#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে,০৮,০৯
#ফারজানা_আক্তার
০৮
চারপাশ জোড়ে হৈচৈ পরে গিয়েছে। গাছের পাতাগুলোও যেনো নেতিয়ে পরেছে। রোদের উত্তাপ প্রখর। পুরো পুকুর পাড় মানুষের ভিড়ে ভরপুর। এক এক করে সব মানুষকে ঠেলেঠুলে ভেতরে গিয়ে দেখলাম মাহি চিৎকার করে করে কান্না করছে। মাহির শরীর ভিজে চুপেচুপে হয়ে আছে। আমার শ্বাশুড়ি মাহিকে সামলাতে ব্যাস্ত। মাহির পাশেই চুপটি করে বসে আছে নিয়ান। মাহির স্বামী রওশানের মাথা ফেটে র’ক্তে মাখামাখি অবস্থা। আজব মাথা ফেটে গেছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে না গিয়ে এখানে হৈচৈ করে কান্নাকাটি করলে কি ভালো হয়ে যাবে নাকি। রওশান ভাই ব্যাথায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠছে। গ্রামের কয়েকজন চিৎকার করে করে বলেই যাচ্ছে রওশান ভাইকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মাহি আর আমার শ্বাশুড়ির কানে যাচ্ছেইনা সে কথা। তারপর গ্রামের এক ছোট ভাইকে ডেকে বললাম একটা সিএনজি এনে দেওয়ার জন্য। আমি হ’ন্ত’দ’ন্ত হয়ে মাহির কাছে গিয়ে বললাম এখন এমন বিলাপ ধরে কান্নাকাটি করার সময় নেই দ্রুত উনাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমার শ্বাশুড়িও বললেন একই কথা। তারপর সিএনজি আসলে সবাই ধরাধরি করে রওশান ভাইকে সিএনজিতে তুলে দিলাম। আমার শ্বাশুড়ি দৌড়ে ঘরে গিয়ে টাকা নিয়ে এসে উনিও গেলেন মাহির সাথে। আমার শ্বশুড়ও যেতে চেয়েছেন কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি নিয়ে যায়নি। আমার শ্বাশুড়ি আমার সাথে যতই কঠিন আচরণ করুক না কেনো কিন্তু আমার শ্বশুড়কে একটু বেশিই ভালোবাসেন। তাই তিনি চাননা হাসপাতালের বাজে পরিবেশে উনি যান। আমি মাহিকে বলেছি আমি আর মা নিয়ে যায় রওশান ভাইকে তুমি বরং এই ভেজা কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে এসো কিন্তু মাহি কিছুতেই শুনলোনা আমার কথা। সে যাবেই এই ভেজা কাপড়ে। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সিএনজি ড্রাইভার কে বললাম সাবধানে দ্রুত পৌঁছে দিতে। ওরা চলে গেলে নিয়ানকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। নয়নাকে বললাম ওর সাথে একটু বসতে। তারপর আমি গোসল করতে গেলাম।
আমার শ্বশুড়ের কাছ থেকে শুনলাম মাহি নাকি গোসল করতে নেমেছিলো পুকুরে আর আমার শ্বাশুড়ি পুকুরপাড়ে বসে ছিলো নিয়ানকে কোলে নিয়ে। রওশান ভাই উঠেছিলো নারকেল গাছে। আর হঠাৎ ঘটে গেলো এই বি’প’দ। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হওয়া এই ঘটনা মাহি মানতে পারছেনা। বেচারি কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল। এই অবস্থাতেও মাহি আমার শ্বশুড় কে বলে গেলো নিয়ানকে যেনো আমার কাছে না দেয় তাই নয়নাকে ওর কাছে বসালাম যাতে সবাই বুঝে নয়না ওকে সামলিয়েছে। নয়নাকেও শিখিয়ে দিলাম আমার জন্য ছোট্ট একটা মিথ্যা বলতে।
*
সন্ধ্যায় রওশান ভাইকে নিয়ে আসা হলো। তেমন কোনো ক্ষ’তি হয়নি। শুধু মাথায় আ’ঘা’ত লেগেছে আর হাতের কনুই তে অল্প একটু ছিলে গেছে। আয়ানও অফিস থেকে আসে সন্ধ্যা ৬টা বাজে। ও এসে শুনেছে সব। কিন্তু তেমন কোনো রিয়েক্ট করেনি। মানুষটা কেমন জানি নিরব হয়ে গেছে একদম। মাহি এখন আর আমার সাথে তেমন খারাপ আচরণ করছেনা। কেমন জানি চুপসে গেছে মেয়েটা। রওশান বরাবরই সম্মান করতো আমায় আর আজ হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে অনেকে ধন্যবাদ দিলো ওদেরকে সাহায্য করার জন্য। রওশান ভাই সবার সামনেই বলেছে আমি না থাকলে উনাকে এতো দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হতোনা হয়তো কারণ সবাই তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলো। রওশান ভাই ওই অবস্থাতেও লক্ষ করেছে আমি যে ছুটাছুটি করেছি সেটা। আমার শ্বাশুড়ি মেয়ে জামাইর সামনে আমাকে কিছু বললেন না আর।
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখনই কারো কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহর হতেই হৃদপিন্ড যেনো বেড়ে যায় হুট করে।
“ধন্যবাদ আমার পরিবারের সাথে থাকার জন্য সাহায্য করার জন্য।”
আয়ান আমার রুমে প্রবেশ করে এই কথাটি উচ্চারণ করতে করতে। বড্ড বেশি কষ্ট হলো আয়ানের এহেন কথায়। কান্নারা এসে গলায় আঁটকে গেলো। কি অদ্ভুত একটা মুহূর্ত। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে আয়ানের চোখে দৃষ্টি রেখে বললাম “এটা কি আমার পরিবার নয় আয়ান? সত্যি কি শুধুই আশ্রিতা আমি?”
কথাগুলো বলতেই গলা ধরে আসছে। আয়ান হালকা কন্ঠে বললো “হুম যেটা ভাবছো সেটাই।”
আর কিছু বললাম না আমি। কিভাবে পারলো আয়ান আমার সাথে এমন আচরণ করতে? এই আয়ানকে তো চিনিনা আমি। নয়টা বছর কি মুহুর্তেই ভুলে যাওয়া যায়? আমার নিরবতা দেখে আয়ান চলে গেলো তবে যাওয়ার আগে বলে গেলো রাতের ঔষুধ যেনো খেয়ে নেয়। কিন্তু আজ খেলাম না আমি ঔষুধ। রাগ হচ্ছে খুব সাথে কষ্ট তো আছেই। খুব বেশিই কান্না পাচ্ছে আজ। আমাদের যখন নতুন বিয়ে হয়েছিলো তখন খুব লাজুক ছিলাম আমি। আয়ান একটু আদর করলেই লজ্জাবতী গাছের মতো মুখে লুকাইতাম আয়ানের বুকে। প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে কেমন জানি খুব একটা ভালো লাগা কাজ করতো নিজের মাঝে। আর সেই স্পর্শ যদি ভালোবাসার হয় তবে তো একটা মেয়ে সারাজীবন সেই স্পর্শের দাসী হয়ে থাকতেও রাজি। কিন্তু আমার কপালে তো সইলোনা এতো সুখ। বড় অভাগী আমি। পেয়েও হারিয়ে ফেললাম ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে টাকার যেমন মূল্য তেমন ভালোবাসারও। টাকা উপার্জন করতে যেমন শারীরিক পরিশ্রম করা লাগে তেমন কারো ভালোবাসা পেতে মানসিক পরিশ্রম করা লাগে। ভালোবাসার মানুষকে খুশি করতে অনেক কিছুই করা লাগে, ভালোবাসার মানুষের মনে নিজের জন্য জায়গা জুড়াতেও লাগে অনেক পরিশ্রম। কিন্তু আমার কিছুই করা লাগেনি। না চাইতেও আয়ান আমায় অবিশ্বাস্য ভালোবেসেছে কিন্তু সেই আয়ানকে চিনতে আজ বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার। নিয়তি ভীষণ নিষ্ঠুর। আমার শ্বশুড়ের কথা খুব মনে পরছে। মানুষটা সেদিন আমায় আরেকটা কথা বলেছিলো “পৃথিবীতে বাঁচার মতো বাঁচতে হলে ল’ড়া’ই করে বাঁচতে হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়।”
ভুল কিছু বলেননি উনি। আমার চুপ থাকাটাকে সবাই আমার দূর্বলতা ভেবে নিচ্ছে অথচ তারা কেউই বুঝতেছেনা যে আমি তাদের ভালোবাসি বলেই এ-সব অন্যায় চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছি।
*
এভাবে টক ঝাল মিষ্টিতে কাটতে লাগলো আমাদের সবার দিনগুলো। রওশান ভাই এখন সুস্থ কিছুটা। আয়ান মাঝে মাঝেই আসে আমার রুমে নিজ থেকে আর ছোটখাটো ঝগড়া করে চলে যায়। আমি বুঝতে পারি মানুষটা আমার সাথে থা না বলে আমাকে প্রান ভরে না দেখে থাকতে পারেনা তাই ঝগড়ার অজুহাতে আসে আমার কাছে। নয়তো কোনো কারণ ছাড়া কি কেউ কখনো ঝগড়া করে? হুম আমার আয়ান কারণ ছাড়াই ঝগড়া করে।
নয়না মেয়েটা কেমন জানি মনমরা হয়ে থাকে ইদানীং। হাঁসেনা আগের মতো তেমন একটা, কথাও বলে খুব কম কিন্তু আমার সাথে এখনো সেই আগের মতো স্বাভাবিক। এক মাস হয়ে গেছে নয়নার এই বাড়িতে আসার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বিয়ের পর থেকে এখনো সে একবারও বাপের বাড়ি যায়নি, কেউ দেখতেও আসেনা ওকে নিতে আসবে তো পরের কথা। হয়তো বাপের বাড়ির জন্য মন খারাপ মেয়েটার। ফোনে কথা বলে দেখি মাঝে মাঝে ভাইয়ের ছেলের সাথে, আর কারো সাথেই বলতে দেখিনা। আমিও কখনো নিজ থেকে কিছু জানতে চাইনি ওর কাছে।
*********
আজ রাতে সবাই খেতে বসেছে। আমি আর নয়না সবাইকে খাবার বেরে দিচ্ছি। এর মাঝেই আমার শ্বাশুড়ির কড়া আদেশ নয়না যেনো খেতে বসে। নয়না কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে বসে যায়। আমি একটু মুচকি হাসলাম যদিও ভেতরটা কষ্টে জ’র্জ’রি’ত হচ্ছে। সবাই খাওয়ায় মন দিয়েছে, আমিও সবাইকে খাবার বেরে দিয়ে আয়ানের পাশে একটা চেয়ার খালি আছে সেটাতে বসে খাবার প্লেটে নিতে লাগলাম। আয়ান বড় বড় দৃষ্টিতে দেখছে আমায় কারণ প্রায়ই একবছর ধরে আমি সবার সাথে বসে খাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। তবুও আয়ান কিছু না বলে আবারও খাওয়ায় মন দিলো। হঠাৎ হুং’কা’র দিয়ে উঠলেন আমার শ্বাশুড়ি “এই মেয়ে তোর এতো বড় সাহস হয় কি করে তুই আমার ছেলের পাশে বসিস। উঠ বলছি উঠ। আমি তোমাকে আমাদের সাথে বসে খাওয়ার অনুমতি দেয়নি মেয়ে।”
আমার শ্বাশুড়ি এসব কথা চোখমুখ লাল করে বলছে। আমিও কিছু না শোনার ভান করে ভাত মেখে এক লুকমা মুখে দিলাম। একপ্রকার এড়িয়ে গেলাম আমার শ্বাশুড়ির কথাটা। মুখে কিন্তু মুচকি হাসির আভাস রেখেছি। সবার চোখ যেনো রসগোল্লা। হা করে দেখছে সবাই আমার এই অদ্ভুত কান্ড। আমি আমার শ্বাশুড়ির কথায় পাত্তা না দেওয়ায় এবার মাহি বলে উঠে “কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতোই থাকবে। এবার তো আমার মনে হচ্ছে তোমাকে এই বাসায় আশ্রিতা হিসেবে রেখেও ভুল করেছি আমরা। থাকতে দিয়েছি বলে এখন মাথায় উঠে নাচতেছো। লজ্জা করেনা তোমার এভাবে আমার আম্মুর অনুমতি ছাড়া আমাদের বাসার দানা গিলে যাচ্ছো।”
মাহির কথাগুলো সোজা গিয়ে হৃদপিন্ডে লাগলো। এবার আর চুপ থাকতে পারলাম নাহ। অনেক হয়েছে অনেক সহ্য করেছি। ধৈর্যের একটা সীমা আছে পারছিনা আর। মাহি উঁচু গলায় বললেও কথাগুলো আমি শান্তভাবে জবাব দিলাম “কাকে কাজের মেয়ে বলছো মাহি তুমি? আমাকে? বাড়ির বউ কাজ করবে স্বাভাবিক, এতে আবার কাজের লোকের প্রশ্ন আসবে কেনো? হ্যাঁ যদি মাস শেষে বেতন দিতে তবে মানতাম আমি কাজের মেয়ে কিন্তু আমাকে তো কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয়না। ভুলে যেওনা তোমার ভাইয়ের স্ত্রী আমি। আর আশ্রিতার কথা আসলে আমি বলবো এই ঘরে যদি কেউ আশ্রিতা থাকে তাহলে সে তুমি। বিয়ের পর এভাবে বাপের বাড়ি পরে থাকাকেই আশ্রিতা বলে বাড়ির বউকে নয়। বিয়ের পর বাপের বাড়ি নয় স্বামীর বাড়িই আসল ঠিকানা। আমি এই বাড়ির বউ কোনো আশ্রিতা নয়। আর যেখানে তোমার মায়ের অনুমতি ছাড়া খাবার খাওয়ার প্রশ্ন তুলেছো সেখানে তোমার এমন প্রশ্ন করার অধিকার নেই আমাকে কারণ আমি আমার স্বামীর টাকায় আনা আমার নিজের হাতের রান্না করা খাবারই খেয়েছি। আর এই পৃথিবীতে সব নারীর-ই অধিকার আছে তার স্বামীর উপর। সেখানে শ্বাশুড়ির অযুক্তিক কথার কোনো মূল্য নেই। আশা করি বুঝতে পেরেছো নয়তো বলো এর চেয়েও ভালো করে বুঝাতে পারি আমি।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ
#ফুল_ফুটেনি_এই_বসন্তে [০৯]
#ফারজানা_আক্তার
সর্বত্রে পিনপতন নিরবতা। মৌ মৌ বাতাস সাথে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। অদ্ভুত রকমের কষ্টের মাঝে একটু স্বস্তি। অন্তরীক্ষে অর্ধ আকারের হলদেটে চাঁদ। চিলেকোঠার নীল বাত্বি। খোলা জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া। অম্বরজুড়ে হাতে গুনা কয়েকটা তাঁরা। আজ তাঁরা রাও মুখ লুকিয়েছে সুপ্ত মেঘের আড়ালে। চিলেকোঠার ছোট একজনার চিকন খাটে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছি আমি। বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। নিজেকে যেনো নিজেই চিনতে পারছিনা। আমি এভাবে কথা বলে মাহিকে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু সহ্যও তো করতে পারছিলাম না ওদের তি’ক্ত’তা মেশানো কথাগুলো। তখন সবার সামনে এতো সাহস দেখিয়ে এখন কষ্ট হচ্ছে ভীষণ, যে মানুষটাকে মায়ের আসনে বসিয়েছি সেই মানুষটাকেই আজ এতো অপমান করলাম। কিভাবে এতোটা হিং’স্র হতে পারলাম আমি? আজ সবাই কষ্ট পেয়েছে আমার জন্য। আমি ছাড়া রাতের খাবারটাও কেউ খায়নি, আমিও সম্পূর্ণ খায়নি খাবার, সবাই চলে গেলে উঠে গিয়েছিলাম। আমার এখনো শরীর কাঁপছে। ছোটবেলা থেকে এভাবে কারো সাথেই কথা বলিনি আমি। আমি খুব শান্ত প্রকৃতির রমণী ছিলাম কিন্তু হঠাৎ ভা’ঘি’নি হবো এভাবে কখনোই কল্পনায় ছিলোনা। আমার কথা শুনে সবাই হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো শুধু। কারো মুখে কোনো কথা ছিলোনা। আয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো একবার কিন্তু আমি পাত্তা দেয়নি। আমার শ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মানুষটা আমার এমন প্রতিবাদে বড্ড বেশি খুশি হয়েছে। আর নয়নার কথা কি বলবো, বেচারি ভয়ে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ তারপর দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছে ঢকঢক করে। রওশান ভাই আমার কথাটি শোনেও যেনো শুনলোনা এমন ভাব ধরেছে কারণ উনার সাথে দূর্ঘটনা টা ঘটার পর থেকে উনি আমাকে আবারও আগের মতো সম্মাণ করেন, এক কথায় বলতে গেলে আমার প্রতি উনার কৃতজ্ঞা প্রকাশ করছেন সর্বদায় আর মাহিকেও বুঝাই প্রচুর কিন্তু মাহি বুঝতে রাজি নয় এবং এটা নিয়ে ওদের মধ্যেও কথা কাটাকাটি হয় ইদানীং। আজ মনে হচ্ছে আমার প্রতিবাদ দেখে রওশান ভাইও বেশ খুশি হয়েছেন। আমার শ্বাশুড়ি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে কারণ বিয়ের নয় বছরেও আমার এমন রুপ দেখেনি কেউ। কথাগুলো আমি খুব শান্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেও একদম তীরের মতো নিশানা করেছে। মাহি অশ্রু সিক্ত কন্ঠে আমার শ্বাশুড়িকে বলেছিলো “মা দেখেছো এই অপয়া বন্ধ্যা মেয়েটা আমায় কি বলছে আমি নাকি আমারই বাড়ির আশ্রিতা। এটা শোনে আমার মোটেও খারাপ লাগেনি আর কষ্টও লাগেনি কারণ অভ্যাস হয়ে গেছে এসব শুনতে শুনতে। মাহির কথায় আমার শ্বাশুড়ি বলেছিলো ” এই মেয়ে তুই এখন এই মুহুর্তে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাহ। আমার সংসারে তোর কোনো জায়গা নেই।”
আমার শ্বাশুড়ির কথা শুনে কুটকুট করে শব্দ করে হেঁসে দিয়েছিলাম। আয়ান অবাক কন্ঠে আমায় বলেছিলো “পাগলটাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?” আমি আয়ানকে বলেছিলাম একটু অপেক্ষা করো,এসবের মাঝে তুমি আসিওনা। তোমার সাথে পরে বলবো কথা। তারপর মুচকি হেঁসে আরেক লুকমা ভাত মুখে দিলাম। আমার শ্বাশুড়ি আবারও হুং’কা’র দিয়ে উঠলে সাথে সাথে আমিও চেঁচিয়ে উঠি আর বলি “আপনি আর একটা কথাও বলবেননা। এই সংসার আপনার একার নয়। এই সংসার আমারও। ভুলে যাবেননা আপনার ছেলে এখনো আমায় ডিভোর্স দেয়নি। আর দ্বিতীয় বিয়ে করলেই প্রথম স্ত্রীর অধিকার মুছে যায়না। আমি চাইলে এখনই থানায় মা’ম’লা করতে পারি আপনাদের নামে কিন্তু আপনাদের ভালোবাসি বলে তা করলম না। আপনাকে মায়ের মতো সম্মাণ করি বলে আপনি আমাকে দূর্বল ভেবেছেন তাইনা? নারী দূর্বল হতে পারে কিন্তু স্বামীর ক্ষেত্রে কোনো নারীই দূর্বল নয়। আমি চাইলে এখনই আইনের সাহায্য নিতে পারি কারণ আপনারা এই বিয়ের আগে আমার থেকে একবারও অনুমতি নেননি। হ্যাঁ আয়ান অনুমতি নিয়েছিলো কিন্তু ওর কথায় কোনো ভালোবাসা ছিলোনা সেদিন ছিলো শুধু তিক্ততা আর আমি যদি অস্বীকার করি যে আয়ান আমার অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তবে আপনাদের পুরো পরিবার জেলে পুঁচবে। ভালো লাগবে তখন আপনার?”
এক নিঃশ্বাসের কথাগুলো বলে আমি আমার মতো ভাত খাওয়ায় ব্যাস্ততা দেখালাম যদিও ভাতগুলো গিলতে কষ্ট হয়েছে খুব তবুও কারো সামনে দূর্বলতা না দেখানোর চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখিনি আমি। আমার কথায় উপস্থিত সবাই এতোটাই অবাক হয়েছিলো যে কারো মুখ থেকে কোনো কথা-ই বের হয়নি। মাহি নিয়ানকে খুলে নিয়ে কান্নাজড়িতো মুখশ্রী নিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটে গিয়েছিলো। আর তারপর এক এক করে সবাই নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো। আমার সাথে ছিলো শুধু নয়না। নয়না মেয়েটা এখনো হা করে বসে আছে। সবাই যে চলে গেছে তাতে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি ওকে হালকা ধা’ক্কা দিতেই ও হুঁশে ফিরে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো “আপু আজ আমি অনেক অনেক খুশি তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছো বলে।”
ওর কথা শুনে আমি একটুও খুশি হয়নি এবং মুখটা আরো গম্ভীর করে ফেলেছিলাম। তারপর সব গোছগাছ করলাম ডাইনিং টেবিল পরিষ্কার করলাম দু’জনে মিলে। আমার কোনো কথা না শুনে আর আমার গম্ভীর মুখ দেখে নয়না জিজ্ঞেস করেছিলো বারংবার তখন রাগে ওকে বলেছিলাম “বিয়ের একমাস পূরণ হয়ে গেছে আরো কয়েকদিন আগে তোর। এবার নিজেকে নিয়ে চিন্তা কর, বাচ্চা দিতে না পারলে তোর অবস্থাও আমার মতোই হবে।”
জানিনা কথাটা শুনে নয়নার কি হয়েছিলো কিন্তু ও সাথে সাথেই এক ছুটে আয়ানের রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। যাওয়ার আগে ওর চোখে হতাশা আর বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিলো। মেয়েটার মাঝে কিছু একটা রহস্য আছে যা আমি খুব কাছ থেকে দেখেও বুঝতে পারছিনা।
*
সকালে ঘুম ভা’ঙ’তে’ই আজানের সুর ভেসে আসে কর্ণধারে। গা আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসলাম। রাতে তেমন একটা ঘুম হয়নি। সবাইকে এতো কষ্ট দিয়ে শান্তিতে আর ঘুমাই কেমনে। আমার আয়ানটাও যে খুব কষ্ট পেয়েছে ওর মা বোনের সাথে এমন কথা বলায়। সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো আমার বলা প্রতিটি শব্দে। আজান দেওয়া শেষ হলে চিলেকোঠায় তালা দিয়ে নিচে নামতে যাবো ঠিক তখনই ছাঁদের পূর্বপাশে পুরুষালী অবয়ব দেখতে পেলাম। একটু কাছে যেতেই দেখি আয়ান। হাতে নিকোটিন। আমি ধীর পায়ে ওর পেঁছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে ওর ওষ্ঠ মাঝ থেকে সিগারেট টা ছুঁ মে’রে নিয়ে নিলাম। আচমকা আয়ান ভরকে গিয়ে পেঁছনে ফিরতেই আমার সাথে ধা’ক্কা লেগে যায় আর আমি তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পরে গেলাম আমার উপরে পরলো আয়ান। বেশখানিক ব্যাথা পেলাম। এতো ওজন শরীর নিয়ে কেউ উপর থেকে পরলে ব্যাথা পাবো তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাথা টা প্রকাশ করলাম না। একমাস পর স্বামীকে এতোটা কাছে পেলে কোনো নারীই অন্যকিছু ভাবতে পারবেনা স্বামীর ছোঁয়ার অনুভূতি ছাড়া। আয়ান খুব রেগে গিয়ে বলে “তুমি এই ভোর রাতে এখানে কি করছো?”
আয়ানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম “একই প্রশ্ন যদি আমিও করি?”
আমার এমন বাঁকা কথায় আয়ান বেশ বিরক্ত হলো আর আমার উপর থেকে সরে গিয়ে উঠতে উঠতে বলে “খুব কথা শিখে গেছো। কোনো কথারই সোজা উত্তর পাওয়া যায়না তোমার কাছে আর এখন।”
আমি মৃদু হাসলাম, আয়ানের দিকে তাকালাম অপলক ভাবে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে মিটিমিটি আলোর মাঝে আয়ানের মুখটা আমার কাছে মনে হলো হাতে পাওয়া আকাশের চাঁদ।
আয়ান আমাকে এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে আমার দিকে “কানে যায়না কথা? এই ভোর রাতে ছাঁদে কেনো আসছো?”
একটু উঁচু গলায় বললো আয়ান কথাটা। আমি সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছি ওর এমন কথায়। তারপর একদম ধীর কন্ঠে বললাম “আসলে রাতে সবার সাথে এমন আচরণ করার পর নিজের উপর খুব রাগ হলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই সারা রাত চিলেকোঠায় কাটিয়েছি। এখন আজান দিয়েছে তাই নিচে যাওয়ার জন্য বের হতেই দেখি তুমি এখানে। আচ্ছা তুমি কেনো এই অসময়ে এখানে? রোজ আসা হয় নাকি শুধু আজ?”
কিছু একটা ভাবলো আয়ান তারপর এক কদম আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে “তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নয়।”
কথাটি বলেই হনহন করে নিচে যেতে লাগলো আয়ান। আমিও পেঁছন পেঁছন পা বাড়ালাম ওর। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখি নয়না দাঁড়িয়ে আছে আর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ