#ফাগুন_ এলো_ বুঝি!
(৩৭) শেষ
হাসপাতালের করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে ধীর।ওটির সামনের বেঞ্চীতে একে একে বসে আছে দুই পরিবারের সদস্যরা। চিন্তায় অস্থির প্রত্যেকে।পূর্নতা,সায়রা হাঁসফাঁস করছে।পারছেনা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যেতে।আশরাফ কপালে জমা ঘাম ক্ষনে ক্ষনে মুছছেন।পূর্নতা ঘাড় কাঁত করে রুপের দিক তাকাল।জিগেস করল,
‘খারাপ লাগছে?বসবি একটু?
রুপ দুদিকে মাথা নাড়ে।সে দু মাসের অন্তঃসত্ত্বা।এরকম পরিস্থিতিতেও পূর্নতার তাকে নিয়ে ভাবায় অবাক হয়নি ও।কারন,পূর্নতাতো এরকমই।পূর্নতা তাও বলল,
“বোস।ভালো লাগবে।অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আছিস।
” লাগবেনা রে!আমি ঠিক আছি।
পূর্নতা চোখ ফেরাল ” অপারেশন থিয়েটার” লেখাটার দিক।কখন আলো নিভবে?
ধ্রুব আর রিদ বাইরে থেকে ফিরল কিছুক্ষন পর।হাতে শুকনো খাবার,পানি।সবাইকে দিতে গেলেও কেউ নিলোনা।কেউ বা হাতেই রেখে দিল, খেলোনা।রিদ গিয়ে রুপের পাশে দাঁড়াল।রুপ ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দিল ওর কাঁধে।রিদ চিন্তিত কন্ঠে শুধাল,
‘শরীর খারাপ লাগছে?
“উহু!চিন্তা হচ্ছে!এতক্ষন লাগছে কেন?
ধীর একটা মুহুর্ত বিশ্রাম নিচ্ছেনা।না বিশ্রাম পাচ্ছে তার পা দুটো।হাঁটছে আবার ঘুরে ঘুরে ওটির দিকে তাকাচ্ছে।এই বুঝি কেউ বের হয়!ধ্রুব গিয়ে ভাইয়ের কাঁধের ওপর হাত রাখে।ধীর অসহায় চোখে তাকায়।ধ্রুব আশ্বাস দিল,
“ভাইয়া এতো টেনশন করিসনা।
ধীর কাঁধ থেকে ভাইয়ের হাত মুঠোয় নিল,
“সব ঠিক হবেতো রে ধ্রুব?মিশুর কিচ্ছু হবেনা তো?
ধীরের আকুলতা দেখে ধ্রুব হাসার চেষ্টা করল।চিন্তা যে তার হচ্ছেনা এমন না।তবুও ভাইকে শান্ত করতে বলল,
” কিচ্ছু হবেনা।দেখবে, সব ভালো হবে।
মন মানলনা ধীরের।ভেতরটায় কু ডাকছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি খারাপ কিছু হলো।শুকনো ঠোঁট জ্বিভ দিয়ে ভেজাল ধীর।সুস্থভাবে দেখা পাবেতো,মিশরা আর সন্তানের?
মিশরার ডেলিভারির ডেট ছিল আরো দুটো দিন পর।কিন্তু আজ সকাল থেকেই পানি ভাঙা শুরু হয়।সাথে প্রচন্ড ব্যাথা।বাড়িতে তখন একটা পুরুষও নেই।মেহবুব ঢাকার বাইরে।ধ্রুব অফিসে,ধীর ম্যাচ খেলতে।সেলিনা আর পূর্নতার মাথায় আকাশ ভেঙে পরার অবস্থা হলো ।মিশরার শরীর খারাপ ধীরে ধীরে বাড়ল।মেয়েটা গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করছিল ব্যাথায়।বাজার থেকে কাজের ছেলেটা আব্দুল ফিরে এলেই সবাই মিলে ওকে ধরাধরি করে হাসপাতাল নিয়ে ছুটল।গাড়িতে বসে, হাসপাতালে এসে ধ্রুব,ধীর,আশরাফ সবাইকে লাগাতার ফোন করেছে পূর্নতা।কাউকে পেলনা।তারপর রিদকে জানাল।রিদ,রুপকে নিয়ে ছুটে এল।তারও অনেকটা সময় পর ধ্রুব কল ব্যাক করল।এরপর একে একে বাকিরা।ধীর ব্রেক টাইমে ছিল তখন।খবরটা পেতেই ম্যাচ ওভাবে ফেলেই সবেগে পৌঁছাল হাসপাতালে।
____
ধীর তখন সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে ঘরে চলে যায়।একমাত্র মিশরার উদ্দেশ্যে একটা বাক্যব্যায়ও করলনা।
মিশরা আহত মনে যখন রুমে ঢুকল ধীর তখন বারান্দায়।মিশরার শরীর খারাপ লাগছিল বিধায় বিছানায় শুতে যায়।ওর উপস্থিতি টের পেয়ে ধীর রুমে আসে।পেছন থেকে ডাকে,
“মিশু!
মিশরা থমকে দাঁড়ায়।ফিরে তাকায়।ধীর এগিয়ে এল।নিষ্প্রান চোখে চেয়ে থাকল মিশরার মুখের দিকে।এই মুখটা পারবে হৃদয়ে গাঁথতে?পারবেনা।মিশরাকে সে ভালোবাসবেনা।কোনও দিন না।শুধুমাত্র সন্তানের জন্যে মেনে নেবে।সংসার করবে।একই বাড়িতে পূর্নতা থাকাকালীন অন্য কাউকে কখনও মন থেকে গ্রহন করা তার জন্যে অসম্ভব।তাছাড়া,মিশরা যতই বদলাক,পালটে যাক,ও অপরাধী ছিল।আর সারাজীবন ধীরের কাছে অপরাধীই থাকবে।ধীর পারবেনা মেয়েটাকে ক্ষমা করতে।কিন্তু এখন মিশরার একটা পরিচয় যোগ হয়েছে।ওর সন্তানের মা।ভালোবাসা পেলনা,ভালো স্বামী হওয়া কোনওদিন হবেনা ঠিকই,কিন্তু একজন ভালো বাবা হবে ধীর।পূর্নতা যেমনটা চায় তেমনটাই হবে।আর তার জন্যে সব করবে ধীর।সব।
” কিছু বলবে?
মিশরার ব্যাকুল স্বর।সে শুনতে চায় ধীরের কথা।ধীরের ধ্যান ভাঙে।চিন্তা কেটে যায়।
“হু?
এরপর ঢোক গিলল ধীর।নিজেকে সামলাল।মিশরার প্রতি নিজের ক্রোধ সংবরন করল।ধমকাল নিজের অযৌক্তিক অনুভূতিদের।সময় নিয়ে বলল,
” তুই সব নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলি।আমি জানিনা কতটা কী পারব!তবে চেষ্টা করব।যাতে আমাদের সন্তান পৃথিবীতে এসে আমার ওপর আঙুল তুলতে না পারে,তার সব চেষ্টা আমি করব।
এতেই মিশরার অন্তস্থল ভরে উঠল কানায় কানায়।ঠোঁট ভরল হাসিতে।ধীর ঠিক তখনি বলল,
“কিন্তু আমার ভালোবাসা তুই কোনওদিন পাবিনা।
মিশরার সবে সবে ফোঁটা হাসিটা,দপ করে নিভে যায়।অন্ধকার ছেঁয়ে গেল সেখানে।
ধীর ভণিতা ছাড়াই বলল,
“আমাদের সন্তান জানবে,আমরা হ্যাপি কাপল।
ধীর আর দাঁড়ায়না।কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে তৈরি হতে যায়।দুঃখে জুবুথুবু মিশরা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে।পরমুহূর্তে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল,
“অন্তত ধীরের সঙ্গে সংসার তো করা হবে।এই অনেক।
তারপর দিন যায়,পার হয় সপ্তাহ।পার হয় মাস।মিশরার স্লিম পেট ফুলতে শুরু করে।সেখানে বেড়ে ওঠে ধীরের ঔরসজাত সন্তান।একটা দিনও ধীর অযত্ন করেনি মিশরার।একটা দিনও আর পূর্নতার দিকে ফিরে তাকায়নি।কথা বলেছে,সহজ -স্বাভাবিক সে কথা।ধীরে ধীরে বাড়িটা সুস্থ হয়ে ওঠে।সুস্থ হয় সবার সম্পর্ক।
একদিন রাতে মিশরা কিছুতেই খেতে চাইলনা।ধীর জোর করল ভাত খেতে।খেলোনা।শেষে ধীর বাটিতে স্যুপ নিয়ে রুমে এল।বানিয়েছিল পূর্নতাই।মিশরা তখন বিছানায় আধশোয়া।ধীরের যাওয়ার ফাঁকে বমি করেছে একদফা।ধীর এসে স্যুপ মুখের সামনে ধরলে মিশরা হাত দিয়ে ঠেলে দিল।ধীর তাও শুনলনা।এ সময় খাবার বেশি বেশি প্রয়োজন যেখানে,সেখানে রাতে পুরোপুরি না খেয়ে ঘুমাতে দেয় কী করে?জোর করে স্যুপ মুখে দিতেই মিশরার গা গুলিয়ে ওঠে।নাড়িভুড়ি পাক খেয়ে গড়গড় করে ধীরের গায়ে বমি করে দেয়।প্রচন্ড রেগে গেল ধীর।সংবরন করতে না পেরে শক্ত চড় বসাল মিশরার কোমল গালে।পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেল সেখানে।অথচ মিশরা ক্ষীন হাসল।যেন কিছুই হয়নি।কিন্তু ভেতরটা জানত,কেমন হুহু করে কাঁদছে তারা।
___
হাসপাতালে ধীর পৌঁছেছিল সবার শেষে।তার যাতায়াতের পথে জ্যাম থাকে এইসময়।
এদিকে প্রসব যন্ত্রনায় কাতরালেও মিশরা কিছুতেই ওটিতে যাবেনা।ওটিতে ঢোকার আগে ধীরকে সে দেখবে।মেয়েটার জেদের কাছে হার মানল সবাই।অবস্থা বেগতিক হলেও হাত পা গুটিয়ে বসা ছাড়া উপায় রইলনা।ধীর এল হন্তদন্ত পায়ে।
ধীরের ঘামে ভেজা মুখটা দেখতেই মিশরা যেন প্রান ফিরে পায়।ধীর কাছে এল।মিশরার মাথায় হাত বোলাল।মিশরা তখন ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল।খুব কাতর স্বরে বলল,
“আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি ধীর ভাইয়া।অথচ তোমার ভালোবাসার বিপরীতেই রয়ে গেলাম।যেখানে ঘৃনা,রাগ,ক্ষোভ ছাড়া কিচ্ছু নেই।
আমি জানিনা আমি বাঁচব কীনা,তাই আমার একটা শেষ ইচ্ছে রাখবে?
ধীর মৃদূ ধমক দিল,
‘এসব কী কথা?তোর কিচ্ছু হবেনা।
ধীরের স্বর ভগ্ন।মিশরা সেকথা কানে না তুলে নিজের মত বলল,
‘আমায় ভালোবেসে একটা চুঁমু দেবে ধীর ভাইয়া?
এই এখানটায়!
কম্পমান আঙুলের ডগা তুলে কপাল দেখাল মিশরা।বাবা,মা শ্বশুর, শাশুড়ী কিচ্ছু খেয়াল নেই।ধীর ঝুঁকে গভীর চুঁমু খেল মিশরার ললাটে।মিশরা প্রসব ব্যাথা এক মুহুর্তের জন্যে ভুলে গেল।প্রথমবারের মত ধীরের এইটুকু স্পর্শে স্পষ্ট ভালোবাসা খুঁজে পেল।শ্বাস টেনে খুশি হয়ে বলল,
‘আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই ধীর ভাইয়া।
সেলিনা তাড়া দিলেন ডাক্তার,নার্সদের।তারা ত্রস্ত পায়ে মিশরাকে ওটিতে নিয়ে ছুটল।পুরোটা সময় ধীর-মিশরা একে অন্যের দিক তাকিয়ে রয়।চোখের পাতা পরেনা তাদের।চলে নিশ্চল, নিষ্পলক দৃষ্টি বিনিময়।মিশরা যত দূরে যেতে থাকল,ধীর হুট করেই তত গাঢ় অনুভব করল,
” মিশরাকে সে ভালোবাসে।খুব বেশিই ভালোবাসে।জোর করে সংসার করতে করতে কখন ভালোবেসে ফেলল?ধীর উত্তর পেলনা।শুধু বুঝল,মিশরাকে ছাড়া সে অঁচল,নিঃস্ব।
ওটির দরজা খুলতেই ভাবনার সুতোয় টান পরে ধীরের।ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত পায়ে এগোয়।বসে থাকা সকলে দাঁড়িয়ে যায়।দাঁড়ানোরা সচকিত হয়।একজন ডাক্তার বের হলেন প্রথমে।মুখের মাস্ক খুলে চিন্তিত,উৎকন্ঠিত মানুষগুলোর দিক চেয়ে মৃদূ হাসলেন।জানালেন,
“ছেলে হয়েছে!
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই।সেলিনা অস্পষ্টস্বরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’বললেন।
ধীর ঠোঁট ভেজাল জ্বিভ দিয়ে।ছটফটে কন্ঠে শুধাল,
” আর আমার স্ত্রী?ও কেমন আছে ডাক্তার?
__
ধীরের টলমলে চাউনি।পাতা ফেললেই কেবল গড়িয়ে পরার অপেক্ষা তাদের।সে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে।চোখদুটো দেয়ালে টাঙানো একটি বিশাল বড় ছবির ওপর।ছবিটা মিশরার।হাসি-হাসি মুখ,জিন্স-টপ্স আর মাথায় ক্যাপ পরা সেই পুরোনো মিশরাই বসে।ছবিটা ধীর, মিশরার ফোন থেকে নিয়েছে,তারপর বড় করে বাধিয়েছে।অদ্ভূত হলেও সত্যি,তাদের দুজনের যুগল কোনও ছবিই নেই।
হঠাৎ কোমড়ে দুটো ছোট ছোট হাতের স্পর্শ পেয়ে নড়ে উঠল ধীর।বুঝতে বাকি নেই এটা কে!ছেলেটা গিয়ে ধীরের পেছনে লোকাল।ধীর অবাক কন্ঠে বলল,
“কী হলো আব্বু,লুকোচ্ছো কেন?
ধূসর পিটপিট করে তাকাল,
‘মাম্মা কাবাল নিয়ে আসছে।আমি কাবনা।
ধীর মৃদূ হাসে,ঝুঁকে যায়,
‘এমন করেনা বাবু।না খেলে বড় কী করে হবে?
‘আমি বলো হতে চাইনা।আমি আগে আগে বলো হলে পিউ কী কলবে?
ধীর শব্দ করেই হেসে ফেলল,বোঝানোর ভঙিতে বলল,
‘পিউ ও বড় হবে।সাথে তুমিও।দুজন একসঙ্গে বড় হলে মজা হবেনা?
বাবা-ছেলের কথার মধ্যেই খাবার হাতে রুমে ঢুকল পূর্নতা।শাড়ির আঁচল কোমড়ে গোঁজা।লম্বা চুল হাতখোপা করা।সে পাঁকা গিন্নি এখন।ওকে দেখতেই ধূসর যত্র মাথাটা ধীরের পেছনে নিয়ে গেল।পুরোপুরি আড়াল করল নিজেকে।পূর্নতা ঠিক দেখে ফেলল তাও।
” ধূসর!বাবাই,বেরিয়ে এসো।মাম্মা মজা করে খাবার বানিয়েছি দ্যাখো।
ধূসর খরগোশের মতো মাথাটা বের করল।দুপ্রান্তে দুলিয়ে বলল,
‘কাবোনা।
‘বাবাটা লক্ষীনা?এসো।
ধূসর তাও এলোনা। এত আদুরে স্বরেও কাজ হলোনা দেখে পূর্নতা গাল ফোলাল এবার।
‘ঠিক আছে।ধূসর না খেলে মাম্মা আর ওর সাথে কথা বলবনা।
পূর্ণতা রেগে যাওয়ার ভাণ করে চলে যেতে নিল,এতেই কাজ হলো।ধূসর তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে এসেই আঁচল টেনে ধরল।
“কাবো কাবো।আমি কাবো।
পূর্নতা ধীরের দিক চেয়ে হেসে ফেলল।ধীর ও হাসছে।ধূসরের ছোট্ট গালে চুঁমু খেয়ে কুটিকুটি আঙুল ধরল পূর্নতা,
” এসো।
যেতে নিয়ে পূর্ণতা ফিরে তাকাল আবার।ধীরকে বলল,
‘নাস্তা দিয়েছি ভাইয়া।খেতে এসো।
ধীর ছোট করে বলল ‘ আসছি।
পূর্ণতা ধীরের পাঁচ বছরের ছেলেটার কোমল হাত আকড়ে ঘর ত্যাগ করল।ধীর চোখ ফেরাল সেদিক থেকে।আবার ঘুরে তাকাল মিশরার ছবিতে।একিরকম ভরে উঠল চোখ।অথচ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“দেখেছিস মিশু,পূর্না আমাদের ছেলেকে কত যত্ন করে,ভালোবাসে!তুই থাকলে যেমনটা করতিস,ঠিক তেমন।ছেলেটা জানে পূর্নতাই ওর মা।শোয়-ও ওর কাছে।আমার কাছে আসেইনা তেমন।পূর্নাই যেন সব ওর।ভাগ্যিশ,পূর্না ছিল,নাহলে কীভাবে সামলাতাম ওকে?ও তোকে খুঁজতোনা?তখন কী বলতাম?ছেলেটা যে আজও জানেনা,”ওর মা এত বড় পৃথিবীর কোথাও নেই।
সেদিন ডাক্তারকে করা ধীরের প্রশ্নের উত্তর এসেছিল সময় নিয়ে।তিনি থমথমে মুখে বললেন,
‘আ’ম স্যরি!ওনাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।বেবি বাম্প করার কয়েক সেকেন্ড পরেই উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ব্যাস!এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল ধীরের ধরিত্রী থমকে দিতে।পুরো শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল।মাথাটা অবশ হয়ে গেল।ফ্যাকাশে হয়ে গেল বাকিদের চেহারা।পূর্নতা,সায়রা,সেলিনা,রুপ এরা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।বাদ গেলনা আশরাফও।অথচ এদের কারোর কান্নার শব্দ কানে যায়নি ধীরের।তার চোখের সামনে গোটা পৃথিবী ঘুরছে।
সে ধপ করে বসে পরল।ধ্রুব,রিদ আগলে ধরল ওকে।ধীর গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল পরপর।হাত পা ছড়িয়ে আর্তনাদ করল।পুরো হাসপাতাল দুলে উঠল তার আহাজারি,হাহাকারের শব্দে।
কেউ পারলনা ওকে সামলাতে।কেউনা।যে মানুষটা ছিল চক্ষুশূল সেদিন তার চলে যাওয়া নিয়ে ধীরের হা-হুতাশ ছিল বাধভাঙ্গা নদী।
দাফনের সময়েও মিশরার লাশ জড়িয়ে রাখল ধীর।নিঃশব্দে কাঁদল।গাল চাপড়ে ডাকল।মিশু উঠলনা।কয়েকজন মিলে বেগ পুহিয়ে সরাল ওকে।এক বাড়ি আত্মীয় স্বজনের সামনে ধীর পা ছুড়ে ছুড়ে চিৎকার করল।কেন সব সময় তার ভালোবাসা হেরে যায়?কেন?
মিশরার শোকে ধীর ছন্নছাড়া।খায়না,ঘুমোয়না।ঘর বন্ধ করে পরে থাকে।
মা হারা সন্তানটাকে পূর্নতা বুকে আগলে নেয়।ওর হাতেই বেড়ে ওঠে ধূসর।ছেলেটা জানে পূর্নতাই ওর মা।
তারপর পাঁচটা বছর পার হলো।প্রতিটা দিন ধীরের অনুতাপ,আফসোসে কাটে।কেন মিশরাকে তখন ভালোবাসলনা?কেন?
বেঁচে থাকতে ভালোবাসেনি,অথচ মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ওকে ভালো বাসতে না পারার অনলে দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ধীরের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়।ফেলে আসা বছর গুলোর বিষাদের স্মৃতি মনে করে করে যন্ত্রনা হয় বুকে।এখনও কানে বাজে মিশরার কন্ঠস্বর।চোখে ভাসে মিশরার মুখ,মিশরা সেই হাসি।ধীর যখন বলেছিল,তোর সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করব?কী শুভ্র,সুন্দর হাসল ও।
তারপরে যখন বলল
“কিন্তু কোনও দিন তোকে ভালোবাসবনা,হাসিটা নিভেও গেল।অথচ ধীরের এখন চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়,
“তোকে আমি ভালোবাসি মিশু।তুই আদায় করে নিলি আমার ভালোবাসা।পারলাম না না ভালোবেসে থাকতে।
“জীবনটা ছেলেখেলা নয় ধীর ভাইয়া।আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। ছোট্ট জীবনটায় তোমাকে না পাওয়ার আফসোস নিয়ে আমি মরতেও চাইনা।”
এইতো,ঠিক এই কথাটাই মিশরা বলেছিল একদিন।যেদিন সেজেগুজে ধীরের সামনে এসে দাঁড়ালো।অথচ ধীর ফিরে দেখেনি একবার।না তোয়াক্কা করেছে মিশরার কোনও কথা।
পূর্নতা ঠিক বলেছিল,
একদিন হয়ত এই ভালোবাসার জন্যেই ছটফট করবে তুমি।
তাইতো হচ্ছে।পেছনের প্রতিটি মুহুর্ত সাক্ষী,খালি বিছানায় ধীর কিরকম ছটফট করেছে মিশরার জন্যে!কতরাত,মিশরার বালিশটা বুকে নিয়ে কেঁদেছে!মিশরাকে থাপ্পড় মারা হাতটায় একের পর আঘাত করেছে।মিশরা তার অভ্যেস।মিশরা তার না বলা ভালোবাসা।যদি জানত সেদিনের পর আর ও ফিরবেনা?বাচ্চা চাইতোনা ধীর।মিশরাকে চাইত।চাইত ওর সাথে বাঁচতে।মিশরাওতো বলেছিল,
“আমি তোমার সঙ্গে বাঁচতে চাই ধীর ভাইয়া।
তাহলে কেন চলে গেলি মিশু?কেন?এত বড় শাস্তি দিলি আমায়?এত বড় শাস্তি?
ধীর ফের ডুকরে কাঁদে।
মনে পড়তে থাকে মিশরার আকুতি।ওটিতে যাওয়ার আগের সেই নিষ্পাপ আবদার।তারপর বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো,
‘আমি তোমার ভালোবাসার বিপরীতে রয়ে গেলাম ধীর ভাইয়া।যেখানে রাগ,ক্ষোভ,ঘৃনা ছাড়া কিচ্ছু নেই।
এসব মনে পড়লেই ধীরের শ্বাসকষ্ট হয়।দম আটকে আসে।মিশু থাকলে দুইহাতে ওর মুখটা তুলে চুমু খেত কপালে।বলত,
” আমার রাগ,ক্ষোভ,কিচ্ছু নেই মিশু।তোর প্রতি এখন শুধুমাত্র ভালোবাসা আছে।একবার ফিরে আয়না,বুকের মধ্যে সযত্নে আগলে রাখব তোকে।দেখিস!
ধীরের প্রত্যেকটা সেকেন্ডে মিশরার কথা মনে পড়ে।মনে পড়ে ওর ভালোবাসা চাওয়ার ব্যাকুল কন্ঠ,সেই ব্যগ্র স্বর,
” আমাকে একবার ভালোবাসোনা ধীর ভাইয়া!
কষ্টে,যন্ত্রনায় ধীর হাঁসফাঁস করে উঠল।চোখে টইটম্বুর জল নিয়ে মিশরার মুখের দিক তাকাল,আওড়াল,
“আমার জীবনে বুঝি ফাগুন এলোনারে মিশরা!কারন তুই রইলিনা আমার কাছে।বারবার ভালোবেসে আমি নিঃস্ব!
আশরাফ পাঁচটা বছরে খান বাড়িতে পা রাখেননি।ধীরের প্রতি এক পশলা অভিমান তার।সায়রা মাঝেমধ্যে এসে দেখে যান,নাতি আর পূর্নতাকে।মেহবুব কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন।ব্যবসা সব ধ্রুব আর ধীরের কাঁধে।ধীর তার প্যাশন,তার ম্যাচ,সব ছেড়েছুড়ে ব্যবসায় হাত লাগিয়েছে।উন্নতি কানায় কানায়।অথচ দিন শেষে তার শুকনো মুখমণ্ডল কাউকে সুখি করেনা।পরিবারের সবাই চেয়েছিল,ধীরকে বিয়ে করাতে।সংসারি করতে।কিন্তু ধীরের “না” কে “হ্যা” বানাতে পারলনা।তার এক কথা,শেষ অব্দি মিশরার স্মৃতি আকড়ে বাঁচবে।
মিশরাকে একবিন্দু সহ্য করতে না পারা ছেলেটা যে মরার পর ওকে এতটা ভালোবাসবে,কে জানত?
সময় গড়ায়, মিশরার শোক কাটিয়ে ওঠে খান পরিবার।সংসার,ধ্রুব,ধূসর এসবে ব্যাস্ত হয় পূর্নতা।মাঝেমধ্যে মিশরার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।কখনও চোখ ভিজে ওঠে।কিন্তু শেষে সবাই স্বাভাবিক।একমাত্র ধীর পারেনা স্বাভাবিক হতে।ঘরের দোরগোড়ায় এসে দেয়ালে মিশরার বিরাট ছবিটা দেখলেই বুক মোচড় দেয়।মনে হয় এইতো,মিশরা হাতে জল নিয়ে এল।কিন্তু আসেনা।পূর্নতা আসে।এতে ধীরের সুখ লাগেনা।সে মিশরাকে চায়।আজ আর পায়না।
এইতো,এভাবেই দিন যাচ্ছে,রাত হচ্ছে।।সাথে কাটছে ধীরের নিসঙ্গ জীবন।
____
ধূসর কুটিকুটি দাঁত দিয়ে খাবার চিবোচ্ছে।কতক্ষন আবার চেয়ে চেয়ে দেখছে ঘুমন্ত দুই মাসের পিউকে।ধ্রুব, পূর্নতার মেয়ে পিউ!
পিউকে প্রথম দেখেই ধূসর রেগেমেগে মারতে গেছিল।কেন ও তার মাম্মামের কোলে উঠল?পরে যখন পূর্নতা বলল,
” ওতো কোনও বাবু নয়।ও হচ্ছে ‘এক পুতুল।তোমার পুতুল।
ব্যাস,পুচকে ধূসর সেই থেকেই পিউয়ের ভক্ত।পিউ ছাড়া মাথায় আর কিচ্ছু নেই।মাঝেমাঝে চিমটি কাটে ওইটুকু বাচ্চাটাকে।পিউ কাঁদে আর সে হাসে।এতেই তার আনন্দ!
ধুসর খাবার মুখে নিয়ে পূর্নতাকে জিগেস করল,
“ও গুমাচ্চে কেন? ওকে তোলো।
” ছোট পুতুলরা ঘুমায়।নাহলে বড় হতে পারেনা।তুমি খাও আগে।
পিউয়ের ক্ষুদ্র বুক নিঃশ্বাসে ওঠানামা করছে।ধূসর এগোতে নিলেই পূর্নতা হাত চেপে ধরল।
“আগে খেতে বলেছিনা?
” আবাল পলে কাব।
“পরে না।এক্ষুনি।
এর মধ্যেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে ধ্রুব বের হয়।ধূসরের খাওয়া শেষ। সে ছুট্টে ধ্রুবর কাছে গিয়েই দুহাত বাড়িয়ে দিল।ধ্রুব মুচকি হাসল।ভেজা শরীরেই কোলে ওঠাল ধূসরকে।।পূর্নতা স্বর মোটা করে ডাকল,
” ধূসর,নেমে এসো।খেতে হবে।
ধূসর ঠোঁট উলটে ধ্রুবর দিক তাকায়।নিরবে সাহায্য চায়।ধ্রুব পূর্নতাকে বলল,
“আর খেতে হবেনা।এখন থাক।
ধূসর হৈহৈ করে উঠল।চুমু খেল ধ্রুবর ক্লিনশেভ গালে।পূর্নতা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল।
খাবার প্লেট রেখে দিল টেবিলের ওপর। ধূসর বায়না করল ধ্রুবর কাছে,
‘আচকে আসাল সময় আমাল জন্যে অগেন চকলেট এনো তাচ্চু।
ধ্রুব মাথা কাত করল,
‘আচ্ছা বাবা।
‘তালে আমায় নামাও,দাদুর কাছে যাই!
ধ্রুব নামিয়ে দিতেই ধূসর এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।পূর্নতা, ধ্রুব ওর চঞ্চলতা দেখে হাসে।পূর্নতা এগিয়ে আসে ধ্রুবর দিক।ভ্রুকুটি করে বলে,
‘চুলটাও মোছোনি?এখনো পানি পরছে।
ধ্রুবর হাতে তোয়ালে ছিল।অথচ পূর্নতা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মোছাতে শুরু করল ধ্রুবর।ধ্রুব ওমনি পূর্নতার কোমড় চেপে কাছে টেনে আনল।ঠোঁট ছোঁয়াল গলায়।পূর্নতার শরীর শিরশির করে উঠতেই নড়েচড়ে উঠল একরকম।
‘এক মেয়ের বাপ হওয়ার পরেও দুষ্টুমি গেলনা তাইনা?
ধ্রুব গলায় নাক ঘষতে ঘষতে জবাব দিল,
‘এক মেয়ে কেন,এক ডজন হলেও ধ্রুবর ভালোবাসা শেষ হবেনা।
‘হয়েছে ছাড়ো।অফিস যেতে হবেনা?বাজে কটা,খাবে কখন?এক ঘন্টা ঠেলতে ঠেলতে তারপর উঠেছ।
পূর্নতা নিজেকে ছাড়িয়ে-ছুড়িয়ে কাবার্ড থেকে ধ্রুবর জামা-প্যান্ট বের করে দিল।পিউকে একবার দেখে চলে গেল সেও।ধ্রুব ঠোঁট ওল্টাল বাচ্চাদের মত,
‘মায়াপরি,ভালোবাসতে গেলেই কেমন করে!সেকী পুরোনো হয়ে গেল?
ধ্রুব নিচের দিক চেয়ে নিঃস্বাস ও নিতে পারলনা ওমনি হাওয়ার বেগে এসেই পূর্নতা ডান গালে চুঁমু খেল ওর।ধ্রুব ভঁড়কে গেল।তাকাল গোল চোখে।পূর্নতা যেমন গতিতে এসেছিল তেমন দৌড়েই বেরিয়ে গেল।ঘটনাটা বুঝে উঠতে সময় লাগল ধ্রুবর।যখন ঢুকল মাথায় গালে হাত দিয়ে মুচকি হাসল।বুকে হাত দিয়ে গেয়ে উঠল,
“তুমি ছুঁয়ে দিলে হায়,আমার কী যে হয়ে যায়!
___
ধ্রুব,ধীর সবাই বেরিয়েছে।পূর্নতা দরজা লাগিয়ে ফিরল কেবল,ওমনি ধূসর কোত্থেকে ছুটে এসে দাঁড়াল।দুহাত বেঁধে রেখেছে পেছনে।পূর্নতা চোখ ছোট করে বলল,
“হাতে কী বাবাই?
ধূসর মাথা নাড়ল,
দেখাবেনা সে।
বাচ্চা ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।পূর্নতা ওর হাসি দেখে নিজেও হাসল।আগের থেকেও আদুরে স্বরে বলল,
” দেখাও বাবু।ভালোনা তুমি!কি এনেছ?ব্লেড ধরেছ নাকি?
“না।এই দ্যাকো।
পেছন থেকে হাত এনে পূর্নতার সামনে ধরল ধূসর।হাতের মধ্যে পুরোনো সেই রুপার নূপুরটা দেখেই পূর্নতা চোখ বড় করে ফেলল।চট করে নিজের পায়ের দিক তাকাল।একটা নেই।পরে গেছিল,আর ধূসর সেটাই পেয়েছে।
পূর্নতা চাইল,
‘এটাত মাম্মার নূপুর।দাও বাবা।
ধূসর তড়িৎ বেগে হাত আবার নিয়ে গেল পিঠের কাছে।
‘না।দেবনা।
পূর্নতা অবাক হলো,
” ওমা, কেন?এগুলোতো মেয়েদের জিনিস,তুমি দিয়ে কী করবে?ছেলেরা কী এসব পরে?
“আমি পলবনা।পিউয়ের জন্য লেখে দেব।ও বলো হলে ওকে পলাব।তালপল যকন ও হাটবে,আমি শুনব।
ধূসর নিষ্পাপ স্বর।অথচ কত্ত বড় একটা কথা বলল!পূর্নতার মুখটা রীতিমতো হা হয়ে গেল।এই রকম একটা কথা একদিন ধ্রুব বলেছিল না ওকে?এই পুচকে ছেলে শিখল কোত্থেকে!ওর মাথায় এলোই বা কী করে?
ধূসর আর দাঁড়ালনা।সে ছুট্টে পূর্নতার ঘরের দিক চলল।যেখানে পিউ ঘুমিয়ে।
পূর্নতার তখনও বিস্ময় কাটেনি।কেন যেন মনে হচ্ছে,
আরো একবার ফাল্গুন আসবে।
ফের রচিত হবে #ফাগুন এলো বুঝি’র গল্প।
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
সমাপ্ত!
কেমন লাগল,জানাবেন।মিশরা ব্যাপারটা শকিং তাইনা? আমার নিজেরও লিখতে গিয়ে খারাপ লেগেছে।আপনাদের অনুভূতি জানাবেন?