ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,২৬,২৭ শেষ

0
1030

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,২৬,২৭ শেষ
#আফসানা_মিমি
| ছাব্বিশ তম পর্ব|

আজ শুক্রবার। আমাদের দুজনেরই ছুটির দিন। কলেজে ক্লাস করছি। সকল শিক্ষকদেরর পছন্দের পাত্রী হয়ে গিয়েছি কয়েকদিনের মধ্যেই। আমার সহপাঠীরাও অনেক ভালো। তাদের সাহায্যে আজ যাবির ভাইয়াকে চমকে দিব। জুমাআর নামাজে যেতেই কাজে লেগে পড়লাম।
নীল শাড়ি পরিধান করেছি। মাথায় খোঁপা করেছি। চোখে মোটা করে কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। আমাদের ঘর বর্তমানে জিনিসপত্রে ভরপুর। উনি মাস্টার্স শেষ করেছেন চার মাস পূর্বে। বর্তমানে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। বেতন খুব ভালো। প্রথম মাসের টাকা দিয়ে একটা খাট, আরেকটা আলনা কিনেছিলাম। উনি আমাকে বলেছিলেন, ” একটা আয়না নাও।” আমি রাজি হইনি কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। আমার জন্য একটা আয়না কিনে নিয়ে আসেন। আয়নাটা এত বেশি বড়ো না, ছোটও না। একটা কাঠের বক্সের সাথে আয়নাটা লাগানো, খুব সুন্দর। সাজগোজ করার পর যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখি তখন লাজে ম’রে যাই। একদিন উনি বলেছিলেন, ” তুমি যখন এইভাবে আয়না দেখো আমার কেমন কেমন যেনো লাগে। ইচ্ছে করে এভাবেই সারা জীবন তাকিয়ে থাকি, তোমার পানে।”

উনার কথায় সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিলাম। সমস্ত কাজ শেষ করে পুনরায় আয়নায় নিজেকে দেখে নিলাম। আজ কেনো যেনো খুব লজ্জা লাগছে। ইচ্ছে করছে কোথাও লুকিয়ে থাকি কিন্তু আমি তো জানি, যেখানে লুকিয়ে থাকি না কেনো উনি আমাকে ঠিকই খুঁজে নিবেন।
ঠিক দুইটার সময় উনি বাসায় আসেন। এসে কিছুক্ষণ আমাকে ডাকাডাকি করেন। আমি পাশের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছি। এখন সামনে যাওয়া মানে বিপদ।
দু’একবার ডেকে উনারা সারা শব্দ শুনতে পেলাম না। উনার খোঁজ করব তার আগেই উনি আমার পিছন দিয়ে জাপটে ধরেন। আমি চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসি। উনি আমার ঘাড়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলেন, –” রান্না করেছে কে?”

–” ইয়ে মানে আমি করেছি।”

–” এত সুন্দর করে সাজগোজ করার কারণটা কি জানতে পারি? আমার জানামতে আজ তো আমার জন্মদিন না, তোমার জন্মদিনও না। এমনকি আমাদের বিবাহ বার্ষিকও না। তাহলে এত আয়োজন কেনো? এক মিনিট, এক মিনিট, একটু আগে কি বললা? তুমি রান্না করেছো? রান্না কোথায় শিখলে?”

যাবির ভাইয়ার দিকে ফিরে তাকালাম। উনির গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, –” ভাবির কাছে কিছু কিছু শিখেছি। শেফালির মার কাছ থেকে ভালো করে শিখেছি। আন্টি প্রতিদিন টিফিন নিয়ে আসেন। তো টিফিনের সময় গল্প করতে করতে উনার কাছ থেকে শিখে নিয়েছি।”

–” বাহ আমার বউ তো দেখি খুব বড়ো হয়ে গেছে? সব রান্নাবান্না করতে পারে। আমার তো এই জীবনে কষ্টই রইল না।”

–” মানুষ পরিবর্তনশীল। মানুষের মন মিনিটে, সেকেন্ডে, ঘন্টায় পরিবর্তন হয়। আমিও পরিবর্তন হয়েছি। এখনো সেই ছোট্ট নেই, বড়ো হয়ে গেছি। আপনি এখন থেকে শুধু কাজ করে আসবেন আর আরাম করবেন। আর আমি বাসায় বসে সব কাজ শেষ করব।”

আমার কথা শুনে উনি মুচকি হাসলেন। আমাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে রইলেন কিছুক্ষণ।

খাবার খেতে বসেছি দুজন। উনি কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসলেন। অভ্যাস মোতাবেক পাঞ্জাবিকে তোয়ালে বানাতে নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই আমি বাঁধা দিয়ে হাতের তোয়ালে তুলে দেই।
আজকে খাবারে একটা মাত্র পাত্র নিয়েছি। সামনে ভাতের এবং তরকারি একটা বাটি রেখে আসন পেতে উনার পাশে চুপচাপ বসে পড়লাম। উনি আমার কার্যকলাপ দেখে বুঝতে পারলেন আজকে উনার হাতে খেতে চাইছি। সর্বপ্রথম লোকমা আমার মুখে দিতে চাইছিলেন তখন আমি বাঁধা দেই।

–” প্রতিদিন তো আগে আমাকে খাওয়ান।আজ না হয় আপনি প্রথম খান। আমি চাইছি আমার হাতের রান্না করা খাবার আপনি প্রথমে পরখ করুন। উনিও তাই করলেন। ভাত মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলেন। খুব মজার খাবার খেলে যেমন ভাবভঙ্গি করা হয় তেমন উনিও করছেন। অথচ আমি জানি, খাবার এতটাও স্বাদ হয়নি। হয়তো নুন বেশি দিয়েছি ,নয়তো মরিচ বেশি দিয়েছি। একসাথে তিন চার লোকমা খাওয়ার পর উনার খেয়াল হলো যে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি এবং অপেক্ষা করছি উনার হাতে খাবার খাওয়ার। আমার দিকে এক লোকমা এগিয়ে দিলেন। চোখ বড়ো হয়ে আসলো। জীবনের প্রথম রান্না করেছি তবে খুব সুস্বাদু হয়েছে। হালটা একটু মরিচ বেশি কিন্তু খেতে অনেক মজাদার।
খাবারের পর্ব সমাপ্ত করে বিছানায় এসে আরাম করে বসলাম। উনি শুয়ে আছেন আর আমি উনার পাশে বসে উনার হাতে আঁকিবুকি করছি।
–” ইদানিং তুমি এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছ কীভাবে বউ? মুখে অতিরিক্ত কিছু মাখো? নাকি আমার আদর পেয়ে পেয়ে সুন্দরী হয়ে যাচ্ছো?”

–” ইস আপনার মুখে কিছু আটকায় না। এভাবে বললে, আমি লজ্জা পাই তো।”

আমার কথা শুনে উনি হাহা করে হেসে ফেললেন। আমিও লজ্জায় লাল হয়ে উনার বুকে মাথা ঠেকালাম।

আমাদের জীবন এভাবেই চলছে। দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের প্রতিটা সকাল এবং রজনী। শুধু মনে একটা কষ্টই রয়ে গেল। পরিবারকে ছেড়ে আমি একা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আমার শ্বশুর কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরে গিয়েছেন। আমার শাশুড়ি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কথা বলেন না। আমরা ওসব কিছুর পরোয়া করি না। বড়ো ভাইয়া ভাবিও সপ্তাহে দুইবার এসে ঘুরে যান।
——–
কিছুদিন পর প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। ইদানিং শরীর একটু দুর্বল মনে হয়। বিয়ের পর নিজের সাথে সাথে শরীরও পরিবর্তন হয়েছে। আগে ছিলাম শুকনা কাঠি, এখনো হয়েছি মোটা আলুর বস্তা। এজন্যই হয়তো শরীর দুর্বল লাগে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আর চিন্তা করছিলাম। তখনি কেউ আপু বলে ডাক দেয়। কন্ঠস্বরটা খুবই পরিচিত। থেমে যাই আশেপাশে নজর ঘুরিয়ে খোঁজ করি। মনের ভুল ভেবে আবারো এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আবার স্বরে কর্ণধারে ভেসে আসে।
–” আপু আমার সাথে কথা বলবে না?”

এবার থেমে গেলাম। কন্ঠস্বরটা মেহেদীর কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে,” মেহেদী এখানে কোথায় থেকে আসবে?” মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটতে নিতেই কেউ এসে আমার হাত ধরে। পাশ ফিরে তাকাতেই আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। মেহেদীকে এত মাস পর স্বচক্ষে দেখছি। ছেলেটা হাতে পায়ে বড়ো হয়ে গেছে।

–” কেমন আছো আপু?”
মেহেদীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। কতদিন আমার ভাইটাকে দেখি না। অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। মনে প্রশ্ন জাগলো, ” মেহেদী এখানে কী করছে? চোখের পানি মুছে প্রশ্ন করলাম, –” তুই এখা এখানে কি করছিস? বাবা এসেছে? নাকি বড়ো মা এসেছে? আমি জানতাম উনারা রাগ করে থাকতে পারবেন না। কোথায় উনারা?”

আমার অস্থিরতা দেখে মেহেদীর মুখ কালো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো, –” কেউ আসেনি আপু। আমি আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আমি জানতাম না তুমি এখানে থাকো। হঠাৎ তোমার দেখা পেলাম।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিলাম। কিছু মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল বাবা-মা আমাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু না, উনারা আমার সাথে রাগ করেই আছেন।

মেহেদীকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বাড়িঘর দেখে মেহেদী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

–” তুমি এখানে থাকো আপু? স্যার কোথায়? স্যারকে বাসায় আসে না?”

–” তোর স্যার অফিসে। আসবেন বিকেলে। দুপুরে খেয়ে গেছেন। আমি কলেজে ছিলাম।”

–” তুমি পড়াশোনা করো?”
–” হ্যাঁ। এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। এখন ইন্টারে পড়ছি।”

মেহেদী অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। যেই মেয়ে বাসায় কোনো কাজ করেনি সে দিব্বি সংসার করছে দেখে অবাক হওয়ারই কথা।

–” তুই বোস ভাই। আমি তোর জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করি। বাবা কেমন আছে রে? মা কী এখনো বড়ো মার সাথে খারাপ ব্যবহার করে? বড়ো মার শরীর ঠিক আছে তো?”

–” সবাই ভালো আছে। মা বড়ো মাকে আগে থেকে বেশি কাজ করায়, কটু কথা বলি কষ্ট দেয়। আমি এসব দেখে চুপ করে থাকতে পারি না, প্রতিবাদ করি বলে আমাকেও কথা শোনায়।”
মেহেদীর কথায় মুখ মলিন করে বাহিরে চলে এলাম। আমার হাতে লাগানো কিছু ফলের গাছ বুনেছি। পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা, আর শশা গাছ থেকে শসা ছিঁড়ে মেহেদীর জন্য নিয়ে নিলাম।

আমার ভাবতেই আনন্দ লাগছে। আমার হাতের ফল-সবজি আমার ভাই খাবে। কিছু পথ এগিয়ে আসতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল। বর্তমানে যাবির ভাইয়া নেই তাই মেহেদি বলে চিৎকার দিয়ে বসে পড়ি। মেহেদী আমার এই অবস্থা দেখে আমাকে ধরে আস্তে করে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

প্রায় এক ঘন্টা পর যাবির ভাইয়া আসেন। মেহেদীকে দেখে অনেকটা অবাক হন।

–” কেমন আছো মেহেদী? কখন এসেছো? পড়াশোনা কেমন চলছে?”

–” ভালো আছি স্যার। আপু হটাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি অনেক আগেই চলে যেতাম
আপু একা থাকবে বলে যাওয়া হয়নি।”

মেহেদীর কথা শেষ হতেই উনি বিচলিত হয়ে আমার কাছে আসেন। কপালে গালে হাত রেখে শরীরে তাপমাত্রা বুঝতে চেষ্টা করেন। স্বাভাবিক তাপমাত্রা। প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে তাকান।

–” কি হয়েছে বউ? অসুস্থ লাগছে?”

–” কিছুদিন ধরে শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।
আমাকে আগে বলোনি কেনো?”

–” ভেবেছি মোটা হয়েছি এজন্য শরীর দুর্বল লাগে।”

–” আমার তো তা মনে হচ্ছে না। চলো ডাক্তারের কাছে যাই।”

মেহেদীর এখানে আসা এবং আমাদের দেখা হওয়া সবকিছু মেহেদী যাবির ভাইয়াকে জানায়। মেহেদীকে বিদায় দিয়ে দিলাম। বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে মেহেদীকে গাড়িতে তুলে আমরাও রওনা হলাম পাশের একটা ক্লিনিকে।
সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুজনেই কিছুটা ভয় পেয়ে ক্লিনিকের বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় তিন ঘন্টা পরে ফলাফল আসে। ক্লিনিকের ডাক্তার হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানায়। আমাদের জীবনে নতুন অতিথি আসতে চলেছে। এ বিষয়ে জেনে দুজনেই অবাক হয়ে যাই। আমরা দুজনে প্রস্তুত ছিলাম না এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য।

যাবির ভাইয়া এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে ডাক্তারের সামনে জাপটে ধরে কপালে অধর ছুঁয়ে দেন। গালে হাত রেখে বলেন, –” আমি খুব খুশি বউ। তুমি আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছ। যে আলো তুমি চলে গেলেই নিভে যাবে। এভাবেই পাশে থেকো মায়াবিনী।”

বাড়ি ফিরে আসলাম। বারান্দায় দুজন শীতলপাটি বিছিয়ে বসে রয়েছি। আমার মাথা উনার কাঁধে রেখে নারিকেল গাছের পাতার আড়ালে উজ্জ্বল চাঁদকে দেখছি। সত্যিই জীবনটা সুন্দর। উনি পাশে থাকলে সব কিছু রঙিন মনে হয়। এভাবেই আমাদের জীবন চলবে নাকি কোনো ঝড় তুফান এসে আমাদের সুখের সংসার তছনছ করে দিবে। কে জানে?

চলবে……..

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
| সমাপ্তি পর্ব |

এটি চারা রোপন করেছিলাম। চারাটা ছিল পলাশ ফুলের গাছের চারা। গাছটা একটু একটু বড়ো হতে হতে অনেকটুকুই বড়ো হয়েছে। বর্তমানে গর্ভকালীন সময় দুই মাস অতিবাহিত হয়েছে। আমরা খুব খুশি। সবচেয়ে বেশি আমি খুশি। কেননা আমার ধারণা, বাচ্চার মুখ দেখলে আমার বাবা-মা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। অবশ্যই আমাকে গ্রহণ করে নিবে। পেটে হাত বুলিয়ে পলাশ গাছটা দেখছি। আমার এই বাবুটা যখন অনেক বড়ো হয়ে যাবে তখন হয়তো এই পলাশ গাছে পলাশ ফুল ফুটবে। শুনেছি এই বাড়ির মালিক বাড়িতে বিক্রি করে দিবে। যাবির ভাইয়া অনেক চেষ্টা করছেন বাড়িটা কিনে রাখার জন্য। শ্বশুরের কাছে টাকার আবেদনও করেছেন। শ্বশুর বলেছেন,” টাকা দিবে”। আমরা তো বেজায় খুশি। এ অল্প কয়েক দিনে বাড়িটা আমার খুব আপন হয়ে গেছে।

পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে কয়েক সেকেন্ডে। ঝলমলে রোদের প্রখোরতা সরে গিয়ে আকাশে আঁধার নেমেছে। বৃষ্টি মেয়েদের খুব পছন্দের হয়। তেমন আমারও কিন্তু বর্তমানে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে বাবুর ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টি নামছে মুষলধারে। মাটিতে বৃষ্টি পড়ে কাঁদার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে নিমেষেই। এখন এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। চা বানিয়ে ঘরের আঙিনায় বসে পড়লাম। রিমঝিম বৃষ্টির সাথে গরম চা ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে উপভোগ করছি। এই বৃষ্টির দিনে যাবির ভাইয়াকে খুব অনুভব করছি। রিমঝিম বৃষ্টির দিনে উনার কাঁধে মাথা হেলিয়ে গল্প করতে পারলে ভালো লাগতো। শুনেছি এই সময় মেয়েদের মনের ইচ্ছা আকাঙ্খা পরিবর্তন হয়। কখন কি করতে মনে চায় বলা যায় না এবং যদি করতে না পারে তাহলে নাকি বাচ্চার ক্ষতি হয়।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আমার চা-ও শেষ। রাতের রান্না শেষ করতে হবে। বৃষ্টির কারণে শক্ত মাটি পিচ্ছিল রূপ ধারণ করেছে। চা পান করে ওঠার সময় অসাবধানতাবশত পা পিছলে পড়ে গেলাম। চা-য়ের কাপ পড়ে ঝনঝন শব্দের উৎপত্তি হলো। আমি পড়ে গিয়ে “মা গো”বলে আর্তনাদ করে ওঠি। পিছলে পড়ার কারণে পেট নিচে পড়েছে। সাথে সাথেই পেসাবের রাস্তা দিয়ে র’ক্তে’র বন্যা বইতে শুরু করেছে। আল্লাহ বলে চিৎকার করছি। আজ যদি আমার গাফিলতির কারণে বাচ্চার কিছু হয় তাহলে আমি জীবিত অবস্থায় ম’রে যাব। তীব্র ব্যথায় ছটফট করছি। আশেপাশে কেউ নেই। আমার কি হবে ভাবতে পারছি না। তীব্র যন্ত্রণায় শরীর অশার হয়ে আসছে। চোখের সামনে সব ঘোলাটে লাগছে। আমি ম’রে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে।
———

নরম তুলতুলে বিছানায় শুয়ে আছি চোখ বন্ধ অবস্থায়। আশেপাশে পরিচিত মানুষদের শরীরের সুঘ্রাণ অনুভব করতে পারছি। হঠাৎ করে চোখ খুলে তাকাই। মাথা ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকিয়ে দেখি বড়ো মা বসে বসে ঝিমাচ্ছেন। অশ্রুতে চোখ ভরে আসে। দুর্বল শরীরে কয়েকবার বড়ো মা বলে ডাক দিলাম কিন্তু হায়! কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। এবার বাম পাশে তাকালাম। উনি আমার হাত ধরে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মাথা উঠিয়ে নিচের দিকে তাকালাম, বাবা সোফায় ঘুমাচ্ছেন।
চোখ খুলে রাখতে পারছি না, বন্ধ করে রাখলাম। কেনো যেনো মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন। আমি চাই এই স্বপ্নটা স্বপ্নতেই সীমাবদ্ধ থাকুক বাস্তবে পরিণত হলে কি রূপ নিবে তা অজানা নয়। শরীর দুর্বলতার কারণে আবারও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। আমি যেন ভুলে গিয়েছি শরীর অসুস্থতা। আমার ভেতরের সত্তাকে যে হারিয়ে বসেছি সেটাও ভুলে গিয়েছি।

সকালে মালা মেহেদীর চিৎকারে শুনে ঘুম ভেঙে যায়। পূর্বে যখন বাসায় ছিলাম, প্রায় সময় মালা মেহেদীর চিৎকারে ঘুম ভাঙতো। ঘুমের ঘোরে বিরক্ত হতাম উঠে বকা দিতাম। বর্তমানে মনে হচ্ছে আমি বাসায় ঘুমিয়ে আছি আর মালা মেহেদী বাহিরে চিল্লাপাল্লা করছে। মনে হচ্ছে এখনই ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মালা মেহেদীকে মে’রে আসতে। ঘুমের মধ্যে বাস্তব অবাস্তবের মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে ফেলছি। স্বপ্ন বাস্তব মনে হচ্ছে আবার বাস্তব স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
ঘুমের ইনজেকশন দিলে যেমনটা হয় ঠিক তেমন লাগছে। মাতাল মাতাল লাগছে। কিছুক্ষণ পর মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেলাম। চোখ খুলে তাকিয়ে যাবির ভাইয়ার অসহায় চোখ নজরে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ওনার অশ্রুশিক্ত নয়ন দেখে আমার মনে পড়ে যায় বিকেলের ঘটনা। কাঁপা হাত চলে যায় পেটের উপর যেখানে তীব্র থেকে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। চোখের ইশনে ওনাকে জিজ্ঞেস করি, –” আমি ব্যর্থ হয়েছি তাই না?”

উনি আমার হাতে অধর ছুঁয়ে বলেন, –” আল্লাহ তোমাকে যে আমার কাছে আবারো সুস্থভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেটার জন্য হাজার হাজার শুকরিয়া। আমরা আবার বাবু নিব। আমাদের পরিবার হবে, আমাদের সন্তান হবে। তুমি কষ্ট পেয়ো না মায়াবিনি।”

আশেপাশে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম আমাকে আমার বাবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আমার রুমের আনাচেকানাচে মন ভরে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলাম, –” এখানে এনেছে কে? বাবা, বড়ো মা দেখতে পেলে বের করে দিবে। আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন।”

–” তোমার এখন আপনজন প্রয়োজন। আদর,যত্ন প্রয়োজন।”
–” আপনি আছেন তো! আমার আদর,যত্ন, ভালোবাসা সব আপনার থেকেই পাবো।”
–” মায়ের মত যত্ন তো পাবে না।”

আমাদের কথার মাঝে বড়ো মা খাবার হাতে ঘরে প্রবেশ করেন। আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন।

–” এই কি হাল করেছিস মা? জামাই বাবা আমাদের না বুঝালে আমার তো তোকে সারা জীবনের জন্য ভুল বুঝে যেতাম।”

অভিমানে বড়ো মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বড়ো মা নিঃশব্দে কাঁদছেন।
–” বড়ো মাকে ক্ষমা করে দাও মায়া। উনি ওনার স্থানে ঠিক ছিলেন। দোষটা আমাদেরই ছিল। পরিবারের অমতে গিয়ে আমরা ঠিক করিনি। তাইতো আল্লাহ আমাদের শাস্তি স্বরূপ আমাদের সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন।”
অন্তরে লুকায়িত কষ্ট গুলো এবার বুক চিরে বেরিয়ে আসে। হু হু করে কান্না করছি। আমার কান্না দেখে বড়ো মা আমার কাছে আসেন। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথা হাত বুলিয়ে বলেন, –” কাঁদিস না মা! এটা শুধুমাত্র একটা দুর্ঘটনা ছিল। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। ভাগ্যের লিখন তো আর খন্ডানো যায় না।”

–” আমি পারিনি মা, আমার সন্তানকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি খুব খারাপ মা, খুব খারাপ।”

আমাদের কান্নার শব্দ শুনে বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়েন।

–” আসসালামু আলাইকুম আম্মা। বাবাকে ঘরে আছো অনুমতি দিবে?”

মেয়েরা বাবার খুব আদরের হয়। বাবারা যদি মেয়েদের শাসন করে বা কটু কথা বলে তাহলে মেয়েরা সহ্য করতে পারে না। বাবার শেষের দিনের কথাগুলো এখনো ভুলিনি। আমাকে মেনে নেবেন না। যাবির ভাইয়ার হাত শক্ত করে ধরলাম এবং অনুনয়ের স্বরে বললাম, –” আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলুন। যেখানে আমি আমার পলাশফুল গোপন করেছি। এখানে থাকবো না। এখানে মানুষজন আমাদের মেনে নিবেন না।”

–” বাবা আমাদেরকে মেনে নিয়েছে মায়াবিনী। উনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। কথা বলো বাবার সাথে।”

–” আমি কথা বলব না। আমি বাড়ি যেতে চাই।”

বাবা অনুমতি পাওয়া আশা ছেড়ে দিয়ে নিজে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমার কাছে এসে বসে মাথায় হাত রেখে বলিন, –” আমরা পিতারা সব সময় চিন্তা করি সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। সন্তান যেখানে সুখী, খুশি থাকবে চেষ্টা করি সেভাবেই রাখতে। আমি ভেবেছিলাম আমার সন্তান আমার পছন্দ করা মানুষের সাথে সুখে থাকবে কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে সুখে আছে। অহংকার গ্লানিতে এতদিন মন বিষিয়ে ছিল। কিন্তু আমার ছোট ছেলেটা এসে আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে গেল কোনটা আসল এবং কোনটা ভুল। তোমরা যে সঠিক কাজ করেছিলে সেটা কিন্তু না। তোমাদের সিদ্ধান্তও ভুল ছিল কিন্তু আমরাও সমান অপরাধী বিশেষ করে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসা নেই। আছে শুধু হিংসা এবং অহংকার। আমার প্রথম স্ত্রীর সাথে অহংকার করে নিজের সন্তানকে জাহান্নামের দিকে দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু আমার মেয়ে হয়তো তার মায়ের আচরণ বুঝে গিয়েছিলাম তাই তো নিজের পছন্দ করে ছেলের সাথে চলে গিয়েছিল দূর অজানায়।”

–” আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা।”

–” বাবারা সন্তানের উপর বেশিদিন রাগ করে থাকতে পারে না।”

বাবা নিজ হিতে খাইয়ে দিচ্ছেন। যাবির ভাইয়া মাকে ঔষধ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মা ঘরে আসেন। মাথা নীচু করে বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, –” আমাকে ক্ষমা করে দাও মায়ার, আব্বু। আমি অহংকারে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মা হয়ে মেয়ের সাথে অন্যায় করতে চেয়েছিলাম।”
–” তোমার ক্ষমা নেই সুরজাহান। ফুলবানুকে বাধ্য করেছো মায়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে। মায়ার বিয়ে এমন একজনের সাথে ঠিক করেছিলে যে কিনা পূর্বেই দুই বিয়ে করেছে। আমার সামনে এমনভাবে সেই ছেলেকে উপস্থাপন করেছো, আমিও অন্ধের মত তোমার কথা বিশ্বাস করেছি। এর জন্য আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করব না।”
মা কাঁদছেন। অসহায় চোখে আমার দিকে তাকালেন। মা তো মা-ই হয়। মাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলাম। বাবা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মা কাছে এসে বসলে উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আওড়ালাম, –” একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, মা? আমার মনে না খুব কষ্ট। আমার সন্তানকে হারানোর কষ্ট। আমি খুব খারাপ মা! সন্তানকে সুরক্ষা করতে পারিনি। অন্তরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এতদিন তোমার কী একটুও খারাপ লাগেনি? তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছো। নাড়ির টানেও কী মনে পড়েনি? ও মা, তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন?”

মা কাঁদছে। আমার সারা মুখে চুমু এঁকে কপালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে।
–” আমাকে ক্ষমা করে দে মা! আমিও তোর মতো সন্তানকে ভালোবাসতে পারিনি। অহংকারে আমার ভেতরে সব কালো করে ফেলেছে রে মা!”

মা নিজের কুকর্মের ফল পেয়েছে। হোক সেটা দেরিতে। বড়ো মার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। বাবার নিশ্চুপ। যাবির ভাইয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দুষ্টুমির ছলে বলেন, –” আপনাদের মেয়ে সারাদিন বাবা,মা, বড়ো মা বলে বলে আমার কান ফালাফালা করে ফেলতো। আর এখন দেখুন। আপনাদের সবাইকে কষ্ট দিচ্ছে। এখন আপনাদের মেয়েকে শাস্তি স্বরুপ ঔষধ খেতে হবে।”
যাবির ভাইয়ার কথায় সকলের হেসে ফেললেন। কেননা আমি ঔষধ সেবন করতে চাই না। এখন জোর করিয়ে খাইয়ে উনি ক্ষান্ত হবেন।

উনার কাছে শুনলাম, আমার শ্বশুর- শাশুড়ি আসছেন। আমার দুর্ঘটনার কথা শুনে শাশুড়ি আফসোস করছেন। বাবা নাকি উনাদের ফোন করে আসতে বলেছেন। এবার হয়তো আমাদের পরিবার ঠিক হবে। আনন্দে, উচ্ছাসে মুখরিত হবে দুই বাড়ির আঙিনা।

———-

পাঁচ বছর পর,
শ্রেণীকক্ষে পীনপতন নীরবতা। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারা পরীক্ষা দিচ্ছে। কেউ পরীক্ষা দিচ্ছে তো কেউ অন্যান্যদের খাতায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আবার কেউ কলমের ক্যাপ কা’ম’ড়ে কলমের ক্যাপ নষ্ট করে ফেলছে। শিক্ষকরা বাচ্চাদের সামলাতে ব্যস্ত। কাউকে হাতে কলমে লিখে দিচ্ছেন তো কাউকে বলে দিচ্ছেন। পরীক্ষা হলের সকল ছাত্রছাত্রী সমবয়সী, দেখতেও একই রকম লম্বা। তার মধ্যে প্রথম সারির ছাত্রকে চোখ আটকে যাবে। একজন বাচ্চা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে, সে বসে উপরের বেঞ্চ নাগাল পায় না। শিক্ষকরা আদরের এই ছাত্রটির পরীক্ষায় যেন অসুবিধে না হয় তাই পায়ের নিচে চারটি ইট দিয়ে রেখেছে। এবং তার উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পরীক্ষার সময় মাঝামাঝি, আর আধা ঘন্টা পর পরীক্ষার সময়সীমা শেষ। ছোট ছাত্রটা এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকে অনুসন্ধান করছে। আমি আড়াল থেকে দেখছি আর হাসছি। কিছুক্ষণ পর বাচচাটাকে দেখি, বাচ্চাটা লেখা বন্ধ করে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবার আর আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, –” কি হয়েছে সোনা?”

–” আম্মু আমি ইয়াম ইয়াম খাব।”
বাচ্চাটার কথা শুনে আমার মাথায় হাত। ব্যাগ থেকে দুধ ভর্তি ফিডার বের করে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। সেও এক নিঃশ্বাসে অর্ধেক ফিটার পান করে আবার চলে গেল পরীক্ষা দিতে।
আবরার আমার এবং যাবির ভাইয়া একমাত্র সন্তান। বয়স সাড়ে তিন। বয়সের তুলনায় সে পড়াশোধায় অনেকটা এগিয়ে। এখনই প্রায় এক হাজারের উর্ধ্বে ইংলিশ শব্দ বলতে পারে। আমি তাকে সেভাবেই শিখিয়েছি। আজ তার প্রথম সাময়িক পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা।
এত অল্প বয়সে আমি তাকে স্কুলে ভর্তি করতে চাইনি। কিন্তু পাশের বাসার হামিদা আপার ছেলে প্রতিদিন ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায় বলে আবরারও বায়না ধরে। সন্তানের বায়না আমার কাছে ঊর্ধে। একটি ব্যাগ কিনে দেই তার মধ্যে খাতা কলম ঢুকিয়ে দেই। একদিন সে বায়না ধরে সেও স্কুলে পড়বে। আমি তার আবদার পূরণ করি স্কুলে নিয়ে আসি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন ক্লাস করার পর তার দিকে লক্ষ্য করলাম, সে অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় পড়াশোনায় ভালো, পারেও। আমি তেমন মনোযোগ দেয়নি এভাবেই ক্লাস করতে দিচ্ছিলাম। একমাস পর যখন দ
খেয়াল করি তার উপর কোনো চাপ পড়ছে না। পড়াশোনা করতে চাইছে। তখন শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে ক্লাস ওয়ানে রেখে দেই। এখন সে পরীক্ষা দিচ্ছে আর পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে অভ্যাস মোতাবেক একটু পর পর দুধ খেয়ে যাচ্ছে।

পরীক্ষা শেষে আবরার বায়না ধরে সে নানু বাড়ি যাবে। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, যাতায়াতের ব্যবস্থাও খুব ভালো। উনাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম অফিস শেষে যেন সরাসরি ধলিপাড়া চলে আসে। মা ছেলে রওনা হলাম বাবার বাড়ি উদ্দেশ্যে। মালা মেহেদী এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। দশম শ্রেণীতে পড়ে। এখন দুজনকে দেখে বুঝাই যায় না তারা একসময় অনেক বিচ্ছু ছিল। মা আগে থেকে ভালো হয়ে গেছে। বাবা এখন খুব খুশি। আমার বাবার পরিবারে এখন খুশি আর খুশি। কোনো সময় দেখা যায় বড়ো মা এবং মা মিলে দুজন খোশ গল্প করছেন আর কাজ করছেন। আবার কখনো দেখা যায় বড়ো মা ছোটমার কোমড় মালিশ করে দিচ্ছেন। আবার কখনো দেখা যায় ছোটমা বড়ো মার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। উনাদের এমন মিল মোহব্বত দেখে অন্তরে শান্তি মিলে।
নানু বাড়ি আসতেই আবরারের ছোটাছুটি শুরু হয়। একবার বড়ো নানুর কাছে তো একবার ছোট নানুর কাছে এসে এটা সেটা আবদার করে। আর দুই নানু মিলে নাতির সকাল আবদার পূরণ করে।
আমি যাবির ভাইয়াকে খুব মিস করছি। উনি কখন আসবেন? আমি আজ অনেক বছর পর উনার সাথে শুভ্রপুষ্পে যেতে ইচ্ছে করছে। ওনার হাতে হাত রেখে পলাশ ফুলের উপর হাঁটতে ইচ্ছে করছে। পলাশ ফুলের মালা গেঁথে উনার গলায় পড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
মুঠোফোন বের করে ছোট্ট একটি বার্তা উনার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর বড়ো মাকে এবং মাকে বলে রওনা হলাম শুভ্রপুষ্পের উদ্দেশ্যে।

কোনো এক ফাগুন মাসে যাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন দেখেছিলাম আজ সে আমার স্বামীরূপে এবং তার ভালবাসার চিন্হ আমাদের ছেলে। শুভ্রপুষ্পে এসে পলাশ গাছটা নিচে বসি। এখন আর কেউ পলাশ ফুল চু’রি করতে আসে না। এখন হাজারো পলাশ ফুল পড়ে থাকে জমিনে। হয়তো আমি নেই তাই কেউ আসেও না। কোমড় থেকে সুই সুতা বের করে মালা গাঁথতে শুরু করলাম। পলাশ ফুল অনেক ভারি হয়। একটা বড়ো মালা গেঁথে পাশে রেখে দিলাম।

সন্ধ্যা লগনে উনার আগমন ঘটে। আমাকে পিছন থেকে ধরে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। আমাদের চারপাশে পলাশ ফুলের সমাহার। উনি গুনগুন করে ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গান গাইছেন। আমি চোখ বন্ধ করে উনার গান শুনছি নিজেও গুনগুন করে গাইছি। হঠাৎ মনে হল উনার জন্য বানিয়ে রাখা মালাটা উনাকে পরাইনি। আমার বহু বছরের ইচ্ছে, পলাশ ফুলের মালা উনার গলায় পরিয়ে দিব। উনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। নিজের হাতে তৈরি করা পলাশ ফুলের মালা উনার গলায় পরিয়ে দিলাম। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত যাবির ভাইয়ার গলায় মালাটা খুব সুন্দর ভাবে মানিয়েছে।

” কত দিনের ইচ্ছে ছিল, পলাশ ফুলে রাঙিয়ে দেব তোমার গলা। তুমি হাসবে, আমি দেখব। তুমি গাইবে, আমি শুনব। তুমি হাত বাড়িয়ে দিবে, আমি হাতে হাত রেখে পথ চলব।”

উনি প্রশান্তির হাসি হাসলেন। আমার খোপায় পলাশ ফুল গেঁথে দিলেন। আমরা সুখী, অনেক সুখী। হাতে হাত ধরে পথের পথ হেটে চলছি। আজীবন একে অপরের পাশে রইবো বলে শপথ নিয়েছি। প্রজাপতির মতো মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াব। সে মুগ্ধ হয়ে দেখবে, আমি লজ্জা পাবো। এবার দুজন একসাথে হাঁটছি আর গান গাইছি,

তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here