ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০৪,০৫

0
309

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০৪,০৫
#ফারজানা_আক্তার
০৪

মেঘলা আকাশ। রোদের ছিটেফোঁটাও নেই অন্তরীক্ষে তবুও গরমের উত্তাপ ছড়িয়ে আছে প্রকৃতি জোড়ে।। প্রকৃতি যে কোন রহস্যের জন্ম দিচ্ছে দিন দিন বুঝা মুশকিল। শরৎ এর শেষ কালেও বৃষ্টির উৎসব। শীতের তো কোনো আবির্ভাবই নেই যদিও ভোরবেলা হালকা অনুভব করা যায় ঠান্ডা ভাব টা। তবুও এই জায়গাটা শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় এই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে নয়তো শহরে তো দিনে রাতে ২৪ঘন্টায় গরমের উত্তাপ বেশ অধিক। আয়ানদের বাসাটা একটু পাহাড়ি এলাকায় পরেছে। এই বাসার আশেপাশে বাড়িঘর রয়েছে হাতে গুনা কয়েকটা। তবে নতুন নতুন বাড়িঘর হওয়ার প্রস্তুতি চলছে খুব চারপাশে। আয়ানকে প্রকৃতির মতো রহস্যময় মনে হচ্ছে ইদানীং আমার। কোনো কথা সে এখন আর স্পষ্ট করে বলেনা আমার সাথে। প্রায়ই একবছর ধরে আমার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করছে আয়ান। মন খারাপ করে রাখতো সবসময়ই। গম্ভীর হয়ে থাকতো। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও ঝগড়া লেগে যেতো আমার সাথে অযথা। কিন্তু এখন তো বিয়ে করেছে। আল্লাহ চাইলে নয়নার কোল জোড়ে আসতে পারে আয়ানের সন্তান কিন্তু আয়ানকে বিয়ের দিন খুশি দেখলেও বাসর রাতের পর থেকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ভীষণ উদাস। আয়ান কি চাই তা রহস্য ছাড়া আর কিছুই না আমার কাছে এই মুহুর্তে। এই একবছর ধরে আয়ানের অবহেলা গুলো ভীষণ য’ন্ত্র’ণা দিচ্ছে আমায়, নিদারুণ আ’ঘা’তে ক্ষ’ত বিক্ষত করছে রোজ। আবারও আওয়াজ এলো মাহির। একরাশ বিরক্তি নিয়ে পা বাড়ালাম রান্নাঘরের দিকে। রান্না ঘরে যেতে যেতে মনে পরলো নয়নার সকালে বলা কথাগুলো আর নিজের অজান্তেই মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আমার ওষ্ঠদ্বয় জোড়ে। সকালে মেয়েটা খুব আদুরে সুরে আমায় বলেছিলো “আপু জানেন আমার কোনো বড় বোন নেই। বড় বোনের আদর কখনো পাইনি আমি, একটা আক্ষেপ রয়েই গিয়েছিলো বুকের ভেতর। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আল্লাহ আমার সেই বড় বোনের অভাবটা দূর করে দিয়েছেন। আপনাকে বড় বোনের আসনে বসিয়েছি। প্লিজ আপু আমাকে ছোট বোনের মতো আগলে রেখো।”
মেয়েটার এতো সুন্দর আবদারে যে কেউ দূর্বল হয়ে পরবে আর আমি তো সেখানে ভালোবাসার কাঙ্গালি।

*
আমি বিরিয়ানি রান্না করছি আর আমার সাথে টুকটাক কাজে হাত লাগাচ্ছে নয়না। অনেকবার বারণ করা সত্বেও মেয়েটা শুনছেনা। পরে সালাদ কাটতে বলি, অনেক খুশি হয়ে যায় পাগলিটা। আসলেই একটা ছোট্ট বোনের অভাব ছিলো বড্ড। নয়না সেই স্থানটা বানিয়ে নিচ্ছে নিজের মতো করে। কি করেই বা পিচ্চি মেয়েটার সাথে রাগ দেখাবো? দোষ তো আমার কপালের নয়নার না। আল্লাহ চেয়েছে বলেই তো হয়েছে বিয়েটা। আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়েনা।
সালাদ কাটতে কাটতে নয়না বলে “আপু আজ আমাদের বাসা কিছু লোক আসবে আমাকে দেখার জন্য। বেশি কেউ আসবেনা। শুধু আমার খালাতো বোন আর আমার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এই দুই জনই আসবে। আমিই বলেছি বেশি কেউ না আসার জন্য। জানেন আপু আপনাকে এভাবে খাটতে দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।”

আহ্ কত মায়া করে কথাগুলো বললো মেয়েটা। খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কপালে বড় বোনের আদরের আল্পনা ছোঁয়ায় দিতে। ইস্ নয়না যদি সত্যি সত্যি আমার ছোট বোন হতো। আমরা দুই বোন এক ভাই। আপু আর ভাইয়া বড় আর আমি সবার ছোট পরিবারের। আমি একটু অবাক হয়ে কোতুহলী দৃষ্টিতে তাকালাম নয়নার দিকে। আমার তাকানো দেখে নয়না বুঝতে পারে আমি ওকে প্রশ্ন করেছি তাই সে আবারও স্বাভাবিক ভাবে বলে “আমি শুনেছি মা আর মাহি আপু কথা বলছিলো আমাদের বাসা থেকে মেহমান আসলে তাদের সবার জন্য আপনাকে দিয়ে নাস্তা বানিয়ে নিবে। আর তাদের সামনে আপনাকে পরিচয় দিবে কাজের মহিলা বলে। তাই আমি ফোন করে আমার ভাবিকে বলে দিয়েছি তারা দুইজন ছাড়া যেনো কেউ না আসে। এরা দুইজন মানুষ আমার খুব কাছের তাই তারা আসবেই আমি না করলেও।”

এতটুকু কথা বলে নয়না আবারো সালাদ কাটায় মনোযোগ দিলো। মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে আমাকে চম্বুকের মতো জড়িয়ে নিচ্ছে নিজের সাথে। আমার সব চিন্তা দ্বারা ভাবনাকে মেয়েটা উল্টো করে দিচ্ছে। এতোদিন এই বাসায় নিজেকে খুব একা লাগতো কিন্তু আজ যেনো মৃত দেহ প্রাণ ফিরে পেয়েছে এমন অনুভব হচ্ছে। নয়নার কথা শোনে না চাইতেও চোখে জ্বল টলমল করছে। নয়না সেটা লক্ষ করে বললো “আপু একটু জড়িয়ে ধরার অধিকার দিবে আমায়?”
আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। দেখলাম মেয়েটার মুখশ্রী খুশিতে ঝঁকঝঁক করে উঠেছে। খুব উত্তেজিত হয়ে মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে। অদ্ভুত ভাবে আমার বেশ স্বস্তি লাগছে ঠিক তখনই আমার ননদ আর আমার শ্বাশুড়ির প্রবেশ ঘটলো রান্না ঘরে। মা মেয়ে দু’জনেই আমাকে সমানে বকে যাচ্ছে। আমি নাকি তাদের নতুন বউয়ের মাথা চি’বি’য়ে খাচ্ছি। আমি নিশ্চুপ। নয়না কিছু বলতে চাইলেও মাহি ওকে বলতে দিলোনা। এবার আমার সত্যিই ভীষণ কান্না পাচ্ছে কিন্তু আমিও কান্নাটাকে গলা বেয়ে আসতে না দিয়ে কণ্ঠনালিতেই কান্নাটাকে আঁটকে ঢুক গিলে ফেললাম। কিছুতেই এদের সামনে আমি দূর্বল হবোনা। আমার শ্বাশুড়ি আবারও আমায় বলে উঠলেন “মেয়ে শোন এ বাড়িতে থাকতে হলে আমার ইশারায় চলতে হবে তোকে নয়তো দরজা দেখিয়ে দিতে হবেনা আশা করি নিজেই চলে যাবি আমাদের কে মুক্তি দিয়ে।”
আমি মুচকি হাসলাম। নাক আর ভ্রু কুঁচকে বললাম “কিছু ছায়া সহজে পিঁছু ছাড়েনা মা। মনে করেন আমিও সেই অদৃশ্য ছায়া।”
আমার শ্বাশুড়ি এবার খুব গলা উঁচিয়ে বললেন “খুব সাহস বেড়েছে তোর নাহ? এখন তুই আমার মুখে মুখে তর্ক করবি এতোই সাহস।”
কিছু বললাম না। একটা পিচ্চি মেয়ের সামনে নিজের সম্মান আর নষ্ট করতে পারবোনা। কথার নাম নাকি লতা। আমি একটা বললে তারা হাজার টা বলবে তারচেয়ে ভালো চুপ থাকি এই মুহুর্তে। এক মাঘে কি আর শীত যায়? সময় আমারও আসতে পারে।
আমার নিরবতা দেখে আমার শ্বাশুড়ি নয়নাকে আহ্লাদী সুরে বললো “মা যাও রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। এই মেয়ের জন্য অনেক অনেক খাটা খাটনি করে ফেলেছো।” তারপর আমার উদ্দেশ্যে বললেন “নিজে তো একটা অপয়া বন্ধ্যা আবার আমার ছেলের নতুন বউকেও নিজের দলে নেওয়ার ধান্দা করছে।”
মাহিও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো “নয়না ভাবি তুমি প্লিজ একদম ঘেঁষবা না এই অপয়ার সাথে। আমরা তোমাকে অনেক আশা নিয়ে আমার ভাইয়ের বউ করে এনেছি।”

আমি চুপ হয়ে শুধু সবটা হজম করে যাচ্ছি। হঠাৎ নয়নার কঠিন গলার স্বরে তাকালাম ওর দিকে। নয়না বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে “ছিঃ আপনারা কি মানুষ? নেহাৎ আমার একটা দূর্বলতা আছে বলে বিয়েটা করতে রাজি হয়েছি নয়তো কখনোই আপনাদের মতো ছেঁচড়া পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াতাম নাহ।”

কথাগুলো বলেই হনহন করে হাটা ধরলো নয়না নিজের রুমের দিকে। থমথমে হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আমার শ্বাশুড়ি আর আমার ননদ। দৃশ্য টা যেনো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই ঘটে গেলো হুট করে। আমি তাদের কে কোনো পাত্তা না দিয়েই আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। দুপুর হতে চললো। ঠিক সময়ে খাবার না ফেলে যে খিদের জ্বা’লা’য় বেশ বিরক্ত হবে আমার পাগলটা। আয়ানের কথা মনে আসতেই কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হলো আমার মনে। মানুষটাকে ভুলা কোনোভাবেই সম্ভব নয় আমর পক্ষে।
পরক্ষণেই আবার খেয়াল হলো নয়নার বলা কথাটা। কি এমন দূর্বলতা ওর যার জন্য একজন পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী হতে এভাবে রাজি হয়ে গেলো কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া? আমার অজান্তে কি কিছু চলছে? সবটা কেমন জানি ধোঁয়াশা লাগছে।

সব কাজ শেষ করে গোসল সেরে ছাঁদে গেলাম কাপড়চোপড় শুকাতে দেওয়ার জন্য। কাপড়চোপড় দ’ড়িতে জুলিয়ে দিয়ে পেঁছনে ফিরতেই দেখলাম আমার খালা শ্বাশুড়ির ছেলে রোহান আমার দিকে কেমন জানি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোহান সদর দরজার ঠিক পাশেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত গুঁজে। বরাবরই এই ছেলেকে আমি পছন্দ করিনা, একটু অন্য ধাঁচের ছেলেটা তাই। নারী আসক্ত যাকে বলে। তাই আমি সবসময়ই ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করি। আমি দ্রুত পা চালিয়ে চলে যেতে নিলাম। ছাঁদের সদর দরজায় যেতেই খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে রোহান। রাগে গা জ্ব’লে উঠলো আমার। সাহস কি করে হয় এই ছেলের আমার হাত ধরার। আমি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও বলে উঠলো “শুনেছি তুমি নাকি বন্ধ্যা তাই আয়ান ভাই দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তুমি যেহেতু বন্ধ্যা সেহেতু একটা রাত দিতেই পারো আমাকে, কোনো সমস্যা হবেনা প্রেগন্যান্ট হওয়ারও চান্স নেই।”
রোহানের কথাটা শোনে মাথায় র”ক্ত উঠে গেলো আমার। এতোটা জঘন্য একটা পুরুষ হয় কেমনে। নিজের ভাইয়ের বউয়ের দিকে যে ছেলে কু’নজর দিতে পারে সে কখনোই কারো ভাই হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। আমি কোনোমতে হাতটা ওর থেকে ছাড়িয়ে ঠা’স করে চ’র বসিয়ে দিলাম ওর বাম গালে। সাথে সাথেই হতভম্ব হয়ে গেছে সে। রোহান কিছু বুঝার আগেই আমি বলে উঠলাম “সাহস হয় কি করে তোর আমার হাত ধরার। আরেকবার যদি এই দুঃসাহস করিস তবে আয়ানকে বলে দিবো আমি সব।”
এটা বলে আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে চলে আসলাম।
এতোটা রাগ হচ্ছে যে কিছুই ভালো লাগছেনা। এই ছেলে যতদিন এই বাড়িতে আছে সাবধানে থাকতে হবে আমায়। নিচে নামতেই চোখাচোখি হলো আয়ানের সাথে। আমার ঠিক এক হাত সামনে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। আমাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে আর হাঁপাতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো আমার দিকে। “কি হয়েছে? এভাবে নামলে কেনো ছাঁদ থেকে? ছাঁদে কি রোহান আছে?”
আমি কিছু না বলে অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আয়ানের দিকে। মানুষটা আজও আমার না বলা কথা এভাবে বুঝে গেলো আমার চোখ দেখে শুধুমাত্র। তাহলে কি এখনো আয়ানের মনে আমার জন্য ভালোবাসার ছিটেফোঁটা আছে? আমি এসব ভাবতে ভাবতেই অজ্ঞান হয়ে পরলাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি_____

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [০৫]
#ফারজানা_আক্তার

চারপাশ জোড়ে নিরবতা বিদ্যামন। মাথার উপর ভনভন করে সিলিংফ্যান চলছে। জ্ঞান ফিরতেই সবার আগে সিলিংফ্যানের অদ্ভুত শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো। ধীরে ধীরে চোখ মেলে সামনে তাকালাম। দেখি কেউই নেই সামনে কিন্তু আছে ওয়ালের সাথে লাগানো দেওয়াল ঘড়িটা যেটা আমার আর আয়ানের বিয়েতে আমার বেস্টফ্রেন্ড দিয়েছিলো। অদ্ভুত সুন্দর এই ঘড়িটা নাকি অনেক দোকান ঘুরে ক্লান্ত হয়ে খোঁজে কিনেছিলো আমার জন্য। বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলাম। এটা যে আমার হাতে যত্ন করে গুছানো সেই রুম টা যেটা এখন আর আমার নেই। তখনই মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম আমার ডানপাশে। নয়না বসে আছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে খুব যত্নে। মেয়েটার ছোট্ট মুখটা ভীষণ ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। এমন মনে হচ্ছে যেনো কোনো কিছুর জন্য ভয় পেয়ে রয়েছে। আমি ইশারা করে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আমার? নয়না নরম সুরে বলল “আপু আপনি কেনো নিজের শরীরের অযত্ন করছেন এতো? ডাক্তার উনাকে এত্তগুলো বকা দিয়ে গেলো। শুনলাম ডাক্তারবাবু নাকি উনার বন্ধু। আপনাকে ভাবি বলে সম্মোধন করলো।”
আমি খুব ধীরে কন্ঠে ওকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম “এসব পরে আগে আমায় বলো কি হয়েছে আমার? ডাক্তার কি বলেনি আমি হঠাৎ জ্ঞান কেনো হারালাম?”
“ডাক্তার বলেছে আপনার শরীর খুব দূর্বল। নিজের দূর্বলতা কি আপনি একটুও বুঝেননা আপু? আমি জানি আমার আগমনেই আপনার এমন অবস্থা। কিন্তু আপু আমি খুব খুব সরি। আমার জানা ছিলোনা এতোকিছু সম্পর্কে। ডাক্তাবাবু বলেছে আপনার ফুল বেড রেস্ট প্রয়োজন। দুশ্চিন্তার কারণেই আপনার শরীর এমন অসুস্থ হয়ে পরছে দিনদিন। আমার ভুলের জন্য নিজেকে এভাবে তিলে তিলে শেষ করবেননা আপু প্লিজ! আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা কখনো।”

এক নাগারে কথাগুলো বলে থামলো নয়না। আমি শুধু অবাক চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম আর ওর মুখে ফুটে ওটা অপূর্ব ধ্বনি শুনছিলাম। যত যাই-ই হয়ে যাক এই রুমে আমি কিছুতেই থাকবোনা। এই রুমের দিকে তাকাতেই তিক্ত লাগে। এই রুম জোড়ে যে আমার শত শত স্মৃতি সেগুলো আমি মনে করতে চাইনা আর। তবুও কি ভুলা যায় সেসব মধুময় স্মৃতি? মুছে ফেলা যায় মস্তিষ্ক থেকে পূর্বের সমস্ত মুহুর্ত? কিছু প্রশ্ন বরাবরই ভাসমান থেকে যায়। আমি নয়নার কথার কোনো জবাব না দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। মেয়েটা আবারো বলে উঠলো “এই কি আপু! উঠছেন কেনো? আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। উনি গেছেন ডাক্তারের কাছে।”
মেয়েটার নিষ্পাপ চাহনি আমায় বারেবার তার প্রতি দূর্বল করে চলেছে। আদৌ কি কেউ সতীনের সেবা করে এভাবে? ভাবতেই চিকন ঠোঁট মেলে হেঁসে দিলাম কিঞ্চিৎ। আমার হাসি দেখে নয়না কেমন জানি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। পিচ্চি টা হয়তো বুঝতে পারছেনা আমার মনের অবস্থা। আমার যে এই রুমে দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস থেমে থেমে যাচ্ছে। বুকপাঁজর টা ভার হয়ে আসছে। অতীতটাকে খুব করে ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে।
আমি বিছানা ছেড়ে খাট থেকে নিচে পা রাখতেই আয়ান হাতে করে কি জানি নিয়ে ফিরে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। আমিও ওর দিকে না তাকিয়ে চলে যেতে পা বাড়ালাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে ফেলে খপ করে আয়ান আর হুকুম করে চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসতাম। আমি ওর কথাকে পাত্তা না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নিতেই আয়ান শক্ত কন্ঠে বলে উঠে “এতো অবাধ্য হয়ে উঠবে মুহুর্তে তা ভাবতে পারিনি। যাইহোক এগুলো নিয়ে যাও। নিয়মিত খেয়ে নিও ঔষুধগুলো।”
আমি একটুখানি হাঁসার চেষ্টা করে বললাম “অবাধ্য তো হওয়ারই ছিলো আয়ান। যাইহোক তুমি তোমার মতো করে ভালো থেকো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। এই ঔষুগুলো তুমি ফেরত দিয়ে দিও, আমি আমার টাকায় ঔষুধ কিনে নিতে পারবো। জমানো টাকা আছে তো কিছু।”
আয়ান চোখ বন্ধ করে ফেলে। বুঝতে পারছি খুব রেগে যাচ্ছে। আয়ান রেগে গেলে খুব ভয়ংকর রুপ ধারণ করে। নতুন বউয়ের সামনে আর কোনো ঝামেলা করতে চাইনা। আয়ানের সামনে থেকে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু দরজার বাহিরে পা রাখতে পারলাম নাহ তখনই আমার শ্বাশুড়ি আর ননদ হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করে আর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে “কিরে নবাবজাদি এখনো নাটক শেষ হয়নি? নাকি আবারও আমার ছেলেটার মাথা নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস? কোনটা?”
আমি খুব ভদ্রতার সাথে বললাম “ছি মা কি বলছেন এসব? আয়ান আমার স্বামী, আমার নয় বছরের ভালোবাসা। ”

-আহারে ভালোবাসা! তুই হলি আমার ছেলের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ।
কটমট করে বলল আমার শ্বাশুড়ি কথাটা। আমি আঁড়চোখে আয়ানের দিকে তাকালাম। একবছর ধরে আয়ানের সামনেই ওর মা বোন আমার সাথে এমন ব্যবহার করে কিন্তু কখনোই আয়ান প্রতিবাদ করেনা। এখনো আয়ান শক্ত করে চোখ মুখ খিঁচে রেখেছে। কান দুটো টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে ওর যেটা আজ নতুন না। সবসময়ই রাগ কন্ট্রোল করে এভাবে হাতের আঙ্গুল মুষ্টি করে চোখ বন্ধ রেখে। তাই আশা ছেড়ে দিলাম ওর থেকে। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে চুপ দেখে আবারো বলল “তোর জন্য তো আমার বোন আর বোনের ছেলেকে এই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। তুইও বেশিদিন আর টিকতে পারবিনা এই বাড়িতে। যা এখন সবার জন্য টেবিলে খাবার সাজা, দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে। ”

আর সহ্য হচ্ছে না। হজম করতে পারছিনা কথাগুলো তাই ত্যাগ করলাম সেই রুম যেটার প্রতিটি জিনিস আমার ছোঁয়ায় সেজেছে। রান্নাঘরে এসে সবার জন্য খাবার বেরে টেবিলে নিয়ে যেতে হবে। সবকিছুর মধ্যে নয়না মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সব পর্যবেক্ষণ করেছে আর চোখের পানি ফেলেছে যা আমার চক্ষু এড়ায়নি। ঠিকই লক্ষ করেছি আমি মেয়েটার দিকে। হয়তো শ্বাশুড়ির এমন ব্যবহার সে মানতে পারছেনা। কিন্তু আমাকে তো মেনে নিতে হচ্ছে। এতকিছুর পরেও কেনো আয়ান ডিভোর্সের কথা বলছেনা আমায়? আমি যে আর পারছিনা। শরীরটা প্রচুর দূর্বল। হাঁটতে পারছিনা ঠিক মতো। তবুও তো কাজগুলো আমাকেই করতে হবে। একজন কাজের মহিলা ছিলো কিন্তু উনিও নাকি অসুস্থ তাই আসতে পারছেনা কয়েকদিন ধরে। হুট করে মনে পরলো রোহানের কথা। আমার ঠিক মনে আছে জ্ঞান হারানোর আগে আয়ান রোহানের কথাই বলছিলো। তবে কি আয়ান কিছু করেছে রোহানের সাথে নয়তো আমার শ্বাশুড়ি কেনো বললো যে রোহানকে আমার জন্য এই বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। সব এলোমেলো লাগছে কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা। যদি আমার এতো চিন্তা আয়ানের তবে কেনো সে আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো, কেনো একবছর ধরে বিভিন্ন বাহানায় দূরত্ব সৃষ্টি করলো? ঝিম ধরে আছে মাথাটা। কিছুই বুঝতে পারছিনা চারপাশে কি হচ্ছে। কেনো এতো এতো রহস্যময় লাগছে সব? মনে হচ্ছে আমার অজান্তে নিশ্চয়ই কিছু চলছে যা আমি বুঝতেছিনা। আমি একটা একটা করে সব খাবার সাজিয়ে নিয়েছি এবার শুধু ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাওয়ার পালা। তখনই নয়না আসে আর আমার সাথে সব খাবার ডাইনিংয়ে নিয়ে আসে। আমি কিছু বলিনি চুপ থেকেছি কারণ আমি জানি নয়নাকে বাঁধা দিলেও সে মানবেনা আর আমার শ্বাশুড়ি দেখলেও সেই আমার উপরেই দোষটা দিবে। নিজের ভাগ্যের উপর বড্ড বেশি হাঁসি পাচ্ছে।

*
সবাইকে খাইয়ে আমিও খেয়ে নিয়েছি। আমি খেতে চাইনি কারণ খাওয়ার প্রতি মোটেও রুচি নেই। কেনো জানি আজকাল পানি ছাড়া কিছুই খেতে ইচ্ছে করেনা। কথায় আছে মন খারাপ হলে শরীরও খারাপ হয়। আমারও তাই। মনের সাথে শরীরটাও বেঁকে বসেছে। মনে হচ্ছে যেনো কোনো সমুদ্রের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে।
নয়না মেয়েটা অনেক জোরাজোরি করে নিজ হাতে খুব যত্ন করে খাইয়ে দিয়েছে আমায়। মেয়েটার যত্নগুলো একদম অন্যরকম। মনেই হয়না যে মেয়েটার সাথে আজকেই প্রথম পথ চলা। আয়ান দুপুরে খেতে ডাইনিংয়ে আসেনি। নয়না ওকে রুমে দিয়ে এসেছিলো খাবার। আমার শ্বাশুড়ি খেতে বসেই বিলাপ ধরেছিলো রোহানের জন্য কারণ ও নাকি বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে বলে আমাকে তা রান্না করতে বলা হয়েছিলো কিন্তু তা আমি একটু আগেই জানলাম। রোহানের এভাবে চলে যাওয়াটা আর আমাকে দোষারোপ করাটা সব কেমন জানি আয়ানের উপর সন্দেহের সৃষ্টি করছে। মানুষটা কি চাই আসলে? কেনো এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করছে? কেনোই বা স্পষ্ট করে কিছু বলছেনা। এসব ভাবতে ভাবতে ফ্লোরে বিছানা পেতে শুয়ে পরলাম। বিকালের ঘুমটা যদি একটু ক্লান্তি দূর করে সেই আশায়। দরজায় ছিটকিনি লাগাইনি কারণ যদি কেউ এসে ডাকাডাকি করে আবার। একদম শোয়া থেকে উঠতে ইচ্ছে করেনা তারউপর আবার নিচে থেকে উঠা খুবই কষ্টকর, অভ্যাস নেই তো।
অনেক ভেবে চোখ টা বন্ধ করলাম। তন্দ্রা প্রয়োজন এই মুহুর্তে খুব করে। তখনই দরজার শব্দে চট করে চক্ষু খুলে হতবাক হয়ে গেলাম। সেই ঔষুধের পেকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান আমার সামনে। আমি শুয়েই রইলাম, মোটেও ইচ্ছে করছে না উঠতে। আয়ান আমাকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলো আমার দিকে। তবুও আমি শোয়া থেকে উঠলাম না। আয়ান হয়তো তেমন অবাক হয়নি কারণ আমার শরীর যে দূর্বল তা আয়ান বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। আমি শোয়া থেকেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম “কি চাই এখানে? খুব বেশিই দরদ উথলায় পরছে নাকি বন্ধ্যা মেয়েটার জন্য?
হঠাৎ খুব রেগে গেলো আয়ান আমার এমন কথায় আর হুট করেই____

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here