন। চিমটে চিমটে ঘাস তুলছেন আর দূরে ফিকে মারছেন। উনাকে দেখে হৃদপিন্ড খুব জোরেই বাজতে শুরু করলো। হাত পা কেঁপে অবশ হয়ে যাচ্ছে। কাঁপা স্বরে ডাকলাম, –” কারোর অপেক্ষা করছেন বুঝি?”
অনাকাঙ্ক্ষিত কোন জিনিস যদি আপনার সামনে চলে আসে তাহলে আপনি যেমন অবাক হবেন, যাবির ভাইয়ার অবস্থাও এখন তেমন। আমাকে দেখে একটু না অনেকটুকুই অবাক হয়েছেন। আমার পানে হা করে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি লাজুক মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছি। যাবির ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। এতক্ষণ গাছের নিচে বসে ছিলেন, দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ায় খেয়াল করেননি ফলস্বরূপ গাছের ডালের সাথে মাথায় আঘাত পেলেন।
উনি আঘাত পেলেন আর ব্যথা পেলাম যেন আমি। শব্দ করে ইশশশ বললাম। অবশ্য আমার থেকে সেই ডালটা আরো এক হাত উপরে হবে। উনি লম্বা মানুষ তাই মাথায় আঘাত পেয়েছেন সহজেই।
যাবির ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ডলে দিচ্ছেন। আমি বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, –” বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?”
উনি প্রত্যুওরে কিছু বললেন না। অবাক নয়নে এখনো তাকিয়ে আছেন। আমি আবার বললাম, –” কথা বলবেন না?”
ভেবেছিলাম অন্যান্য প্রেমিক পুরুষদের মত জড়িয়ে ধরবেন অথবা আমার গালে কষে থা’প্প’ড় মারবেন। কিন্তু কোনটাই করলেন না বরঞ্চ আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে বললেন, –” তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেই, মায়া?”
এমন আদরে আবদার কি ফেলা যায়? হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাসিমুখে বললাম, –” ছুঁয়ে দিন, মানা করেছে কে? আপনি আলতো হাতে আমায় ছুঁয়ে দিবেন,আমি চোখ বুঝে তা অনুভব করব।”
যাবির ভাইয়া হেসে ফেললেন। আলতোভাবে আমার হাত ধরলেন। প্রথমে আস্তে করে ধরেছিলেন কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে উনার হাতের বন্ধন আর শক্ত হয়ে গেলো।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাত উনার হাতের বন্ধনে আবদ্ধ। উনার হৃদয় স্পন্দন অনুভব করতে পারছি, শুনতে পারছি হৃদয়ের আকুলতা। নীরবতা ভঙ্গ করে উনি বললেন, –” এভাবে হঠাৎ করে আর এসো না, মায়া। দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবো। তারপর তুমি পাগলি প্রেমিকা হয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। আর আমায় খুঁজবে।”
–” আপনার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়, এই দোয়া করি সব সময়। কেননা আপনি কিনা অন্তরে কষ্ট হয়।”
–” আমার সাথে কিছুক্ষণ হাঁটবে, মায়া? বেশি দূর না। ঐ যে আকাশি গাছ দেখছো, ওই পর্যন্তই হাঁটব। খুব ইচ্ছে করছে তোমার পাশাপাশি থাকার।”
যাবির ভাইয়ের কথায় মুচকি হাসলাম। সবুজ ঘাসের উপর উনার হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
বর্তমানে আমার একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমাদের সময়ের সাথে গানটাও মিলে গিয়েছে। মনে মনে গুন গুন করে গাইছি তখনই যাবির ভাইয়ার স্বর কানে ভেসে উঠে। উনি আমার হাতে অধর ছুঁয়ে দিয়ে গলা ছাড়লেন,
” এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হবে মায়াময়ী, বলো তো!
উনার কথার প্রত্যুওরে জোরে বলতে ইচ্ছে করছে, –” আমি চাইনা এ পথ শেষ হোক। আমি চাই সময় থেমে থাকুক। পথ আরো দীর্ঘ হোক। অনুভূতিরা সুন্দরভাবে কাছে আসুক। ফাগুন হাওয়ায় ভেসে উঠুক সকল প্রেমিক যুগল। সাথে আমি এবং সে!”
চলবে…….