ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০৬,০৭

0
316

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০৬,০৭
#ফারজানা_আক্তার
০৬

ঠা’স করে দরজা বন্ধ করার শব্দে কেঁপে উঠলাম কিঞ্চিৎ। এতোটা জুরে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো যে আয়ান আমি ভয়ে দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসি আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। আয়ানের রাগ থাকলেও সে স্বাভাবিক ভাবে আমার পাশে বসে আর হাতে করে আনা পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি অন্যদিকে মুখ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছি। অভিমানের বেড়াজাল ভে’ঙে এই বুঝি অশ্রু বৃষ্টি শুরু হবে। আয়ান দাঁত চেপে বলে “বোতলটা হাতে নাও, আজ এমনিতেই মেজাজ খারাপ প্রচন্ড তারউপর তোমার এমন বিরক্তিকর অভিমান ভালো লাগছেনা। সত্যি বলতে কি জানো তোমাকেই ভালো লাগেনা আর আমার।”
কথাটা বলতে বলতে আয়ান আমার হাতে পানির বোতলটা ধরিয়ে দিয়ে একটা একটা করে সব ঔষুধ খুলেছে। আমার হাতে ঔষুধগুলো দিয়ে বলে কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেতে। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিয়েছি কোনো বাহানা না করে। আমার বালিশের পাশে ঔষুধের প্যাকেট টা রেখে আয়ান আবার বলে “নিয়ম করে সময়মতো খেয়ে নিও প্লিজ। অযথা নাটক আর করিওনা।”
এটা বলেই আয়ান চলে যায়। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি মানুষটার যাওয়ার দিকে। একটু আগে আয়ান বলল ওর নাকি আমায় আর ভালো লাগেনা। কথাটা একবছর ধরেই বলে যাচ্ছে আয়ান তাই আজ ওর এহেন কথায় নতুন করে অবাক হলাম না। কারণ আমি জানি এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আয়ান যতবারই এমন কিছু বলেছে ততবারই ওর চোখ ছিলো নিচের দিকে কিংবা অন্যদিকে। আমার চোখে চোখ রেখে কখনোই সে এমন কথা বলার সাহস পায়নি আর আজও তাই। আমি জানি আয়ান এখনো আমায় ভালোবাসে আর আয়ান কেনো এমন করছে কেনো নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে কেনো আয়ান চাই আমি অত্যাচার গুলো সহ্য করতে না পেরে চলে যায় সব রহস্য আমি উন্মোচন করবোই তবে একটু সময় লাগবে আমার। আমি কিছুতেই আমার নয় বছরের ভালোবাসাকে হারতে দিবোনা কখনোই না। নয়না মেয়েটার জন্যও চিন্তা হচ্ছে আবার। মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই।

*
বিকালের দিকে ঘুম ভা’ঙ’লো বিচ্ছিরি রকমের চেঁচামেচির শব্দে। আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আমার শ্বাশুড়ি ননদ চেঁচামেচি করেই চলেছে আর গালাগালি তো আছেই। অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি তবুও চুপচাপ শোয়া থেকে উঠে বসলাম বড্ড বেশি দূর্বল লাগছে। একদমই সাই দিচ্ছে না শরীরটা উঠে দাঁড়াতে। তবুও উঠলাম। উঠে দরজায় যেতেই তাদের হুকুম মেহমান আসবে নাস্তা তৈরি করতে হবে আমায়। আর মেহামনদের সামনে যেনো একদম বেশি কথ না বলি। আমি মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালাম। কথা বলতেও যেনো শক্তি পাচ্ছিনা। ওরা চলে গেলো হুকুমজারি করে। যাওয়ার আগে আমার ননদ বলে গেলো আর অসুস্থতার নাটক না করে দ্রুত কাজে লেগে যাও। ওর কথায় একটুখানি মৃদু হেঁসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসে আছরের নামাজ পড়লাম। মোনাজাতে ইচ্ছেমতো কেঁদেছি। খুব ইচ্ছে হলো আজ কাঁদতে। নামাজ শেষে হেলেদুলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। রান্নাঘরে গিয়ে আমি শুধু অবাক হয়নি বরং প্রচন্ডরকম অবাক হয়েছি। ফ্রীজ চেক করতেই দেখলাম খুব সুন্দর করে শরবত বানিয়ে কেউ আগে থেকেই রেখে দিয়েছে ঠান্ডা হওয়ার জন্য। কড়াইয়ে দেখলাম নুডলস আর পাতিলে পায়েশ। এসব দেখে চোখ যেনো বড় বড় হয়ে গেলো রসগোল্লার মতো। নুডলসের জন্য খুব চিকন চিকন করে সালাদ কাটা আর সস দেখলাম টেবিলের উপর রাখা আছে। পায়েসের জন্য কিসমিসও রাখা আছে একটা চিনির বাটিতে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। আমি শুধু চোখ বুলিয়ে দেখছি চারপাশ টা। তখনই পেঁছন থেকে একটা পরিচিত কন্ঠে ভেসে আসলো “দুজনের জন্য এইটুকু যথেষ্ট আপু। চিন্তা করোনা। বাকি নাস্তা তো ওরা আসার সময় নিয়ে আসবেই তাই আর ঝামেলা করিনি। ওরা তো আর খালি হাতে আসবেনা তাইনা? তোমার বেডরেস্ট প্রয়োজন আপু।”
কিছু বললাম না নয়নার কথার প্রতিত্তোরে। কিন্তু মেয়েটার চাহনি দেখে বুঝলাম সে আমার থেকে উত্তরের অপেক্ষায় আছে। আমাকে চুপ দেখে নয়না আবারো বললো “তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কি রাগ করেছো আপু?”
এমন কথা শোনে আর চুপ থাকতে পারলাম না, মিহি কণ্ঠে বললাম “না বোন কোনো রাগ নেই আমার। তোমার যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবে ডেকো, কেমন?” কথাগুলো খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করলাম। আমার একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই চুপচাপ রাতের খাবার তৈরি করতে লেগে গেলাম অবশ্য নয়নাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। একটু পর মাগরিবের আজান দিবে। মেয়েটা আবারো খুব অনুরোধের সুরে আমায় বললো ওকে যেনো ‘তুই ‘ করে বলি এখন থেকে। আমিও মাথা নেড়ে সাই দিলাম। মনে মনে খুশি হলাম কিছুটা। মেয়েটা সত্যিই কি বোন ভাবে আমায়?? মনের মাঝে প্রশ্ন জাগলো খুব করে।

*
সকালে আজানের সুমধুর ধ্বনিতে ঘুম ভাং’গে আমার। বন্ধ চোখেই শুয়ে থাকি আরো কিছুক্ষণ। জাগলেও শোয়া থেকে উঠার শক্তি পাচ্ছিনা যেনো। ক্লান্ত লাগছে। দূর্বলতা জড়িয়ে ধরেছে। খানিকপরে ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। চুলগুলো হাত খোঁপা করলাম। শাড়ির ভাজটা ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ালাম। নামাজটা যে পড়তে হবে। আমার বিয়ের পরে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র থ্রি পিচ পরিধান করেছিলাম আমি কারণ আয়ান সবসময়ই শাড়িতে দেখতে চেয়েছে আমায়। আয়ানের ভাষ্যমতে শাড়ি ছাড়া অন্যকিছুতে আমায় তেমন একটা আকর্ষণীয় দেখায় না। শাড়িতেই আয়ান মুগ্ধ হয় রিহানার ভালোবাসায় সিক্ত হয়। কিন্তু আজ সবই অতীত।
ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে হেলেদুলে রুমে আসলাম। নামাজ শেষ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
গতকাল সন্ধ্যায়। নয়নার বান্ধবী আর খালাতো বোন এসেছিলো। মেয়ে দুটোও ঠিক নয়নার মতো। খুব মিশুক। ওর আসার আগেই নয়না আমার শ্বাশুড়ি আর ননদের কাছে খুব রিকুয়েষ্ট করেছে উনারা আমার সাথে যেনো ওদের সামনে খারাপ আচরণ না করে। এতে ওরা বাসায় গিয়ে বদনাম করবে এমন কিছুটা বলে মানিয়ে নিয়েছিলো মা মেয়েকে। আমিও সব শুনেও না শোনার মতো হয়ে নিজের মতো কাজে ব্যস্ততা দেখিয়েছি। ওরা এসে ঘন্টাখানেক থেকেই চলে গেছে কিন্তু রাতের খাবার টা খেয়ে যায়নি কোথাও একটা দাওয়াত আছে এমন অজুহাত দেখিয়ে চলে গেলো। তবে আমি জানি নয়না-ই ওদেরকে বলেছে এমনটা বলতে। মেয়েটা বেশ দূরন্ত।

*
চিলেকোঠায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। বিকালে সবাই ঘুমাচ্ছে। আজ আমার একদমই ঘুম আসছিলোনা তাই মৃদু বাতাসে নিজেকে বিলিয়ে দিতে এসেছি। স্টোর রুমে কোনো জানালা না থাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে ঘরটাই তবুও আয়ানের ভালোবাসার জন্য মেনে নিয়েছি সব কিন্তু আর কত? অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে যে বুঁকপাজরে। আমি চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিচ্ছি, স্বস্তি লাগতেছে কিছুটা। তখন পেঁছন থেকে এক পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি নয়না দাঁড়িয়ে আছে। হলুদ জামা পরিধান করেছে মেয়েটা। দেখতে একদম হলুদ পরী লাগছে। আমার পাশে এসে ক্ষীণ স্বরে উচ্চারণ করলো “আপু তোমার প্রয়োজন বেডরেস্ট আর তুমি কিনা এখানে দাঁড়িয়ে আছো? উনি দেখলে তো খুব বকা দিবে আবার তোমাকে।”

“তোর উনিকে আমি ভয় পাইনা।”
শক্ত কণ্ঠেই একটুও সময় না নিয়ে বলে ফললাম কথাটি। মেয়েটা আমার কথা শোনে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। এই প্রথম এই মেয়ের হাসি দেখলাম। প্রাণ খুলে হাসলো মেয়েটা। এর মাঝেই আমি কল দিলাম রিদিমার আম্মু শাহানা খালাকে। যিনি আমাদের বাসায় কাজ করেন। উনি এখন একটু সুস্থ হয়েছেন বললেন। মূলত উনার খোঁজ নেওয়ার জন্যই কল দেওয়া উনাকে। উনার মেয়ে রিদিমা ক্লাস ১০এর ছাত্রী। মেয়েটা খুব মিষ্টি। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে আসে এই বাড়িতে। আমার সাথে খুব একটা ভাব ওর। ভাবি বলেই সম্মোধন করে আমায়। মেয়েটার সাথেও একটু কথা বলে নিলাম। মানুষগুলো পর হলেও কিছুটা মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এদের সাথে কথা বলে। আমি রিদিমা আর ওর মায়ের সাথে কথা বলে কল কেটে দৃষ্টি রাখলাম টুকরো টুকরো উড়ে যাওয়া মেঘের ভাজে। একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলাম। মনটা কিছুটা হালকা লাগছে। দুই একদিনের মধ্যেই শাহানা খালা আসবেন বলেছেন। নয়না অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ঠিকই লক্ষ করেছি কিন্তু কিছু বলছিনা। মেয়েটা যতই ভালো হোক তবুও এই মেয়ের সাথে ভাব জমাতে কেনো জানি ইচ্ছে করেনা কিন্তু মেয়েটার মায়াবী মুখের দিকে তাকাতে বড্ড বেশি ভালো লাগা কাজ করে। মেয়েটার চেহারাই স্পষ্ট বুঝা যায় কিছু একটার অপূর্ণতা আছে মেয়েটার মাঝে। কিন্তু কি হতে পারে? আর গতকাল কোন দূর্বলতার কথা-ই বা বলেছিলো স্পষ্টভাবে সবার সামনে।

“আপু কি ভাবছো এতো? চলো নিচে যাবো। একটু বিশ্রাম নিবে এখন।”
নয়নার এই যত্ন মাখা কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। নয়নার দিকে তাকালাম, ভ্রু কুঁচকে টান টান কণ্ঠে বললাম “তুই যা বোন। আমার ভালো লাগছেনা। আমি চিলেকোঠায় সময় কাটাবো কিছুক্ষণ। আর হ্যাঁ তোর উনি যদি বাসায় থাকে আছরের নামাযের পর কফি দিস এক মগ। বাসায় থাকলে ওই সময় কফি প্রয়োজন হয় ওর। আগামীকাল থেকে তো আবার চাকরি আছে।”

নয়না আর কিছু বললোনা। চুপচাপ নিচে চলে গেলো। মেয়েটা কেমম জানি। আমার সাথে ছাড়া কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলতে দেখিনা ওকে। হয়তো ওরা আমার সাথে খারাপ আচরণ করে বলেই ওদের থেকে দূরত্ব রেখে চলে সে।

নয়না চলে যেতেই আমি চিলেকোঠায় পা রাখলাম। ছোট্ট একটা জানালা আছে সেটা খুলে দিতেই দক্ষিণা বাতাসের প্রবেশ। চোখ বন্ধ করে জানালায় মুখ রেখে কিছুক্ষণ অনুভব করলাম সুন্দর মুহুর্ত টা। দিনের বেলা এমনিতেই টুকটাক আলো থাকে ঘরে তাই আর বাত্বি জ্বা’লা’নো’র প্রয়োজন হয়না। একটা ছোট্ট খাট আছে এই ঘরে যেটাতে শুধু একজনই থাকতে পারবে। মাঝে মাঝে আমার সাথে অভিমান করে আয়ান এখানে এসে থাকতো। আমিও চুপটি করে এসে ওর বুকের সাথে মিশে যেতাম। তখন আর অভিমান করে থাকতে পারতো না আয়ান আমার সাথে। এই ঘরে আরেকটা জিনিস আছে যা খুব আকর্ষণীয়। একটা বুকশেলফ, যেটা আয়ান আমাদের বাসর রাতে আমাকে গিফট করেছিলো। তারপর থেকে প্রতিমাসে একটা করে বই আনতো আমার জন্য আমিও খুব তৃপ্তি নিয়ে পড়তাম। আমার আবার হুমায়ুন আহমেদ এর বই বেশ লাগে। তাই হুমায়ুন আহমেদ এর বই বেশি আনতো আবার পাশাপাশি ইসলামিক বইও আনতো প্রচুর। হাত বুলিয়ে দিলাম আলতো করে সবগুলো বইতে। একবছর ধরে কোনো বই যোগ হয়নি এই পুরোনো বইগুলোর সাথে। ধীরে ধীরে একদম বদলে গেলো আমার আয়ান টা কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা। বুক ছিঁ’ড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। চোখ বেয়ে জল আসতে চাইলে তা আঁটকিয়ে নিলাম। কান্না আঁটকাতে গিয়ে গলা আর চোখ ব্যাথা হয়ে আসলো। কন্ঠনালী ভার হয়ে আসলো।
হঠাৎ দরজায় কটকট শব্দ হতে চোখ তুলে তাকালাম সেদিকে। একটু অবাক হলাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে কারণ আমার বিয়ের পর থেকে কখনোই আমি উনাকে এই ঘরে আসতে দেখিনি। ছাঁদে মাঝে মাঝে আসলেও এই ঘরের দিকে ফিরেও তাকান না তিনি কারণ আয়ান নাকি একপ্রকার জোর করেই সবার অমতে এই চিলেকোঠা তৈরি করে। আর এই মানুষটার অনুমতি না নিয়েই এই কাজ টা করে আয়ান। এই মানুষটা নাকি মোটেও রাজি ছিলেননা ছাঁদের অর্ধেক অংশ এভাবে নষ্ট করতে। উনার ভাষ্যমতে ঘরের ভেতরে পর্যাপ্ত রুম থাকতে এখানে কেনো রুম করতে হবে আবার? ছাঁদ খোলামেলা না হলে কি সৌন্দর্য থাকে?
আমি অবাক হলাম খুব। বড় বড় চোখ করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি মানুষটার দিকে। মানুষটাকে নিশ্চুপ দেখে আমি নিজ থেকেই বললাম “আপনি হঠাৎ এই চিলেকোঠার দরজায় কি মনে করে?”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [০৭]
#ফারজানা_আক্তার

দক্ষিণা বাতাসে খোলা চুল উড়ছে। বাতাসে ভেসে আসছে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। টুকরো টুকরো মেঘ যেনো ডাকছে আমায় দু’হাত বাড়িয়ে। রোদের উত্তাপ কমে এসেছে। চারিদিকে আছরের আজানের সুর। কান মেলে শুনছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। এই সুরের কাছে যে পৃথিবীর সবকিছু হার মানে। এই চিলেকোঠায় জানালার কাছেই একটা কেদারা রাখা আছে সেইটাতে বেশ আরাম করেই বসে আছি। চুলগুলো হাত খোঁপা করে মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিলাম।

একটু আগে আমার শ্বশুড় এসেছিলো এই ঘরে। এই চিলেকোঠায় আজ প্রথম প্রবেশ ছিলো আমার শ্বশুড়ের। আয়ানের উপর রাগ করে এই চিলেকোঠার দিকে কখনো চোখ তুলেও তাকাননি এতোগুলো বছর। শুনেছি আমার বিয়ের আগে আয়ান বাসায় যতক্ষণ থাকতো এই চিলেকোঠায় সে সময় কাটাতো। আমার শ্বশুড়ের চোখ ছলছল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মানুষটা ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভে’ঙে পরেছে। আমি দ্রুত কেদারা টা টেনে উনাকে বসতে দিলাম। চিলেকোঠার এক পাশে ছোট্ট একটা ফ্রিজ আছে, সেটা থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এনে দিলাম। ঢকঢক করে খেয়ে নিলো সব পানি। ছোট বোতল ছিলো বিদায় পানিও কম ছিলো পরিমাণে। আমি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কারণ উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি কিছু বলবেন। তাই উনাকে সুযোগ আর সময় দু’টোই দিলাম। এই সময়ে আমার শ্বাশুড়ি ননদ দু’জনই ঘুম থাকে তাই এখানে আসার সুযোগ পেয়েছেন আমার শশুড়। আছরের আজানের পর সবাই উঠবে ঘুম থেকে ধীরে ধীরে।
আমার শ্বশুড় বেশ কিছুক্ষণ পর আমার হাতে একটা কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলেন “মা এই ঘরে এই একবছর ধরে তোমার সাথে অনেক অন্যায় হচ্ছে কিন্তু তুমি সব মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছো। মেনে নিচ্ছো সব অন্যায়। আর আমি চেয়েও কিছু করতে পারছিনা তোমার জন্য। তোমার এই সরলতা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। তোমাকে আমি নিজের মেয়ের মতোই জানি, মাহি আমার কাছে যেমন তুমিও ঠিক তেমন। আমি জানি ওরা যতই খারাপ আচরণ করুক তোমার সাথে কিন্তু তুমি কখনোই ওদেরকে অবহেলা করবেনা, অসম্মান করবেনা। আমার বিশ্বাস ওরা একদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং অনুতপ্ত হবে। মা তুমি হলে আমার ভরসা। তোমার উপর ভরসা রেখে আমি নিশ্চিন্তে সুখের ঘুম দিতে পারবো। আমি জানিনা কখন কি হয়ে যায় তবে সময় বড্ড কম আমার। পৃথিবীর নির্মম পরিস্থিতির কাছে আমরা কেবলই দর্শক। কার ভাগ্য কখন রং বদলায় তা কেউ-ই বলতে পারেনা শুধু নির্বাক দর্শকের মতো পর্যবেক্ষণ করে। তুমি আমায় কথা দাও মা আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি এই পরিবারের হাল ধরবে, সবাইকে গুছিয়ে একসাথে রাখবে, কাউকে ভেং’গে পড়তে দিবেনা, সবাইকে আগলে রাখবে। কথা দাও মা কথা দাও। আমি যে তোমার উপর আস্তা রেখে স্বস্তি পাই।”

উনার কথা শোনে চোখের অবাধ্য নোনাজল আর ধরে রাখতে পারলাম না। নাক টেনে টেনে কেঁদেই যাচ্ছি সাথে শ্বশুড় আব্বাও কাঁদছেন কিঞ্চিৎ। পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই তাই হয়তো এতো অস্পষ্টভাবে কাঁদছেন উনি। উনি আমার সামনে তার ডানহাত টা পেতে রেখেছেন কথা নেওয়ার জন্য আমি একটা ঢুক গিললাম তারপর নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে বললাম “আব্বু আপনি এসব কেনো বলছেন হঠাৎ। কিছু হবেনা আপনার আমরা আছি তো সবাই। কি হয়েছে বলুন আপনার?”
উনি ক্ষীণ হাসলেন আর স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন “আগে কথা দাও মা আমার সব কথা তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমার যে সময় ফুরিয়ে এসেছে মা। তোমার শ্বাশুড়ি এই বয়সে এসব মেনে নিতে পারবেনা তাই তোমাকে বলে যাচ্ছি সব। কথা দাও মা কথা দাও।”
উনার এই কথাগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য কষ্টের হাঁহাকার।
আমি আর কিছু না ভেবেই কথা দিলাম যা হয়ে যাক না কেনো কখনোই এই পরিবার ছেড়ে যাবোনা। যুদ্ধ করে থাকতে হলে নাহ হয় থাকবো। তবুও এই পরিবারকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো। তারপর আমার শ্বশুড় আবার বলে “যাক তাহলে এবার ম’রে’ও শান্তি পাবো৷ তুমি আমাকে স্বস্তি দিলে মা।”
আমি চোখের জল মুছে বললাম “আব্বু আপনি কেনো এতো চিন্তা করছেন। আমাদের জন্য হলেও আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। আপনার মাঝেই তো আমাদের সবার প্রাণ।”
আমার শ্বশুড় একটুখানি মৃদু হাসলেন। আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। মানুষটাকে দেখে হঠাৎ করে আজ খুব মায়া হতে লাগলো। আমাকে আরো বেশি অবাক করে দিয়ে হুট করে আমার শ্বশুড় উচ্চারণ করলো “এই কাগজের প্যাকেটে একটা খাম আছে। এই খাম টা তুমি এখন খুব যত্ন করে রেখে দিবা। আমার মৃত্যুর পর তুমি এই খাম টা খুলে দেখবে কিন্তু খবরদার আমর মৃত্যুর আগে এই খামে যেনো তোমার দৃষ্টি না যায়। আমার বিশ্বাস টাকেও খুব যত্নে পুষে রেখো মা। আসছি।”
এটা বলেই চোখের কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটি খুলে দু-চোখ আঙ্গুলের সাহায্যে খুব সাবধানে মুছলেন তার আবার চশমাটা চোখে পরলেন। তারপর একদম ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে আমার চোখের আঁড়াল হয়ে গেলেন। নিজের রুমে গিয়েছে হয়তো নয়তোবা পুকুর পাড়ে।
আমি একটা লম্বা শ্বাস নিলাম। আজ খুব অদ্ভুত লেগেছে এই মানুষটাকে আর উনার কথাগুলোও। কেমন জানি ভাবাচ্ছে আমায়। আমি খাম টা একটা বইয়ের ভাজে রেখে দিলাম প্যাকেট টা সহ। এই ঘরের চাবি যেহেতু আমি ছাড়া আর কারো কাছে নেই তাই এটাই আমার জন্য সেভ জায়গা। আয়ানও একবছর ধরে এখানে আসেনা। একদম পাল্টে গেছে আমার আয়ান টা।

*
রাতে সবার খাওয়া শেষে আমি বসলাম খেতে। নয়না সবার জোরাজোরিতে সবার সাথেই খেয়ে নিয়েছে। আয়ান এখন প্রায় সময়ই বাহির থেকে খেয়ে আসে। আমিও সেধে আর কিছু জিগায় না। আয়ান আমার দিকে তাকায় আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো সেই আশায় কিন্তু আমি ওর সব আশাকে মাটি করে দেয়।
খেতে বসে দেখি আমার শ্বশুড় খুব ভালো মেজাজে আছে আজ। খুব হাসিখুশিতে খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। খাওয়ার মাঝে আমার শ্বাশুড়ির সাথে টুকটাক খুনসুটিও করলো। বিকালের সাথে এখনের কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। বিকালের বিরহ চেহারার সাথে এই উজ্জ্বল চেহারার কোনো মিল খুঁজে পেলাম না। কেমন জানি সন্দেহ সৃষ্টি হতে লাগলো আমার মনে। কিন্তু কিছু তো শেয়ার করাও যাবেনা কারোও সাথে। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছিনা। ওই খামটাতে এমন কি আছে যে আমি ওটা এখন দেখতে পারবোনা?
এসব ভাবতে ভাবতে এক লোকমা ভাত মুখে দিলাম। নয়না আমার পাশে বসে আছে। কত করে বললাম রুমে যেতে, আয়ানকে একটু সময় দিতে কিন্তু মেয়েটা কোনো কথায় শুনলোনা। আমিও চুপচাপ খেয়ে উঠে সব থালাবাসন ধুয়েমুছে রেখে, বাকিসব গোছগাছ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালাম হাতে একটা পানির বোতল নিয়ে। মেয়েটাও আমার সাথে সাথে সব কাজে হাত লাগিয়েছে। বিছানায় বসে ঔষুধ খেয়েদেয়ে শুয়ে পরলাম। চোখ বুঁজতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম সব ক্লান্তি ছেড়ে।

*
আয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রান্নাঘরে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে “অফিসের কার্ড টা রেখেছো কোথায়? এতো বিরক্ত কেনো করো আমায়? সারা ঘর খুঁজেও পেলাম না কার্ডটা।”
আয়ানের কথায় আমি আর নয়না একসাথেই ওর দিকে তাকালাম। তারপর নয়না ধীর কণ্ঠে খুব স্বাভাবিক ভাবে আমায় বলে “আপু তুমি যাও উনাকে কার্ড টা খুঁজে দিয়ে এসো। আমি তাদের দু’জনকে কিছুই বললাম না। হাতের কাজ টা রেখে চুপচাপ আয়ানের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম ইচ্ছে না থাকা সত্বেও। চাইলেও এখন আর এই রুমটাকে আমার রুম বলতে পারিনা। রুমে গিয়ে ওয়ারড্রব খুলে ড্রয়ার থেকে কার্ডটা বের করলাম। সেদিন বাসর ঘর সাজাঁনোর সময় সব গুছিয়ে রাখার সময় এটাও ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম সাবধানে। আয়ান আমার পেঁছন পেঁছন আসলো। আমি মুখে কোনো কথা না বলে আয়ানের দিকে এগিয়ে দিলাম কার্ডটা। আয়ানের মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ভীষণ কষ্টের রেখা। এই এক বছরে আয়ান আমাকে অবহেলা করলেও আমি সারাক্ষণ ওর আগে পিছে পরে থাকতাম কিন্তু ইদানীং আমি নিজেই ওর থেকে দূরত্ব রেখে চলাফেরা করি যা হয়তো সে মেনে নিতে পারছেনা। আয়ান চোখমুখ শক্ত করে বলে আমায় “আমার কোনো জিনিসেই হাত দিবেনা তুমি আর? সহ্য হয়না তোমাকে আর কেনো বুঝোনা।?”

“শুধু একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো কথাটি। কথা দিচ্ছি এই এক জীবনে তোমার দৃষ্টির সীমানায় আর ঘেঁষবো না।”

“কি প্রমাণ করতে চাও কি তুমি?”

” ভালোবাসো কিনা তা।”

“নয় বছর আগের আয়ান ভেবে ভুল করিওনা রিহানা। অনেক পরিবর্তন এসেছে এই নয় বছরে।”

“আমিও তো সেটাই বলি। একবার শুধু চোখে চোখ রেখে বলো তি’ক্ত’তা ছড়ানো কথাগুলো।”

“তোমার সাথে কথা বলাও আমার জন্য সময় নষ্ট শুধু।”

কথাটি বলেই আয়ান অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো। মুচকি হেঁসে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। মানুষটা আবারো প্রমাণ করে গেলো সে আমায় বড্ড বেশি ভালোবাসে।

*
গুনে গুনে ১৫দিন হয়ে গেলো আয়ানের দ্বিতীয় বিয়ের কিন্তু সময় আর অবস্থা যেনো এখনো সেখানেই থমকে আছে। এই ১৫দিনে নয়নার সাথে ভাব জমে গেলো বেশ কিন্তু আমি তেমন একটা আগ বাড়িয়ে কখনোই নয়নার সাথে কথা বলিনা। কষ্ট হয় আমার ভীষণ। এই কষ্টের শেষ কোথায়? বড্ড বেশি একাকিত্ব অনুভব করি রোজ। যে মানুষটা আমাকে বুকে না জড়িয়ে ঘুমাতে পারতোনা সে কিভাবে এতোগুলা দিন আমাকে ছাড়া ঘুমাচ্ছে বুঝতে পারছিনা। আমার চোখের নিচের কালিগুলো আরো বেশি গাঢ় হলো।
আমি ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু কাজ করছিলাম। নয়না হয়তো গোসল করতে গেছে। মাহির ছেলে নিয়ান হঠাৎ এসে আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় বলে “মামণি কোলে নাও।” তিন বছরের ছেলের মুখে উচ্চারিত হওয়া মামণি শব্দ টা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি জন্ম দিলো আমার মনে। খুশিতে গদগদ হয়ে কোলে তুলে নিলাম নিয়ানকে। নিয়ানকে কোলে নিয়ে খুব করে আদর করতেছি। সঠিক সময়ে সন্তান জন্ম দিলে হয়তো আমার সন্তানের বয়স এখন ৭/৮ হতো।
হঠাৎ কোথায় থেকে জানি হনহন করে মাহি এসে আমার কোল থেকে নিয়ানকে কেঁড়ে নিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে দেয় আমায়। মাহির বলা অনেক কথার মাঝে একটা কথা ছিলো “নিজে তো সন্তানের মুখ কখনো দেখবেনা। অপয়া একটা, আবার আমার ছেলেকেও আমার থেকে কেঁড়ে নিতে চাও। শুনে রেখো যতদিন আমি এই বাসায় আছি ততদিন তুমি আমার ছেলেকে কোলে নেওয়া তো দূরের কথা আমার ছেলের দিকে তাকাবেও না। আমি চাইনা কোনো অপয়া বন্ধ্যার ছায়া পড়ুক আমার একমাত্র ছেলের উপর, দয়া করে আমার ছেলের ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেওনা।”

নির্বাক দর্শকের মতো শুধু শুনছিলাম কথাগুলো। ওর এমন কথার প্রতিত্তোরে কি বলবো তা আমার জানা নেই। কিভাবে পারলো মাহি আমাকে এমন কথা বলতে। তবে কি এই নয় বছর ওরা আমার সাথে আমাকে ভালোবাসার অভিনয় করে এসেছে? ছিঃ নিজের বন্ধ্যা প্রাণটাকে আজ প্রথম বড্ড ঘৃণা লাগছে নিজের কাছে।

*
একটু পর সব কাজ শেষ করে গোসল করতে যাবো এমন সময় পাশের পুকুর পাড় থেকে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসলো কর্ণকুহরে। কাপড়চোপড় গুলো সোফায় রেখে এক দৌড়ে চলে গেলাম পুকুর পাড়ে। পুকুর পাড়ে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। মুহুর্তেই যেনো থমকে গেলাম আমি। সবসময়ই এমনটা কেনো হয় যা আমরা মেনে নিতে পারিনা।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here