# ফাগুন_ এলো _বুঝি!
(০৪)
আশরাফ দুপুরে এসে আর অফিস যাননি আজ।সারাক্ষন ঘরের মধ্যে পূর্নতাকে আগলে বসে ছিলেন। সায়রার ওপর চাপা ক্ষোভ তখনও ছিল।পূর্নতা অনেকবার বলে বলেও ঘর থেকে বের হতে পারেনি।আশরাফ দেয়নি।বাধ্য হয়ে সায়রাই ঘরের সব কাজ করেছেন।আশরাফের কোটি কোটি টাকা না থাকলেও ধনীর কাতারে তাকে রাখা যাবে।অথচ তার বাড়িতে কাজ করার লোক নেই।সায়রা রাখেনি।রেখেই বা কী হবে?কাজতো সব পূর্নতাই করে।মিশরা ফিরেছিল সন্ধ্যের দিকে।সারাদিন আড্ডা মেরেছে।প্রথম দিনেই ভার্সিটিতে এক গাদা বন্ধু জুটেছে তার।সেও ফিরে ঘরে খিল দিয়ে বসেছিল।প্রথমে বাবার প্রতি অভিমান,দ্বিতীয় নিজের স্বভাবসুলভ অভ্যেস।আশরাফ কিন্তু মাঝখানে গিয়েছেন ওকে ডাকতে।দরজাও ধাক্কিয়েছেন।অথচ ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাননি।অগত্যা ফিরে আসেন রুমে।সারাটাদিন পূর্নতা হাত ব্যাথায় নাড়াতে পারেনি।দুপুরে আশরাফ খাইয়ে দিলেন।
রাত এখন দশটা প্রায়।ডায়নিং টেবিলে আশরাফ আর পূর্নতা এসে বসেছে।আশরাফ সেই থেকেই সায়রার সাথে একটা কথাও বলেননি।সায়রা সব ভুলে কথা বলতে এসেছিলেন।এই যে একটু আগে খাওয়ার জন্যে ডাকলেন।কিন্তু আশরাফ যেন সায়রার ক্ষেত্রে বোবা হয়েছেন।সায়রা প্রথমে আশরাফের প্লেটে ভাত তুলে দিলেন।পূর্নতার সামনে ভাতের বাটি রেখে দিয়ে নীরবে বোঝালেন নিজে তুলে নিতে।আশরাফ খেয়াল করেছেন সেটা।সায়রাকে কিছু বলার আগ্রহ পেলেন না।নিজেই ভাত তুলে দিলেন মেয়ের পাতে।পূর্নতার মুখটা একটুখানি হয়ে আছে।ভেতরে ভেতরে দারুন ভয়ে কাঁপছে সে।বাবা বাড়ি থেকে চলে যাওয়া মাত্র আজকের গোঁটা দিনের ঝাল সায়রা কীভাবে মেটাবেন ওর ওপর সেটা ভেবেই গাঁয়ে কাঁটা দিচ্ছে।আশরাফ পরপর মাছ তুলে দিলেন পূর্নতার পাতে।
নিজের প্লেটের দিক চেয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন
-মিশু খাবেনা?
প্রশ্ন কাকে করা হয়েছে কেউ না জানলেও সায়রা জবাব দিলেন,
‘ ডেকেছি।আসছে।
আশরাফ আর কিছু বললেননা।পূর্নতা পেইন কিলার নেয়ার পর হাতের ব্যাথা সহনীয়।তাই আসার আগে বলে এসেছে বাবাকে “সে নিজেই খেতে পারবে।খাইয়ে দিতে হবেনা।পেছনের কারন অবশ্য সায়রার ক্ষোভ আর মিশরার অহেতুক হিংসেকে এড়িয়ে যাওয়াই ছিল।
মিশরা এলো বেশ খানিকক্ষন পর।আশরাফই কথা বললেন প্রথমে।মিষ্টি হেসে শুধালেন,
“মামুনি!সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?বাবা তোমাকে কল করেছিলাম।
মিশরা ধাক্কা খাওয়ার মত তাকালো।ভেতর টা তার জুড়িয়ে গিয়েছে মামনি ডাক শুনতেই।কিন্তু মুখটা সহজ রেখে বলল ‘ আমি দেখতে পাইনি বাবা।
” বাবার পাশে বোসো মিশু।
আশরাফ বললেন।মিশরার খুব ভালো লাগছে।বাধ্য মেয়ের মত আশরাফের পাশের চেয়ার টেনে বসলো সে।
“ভার্সিটির প্রথম দিন কেমন লাগলো তোমাদের?
পূর্নতা বলল ‘খুব ভালো লেগেছে বাবা!ভীষণ সুন্দর ভার্সিটি।
আশরাফ হাসলেন,
“আমি জানতাম. তোমাদের ভালো লাগবে। সে জন্যেই ওখানে তোমাদের এডমিশন করিয়েছি।কিন্তু আমার রাজকন্যারা, এবার যে আরো ভালো করে স্টাডি করতে হবে তোমাদের। আমি কিন্তু এইচএসসির থেকেও বেটার রেজাল্ট চাই, ওকে?
মিশরা মাথা নাড়লো।পূর্নতাও তাই।
” ভেরী গুড।
সায়রা মিশরার জন্যে ভাত বাড়তে গেলে আশরাফ মানা করলেন।তবে সরাসরি বললেন না।অন্যদিক চেয়ে বললেন,
‘আমি মিশুকে খাইয়ে দিচ্ছি।ওকে আলাদা প্লেট দিতে হবেনা।
মিশরার মন আনন্দে নেঁচে উঠলো।
খুশিটা ভেতরে চেপে রাখতে না পারায় চেহারা চকচক করছে।সায়রাও খুশি হলেন।
আশরাফ খুব সুন্দর করে ভাত মেখে মিশরার মুখে তুলে দিলেন।মিশরা খেতে খেতে পূর্নতার দিক তাকালো।পূর্নতা হেসে ওদের দিকেই চেয়ে।সায়রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।মিশরা আর আশরাফের সম্পর্ক সহজ হোক,স্বাভাবিক হোক এটাই তার একমাত্র চাওয়া ছিল।হোক দেরিতে তাও পূরন হোক।খাওয়ার মাঝে আশরাফ পূর্নতার দিক ফিরে বললেন,
“পূর্না,এখানে এসো।
মিশরা ভ্রু গোঁটালো ‘ ওকে ডাকছো কেন?
‘আজকে আমি আমার দুই মেয়েকে একসাথে খাইয়ে দেব তাই।
মিশরার হাসিটা নিভে গেল।পূর্নতা উঠতেই নিয়েছিল, মিশরার পরবর্তী বাক্যে আটকে গেল সে।একপ্রকার চেঁতে গিয়েছে মিশরা,
‘হোয়াট?তুমি ওকেও খাইয়ে দেবে?মানে এই হাত দিয়ে একবার ওকে, তারপর আমাকে? আর ইউ ক্রেজি বাবা? ওর মুখে তুলে দেয়া সেই এঁটো হাত দিয়ে আমি খাবো?
আশরাফের মেজাজ খারাপ হলো।তবুও শান্ত কন্ঠে বললেন,
– এসব কি কথা মিশু? ও তোমার বোন হয়।
মিশরা মুখের ওপর জবাব দিলো,
‘নিজের তো আর নয়।সৎ বোন।
আশরাফ মৃদূ ধমকে উঠলেন, ‘ মিশরা!
মিশরা অভিমানি চোখে তাকালো,
“এক কাজ করো বাবা তুমি বরং ওকেই খাইয়ে দাও।
কারণ আমাকে খাইয়ে দাওয়া তো তোমার নিছক একটা বাহানা ছিলো।আসলে তোমার মেয়েকে আমাদের সামনে সরাসরি খাইয়ে দেয়ার কথা বলতে তুমি পারছিলেনা।তাই আমাকে এখানে ইউজ করলে তুমি।
পূর্নতার চোখের পানি প্লেটের ভেতর পরলো।বাবার ওপর রাগ হলো খুব।এসব অশান্তি যত এড়াতে চাইছে তত পিছু নিচ্ছে তার!
আশরাফ ভুল ভাঙানোর ভঙ্গিতে বললেন,
‘তুমি ভুল ভাবছো মিশু। আমি__
” থাক বাবা।আমি বাচ্চা নই। যেটা বোঝার আমি ভালো করে বুঝেছি।
মিশরা উঠে চলে গেল। যেতে যেতে চোখ মুছল। আশরাফ সেদিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মিশরার পিছু পিছু সায়রাও উঠে গেলেন।মেয়ের এই রাগ ভীষণ বিরক্ত লাগে তার।আশরাফ কাছে ডেকেছিল, তাহলে তোর এমন করার দরকার কি ছিল?
আশরাফ পূর্নতার দিক তাকালেন।পূর্নতা কাঁদছে।বাবা তাকাতেই ফিচেল কন্ঠে বলল,
” আমি এসবে ক্লান্ত হয়ে গেছি বাবা!কেন যে এমন করতে গেলে।
“এদিকে এসো।
আশরাফ গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন।পূর্নতা উঠে গেলে আশরাফ পাশের চেয়ার ইশারা করলেন।পূর্নতা বসে মাথা নিঁচু করে রাখলো।আশরাফ মুখের সামনে খাবার ধরে বললেন ‘ হা করো।
পূর্নতা তাকালো,
‘থাক না বাবা।শুধু শুধু অশান্তি বাড়ানোর কি দরকার?
আশরাফের গুমোট স্বর
‘ তোমাকে হা করতে বলেছি আমি?
পূর্নতা আর কথা বাড়ায়না।হা করলো।মিশরা দাঁড়িয়ে ছিল ওপরে।পাশে সায়রা।খাবার টেবিলের ওই দৃশ্যে মিশরার থৈথৈ চোখটা এবার উপচে পরলো জলে।শক্ত কন্ঠে বলল ‘ দেখলে মম?আমি কিন্তু ভুল বলিনি।বাবা পূর্নতাকে খাওয়ানোর জন্যেই আমার সাথে ওমন নাটক করলো।
সায়রার চেহারাতে কাঠিন্য।সেও বিশ্বাস করলেন” মেয়ের কথাই সত্যি।”
____
Ho ekk ladki ko dekha to aisa lagan..
Jeyse khilta golab,jeyse shayaar ka khawab,jeyse ujli kiran, jeyse ban me hiran..jeyse mandir ki koyi jalta diya……
Ho ek ladki ko dekha to aisa lagaan…
বেলকোনিতে বসে ধ্রুব।হাতে গিটার।গলা ছেড়ে গান গাইছে সে। চোখের সামনে স্পষ্ট পূর্নতার মুখস্রী।
ধ্রুবর মন গহীনে একটা প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে বারবার।কেনো ঐ মেয়েটির কথা এত মনে পড়ছে?লাইফে কত মেয়ে দেখেছি।এর থেকেও কত সুন্দরী মেয়ে।অথচ, এতটা গভীর ভাবে কারো চোখের মায়ায় ডুবেছি প্রথমবার।প্রথম বার নিজেকে বিলীন মনে হচ্ছে আমার।কি অদ্ভুত! আফনান খান ধ্রুব ও কিনা একটা মেয়ের মায়ায় আটকেছে?মায়া!এত মায়াইতো!কিন্তু এটা কি শুধুই মায়া? নাকি অন্য কিছু?
‘কি তাজ্জব ব্যাপার! আজ এই সময়ে আমার ছেলের হাতে বইয়ের বদলে গীটার দেখছি?
ধ্রুব এতটাই পূর্নতার ভাবনায় মজে ছিল যে,মায়ের কথায় চমকে উঠলো।
“তুমি এখনও ঘুমাওনি?
সেলিনা দরজা ছেড়ে বারান্দায় গেলেন।ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বললেন,
“আমার কথা ছাড়,,আগে বল তোর কি হয়েছে?
ধ্রুব কোল থেকে গিটার পাশে নামিয়ে রাখলো, কাঁধ উঁচু করে বলল,
“আমার আবার কি হবে?
“কিছুতো হয়েইছে।নাহলে আমার বই পোঁকা ছেলে।যে কীনা সারারাত ধরে পড়তে পড়তে বইয়ের ওপরেই ঘুমিয়ে যায়।আজ সে গান গাইছে?আর একা একা ওমন মিটমিট করে হাসছিলি কেন?প্রেমে টেমে পড়েছিস !
সেলিনার সন্দেহী দৃষ্টি। ধ্রুবর কাশি উঠে গেল কথাটায়।
নিজেকে সামলে বলল
“মা! কি যে বলোনা তুমি? আমি আর প্রেম?
“সত্যিই প্রেমে পড়িস নি?
ধ্রুব দুদিকে মাথা নাড়লো।পরেনি।
সেলিনার মনটা ঝুপ করে খারাপ হলো।বেতের চেয়ারে বসে পরলেন।
– ধুর! ভাবলাম ছেলে আমার প্রেম করছে।এবার বোধহয় একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসতে পারবো।
হ্যারে ধ্রুব,অনেক তো পড়াশুনা হলো,রাজি থাকলে বল না,তোর বড় ফুপির মেয়েকে দেখি তোর জন্যে।মেয়েটা যা সুন্দরী না!আমার তো ভীষণ পছন্দ!
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো।সেলিনার উচ্ছ্বাস নেতিয়ে পরলো কলমি ডগার মতোন।
ধ্রুব হাসতে হাসতে বলল,
‘মা তুমিওনা।তোমার বড় ছেলে কে রেখে আমার পেছনে কেনো পড়লে?
সেলিনা দুই ভ্রু ওঁচালেন,
– কে ধীর?ওর বিয়ে?সে হয়ত এ জীবনে আমার দেখা হবেনা বাবা।
সে তার খেলা নিয়েই পরে আছে।তোর কি মনে হয় আমি ওকে বলিনি?বলেছি।বলতে বলতে গাল ব্যাথা বানিয়েছি। কিন্তু সে আমার কথায় পাত্তাই দেয়না।উল্টে কোন খেলোয়াড় বিয়ের আগেই সাফল্য পেল,বিয়ের আগে কে কয়টা কাপ জিতলো,সেসব কাহিনি শুনিয়ে দেয়।
“তাহলে আর কি,ছেড়ে দাও।
ধ্রুবর নিরুদ্বেগ জবাব।
সেলিনা ভ্রু কোঁচকালেন,
” ছেড়ে দেব?কেন রে,আমার বুঝি ইচ্ছে করেনা,বাড়িতে বউ আসবে?আমি নাতিনাতনি নিয়ে সময় কাটাব?
সেলিনা মুখ কালো করলেন।ধ্রুব মায়ের হাতের ওপর হাত রাখলো।
“আচ্ছা ঠিক আছে। মন খারাপ করতে হবেনা।ব্যাপার টা বিবেচনায় রেখে দিলাম আমি।
“আপনাকে আর বিবেচনায় রাখতে হবেনা।
অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পর।
রাত জেগে জেগে চেহারার কি হাল করেছিস দেখেছিস একবার?
” মা!
তোমার ছেলের এই বেহাল চেহারা দেখেই যে কত মেয়ে ক্রাশ খেয়ে হেলে পরে সেটাতো আর জানোনা!
ধ্রুব চুল গুলো পেছনের দিক ঠেলল।সেলিনা বললে,
” তা মেয়েরা ক্রাশ খেয়ে হেলে পরলে আমার কি লাভ বাবা? আমার ছেলে তো আর কারো প্রতি হেলছে না তাইনা?
ধ্রুব চুপ করে গেল।পূর্নতার মুখটা মনে পড়তেই মুচকি হাসলো।সেলিনা চলে গিয়েছেন।ধ্রুব সেদিক চেয়ে বিড়বিড় করলো,
“কি জানি মা! যা অবস্থা দেখছি,কখন যে আমিও হেলেদুলে পরে যাই।
___
আজ ফার্স্ট ইয়ারদের প্রথম ক্লাশ।পূর্নতা তাড়াতাড়ি এসেছে।রুপ ও দেরি করেনি।পূর্নতার তাড়াতাড়ি আসার কারন আশরাফ।সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন রান্নাঘরে যাচ্ছিল পূর্নতা, হোচট খেল গিয়ে।সায়রা রুটি বেলছিলেন।চুলোর ওপর ভাজি বসানো।পূর্নতা তড়িঘড়ি করে গিয়েই বলল,
‘ছোট মা তুমি সরো,আমি থাকতে তুমি কেন করছো?
সায়রা একবার চোখা চোখে তাকালেন।রুটি বেলতে বেলতে বললেন,
‘এখন কী বাপেরহাতে আরেকটা চড় খাওয়ানোর ফন্দি করছিস?
সায়রার খোঁচানো কথায় পূর্নতার মুখটা চুপসে গেল।সেতো ওসব ভেবে বলেনি।এর আগেও আশরাফ বাড়িতে এলে সায়রা কাজ করতে দিতেন না।কিন্তু আশরাফ সকালে এসে রাতে চলে যেত আবার। ওইটুকু সময় পূর্নতা শুয়ে বসে কাটাতো।সায়রার নিছক অভিনয়ে সেও ছিল তখন পার্শ্ব চরিত্র।
‘সংয়ের মত দাঁড়িয়ে না থেকে যা এখান থেকে।
সায়রার কন্ঠে ঝাঁঝ।পূর্নতা বুঝলো দাঁড়িয়ে থেকে লাভ ও নেই।ধীর পায়ে আবার ওপরে চলে গেল।সায়রা সেদিক একবার চোখ বুলিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।মেজাজ ভীষণ খারাপ তার।তার মনে একটা প্রশ্নই উঠছে ‘ আশরাফ এবার যাচ্ছেনা কেন?
সে চায়না আশরাফ চলে যাক।বাকি স্ত্রীদের মতন চায় স্বামী কাছেপিঠে থাকুক।কিন্তু এই ইচ্ছে পূরন হলে তো!আশরাফ ঘুমোয় আলাদা ঘরে।আর সে আলাদা ঘরে।এর থেকে বড় যন্ত্রনার আর কী আছে!ভাবতেই সায়রার রাগটা আবার চড়াও হলো পূর্নতার ওপর।দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন ” তোর বাবা যাক এবার,দেখিস তোকে কী করি!
রুপের ধাক্কায় চমকে উঠলো পূর্নতা।হকচকিয়ে তাকালে দেখলো রুপ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে।এই মুহুর্তে তারা বসে আছে ভার্সিটির গোল চত্বরে।পাশেই বিরাট ডালপালা ছড়ানো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।
“কী ভাবিস এত?আমি কতক্ষন ধরে বকবক করছি,আদৌ কিছু কানে ঢুকেছে তোর?
পূর্নতা অনিহ কন্ঠে বলল,
‘তোর ওসব হাবিজাবি আলোচনা শুনে করব কি?ভার্সিটিতে কোন ছেলে বেশি সুন্দর,কোনটা ফর্সা,কোনটা লম্বা এসব মাপতে এসেছি?পড়াশুনা করতে এসেছি এখানে।
রুপ ঠোঁট উলটে বলল
” এভাবে বলতে পারলি?
‘পারলাম।
‘যা তোর সাথে কথাই বন্ধ।
রুপ ঘুরে বসলো।পূর্নতা হেসে এগিয়ে এলো ওর দিক।থুতনী ধরে বলল,
“ওলে থোত বাবুতা,তাক লাগ কলেনা।
রুপ হু হা করে হেসে উঠলো।এই হাসি আপাতত কিছুক্ষন লাগবে থামতে।রুপ একবার হাসতে শুরু করলে থামতে সময় নেয়।পূর্নতা নিজেও হাসছে। শব্দহীন।পায়ের কাছে পরে থাকা কৃষ্ণচূড়ার একটা থোকা তুলে বইয়ের ভেতর রাখলো।
রুপের হাসি তৎক্ষনাৎ থেমে গেল।
‘এটা দিয়ে কী করবি?
‘এটা বইয়ের মধ্যেই রেখে দেব।ভার্সিটির প্রথম ক্লাশের স্মৃতি হিসেবে।
রুপ মাথা দুলিয়ে বলল,
‘আর কাল কের ফুলটা?ওটা রেখে দিসনি?নবীন বরনেরর স্মৃতি হিসেবে?
‘হ্যা রেখেছি।
‘বাহ।তুই এত স্মৃতি রাখিস তাহলে ওই যে মিস্টার হ্যান্ডসামের ঘড়িতে তোর ওড়নার সুতো আটকেছিল কাল? তা সুতোটা রেখেছিস তো বইয়ের মধ্যে?
পূর্নতা কপাল কোঁচকায়। ক্ষেপে বলল
‘তুই কী আমাকে নিয়ে মজা করছিস?
রুপ সোজাসাপটা বলল,
‘করছি।বেস্টফ্রেন্ড কে নিয়ে মজা না করলে কাকে নিয়ে করব।আচ্ছা মিস্টার হ্যান্ডসাম আসেনি আজ?দেখিতো খুঁজে..
রুপ এদিক ওদিক দেখলো।পূর্নতা নিজে নিযে আওড়াল,
‘ক্যাবলাকান্ত নাকি আবার হ্যান্ডসাম।
‘ওইত মিস্টার হ্যান্ডসাম!
রুপের কথায় পূর্নতাও তাকালো।দূরে দৃষ্টিগোচর হলো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ধ্রুবকে।পকেটে দুহাত গোঁজা,চোখে কালো সানগ্লাস।পড়নে কালো শার্ট।রুপ অভিভূতের মতন চেয়ে বলল
‘উফ ভাই! এর দাড়ানোটাও কী জোশ!বয়ফ্রেন্ড টা না থাকলে একে লাইন মারতাম নিশ্চিত।
পূর্নতা আর তাকায়নি।লোকটাকে দেখলে কেমন কেমন লাগে।গতকাল কীভাবে চেয়েছিল সেসব মনে পড়ে।ধ্রুবর সানগ্লাসের জন্যে পূর্নতা বুঝলনা,ছেলেটা এখনো চেয়ে দেখছে তাকে।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ,বাইকের সাথে হেলান দেয়া সুমন, পিয়াস এদের একটা কথাতেও তার মনোযোগ নেই।সে বারবার পূর্নতার দিকেই চাইছে। পূর্নতা হাসলে গালে টোল পরে।এটা দেখলেই বুকে ব্যাথা করে তার।কী মহাযন্ত্রনা!
রিদ অনেক ক্ষন ধরে ধ্রুব কে ফলো করছিলো।ধ্রুব যে তাদের আশেপাশে থেকেও নেই সেটা বেশ বুঝতে পারছে।কিন্তু কালো চশমার জন্যে ওর দৃষ্টি ঠাওড় করতে পারছেনা।রিদ আশপাশ দেখলো।একটু দূরে রুপকে দেখেই সতর্ক চোখে তাকালো,
“এটা তো কালকের সেই ঝগড়ুটে মেয়েটা!
রিদের নাক ফুলে উঠলো মেজাজে।এই মেয়ে কাল তাকে ঢেঁড়স বলেছে।আজ এর একটা উপযুক্ত বদলা নিতে হবে।রিদের হঠাৎ চোখ গেল রুপের পাশে বসা পূর্নতার ওপর।নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে।গতকাল রুপকে করা ধ্রুবর প্রশ্নের কথা মাথায় এলো।
ধ্রুব কি তবে এই মেয়ের নাম জানতে চাইছিল?হুম হুম,তাই হবে।
ক্লাসের সময় হতেই বাকিদের মত রুপ আর পূর্নতা উঠে চলে গেল।ধ্রুব এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল।সবাইকে বলল,
” চল
সুমন প্রশ্ন ছুড়লো,
‘কোথায়?
“মঈনুল স্যারের রুমে।
‘এখন আবার কেন?
রিদের কথায় ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল ‘প্রশ্ন পরে কর।চল আগে।
ধ্রুব আবার মনে করার ভঙিতে বলল,
‘ও হ্যা,আচ্ছা আমাদের ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের মধ্যে টপার,কী যেনো নাম ওর?
রিদ কপাল চাঁপড়ে বলল,
হায়রে!এত সহযে ভুলে গেলি?ছ, ছ’বার, ও তোকে প্রপোজ করেছে।
ধ্রুব ওর মাথায় চড় মেরে বলল,
“ভুলে গিয়েছি। কারণ, আই হ্যাড নো ইন্টারেস্ট অন হার।এন্ড স্টিল আই ডোন্ট হ্যাভ।
” তাহলে ওর কথা জানতে চাইলি কেন?
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল
“আগে পুরো কথা শেষ করতে দে।মেয়েদের মত এত বকবক কেনো করিস তুই?এনি ওয়ে,নোরা কেও ডেকে নিস।
মিশরা এসেছে একটু আগে।পূর্নতা ওকে দেখেই সরে বসে জায়গা দিল।যাতে মিশরা ওর পাশে বসে।মিশরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গিয়ে বসলো পেছনের বেঞ্চে।সব সময়ের মত ইশিতা আছে সাথে।রুপের ভারি মেজাজ গরম হলো পূর্নতার ওপর।রেগেমেগে বলল,
‘জানিস ও ওরকম,ঢং করে আবার পাশে বসতে বললি কেন?
পূর্নতা মন খারাপ করলো।বললনা কিছু।ডিপার্টমেন্টের হেড ঢুকতেই সবার গল্প শেষ।তটস্থ হয়ে এক যোগে দাঁড়িয়ে গেল সব।সালাম দিল।হাসি মুখে সালামের উত্তর দিলেন তিনি।ওনার পেছন পেছন ঢুকলো, রিদ, নোরা আর ধ্রব।ধ্রুবকে দেখেই পূর্নতার বুক অকারনে ধ্বক করে উঠলো।তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে অন্যদিক তাকালো সে।ডিপার্টমেন্টে হেড মঈনুল হাসান বললেন,
– হ্যাভ ইউর সিট মাই চাইল্ড!
অনুমতি পেয়ে যে যার জায়গায় বসলো।
“সো, হাউ ইজ দা ভার্সিটি?
“অল গুড স্যার।
একসাথে সকলের জবাব।
‘আচ্ছা, তোমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দেই,এ হচ্ছে
রিদ হোসাইন।আমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট। সি ইজ তানিশা নোরা,সি ইজ অলসো আ ব্রাইট স্টুডেন্ট ইনক্লূডিং দ্যা গার্লস।
মেয়েদের মধ্যে সব থেকে ভালো স্টুডেন্ট সে।
এন্ড দিস ইজ ধ্রুব।আফনান খান ধ্রুব।তার কিছুটা প্রতিভার প্রুফ তোমরা গতকাল অনুষ্ঠানেই পেয়ে গিয়েছো।বাট তার সব থেকে বড় প্রতিভা হচ্ছে,
হি ইজ আ মোস্ট টেলেন্ডেড বয় ইন বিবিএ ডিপার্টমেন্ট। শুধু তাই ই নয়,লাস্ট সেমিস্টারে ধ্রুবর রেজাল্ট সব্বাইকে ছাড়িয়েছে।হি ইজ আ টপার অফ আওয়ার ভার্সিটি।
পূর্ণতা আর রুপ মুখ হা করে একে অন্যের দিক তাকালো।
‘ হ্যারে পূর্ণতা!এতো দেখছি রুপে লক্ষী, গুনে সরস্বতী।
পূর্ণতা মাথা দোলায়।
কথা ঠিক।
ধ্রুব মইনুল হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলল ‘
“আমি কিছু বলতে চাই স্যার।
‘নিশ্চয়ই, বলো কি বলবে?
ধ্রুব ঠোঁট দিয়ে জ্বিভ চেটে বলল ‘ স্যার,আই থিংক আমরা যেমন ওদের সাথে পরিচিত হলাম,ওদের ও আমাদের সাথে পরিচিত হওয়া উচিত।
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।গমগমে কন্ঠে বললেন,
‘কারেক্ট!
ধ্রুব হেসে সবার দিক চেয়ে বলল ‘তো তোমরা একেক করে সবাই সবার পরিচয় দাও।
পরিচয় পর্ব শুরু হলো ফার্স্ট বেঞ্চের কর্নার ধরে।একেকজন দাঁড়িয়ে নাম বলে বসছে আবার।একটা সময় সিরিয়াল এলো পূর্ণতার।পূর্নতা দাঁড়ালো।ওমনি চোখাচোখি হলো।খুব তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নামালো পূর্নতা।মৃদূ কন্ঠে বলল
‘সুলতানা মেহরীন পূর্নতা।
ধ্রুব অস্পষ্ট নিচু কন্ঠে আওড়াল ‘ পূর্নতা!
ভদ্রলোক বাকিদের মতোই প্রসংশা করলেন ‘ সুন্দর নাম।
পূর্নতা মুচকি হাসলো।সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবর হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো।এই সুন্দর,মায়াময় হাসির স্রোতে নিজেকে অবলীলায় ভাসাতে পারবে সে। হারাতে পারবে দূর থেকে বহূদূর।
পরিচিত পর্ব ইতি টানলো।,মঈনূল হাসান এবার বললেন,
“ওকে,সবার সাথে আলাপ শেষ?এবার তোমাদের জন্যে আমার একটা সাজেশন হলো, ভালো ভাবে,ফুল এটেনশন দিয়ে স্টাডি করবে সবাই।আমি চাই তোমরা এদের মতো(ধ্রুব, রিদ নোরা কে দেখিয়ে?ব্রাইট স্টুডেন্ট হও।এন্ড আওয়ার টপার বয় ধ্রুব,ইওওর’স রেজাল্ট স্যুড বি লাইক হিম।
ধ্রুব বলল,
“আমার মত নয় স্যার, আমি আশা করছি ওরা আমার থেকেও বেটার রেজাল্ট করবে।
– ইয়েস!দে উইল।আর হ্যা স্টাডির ব্যাপারে তোমাদের যেকোনো হেল্প লাগলে ওরা তোমাদের হেল্প করবে।একদম সংকোচ করবেনা ওকে!
কথা শেষ করে উনি বেরিয়ে গেলেন।শিক্ষার্থীরা আরো একবার দাঁড়ালো উঠে।ধ্রুব যাওয়ার সময় একবার পূর্ণতার দিকে তাকালো।মনে মনে বলল,
‘পূর্নতা!আমার জীবনে কোন পূর্নতা দিতে এসেছ তুমি?
____
ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে ক্যান্টিনের এক কোনায়।রিদ গিয়েছে কফি অর্ডার করতে।ধ্রুব ফোন টিপছিল মনোযোগ দিয়ে।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ কাধে হাত রাখলো।সাথে ডাকলো,
” ধ্রুব ভাইয়া!
ধ্রুব চমকে তাকালো।টপ্স,জিন্স পরিহিতা এক সুন্দরী মেয়ে দেখে ভ্রু কোঁচকালো।চেনা চেনা লাগছে ভীষণ।
‘আপনি ____কে?
থেমে থেমে প্রশ্ন করলো ধ্রুব।মেয়েটি এক গাল হাসলো।গমগমে কন্ঠে বলল,
‘আমাকে চিনতে পারোনি?
ধ্রুবর ভ্রু কুঞ্চন গাঢ় হয়।আওয়াজ টাও কেমন চেনা লাগছে।
ধ্রুবর চেহারা দেখে মেয়েটির মুখ কালো হয়ে গেল।ঠোঁট উল্টে বলল,
‘এই ক’বছরে ভুলে বসলে?আমিতো দেখেই চিনে ফেললাম।
ধ্রুব অসহায় চোখে তাকালো।সে চিনতে পারছেনা তাতে তার কী দোষ?
নম্র কন্ঠে বলল ‘ আমি আসলেই চিনতে পারছিনা। আপনিই পরিচয়টা দিন।
মেয়েটি গাল ফুলিয়ে বলল ‘চিনবে কীভাবে?তোমরা তো ভুলেই গেছ আমাদের।যাই হোক,আমি মিশু।মানে মিশরা।তোমার ছোট ফুপির মেয়ে।
চলবে,