#ফাগুন_ এলো_ বুঝি,২৩,২৪
(২৩)
কিছুদিন কেটেছে তারপর।মন-মেজাজ ভালো না থাকায় পূর্ণতা ভার্সিটি যায়নি।এই কদিনের এমন কোনও মুহুর্ত ছিলনা,পূর্ণতা ধ্রুবর নম্বরে ডায়াল করেনি।আগে ধ্রুব রিসিভ করতোনা কিন্তু এখন ধ্রুবর নম্বরটাই ব্যস্ত পাচ্ছে পূর্ণতা।তার বুঝতে বাকি নেই,ধ্রুব তাকে ব্লক করেছে।প্রথমে কষ্ট পেলেও পরমুহূর্তে নিজে নিজেই হাসল পূর্ণতা,
‘যে মানুষটা তাকে জীবন থেকেই বাতিল করে দিচ্ছে,ফোন আর এমন কী!
আজ তিনদিন পর ভার্সিটির গেইটে পা রাখল পূর্ণতা।আর প্রথমেই মুখোমুখি হলো ধ্রুবর।ধ্রুব আর তার বন্ধুরা বসেছিল মাঠে।পূর্নতাকে দেখতেই ধ্রুব মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।পূর্ণতা আর কথা বাড়ালনা।ক্লাসের সময় হয়েছে।যা বলার,ক্লাশ শেষেই বলবে।আজকে জানতেই হবে,ধ্রুব সত্যিই কী চায়!
এক ঘন্টা পর ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশ শেষ হলো।সবাই বের হলো।পূর্ণতা রুপকেও বলল বাড়ি যেতে।রুপ আর রিদের সম্পর্ক এখন ভিন্ন।তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে ভালোবাসা।কিন্তু পূর্ণতার উদাস,বিষন্ন মুখমন্ডল দেখে নিজের খুশির কথা আর জানাতে পারেনি রুপ।রিদের থেকে শুনেছে পূর্ণতার বিয়ে হচ্ছে।তাও ধ্রুবর বড় ভাইয়ের সঙ্গে।কেন?কী কারন,এসব রুপ জানেনা।জানতে চাইলেও রিদ বলেনি।পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করবে তার উপায় ও নেই।মেয়েটার মুখচোখের অবস্থা ভালো নয়।রুপের মায়া হয় পূর্ণতার জন্যে।ছোট থেকে সৎ মায়ের অত্যাচারে বড় হলো।প্রথমবার একজনকে ভালবাসল সেও কী ঠকাচ্ছে?নাকি অন্য কোনো কারন লুকিয়ে এখানে?
রুপ পূর্ণতার অস্থিরতা দেখেই বুঝলো ও হয়ত ধ্রুবকে খুঁজছে।তাই আর কথা বাড়ালনা।শুধু কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সাবধানে যাস!
পূর্ণতা সারা ভার্সিটি খুঁজে ধ্রুবকে পেলনা।অন্তত যেখানে যেখানে ধ্রুবকে আড্ডা দিতে দেখেছে সেখানেও না।হয়রান পূর্ণতা সবশেষে পেল রিদকে।রিদ তখন কতগুলো ছেলের সঙ্গে শলা -পরামর্শে ব্যাস্ত।এত্তগুলো ছেলের সামনে গিয়ে রিদকে কিছু জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি হচ্ছে পূর্ণতার।কিন্তু উপায়ও নেই।ধ্রুবকে শেষ বার রিদের সঙ্গেই দেখেছিল।পূর্ণতা ইতস্তত কাটিয়ে ডেকে উঠল নরম গলায়,
” রিদ ভাইয়া!
রিদ পেছন ফিরে তাকাল।পূর্ণতাকে দেখেই কোঁচকানো ভ্রু শিথিল হলো।বাকিদের দিক চেয়ে বলল,
‘দাঁড়া।আসছি।
রিদ হাসিমুখে এগিয়ে এল।কাছে এসে পূর্ণতার চেহারার অবস্থা দেখতেই হাসিটা মিলিয়ে গেল আবার।অল্পদিনেই চোখ ডেবে কালি পরেছে।ফর্সা মুখে সেই কালো রঙ আরো বেশি দৃশ্যমান।রিদের ভীষণ মায়া হলো।ইচ্ছে করল সব বলে দিই।ধ্রুবর বন্ধুত্বের দোহাই দেয়া বিধায় পারলনা। খুব কষ্টে হাসিটা ঠোঁটে ধরে রেখে শুধাল,
‘কেমন আছো পূর্ণতা?
নিজের প্রশ্ন নিজের কাছেই অবান্তর ঠেকল রিদের।মেয়েটা কেমন আছে, কেমন থাকতে পারে, তার কী আন্দাজে নেই?তাহলে কেন জিজ্ঞেস করল?পূর্ণতা ছোট করে বলল,
“ভালো।
রিদ তাকিয়ে।পূর্ণতা একটু চুপ থেকে বলল
” ধ্রুব কে দেখেছেন?
রিদ আশেপাশে দেখতে দেখতে বলল,
‘অনেকক্ষন ধরেই দেখিনি।এখানেই তো থাকার কথা।বাড়ি চলে গিয়েছে হয়ত।
‘অনেক খুঁজেছি, পাইনি।
রিদের খুঁজতে থাকা চোখদুটো স্থির হলো পূর্ণতার মুখের ওপর।পূর্ণতার এইটুকুন কথায় সহস্র দুঃখ ঝরে পরল যেন।ঝরে পরল ধ্রুবর প্রতি ওর সমস্ত ব্যাকুলতা।
এর মধ্যে সাকিব এসে রিদের পাশে দাঁড়াল।পূর্ণতাকে বলল,
‘ধ্রুবকে ভার্সিটির পেছন দিকে পাবে।
পূর্ণতাএ নিভে যাওয়া মুখশ্রী দপ করে জ্বলে উঠল খুশিতে।সাকিবকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে গেল সে।পূর্ণতা যেতেই রিদ কটমট করে সাকিবের দিক তাকাল।
” আগ বাড়িয়ে কেন বলতে গেলি? তোর কাছে জানতে চেয়েছিলো?আমিওতো জানতাম ধ্রুব কোথায়।মেয়েটাকে বলিনি,কারন চাইনি ও দুঃখ পাক।তুই এসে মধ্যিখানে,তোকে কেউ বলতে বলেছে?দিলিতো__
“ধ্রুব বলেছে।
রিদের কথা থেমে যায়।অবাক কন্ঠে বলল,
‘কী?
‘হ্যা।পূর্ণতা ওর কথা জিজ্ঞেস করবে ও জানত।আর তুই বলবিনা তাও জানত।তাই আমাদের বলে গেছে।
রিদ বিরক্তির শীষ টানল।মেজাজ খারাপ হল খুব।
“ধ্রুব যে কি চাইছে কে জানে?সম্পর্কটা ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
___
ভার্সিটির পেছন দিক বরাবর নির্জন।পূর্ণতা লোক সমাগম পেছনে ফেলে যত এগোচ্ছে,ততবার মনে প্রশ্ন জাগছে ‘ধ্রুবর এখানে কী কাজ?
পূর্নতা চারপাশ দেখতে দেখতে হাটছে।হঠাৎ সামনে তাকাতেই থমকে গেল।ভারি বজ্রপাত যেন আছড়ে পরল মাথায়।
সাদা রঙের বেঞ্চে বসে আছে ধ্রুব।গা ঘেঁষে বসেছে নোরা।মাথাটা ধ্রুবর কাঁধে।আর ধ্রুবর এক হাত পিঠ ছাড়িয়ে নোরার কাঁধে রাখা।কখনও উঠছে চুলে।বিলি কাটছে।দুজনের চলছে গভীর আলাপ।শুধু ঠোঁট নাড়তে দেখছে পূর্ণতা।শুনতে পাচ্ছেনা।
পারলেও হয়ত শুনতোনা।এই মুহুর্তে জাগতিক সব কিছু কেমন ধোয়াসা লাগছে তার।স্তব্ধ হয়ে পূর্ণতা চেয়ে রইল ধ্রুবর দিকে।চোখ ভিজে জলের পুকুর হলো।ধ্রুব অন্যহাতে নোরার হাত মুঠোয় তুলে ওর আঙুল ধরছে।নরম,যত্নের সে স্পর্শ।পূর্ণতার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করল।রক্রশূন্য চেহারায় নাকের ডগা লাল হলো। মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে লাগাল পূর্ণতা।একপ্রকার পালিয়ে এল এই দৃশ্য হতে।
পূর্ণতা চলে গেছে।ধ্রুব ঠিক টের পেল না দেখেই।সঙ্গে সঙ্গে নোরার থেকে দূরে সরে গেল।বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।কিছুক্ষন থম ধরে থেকে হুঠাৎ দুই হাটুমুড়ে বসে পরল মাটিতে।নোরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেল।চাইল ধ্রুবকে শান্ত করতে।কিছু বলবে এর আগেই ধ্রুব ডুকরে কেঁদে উঠল।বোজা কন্ঠে আওড়াল,
আ’ম স্যরি মায়াপরী! আ’ম স্যরি! ঘৃনা কর আমায়, ঘৃনা কর।যত্ত বেশি পারো ঘৃনা কর।
নোরার চোখ চিকচিক করছে, ধ্রুব’র যন্ত্রনা দেখে।এই ভালোবাসার এক বিন্দু যদি ওকে দিত!দুনিয়ার সব থেকে সৌভাগ্যবতী মনে হতো নিজেকে।নোরা ধ্রুবর কাঁধের ওপর হাত রাখল।ধ্রুব তাকালনা।তবে চুপ করে গেল।নোরা বলল,
“মেয়েটাকে এতোটা ভালোবেসেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছো ধ্রুব?সত্যিই আমার নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে,আমিই তোমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্টের কারণ হলাম আজ।
ধ্রুব হাসল।পেছনে থাকায় নোরা ওর দুর্বোধ্য হাসিটা দেখলনা।
“,তুমিতো একজন অভিনেত্রি মাত্র নোরা।যা বলেছি তাই করেছ।উলটে আমার উপকার করেছ তুমি।এখানে তোমার কোনও দোষ নেই।নিজেকে ছোট ভেবনা।পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।এই উপকারের জন্যে সারাজীবন ঋনী থাকব আমি।
‘কিন্তু ধ্রুব পূ___
“প্লিজ নোরা,আমি একটু একা থাকতে চাইছি।উইল ইউ
—
ধ্রুবর বরফ স্বর।নোরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ধ্রুবকে রেখেই পা বাড়াল।তীব্র আফসোস হলো ভেবে,
‘কেউ তোমার ভালবাসা খুব করে চায়,
আর কেউ পেয়েও হারায় ধ্রুব।
ভাগ্যিশ!তুমি আমাকে ভালোবাসোনি।তোমার ভালোবাসা পেয়ে হারালে আমি হয়ত মরেই যেতাম।তার থেকে আমার এক তরফা ভালোবাসা ঢেড় ভালো ধ্রুব।সেদিক থেকে পূর্ণতার দুঃখের কাছে আমার দুঃখ কিচ্ছুনা।
____
চারদিন পর,ধীর আর পূর্ণতার আংটিবদলের আনুষ্ঠানিক পর্ব আজ।সারাবাড়ি জুড়ে আয়োজন।জমকালো আলোয় ভর্তি পুরো ঘর।সবাই মেতেছে পূর্ণতা আর ধীরের এক হওয়ার আনন্দে।অথচ দুটো মানুষের মনে এত আলোতেও অন্ধকার।
সাদা স্টোনভর্তি একটা ভারি লেহেঙ্গা পরেছে পূর্ণতা।পরানো হয়েছে তাকে।ধীর নিজে সমস্ত বিয়ের শপিংয়ে উপস্থিত থেকে থেকে কিনেছে।পূর্ণতা একেক দিন একেক অজুহাত দিয়ে যায়নি।আশরাফ মেয়ের ওপর জোর করেননা কখনও।তাই এবারেও নড়চড় হলোনা।
পার্লার থেকে দুজন লোক এসে সাজিয়েছে পূর্নতাকে।ভারি মেক-আপ আর অর্নামেন্টসে গা ভরে গেছে।অথচ হাসি নেই এক ফোঁটাও।মলিন মুখটা তখনও মলিন।
আংটিবদলের আয়োজন হয়েছে ধীরদের বাড়িতে।পূর্ণতাকে সাজিয়ে গুছিয়ে গাড়ি করে হাজির হলো সকলে।চারটে লোকইতো।পূর্ণতা দরজা দিয়ে ঢুকলেই ফুলের পাপড়ি ওর ওপর ছেটানো হয়।পূর্ণতার কোনওরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়না।জড় জীবের ন্যায় ধীর পায়ে এগোয় সে।
ধীর, ধ্রুব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।স্টেজের ওপর।সামনে ফটোগ্রাফার ক্লিক দিচ্ছে ক্যামেরায়।বন্দি হচ্ছে দুইভাইয়ের মুখ।
পূর্ণতারা আসতেই হৈচৈ বেধে গেল বাড়িটায়।আনন্দে,উল্লাসে।ধীরের চাউনি অবিচল হয়ে পরল।চোখই সরছেনা পূর্ণতার থেকে।কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে তার পূর্নাকে!ধীরের পড়নে সাদার ওপর সোনালি সুতোর কাজ করা শেরওয়ানি।পূর্ণতার লেহেঙ্গার সঙ্গেই মিলিয়ে কেনা।
পূর্ণতার ফ্যাকাশে চোখমুখ দেখে ধ্রুবর বুক মোচড় দিয়ে উঠল।পাশাপাশি জ্বলে উঠল চোখদুটোও।ঘুরে গিয়ে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছল ধ্রুব। ফিরে তাকাল হাসি মুখে।
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন?বউকে নিয়ে আয়, যা।
ধীর কে ঠেলে দিল ধ্রুব।ধীর চওড়া হেসে পূর্ণতার দিকে এগোলো।মুচকি হেসে হাত বাড়ালো পূর্ণতার সামনে। পূর্ণতা ধ্রুবর দিক তাকাল।তীরের বেগে একটা সূক্ষ্ণ ব্যাথা বুকে এসে বিঁধল ধ্রুবর পড়নের পাঞ্জাবিটা দেখে।ধ্রুবর জন্মদিনে পূর্ণতার দেয়া সেই পাঞ্জাবি আজ পরেছে ধ্রুব।পূর্ণতা কম্পমান দৃষ্টিতে চেয়েই থাকল ধ্রুবর দিকে।মানস্পটে জলের মত ভাসছে সেই দিন ধ্রুবর করা দুষ্টুমি।পূর্ণতার একটা চুঁমু পেতে কী না কী করল!
আজ এই পাঞ্জাবিটা কেন পরল ধ্রুব?কষ্টের পরিমান কি কম ছিল?ছিলনা।ধ্রুব আরো কয়েকগুনে বাড়িয়ে দিল এখন।ধ্রুবর দিক চেয়েই মুখ কঠিন করে ধীরের হাতে হাত রাখল পূর্নতা।ধীর শক্ত করে আকড়ে ধরল ওর হাত।ধ্রুব চোখ বুজে ঢোক গিলে তাকিয়ে হাসল।বোঝাল তার ভ্রুক্ষেপ নেই এসবে।একদম নেই।
ধীর পূর্ণতাকে নিয়ে স্টেজে উঠল।ধ্রুব নেমে গেল।ওরা দুজন পাশাপাশি বসল।পূর্ণতার হাত ছাড়ার নাম নেই ধীরের।পূর্ণতাও ছাড়ালনা।
“হাত আকড়ে থাকলে কি আর মন আকড়ে থাকা যায়??
ধ্রুব নেমে এসে ফটোগ্রাফার এর কাছে ক্যামেরা চাইল।
তিনি দিতেই নিজেই গলায় ঝোলাল সেটা।লেন্সে চোখ বসিয়ে ধীর আর পূর্ণতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘স্মাইল!
পূর্ণতাতো তাকিয়েই ছিল।এখন শুধু ধীর তাকাল।প্রসস্থ হাসল সে।ধ্রুবর ওপর রাগ, অভিমান, ক্ষোভ মিলিয়ে পূর্ণতা দাঁত পিষে ধরল।দুজনের দুই অভিব্যাক্তিতেই ধ্রুব ছবি ওঠাল।
___
আমার ছেলেটাকে এতো খুশি আমি আগে কখনও দেখিনি সায়রা।
ধীরের চকচকে মুখ দেখে বললেন সেলিনা।সায়রা মৃদূ হাসলেন।মনে মনে বললেন,
আমিও দেখিনি ভাবি।ছোট থেকে অনেক মারধর করেছি পূর্ণতাকে।অথচ আজকের মত এতটা মলিন, এতটা নিষ্প্রাণ আগে কখনও দেখিনি ওকে।
সায়রা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
পূর্ণতার সাথে বারবার কথা বলেও কিছু জানতে পারলেন না।কেন যেন মনে হচ্ছে পূর্ণতা চাইছেনা এই বিয়ে হোক।সেই ওকে আংটি পড়াতে যাওয়ার দিন থেকে লক্ষ্য করেছেন,পূর্ণতা বারবার ধ্রুবর দিক তাকায়।আকুল থাকে ওর দৃষ্টি।সায়রার দৃঢ় বিশ্বাস,পূর্ণতা ধীরকে নয়,ধ্রুবকে ভালোবাসে।সায়রা সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আচ্ছা ভাবি,ধ্রুবর জন্যে মেয়ে টেয়ে দেখছো?
সেলিনা ভ্রু কপালে তুলে বললেন,
‘এখনি?পড়াশোনাই তো শেষ হলোনা।আগে ধীরের বিয়ে হোক।তারপর ধ্রুব কাউকে পছন্দ করে কীনা জেনে নেব।
সায়রা কিছু বলবেন এর মধ্যে সায়রার বড় বোন রাফিজা খাতুন এসে দাঁড়ালেন সেখানে।সায়রা এসব নিয়ে আর কথা তুললেননা।বোনের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে যোগ দিলেন।
ধীরের সমস্ত আত্মীয় -স্বজন স্টেজে উঠে উঠে পূর্নতার সাথে আলাপ করছে।এদের খুব ছোট বেলায় পূর্ণতা দেখেছে,কাউকে আবার দেখছে প্রথম। সবাই ওদের সঙ্গে ছবি তুলে নেমেও যাচ্ছে আবার।পূর্ণতাদের নিজেদের আত্মীয় বলতে ওর ছোট চাচার পরিবার।তারাও এসেছেন আজ।একটা মানুষের ও কমতি নেই।কমতি শুধু পূর্ণতার হাসির,আনন্দের।
ধীরের চাচাতো ভাইয়ের বউ একটা ট্রেতে দুটো লাল বক্স নিয়ে স্টেজে উঠল।ট্রের ওপর আবার লাল চিকমিকি কাপড় বিছানো।আমুদে কন্ঠে বলল,
‘নিন,দুজন দুজনকে আংটি পড়িয়ে দিন।
পূর্ণতার সোফার হাতল ঘেঁষে দাঁড়াল রুপ।পূর্ণতার দিক তাকাল অসহায় চোখে।এরপর দেখল দূরে দাঁড়ানো ধ্রুবকে। রুপের প্রচন্ড রাগ হলো ধ্রুবর প্রতি।কী সুন্দর গল্প করছে বন্ধুদের সঙ্গে।যদি এমনটাই করবে তাহলে পূর্ণতাকে ভালোবাসতে এলো কেন?রুপের ভয় হতে লাগল,রিদ আবার এমন করবেনাতো?এখনো মুখে বলেনি রিদকে ভালোবাসার কথা।যায়নি কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে।প্রতিরাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনালাপ,ঘুরতে যাওয়া,দেখা করা আর মনে মনে তীব্র অনুভূতির আঁচেই তাদের না বলা সম্পর্ক জমেছে।রিদ ও হাত ছেড়ে যাবেনাতো?রুপ অস্থির চোখে রিদকে খুঁজল।পেল সিড়ির গোড়ায় দাঁড়ানো।মুখ থমথমে।
রিদ মূলত রেগে আগুন হয়ে আছে ধ্রুবর ওপর। এই প্রোগ্রামেও নোরাকে ইনভাইট করার কী দরকার ছিল?পূর্ণতাকে কী একটুও শান্তি দেবেনা এই ছেলে?অসহ্য!
পূর্ণতার বাম হাতে সেদিন একটা স্বর্নের আংটি পরিয়েছিল ধীর।আজ কথাছিল ওটা খুলে হীরেরটা পড়াবে।অথচ দেখল পূর্ণতার আঙুল ফাঁকা।ধীরের হাসি নিভে গেল।ভরা বাড়িতে টু শব্দ করলনা এ নিয়ে।নিজে আংটি পরিয়ে পূর্ণতার দিক হাত বাড়াল ধীর।
ধ্রুব এক ধ্যানে স্টেজের দিক তাকিয়ে রইল যখন,নোরা এসে পাশে দাঁড়ায়।পূর্ণতা যেই মাত্র তাকাল ধ্রুব নোরার আঙুলে নিজের আঙুল বন্দী করল।এটা দেখে পূর্ণতা
ঠোট কামড়ে কান্না চেপে ধীরের আঙুলে পরিয়ে দিল আংটি।সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো করোতালির বর্ষন।ধ্রুব ছেড়ে দিল নোরার হাত।
চোখে পানি আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে তালি বাজাল সেও।
“ভেতর টা যে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে মায়াপরী!সামান্য একটা আংটি আজ তোমাকে আমার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেল।ঘোষণা হল তুমি আর আমার নেই।
চলবে..
#ফাগুন_এলো_বুঝি!
(২৪)
স্বপ্নের বালুকায়,কেউ কি পা লুকায়?
যদি না আসে, ভেজা দিন।
ইচ্ছের হিমালয়,হয়না কভু ক্ষয়।
হৃদয়ে থাকে, অমলিন।
কিছু স্বপ্ন কিছু ইচ্ছে,এই আমায় টেনে নিচ্ছে,তোমার কাছে বারেবার……
“কেউ না জানুক তুমিতো জানো তুমি আমার।
কেউ না জানুক আমিতো জানি আমি তোমার।”
সব লেনা-দেনার, হয়না কভু শেষ।
আজীবন কারো কারো থেকে যায় রেশ।
ভালোবাসা ফুরায়না,
প্রেম কভু হারায়না।
অনুভবে থাকে যার যার।
“কেউ না জানুক তুমিতো জানো তুমি আমার
কেউ না জানুক আমিতো জানি আমি তোমার”
চোখ বুজে গলা ছেড়ে গান গাইছে ধ্রুব।মনোমুগ্ধকর তার সুর ছড়িয়ে পরছে চারপাশে।নিস্তব্ধতায় ধ্রুবর ভরাট কন্ঠ বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে।গভীর মনোযোগে শুনছে সকলে তার গান।
পূর্ণতার বিষন্ন মুখে আরো অন্ধকার নেমে এল।ধ্রুবর এই গানের কী অর্থ?কেনই বা এরকম একটা গান এই সময় গাইলো ধ্রুব?কাকেই বা উদ্দেশ্য করল ও?
গান শেষ করে ধ্রুব থামল।লম্বা করে শ্বাস ফেলল।সকলের তালির শব্দে চোখ মেলে তাকাল।সবার প্রথমে দেখল স্টেজে বসা তার মায়াপরিকে।মেয়েটা কি অসহায় চোখে চেয়ে আছে!সেকেন্ডের কম সময়ে ধ্রুব ফিরিয়ে আনল সেই দৃষ্টি।
মিশরা এগিয়ে গেল,ভ্রু কুঁচকে বলল
“গান তো সুন্দর। কিন্তু ধ্রুব ভাইয়া,এমন আনন্দের সময় তুমি এমন ঠান্ডা একটা গান কেন করলে?পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেলো দেখলে!
ধ্রুব মৃদূ হেসে বলল,
“হঠাৎ গাইতে বললি, তাই মাথায় যা এল গেয়েছি।
মিশরা হাত নাড়িয়ে বলল,
“কোনও ব্যাপার নয়।এক্ষনি সব ঠিক করে দিচ্ছি।
ধীরের দিক ফিরে বলল
” ধীর ভাইয়া!তোমাদের দুজনের একটা কাপল ডান্স হয়ে যাক?
পূর্ণতা আর ধ্রুবর মুখ শুকিয়ে এল আরো।উৎফুল্ল মনে উঠে দাঁড়াল ধীর।
‘অবশ্যই।
‘এসো তাহলে।
এবারে আপত্তি করে বসল পূর্ণতা।জোড়াল আওয়াজে বলল,
‘আমি নাঁচবনা।
ধীর কপাল কোঁচকায় ‘ কেন?
পূর্ণতা কি বলবে খুঁজে পেলনা।ধীরের গায়ে গা লাগিয়ে নাঁচার কোনো ইচ্ছে তার নেই।ঠোঁট জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে উত্তর ভাবতে বসল।ধীর ফের শুধাল,
‘কিছু হয়েছে পূর্না?নাঁঁচবিনা কেন?
তখনি সায়রা এগিয়ে এসে বললেন,
‘কীভাবে নাঁচবে বলতো ধীর!এত্ত ভারী একটা ড্রেস পরেছে।স্বাস্থ্যতো ওই।ওতো নড়তে চড়তেই পারবেনা।
ধীরের মন খারাপ হলেও মেনে নিল।যুক্তি মিথ্যে নয়।মাথা নেড়ে বলল,
” বেশ ঠিক আছে। দরকার নেই।আমি বরং অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করতে বলছি।পূর্না চেঞ্জ করে একটু রিলাক্স হোক।
পূর্ণতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল সায়রার দিকে।সায়রা মুচকি হেসে বললেন,
” সেই ভালো।
মিশরা ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করল মুখ দিয়ে।একটু শয়তানি বুদ্ধি এসেছিল মাথায়।ভাবল পূর্ণতা আর ধীর নাঁঁচতে আসবে আর সেই ফাঁকে পায়ে বাধিয়ে ফেলে দেবে ওকে।এতগুলো লোকের মধ্যে বাড়ির হবু বউ পরলে কী কেলেঙ্কারি হবে!পূর্ণতার মান ইজ্জ্বত ধুয়ে যেত।ধুর!সব প্ল্যান জলে গেল,তাও তার মায়ের জন্য। মিশরা জিজ্ঞাসু চোখে সায়রার দিক চেয়ে ভাবল,
‘এই মায়ের আজকাল হয়েছে কী?যখনই দেখছি পূর্ণতাকে আহ্লাদ করছে।শাকচূন্নি কী আমার মাকেও বশ করে ফেলছে?
অনুষ্ঠান শেষ হলো সেদিন।পরপর অনুষ্ঠান।গায়ে হলুদ কাল । আর তারপর দিন সন্ধ্যায় বিয়ে।মেহবুব,আশরাফ কেউই কনভেনশন হলে অনুষ্ঠান পছন্দ করেন না।যেখানে তার এত বড় বাড়ি আছে,হলে যাবেন কোন দুঃখে?নিজেদের বাড়িতেই হচ্ছে যত আয়োজন।পূর্ণতারা ফিরে এল বাড়ি।কাল সকাল হলেই শুরু হবে বিয়ের তোড়জোড়।পূর্নতার মনে হচ্ছে কাল বিয়ে নয়,কাল হবে তার ভালোবাসা,আর বিশ্বাসের কোরবানি।
___
হু হু করে বাতাস বইছে বাইরে।মনে হচ্ছে ঝড় হবে এক্ষুনি।সুপ্ত ঝড় যেমন অবিচল বইছে পূর্ণতার বক্ষে।পূর্ণতার ভেতরে।জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে ভোরের শান্ত শহর দেখছে পূর্ণতা।ঠিকঠাক আলোও ফোটেনি এখনও।অথচ সারাবাড়ি জুড়ে হল্লাহল্লি।পূর্নতার প্রানহীন,ভেজা, ঝাপ্সা দৃষ্টি। তবু সে নিষ্পলক তাকিয়ে।
কিছু পুরোনো অতীত চোখের সামনে ভাসছে।সেবার ছাদে ধ্রুব তার পায়ে নুপুর পরিয়ে দিয়েছিল।গভীর রাতে তাকে ছাদে নিতে কত মিথ্যেই না বলল!ভয়ও দেখাল।সেদিনইতো পূর্ণতা প্রথম অনুভব করল,ধ্রুবকে ভালোবেসে ফেলেছে।কুয়াশার মত অনুভূতি গাঢ় হয়ে ঐদিন ধরা দিল তাকে।পূর্ণতা সালোয়ারের অংশটা পা থেকে একটু ওপরে তুলে রুপার নূপুর জোড়া দেখল।ধ্রুব বলেছিলনা,
‘এই নূপুর পরে হাটলেই সে বুঝবে পূর্ণতার আগমন?আজকের পর থেকে ধ্রুবদের সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াবে পূর্ণতা।ধ্রুব তখন কী অনুভব করবে? তার মায়াপরি আসছে,নাকি ভাইয়ের বউ?
পূর্ণতার চোখ বেয়ে জল গড়াল।হাওয়ার তোপে অগোছালো লম্বা চুল উড়ে উড়ে মুখে এসে পরছে।কতক চোখের জলে ভিজে লেগে থাকছে গালের ওপর।এত শোকের মধ্যেও পূর্ণতা গুনগুন করে গেয়ে উঠল ধ্রুবর গতদিনের গানের অসমাপ্ত অংশটুকুন,
“সব জানা শোনার,লাগেনা পরিচয়।
দূর থেকে কারো কারো ছায়া কথা কয়।
ভালোবাসা ফুরায় না,
প্রেম কভু হারায় না,
অনুভবে থাকে যার যার।
কেউ না জানুক তুমিতো জানো তুমি আমার।
কেউ না জানুক আমিতো জানি আমি তোমার।
____
সবাই তৈরি হতে ব্যাস্ত।পূর্ণতাদের বাড়ি যাবে।ওখানেই গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে।যেভাবে সেন্টারে হতো,সেভাবেই হচ্ছে। তবে বাড়িতে।গ্রামীন উপায়ে হলে ছেলেমেয়ের আলাদা আলাদা হতো।কিন্তু ধীর আগেভাগেই বলে রেখেছিল পূর্ণতার সঙ্গেই তাকে যেন হলুদ দেয়া হয়।
সেলিনা সকাল থেকেই ধ্রুব কে ঘরের বাইরে দেখেননি।ইদানীং তার চঞ্চল ছেলেটা কেমন চুপচাপ থাকে।জিজ্ঞেস করা ছাড়া কোনো উত্তর নেই, কথা নেই।শান্ত,নিরিবিলি, ধ্রুব ছোট বেলায় থাকলেও বড় হয়ে অতিরিক্ত চঞ্চল হয়েছিল।হঠাৎ কী হলো কে জানে!
সেলিনা প্রায়সই টের পান ধ্রুব মাঝরাতে বারান্দায় বসে গান গায়।দুঃখের গান।যেন ছ্যাকা খেয়েছে।ঘরের আলো জ্বালায় খুব কম।পড়াশূনা করতেও তেমন দেখেননা।বেশিরভাগ থাকে বাড়ির বাইরে।ঘরে যতটুকুও বা থাকে খিল দেয় দরজার।খেতে বসলে চুপ করে খেয়ে উঠে যায়।এত ব্যস্ততায় ধ্রুবর দিকে একটু খেয়াল রাখতেও পারছেননা সেলিনা।আজ সকাল থেকে কাজ কম।যেহেতু আয়োজন ওই বাড়িতে।সেলিনা ঘুম থেকে উঠে মেহমানদের নাস্তা দিয়ে ধ্রুবর ঘরে খাবার নিয়ে চললেন।দরজায় টোকা দেয়ার সাথে সাথে ধ্রুব খুলে দিল।সেলিনা অবাক হয়ে বললেন,
‘তুই জেগে ছিলি?তাহলে খেতে গেলিনা যে।
ধ্রুবর কন্ঠ শান্ত,
‘তোমার কী সারাদিনে একটাই কাজ মা,আমাকে খেতে ডাকা?
তখন চোখ পরল মায়ের হাতের দিকে
‘ও খাবার সাথেই এনেছো আজ?
সেলিনা গাল ফোলালেন,
‘তো করব টা কী?আজকাল ডাকতে ডাকতে মুখ ব্যাথা বানালেও তোর দেখা পাওয়া যায়না।খিটখিটে হয়ে গেছিস কেমন।
ধ্রুব বলল,
‘ভেতরে আসবে?
সেলিনা মাথা নাড়লেন।এই ছেলের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।বললেন,
‘সর।
ধ্রুব সরে দাঁড়াল।সেলিনা
খাবার রাখতে ভেতরে ঢুকলেন।বিছানার ওপর ট্রলি ব্যাগ,আর ভেতরে জামাকাপড় দেখেই থেমে গেলেন।ভ্রু কুঁচকে শুধালেন,
‘ব্যাগ গোছাচ্ছিস কেন ধ্রুব?
ধ্রুব এগিয়ে এল।বিছানার ওপর রাখা শার্ট-প্যান্ট গুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল,
‘আমি চিটাগং যাচ্ছি মা।
সেলিনা ত্রস্ত হাতে খাবারের ট্রে রাখলেন টেবিলের ওপর। উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘চিটাগং যাচ্ছিস মানে?কেন?
‘কাজ আছে।
‘কী কাজ?
‘তোমাকে বলা যাবেনা।
সেলিনা উত্তেজিত হয়ে পরলেন,
‘কী এমন কাজ তোর? যে আমাকেও বলা যাবেনা?খুব বড় হয়ে গেছিস ধ্রুব?আজ তোর ভাইয়ের গায়ে হলুদ,কাল বিয়ে।আর তুই এখন যাবি ঢাকার বাইরে?এটাকি ফাজলামো হচ্ছে?
ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়াল।
‘ভাইয়ের বিয়ে, আমার নয়।আমি থাকা না থাকা সমান।
সকাল সকাল এত চেঁচিও না মা। শরীর খারাপ করবে।তাছাড়া বাড়ি ভর্তি মেহমান।কেউ শুনলে কী ভাববে?
‘বড় ভাইয়ের বিয়ে ছেড়ে ছোট ভাই চলে গেলে তখন কেউ বুঝি কিছু ভাববেনা?
‘কেউ জানবেইনা আমি নেই।আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব।সমস্যা নেই।
সেলিনা প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে বললেন,
‘এমন কী হলো হঠাৎ?তুই এরকম করছিস কেন?তুই কী রাগ করেছিস আমার ওপর?
ধ্রুব দুর্বোধ্য হাসল।ঠান্ডা গলায় বলল,
‘না মা।রাগ তো নিজের ওপর করছি।কারন আমিই যে অপরাধী!
সেলিনা বুঝলেন না।
‘কীসের অপরাধ?
‘ওসব তুমি বুঝবেনা।
ধ্রুব টেবিলের কাছে এসে প্লেট থেকে স্যান্ডউইচ তুলে মুখে দিল।গলা দিয়ে খাবার না নামলেও আজ খুব দ্রুত খেয়ে পানি খেল।মুখ মুছে তাকাল মায়ের দিক।সেলিনা এখনো তাকিয়ে আছেন।বুঝতে চাইছেন ছেলের মনের অবস্থা।
‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
সেলিনা চোখ চিকন করে বললেন,
“তার মানে তুই যাবিই?
‘হ্যা।
সেলিনা হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।এক্ষুনি মেহবুব আর ধীরকে গিয়ে জানাবেন।ধ্রুব কী করে যায়, দেখে ছাড়বেন তিনি।
____
লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরেছে পূর্ণতা।গা ভর্তি কাঁচা ফুলের গয়না।গোলাপ আর গাঁদা মেশানো।ধীর আর তার গায়ে হলুদ একসঙ্গে হবে।এই বাড়িতেই।পূর্ণতা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে বিছানায়।তাকে ঘিরে তার আত্মীয় স্বজনের ভিড়।আংটিবদলের দিন যারা আসেননি আজ তারাও এসছেন।কে আসছেন,কে যাচ্ছেন পূর্ণতার ওসবে মন নেই।তার মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই প্রশ্ন,
‘এখনও তুমি কিছুই করবেনা ধ্রুব?
কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়িতে হৈচৈ পরে গেল।ধীররা এসে গেছে।নির্জীব পূর্ণতাকে নিতে ঘরে ঢুকলেন সায়রা।পূর্ণতার দিক চেয়ে ভারি শ্বাস ফেললেন।একটা যদি উপায় পেত বিয়েটা আটকানোর!
” চল।অনুষ্ঠান শুরু হবে।
পূর্ণতা চোখ তুলে তাকাল।সায়রার বুক কেঁদে উঠল ওর চাউনিতে।খুব কষ্টে স্বাভাবিক রাখলেন নিজেকে।পূর্ণতা যেন শুনতেই পায়নি সায়রা কী বলেছে।তাকিয়ে রইল একভাবে।সায়রা ফের বললেন,
‘নেমে আয়।
পূর্ণতা আস্তেধীরে নামল বিছানা থেকে।সায়রা ওর হাত ধরে নিয়ে চললেন।পেছন পেছন অতিথি মেয়েগুলোও এল।সায়রা হাটার মধ্যেই চারপাশ চেয়ে চেয়ে মিসরাকে খুঁজছিলেন।এই মেয়ে কোথায় যে গেল!কাজের সময় যদি পাওয়া যায়।পূর্ণতাকে নিয়ে যাওয়ার কথা তো ওরই।তা না,নির্ঘাত কোথাও আড্ডা মারছে গিয়ে।একটু যদি শুধরায়!
পূর্ণতার চেহারায় একটা বউ বউ ভাব ফুটে উঠেছে।গায়ে হলুদের সাজে পূর্ণতাকে দেখে এটাই মনে হলো ধীরের।তার বউ পূর্ণা।আজ বাদে কাল বিয়ে তাদের। তারপর আর কেউ আলাদা করতে পারবেনা।কেউ আসবেনা মাঝখানে।
ধীরের পাশে বসানো হলো পূর্ণতাকে।ধীর যত্র কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মারাত্মক লাগছে!
পূর্ণতা স্থির হয়ে বসে রইল।কোনো উত্তর করলনা।মাথায় ঘুরছে পুরোনো কথা।ধ্রুবর কথা।ধ্রুব সব সময় এরকম ফিসফিস করে কথা বলতো।গায়ের লোম অব্দি দাঁড়িয়ে যেত পূর্নতার।সমগ্র রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইত শিহরনের স্নিগ্ধ বাতাস।ধীর আবার বলল,
” আমাকে কেমন লাগছে বললিনা!
পূর্ণতা অনিহা নিয়ে তাকাল।কিন্তু চোখ আটকে গেল সাথে সাথে।পাশে ধ্রুব বসে।পড়নে মেরুন শেরওয়ানি।ঠোঁট জুড়ে সেই পুরোনো হাসি।পূর্ণতার চেহারা ঝলমল করে উঠল।মুগ্ধ হয়ে আওড়াল,
‘একদম আমার স্বপ্নের রাজপূত্রের মত!
ধ্রুবর হাসিটা বিস্তৃত হলো।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“তাই?
‘হ্যা তা__
পূর্ণতার হাসিটা উবে গেল।খেয়াল পরল পাশে ধ্রুব নয় ধীর রয়েছে।চট করে চোখ ফিরিয়ে কোলে রাখা হাতদুটোর ওপর রাখল।শরীরটা কাঁপতে শুরু করেছে।একটু আগের কল্পনাটাই যদি সত্যি হতো!তখন সামনে থাকা ফটোগ্রাফার বললেন,
‘ম্যাম এদিকে তাকান।
পূর্ণতা তবুও তাকালনা।ধীর এগিয়ে এসে পূর্ণতার পিঠ ছড়িয়ে কাধে হাত রাখল।বলল,
‘তুলুন।
পূর্ণতা দাঁত চেপে বসে রইল।চোখ ফেটে অশ্রুদানা এসে পরল হাতের ওপর।ঠেলে সরাতে ইচ্ছে হলো ধীরকে।পারলনা।বসে রইল কলের পুতুলের মতন।
একটু পর পূর্নতার কাজিন এগিয়ে এল স্টেজের দিকে।
পূর্ণতার ফোন ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপু আপনার অনেকবার কল এসেছিল।
ধীর সাথে সাথে প্রশ্ন করল,
‘কে ফোন করেছে?
মেয়েটি বলল,
‘আনসেভ নম্বর।অনেকগুলো কল দেখে নিয়ে এলাম।
ধীর ফোন ধরতে গেলেই পূর্ণতা টান মেরে নিল।ধীরের দিকে রুষ্ট চোখে চেয়ে বলল,
‘এখনও তোমার বউ হইনি ধীর ভাইয়া।বিয়ের পর নাহয় খবরদারি কোরো?
ধীর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘না না আমিতো__
‘তুমি একটু সরে বসবে ভাইয়া?বড়রা আছে।আই ফিল আনকমফোর্টেবল।
ধীরের মুখ থমথমে হয়ে গেল।দুরুত্ব রেখে সরে বসল সে।পূর্ণতা ফোনের দিক তাকাল।হ্যা বারোটা মিসডকল উঠে আছে।কিন্তু এটা কার নম্বর?রুপের?ওতো আসেনি এখনও।তাইজন্যেই কী ফোন করল?
পরপর দেখল একই নম্বর থেকে মেসেজ উঠে আছে।পূর্নতা এবার লক খুলে ইনবক্স চেক করল।
” বাড়ির পেছন দিকে একবার আসবে মায়াপরী?প্লিজ!
পূর্ণতার বুক ধ্বক করে উঠল।মায়াপরি?তার মানে ধ্রুবর মেসেজ এটা।তবে কি ধ্রুব ওর ভুল বুঝতে পেরেছে?ওকি সব ঠিক করতে চাইছে? হ্যা তাই হবে।নাহলে ডাকবে কেন? আমি জানতাম ধ্রুব আমাকেই ভালোবাসে।আমার বিয়ে হয়ে যাবে সেটা কি ও হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখতে পারে?কোনও দিন না।
পূর্ণতার চকচকে চেহারা দেখে ধীর ভ্রু গোঁটাল।একটু আগেও তো মনমরা হয়ে বসেছিল,হঠাৎ হলো কী?কী আছে ফোনে?ধীর চেষ্টা করল দেখতে।কিন্তু যৎকিঞ্চিত দূরে বসায় পারলনা।
পূর্ণতা উদ্বিগ্ন চোখে আশেপাশে তাকাল।সাথে ব্যাকুল কন্ঠে ডাকল,
‘ছোট মা!ছোট মা!
ডাক শুনেই ছুটে এলেন সায়রা।ব্যস্ত ছিলেন অতিথি আপ্যায়নে।
‘হ্যা বল,কিছু লাগবে?
‘আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।
পূর্ণতার মিনমিনে কন্ঠ।সায়রা বললেন,
‘আয়।
পূর্ণতা ত্রস্ত পায়ে নামল।স্টেজ ছেড়ে দূরে আসতেই সায়রাকে বলল,
“তুমি যাও।আমি পারব।যাও তুমি।যাও।
সায়রা অদ্ভূত লাগল কেমন।পূর্ণতা এত উতলা হয়ে আছে কেন?তাও চলে গেলেন চুপচাপ। সায়রা আড়াল হতেই পূর্ণতা ছুটে গেল বাড়ির পেছন দিকে।ধ্রুব অপেক্ষা করছে ওখানে।দশ মিনিট আগেইতো মেসেজ পাঠিয়েছে।নিশ্চয়ই এখনও আছে।
পূর্ণতার মন বলছে আজ কোনও মিরাকল হবে।দুটো ভালোবাসার মানুষকে ভাগ্য আলাদা করবে না।বাড়ির পেছনে এসে থামল পূর্ণতা।দৌড়ে আসায় হাপিয়ে গেছে।হাপাতে হাপাতে এদিক ওদিক তাকাল।ধ্রুব নেই দেখে পূর্ণতা তাড়াতাড়ি ডায়াল করল ওর নম্বরে।আঙুলগুলোও কাঁপছে উত্তেজনায়।
ওপাশ থেকে ভেসে এল একটি নারীকন্ঠ।আওড়াল কিছু বিদঘুটে লাইন,
‘দুঃখিত!কাঙ্ক্ষিত নম্বরে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা।
পূর্ণতা হাল ছাড়লনা।অনেক সময় নেটওয়ার্কের কারনেও বন্ধ আসে ফোন।আবার ডায়াল করল সে।এবারেও বন্ধ।পূর্ণতা চেষ্টা করতেই থাকল।বিশ্রাম নিলনা।কিন্তু ফলাফল শূন্য।বরাবর।
পূর্ণতা থামল এবার।হাত থেকে ফোন পরে গেল মাটিতে।ধ্রুব এরকম একটা মুহুর্তেও মজা করল তার সঙ্গে? পূর্ণতার মনে হলো,গোটা পৃথিবী থমকে গেছে।পায়ের নিচে মাটি নেই।শ্বাস নেয়ার উপায় নেই।সব শেষ! সব!
ধপ করে মাটিতে বসে পরল পূর্ণতা।দু গাল গড়িয়ে জল গলা অব্দি আসছে।একটা সময় শাড়ি খাঁমচে ধরে কেঁদে উঠলো।বিয়েবাড়ির এত শব্দে তার চিৎকার শুনলোনা কেউ।মিশে গেল বাতাসে।পূর্ণতা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
‘ধ্রুব!এর থেকে নিজের হাতে মেরে ফেলতে আমায়।বেঁচে যেতাম তোমার প্রতারনা হতে।
গাছের আঁড়ালে দাঁড়িয়ে ধ্রুব।পাশেই দাড় করানো লাগেজটা।শার্টের হাতা দিয়ে বারবার চোখ মুচছে ধ্রুব।কিন্তু প্রতিবার ভিজে উঠছে তাও।ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে আর দেখছে পূর্ণতাকে।অসহায় তার দৃষ্টি।
” আমি চলে যাচ্ছি মায়াপরী।অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছি।দাঁড়িয়ে থেকে তোমার বিয়ে দেখার সাহস,শক্তি কোনোটাই আমার নেই।কিন্তু গায়ে হলুদের সাজে তোমাকে দেখার লোভ টাও যে সামলাতে পারলাম না।অপেক্ষা করে করে রয়ে গেলাম।এবার যে যেতে হবে।
ভালো থেকো মায়াপরী।খুব ভালো থেকো।ভুলে যেও আমাকে।আমার ক্ষনিকের ভালোবাসাকে।
চলবে…
[ কি ঘটতে যাচ্ছে,, ধ্রুব পূর্ণতার জীবনে?