#ফাগুন_ এলো_ বুঝি
(০৩)
লম্বা সোফাটায় সবে মাত্র গা এলিয়ে বসলেন আশরাফ।আজ একসঙ্গে দুটো মিটিং পরেছে,সাথে বাইরে রোদের অসহনীয় তাপমাত্রা। শরীর আর শরীর নেই।গলার টাই ঢিলে করে বললেন,
“সায়রা,এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।
সায়রা পানির গ্লাস হাতে হাজির হলেন।থমথমে চেহারা তার।আশরাফের হাতে কোনো রকমে গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে হাটা দিতেই আশরাফ প্রশ্ন ছুড়লেন
“কিছু হয়েছে?
সায়রা দাঁড়িয়ে পরলেন।পেছন না ঘুরে জবাব দিলেন,
‘নতুন করে আর কি হবে?
তার স্বরে রাগের আভাস। আশরাফ বললেন
‘তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না।
সায়রা তাকালেন।দৃপ্ত কন্ঠে বললেন,
‘বুঝেও না বোঝার ভান করলে আমার কিছু করার আছে কি?
আশরাফ মুখ কোঁচকালেন বিরক্ত হয়ে।এতবার এক প্রশ্ন করার শক্তি নেই শরীরে।ক্লান্ত লাগছে।পানিতে চুমুক দিলেন।তার নিরুদ্বেগ ভঙিমা পছন্দ হয়নি সায়রার।সকাল থেকে চটে থাকা সে এবার মারাত্মক চটলেন।উঁচু কন্ঠে বললেন,
‘এই বাড়িতে আমি আসলে কী আশরাফ?আর আমার মেয়ে, ওই বা কী?বাড়িতে আমরা বোধ হয় তোমাদের আশ্রিতা।তোমার কাছে তো তোমার নিজের মেয়েটাই সব। তাইনা?
আশরাফ ভ্রু কোঁচকালেন ‘ এসব কী কথা সায়রা?কি বলতে চাইছো তুমি?
“আর কি বলার বাকি আছে?কিই বা বাকি রেখেছ তুমি?দিনে দিনে আমাকে তুমি বুঝিয়ে দিচ্ছ যে মিশরা তোমার কেউ নয়।চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছ তোমার দুই মেয়ের মধ্যে টেনে দেয়া তফাতের রেখা।
এই যে আজ তুমি আসবে আমাকে বা মিশুকে একবারও বলেছিলে?না। বলোনি।বলবে কেন?কে হই আমরা তোমার?তোমার আপন তো পূর্নতা।তাই ও ঠিক জানে।যখন বাড়িতে থাকো তখন?প্রত্যেকদিন রাতে নিজের মেয়ের ঘরে গিয়ে তার কপালে চুমু দাও,মাথায় হাত বোলাও, তার গায়ে কাথা টেনে দিয়ে আসো।কি ভেবেছ আমি দেখিনি?দেখেছি।অথচ আমার মেয়েটার রুমের আশপাশেও তোমাকে যেতে দেখিনা।ওসব কথা না হয় ছেড়ে দিলাম।কিন্তু আজ? আজ ওদের দুজনারই ভার্সিটির প্রথম দিন ছিল তাইনা?অথচ তুমি কি করলে?তুমি নিজের মেয়েকে সাথে করে নিয়ে গেলে।কিন্তু আমার মেয়ের কথাটা একবারও জানতেও চাইলেনা?ও কোথায় আছে কি করছে জিজ্ঞেস অব্দি করলেনা।কেনো আশরাফ..? কেনো সবসময় সব অবহেলা আমার মেয়ের জন্যে তুলে রাখো তুমি? কেনো এতটা অন্যায় করো তুমি ওর সাথে?বিয়ের সময়ে বলেছিলে যে ওদের দুজনকে কখনই তুমি আলাদা চোখে দেখবেনা,তাহলে আজ এগুলো কি হচ্ছে?
সায়রা চেঁচিয়ে উঠলেন।রাগে শরীর জ্বলছে তার।
আশরাফ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন।রেগে কিছু বলতে গিয়েও থেমে শান্ত করলেন নিজেকে।
“প্রথমত আমি যে আসবো সেটা তোমার আর মিশুর মত পূর্ণতাও জানতোনা।দ্বিতীয় কথা হলো মিশুর সাথে আমার ইঞ্চি ইঞ্চি দুরুত্ব মিশুই তৈরি করেছে আমি নই।
তৃতীয়ত,, আমি কখনই ওকে পূর্ণতার থেকে আলাদা চোখে দেখিনি।সবসময় বাবার মত ওকে বুকে আগলে রাখতে চেয়েছি।কিন্তু মিশুই আমার থেকে দূরে দূরে থেকেছে।বাসায় আসা মাত্র পূর্ণতা বাবা বলে বুকে ঝাপিয়ে পড়তো,আর ও পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে থেকেছে।সেসব তোমার স্বচক্ষে দেখা।মিশুকে কাছে ডাকলেও ও কখনও আসেনি।,আর আজকের গোটা বিষয় টাই আমি ভুলে বসেছিলাম।কারন আমি ঘরে বসে এসির বাতাস খেয়ে দুই মেয়ের পার্থক্য করিনা।আমি একটা ব্যাবসা সামলাই।সেসব নিয়েই আমাকে ব্যাস্ত থাকতে হয়।যার দরুন পৃথিবীর এ টু জেট সব কিছু মনে রাখা হয়ে ওঠেনা। আমি আগে জানলে অবশ্যই ওদের দুজন কে একসঙ্গে নিয়ে যেতাম।কিন্তু তাও আমি মিশুকে কল করেছিলাম।ও কি করেছে জানো?আমার মুখের ওপর লাইন কেটে দিয়েছে।আমি ওকে মেয়ে মেনে নিলেও ও আমাকে বাবা হিসেবে মেনেছে কীনা সে খবর তুমি রেখেছ? দুরুত্ব যদি ও নিজেই বাড়াতে চায় আমার এখানে কি করার আছে? বলতে পারো?
সায়রা নিশ্চুপ।তার উত্তর করার মতো একটা কথাও জ্বিভের ডগায় নেই।হবেই বা কী করে?আশরাফের প্রত্যেকটা কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।মিশরাই আসরাফের থেকে দূরে থেকেছে।আশরাফ ডেকেছে, কোলে নিতে চেয়েছে কিন্তু পালিয়ে বেড়িয়েছে মেয়েটা।কখনও কখনও আশরাফ বাড়ি ফিরেছে শুনলে রুম আটকে বসে থেকেছে।উঁকি অব্দি দেয়নি।
আশরাফ আবার বলতে শুরু করলেন,
তবে একটা কথা কী জানো সায়রা?বারবার আমার মেয়ে তোমার মেয়ে এই শব্দগুলো উল্লেখ করে করে তুমি নিজেই আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছো যে তোমার কাছে ওদের কার জায়গা কি রকম।আমি বিয়ের সময় তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, পূর্নতা আর মিশুকে কোনও দিন আলাদা চোখে দেখবনা।একিরকম কথা তুমিও দিয়েছিলে আমাকে।আমি আমার কথা পালন করার সম্পুর্ন চেষ্টা করলেও তুমি আদৌ করেছিলে?নাকি করছো?তুমি কখনওই পূর্ণতাকে নিজের মেয়ে মানতে পারোনি।তোমার কাছে পূর্নতার একটাই পরিচয়, “সতীনের মেয়ে”।তোমার হাতে ওকে তুলে দিয়ে নিশিন্ত মনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই,মাস শেষে ফিরে এসে দেখি মেয়ের গায়ে দাগে ভর্তি।কেন?বলো কেন?
আশরাফের চিৎকারে সায়রা কেঁপে উঠলো।আশরাফ শান্ত মানুষ। তার উঁচু কন্ঠের সঙ্গে সায়রার পরিচিতি খুব কম।
‘পূর্নতা আমাকে কোনও দিন তোমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেনি।ও সব সময় বলেছে ও ভালো আছে।তুমি ওকে খুব আদর করছো।আমি প্রথম প্রথম মেনে নিয়েছি।ভুল করেছি আমি।তোমার প্রত্যেকটা কথাই প্রমান করে তুমি আসলেই পূর্নতার সৎ মা।
আর তোমার মেয়ে মিশরা?সেতো আরো এক কাঠি ওপরে।আজ স্কুলে পূর্ণতাকে ইটের টুকরো মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে,তো কাল ধাক্কা দিয়ে ডোবায় ফেলে দিয়েছে।আর সেসব নিয়ে শাসন করতে এলেই তোমরা ভেবে নিতে আমি ওর নিজের বাবা নই তাই এমন করছি।আগে নিজেদের অন্যায় গুলোকে স্বীকার করে সেগুলো শুধরাতে চেষ্টা করো।তারপর অন্যকে ন্যায় অন্যায় নিয়ে জ্ঞান দিতে আসবে, বুঝেছো?
আশরাফ লম্বা পা ফেলে হেটে গেলেন সিড়ির দিক।
সায়রা রাগে হিঁসহিঁস করছে।দাঁতের সঙ্গে দাঁত লেগে এসেছে তার।এই পূর্নতা মানে আস্ত একটা অভিশাপ তার জীবনে।এই মেয়ের জন্যে ‘এখনও কথা শুনতে হয়।আগেও হয়েছে।
তার কি দোষ?সৎ মেয়ে নিয়ে সংসার করতে হবে এটা কী আগে জানতো?নিয়তির নিদারুন খেলাও বলিহারি! মিশরার বয়স যখন ৩ বছর?তখন মিশরার বাবার পরকীয়ার কথা প্রথম জানতে পারেন সায়রা।মেয়েকে সাথে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে এসেছিলেন অভিমান করে।ভেবেছিলেন তার স্বামী বাঁধা দেবে,অন্তত মেয়ের টানে হলেও ফেরত নিতে যাবে।হয়নি।বরং সেই জায়গায় দু মাস পরেই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলেন।সায়রার তখন অকূল পাথারে ডুবে মরার দশা।সংসার টা ভাঙতে চাননি উনি।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।তালাক নামায় সই করতে না করতেই তিনি সেই মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললেন।আর সায়রার পার্মানেন্ট গন্তব্য হয়ে উঠলো বাবার বাড়িটা।মেয়েটা কত দিন কেঁদে কেঁদে বায়না ধরেছে বাবার কাছে যাবে।সায়রা রেগেমেগে মে’রেছে।চড় থাপ্পড় দিয়েছে।সাথে নিজেও কেঁদেছে।কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি।মেয়ের অল্প বয়স বলে সায়রার বাবা ঠিক করলেন আবার বিয়ে দেবেন ওনাকে।সমন্ধ দেখা শুরু হলো।কিন্তু এক মেয়ের মাকে কে বিয়ে করবে আপোসে?আসরাফের মাও তখন ছেলের জন্যে পাত্রী খুঁজছিলেন।ঘটকের সাহায্যে সায়রাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। তার বাবা এক বাক্যে মেনে নিলেন।মেনে নিলেন সে-ও।ভাবলেন এবার হয়তো একটা আশানুরূপ সংসার পাবেন।কিন্তু বাসর রাতেই সব পালটে গেল।সে রাতে প্রতিটি মেয়ে স্বামীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়।স্বামীরা স্ত্রীদের হাতে দামী গিফট তুলে
দেয়।অথচ সেখানে আশরাফ তার হাতে তুলে দিলেন পূর্ণতার ছোট্ট হাতটা।পূর্ণতার বয়স তখন ৪ বছর তিন মাস।আশরাফ বললেন ‘আজ থেকে তুমিই ওর মা।এই একটাই ছিল্য বাক্যলাপ তার।পূর্ণতাকে কোলে তুলে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরলেন না আশরাফ।দুঃখে কষ্টে সায়রা হাউমাউ করে কাঁদলেন।এ সংসারেও বুঝি সুখ মিললোনা তার।পূর্নতার ছোট কোমল মন অত কিছু বোঝেনি।সারা বিয়েতে সে মা পাওয়ার আনন্দে মেতে ছিল।সেই মাকে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে আধো বুলিতে যখন জিজ্ঞেস করলো
‘কাঁদছো কেন নতুন মা?
সায়রার ক্ষোভ টা হঠাৎই বর্তালো পূর্নতার ওপর।সেই প্রথম মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন মাটিতে।পূর্নতা কেঁদে উঠলো ব্যাথা পেয়ে।কান্না শুনে আশরাফ,তার মা,চাচাচাচি এরা ছুটে এলেন।পূর্নতাকে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করতেই বাচ্চা মেয়েটা সত্যি কথাই বলল।আসরাফ রেগে গেলেন।দাদু হা -হুতাশ শুরু করলেন ‘ কী মেয়ে আনলাম আশরাফ?প্রথম দিনেই আমার নাতনিকে মারলো?
আশরাফ ও যাচ্ছে তাই শোনালো।পূর্নতার জন্যেই তাকে আনা, কানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল সে কথা।মেয়ের যত্নে হেরফের হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবেন সেই হুমকিও দেয়া হলো।অপমানে জর্জরিত হয়ে সমস্ত রাত হাহাকার করে পার করলেন সায়রা।মিশরা তখন ছিল নানাবাড়িতে। পরে আশরাফ গিয়ে নিয়ে আসে।আশরাফ তার ধারে কাছে ঘিষতেন না।কারন টা তহমিনার প্রতি অগাধ ভালোবাসা হলেও সায়রা ভেবে নিলেন পূর্নতার জন্যে হয়েছে।আশরফের সাথে তার যোজন যোজন দুরুত্বের অংশীদার করলেন পূর্নতাকেই।সায়রার সহ্যই হয়না পূর্নতাকে।শুধু ভাবতেন এই মেয়ে না থাকলেই আজ সংসারটা শান্তির হতো।সেই অসহ্য ভাব পূর্নতার ওপর আজও রয়ে গেছে।মেয়েটাকে দেখলেই তার রাগ হয়।দেহ জ্বলে।ইচ্ছে করে মে’রে ফেলতে।খু’ন করতে।
পূর্ণতা বাড়িতে ঢুকেছে কেবল।সায়রাকে থম মেরে দাঁড়ানো দেখে সেও দাঁড়িয়ে পরলো।সায়রার গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুঁটে উঠলো ওকে দেখে।ক্রোধের কালো কাক ঝাপ দিলো পূর্নতার ওপর।মনে,কানে একটা কথাই বাজলো ‘ সব কিছুর জন্যে দ্বায়ী ও।সবকিছুর জন্যে।
সায়রার অগ্নিমূর্তি দেখে ঘাবড়েছে পূর্নতা।এই রুপ তার পরিচিত।সেকি আবার কোনো ভুল করেছে?ছোট মা রেগে আছে কেন?
ভয়ে ভয়ে শুধালো,
“কিছু হয়েছে ছোট মা?
সায়রার হিংস্র চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো।হিতাহিত জ্ঞান যেন খুইয়ে ফেললেন।হাতের কাছে কাঁচের ফুলদানি রাখা ছিল।রেগেমেগে সেটাকেই ছুঁড়ে মারলেন পূর্নতার গায়ে।
পূর্ণতা প্রচন্ড হকচকাল।কাঁচের ফুলদানিটা এসে বাম বাহুতে লেগে আছড়ে পরলো ফ্লোরে।বিকট শব্দ হলো।ব্যাথায় কুকড়ে গেল পূর্নতা।হাতের হাড়গোড় যেন ভেঙে যাচ্ছে।আর্তনাদ করে চেপে ধরলো হাতটা।জামার হাতার ভেতরে পাচ্ছে তরল কিছু গড়িয়ে পরার স্পর্শ ।রক্ত বের হয়েছে এর মানে!পূর্নতা ছোট থেকেই নম্র।নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল সে।
এদিকে সায়রার গালে ঠাটিয়ে চড় বসালেন আশরাফ।শব্দ পেয়ে পূর্নতা তাকালো।পরপর আরো দুটো চড় মারলেন তিনি।সায়রার বিস্ফোরিত দৃষ্টি তোয়াক্কাই করলেন না।
“তোমার এত বড় সাহস!আমারি বাড়িতে, তুমি আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলো??এ বাড়িতে তোমার জায়গা পূর্ণতার কারনেই হয়েছিলো সেটা বারবার কেনো ভুলে যাও তুমি?আমার মেয়ের জন্যে যদি তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে পারি,ঠিক তেমন ভাবেই মেয়ের জন্যেই বাড়িথেকে বের করেও দিতে পারব।ভবিষ্যতে এমন কাজ করার দুঃসাহস দেখিওনা সায়রা।তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা বুঝেছ তুমি?
আশরাফ ক্রুদ্ধ কন্ঠে আওড়ালেন।কাঁপছে তার শরীর।যে মেয়ের গায়ে কখনও ফুলের টোকাও দেননি তাকে এই মহিলা আঘাত করছে?তাড়াহুড়ার একটি ভুল আজ তাকে শেষ করে দিল।সাথে মেয়েটাকেও।
আশরাফ ছুটে গেলেন পূর্ণতার কাছে।সে হতভম্ব হয়ে বাবার দিক চেয়েছিল।আশরাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন।ফ্লোর থেকে ধরে ধরে উঠিয়ে পূর্নতাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।মেয়েটার এমন অবস্থার জন্যে নিজেকে দ্বায়ি মনে হয়।নতুন মা এনে দাও,নতুন মা এনে দাও দিনের পর দিন পূর্ণতার বেড়ে যাওয়া জেদটা পূরন না করলেই কী হতোনা?দু বাবা মেয়ে কী পারতেন না,সারাটাজীবন নিজেদের আগলে কাটিয়ে দিতে?
বাবা মেয়ের যাওয়ার দিক চেয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলেন সায়রা।প্রথম বার স্বামীর হাতে মার খেয়ে স্তব্ধ সায়রা ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন।গলায় দড়ি দিয়ে যদি মরতে পারতেন!এই নরক সমান জীবন থেকে মুক্তি পেতেন হয়ত।
কনুইয়ের ওপর থেকে অনেকটা জায়গা ত্যারছাভাবে কেটেছে।গলগল করে রক্ত পরছিল এতক্ষন।তবু টু শব্দ পূর্নতা করেনি।ঠিক এই অশান্তির ভয় সে পেত, পায় এখনো। তাই জন্যেই কোনো দিন আশরাফ কে জানায়নি কিছু।সে চায়নি বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হোক,কাটাকাটি হোক।আর তার উৎস থাকুক সে।ছোট মা কে নিজের মা ভেবেই তো এসব চিন্তা করেছে।মায়েরা মেয়েদের মারতেই পারে।এ আর এমন কী?
আশরাফের চোখ চিকচিক করছে।নিশ্চুপ ভাবে সে ব্যান্ডেজ বাঁধছে পূর্নতার কাটা জায়গায়।হঠাৎ বললেন,
‘কতবার তোমাকে বলেছি চলো আমার সাথে।এ বাড়িতে থাকলে তুমি শেষ হয়ে যাবে। এতদিন আন্দাজ করেছিলাম আজ তো নিজের চোখে দেখলাম আমি।এভাবেই ও মারে তোমাকে তাইনা?
পূর্নতা হাসার চেষ্টা করলো,
“কেউ আমাকে কষ্ট দেয়না বাবা।কেউ মারেনা।তুমি শান্ত হও।ছোট মাকে ওভাবে না মারলেও পারতে।
” চুপ করো তুমি।এত মহান হতে যেওনা মা।তোমার মহত্বকে কেউ মূল্য দেবেনা বরং সেটাকে তোমার দূর্বলতা ধরে নেবে।
আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা এবার তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ।
পূর্নতা মাথা নিচু করে ফেলল,
” এ বাড়ি ছেড়ে আমি কেনো যাবো বাবা?এটাত আমাদের বাড়ি। বাড়ির প্রত্যেকটা জিনিসে আমার মায়ের ছোঁয়া আছে। আনাচে কানাচে মায়ের স্মৃতি মিশে রয়েছে।তুমিই না বলতে?দেয়ালের একেকটা পেইন্টিং দেখিয়ে বলতে মা এঁকেছে,কাথাগুলো দেখিয়ে বলতে মা সেলাই করেছে।ঘরের আসবাব দেখাতে,এটা আমি আর তোমার মা কিনেছিলাম বলতে না বাবা?তাহলে সেসব ফেলে আমি কেন যাব?এখানে থাকলে আমি মাকে অনুভব করি।মায়ের বিছানায় ঘুমালে আমার মনে হয় আমি যেন মায়ের কোলে ঘুমিয়েছি।তোমার সাথে চলে গেলে পাব সেসব?
পূর্নতার যুক্তি ভিত্তিহীন।কিন্তু মেয়ের কান্নায় আবেগে আশরাফ নিজেও শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।মানস্পটে তহমিনার প্রতিচ্ছবি ভাসছিলো স্পষ্ট। অভিমান হলো,কেন এভাবে চলে গেল সে?এমন তো কথা ছিলনা।একটা মানুষ চলে গিয়েছে সাথে নিয়ে গেল তার জীবনের সব রঙ,সব আলো।
পূর্নতা উদ্বীগ্ন হয়ে বাবার চোখ মোছাতে গেলেই আশরাফ ওকে টেনে নিলেন বুকে।কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘আমাকে ক্ষমা করিস মা।আমি ভালো বাবা হতে পারিনি।
পূর্নতা কান্নার মধ্যেও হাসলো।
বিরোধিতা জানাল,
‘কে বলেছে?তুমিই পৃথিবীর বেস্ট বাবা।
____
ধ্রুবর মনে বসন্তের কোকিল ছোটাছুটি করছে।এ ডাল থেকে ও ডালে লাফাচ্ছে।ডানা ঝাপটাচ্ছে।
শিষ বাজাতে বাজাতে আঙুলে চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকলো সে।সিড়ি দিয়ে উঠতে যেতেই ভেসে এলো একজন বৃদ্ধা নারীর কন্ঠ,
“কি ব্যাপার ছোট মিয়া?হাওয়া অন্য রকম মনে হচ্ছে।
ধ্রুব তাকালো।মানুষ টাকে দেখেই হৈহৈ করে বলল,
‘আরে নানু তুমি?তুমি কখন এলে?
‘আজকে দুপুরেই এলাম নানুভাই।তোমাদের জন্যে বসে থাকতে থাকতে বুড়ো হাড়গোড়ে জং ধরে গিয়েছে ।গেছিলাম একটু ঘরে শুতে।বাইরে তোমার কথা টের পেয়েই না এলাম।তা কেমন আছো তুমি?
ধ্রুব হেসে, গিয়ে নানুর সামনে দাঁড়ালো।দুহাত মেলে দিয়ে বলল,
‘একদম বিন্দাস।এই দেখো।
‘তাতো থাকবেই।নাঁচতে নাঁচতে ঢুকলে দেখলাম।তা ব্যাপার স্যাপার কী?পরি টরি আছড় করেছে নাকি?
ধ্রুব শব্দ করে হেসে বলল,
‘পরি নয় নানু।একটা জলজ্যান্ত মানুষ দেখেছি।শুভ্র সুন্দর রজনীগন্ধা।
নানু অবাক কন্ঠে বললেন ‘ প্রেমে পড়েছো নাকি ছোট মিয়া?
ধ্রুব ভ্রু গোঁটালো ‘ তোমার কী মনে হচ্ছে নানু?মানে আমাকে দেখে কী মনে হয় আমি প্রেমে পড়েছি?
হাজেরা খাতুন মাথা নাড়লেন।কন্ঠ দৃঢ়।
‘হচ্ছে।
ধ্রুব অনিশ্চিত ভাবে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল।আসলেই কী প্রেমে পড়েছে? তাও এক দেখায়?
হাজেরা খাতুন এগিয়ে এলেন।রান্নাঘরে একবার চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করে শুধালেন
‘তা মেয়ে দেখতে কেমন?
ধ্রুব হা করলো,শব্দ ফোটার আগেই
হাজির হলেন সেলিনা।
‘ধ্রুব!এত দেড়ি হলো কেন ফিরতে?
মায়ের কথায় থেমে গেল ধ্রুব।হাজেরা খাতুন ও চুপ করে গেলেন।এসব তাদের নানী আর নাতির মামলা।এসবে মেয়েকে কেন জড়াবেন?
‘দেরিতেই তো গেলাম মা।তাড়াতাড়ি আসব কিভাবে?তাছাড়া আজ অনেক কাজ করেছি ভার্সিটিতে।
‘তাও একটা কথা বাবা।তোমরা দুইভাই যে রাজ্যের কাজ করো আমার তো মনে থাকেনা।
‘ভাইয়া ফেরেনি?
‘এত তাড়াতাড়ি? সে তো চ্যাম্পিয়ন। ট্রফি নিতে হবেনা?বাড়ি ঘর মা বাপ গোল্লায় যাক।ক্রিকেট হলেই চলবে।ভাত ও খেতে হয়না ওসব নিয়ে থাকলে।সত্যি বাবা কী ছেলে বানিয়েছি আমি।কারো সাথে মেশেনা, কথা বলেনা খালি খেলা খেলা আর খেলা।আমিতো ওকে পেটে নিয়ে খেলা দেখিনি।দেখব কি?ওসব বুঝিওনা।তাও এমন ক্রিকেট পাগল হল কী করে?
সেলিনা হা হুতাশ করতে করতে আবার রান্নাঘরে ছুটলেন।রান্না শেষ হয়েছিল আগেই।মা আসবেন তিনি জানতেন না।একটু আগেই তার ভাই এসে দিয়ে গেলেন।দুটো দিন থেকে চলে যাবেন আবার।নাতি আর মেয়েকে না দেখলেই তার মাস কাটেনা।ওনার জন্যেই ঝাল ছাড়া আবার তরকারি বসিয়েছেন সেলিনা।বাড়িতে দুজন কাজের লোক থাকলেও রান্না সেই করে।বাড়ির তিন পুরুষ সদস্যের কেউই বাইরের কারোর হাতের রান্না খেতে চায়না।আর নিজের ও সময় কাটেনা বাড়িতে।তাই তার প্রধান কাজই হয় ইউটিউব ঘেটে নতুন নতুন পদ তৈরি করা।আর সেসব সবার আগে কাজের মেয়ে দুটো মানে বেনি আর রাহেলাকে খাইয়ে মন্তব্য শোনা।ওরা যখন খেয়ে বলে “দারুন!
তারপর বাকিদের খেতে দেন সেলিনা।
এক প্রকার ছুটতে ছুটতে ঢুকলো ধীর।ডান হাতে মস্ত বড় ট্রফি আর বা হাতে সাদা রংয়ের ব্যাট।ঠোঁটে রাজ্যজয়ের হাসি তার।পড়নের জার্সি ঘামে ভিজে চুপচুপে।
ধীর বসার ঘরে এসেই দুহাত ওপরে তুলে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার দিলো।
‘ইয়াহু!আমি জিতে গেছি।আমার টিম জিতেছে।
আমি ম্যান অফ দা ম্যাচ হয়েছি।
ধ্রুব আর হাজেরা খাতুন মাত্র বসেছিলেন সোফাতে।ধীরের এক চিৎকারে চমকে উঠলেন দুজনে।স্বাভাবিক হতেই দুজন দুজনের দিক ফিরে মাথা নেড়ে নিঃশ্বাস ফেললেন।
একা একা কতক্ষন নেঁচে থামলো ধীর।তার চেঁচামেচিতে সেলিনা বেরিয়েছিলেন একটু।আবার ঢুকে পরেছেন কিচেনে।ধ্রুব পকেট থেকে ফোন বের করে টিপছে।হাজেরা খাতুন পাশে পরে থাকা টিভির রিমোট হাতে তুলেছেন।মানে তিনিও টিভি দেখবেন।ধীরের উচ্ছ্বাস নেতিয়ে গেল।সে যে এতক্ষন ধরে লাফালো সেটা কী কেউ দেখেনি?ধীর মুখ কালো করে এগিয়ে এসে বলল,
“কি ব্যাপার? আমি জিতেছি তোমরা খুশি হওনি?
ধ্রুব ফোনের দিক চেয়ে ছোট করে বলল ‘ হয়েছি।
‘হয়েছিস?কই,তোর মুখ দেখেতো মনে হচ্ছেনা।কারোর মধ্যেই কোনও হেলদোল নেই।আমি যে একটা ম্যাচ জিতলাম,ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হলাম,আর তোমাদের কোনও রিয়্যাকশনই নেই?কেন?এত নিষ্ঠুর কেন তোমরা?
ধ্রুব উঠে দাঁড়ালো।ফোন পকেটে ভরে বলল,
“ভাইয়া,এক জিনিসের পুনরাবৃত্তি রোজ হলে রিয়্যাকশন কি করে আসবে?
তুই একটা ম্যাচে যাওয়া মানে ম্যাচ টা জিতবে,আর তুই হবি ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ।তারপর একটা ট্রফি নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাসায় ঢুকবি।এটা আমরা সবাইই অনেক বছর আগে থেকে দেখে আসছি।আমিতো রীতিমতো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেছি।
তাই রিয়্যাকশন দিতে দিতে আমাদের সবারই স্টক আউট।
ধীর ধপ করে বসলো।মুখ ফুলিয়ে বলল ‘ধুর!
পরমুহূর্তে নাটক করে বলল,
এক চুটকি প্রতিভাকা মূল্য তুম ক্যা সামঝোগে রমেশ বাবু?
‘ক্ষমা দে ভাই,এইসব প্রতিভা না হলেও চলবে।আমার যা যাছে তাতেই চলবে।
“অনেক হয়েছে যাও, এবার ফ্রেশ হয়ে এসো দুজন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।তোমাদের নানু জার্নি করে এসেছেন।খিদে পেয়েছে তার।
কিচেন থেকে চেঁচিয়ে বললেন সেলিনা।
ধীর এর মধ্যেই হাজেরা খাতুনের সাথে আলাপ সেড়ে ফেলেছে।
সেলিনার কথা তারা কানে নিলোনা।দুভাই ওভাবেই গল্প জুড়ে বসলো।
সেলিনা এবার মোটা গলায় হাঁক পারলেন,
“ধীর?ধ্রুব?
দুভাই সমস্বরে জবাব পাঠালো , ইয়েস মম?
‘ ফ্রেশ হয়েছো তোমরা?
‘নো মম।
‘এখনও যাওনি?
‘নো মম।
‘যাবে নাকি আসতে হবে আমাকে?
‘ নো মম।
‘ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে?
‘হা হা হা
‘তবে রে,দাঁড়া আসছি।
মাকে খুন্তি নিয়ে বের হতে দেখেই দুভাই ছুট লাগালো।দৌড়ে দুদিকের সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো দুজন।
সেলিনা মায়ের দিক চেয়ে মুচকি হাসলেন।হাজেরা খাতুনের পান খাওয়া টকটকে দাঁত বেরিয়ে আছে আগেই।মন ভরে দোয়া করলেন,
‘তোর সংসারে কারো নজর না লাগুক।
চলবে