#ফাগুন_ এলো_ বুঝি,০৮,০৯
০৮
বসার ঘরের সোফায় বসে আছেন সেলিনা।থমথমে মুখ।ধ্রুবর ওপর রাগের পরিমান মাত্রা ছাড়িয়েছে আজ।
ধ্রুব তাকে মিথ্যে বলেছে। গতকাল রাতে ও হাসপাতালে ছিলনা।ব্যাস্ততা ছিল অজুহাত।আসলে সে কতগুলো ছেলেকে বেধরম পিটিয়েছে কাল।সাথে তার চ্যালাপেলাও ছিল।সবগুলো এমন মার মেরেছে ওদের, ছেলেকটা এখন আই সি ইউ তে ভর্তি।
আর এই খবর শুনতে হচ্ছে পাশের বিল্ডিংয়ের এক মহিলার থেকে।তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন ধ্রুবকে ছেলেগুলোর সাথে ঝামেলা করতে।ধ্রুব সেখানে একজন কে থাপ্পড়ও মেরেছিল।এটুকুই তিনি সেলিনাকে জানিয়েছেন আজ।সেলিনা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি।ধ্রুবর মত শান্ত শিষ্ট ছেলে এরকম করবে কেই বা বিশ্বাস করবে?কিন্তু ওনার বলার ভঙিতে সন্দেহ হলো।ভালোভাবে জানতে রিদকে ফোন করলেন।রিদ প্রথমে অস্বীকার করলো।কিন্তু সেলিনা ওর তোতলানোতেই বুঝে গেলেন ঘটনা সত্যি।শেষ মেষে অনেক জোড়াজুড়িতে রিদ স্বীকার করলো।সেদিন ব্যাপারটা ঝামেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা,বরং মারামারি ও হয়েছে।ঠিক কি কারনে হয়েছে সেসব আর সেলিনা শোনার আগ্রহ পেলেন না।ঐটুকু তেই ভীষণ রেগে গেলেন,কষ্ট পেয়ে কেটে দিলেন লাইন।
ধ্রুব এমন করেছে এখনো কষ্ট হচ্ছে মানতে।ঠিক করলেন বাকি কথা ধ্রুবর মুখ থেকেই শুনবেন।কত মিথ্যে বলতে পারে ও সেলিনাও দেখে ছাড়বেন আজ।
‘মুখ টাকে ওমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছো কেন? কি হয়েছে?
মেহবুবের কথায় সেলিনা তাকালেন।আবার চোখ নামিয়ে বললেন
‘কিছু হয়নি।
‘তবে এমন কেনো লাগছে?
‘ আমার মুখটাই এমন, অফিস যাচ্ছো?
‘হ্যা..
সেলিনা উঠে বললেন,
“চলো দরজা অব্ধি এগিয়ে দেই।
মেহবুব ভ্রু বাঁকালেন,
‘সেকি! তাড়াচ্ছো মনে হচ্ছে!
‘হ্যা তাই,,যাও বের হও।
‘যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি।
মেহবুবকে একপ্রকার ঠেলেঠুলে বাসা থেকে বের করলেন সেলিনা।উনি থাকলে ধ্রুব কে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেননা।মেহবুব ও শান্ত প্রকৃতির।এমন মানুষ রেগে গেলে বিপদ।
সেলিনা দরজা চাপাতে গেলেন। এর মধ্যে হাজির হলো ধ্রুব।মাকে দেখেই প্রসস্থ হাসলো।খুশি দেখাচ্ছে খুব।সেলিনা খানিক থমকালেন।এখনই কী জিজ্ঞেস করবেন?ছেলেটার হাসি মুখটা নষ্ট করতে কেন যেন ইচ্ছে করছেনা।পরমুহূর্তে পাশের বাড়ির লতা বেগমের রসিয়ে রসিয়ে বলা কথাগুলো মনে পড়তেই রাগটা চড়াও হলো আবার।ধ্রুব ততক্ষনে সিড়ির গোড়ায় চলে গিয়েছে।
সেলিনা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“দাঁড়া ধ্রুব।
ধ্রুব পেছন ঘুরলো।
‘ কিছু বলবে মা?
‘ গতকাল রাতে কই ছিলে তুমি?সত্যি করে বলো?
ধ্রুব ধাক্কা খেল।মা তুমি করে তখনই বলেন যখন রেগে যান।
‘মা হঠাৎ এসব কেনো জিজ্ঞেস করছে? কিছু জেনে ফেললো কি?
মুখে বলল ‘ হাসপাতালে ছিলাম।বলেছি তো তোমাকে।
সেলিনা ধমকে উঠলেন,
‘চুপ করো।মিথ্যে বলছো কেন?যা যা করে বেড়াও সেসব স্বীকার করার কী সৎ সাহস নেই?
ধ্রুব চুপ করে গেল।সেলিনা এগিয়ে এসে বললেন,
‘আমি জানি তুমি কোথায় ছিলে।আসলে কাল রাতে তুমি কতগুলো ছেলের সাথে মারপিট করেছ।তাও ছেলেগুলোকে রিদদের পুরোনো তেলের কারখানায় বেধে রেখে।
ধ্রুব চমকালো।অবাক হয়ে বলল
‘তুমি এসব কি করে জানলে?
‘ আমি কি করে জেনেছি সেসব ছাড়! আগে বল এসব, সত্যি না মিথ্যে।তোর মুখ থেকে শুনতে চাইছি আমি।
ধ্রুব মাথা নিচু করে বলল
‘সত্যি।
সেলিনা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন।
‘এই জন্যে বুঝি তোকে পড়াশুনা শেখাচ্ছি? এভাবে মাস্তানি করে বেড়ানোর জন্যে?কোনও মানুষ এভাবে কোনও মানুষকে মারতে পারে ? জানিস ছেলে গুলোর কি অবস্থা এখন?
‘জানি ।আর ওদের আমি মারিনি,উচিত শিক্ষা দিয়েছি,,
তুমি জানোনা ওরা কি করেছে?
ওরা একটা মেয়েকে রেপ করার জন্যে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো।পিয়াশ সেটা দেখে প্রতিবাদ করতে গেলে ওরা ওকে এমন ভাবে মেরেছে যে ওর একটা পায়ের হাড়ই ভেঙে গিয়েছে!ভাগ্য ভালো যে সেখানে সুমনরা সময় মতো পৌঁছেছিল।যার কারনে মেয়েটা আর পিয়াশ দুজনেই বেঁচে যায়।এতবড় অপরাধ করার পরেও ওদের কিভাবে ছেড়ে দিতাম আমি?ওরা যা করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি কেবল।এতে অন্যায় কিছু নেই।
সেলিনা প্রত্যত্তর করলেন না।নির্বাক রইলেন।ধ্রুব এসে মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল,
‘তোমার ছেলে অন্যায় সহ্য করতে পারেনা মা।তুমিইতো ছোট বেলায় পড়িয়েছিলে
অন্যায় যে করে,আর যে সহ্য করে দুজনেই অপরাধি!আমি সেই অপবাদ কিভাবে মাথা পেতে নেব মা?তাছাড়া পিয়াস আমার খুব ভালো বন্ধু।আমার জন্যে চাইলে ওরা সবাই জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। সেই বন্ধুর এই অবস্থাই বা কী করে সহ্য করব?
সেলিনার চোখে জল।কোমল কন্ঠে বললেন,
‘সবই বুঝি বাবা।কিন্তু
এতে যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যায় তোর? আমরা কি নিয়ে বাঁচব?
ধ্রুব মায়ের হাত মুঠোয় তুলে বলল ‘
আমার কিচ্ছু হবেনা মা।তোমার দোয়া সব সময় আমাদের দুইভাইয়ের সঙ্গে থাকে।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।আমি এরপরে আর কোনো ঝামেলায় জড়াব না।
‘সত্যি বলছিস?নাকি আমাকে শান্ত করার জন্যে?
‘দুটোই।
সেলিনা চোখ রাঙালেন ‘ ফাজিল ছেলে!
‘খেতে কি দেবে মা?খুব খিদে পেয়েছে আমার।
ধ্রুবর অসহায় কন্ঠ।সেলিনা ব্যাস্ত হাতে চোখ মুছে বললেন,
‘দিচ্ছি দিচ্ছি।তুই ফ্রেশ হয়ে আয় যা।
ধ্রুব যেতে নিলে সেলিনা আবার ডেকে বললেন,
‘ভবিষ্যতে মারামারি করবিনা কিন্তু।
‘করবনা বাবা করবনা।
বিড়বিড় করে বলল ‘বখাটেদের শায়েস্তা করা
কে মারামারি বলেনা।শিক্ষা দেয়া বলে।
___
বাড়ি ফেরা থেকে শুরু করে পূর্ণতা পায়চারি করছে।রুমের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়ানো শেষ করে বিছানায় বসলো।নাক বরাবর রাখা ড্রেসিং টেবিলের দিক চেয়ে আরো একবার লাল হয়ে উঠল লজ্জ্বায়।মানস্পটে শুধু ধ্রুবর গায়ের ওপর পরে যাওয়া দৃশ্য ভাসছে।পূর্নতার মনে হচ্ছে আয়নার মধ্যে থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলছে,
ছি পূর্ণতা!সবার সামনে তুই কিনা আজ ওই চকলেট বয়ের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পরলি?একটু দেখে শুনে দৌড়াতে পারলিনা?পরলি পরলি একেবারে তাকে সহ নিচে?তাও একটা খেলনা সাপের ভয়ে?মান সন্মান আজ সব চুলোয় উঠেছে তোর পূর্ণতা।কিভাবে পারলি তুই?কি ভাবলো সবাই?আর সেই ধ্রুব? সে না জানি কি ভাবছে তোকে?দৌড়া আরো বেশি করে দৌড়া।নির্বোধ মেয়ে!
পূর্নতা লজ্জ্বায় দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।জোরেজোরে বলল,
‘আমি আর দৌড়াবনা।কখনও না।কেউ যদি গায়ে সত্যিকারের সাপ ও ছেড়ে দেয়,তবুও না।
____
ধ্রুব একটা লম্বা শাওয়ার নিয়েছে।ইদানিং প্রচন্ড গরম পরেছে।এসিতেও কাজ হয়না।বাইরে রোদে বের হলেতো গরমের ষোলকলা পূর্ন। উদাম গায়ে বের হলো ধ্রুব।কোমড়ে তোয়ালে প্যাচানো।আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো সে।চুল ঝাড়তে ঝাড়তে হঠাৎ খেয়াল পরলো বুকের ওপর।দুটো নখের আচড় লাল হয়ে ফুটে আছে সাদা চামড়ায়।ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে হাত বোলালো সেখানে।এখানে এরকম আচড় কীভাবে এলো?কোত্থেকে এলো?আচমকা মনে পড়লো পূর্নতার কথা।পূর্নতা ছুটে এসে তাকে সহ পরে গেছিল নিচে।খামচে ধরেছিল ভয়ে।তখনই কি লেগেছে?
তবে কি এটা পূর্ণতার__
ভাবতেই খুশিতে নিজের চুল নিজে এলোমেলো করে দিল ধ্রুব।
‘ওয়ে হোয়ে!লাভ স্টোরি শুরু হওয়ার আগেই লাভ বাইট দিয়েছ মায়াপরি!এত ফাস্ট তুমি?
___
পরের দিন সকাল থেকে সেলিনা ভীষণ ব্যাস্ত।কাজের লোকদের নিয়ে রান্নার মহা তোড়জোড় শুরু করেছেন তিনি।তৈরী করছেন নানান পদ।তালিকা অনেক লম্বা। আশরাফ থেকে শুরু করে পূর্নতা অব্দি সবার জন্যে পছন্দের আইটেম বানাচ্ছেন।পূর্নতার মিষ্টি পছন্দ বলে তার জন্যে ভিন্ন পিদ,মিশরার পছন্দ ঝাল।আশরাফের জন্যে মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল।সায়রার জন্যে খাসির রেজালা।সব আলাদা আলাদা করে বানাচ্ছেন।এরপরে ধীর- ধ্রুব, মেহবুব ওদের কথাতো আছেই।
ডায়নিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসলো ধীর।হাতে ব্যাটবলের ভারি ব্যাগ রেখে দিল পাশের চেয়ারটায়।চেঁচিয়ে বলল ‘ মা নাস্তা দাও।
সেলিনা ব্যাস্ত পায়ে এলেন।হাতে ট্রে।তার মধ্যে এক গ্লাস মাল্টার জুস,দুটো পরোটা,ডিম সেদ্ধ আর ভাজি তরকারি।ছেলের সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে শুধালেন,
” তুই বেরোচ্ছিস?
‘হ্যা।
সেলিনার হাত থেমে গেল
” কোথায় যাচ্ছিস আবার!
ধীর পরোটা ছিড়তে ছিড়তে বলল,
টেস্ট ম্যাচ আছে মা।এন্ড ইটস ইম্পরটান্ট..
সেলিনা মুখ বাঁকালেন,
‘কঁচুর ম্যাচ।আপনার জন্যেতো সব ম্যাচই ইম্পোরট্যান্ট। বাবা মা,ভাই পরিবার এদের দেয়ার জন্যে সময় কোথায় আপনার?ব্যাটে বলে বারি দিয়েই ছক্কা বানালেই হয়না।মাঝে মাঝে একটু মাকে সময় দিতে হয়।
ধীর এসব শুনে অভ্যস্ত।সে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করছে।সেলিনা রাগটাকে কমালেন।এভাবে বলে লাভ হবেনা।হলে আগেই হতো।এ ছেলে চুপচাপ শুনে ভুলে যাবে সব।সেলিনা ধীরের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে আহ্লাদ করে বললেন,
“আমি বলি কি ধীর,ম্যাচ তো রোজই থাকছে।আজ বরং থেকে যা বাবা।সোনা ছেলে না তুই?
ধীর জুসে চুমুক দিয়ে বলল,
‘হঠাৎ থেকে যাব কেন? আজ কি স্পেশাল কিছু আছে?ধ্রুবর জন্যে বউ টউ আনছো নাকি!
সেলিনা কপাল কুঁচকে বললেন,
‘যত্তসব আজেবাজে কথা!তোর ছোট ফুপি আসছে আজ।
ধীর শান্ত চোখে তাকালো।মুখ বিকৃত করে ভাবল
‘ছোট ফুপি আসছে? নিশ্চয়ই উনি আর মিশরা আসবেন।চূন্নিটাকে দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়।এরপর তো আরো বেশি করে থাকবোনা।
মুখে বলল,
‘ম্যাচ টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।ফুপি আসছে তো আসুক না!আজ না হোক কাল দেখা তো হচ্ছেই।তাছাড়া আমি চলে আসবো তাড়াতাড়ি
। তুমি ভেবোনা।থাকতে পারলে থাকতাম মা।
সেলিনার মেজাজ খারাপ হলো।
‘যা খুশি কর।আমার কথার কোনো দাম দেয়না এই ছেলে।এত করে বলার পরেও খেলতে যেতে হবে।নাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে তো!তোর সাথে কথা বলাই বেকার।
আমার কত সময় নষ্ট হলো।যাই বাবা পায়েস টা বসাই। পূর্ণতা আমার হাতের পায়েস খেতে যা ভালোবাসেনা।ভীষণ খুশি হবে ও।
সেলিনা রান্নাঘরের দিক চলে গেলেন।যেতে যেতে বললেন এতগুলো কথা।
পূর্ণতার নাম শুনতেই ধীরের খাবার গলায় আটকাল।কোনো মতে সেটুকু গিলে চোখ বড় বড় করে তাকালো।রান্নাঘরের দিক চেয়ে উঁচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘পূর্ণতার জন্যে পায়েস কেনো রাধবে? পূর্ণতাও কি আসছে মা?
সেলিনাও একইরকম চেঁচিয়ে জবাব দিলেন।
‘হ্যা। সবাই আসছে।তোর ফুপিকে তো চিনিস, পূর্ণতাকে একেবারেই নিয়ে আসতে চায়না।প্রত্যেক বারের মত এবারো জোড় করেই বলেছি নিয়ে আসতে।
ধীরের মাথা চক্কর দিল।
‘পূর্ণা আসবে? ওহ শীট!কেনো যে মাকে বলতে গেলাম ওসব।এখন কি করি?
চলবে,
#ফাগুন_ এলো_ বুঝি!
(০৯)
ধীর কপাল চাপড়াচ্ছে বসে বসে।অজান্তে এ কী করে ফেলল!পূর্নতা আসবে জানলে এরকম ভূয়া ব্যাস্ততা জীবনেও দেখাতোনা।
‘এখন যদি মাকে বলতে যাই আমি যাবোনা,তাহলে মা কি ভাববেন?উফ ধীর! এই খেলাই আজ তোকে বিপদে ফেলল।কি করবি এখন?
ধীর ঠোঁট কামড়ে ভাবছে।খাবার পরে আছে আধখাওয়া।সেদিকে মনোযোগ নেই ।সে গভীর ভাবনায় তলিয়ে।উপায় খুঁজছে। খুঁজছে বাড়িতে থেকে যাওয়ার একটা অজুহাত।অনেকক্ষন ভাবার পর হঠাৎই কিছু একটা ভেবে চেহারা চকচক করে উঠলো ধীরের।
‘ইয়েস পেয়েছি..
ধীরের ফোনের রিংটোন সমানে বাজছে।তাও একটা মাথা ব্যাথা তুলে দেয়া রিংটোন।সেলিনা বিরক্ত হয়ে একবার উঁকি দিলেন রান্নাঘর থেকে।ধীর তো ডায়নিংয়েই বসা।পাশেই ফোন বাজছে।তাহলে তুলছে না কেন?
‘কিরে ধীর? ফোন বাজছে শুনতে পাচ্ছিস না? ধর।
ধীর ভান করে বলল,
‘ও, হ্যা তাইতো।ধরছি।
সেলিনা বিড়বিড় করে বললেন ‘ এই ছেলের কানে কী হলো কে জানে।এতদূর থেকে আমি শুনলাম আর ও পাশে বসেও শোনেনি?অদ্ভূত না।
পাশ থেকে কাজের মেয়ে বেনি বলল,
‘খালাম্মা,মনে হয় বড় ভাইর কানে সমেস্যা।ডাক্তার দেহান লাগব।
‘তুই নিজের কাজ কর।
ধমক খেয়ে বেনি আবার পেয়াজ কাটায় মন দিল।এদিকে ধীর ফোন তুলে কানে ধরে জোরে জোরে বলল,
‘হ্যালো কে বলছেন?
‘জি আমি আদনান খান ধীর বলছি।
‘কি বললেন? আজ ম্যাচ ক্যান্সেল?
‘ও ওকে ওকে।
ধীর কথা বলতে বলতে রান্নাঘরের দিক এগিয়ে গেল।চেষ্টা করলো কথাগুলো মায়ের কানে পৌছে দিতে।ফোন পকেটে রাখতেই সেলিনা জিজ্ঞেস করলেন,
‘কার ফোন?
“তুমি চিনবেনা।বললো আজ ম্যাচ ক্যান্সেল।মানে খেলা হচ্ছেনা..
সেলিনা ভ্রু গোঁটালেন,
‘এখন ম্যাচ ক্যান্সেল কেনো করলো? এখন তো বৃষ্টিও নেই।
ধীর কাঁধ উঁচু করে বলল,
‘সে আমি কি জানি।তোমার সামনেইতো কথা বলেছি।
সেলিনা ভ্রু টানটান করে বললেন ‘ তাহলেতো তোর আজ যাওয়া হচ্ছেনা।
ধীর মাথা নাড়লো ‘ হচ্ছেনা।
সেলিনা খুশি হয়ে বললেন,
” ভালো হয়েছে।বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ থাকবে,অথচ আমার ছেলে মিসিং হলে হয়?
তুই থাকছিস জানলে তোর বাবাও খুশি হবেন।
ধীর হাসলো।মায়ের সামনে থেকে সরে এসে হাতপা ছুড়ে নাঁচলো কিছুক্ষন।ব্যাপারটা দারুন হলো।তার মা বুঝলোইনা সে তখন ফোনে কথা বলার নাটক করছে।ফোনের রিংটোনতো ইচ্ছে করেই বাজিয়ে রেখেছিল যাতে সেলিনার কান অব্দি পৌঁছায়।ধীর নাচানাচি থামিয়ে শার্ট ঠিকঠাক করলো।
প্ল্যান সাকসেকফুল।এবার কিছুক্ষনের অপেক্ষা। পূর্না আসবে।আর ধীর গালে হাত দিয়ে দুচোখ ভরে দেখবে ওকে।
____
মেয়ের ঘরে ঢুকে সায়রার চোখ কপালে উঠে গেল।
‘কিরে মিশু! সমস্ত জামাকাপড় এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিস কেন?
মিশরা অসহায় চোখে তাকালো।
‘মামা বাড়ি কোন ড্রেসটা পরে যাব মা?আমিতো সিলেক্ট করতেই পারছিনা।
সায়রা দুধের গ্লাস টেবিলে রেখেবললেন,
‘ওমা এ আবার কি কথা!মামার বাড়ি যাচ্ছিস তাতেই এই অবস্থা?এমন করছিস যেন তোকে দেখতে আসছে!
মিশরা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
‘মা,ফ্যাশন ইজ ফ্যাশন।সেটা মামার বাড়ি হোক,বা শশুড় বাড়ি।বুঝেছ।
‘বুঝলাম।
‘এখন তুমি একটু কষ্ট করে পূর্ণতাকে ডেকে দাও।
সায়রা মুখ কোঁচকালেন,
‘কেন?ওর এখানে কী কাজ?
‘ওর তো ফ্যাশন সেন্স ভালো।ওকে দিয়ে বাছাই। ভালো লাগলে পরব নাহলে না।
সায়রা খুশি হতে পারলেন না।মেয়ের কথায় মানা ও করলেন না।মেনে নিলেন।বললেন,
‘ঠিক আছে, ডেকে দিচ্ছি।
____
সদর দরজায় কলিং বেলের শব্দ।ওপর থেকে এক প্রকার দৌড়ে নামলো ধীর।
বেনি দরজা খুলতেই যাচ্ছিল।ধীর সিড়ি থেকে চেঁচিয়ে বলল,
‘না।
চিৎকার শুনে বেনি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।ধীরের দিকে তাকালো প্রচন্ড অবাক হয়ে। ধীর লজ্জ্বা পেল খানিক।হাসার চেষ্টা করে বলল,
” তোকে খুলতে হবেনা বেনী।তুই যা।আমি খুলছি।
বেনি মাথা নাড়লো।ভেতরে এসে বুকে থুথু ছেটাল সে।দারুন ভয় পেয়েছে মেয়েটা।
এদিকে কলিংবেল বাজছে।ধীর আস্তে আস্তে এগোচ্ছে সেদিকে।নিজেকে সত্যিই পূর্নতার খেতাব অনুযায়ী স্লো স্লো মনে হচ্ছে।দরজার দিক যত পা বাড়াচ্ছে হৃদযন্ত্র ধুকপুক করছে তত বেশি।
একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে দরজা খুলল ধীর।ভাবল খুলেই দেখবে পূর্ণতার স্নিগ্ধ মুখখানি।কিন্তু ওপাশে ধ্রুবকে দেখতেই মুখটা চুপসে গেল।
ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল,
“এতক্ষন লাগে দরজা খুলতে?সর সর।দাড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে।
ধীরের মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে।দরজা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়াল চুপচাপ।ধ্রুব পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো..
“তুই এইসময় বাসায় কেন?
“ম্যাচ ক্যান্সেল হয়েছে,তাই।
তখন সেলিনা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কে এলো?
‘তোমার অতি আদরের দুলাল এসেছেন।বরন করলে ডালা নিয়ে এসো।হুহ!
মেয়েদের মত মুখ ভ্যাঙালো ধীর।লম্বা লম্বা পা ফেলে আবার ওপরে চলে গেল।
পেছনে ব্যাক্কলের মত দাঁড়িয়ে রইল ধ্রুব।হতভম্ব হয়ে বলল
“এর আবার কি হলো?
দ্বিতীয় বার কলিং বেলের শব্দ। আবারও হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামলো ধীর।সেলিনা ততক্ষনে দরজা খুলেছেন।ধীর সিড়িতেই দাঁড়িয়ে যায়।একটু ঝুঁকে দেখল মেহবুব ঢুকছেন।মুখখানা আবার কালো হয়ে গেল ধীরের।সেলিনা কিন্তু ঠিক খেয়াল করেছেন ধীরের ছোটাছুটি। ধীর যেতে নিল ঘরে।পরপর সেলিনার কথায় থেমে গেল।
‘তুই এত ছুটছিস কেন ধীর?এভাবে নামলে তো পরে হাত পা ভাঙবে বাবা।
ধীর জোরপূর্বক হেসে বলল ‘না আসলে ভাবলাম ফুপিরা এসেছেন।অনেকদিন দেখিনিতো ওনাদের।তাই।
সেলিনা চোখ ছোট করে বললেন,
‘ওরা এখন কেনো আসতে যাবে?ওরা তো সেই বিকেলে আসবে রে!
ধীর হোচট খেল এক প্রকার।
‘বিকেলে আসবে? এতক্ষন ধরে তাহলে আমি শুধু শুধু অপেক্ষা করছিলাম?এত বার সিড়ি থেকে দৌড়ানোটাও বৃথা?ইয়া আল্লাহ!
‘কী ভাবছিস? খিদে টিদে পেয়েছে নাকি?
মায়ের কথায় ধীর তাকাল।উত্তরে বিরক্তি দেখিয়ে বলল,
“কাজের কথাগুলো এত দেরিতে বলো কেন মা?ভাল্লাগেনা।
ধীর হনহন করে রুমে ঢুকল।মেহবুব সেলিনা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।সেলিনা বুঝতে না পেরে বললেন
” তোমার বড় ছেলে এমন কেন করছে?কোন কাজের কথা দেরি করলাম বলতে?
মেহবুব পায়ের জুতো খুলতে খুলতে বললেন
‘দেখো কোনও গার্লফ্রেন্ডের রাগ তোমার ওপর ঝেড়ে দিলো কিনা!
‘সেটা হলে তো খুশিই হতাম.কিন্তু ওর আবার গার্লফ্রেন্ড?নিশ্চয়ই ম্যাচ ক্যান্সেল হওয়ার শোকে স্তব্ধ।
_____
ডাকছিলে আমাকে?
মিশরা তাকালো।দরজায় দাঁড়ানো পূর্নতাকে দেখে চোখ আটকাল তার।পূর্ণতার পড়নে সাদা জর্জেটের থ্রি পিস।
মিশরা মনে মনে আওড়াল ‘ আর যাই হোক,মেয়েটা সুন্দরী।কিন্তু আমার থেকে কম।
মুখে বলল,
‘এটা কি জামা পরেছিস তুই?কেমন লাগছে দেখতে!
পূর্ণতা নিজের আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘ভালো লাগছেনা?পালটে ফেলব?
‘ফেলিস।এখন এদিকে আয়।
পূর্ণতা ভেতরে এসে দাঁড়াল।ঘরের চারপাশে তাকাল।সায়রা প্রতিদিন গুছিয়ে দেন মিশরার রুম।আবার অগোছালো করে মিশরা।এই যে এখন,সব কেমন ছড়ানো ছেটানো।এই কামড়ায় এত বড় একটা মেয়ে থাকে কে বলবে।বারান্দার গাছগুলো শুকিয়ে মরে গেছে।ঠিকঠাক পানি দেয়া হয়না।পূর্ণতার ওদের জন্যে মায়া হলো।এরুমে তার আসার অনুমতি থাকলে ঠিক এসে নিয়ম করে গাছগুলোয় পানি ঢালতো।
ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?তোকে কী আমার ঘর দেখতে ডেকেছি?
পূর্ণতা চমকে উঠলো মিসরার কর্কশ আওয়াজে।মিহি কন্ঠে শুধালো ‘ তাহলে?
‘এখান থেকে একটা জামা বেছে দে আমায়।
পূর্ণতা অবাক চোখে তাকালো।অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
‘আমি?
আমি তোমাকে ড্র্বেস বেছে দেব?
‘নয়ত কী?তোর চেহারা দেখতে ডেকেছি?
পূর্ণতা মনে মনে ভীষণ খুশি হলো।অন্তত একটা কাজে তো লাগল মিশরার।এভাবে কোনও একদিন মিশরার সাথে ভাবটাও হয়ে যাবে হয়ত।
পূর্ণতা গুটিগুটি পায়ে এসে বিছানা ঘেঁষে দাঁড়াল।
অনেক বেছে একটা মেরুন ফুল হাতা টপ্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা দেখতে পারো।
মিশরা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল।
“এটাতে ভালো লাগবে আমাকে?
“তুমিতো এমনিতেই সুন্দর।তাই সব কিছুতেই তোমাকে মানাবে।
মিশরার ঠোঁটে হাসি ফুটল প্রসংশা শুনে।
‘আচ্ছা এটা পরব তাহলে। তুই এক কাজ কর,আমার জামাগুলো গুছিয়ে আলমারিতে রেখে দে।
পূর্ণতা মাথা কাঁত করলো।গোছানোর জন্যে হাত দিতে যাবে বাইরে থেকে আশরাফ ডেকে উঠলেন,
‘পূর্নতা!
মিশরা ব্যাস্ত কন্ঠে বলল ‘ বাবা ডাকছেন। তুই যা। গোছাতে হবেনা।
পূর্ণতা বলল ‘ আমিতো কাজ করছি।তুমি যাও।
মিশরা চোখ বড় করে বলল ‘ আমি যাব?
‘হ্যা।আমরা দুজনেইতো বাবার মেয়ে।আমি যেতে না পারলে তুমিই তো যাবে।আমি বরং জামাগুলো ভাঁজ করি।যাও তুমি।
মিশরা খানিকক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল।ওদিকে আশরাফ ডাকছেন।পূর্নতা কাপড় গোছাতে ব্যাস্ততা দেখাচ্ছে।মিশরা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে ঘর থেকে বের হয়ে আশরাফের কাছে গেল।দরজায় দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে বলল,
‘পূর্ণতা ব্যাস্ত আছে।
আশরাফ তাকালেন।মিশরাকে দেখে বললেন,
‘ও আচ্ছা।
তখনও কিছু খুঁজছেন তিনি।মিশরা জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে ইতস্তত করে বলল,
‘কিছু লাগলে আমাকে বলতে পারো।
আশরাফের খুঁজতে থাকা হাতটা থেমে গেল।বিস্মিত হয়ে পেছন ফিরে তাকালেন।বাবা তাকাতেই মিশরা চোখ নামিয়ে বলল,
‘না মানে __
আশরাফ মুচকি হেসে বললেন ‘ চশমার বক্স টা খুঁজছিলাম।সকালে বের করে এখানেই রেখেছিলাম।এখন পাচ্ছিনা।তুমি কি ওটা খুঁজে দেবে আমায়?
মিশরা ভেতরে এলো ঘরের।পরপর হাত লাগালো বাবার চশমার বাক্স খুঁজতে।আশরাফ ততক্ষন স্থির চোখে চেয়ে রইলেন ওর দিকে।এক সময় চোখ ভিজে উঠল।মিশরা ততক্ষনে খুঁজে পেয়েছে ওটা।খাটের এক কোনায় পরেছিল।মিশরা হাতে তুলে আশরাফের দিক ফিরতেই দেখল আশরাফ জল মুছছেন চোখের।মিশরা থমকালো।প্রথম বার ভীষণ কোমল কন্ঠে বলল,
‘কাঁদছো কেন?
আশরাফ মিথ্যে বললেন ‘ চোখে কি যেন পরেছে।কাঁদব কেন?
মিশরা ছোট করে বলল ‘ও।
নাও পেয়েছি।
আশরাফ ছোট বাক্সটাকে ধরতেই মিশরা ঘর ছেড়ে বের হয়।যেতে যেতে আবার ফিরে তাকায়।আশরাফ চেয়ে ছিলেন তখনও। মিশরা মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘পরেরবার কিছু খুঁজে না পেলে আমাকে বলবে।আমাকেই বলবে।
আশরাফ মাথা নাড়লেন।মিশরা চলে যেতেই বুক ভরে শ্বাস টানলেন।মেয়েটা বাবাকে ভালোবাসে,অথচ বাবার ভালোবাসাটা বোঝেনা।
____
আবারো সেই উৎকট ডোরবেলের শব্দ।ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো ধীরের।নাক মুখ কুঁচকে নড়েচড়ে উঠল।শুয়ে থেকেই দেয়াল ঘড়িতে চোখ বোলালো।পাঁচটা দশ বাযে।বিকেল তার মানে।অপেক্ষা করতে করতে এতক্ষন ঘুমালো?
ওদিকে বেল বাজছে।ধীর গাঁট হয়ে শুয়ে রইল।
না, এবার সে যাবেনা।পরপর দুই বার বিরাট ছ্যাকা খেয়েছে। এবার সে যাবেনা।কিছুতেই না।না মানে না।
পরমুহুর্তে ভাবল,
বাবা, ধ্রুব সবাই বাড়িতে।বাইরেতো আর কেউ নেই।
তার মানে এটা__
ব্যাস! এই নিয়ে তিনবারের মত দরজা খুলতে ছুট লাগালো ধীর।তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে দরজা টেনে খুলল।ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটিকে পা থেকে মাথা অব্দি দেখল।মেয়েটি চেনার ভঙিতে বলল
” ধীর ভাইয়া?রাইট?
চলবে।
চলবে