ফাগুন_ এলো_বুঝি (০২)

0
1370

#ফাগুন_ এলো_বুঝি
(০২)
সময় যেন আটকে গেল।গোঁটা পৃথিবী থমকে গিয়েছে ধ্রুবর।চোখ দুটো নিশ্চল হলো সামনের অপরিচিতা মেয়েটির ওপর।
কালো ওড়নায় ঘোমটা টানা মাথায়।কপালের ওপর বিন্যস্ত ছোট ছোট চুল।সরু নাকের ওপর জ্বলজ্বল করছে অতি সূক্ষ্ণ পাথরের নাকফুল।মুখে আর কোনো প্রসাধনি নেই।আহামরি,অত্যন্ত কোনও কিছু না থাকলেও মেয়েটির এই সামান্য রুপেই যেন অবিচল রইলো ধ্রুবর দৃষ্টি।অভিভূতের মতো চেয়ে রইলো সে।ধ্রুবর চাউনি দেখে পূর্নতার অস্বস্তি হলো।এলোমেলো পাতা ফেলে হাত দুটো এগোলো ধ্রুবর ঘড়ি থেকে ওড়না ছোটাতে।পূর্নতা মনোযোগ দিয়ে সুতো ছাড়ানোর পুরোটা সময় ধ্রুব চেয়েই থাকলো।
পূর্নতা ওড়না ছাড়িয়ে একবার ধ্রুবর দিক তাকালো।ছেলেটা এখনো হাত ওমন উচু করে ধরে আছে।ক্যাবলাকান্ত!
পূর্নতার হাসি পেল।চেপে রাখতে না পেরে মিটিমিটি হেসেও ফেলল।ওমনি গালের পাশের গর্তটা মাথা তুলল।তৎক্ষনাৎ ধ্রবর বুক কেমন অদ্ভুতুরে বিট করলো। পূর্নতা আর দাঁড়ালোনা।ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান নিলো।এক প্রকার পালিয়ে গেল ধ্রুবর সম্মোহনী দৃষ্টির কবল থেকে।হা করে চেয়ে থাকলো ধ্রুব।মনোযোগ দিয়ে পূর্নতার প্রতিটি কদম মেপেছে সে!
ধ্রুব ঢোক গিলে বুকে হাত রাখলো।এমন দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে কেন এখানে?কীসের সংকেত এটা?
মেয়েটি কে?
“কোন মেয়ে?
পাশ থেকে হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠলো ধ্রুব।এতক্ষনের বিমোহিত ধ্যান ছুটে গেল।ঘাড় ফেরাতেই দেখল রিদ কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘কোন মেয়ের কথা বলছিস?
রিদের কন্ঠে বিস্ময়।ধ্রুব গলা ঝেড়ে বলল,
‘ককই?ককোন মেয়ে?
‘আমি স্পষ্ট শুনলাম মেয়ে নিয়ে কিছু বলছিলি!
‘ তোর কানের ডাক্তার দেখানো উচিত।
আর তুই এখানে কী করছিস?তোকে না স্টেজের পেছনের দিকটার দায়িত্ব দিলাম আমি।হয়েছে তোর কাজ?

রিদ সন্দেহী চোখে তাকালো।
” কী ব্যাপার? কথা কাটাচ্ছিস যে,উম উম রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি মামা।দেখিতো ভালো করে শুকে…
রিদ নাক এগোতেই ধ্রুব দুম করে ঘুষি বসালো।হকচকিয়ে নাক চেপে ধরলো রিদ,
‘আউচ,এটা কী করলি?ব্যাথা পেয়েছিতো।
ধ্রুব শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
‘পরেরবার আজেবাজে জিনিস শুকতে গেলে নাকটা ফাটিয়েই দেব।যা কাজে যা…
রিদ চোখমুখ ফোলালো।সামনে পা বাড়িয়ে আবার ফিরে এলো।ধ্রুব আশপাশ দেখছে।ওমনি রিদ কানের কাছে এসে গেয়ে উঠলো,
‘তলে তলে টেম্পু চালাও আমরা কইলে হরতাল।
ধ্রুব ভঁড়কেছে।রেগে তাকাতেই রিদ দৌড়ে পালালো।
‘দাড়া তুই খবর আছে তোর!
রিদ থামলোনা।সে প্রানপনে ছুটে গেল।ধ্রুব হেসে ফেলল।মাথা চুলকে আবার তাকালো পূর্নতার যাওয়ার দিকটায়।কী রকম একটা প্রেম প্রেম পাচ্ছে।পরমুহূর্তে নিজেই নিজেকে বোঝালো,
‘এক দেখায় প্রেম হয় নাকি!
___
কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে পূর্নতা মাঠের কোনার বেঞ্চে বসলো।এখান থেকে প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছে। বড় একটা স্টেজ,সামনে বসার জন্যে সাড়ি সাড়ি চেয়ার।
পূর্নতা চোখ ফিরিয়ে কোলের ওপর রাখা ব্যাগের দিক তাকালো।রুপকে কল দেবে ভেবে ফোন বের করতে যাবে ওমনি বেঞ্চের ওপর কেউ ধপ করে বসে পরলো।পাশ ফিরলো পূর্নতা।রুপ রীতিমতো বুকে হাত দিয়ে হাপাচ্ছে।ঘামে ভিজে একাকার হয়েছে। সাথে মাথার চুল গুলোও এলোমেলো।পূর্নতা উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
‘কিরে?তোর এমন বিধ্বস্ত অবস্থা কেন?
রুপ শ্বাস টেনে বলল ‘ পানি আছে?পানি দে আগে।
পূর্নতা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিতেই ঢকঢক করে শেষ করলো রুপ।মুখ মুছে ধাতস্থ হয়ে বলল,
‘ভার্সিটির সামনে এত কুকুর থাকে?আল্লাহ!আমার জান টাই বের হয়ে যাচ্ছিল।
গাড়ি থেকে কোনো মতে নেমেছি।ঢুকতে যাব ওমা দুটো কালো কুকুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।তুইতো জানিস আমার কুকুরে কী মারাত্মক ভয়!সবাই আমায় এত বলে কুকুর দেখলে না দৌড়াতে অথচ আমি প্রত্যেকবার সেটাই করি।আজকেও করলাম।আর ওই দুটোও আমার পেছনে ছুটলো।

‘তারপর?আচড় টাচড় কেটেছে নাকি?
‘ না না তা কাটেনি।কতগুলো ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে।ওরা মিলে তাড়িয়ে দিয়েছে।তারপর আবার তোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।সব মিলিয়ে আমি শেষ আজ।ভার্সিটির প্রথম দিন কুত্তার দৌড়ানি খাওয়ার এই অভিজ্ঞতা আমার স্মরনীয় থাকবে।
পূর্নতা হেসে উঠলো।রুপ ও তাল মিলিয়ে হাসলো।কথার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো,
“বাসায় আজ কোনও অশান্তি হয়নি?
পূর্নতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“নাহ। হতে হতেও হয়নি।

‘ যাক! ভাবলাম আজ আসতে পারিস না পারিস!একটা দিন অন্তত ওরা তোকে ছাড় দিলো।আচ্ছা,ক্যানটিন কোন দিকে?
“এখন আবার ক্যানটিনে কেনো?
‘কেনো মানে? তাড়াহুড়ায় আমি কিছু খেতে পেরেছি?আর ম্যাডাম পূর্নতা আমি খুব ভালো করে জানি যে আপনারও কিছুই খাওয়া হয়নি।অনুগ্রহ করে আসুন প্লিজ!উঠবি?খিদে পেয়েছে আমার।
পূর্নতা মুচকি হাসলো।ওর সব মন খারাপের ওষুধ বাবা আর রুপ।
‘চল
—-
খাওয়া শেষে বের হতেই ওদের কানে এলো মাইক্রোফোনে এনাউন্সমেন্ট।আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো শিক্ষার্থীদের আসন গ্রহন করতে আহবান করা হচ্ছে।অনুষ্ঠান শুরু হবে।
বিশাল বড় আয়োজন।রং বেরং এর বেলুন লাগানো হয়েছে সমস্ত জায়গা জুড়ে।স্টেজের এক পাশে সাইড করে রাখা বড় সোফা গুলোতে প্রফেসর রা বসে।স্টুডেন্টদের ভাগ করা হয়েছে দু তিনটে সাড়িতে।নবীনদের জন্য পুরোটাই আলাদা সাড়ি।আর বাকী স্টুডেন্টদের জন্য আলাদা।
অনুষ্ঠানের একদম শুরুতে প্রিন্সিপাল স্টুডেন্টদের স্বাগতম জানালেন।সাথে অনুষ্ঠান শুরু করার অনুমতি দিলেন।

পরপর মঞ্চে উঠলো ধ্রুব। পড়নে ব্রাউন রঙের পাঞ্জাবি। অনুষ্টানের উপস্থাপনার দায়িত্ব তার।ধ্রুবর চিকন ঠোটের কোনায় লেগে আছে সূক্ষ্ণ হাসি।চুল গুলো একবার পেছনে ঠেলে ধ্রুব মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালো।
শুরু হলো কিছু মেয়ের কানাঘুষা!
-ইয়ার হি ইজ সো হ্যান্ডসাম
– হাউ কিউট হি ইজ!
– ওপ্স কি হাসি! হায় মে মার যাওয়ান!
শেষ কথাটা পূর্নতার পাশের মেয়েটি বলেছে।সে মহাব্যস্ত ছিল এদিক ওদিক চেয়ে মিশরাকে খুঁজতে।এতক্ষন মঞ্চের কোনও কিছুই খেয়াল করেনি।কথাটা শুনেই ভ্রু কোঁচকালো।মেয়েটির দৃষ্টি অনুসরণ করে মঞ্চে তাকাতেই চোখদুটো কপাল ছুঁলো।
‘এত সেই ছেলেটা!একে কেনো ডেকেছে?
‘ইয়া আল্লাহ!এত দেখছি কিউটের ডিব্বারে পূর্না!
রুপ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। পূর্নতা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
‘কিউট না ছাই।ক্যাবলাকান্ত!মেয়ে দেখলেই হা করে চেয়ে থাকে।
রুপ অবাক হয়ে তাকালো,
‘কীহ?এরকম একটা ছেলেকে তোর ক্যাবলা মনে হচ্ছে?
‘তা নয়তো কি?জানিস তখন….
সব শুনে রুপ হা করে বলল,
‘এতো সিনেমার কাহিনি রে পূর্না।
এত্ত সুন্দর হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং একটা ছেলের ঘড়িতে তোর ওড়না আটকে গিয়েছিলো?ইসস! ওড়না টা তো আমার হলেও পারতো রে…
রুপের হা -হুতাশ দেখে পূর্নতা ভ্রু গুঁটিয়ে বলল,
‘ পছন্দ হয়েছে? দুলাভাই বানাবো?

‘না বাবা। একটা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি।আর দরকার নেই। তবে তুই চাইলে বল, এত সুন্দর একটা ছেলেকে না হয় আমার দুলাভাই বানাব।
পূর্নতা চোখ রাঙাতেই রুপ হু হা করে হেসে উঠলো।
পরপর ভেসে এলো সবার করোতালির শব্দ।দুজনেই সচকিত হয়ে মঞ্চে তাকায়।হাতে একটা লম্বা লিস্ট নিয়ে উপস্থাপনা করছে ধ্রুব।তার নিরেট,লহু স্বর।সাবলীল উচ্চারন।সব যেন মন ছুয়ে যাওয়ার মত।পূর্ণতা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।একেকবার একেকটা পারফমেন্স এর জন্যে একেকজন কে ডাকছে ধ্রুব।এরপর ডাকলো নাঁচের জন্যে দ্বিতীয় বর্ষের একটি মেয়েকে।সে নাঁচতে উঠলে ধ্রুব স্টেজের কোনায় গিয়ে দাঁড়ালো।আচমকা চোখ পরলো পূর্নতার দিকে।পূর্নতা তাকানো ছিল।ধ্রুব তাকাতেই চোখাচোখি হলো।অপ্রস্তুত হয়ে গুটিয়ে গেল পূর্নতা।চটপট চোখ সরিয়ে অন্যদিক তাকালো।
ধ্রুব চেয়েই আছে।
সেই মেয়েটা না?হ্যা সেই মেয়েটাইতো।নবীনদের সাড়িতে বসা, মানে মেয়েটা First year এর স্টুডেন্ট?
ধ্রুব আর ভাবলোনা।এত মানুষের মধ্যে একটা মেয়ের দিক চেয়ে থাকা তার ইমেজের সঙ্গে যাচ্ছেনা।তখন ওভাবে তাকিয়েছিল বলেই এখন নিজেকে বেহায়া মনে হচ্ছে।ধ্রুব মনোযোগ সরাতে পাঞ্জাবির পকেট হাতালো।কিন্তু ফোন নেই।ওহ,ফোন তো রিদের কাছে।ধ্যাত।বিরক্ত হয়ে স্টেজে যে মেয়েটি নাঁচ করছে তার দিক ফিরলো।কিন্তু না, তার মতোই তার মনোযোগ বেহায়া।ঘুরেফিরে কেন মেয়েটার দিকেই যাচ্ছে?আচ্ছা ঝামেলা তো!
ধ্রুব মঞ্চ থেকে নেমে যাবে ভাবলো। এর আগেই মেয়েটির নাঁচ শেষ। তার মানে আবার অন্য কাউকে ডাকতে হবে।মাঝখান থেকে হুট করে রিদ এসে মাইক হাতে নিল।ধ্রুব থেমে গেল।রিদ আমুদে কন্ঠে বলল,
‘অনেক তো উপস্থাপনা হলো,এবার আমাদের হিরোর একটা গান শুনলে কেমন হয়?
সঙ্গে সঙ্গে হৈচৈ বেঁধে গেল দর্শক সাড়িতে।তারা গান শুনতে আগ্রহী।ধ্রুবর মেজাজ গিয়ে পরলো রিদের ওপর। এটার কোন মানে আছে?রিদ ধ্রুবর গোটানো ভ্রু পাত্তা দিলোনা।সে হৈহৈ করতে করতে গিটার এনে হাতে দিল ধ্রুবর।ফিসফিস করে বলল,
‘একটা খারাপ গান গাইস মামা,নতুন মেয়ে গুলো সব তোর প্রেমে হুমড়ি খেয়ে পরলে আমাদের কী হবে?
ধ্রুব হেসে ফেলল। রিদ পালটা হেসে বলল,
‘অল দ্যা বেস্ট।

গিটার হাতে মাইক্রোফোনের সামনে এলো ধ্রুব।দু আঙুল দিয়ে গিটারের তারে টুং একটা শব্দ তুলে আড়চোখে একবার পূর্নতার দিক তাকালো।মেয়েটা উৎসুক চোখে চেয়ে আছে।ধ্রুব মুক্ত শ্বাস ফেলে গলা ছেড়ে গান ধরলো,

Akhon kii gustakiyaaaa maff Hooo……..
Ek tuk tumhein dekhti hain,
Jo batt kehna chahey jubban,tumse vo yeh kehti hain.
Haan akhon ki,sarmohayaan maff hoo..
……..

সকাল থেকে এক মিশ্র অনুভূতি ধ্রুবকে তাড়া করছিল।পূর্নতাকে দেখার পর থেকেই কেমন অদ্ভূত টান উঁকি দিচ্ছে মনে।তার সাথেও কি ঘটে গেল,লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট?
ধ্রুব বরাবর ভালো গান গায়।অমায়িক কন্ঠ তার।একদম স্বচ্ছ।একজন সুদর্শন যুবকের প্রতি দূর্বল হতে সময় লাগেনা সাথে সে যদি ভালো গান জানে।তবেতো সোনায় সোহাগা!
ধ্রুব আজ গানের মধ্যে সমস্ত আবেগ ঢেলে দিয়েছে।তার মানস্পটে ভাসছে পূর্নতা মায়া মায়া মুখটা।মেয়েটাতো সামনেই বসে আছে।তাহলে এসবের মানে কী?
সবার তালির বর্ষনে ধ্যান ভাঙলো পূর্ণতার।এতক্ষন মুঁদে ছিল ধ্রুবর গানের মধ্যে।কী সুন্দর গলা,কী দারুন সুর!
অনুষ্ঠান শেষে নবীনদের ফুল দেয়া হবে। দায়িত্ব বর্তেছে দ্বিতীয় বর্ষের ওপর।একটা টকটকে গোলাপ আর শুভ্র রজনীগন্ধা সুতোয় বেঁধে বিতরন করা হচ্ছে।একটা সময় একজন এসে পূর্ণতার হাতে ফুল দিলো।পূর্নতা সাথে সাথে গোলাপ আলাদা করে রুপের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রজনীগন্ধা রেখে দিল নিজের কাছে।ধ্রুব এদিকেই চেয়েছিল।ব্যাপারটায় বেশ বুঝলো পূর্নতার পছন্দের ফুল রজনীগন্ধা!
__
অনুষ্ঠান শেষ।আগামীকাল থেকে ক্লাশ শুরু হবে।পূর্নতা আর রুপ বাইরে এসে দাঁড়ালো।
“মিশরাকে দেখলাম না যে আজ?
“এসেছিলো তো।সকালে একবার দেখেছিলাম,তারপর আর দেখিনি।হয়তো বাসায় চলে গিয়েছে।
রুপ মুখ কুঁচকে বলল,
“কি জানি!যা আড্ডাবাজ মেয়ে,দ্যাখ কোথাও আড্ডায় ব্যস্ত। তোর মত কপাল যদি ওর হতো। বেশ হতো,মজা টের পেত তখন।
পূর্ণতা উদাস হেসে বলল,
“ওর কপাল আমার থেকেও খারাপ।আমিতো তাও নিজের বাবাকে “বাবা” বলে ডাকতে পারি।দিনশেষে তার মুখে ভালোবাসার ডাক শুনতে পারি।কান্না পেলে বাবার বুকে মুখ লুকাতে পারি।কিন্তু মিশু?ওতো নিজের বাবা থাকা সত্ত্বেও তার কাছে যেতে পারেনা।বাবা বলতে পারেনা।এর থেকে বড় দুঃখ আর কি হয় বলতো?
রুপ দুহাত ওপরে তুলে বলল,
“জানিনা বাবা!আপনার মত এত মহৎ ভাবনাচিন্তা আমার মাথায় আসেনা।
তবে ওরা দুই মা মেয়ে তোর সাথে যা করে আমি হলে…

‘থাক না!ছাড় ওসব।ভালো মন খারাপ করতে চাইছিনা।
রুপ একটু থেমে বলল,
“চল তোকে এগিয়ে দেই।
‘তুই শুধু শুধু অতদূর কেন যাবি?উলটো রাস্তা।

“কথা না বাড়িয়ে চল।আর এরপর থেকে আমিই তোকে এগিয়ে দিয়ে আসবো।শুধু আসার সময় টা তোকে একটু ম্যানেজ করতে হবে।তোর ছোট মা যে তোকে বাড়ির গাড়ি ব্যাবহার করতে দেয়না সে আমার জানা আছে।

“আচ্ছা বেশ।তবে এখন দরকার নেই।বাবা এসেছেন।গাড়ি পাঠাতে পারে।
বলতে না বলতেই আশরাফের গাড়ি এসে দাড়ালো।ভেতরে ড্রাইভার দেখে
রুপ বলল,
‘বাহ বলতে না বলতেই হাজির।এ গাড়ি না পঙখীরাজ?
আচ্ছা তুই যা তাহলে। আমি আমার ড্রাইভার কে কল করে ডাকি।
‘ঠিক আছে। সাবধানে যাস।
‘তুইও।
পূর্নতার গাড়ি চলে যেতেই রুপ ফোন বের করে কল দিল তার ড্রাইভার কে।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে,
“এই মেয়ে, শোনো।
রুপ ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরলো।
ধ্রুবকে দেখতেই ভাঁজ টানটান হলো।চকচক করে উঠলো চেহারা।ধ্রুবর ওপর প্রথমে একটা ছোটখাটো ক্রাশ খেয়েছিল,গান শুনে সেটা মহামারি আকার ধারন করেছে।কিন্তু ধ্রুব ওকে কেন ডাকবে?নিশ্চিত হতে শুধালো,
” আমাকে বলছেন?
রিদ মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল,
“এখানে তো আর কোনও মেয়ে নেই।যদি তুমি মেয়ে হয়ে থাকো তবে তোমাকেই ডেকেছি আর যদি অন্য কিছু হও তো সেটা আলাদা ব্যাপার।
রুপ নাক মুখ কোঁচকালো।মৃদূ চটে বলল,
‘অন্য কিছু হব মানে?আমাকে দেখে আপনার মেয়ে মনে হচ্ছেনা?

রিদ বলল ‘হচ্ছিল।এখন হচ্ছেনা।
‘এখন হচ্ছেনা মানে?
রিদ কিছু বলতে গেলে ধ্রুব থামিয়ে দিলো,
‘আহ রিদ! থাম।
রিদ থেমেছে। তবে তীক্ষ্ণ চোখে সে রুপ কে দেখে নিল একবার।ধ্রুব রুপকে বলল,
” একটু আগে তোমার সাথে যে মেয়েটা ছিলো ওর নাম কি?
রুপ অবাক হলো।রিদ একটা প্রবল ঝটকায় ঠোঁট আলাদা করে ফেলল।হা করে চেয়ে থাকলো ধ্রুবর দিক।
“ধ্রুব!যেচে পরে একটা মেয়ের নাম জানতে চাইছে?রিদ কতক্ষন বিশ্বাসই করতে পারলোনা।দুজন মানুষ এমন গোলগোল চোখে চেয়ে থাকায় ধ্রুবর অস্বস্তি হচ্ছে।সে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে এদিক ওদিক তাকানোর ভাণ করলো।
‘এমনিতেই সে মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারদর্শী নয়।আর জুনিয়রদের সাথেতো একেবারেই কথা বলেনা।অথচ এসেছে পূর্নতার নাম জানতে।বাধ্য হয়েই এসেছে।কিন্তু এই মেয়ে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন কি না কি!আর এই রিদ?সেতো এক কাঠি ওপরে।ধ্রুব বিরক্ত হয়ে রিদের পেটে গুঁতো দিল।রিদ তৎক্ষনাৎ মুখটা বন্ধ করে রুপের দিক ফিরলো।

‘এই মেয়ে!একটা নাম বলতে এত সময় লাগে তোমার?দেখে মনে হচ্ছে, বিয়েতে মত আছে কিনা সেটা জানতে চেয়েছে।
মেজাজ বিগড়ে গেল রুপের।কটমট করে রিদের দিক তাকালো।এই ছেলের কথাবার্তা মেজাজ খারাপ করার মতোই।
ধ্রুব হঠাৎ পূর্নতার কথা জিজ্ঞেস করায় অবাক হয়েছে ঠিক। ভাবছিল কিছু বলা ঠিক হবে কীনা!তাই বলে এই ছেলের এভাবে বলতে হবে? রুপ তেজ দেখিয়ে বলল,
” বলবোনা নাম! কি করবেন?
রিদ বিস্মিত কন্ঠে বলল,
‘কি করবো মানে? এই আমরা না তোমার সিনিয়র? সিনিয়র দের রেস্পেক্ট দিতে হয় জানোনা?দ্যাখ ধ্রুব কি অভদ্র মেয়ে!আমাদের অসন্মান করলো।
রুপ ভুল ধরানোর ভঙিতে বলল,
‘আপনাদের নয়,শুধু আপনাকে।স্যরি টু সে,আপনাকে সিনিয়র হিসেবে সন্মান টা দিতে পারছিনা।

রিদ রেগে গেল
‘ দিতে পারছিনা মানে?সিনিয়রদের র‍্যাগিংএর কথা শোনোনি?তেমন কিছুর ইচ্ছে আছে নাকি?জানোনা তো আমরা কি জিনিস!
রুপ পালটা রাগ দেখালো,
” হ্যা হ্যা জানি জানি।আপনারা তো ওটাই পারেন।জুনিয়র দের অসহায় পেয়ে অত্যাচার চালান।ভালোই জানা আছে আমার।
“দেখেছিস ধ্রুব, কি ঝগড়ুটে মেয়ে?
‘কি বললেন?আমি ঝগ__
‘চুপ করবে তোমরা?
ধ্রুব চেঁচিয়ে উঠলো।রুপ,রিদ থেমে গেল দুজনেই।রুপের উঁচালো আঙুলটা ভেঙে নেমে এলো বুকের কাছে।
ধ্রুব মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি একটা সামান্য নাম জানতে চেয়েছি।তোমার বন্ধুর ফোন নম্বর চাইনি যে তোমাকে এত হেজিটেড করতে হবে।
আর রিদ?তুই কী শুরু করেছিস?একটা জুনিয়র মেয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিস?

রিদ চোখ বড় করে বলল ‘ আমি ঝগড়া করেছি?ঝগড়ুটে তো এই মেয়েটা।
রুপ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘আবার?আবার আপনি আমায় ঝগড়ুটে বললেন?ওকে ফাইন!
রুপ ধ্রুবর দিক তাকালো,
শুনুন, আপনি যদি আমাকে পার্সোনালি কথাটা জিজ্ঞেস করতেন তাহলে আমি শুধু ওর নাম কেন? ওর সাথে সাথে আমার নাম,আমার বাবার নাম, মায়ের নাম সব বলে দিতাম।কিন্তু আপনি যেহেতু আপনার সাথে এই ম্যানার্সলেস, বুড়ো ঢ্যাঁড়স টাকে নিয়ে এসেছেন, তাই আমি আপনাকে কিচ্ছু বলবোনা। কিচ্ছু না মানে কিচ্ছুনা। হুহ!
রিদকে ভেঙচি কেটে হনহন করে হেটে গেল রুপ।
রিদ চোখ পিটপিট করে ধ্রুব কে শুধালো,
‘মেয়েটা ম্যানার্সলেস, বুড়ো ঢ্যাঁড়স কাকে বলল ধ্রুব?
ধ্রুবর নিরুদ্বেগ জবাব
‘তোকে।
‘ও আচ্ছা।
সতর্ক হতেই বলল
“কি? আমাকে? এই মেয়ে এই,তোমার সাহস তো কমনা! আমাকে ঢ্যাঁড়স বলা? তুমি জানো আমার মা আমাকে এখনও খোকা বলে ডাকে?আর আমাকে তুমি বুড়ো বললে?তোমাকে দেখে নেব আমি।অভদ্র, পাজি, ফাজিল!
রিদ কথা গুলো চিল্লিয়ে বলল। কিন্তু রুপের কান অবদি পৌছালে তো!তার টিকিটাও নেই এখানে।রিদ আহত হয়ে ধ্রুবর দিক ফিরলো।দুঃখি দুঃখি মুখ করে বলল,
“দেখলি ধ্রুব দেখলি? কি বলে গেলো শুনলি?আমাকে দেখতে কি বুড়ো বুড়ো লাগে?কত মেয়ে ঘোরে আমার পেছনে জানে মেয়েটা?

‘আমি ভাবছি অন্য কথা।
ধ্রুবর কন্ঠ সিরিয়াস।রিদ আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘কি কথা?
‘ একটা বুড়ো ঢ্যাঁড়স কিনা আমার বন্ধু?ছি!মান ইজ্জ্বত কিচ্ছু রইলোনা আমার।
রিদ হা করে বলল
‘তুইও ব্যাটা?
ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো রিদের চেহারা দেখে।রিদ মুখ ফোলালেও পরমুহূর্তে হাসলো সেও।হঠাৎ কিছু মনে করার ভঙি করে বলল

“আচ্ছা ওয়েট ওয়েট, আমাকে একটা কথা বল,তুই হঠাৎ একটা মেয়ের খোঁজ কেন করছিস? হুট করে তোর হলোটা কি?
ধ্রুব আমতা-আমতা করে বলল
‘আসলে,আসলে মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছিল।
রিদ গেয়ে উঠলো,
‘চেনা চেনা লাগে, তবু অচেনা।
ভালোবাসো যদি কাছে আসোনা।
ধ্রুব চোখ রাঙাল।
‘চুপ কর ইডিয়ট।
রিদ কাঁধ উঁচু করে বলল ‘ ওকেহ।
পরমুহূর্তে বেসুরো গলায় গাইলো,
‘আমি ছুঁয়ে দিলেই সব দুঃখ হয়ে যায়।
আবার কিছু বললেই দোষ হয়ে যায়।
কিন্তু আমি দোষি না।
কাছে না ডাকলে আসিনা।

ধ্রুব বিরক্ত হয়ে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করলো।পূর্নতার নাম জানতে না পেরে তার মন অল্পস্বল্প খারাপ হয়েছে।কিছুক্ষন নিঁখুত ভাবে ভাবলো সে।কিছু একটা মনে পড়তেই ঠোঁটের বাম দিকের কোনাটা সূচালো হলো। নাম কেন, মেয়েটার কাছাকাছি থাকার ও একটা দারুন উপায় সে পেয়েছে।এবার শুধু কালকের অপেক্ষা।

চলবে

ধ্রুবর সাথে রুদ্র,বা পূর্নতার সাথে সেঁজুতি কে মেলাবেন না।দুটো গল্প আলাদা, কাহিনি আলাদা,সুতরাং নায়ক নায়িকার বৈশিষ্ট্যও আলাদাই হবে।দুনিয়ার সব মেয়ে সেঁজুতির মত লাফালাফি টাইপের হয়না ?পূর্নতার মত চুপচাপ ও হয়?পূর্নতা বোকাসোকা নয়।সে চুপচাপ শান্ত ওকে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here